বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৪১ অপরাহ্ন

মুসলিম উম্মাহর বিভ্রান্তির কারণ ও উত্তররেণর উপায়

-হাসিবুর রহমান বুখারী*



ভূমিকা

বর্তমান বিশ্বে মুসলিম উম্মাহ পথভ্রষ্ট, পদদলিত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত। অধঃপতন, পাতালগামিতা ও নিম্নগামিতার শিকার। এর কারণ কী? কেউ বলছেন, ‘শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়া’। কেউ বলছেন, ‘নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত, বিচক্ষণ ও আদর্শ নেতার অভাব’। কেউ বলছেন, বর্তমান সময়ে ইসলামের বা মুসলিমদের ধ্বংসের মূল কারণ হল: ‘আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষকের অভাব’। আরার কেউ বলছেন, ‘মুসলিম উম্মাহর বিভ্রান্তির কারণগুলো হল: (১) বস্তুবাদিতা (গধঃবৎরধষরংস), (২)  ব্যক্তিস্বাধীনতা (ওহফরারফঁধষরংস), (৩)  পুঁজিবাদ (ঈধঢ়রঃধষরংস), (৪) সম্প্রসারণবাদ (ঊীঢ়ধহংরড়হরংস) ও (৫) সেক্যুলারবাদ (ঝবপঁষধৎরংস) ইত্যাদি ইত্যাদি। আদতে কিন্তু এগুলো কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সঠিক ব্যাখ্যা বিহীন আমাদের মস্তিষ্কপ্রসূত ধারণা মাত্র। ইতিহাস সাক্ষী, শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও সামরিক শক্তিতে উন্নত অনেক দেশের উপর তাঁতারী ও মঙ্গোলিয়দের মত মূর্খ ও বর্বর সেনাবাহিনী আক্রমণ চালিয়ে জয়ী হয়েছিল। উন্নতির শিখরে অবস্থানকারী আব্বাসী খিলাফত, অটোমান সাম্রাজ্য, স্পেন, তুরস্ক যার জ্বলন্ত উদাহরণ।

প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে প্রচলিত তথাকথিত বিভিন্ন বক্তা, ওয়ালি-আউলিয়া, গাউছ-কুতুব, পীর-মাশায়িখ বিভিন্ন ধরণের অলীক, বানোয়াট ও কল্পিত ঘটনাবলী বর্ণনা করে জনসাধারণকে প্রকৃত ইসলামের উপর বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা ব্যতীত এক কল্পনা ও অবাস্তব ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত করছে। বর্তমানে একশ্রেণীর বক্তারা মানুষের মাঝে এমন সব কেচ্ছা-কাহিনী বলে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করে যা প্রকৃত ইসলামের সাথে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক। তথাকথিত ইসলামী বক্তাগণ ধর্মীয় জ্ঞানহীন জনসমাগমের মাঝে যত অলৌকিক ঘটনা অর্থাৎ কল্পিত ঘটনা বর্ণনা করে এগুলোর কোন ভিত্তিই ইসলামে নেই। এর ফলে জনগণের বিশ্বাস প্রকৃত ইসলাম থেকে সরে এক অবাস্তব কল্পিত অবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের এই প্রোপাগান্ডার ফলে ইসলামের অভূতপূর্ব ক্ষতি সাধিত হচ্ছে।

মুসলমানদের বিগত সাড়ে চৌদ্দশ’ বছরের জীবনকে ইতিহাসের পাতায় দেখলে জানা যায় যে, আমরা সম্মান ও মর্যাদায়, গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব, শান ও শওকত এবং প্রভাব-প্রতিপত্তির একমাত্র ও একচ্ছত্র অধিকারী ছিলাম। কিন্তু যখন ইতিহাসের পাতা হতে দৃষ্টি সরিয়ে বর্তমান অবস্থার উপর দৃষ্টিপাত করা হয়, তখন আমাদেরকে চরম লাঞ্ছিত ও অপদস্ত, নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্থ জাতি হিসাবে দেখি। আমাদের না আছে শক্তি-সামর্থ্য, না আছে ধন-দৌলত, না আছে শান-শওকত, না আছে পরস্পর ভ্রাতৃত্ব বন্ধন, না স্বভাব ভাল, না চরিত্র ভাল, না আমল ভাল, না আচার-আচরণ ভাল, সব ধরণের অকল্যাণ আমাদের মধ্যে, সব ধরণের কল্যাণ হতে আমরা যেন বহু দূরে। অন্যান্য ধর্মের ব্যক্তিবৃন্দ আমাদের এই দুরাবস্থার উপর আনন্দ বোধ করে। প্রকাশ্যে আমাদের দুর্নাম করে এবং আমাদের নিয়ে উপহাস করে। শিক্ষা -দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তিতে আধুনিক বিশ্বের উন্নতি দেখে আমরাও হীনমন্যতায় ভুগতে থাকি। মনে মনে ভাবি-

دنیا تو گئی چاند ستاروں سے بھی آگے

اور ہم بیٹھے مصلی پہ دعا مانگ رہے ہیں.

‘দুনিয়া তো গায়ী চাঁদ সিতারুঁ সে ভী আগে

আওর হাম বেইঠে মুছভাল্লা পে দু‘আ মাঁঙ্গ রাহে হ্যাঁয়!

