সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ১১:২৩ পূর্বাহ্ন

বিদ‘আত পরিচিতি

-মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*


 (৭ম কিস্তি)

বিদ‘আতের ব্যাপারে কতিপয় মূলনীতি [১]


ইসলামের প্রচার-প্রসার ও তা বাস্তবায়নে যতগুলো মাধ্যম সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে তন্মধ্যে বিদ‘আত অন্যতম। কেননা মানুষ ভাল মনে করে ও নেকী অর্জনের প্রত্যাশায় বহু কষ্ট স্বীকার করে এমন অনেক ইবাদত সম্পাদন করে থাকে, যে ব্যাপারে ইসলামের কোন দিক-নির্দেশনা বর্ণিত হয়নি। তাইতো বিদ‘আত হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার পরেও সেটা পরিত্যাগ করে না, বরং তার পক্ষে পূর্বের চেয়েও দৃঢ়তা অবলম্বন করে। অন্যদিকে বিদ‘আত সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান না থাকার কারণে তারা জাগতিক জীবনের প্রয়োজনীয় নিত্য-নতুন আবিষ্কারকে বিদ‘আত বলে আখ্যায়িত করে থাকে। যা সঠিক নয়। এছাড়া কোন্টা বিদ‘আত আর কোনটা বিদ‘আত নয় সে ব্যাপারেও রয়েছে যথেষ্ট ভ্রান্তি। ফলে বিদ‘আত চিহ্নিত করতে তারা যেমন সক্ষম হচ্ছে না, তেমনি বিদ‘আতকে বিদ‘আত হিসাবে চিহ্নিতকারীদের বিরুদ্ধে তারা প্রতিনিয়ত বিষোদ্গার করছেন। তদুপরি স্বল্পশিক্ষিত ও অতি আবেগী একশ্রেণীর ব্যক্তি মহোদয় যত্রতত্র যেকোন কিছুকে বিদ‘আত বলে আখ্যায়িত করছেন। এ সকল বিষয় বর্তমানে দাওয়াতী কার্যক্রমকে যেমন বাধাগ্রস্ত করছে, তেমনি দাঈদেরকে যারপরনাই বিভিন্নভাবে হয়রানী ও হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। যা সত্যিই দুঃখজনক বিষয়। এজন্য সর্বাগ্রে বিদ‘আত নির্ণয়ের মূলনীতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা যরূরী। নিম্নে বিদ‘আতের ব্যাপারে কতিপয় মূলনীতি আলোচনা করা হল :

মূলনীতি-১ : ইবাদতের ক্ষেত্রে নিষেধ এবং বৈষয়িক ক্ষেত্রে বৈধ

ইসলামে ইবাদত ও তার নিয়মাবলী আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক নির্ধারিত। এখানে অন্য কোন ইমাম, বুযুর্গানে দ্বীন, আলিম, ইমাম, বক্তা, নেতা ইত্যাদির নতুন করে কিছু সংযোজন ও বিয়োজনের সুযোগ নেই। কেননা ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। তাই ছালাত, যাকাত, ছিয়াম, হজ্জ, দান-ছাদাক্বাহ, কুরবানী, দাওয়াতী কাজ, যিকির-আযকার সহ অন্যান্য ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত ও রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রদর্শিত তথা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নির্দেশনা ব্যতীত অন্য কোন পথ ও পদ্ধতিতে ইবাদত করা নিষিদ্ধ। কেননা এটা ইবাদতে তাওক্বীফী তথা কুরআন-সুন্নাহর অলংঘনীয় দলীল, যা পরিবর্তন করার ক্ষমতা কারো নেই। এজন্য ইবাদতের ক্ষেত্রে উদ্ভাবিত সকল নতুন পথ ও পদ্ধতি এবং কার্যক্রম বিদ‘আত হিসাবে গণ্য হবে।[২] তাই এ ব্যাপারে মৌলিক নীতিমালা হল- দলীল বা প্রমাণ ছাড়া কোন ইবাদতই গৃহীত হবে না। তবে মু‘আমালাত তথা বৈষয়িক ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির নিত্য-নতুন আবিষ্কার বিদ‘আত নয়, বরং যথাযথভাবে শরী‘আত পরিপালনের গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক মাত্র। যেমন, উড়োজাহাজ, হেলিকপ্টার, বাস-ট্রাক, কম্পিউটার, মোবাইল, মাইক, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন, আধুনিক স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা, কল-কারখানা স্থাপন ইত্যাদি। অনুরূপভাবে মানুষের জাগতিক জীবনে চলার পথে প্রয়োজনীয় এমন অনেক অভ্যাস রয়েছে, সেগুলো যেমন বৈধ তেমনি বিদ‘আত নয়। তবে যেসকল পথ ও পদ্ধতি এবং অভ্যাসের ব্যাপারে ইসলামী শরী‘আত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সেগুলো নিষিদ্ধ হিসাবেই গণ্য হবে। সুতরাং ইবাদতের ক্ষেত্রে নবাবিষ্কৃত আমল নিষিদ্ধ এবং বৈষয়িক ক্ষেত্রে নবাবিষ্কৃত অভ্যাস ও রীতি-নীতি বৈধ।

