উম্মাহর প্রতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অধিকার : একটি বিশ্লেষণ
- ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ভূমিকা
মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহ তা‘আলার সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তিনি সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরিত হয়েছেন। দ্বীন হিসাবে ইসলামকে তাঁর ও তাঁর উম্মাহর জন্য পরিপূর্ণ করেছেন। তিনি এমন এক সময়ে প্রেরিত হয়েছিলেন, যখন রাসূলগণের আগমন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কুফরের বাহুল্যতা প্রকাশ পেয়েছিল এবং সত্য ও ন্যায়ের পথগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তাঁকে প্রেরণের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা হারিয়ে যাওয়া ঈমানের নিদর্শনগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন এবং তাঁর মাধ্যমে মুশরিক ও কাফির গোষ্টীকে দমন করেছিলেন, যারা তিনি মূর্তি, আগুন এবং ক্রুশের পূজা করত। রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা আহলে কিতাবদের মধ্যকার কাফের, মুশরিক ও সন্দেহবাদীদেরকে অপমান ও লাঞ্ছিত করেছিলেন। এতদ্ব্যতীত তাঁর মাধ্যমে তিনি যাদের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন ও দ্বীন প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে নির্বাচন করেছিলেন তাঁদের জন্য দ্বীনের আলোকবর্তিকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
বিশ্ব মানবতার জন্য এটা একটি বিরাট রহমত ও অনুগ্রহ যে, আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে মানুষের কাছে পাঠিয়েছেন। কারণ তার মাধ্যমে যারা হেদায়াত পেয়েছে তাদের জন্য চিরস্থায়ী আযাব থেকে মুক্তির ব্যবস্থা রয়েছে। সুতরাং, মানুষের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা এবং তাঁর প্রেরিত দ্বীন গ্রহণ করা তাদের খাদ্য, পানীয়, এমনকি তারা যে বাতাস থেকে শ্বাস নেয় তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন। আর যদি তারা তা নষ্ট করে ফেলে, তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে এবং তাঁর আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তাদের জন্য জাহান্নামই হবে একমাত্র প্রতিশোধ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَاَنۡذَرۡتُکُمۡ نَارًا تَلَظّٰی - لَا یَصۡلٰىہَاۤ اِلَّا الۡاَشۡقَی - الَّذِیۡ کَذَّبَ وَ تَوَلّٰی
‘অতঃপর আমি তোমাদেরকে লেলিহান আগুন সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছি। নিতান্ত হতভাগ্য ব্যতীত কেউ তাতে প্রবেশ করবে না, যে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়’ (সূরা আল-লাইল: ১৪-১৬)। অর্থাৎ সে তা অস্বীকার করল এবং তার আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। সুতরাং তাদের রাসূল (ﷺ)-এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে, তাঁর আনুগত্য করতে হবে, তিনি যা এনেছেন তা গ্রহণ করতে হবে এবং দিনে ও রাতে, ভ্রমণে এবং বাড়িতে, গোপনে এবং প্রকাশ্যে, সর্বত্র তা মেনে চলতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলার নিকট নবী (ﷺ)-এর মর্যাদা সকলের শীর্ষে। এই কারণে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম উম্মাহর প্রতি তাঁর নবী (ﷺ)-এর উপর কতিপয় অধিকার ও কর্তব্য পালন করা বাধ্যতামূলক করেছেন, যা সুনির্দিষ্ট ও সকল প্রকার অস্পষ্টতা বা সন্দেহ-সংশয়মুক্ত। এই অধিকারগুলোর মধ্যে রয়েছে সেইসব অধিকার, যা তাঁর রিসালাতের সাথে সম্পর্কিত। আবার এমন সব অধিকার, যা ব্যক্তি হিসাবে রাসূল (ﷺ)-এর সাথে সম্পর্কিত, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি অনুগ্রহ ও সম্মান হিসাবে নির্ধারিত। এই অধিকার সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার কিতাব তথা আল-কুরআনে এবং তাঁর নবী (ﷺ)-এর সুন্নাতে অনেক বর্ণনা রয়েছে, যা এই অধিকারগুলোর দিকগুলোর স্পষ্ট, বিস্তারিত এবং ব্যাখ্যা করে। এই অধিকারগুলো দ্বীন ইসলামের দু’টি মৌলিক নীতির মধ্যে দ্বিতীয়। যেমন বলে থাকি যে, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল’। অতএব, যারা এই সাক্ষ্য প্রদান করে এবং এই দ্বীনে বিশ্বাস করে তাদের প্রত্যেকের জন্য এই অধিকারগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং বিশ্বাস, কথা ও কাজে তা মেনে চলা বাধ্যতামূলক। কেননা এটা ঈমানের একটি চুক্তি, যা ছাড়া বান্দার ঈমান অর্জন করা সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমানে অধিকাংশ মুসলিম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি অধিকার সম্পর্কে খুবই অজ্ঞ এবং তারা এর পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত।
- মুসলিম উম্মাহ আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক ফরযকৃত অধিকারগুলো পূরণে ব্যাপকভাবে অবহেলা করে থাকে এবং এ ব্যাপারগুলোকে কোন গুরুত্বও প্রদান করে না।
- অথবা সে একজন চরমপন্থী বিদ‘আতী। যে তার বিদ‘আতী কাজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। তিনি মনে করেন যে, তিনি যে বিদ‘আতী কাজগুলো করেন, তা ভালোই। এর মাধ্যমে তিনি আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর আল্লাহ তা‘আলার অর্পিত অধিকার পূরণ করে থাকেন। অথচ তা নিন্দনীয় এবং অপ্রশংসনীয়।
প্রকৃতপক্ষে উক্ত দুই দলের অধিকাংশ মানুষই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অধিকারগুলো সম্পর্কে শারঈ জ্ঞানের অজ্ঞতার কারণেই বিভিন্ন বিদ‘আতী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ে। উম্মাহর প্রতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অধিকারগুলো দ্বীনের অংশ, আল্লাহ তা‘আলা যার মাধ্যমে আমাদের তাঁর ইবাদত করার আদেশ দিয়েছেন। তাই উক্ত ইবাদত গ্রহণযোগ্যতার জন্য নিম্নের দু’টি শর্ত পূরণ করতে হবে। যথা: (১) ইখলাছ বা একনিষ্ঠতা এবং (২) ইত্তিবা‘ বা আনুগত্য। যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَمَنۡ کَانَ یَرۡجُوۡا لِقَآءَ رَبِّہٖ فَلۡیَعۡمَلۡ عَمَلًا صَالِحًا وَّ لَا یُشۡرِکۡ بِعِبَادَۃِ رَبِّہٖۤ اَحَدًا ‘সুতরাং যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে সে যেন সৎকর্ম করে ও তার একক প্রভুর ইবাদতে কাউকেও শরীক না করে’ (সূরা আল-কাহ্ফ: ১১০)।
এক্ষণে আলোচ্য প্রবন্ধে উম্মাহর প্রতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অধিকারগুলোকে ইসলামী শরী‘আতের আলোকে এবং সালাফে ছালিহীনের আক্বীদা ও মানহাজের আলোকে আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ। যাতে করে এই বক্তব্য ও স্পষ্টী লেখনী অজ্ঞদের জন্য শিক্ষা, গাফিলদের জন্য স্মারক, উদ্ভাবকদের জন্য সতর্কীকরণ ও প্রতিরোধমূলক এবং জ্ঞানীদের জন্য অধ্যয়নের বিষয় হয়ে ওঠে। আমি আল্লাহ তা‘আলা কাছে এ কাজে সফলতার জন্য দু‘আ করছি। সুতরাং আমাদেরকে তাঁর নবী (ﷺ)-এর সুন্নাহ মেনে চলার, তাঁর নির্দেশনা অনুসরণ ও অনুকরণ করার ক্ষেত্রে আমাদের বক্ষ প্রশস্ত করার ও হৃদয়কে আলোকিত করার তাওফীক্ব কামনা করছি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অধিকারগুলোর বিস্তারিত বিবরণের ক্ষেত্রে কোন প্রকার সংকীর্ণতা, দলীয় গোঁড়ামি ও হীনমন্মতা আমাকে পেয়ে না বসে, বরং সম্পূর্ণ কুরআন, সুন্নাহ ও সালাফদের বুঝ অনুযায়ী সঠিক বিষয়টি উপস্থাপন করতে পারি তার জন্যও আল্লাহ তা‘আলার নিকট হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশ থেকে দু‘আ করছি। আল্লাহ তা‘আলা এই কঠিন ও বন্ধুর কাজকে সহজভাবে সম্পন্ন করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!