অর্থাৎ ‘দুনিয়া জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রহ-নক্ষত্রের উপরে পৌঁছে গিয়েছে, আর আমরা এখনো জায়নামাজে বসে বসে দু‘আ করে যাচ্ছি!’

তাই আজ আমরা ‘চলন্ত গাড়ি দেখে ছুটতে থাকা কুকুরের ন্যায়’ উন্নতির পিছনে ছুটে চলেছি। দ্বীন ইসলাম থেকে বিমুখ হয়ে পার্থিব জগতের প্রেমে বুঁদ হয়ে বিরামহীন ছুটে চলেছি। পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা শুধু তাদের মন্দ দিকটাই গ্রহণ করেছি। সেই জন্যই তো আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত তাদের মত উন্নত প্রযুক্তি আসেনি। তৈরি হয়নি উন্নতমানের বিশ্ববিদ্যালয়। ফলস্বরূপ আমরা কী পেয়েছি? উত্তর হল: উন্নতির নামে নিম্নগামিতা, আধুনিকতার নামে বেহায়াপনা, অগ্রগতির নামে অশ্লীলতা, সভ্যতার নামে অসভ্যতা, সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি, পরিবর্তনের নামে উন্মুক্ত যৌনচার, শিক্ষার নামে যৌনশিক্ষা, পোশাকের নামে নগ্নতা, ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে প্রকাশ্য ব্যভিচার, দিবস পালনের নামে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও অবৈধ প্রেম-ভালোবাসা! আধুনিকতার নামে তারা আগ্রাসী পাশ্চাত্য সভ্যতার নোংরামির শিকারে পরিণত হচ্ছে। এ সবই কিন্তু পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণের বিষফল। তাদের পার্থিব জগতের উন্নতি দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে আমরাও তাদের মত হতে গিয়ে একুল ওকুল সবই হারালাম। না পারলাম তাদের মত উন্নত হতে, আর না পারলাম নিজের ধর্মের বিধি-বিধান অনুযায়ী নিজেকে আদর্শ মুসলিম হিসাবে তৈরি করতে। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোর ফলে আমরা শুধু আগ্রাসী পাশ্চাত্য সভ্যতার শিকারে পরিণত হয়েছি।

দেশের রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলা, নিয়মনীতি, বিচার ব্যবস্থা, পুলিশ-প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতেও অসংখ্য অভূতপূর্ব  রীতি-নীতি রয়েছে, সেগুলোও কিন্তু আগ্রাসী পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণেই প্রবর্তিত এবং বিজাতীয় সভ্যতা থেকে আগত। অথচ ইসলামে এর কোন অনুমোদন নেই। সুতারাং আমাদের জন্য উচিত হবে, অনৈসলামিক আদর্শকে বর্জন করে, ইসলামী সংস্কৃতি, সভ্যতা, রীতিনীতি ও আদর্শকে গ্রহণ করা।

অবাক হতে হয়! যে জাতি একদা উন্নত শিক্ষা ও সংস্কৃতির পিপাসা মিটিয়েছে, তারা আজ কেন পিপাসার্ত! যে জাতি দুনিয়াকে সভ্যতা ও সামাজিকতার পাঠ পড়িয়েছে, আজ তারা কেন অসভ্য ও অসামাজিক? যে মুসলিমদের কাছ থেকে মনুষ্যত্ববোধ, পারিবারিক ও সামাজিক সুশিক্ষা, উত্তম আদর্শ ও চরিত্রের পাঠ নেয়ার জন্য তৎকালীন ইউরোপ চাতক পাখির ন্যায় মুখিয়ে থাকত, আজ সেই মুসলিমরাই অবহেলার পাত্রে পরিণত হয়েছে! কারণ একটাই; আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস ভুলে গিয়েছি। আমরা তাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছি। তাই দুনিয়া সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যাক না! বিজাতীরা উন্নতি ও তথ্য-প্রযুক্তির পিছনে পাগলের মত ছুটছে, ছুটুক না! চলুন, আমরা একটু পিছিয়ে যায়, পিছিয়ে যায় আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে। ধারণ করি স্বর্ণ যুগের সেই অমূল্য আদর্শকে, পরিধান করি পরিপূর্ণ ঈমানের পোশাক, জাগিয়ে তুলি নববী যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক বিপ্লব। ইনশাআল্লাহ, পুনরায় আমরা সম্মান ও মর্যাদায়, গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব, শান ও শওকত এবং প্রভাব-প্রতিপত্তির একমাত্র ও একচ্ছত্র অধিকারী হয়ে যাব।

জাতির দিশারীরা আজ হতে অনেক পূর্বেই আমাদের দুরাবস্থাকে অনুধাবন করেছেন এবং নানাভাবে আমাদের সংশোধনের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু বারংবার রোগ নির্ণয়ে ভুল হয়েছে। ফলস্বরূপ চিকিৎসা যতই করা হয়েছে, রোগ ততই বেড়ে চলেছে।