শরী‘আতে নবাবিষ্কৃত বিভিন্ন আমল এবং পথ ও পদ্ধতি যে প্রত্যাখ্যাত সে ব্যাপারে মূলনীতি সমৃদ্ধ একটি হাদীছ নি¤œরূপ:

عَنْ عَائِشَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ أَحْدَثَ فِىْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ فَهُوَ رَدٌّ.

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যদি কেউ আমাদের শরী‘আতে এমন নতুন কিছুর সৃষ্টি করল, যা তাতে নেই- তবে তা প্রত্যাখ্যাত।[৩]

সুধী পাঠক! এই হাদীছ ইবাদতের মধ্যে দলীলবিহীন আবিষ্কার করা যে কোন নতুন আমল ও পদ্ধতিকে অস্বীকার করে। তবে ইবাদত ব্যতীত অন্যান্য বৈষয়িক প্রয়োজনে নিত্য-নতুন দৃষ্টান্তবিহীন আবিষ্কারকে অস্বীকার করে না। বরং সেগুলো বৈধ হিসাবে স্বীকৃত। এ প্রসঙ্গে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়্যাহ (৬৬১-৭২৮ হি./১২৬৩-১৩২৮ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘বিভিন্ন কথা ও কাজের মাধ্যমে রূপান্তরিত ইবাদতসমূহ দুই প্রকার। যথা : (১). এমন ইবাদতসমূহ, যার মাধ্যমে তাদের দ্বীনকে সঠিক করবে এবং (২). এমন প্রথা-পদ্ধতি ও অভ্যাস, যা তাদের দুনিয়াবী জীবনের প্রয়োজন পূরণ করবে। শরী‘আতের মূলনীতিসমূহ পর্যালোচনা করলে আমরা জানতে পারি যে, আল্লাহ তা‘আলা যেসকল ইবাদতসমূহকে আবশ্যক করেন এবং পসন্দ করেন, সেগুলো শরী‘আতের দলীল ব্যতীত স্বীকৃত নয়। আর দুনিয়াবী জীবনের এমন বিভিন্ন প্রথা-পদ্ধতি ও অভ্যাস, যেগুলো প্রয়োজনের তাকীদে মানুষেরা তাদের অভ্যাসে পরিণত করেছে, মূলত সেগুলো নিষিদ্ধ নয়। তবে যেগুলো আল্লাহ তা‘আলা নিষিদ্ধ করেছেন, সেগুলো অবশ্যই নিষিদ্ধ হবে। এই আদেশ ও নিষেধ উভয়টি আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক বিধিবদ্ধ। সুতরাং ইবাদত অবশ্যই আদেশকৃত বিষয়ের হতে হবে। তাই যে বিষয়ে কোন আদেশ বা দিক-নির্দেশনা বর্ণিত হয়নি তাকে কিভাবে ইবাদত হিসাবে হুকুম লাগানো যায়?! আর মানুষের অভ্যাসসমূহের মধ্যে যেগুলোর ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়নি, সেগুলো কিভাবে ‘নিষিদ্ধ’ হিসাবে হুকুম লাগানো যায়?! এ ব্যাপারে ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) ও অন্যান্য আহলেহাদীছ ফক্বীহ বলেছেন, মৌলিকভাবে ইবাদত হল তাওক্বীফী অর্থাৎ ইবাদতের মধ্যে এমন কোন কিছু বিধিবদ্ধ নয়, যেগুলোকে আল্লাহ তা‘আলা বিধিবদ্ধ করেননি। আর এ অর্থটি আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণীর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,    