অধিকার (حق) -এর পরিচিতি
অধিকারকে আরবীতে হক্ব (حق) বলা হয়। এটি একবচন, বহুবচনে حقوق। আরবী হক্ব শব্দের অর্থ اَلصَّوَابُ، ضِدُّ الْبَاطِلِ ‘সঠিক, বাতিলের বিপরীত’। ইংরেজী প্রতিশব্দ Right, title, claim।[১]
হক্বের আরেকটি অর্থ হল- مصدر حق الشئ يحق إذا ثبت وجب ‘হক্ব শব্দটি মাছদার। কোন বস্তুর হক্ব বলতে সে বস্তু আবশ্যক ও প্রমাণিত হওয়া বোঝায়’।[২] এ অর্থেও কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قَالَ الَّذِیۡنَ حَقَّ عَلَیۡہِمُ الۡقَوۡلُ ‘যাদের জন্য শাস্তি অবধারিত হয়েছে তারা বলবে...’ (সূরা আল-ক্বাছাছ, ২৮/৬৩)। এ আয়াতে حَقَّ শব্দটি ثَبَتَ তথা ‘আবশ্যক বা অবধারিত’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।[৩] এছাড়া অভিধানবেত্তাদের মতামত নিম্নরূপ:
- আবূ যায়েদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, حق الله الأمر حقاً: أثبته وأوجبه ‘আল্লাহর অধিকার বিষয়ে হক্ব শব্দের অর্থ প্রতিষ্ঠিত করা ও অপরিহার্য করা’। আর নিজের সম্পর্কে হক্ব সম্পর্কে ব্যবহৃত হলে অর্থ হবে ন্যায়সংগত অধিকার।[৪]
- ‘লিসানুল ‘আরব’ গ্রন্থে ইবনু মানযূর (রাহিমাহুল্লাহ) حَقَّ শব্দের অনেকগুলো অর্থ বর্ণনা করেছেন। যেমন নিশ্চিতকরণ, বাধ্যবাধকতা, নির্ভুলতা, সঠিকতা, নিশ্চিততা এবং সততা।[৫]
- মাজদুদ্দীন ফীরূজাবাদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, أَصل الحَقّ المطابقةُ والموافقة ‘হক্ব (حق) শব্দটির মূল অর্থ মোতাবেক হওয়া, সামাঞ্জস্যশীল হওয়া’।[৬]
- আলী ইবনু মুহাম্মাদ আল-জুরজানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, الحق: في اللغة هو الثابت الذي لا يسوغ إنكاره ‘হক্ব শব্দের আভিধানিক অর্থ হল এমন বিষয়, যা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই’।[৭]
- ড. সা‘দী আবূ হাবীব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, الحق: واحد الحقوق يشمل ما كان لله، وما هو لعباده. اسم من أسماء الله تعالى، أو من صفاته. مقابل الباطل. ‘এটি আল-হুকূক (الحقوق)-এর একবচন। এটি আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর সকল বান্দার অধিকারের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। অথবা এটি আল্লাহ তা‘আলার নামসমূহের অন্যতম। অথবা বাতিলের বিপরীতে প্রয়োগ করা হয়। অতঃপর তিনি আরো কিছু অর্থ বর্ণনা করেছেন। যেমন, সন্দেহহীন অপরিহার্য (الثابت بلا شك) , মীমাংসিত বিষয় (الامر المقضي), দৃঢ়তা (الحزم), প্রয়োজনীয় কর্তব্য (الواجب اللازم), সততা (الصدق), ন্যায়পরায়ণতা (العدل), আল-কুরআনুল কারীম (القرآن الكريم), আল-ইসলাম (الاسلام), অংশ (النصيب)।[৮]
অধিকার বা হক্ব-এর পারিভাষিক সংজ্ঞায় হল- مَا ثَبَتَ بِهِ الْحُكْمِ ‘আইনের মাধ্যমে যা সাব্যস্ত হয়’।