বর্তমান অবস্থা অধিকতর শোচনীয় পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে এবং অতীতের তুলনায় ভবিষ্যত আরও বেশি বিপজ্জনক ও অন্ধকারময় দেখা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় আমাদের চুপ করে বসে থাকা এবং সক্রিয় চেষ্টা না করা এক অমার্জনীয় অপরাধ। তবে বাস্তব কোন পদক্ষেপ নেয়ার পূর্বে আমাদের অবশ্যই ঐ সকল কারণসমূহ চিন্তা করতে হবে, যে সকল কারণে আমরা এই অপমান ও লাঞ্ছনার আযাবে পতিত হয়েছি। আমাদের অবনতি ও অধঃপতনের বিভিন্ন কারণ বর্ণনা করা হয় এবং তা দূর করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপ অনুপযোগী ও বিফল প্রমাণিত হয়েছে। বাস্তব সত্য হল এই যে, আজ পর্যন্ত আমাদের রোগ নির্ণয়-ই সঠিকরূপে হয়নি। যে সব কারণ বলা হয় তা প্রকৃতপক্ষে রোগ নয় বরং রোগের উপসর্গ মাত্র। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত রোগের প্রতি মনযোগ দেয়া না হবে এবং রোগের মূল উৎসের সংশোধন ও চিকিৎসা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত উপসর্গের সংশোধন ও চিকিৎসা অসম্ভব ও অবাস্তব। কাজেই আসুন আমরা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে ‘মুসলিম উম্মাহর বিভ্রান্তির কারণ ও উত্তরণের উপায়’ সম্পর্কে একটু বিস্তারিত আলোচনা করি-

১- শিরকে নিমজ্জিত হওয়ার ধ্বংসাত্মক পরিণতি ও শিরকমুক্ত জীবন-যাপনের সুনিশ্চিত নিরাপত্তা

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শিরকের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্মক। তা সত্ত্বেও মানব জাতি এর ভয়াবহতা সম্পর্কে উদাসীন। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ لَمۡ یَلۡبِسُوۡۤا اِیۡمَانَہُمۡ بِظُلۡمٍ  اُولٰٓئِکَ لَہُمُ الۡاَمۡنُ وَ ہُمۡ مُّہۡتَدُوۡنَ.

‘তাদের জন্যই নিরাপত্তা এবং তারাই সুপথগামী যারা ঈমান এনেছে এবং এরপর ঈমানকে যুল্মের (শিরকের) সাথে মিশ্রিত করেনি’ (সূরা আল-আন‘আম: ৮২)। অর্থাৎ যে ব্যক্তি স্বীয় ঈমানের সাথে কোন প্রকার শিরক মিশ্রিত করে তার কোন নিরাপত্তা নেই। এ আয়াত দ্বারা বুঝা গেল যে, খোলাখুলিভাবে মুশরিক বা মূর্তিপূজারী হয়ে যাওয়াই শুধু শিরক নয়, বরং সে ব্যক্তিও মুশরিক, যে কোন প্রতিমার পূজা করে না এবং ইসলামের কালিমা উচ্চারণ করে, কিন্তু কোন ফিরিশতা কিংবা রাসূল কিংবা ওয়ালীকে আল্লাহর কোন বিশেষ গুণে অংশীদার মনে করে বা আল্লাহকে যা দিয়ে ইবাদত করা হয় তাদেরকে তেমন কিছু দিয়ে ইবাদত করে। সুতরাং জনসাধারণের মধ্যে যারা কোন পীর, জিন, ওয়ালী বা মাযার ইত্যাদিকে মনোবাঞ্ছা পূরণকারী বলে বিশ্বাস করে এবং কার্যতঃ মনে করে যে, আল্লাহর ক্ষমতা যেন তাদেরকে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই মুশরিক। তারা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে শিরক করল। অনুরূপভাবে যারা কবরবাসী, ওয়ালী, মাযার, জ্বিন ইত্যাদিকে আহ্বান করে, সাজদাহ করে, সাহায্য চায়, মানত করে, তাদের উদ্দেশ্যে যব্হ করে তারা সবাই মুশরিক। তাদের কারোর-ই নিরাপত্তা নেই। তারা আল্লাহর উলূহিয়্যাতে শিরক করল এবং তাওবাহ না করে মারা গেলে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকবে।

দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে মানুষ তাদের চিরশত্রু শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে যেসব অপরাধে লিপ্ত হয় তন্মধ্যে মারাত্মক অপরাধ হচ্ছে শিরক। এর ফলে একজন মুসলিম তার অজান্তেই ইসলাম ও আল্লাহর নিরাপত্তা থেকে বেরিয়ে যায়। মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে লক্ষ্য করে বলেছেন,

لَئِنۡ  اَشۡرَکۡتَ لَیَحۡبَطَنَّ عَمَلُکَ وَ  لَتَکُوۡنَنَّ  مِنَ  الۡخٰسِرِیۡنَ.