اَمۡ لَہُمۡ شُرَکٰٓؤُا شَرَعُوۡا  لَہُمۡ مِّنَ الدِّیۡنِ مَا لَمۡ یَاۡذَنۡۢ بِہِ اللّٰہُ

‘তাদের কি এমন কতকগুলো শরীকও আছে, যারা তাদের জন্য দ্বীনের এমন বিধান প্রবর্তন করেছে যার অনুমতি আল্লাহ দেননি?’ (সূরা আশ-শূরা : ২১)। আর মানুষের স্বভাবগত বিষয়গুলো ক্ষমার যোগ্য। সুতরাং এ বিষয়ে আল্লাত তা‘আলা যেগুলো হারাম করেননি, সেগুলো থেকে নিষেধ করা ঠিক নয়। আর এ অর্থটি আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণীর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلۡ اَرَءَیۡتُمۡ مَّاۤ  اَنۡزَلَ اللّٰہُ  لَکُمۡ مِّنۡ رِّزۡقٍ فَجَعَلۡتُمۡ مِّنۡہُ حَرَامًا وَّ حَلٰلًا قُلۡ آٰللّٰہُ  اَذِنَ لَکُمۡ اَمۡ عَلَی اللّٰہِ تَفۡتَرُوۡنَ

‘(হে নবী!) আপনি বলুন, আচ্ছা বলত, আল্লাহ তোমাদের জন্য যা কিছু রিযিক পাঠিয়েছেন, অতঃপর তোমরা তার কিছু অংশ হারাম এবং কিছু অংশ হালাল সাব্যস্ত করে নিলে; আপনি জিজ্ঞেস করুন, আল্লাহ কি তোমাদেরকে অনুমতি দিয়েছেন, না-কি তোমরা আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করছ?’ (সূরা ইউনুস : ৫৯)।[৪]

মূলনীতি-২ : শরী‘আতে বিদ‘আতে হাসানা নেই, বরং প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্ট

মুসলিম সমাজে হাসানা ও সাইয়িয়াহ তথা ভাল ও মন্দ বলে বিদ‘আতের প্রকরণ করা হয়। আর বলা হয় বিদ‘আতে হাসানা জায়েয এবং বিদ‘আতে সাইয়িয়াহ নাজায়েয। প্রকৃতপক্ষে বিদ‘আত সম্পর্কে স্পষ্ট ও পরিপূর্ণ ধারণা না থাকার কারণে এ রকম বিভ্রান্তি সমাজে প্রচলিত রয়েছে। কেননা আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদ‘আতকে যেমন উক্ত প্রকারে বিভক্ত করেননি, তেমনি সকল ধরনের বিদ‘আতকে ভ্রষ্ট বলে উল্লেখ করেছেন। হাদীছে এসেছে, ‘ইরবায ইবনু সারিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

صَلَّى بِنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيْغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُوْنُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوْبُ فَقَالَ قَائِلٌ يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَمَاذَا تَعْهَدُ إِلَيْنَا فَقَالَ أُوصِيْكُمْ بِتَقْوَى اللهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا فَإِنَّهُ مَنْ يَّعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِىْ فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيْرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّيْنَ الرَّاشِدِيْنَ تَمَسَّكُوْا بِهَا وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ

‘একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর আমাদের দিকে ফিরে আমাদের উদ্দেশ্য এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন। তাতে চক্ষুগুলো অশ্রুসিক্ত হল এবং অন্তরগুলো বিগলিত হল। তখন এক ব্যক্তি বলল, এ যেন বিদায়ী ভাষণ! অতএব আপনি আমাদেরকে কী নির্দেশ দিবেন? তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতির, শ্রবণ ও আনুগত্যের উপদেশ দিচ্ছি, যদিও সে (আমীর) একজন হাবশী গোলামও হয়। কারণ তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে জীবিত থাকবে তারা অচিরেই প্রচুর মতবিরোধ দেখতে পাবে। এমতাবস্থায় তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাত ও আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নাতকে অনুসরণ করবে, তা দাঁত দিয়ে মযবুত করে আঁকড়ে থাকবে। সাবধান! নবাবিষ্কৃত বিষয় থেকে বিরত থাকবে। কারণ প্রতিটি নবাবিষ্কৃত বিষয় হল বিদ‘আত আর প্রতিটি বিদ‘আতই ভ্রষ্ট’।[৫] অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ وَكُلَّ ضَلَالَةٍ فِى النَّارِ ‘প্রত্যেক বিদ‘আত ভ্রষ্ট এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম’।[৬]

সুধী পাঠক! এ হাদীছ প্রমাণ করে যে, শরী‘আতে বিদ‘আতে হাসানা বলে কিছু নেই, বরং প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্ট। এটিই ছিল সালাফদের বুঝ। প্রখ্যাত ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেছেন, كُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ وَإِنَّ رَآهَا النَّاسُ حَسَنَةٌ ‘প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্ট যদিও মানুষের নিকট সেটা হাসানা বা উত্তম হয়’।[৭]

বিদ‘আতের ভাল ও মন্দ প্রকরণের ব্যাপারে ‘আলিমগণের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। কতিপয় বিশিষ্ট ‘আলিম বিদ‘আতকে ভাল ও মন্দ প্রকরণ এবং ওয়াজিব, হারাম, মুস্তাহাব, মাকরূহ ও মুবাহ হিসাবে ভাগ করেছেন। যেমন ‘ঈয্যুদ্দীন ইবনু আব্দুস সালাম (৫৭৭-৬৬০ হি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘বিদ‘আত পাঁচ প্রকার। যথা : ওয়াজিব বা আবশ্যক, হারাম বা নিষেধ, মানদূব বা মুস্তাহাব, মাকরূহ বা অপসন্দনীয় এবং মুবাহ বা বৈধ’।[৮] তবে বিদ‘আতের এই প্রকরণ ছহীহ হাদীছ এবং সালাফে ছালেহীনের বুঝের বিপরীত। কেননা সালাফদের নিকট প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা। যেমনটি পূর্বে আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর আছার থেকে প্রমাণিত হয়েছে।[৯]

বিদ‘আতে হাসানার পক্ষের দলীলসমূহ ও তার পর্যালোচনা


প্রথম দলীল

জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

مَنْ سَنَّ فِى الْإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَهُ أَجْرُهَا وَأَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا بَعْدَهُ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَّنْقُصَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَىْءٌ وَمَنْ سَنَّ فِى الْإِسْلاَمِ سُنَّةً سَيِّئَةً كَانَ عَلَيْهِ وِزْرُهَا وَوِزْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا مِنْ بَعْدِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَّنْقُصَ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَىْءٌ

‘যে ব্যক্তি ইসলামে ভাল রীতি চালু করবে, সে তার নিজের এবং ঐ সমস্ত লোকের ছওয়াব পাবে, যারা তার মৃত্যুর পর তার উপর আমল করবে। অথচ তাদের ছওয়াবের কিছু পরিমাণও কম করা হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোন মন্দ রীতির প্রচলন করবে, তার উপর তার নিজের এবং ঐ লোকদের পাপ বর্তাবে, যারা তার পর তার উপর আমল করবে। অথচ তাদের গুনাহর কিছু পরিমাণও কম করা হবে না’।[১০]

উক্ত হাদীছে বুঝা যায় যে, ভাল ও মন্দ সুন্নাত প্রবর্তনের বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর উম্মতের দিকেই নিছবত করেছেন। এছাড়া আরো বলা হয়েছে যে, যদি কেউ ভাল সুন্নাত চালু করে, তাহলে সে মহৎ কর্ম সম্পাদন করল এবং তার মর্যাদাও বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং প্রত্যেক বিদ‘আত খারাপ নয়, বরং এমন অনেক বিদ‘আত রয়েছে, যার মাধ্যমে মানুষ হেদায়াত লাভ এবং অসংখ্য নেকি অর্জন করতে পারে।