- ‘মু‘জামু লুগাতিল ফুক্বাহা’ গ্রন্থকার বলেন, اَلثَّابِتُ الَّذِيْ لَا يَجُوْزُ إِنكَارَهُ، وَمِنْهُ قَوْلَهُمْ: اَلْقُرْآنُ حَقٌّ ‘প্রতিষ্ঠিত সত্য, যা অস্বীকার করা বৈধ নয়। এ অর্থে বিশেষজ্ঞগণের উক্তি ‘আল-কুরআন সত্য গ্রন্থ’।[৯]
- ‘মু‘জামুল মুছতালাহাত ওয়াল আলফাযিল ফিক্বহিয়্যাহ’ গ্রন্থ প্রণেতা ড. মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান আব্দুল মুনঈম (রাহিমাহুল্লাহ) অধিকারের সংজ্ঞায় বলেন, هُوَ مَوْضُوْعُ الْاِلْتِزَامِ : أَيْ مَا يَلْتَزِمُ بِهِ الْإِنْسَانِ تُجَاهَ اللهِ أَوْ تَجَاهَ غَيْرِهِ مِنَ النَّاسِ أَوْ هِيَ الْحُكْمُ الْمُطَابِقِ لِلْوَاقِعِ يُطْلَقُ عَلَي الْأَقْوَالِ وَالْعَقَائِدِ وَالْأَدْيَانِ وَالْمَذَهَبِ بِاِعْتِبَارِ اشْتِمَالِهَا عَلَي ذَلِكَ أَوْ مَا وَجَبَ عَلَيْكَ لِغَيْرِكَ فَهُوَ يَتَقَاضَاهُ مِنْكَ أَوْ مَا وَجَبَ عَلَي غَيْرِكَ لَكَ فَأَنْتَ تَتَفَاضَاهُ مِنْهُ. ‘ইসলামী শরী‘আতের পরিভাষায় হক্ব বা অধিকার এমন অত্যাবশ্যকীয় বিষয়, যা মানুষ আল্লাহর ক্ষেত্রে অথবা বান্দার ক্ষেত্রে আবশ্যক মনে করে। অথবা হক্ব এমন একটি হুকুম, যা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য হয়। সুতরাং হক্বের ব্যবহার কথা-বার্তা, আক্বীদা-বিশ্বাস, ধর্ম, মাযহাব সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অথবা হক্ব এমন পাওয়া যা তোমার উপর অপর কোন ব্যক্তির পাওনা এবং সে ব্যক্তি তোমার নিকট তা দাবী করে। অথবা তুমি কারো নিকট কিছু পাও এবং তুমি তাকে তা দেয়ার জন্য তাকীদ করছ’।[১০]
- অধিকার বা হক্বের সাথে ‘কর্তব্য’ শব্দটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কেননা একজনের যা হক্ব বা অধিকার, অন্যজনের জন্য তা কর্তব্য। একজনের যা পাওনা অন্যজনের জন্য তা দেনা। আর দেনা অর্থ হল যা দেয়া কর্তব্য। এভাবে মানুষ স্বত্ব তথা অধিকার ও দেনা অর্থাৎ কর্তব্যের বন্ধনে পারস্পরিকভাবে বন্দি। এ বন্ধন ছিন্ন করা হলে মানুষের জীবন চলতে পারে না। মূলত স্বত্ব নিয়ে আসে দায়িত্ব, আর অধিকার নিয়ে আসে কর্তব্য। এ দায়িত্ব ও কর্তব্যকে বাদ দিয়ে বা ভুলে গিয়ে মানব সত্তা সম্পর্কে কোন চিন্তা-ভাবনা, বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন হতে পারে না।[১১]
- বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী লিলি বলেন, অধিকারের সাথে দু’ভাবে কর্তব্যযুক্ত। প্রথমতঃ যদি কোন ব্যক্তির অধিকার থাকে তাহলে অপর ব্যক্তির সে অধিকারের দাবী মেটানো অব্যশ কর্তব্য। দ্বিতীয়তঃ ব্যক্তির কর্তব্য জনকল্যাণের জন্য নিজের অধিকারকে ব্যবহার করা।[১২]
- আবার কারো মতে, অধিকারের সাথে ‘কর্তব্য’ কথাটি সম্পৃক্ত। অন্যরা কর্তব্য পালন না করলে আমার পক্ষে অধিকার ভোগ করা সম্ভব নয়। যেমন, অন্যদের কর্তব্য হলো আমাকে পথ চলতে দেয়া। যদি তারা এ কর্তব্য পালন না করে, তাহলে আমার পথ চলার অধিকারের কোন অস্তিত্ব থাকে না। তেমনি আমার কর্তব্য হলো, অন্যদের পথ চলতে দেয়া। আমি যখন অন্যদের পথ চলতে দিব, কেবল তখনই আমার নিজের পথ চলার অধিকার তাদের কাছ থেকে দাবী করতে পারব।