‘তুমি যদি শিরক কর, তা হলে তোমার আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (সূরা আয-যুমার: ৬৫)। রাসূল (ﷺ) থেকে কোন শিরক সংঘটিত না হওয়া সত্ত্বেও এবং তিনি আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয়ভাজন বান্দা হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে এভাবে অনেকটা ধমকের সুরে সম্বোধন করে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এ কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে- তাঁর উম্মতদেরকে এ কথা সুস্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেয়া যে, এ অপরাধ যার দ্বারাই সংঘটিত হবে, আল্লাহ তা‘আলা সে ব্যক্তির যাবতীয় সৎকর্ম নিষ্ফল করে দেবেন এবং সে ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।

এ আয়াত দ্বারা এ কথা সহজেই অনুমিত হয় যে, বিশুদ্ধ ঈমান তথা শিরকমুক্ত আক্বীদাহ ও বিশ্বাসই হচ্ছে আখিরাতে সৎ কর্মের প্রতিদান প্রাপ্তির এবং দুনিয়াতে নিরাপত্তা প্রাপ্তির পূর্বশর্ত। সে জন্য কুরআনুল কারীমে শিরকমুক্ত বিশুদ্ধ ঈমানকে এমন একটি গাছের সাথে তুলনা করা হয়েছে যার শিকড় প্রোথিত রয়েছে মাটির অনেক গভীরে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর কোন ক্ষতি করতে পারে না বলে সর্বদা যেমনি তা পত্র-পল্লব আর ফুলে-ফলে সুশোভিত থাকে, শিরকমুক্ত বিশুদ্ধ ঈমানের অধিকারীর ঈমানও তেমনি আখিরাতে আমলের পত্র-পল্লব ও ফুলে-ফলে সুশোভিত থাকবে। কোন মুশরিকের ক্ষেত্রে এমনটি হবে না। অতঃপর ঘোষিত হচ্ছে যারা ঈমান এনেছে এবং ঈমানের উপর যুল্ম অর্থাৎ শিরককে সংমিশ্রিত করেনি, শান্তি ও নিরাপত্তার অধিকারী তো তারাই এবং তারাই সঠিক পথে পরিচালিত। তারা ইবাদতকে একমাত্র আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট করেছিল এবং সেই ইবাদতকে শিরক থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত রেখেছিল। তাই দুনিয়া ও আখিরাত তাদেরই অধিকারে রয়েছে।

দুনিয়ার অশান্তি ও পরকালের শাস্তির কবল থেকে নিরাপদ ও নিশ্চিত তারাই হতে পারে, যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে, তারপর সে ঈমানের সাথে কোনরূপ যুলুমকে মিশ্রিত করেনি। ছহীহ হাদীছের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে, এ আয়াত নাযিল হলে ছহাবায়ে কিরাম চমকে উঠেন এবং আরয করেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে পাপের মাধ্যমে নিজের উপর যুল্ম করেনি? এ আয়াতে শাস্তির কবল থেকে নিরাপদ হওয়ার জন্য ঈমানের সাথে যুল্মকে মিশ্রিত না করার শর্ত বর্ণিত হয়েছে। এমতাবস্থায় আমাদের মুক্তির উপায় কী? রাসূল (ﷺ) উত্তরে বললেন, ‘তোমরা আয়াতের প্রকৃত অর্থ বুঝতে সক্ষম হওনি। আয়াতে যুল্ম বলতে শিরককে বোঝানো হয়েছে। দেখ, অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, اِنَّ الشِّرۡکَ لَظُلۡمٌ  عَظِیۡمٌ ‘নিশ্চিত শিরক সর্বাধিক বড় যুল্ম’।[১] কাজেই আয়াতের অর্থ এই যে, যে ব্যক্তি ঈমান আনে, অতঃপর আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী এবং তার ইবাদতে কাউকে অংশীদার স্থির না করে, সে শাস্তির কবল থেকে নিরাপদ ও সুপথ প্রাপ্ত।

সুধী পাঠক! এই আয়াতটি তার পূর্বের আয়াতের সাথে সম্পৃক্ততা রেখে আমরা ঐ সম্প্রদায়ের মাঝে তুলনা করবো যারা শান্তি অর্জন করবে। এখন তাদের নিয়ে আলোচনা করব, যারা জীবনে শান্তি অর্জন করবে;

আমাদেরকে জীবনে অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আবেগ, ক্লান্তি, অবসাদ, হতাশা, দুঃখ-কষ্ট, রাগ, দুশ্চিন্তা। এতসবের মাঝে থেকেও আমরা কীভাবে শান্তি অর্জন করব, এই আয়াত থেকে সেটাই শিক্ষনীয়। বিশ্বাস এবং শান্তির মাঝে সম্পর্ক রয়েছে, অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং আত্মার প্রশান্তি। যারা সত্যিকার অর্থে ঈমান এনেছে এবং সেই ঈমানের ছদ্মবেশে কোন খারাপ কাজ করেনি, প্রকৃত শান্তি তাদের জন্যই রয়েছে। ঈমান আনা বলতে আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা, তাঁর শাস্তির ভয় করা, আল্লাহর উপর ভরসা করা, আল্লাহ যে বিধি-বিধান দিয়েছেন তাই আমাদের জন্য সর্বোত্তম- এই কথাকে মনেপ্রাণে আঁকড়ে ধরে, এর গভীরতা উপলব্ধি করে, আল্লাহর জন্য আল্লাহর নাম নিয়ে শরী‘আতের পথে আসা এবং আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা থেকে দূরে সরে আসা বোঝায়। কেননা আল্লাহ তা‘আলার ভাষ্য মতে, যারা আল্লাহর উপর সত্যিই বিশ্বাস স্থাপন করে, তারা আল্লাহর রাস্তায় এমন শান্তি খুঁজে পায় যা তারা ক্লাব, পার্টি, ড্রাগ, নেশা কোন কিছুতেই পায় না। বিনোদনের জন্য আমরা মুভির পর মুভি দেখে যাই, অথচ এটা আমাদের ভেতরকে তছনছ করে দেয়। এরপর আমরা ওই শূন্যস্থান পূর্ণ করার জন্য অন্য বিনোদনের আশ্রয় খুঁজি। এভাবে এই প্রক্রিয়া শেষ হয় না। কেননা এগুলো স্থায়ী ও স্থির কোনো প্রশান্তির উৎস নয়।