জবাব

উক্ত হাদীছে বিদ‘আতে হাসানা বা ভাল বিদ‘আতের কোন দলীল নেই। কেননা হাদীছে বর্ণিত سَنَّ শব্দ দ্বারা নতুন করে কোন সুন্নাত আবিষ্কার করা কিংবা নতুন করে কোন বিধান উদ্ভাবন করা উদ্দেশ্য নয় বরং এটা দ্বারা উদ্দেশ্য হল- রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহ সমর্থিত এমন কোন আমল করা কিংবা এমন কোন সুন্নাতের পুনরুজ্জীবিত করা, যা মানুষ ছেড়ে দিয়েছিল বা ভুলে গিয়েছিল কিংবা সমাজ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। এছাড়া উক্ত হাদীছের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করলে বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হবে। যেমন, জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,

‘একদা আমরা দিনের প্রথম ভাগে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে ছিলাম। অতঃপর তাঁর নিকট কিছু লোক এল, যাদের দেহ বিবস্ত্র ছিল, পশমের ডোরা কাটা চাদর (মাথা প্রবেশের মত জায়গা মাঝে কেটে) পরে ছিল অথবা আবা বা আংরাখা পরে ছিল, তরবারী তাঁরা নিজেদের গর্দানে ঝুলিয়ে রেখেছিল। তাদের অধিকাংশ মুযার গোত্রের লোক ছিল। বরং তারা সকলেই মুযার গোত্রের ছিল। তাদের দরিদ্রতা দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। সুতরাং তিনি বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলেন এবং পুনরায় বের হলেন। তারপর তিনি বেলালকে আযান দেয়ার আদেশ করলেন। ফলে তিনি আযান দিলেন এবং ইক্বামত দিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছালাত আদায় করে লোকদের সম্বোধন করে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, ‘হে মানব সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর’ (সূরা আন-নিসা : ১)। অতঃপর তিনি বললেন, প্রত্যেক ব্যক্তি যেন নিজ দীনার, দিরহাম, কাপড়, এক ছা‘ গম ও এক ছা‘ খেজুর থেকে ছাদাক্বাহ করে। এমনকি তিনি বললেন, খেজুরের আধা টুকরা হলেও। সুতরাং আনছারদের একটি লোক একটি থলে নিয়ে এল, লোকটির করতল যেন তা ধারণ করতে পারছিল না; বরং তা ধারণ করতে অক্ষমই ছিল। অতঃপর তা দেখে লোকেরা পরস্পর দান আনতে আরম্ভ করল। এমনকি খাদ্য সামগ্রী ও কাপড়ের দু’টি স্তূপ দেখলাম। পরিশেষে আমি দেখলাম যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চেহারা যেন সোনার মত ঝলমল করছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,

مَنْ سَنَّ فِى الْإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً ... أَنْ يَّنْقُصَ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَىْءٌ

‘যে ব্যক্তি ইসলামে ভাল রীতি চালু করবে ... তাদের গুনাহর কিছু পরিমাণও কম করা হবে না’ অংশটুকু বললেন’।[১১] উক্ত বক্তব্য রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনছারী ছাহাবীর ছাদাক্বাহ করার বিষয়ে বলেছেন। কেননা ঐ ছাহাবী যে কাজটি করেছিলেন তা নিঃসন্দেহে শরী‘আতের বিধিবদ্ধ সুন্নাত অনুযায়ীই করেছেন। যার কারণে উপস্থিত অন্যান্য ছাহাবীও দান করতে উৎসাহিত হয়েছিলেন। সুতরাং এখানে বিদ‘আতে হাসানা বা ভাল বিদ‘আতের পক্ষে কোন দলীল নেই, বরং শরী‘আতসম্মত আমলই উদ্দেশ্য।[১২]