অতএব একজন ব্যক্তির জন্য যা কিছু ‘অধিকার’ তাই হল অন্যের জন্য ‘কর্তব্য’। যেমন আল্লাহর অধিকার মানে বান্দার উপর একটি কর্তব্য, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অধিকার মানে উম্মাহর উপর একটি কর্তব্য, পিতামাতার অধিকার মানে সন্তানের উপর একটি কর্তব্য, স্ত্রীর অধিকার মানে স্বামীর উপর একটি কর্তব্য এবং শ্রমিকের অধিকার মানে মনিবের উপর একটি কর্তব্য ইত্যাদি।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
তথ্যসূত্র :
[১]. মুহাম্মাদ রাওয়াস কালা‘জী ও হামিদ ছাদিক ক্বানীবী, মু‘জামু লুগাতিল ফুক্বাহা (দারুল নাফায়িস, ২য় সংস্করণ, ১৪০৮ হি./১৯৮৮ খ্রি.), পৃ. ১৮২।
[২]. নাযরিয়্যাতুল হাক্ব বাইনাশ শারী‘আতি ওয়াল ক্বানূন, ১ম খণ্ড, পৃ. ১।
[৩]. লিসানুল আরব, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৪৯। এ অর্থে আরো বর্ণিত হয়েছে, সূরা আয-যুমার, ৩৯/৭১; সূরা ইয়াসিন, ৩৬/৭।
[৪]. আবুল কাসিম মাহমূদ ইবনু আমর ইবনু আহমাদ আয-যামাখশারী, আসাসুল বালাগাহ, ১ম খণ্ড (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪১৯ হি./১৯৯৮ খ্রি.), পৃ. ২০৩।
[৫]. লিসানুল আরব, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৪৯।
[৬]. মাজদুদ্দীন আবূ তাহির মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াকূব আল-ফীরূযাবাদী, বাছাইরু যাউত তামীয ফী লাতাইফি কিতাবিল আযীয, ২য় খণ্ড (কায়রো: আল-মাজলিশুল ‘আলা লিশ শুয়ূনিল ইসলামিয়্যাহ লিজান্নাতি ইহইয়াইত তুরাছিল ইসলামী, ১৪১৬ হি./১৯৯৬ খ্রি.), পৃ. ৪৮৪।
[৭]. আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আলী আল-জুরজানী, কিতাবুত তা‘রীফাত (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ৩য় সংস্করণ, ১৪০৩ হি./১৯৮৩ খ্রি.), পৃ. ৮৯।
[৮]. ড. সা‘দী আবূ হাবীব, আল-ক্বামূসূল ফিক্বহী লুগাতান ওয়া ইছতিলাহান (দামেস্ক: দারুল ফিকর, ২য় সংস্করণ, ১৪০৮ হি./১৯৮৮ খ্রি.), পৃ. ৯৪।
[৯]. মু‘জামু লুগাতিল ফুক্বাহা, পৃ. ১৮২।
[১০]. ড. মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান আব্দুল মুনঈম, মু‘জামুল মুছতালাহাত ওয়াল আলফাযিল ফিক্বহিয়্যাহ, ১ম সংখ্যা (কায়রো: দারুল ফাযীলাহ, তাবি), পৃ. ৫৭৯ ।
[১১]. মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীম, আল্লাহর হক বান্দার হক (ঢাকা: খায়রুন প্রকাশনী, ৯ম প্রকাশ, ২০০৯ খ্রি.), পৃ. ২১৬।
[১২]. মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম, মানবীক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার ধারণা (ঢাকা: আজিজিয়া বুক ডিপো, ১ম প্রকাশ, ২০০৪ খ্রি.), পৃ. ১৪৫।
প্রসঙ্গসমূহ »:
সুন্নাত