২- কুরআন থেকে বিমুখতার ভয়াবহতা ও কুরআনকে আঁকড়ে ধরার বা এর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করার সংশয়হীনতা

আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রেরিত কুরআনের উপর ঈমান ও আমলের বদৌলতে মানুষ উচ্চমর্যাদা লাভ করতে পারে। ইহকাল ও পরকালে শান্তি, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারে। আর কুরআন বিমুখ হলে মানুষ উভয় জগতে হবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত।

عَنْ مُحَمَّدِ بن جُبَيْرِ بن مُطْعِمٍ، عَنْ أَبِيْهِ، قَالَ: كُنَّا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ، بِالْجُحْفَةِ فَقَالَ: أَلَيْسَ تَشْهَدُوْنَ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، وَأَنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ، وَأَنَّ الْقُرْآنَ جَاءَ مِنْ عِنْدِ اللهِ؟ قُلْنَا: نَعَمْ، قَالَ: فَأَبْشِرُوْا فَإِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ طَرَفُهُ بِيَدِ اللهِ، وَطَرَفُهُ بِأَيْدِيْكُمْ، فَتَمَسَّكُوْا بِهِ، فَإِنَّكُمْ لَنْ تُهْلَكُوْا وَلَنْ تَضِلُّوْا بَعْدَهُ أَبَدًا.

জুবাইর ইবনু মুত্বঈম (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমরা ‘জুহফা’ নামক স্থানে একদা নবী (ﷺ)-এর সাথে ছিলাম। তখন তিনি বললেন, ‘তোমরা কি সাক্ষ্য দাও না যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন উপাস্য নেই, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল, আর কুরআন আল্লাহর নিকট থেকে এসেছে?’ আমরা বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ‘অতএব তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো, এই কুরআনের একাংশ আল্লাহর হাতে, আরেকাংশ তোমাদের হাতে। সুতরাং তোমরা একে আঁকড়ে ধর, তাহলে তোমরা তার পরে (অর্থাৎ কুরআনকে আঁকড়ে ধরার পরে) কখনই ধ্বংস হবে না এবং কখনই বিভ্রান্ত হবে না’।[২]

কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তির নিরাপত্তা, মর্যাদা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতেই বৃদ্ধি পায়। হাদীছে এসেছে,

أنَّ نَافِعَ بنَ عبدِ الحَارِثِ لَقِيَ عُمَرَ بعُسْفَانَ، وَكانَ عُمَرُ يَسْتَعْمِلُهُ علَى مَكَّةَ، فَقالَ: مَنِ اسْتَعْمَلْتَ علَى أَهْلِ الوَادِي، فَقالَ: ابْنَ أَبْزَى، قالَ: وَمَنِ ابنُ أَبْزَى؟ قالَ: مَوْلًى مِن مَوَالِيْنَا، قالَ: فَاسْتَخْلَفْتَ عَلَيْهِمْ مَوْلًى؟! قالَ: إنَّه قَارِئٌ لِكِتَابِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، وإنَّه عَالِمٌ بالفَرَائِضِ، قالَ عُمَرُ: أَمَا إنَّ نَبِيَّكُمْ ﷺ قدْ قالَ: إنَّ اللهَ يَرْفَعُ بهذا الكِتَابِ أَقْوَامًا، وَيَضَعُ به آخَرِينَ.

নাফি‘ ইবনু আব্দুল হারিছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ‘উসফান’ নামক স্থানে উমার ফারুক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য গেলেন। উমার ফারুক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাকে কর্মকর্তা হিসাবে মক্কায় নিযুক্ত করেছিলেন। অতঃপর তিনি নাফি‘কে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি মক্কা ও ত্বায়িফের উপত্যকাবাসীদের জন্য কাকে তোমার প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছ? তিনি বললেন, ইবনু আবযাকে। উমার ফারুক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ ইবনু আবযা? তিনি বললেন, আমাদের আযাদকৃত গোলামদের একজন। উমার ফারুক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, তুমি একজন ক্রীতদাসকে তাদের জন্য তোমার স্থলাভিষিক্ত করেছো? নাফি‘ বললেন, তিনি মহান আল্লাহর কিতাবের একজন বিজ্ঞ আলিম, ফারায়িয শাস্ত্রেও অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ বিচারক’। তখন উমার ফারুক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, তোমাদের নবী (ﷺ) যথার্থই বলেছেন, ‘এই কিতাবের অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহ অনেক জাতিকে মর্যাদায় উন্নীত করেন আবার কুরআন পরিত্যাগকারীদের অবনত করেন’।[৩]