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র :
[১]. যাকারিয়া ইবন গোলাম কাদের আল-পাকিস্তানী, মিন উছূলিল ফিক্বহি আলা মানহাজি আহলিল হাদীছ (দারুল খাররায, ১ম সংস্করণ, ১৪২৩ হি./২০০২ খ্রি.), পৃ. ১৯৪-২১৬। 
[২]. শায়খ ছালিহ আল-ফাওযান আল-ফাওযান, ‘আক্বীদাতুত তাওহীদ, পৃ. ৫৮।   
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৯৭, ‘সন্ধি’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮; মিশকাত, হা/১৪০। 
[৪]. তাক্বীউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনু আব্দুল হালীম ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২৯তম খণ্ড (দারুল ওয়াফা, ৩য় সংস্করণ, ১৪২৬ হি./২০০৫ খ্রি.), পৃ. ১৬-১৭; ঐ, আল-ফাতাওয়াউল কুবরা, ৪র্থ খণ্ড (দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪০৮ হি./১৯৮৭ খ্রি.), পৃ. ১২-১৩; ঐ, আল-ক্বাওয়াইদুল নূরানিয়্যাহ আল-ফিক্বহিয়্যাহ (কায়রো : মাকতাবাতুস সুন্নাহ আল-মুহাম্মাদিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৭৩০ হি./১৯৫১ খ্রি.), পৃ. ১১২। 
[৫]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭; তিরমিযী, হা/২৬৭৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৮৪; মিশকাত, হা/১৬৫; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৭৩৫।
[৬]. নাসাঈ, হা/১৫৭৮; ছহীহ ইবনু খুযাইমাহ, হা/১৭৮৫, সনদ ছহীহ।
[৭]. হিবাতুল্লাহ ইবনুল হাসান ইবনু মানছূর আল-লালকাঈ, শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাহি ওয়াল জামা‘আতি মিনাল কিতাবাতি ওয়াস সুন্নাতি ওয়া ইজমাঈছ ছাহাবাহ, ১ম খণ্ড (রিয়াদ : দারু ত্বাইয়েবা, ১৪০২ হি.), পৃ. ৯২, আছার নং-১২৬; আবূ আব্দিল্লাহ উবাইদুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু বাত্তাহ, আল-ইবানাতু ‘আন শারী‘আতিল ফিরক্বাতিন নাজিয়াহ, ১ম খণ্ড (রিয়াদ : দারুর রাইয়াহ, ২য় সংস্করণ, ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি.), পৃ. ৩৩৯, আছার নং-২১৩, সনদ ছহীহ।
[৮]. আবূ মুহাম্মাদ ‘ঈয উদ্দীন আব্দুল আযীয ইবন আব্দুস সালাম, ক্বাওয়াঈদুল আহকাম ফী মাছালিহিল আনাম, ২য় খণ্ড (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফ, তা.বি.), পৃ. ১৭২-১৭৩; আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুল আযীয ইবনু আহমাদ আত-তুওয়াইজিরী, আল-বিদাঊল হাউলিয়্যাহ (রিয়াদ : দারুল ফাযীলাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪২১ হি./২০০০ খ্রি.), পৃ. ২৭-২৮।
[৯]. মিন উছূলিল ফিক্বহি ‘আলা মানহাজি আহলিল হাদীছ, পৃ. ১৯৫-১৯৬। 
[১০]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০১৭; নাসাঈ, হা/২৫৫৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯১৯৭; মিশকাত, হা/২১০।
[১১]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০১৭; নাসাঈ, হা/২৫৫৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯১৯৭; মিশকাত, হা/২১০।
[১২]. মিন উছূলিল ফিক্বহি আলা মানহাজি আহলিল হাদীছ, পৃ. ১৯৭; গৃহীত : ইমাম শাতেবী, আল-মুওয়াফিক্বাত, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮৩।




আল-কুরআন এক জীবন্ত মু‘জিযা - আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইউনুস
ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ১১ রাক‘আতের নির্দেশ দিয়েছিলেন - ব্রাদার রাহুল হোসেন (রুহুল আমিন)
বিদ‘আত পরিচিতি (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ফাযায়েলে কুরআন (২য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
আল-কুরআনের আলোকে দাওয়াতের মাধ্যম - আব্দুল গাফফার মাদানী
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (২য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
সুন্নাতের রূপরেখা (৩য় কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন : সংশয় নিরসন (৪র্থ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৭ম কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
দলাদলির কুপ্রভাব : উত্তরণের উপায় - শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
ইসলামে পর্দার বিধান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ইসলামী তাবলীগ বনাম ইলিয়াসী তাবলীগ (২য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন

ফেসবুক পেজ