কুরআনুল কারীম নিঃসন্দেহে ইহকাল ও পরকালের উচ্চসম্মান অর্জনের সোপান। ফলে কুরআন তিলাওয়াতকারীর সুনাম আসমানে ও যমীনে ছড়িয়ে পড়ে। রাসূল (ﷺ) বলেন,

عَلَيْكَ بِتِلَاوَةِ الْقُرْآنِ، فَإِنَّهُ نُوْرٌ لَّكَ فِي الْأَرْضِ وَذُخَرٌ لَّكَ فِي السَّمَاءِ

‘কুরআন তিলাওয়াতকে তুমি আবশ্যক করে নাও। কেননা এটি তোমার জন্য যমীনে আলোকবর্তিকা ও আসমানে ধনভাণ্ডার স্বরূপ’।[৪] সুতরাং যে ব্যক্তি স্বীয় হৃদয়কে কুরআনের দিকে ও আল্লাহর দিকে পরিচালিত করবে, মহান আল্লাহ তাকে ইহকালে ও পরকালে সর্বোচ্চ মর্যাদাবান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবেন। সে কারণে তিলাওয়াতকারীর কর্তৃত্ব ও প্রভাব তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবদিকে বিস্তৃত হয়। সুতরাং ক্বুরআনের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে সে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে এবং তাঁর সৃষ্টির কাছে মহা সম্মানিত হয়।

কুরআন প্রশান্তি অবতরণের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মাধ্যম। কুরআনে আছে শান্তির বার্তা। আছে রহমত প্রাপ্তির দিশা। যেমন বারা ইবনু আযিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

كَانَ رَجُلٌ يَقْرَأُ سُوْرَةَ الْكَهْفِ وَإِلَى جَانِبِهِ حِصَانٌ مَرْبُوْطٌ بِشَطَنَيْنِ فَتَغَشَّتْهُ سَحَابَةٌ فَجَعَلَتْ تَدْنُوْ وَتَدْنُوْ وَجَعَلَ فَرَسُهُ يَنْفِرُ فَلَمَّا أَصْبَحَ أَتَى النَّبِيَّ ﷺ فَذَكَرَ ذَلِكَ لَهُ فَقَالَ تِلْكَ السَّكِيْنَةُ تَنَزَّلَتْ بِالْقُرْآنِ.

‘জনৈক ব্যক্তি সূরা কাহফ তিলাওয়াত করছিল এবং তার পাশে তার ঘোড়া রশি দ্বারা বাঁধা ছিল। এমন সময় একখণ্ড মেঘমালা তাকে আচ্ছন্ন করল এবং তার নিকটবর্তী হতে লাগল। তখন তার ঘোড়া লাফাতে লাগল। অতঃপর সে ব্যক্তি সকালে নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট এসে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করল। তখন তিনি বললেন, তা ছিল আল্লাহর বিশেষ রহমত ও প্রশান্তি, যা কুরআন তিলাওয়াতের কারণে নেমে এসেছিল’।[৫]

উল্লেখিত হাদীছ থেকে বুঝা গেল যে, কুরআন তিলাওয়াত করলে আল্লাহর বিশেষ রহমত ও প্রশান্তি নাযিল হয়। ফেরেশতারা কুরআন তিলাওয়াত শোনার জন্য দল বেঁধে দুনিয়ায় নেমে আসেন। অথচ আজ মুসলিম সমাজ কুরআন থেকে বহুদূরে। আমাদের দূরাবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ হল: কুরআন থেকে বিমুখতা। আল্লামা ইকবাল মুসলিমদের দূরাবস্থার কথা বলতে গিয়ে ভেঙে পড়েন। তাঁর এক উর্দূ কবিতার লাইনে করুণ আর্তনাদ ফুটে ওঠে। তিনি বলেন,

وہ معزز تھے زمانے میں مسلماں ہو کر

اور تم خوار ہوئے تارک قرآں ہو کر

‘ওহ্ মু‘আযযায থে যামানা মে মুসালমাঁ হো কার।

আওর তুম খার হুয়ে তারিকে কুরআঁ হো কার’।

‘অর্থাৎ ইসলামের প্রথম যুগের মানুষ সম্মানিত ছিলেন কুরআনের বাহক হয়ে, আর তোমরা অপদস্থ হচ্ছ কুরআন ছেড়ে দিয়ে’। কবি ইকবাল যথার্থই বলেছেন। পুরো মুসলিম উম্মাহ আজ ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং অন্তর্জাতিকভাবে যেখানেই অধঃপতন ও আগ্রাসনের শিকার, গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এর মূলে হল: পবিত্র কুরআন থেকে আমাদের দূরে সরে যাওয়া। সময় যত গড়াচ্ছে কুরআন থেকে আমাদের দূরত্ব ততই বাড়ছে। কুরআন না আছে আমাদের সকালের তিলাওয়াতে, না আছে সারাদিনের ব্যস্ততায়। না আছে আমাদের পারিবারিক শাসনে, না আছে সুস্থ সুন্দর সমাজ গঠনে। কুরআন নেই আমাদের চেতনায়, নেই আমাদের দিনরাতের ভাবনায়। কুরআনের ভেতরে আমরা খুঁজি না আগামী দিনের প্রেরণা, কুরআন নিয়ে নেই আমাদের কোন তাড়না। কুরআন নেই আমাদের জীবন সমস্যার সমাধানে, নেই উম্মাহর রাষ্ট্রীয় সংবিধানে। মহাগ্রন্থ নেই আমাদের বিচারে, নেই কুরআনের বাহকদের প্রচারে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রসহ সর্বক্ষেত্রে আমরা সর্বগ্রাসী অধঃপতনের শিকার হয়েছি।

বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ যেসব ক্ষেত্রে অধঃপতনের শিকার। তন্মধ্যে অন্যতম হল: নৈতিক অধপতন, বিজাতীয় সংস্কৃতি লালন, ধর্মহীন শিক্ষাগ্রহণ, নাস্তিকতা পালন, স্বৈরশাসকদের তোষণ, দুর্বল ও প্রতিবেশির প্রতি অবহেলা, নববী আদর্শ থেকে দূরে সরে যাওয়া, সত্যের পথে মানুষকে না ডাকা, অন্যায় থেকে বিরত না রাখা, অন্যের অধিকারের ব্যাপারে বেপরোয়া মানসিকতা, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, বেপর্দা ইত্যাদি। গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এ সমস্যাগুলোর প্রতিশেধক পবিত্র কুরআনে বলে দেয়া হয়েছে। এ সবের বিরুদ্ধে কুরআনের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা আছে। কিন্তু আমরা তো কুরআন থেকে বহু দূরে! যে পবিত্র কুরআন আমাদের সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থার সংবিধান সেই কুরআন আজ সংকুচিত হতে হতে তাবীয-কবয এবং ইসালে ছাওয়াবের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। কোন সমস্যায় আক্রান্ত হলে আমরা মসজিদ-মাদরাসায় গিয়ে কুরআনের একটি কপি হাদিয়া দিয়ে আসি। অথচ একবারও ভাবি না, এই কুরআন খুললেই আমি আমার সমস্যার সামাধান পেয়ে যেতাম! কারণ মহান আল্লাহ তো মানবজাতির যাবতীয় সমস্যা ও প্রয়োজন খুলে খুলে বর্ণনা করার জন্যই কুরআন নাযিল করেছেন। কুরআনে জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান রয়েছে (সূরা আন-নাহল: ৮৯; সূরা আল-আন‘আম: ৫৯; সূরা আন-নামল: ৭৫; তাফসীরে ইবনে কাছীর, ২/৭১৪ পৃ.)। বিশিষ্ট ছাহাবী উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে এক ব্যক্তি বলেন, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। উত্তরে তিনি বলেন, ‘তুমি আল্লাহর কিতাবকে পথপ্রদর্শক হিসাবে গ্রহণ কর। কুরআনকে তোমার বিচারক বানাও। কারণ এটাই সেই বস্তু যা তোমাদের রাসূল (ﷺ) তোমাদের জন্য রেখে গেছেন। কুরআন তোমার জন্য সুপারিশকারী। কুরআন তোমার জন্য অনুসরণীয়। কুরআন এমন এক সাক্ষী যার সাক্ষ্য নিয়ে কারো কোন আপত্তি থাকবে না। এতে তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের আলোচনা আছে। তোমাদের জীবনের যাবতীয় বিষয়ের সমাধান আছে। এখন যা হচ্ছে এবং সামনে যা হবে তার সবই কুরআনে আছে’।[৬]

সুতরাং মুসলিম উম্মাহ পবিত্র কুরআন থেকে দূরে সরে যাওয়ার মাধ্যমেই অধঃপতনের শিকার হয়েছে। অতএব এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কুরআনের কাছে ফিরে আসার মাধ্যমেই হবে। যে জাতিকে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন দিয়ে সম্মানিত করেছেন সে জাতি যদি কুরআন থেকে দূরে সরে অন্য কোথাও নিজেদের সম্মান খোঁজে তবে আল্লাহ তাদেরকে পদে পদে লাঞ্ছিত করবেন, এটাই স্বাভাবিক। যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের মাধ্যমে অন্ধকার থেকে আলোর পথে এনেছেন তারা যদি কুরআন ছেড়ে আবার অন্ধকারে ফিরে যায় অথবা ভিন্নপথে আলো খোঁজে তবে তাদের কপালে অধঃপতনের কলঙ্কতিলক সুনিশ্চিত। পবিত্র কুরআনকে আমাদের চরিত্রের মধ্যে গেঁথে নিতে পারলেই এ সমস্যা থেকে আমাদের উত্তরণ সম্ভব। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে কেউ একজন জিজ্ঞাসা করেন, আল্লাহর রাসূলের চরিত্র কেমন ছিল? উত্তরে তিনি বলেন, ‘কুরআনই আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর চরিত্র ছিল’।[৭] বলা বাহুল্য, কুরআনকে চরিত্র বানানোর অর্থ হাদীছ ছেড়ে দেয়া নয়। কুরআন অনুসরণ করতে গেলে হাদীছকেও অবশ্যই মানতে হবে। কারণ কুরআনের অনেক জায়গায় আল্লাহকে অনুসরণ করার নির্দেশের সাথে সাথে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-কে অনুসরণের কথাও বলা হয়েছে। এ জন্যই প্রিয় নবী (ﷺ) এ উম্মতকে অধঃপতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষনে পবিত্র কুরআনকে আঁকড়ে ধরার পাশাপাশি সুন্নাতে রাসূলকেও আঁকড়ে ধরতে বলেছেন’।[৮]

আমরা সেই জাতি যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন দিয়ে সম্মানিত করেছেন। সুতরাং আমরা যদি কুরআন ছাড়া অন্য কোন মাধ্যমে সম্মান খুঁজি তবে আল্লাহ আমাদেরকে পদে পদে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করবেন। আর এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ইসলাম আমাদের নিকট এসেছে কুরআনের মাধ্যমে। তাই কুরআনের কাছে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমেই আমাদের সম্মান পুনরুদ্ধার করার এবং জাতির অধঃপতন থেকে বাঁচার উপায় নিহিত রয়েছে। তাই আসুন কুরআনের পথে। আসুন আমাদের হারানো সম্মান ও ইজ্জতের পথে। উল্লেখ্য, শিরকমুক্ত জীবন যাপনে নিরাপত্তা ও কুরআনকে আঁকড়ে ধরার প্রাপ্তি সচক্ষে দেখতে চাইলে একবার সঊদী আরবের দিকে দৃষ্টিপাত করা দরকার। এ আহ্বান শুনার পর, অনেকেই হয়তো আমাদের উপর সঊদী আরবের দালালী করার অপবাদ আরোপ করবে। তবুও নিন্দাকারীর নিন্দার ভয়কে উপেক্ষা করে সত্য কথা তুলে ধরা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমরা এ কথা বলছি না যে, সঊদী আরবের সব মানুষই ফেরেশতা, তারা সবাই জান্নাতী। মানুষ হিসাবে প্রত্যের মধ্যেই দোষত্রুটি থাকা স্বাভাবিক, তাদের মধ্যেও আছে। তবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ মানার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে তারা সবার চাইতে এগিয়ে আছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বিংশ শতাব্দীতে পুরো বিশ্ব জুড়ে ইসলামফোবিয়ার ব্যাপক উত্থান হয়েছে। ইসলাম ধর্ম ব্যতীত বর্তমান বিশ্বে আরো যত ধর্ম আছে, প্রত্যেকের ধর্মবিশ্বাস, ধর্মচর্চা, আচার-আচরণ, রীতিনীতি, বিধি-বিধান ও নিয়মাবলী ভিন্ন ভিন্ন। তাদের আপোসে এতো বৈপরীত্য থাকা সত্ত্বেও ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্ধেষ পোষণ করার ক্ষেত্রে কিন্তু বিশ্বের সকল বিধর্মীরা একত্রিত হয়ে যায়। সকল অমুসলিম ইসলাম ও মুসলিমদের বিরোধিতায় একজোট। অনুরূপভাবে ইসলাম ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন দলের মধ্যেও কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। কুরআন ও সুন্নাহকে বুঝার ও মানার ক্ষেত্রে বেশকিছু বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু তাওহীদের দেশ সঊদী আরবের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে সমস্ত দল একজোট হয়ে যায়। অর্থাৎ মোদ্দাকথা হল বিশ্বের সকল বিধর্মী ইসলামের বিরুদ্ধে হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করে। আর ইসলাম ধর্মের নামে তৈরীকৃত প্রায় সবকটি দেশ ও দলই সঊদী আরব তথা আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করে। মিথ্যা খবর প্রচার করে সঊদী আরবকে বদনাম করার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে। আল্লাহ তা‘আলার কোটি কোটি শুকরিয়া যে, এত হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতার পরেও সঊদী আরব এখনো বাতিলের বিরুদ্ধে টিকে রয়েছে। কারণ একটাই, তাহল- সঊদী আরব তাওহীদের দেশ, তারা শিরকের বিরুদ্ধে অত্যধিক কঠোর এবং বিদ‘আতের বিরুদ্ধে সর্বদা সজাগ। তাদের প্রত্যেক ঘরে ঘরে কুরআনের চর্চা আছে। প্রত্যেক মসজিদে জামা‘আতের পর নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করা হয়।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)


* মুর্শিদাবাদ, ভারত।

[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৬২৯, ৬৯১৮।

[২]. ছহীহুত তারগীব, হা/৩৮, ৩৯; ছহীহুল মুসনাদ, হা/১২৩১।

[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮১৭; ইবনু মাজাহ, হা/২১৮।

[৪]. ছহীহুত তারগীব হা/১৪২২, ২২৩৩।

[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০১১; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৯৫।

[৬]. সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৯২।

[৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭৪৬।

[৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২১৮; আবূ দাঊদ, হা/১৯০৫; ইবনু মাজাহ, হা/৩০৭৪।




প্রসঙ্গসমূহ »: মুসলিম জাহান
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম) -এর আগমন সংশয় নিরসন (৬ষ্ঠ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
যমযমের ইতিহাস ও ফযীলত - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
বিদ‘আত পরিচিতি - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
মুছীবতে ধৈর্যধারণ করার ফযীলত - শায়খ আখতারুল আমান বিন আব্দুস সালাম
সচ্চরিত্রই মানব উন্নতির চাবিকাঠি - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
বিদ‘আত পরিচিতি (৩২তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৭ম কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
বিদ‘আত পরিচিতি (১৯তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
বিদ‘আত পরিচিতি (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন : সংশয় নিরসন (৩য় কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন

ফেসবুক পেজ