সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৯:২৭ পূর্বাহ্ন

আশূরায়ে মুহাররম : করণীয়  ও বর্জনীয়

-ইউনুস বিন আহসান*



ভূমিকা

আশূরা নামটি শুনলেই আমাদের মনে হয় ভ্রান্ত শী‘আদের তথাকথিত তাজিয়া ও হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সপরিবারে কারবালার প্রান্তরে শাহাদতবরণের মর্মান্তিক ঘটনা। অথচ কারবালার ঘটনার সাথে আশূরার দূরতম কোন সম্পর্কও নেই। আশূরা হল- আরবী মাসসমূহের প্রথম মাস তথা মুহাররম মাসের দশম তারিখ। এই তারিখে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অপার অনুগ্রহে মূসা (আলাইহিস সালাম) ও তার ক্বওমকে যালিম ফের‘আউনের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন ও ফের‘আউনকে তার সৈন্য-সামন্তসহ নদীতে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। যে ফের‘আউন আজও ঘৃণার পাত্র হয়ে লাশ হয়ে মিশরের জাদুঘরে বিদ্যমান। অত্যাচারী ফের‘আউনের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে মূসা (আলাইহিস সালাম) আল্লাহর শুকরিয়াস্বরূপ এই তারিখে (১০ মুহাররম) ছিয়াম রেখেছিলেন।[১] এই আশূরাকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে ভালো ও মন্দ দুই ধরনের আমলই বিদ্যমান। একদল অতি আবেগী মানুষ এই দিনকে কেন্দ্র করে অনেক বাড়াবাড়ি করে থাকে। বিশেষভাবে শী‘আরা এই দিনকে সামনে রেখে তাজিয়া, আতশবাজি, পটকাবাজি, ধারালো অস্ত্র দ্বারা নিজের শরীর ক্ষত-বিক্ষত করাসহ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। ইসলামে যার কোন স্থান নেই। এই আশূরা বিষয়ে আমাদের যেমন কিছু করণীয় কাজ আছে, তেমনি আছে কিছু বর্জনীয় কাজ। নিম্নে এ বিষয়ে এক নাতিদীর্ঘ আলোচনা তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

মুহাররম মাস ও আশূরার ফযীলত

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

اِنَّ عِدَّۃَ الشُّہُوۡرِ عِنۡدَ اللّٰہِ اثۡنَا عَشَرَ شَہۡرًا فِیۡ  کِتٰبِ اللّٰہِ یَوۡمَ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ مِنۡہَاۤ  اَرۡبَعَۃٌ  حُرُمٌ ؕ ذٰلِکَ الدِّیۡنُ الۡقَیِّمُ ۬ۙ  فَلَا تَظۡلِمُوۡا فِیۡہِنَّ اَنۡفُسَکُمۡ وَ قَاتِلُوا الۡمُشۡرِکِیۡنَ کَآفَّۃً کَمَا یُقَاتِلُوۡنَکُمۡ کَآفَّۃً ؕ وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّ  اللّٰہَ  مَعَ الۡمُتَّقِیۡنَ

‘নিশ্চয় মাসসমূহের সংখ্যা হচ্ছে আল্লাহর নিকট বারো মাস, আল্লাহর কিতাবে, আল্লাহর যমীন ও আসমানসমূহ সৃষ্টি করার দিন হতেই, এর মধ্যে বিশেষরূপে চারটি মাস হচ্ছে সম্মানিত, এটাই হচ্ছে সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন। অতএর তোমরা এ মাসগুলোতে (দ্বীনের বিরুদ্ধাচরণ ও এই মাসগুলোর সম্মানহানী করে) নিজেদের ক্ষতিসাধন করো না, আর সকল মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের সকলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। আর জেনে রেখো যে, আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সাথে রয়েছেন’ (সূরা আত-তওবাহ : ৩৬)।

হিজরী সনের ১২টি মাসের মধ্যে যে চারটি মাস হারাম বা সম্মানিত হিসাবে পরিচিত তাহল- যিলক্বদ, যিলহজ্জ, মুহাররম ও রজব।[২] এই চারটি মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ থাকলেও আরবরা তা মানত না। তারা কৌশলের আশ্রয় নিত। তারা মুহাররম মাসকে ‘ছফরুল আওয়াল’ নাম দিয়ে তাদের ইচ্ছামত যুদ্ধের সময় আগা-পিছা করত। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদের এই যাবতীয় কর্মকাণ্ড বাতিল করে এই মাসের নামকরণ করলেন মুহাররম নামে। তাইতো এই মাসকে ‘শাহরুল্লাহিল মুহাররম’ বলা হয়। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللهِ الْمُحَرَّمُ وَأَفْضَلُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الْفَرِيْضَةِ صَلَاةُ اللَّيْلِ

‘রামাযানের পরে সর্বোত্তম ছিয়াম হল- আল্লাহর মাস মুহাররমের ছিয়াম এবং ফরয ছালাতের পর সর্বোত্তম ছালাত হল- রাতের নফল ছালাত’।[৩] এখানে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুহাররমকে আল্লাহর মাস বলেছেন। এটাই এ মাসের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব। কেননা এই নামটি ইসলামী নাম। কারণ জাহেলী যুগে আরবরা এ মাসকে ‘ছফরুল আওয়াল’ তথা প্রথম ছফর মাস নাম দিয়ে যুদ্ধের সময় হের-ফের করত। অতঃপর ইসলাম আগমনের পর আল্লাহ তা‘আলা এসব কিছু হারাম করে এই মাসের নাম দিলেন মুহাররম। তাই আল্লাহ তা‘আলার দিকে সম্বন্ধ করে একে ‘শাহরুল্লাহ’ বলা হয়। আর অন্য যত মাস আছে সেগুলোর নাম ইসলাম আগমনের পরেও পরিবর্তন করা হয়নি।[৪] অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, صِيَامُ يَوْمِ عَاشُوْرَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِيْ قَبْلَهُ ‘আশূরার ছিয়ামের ব্যাপারে আমি আল্লাহ তা‘আলার কাছে আশা রাখি যে, তিনি এর বিনিময়ে বিগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন’।[৫]

গুরুত্ব

আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু এই দিনে মূসা (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর সম্প্রদায় বানী ইসরাঈলকে ফের‘আউনের কবল থেকে মুক্ত ও ফের‘আউনকে ধ্বংস করেছিলেন। তাই মূসা (আলাইহিস সালাম) আল্লাহর শুকরিয়াস্বরূপ ছিয়াম পালন করেছিলেন।[৬] এমনকি মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর ইন্তেকালের পর বানী ইসরাঈল শুধু নয় ইসলাম আগমনের পূর্বে ইহুদী, খ্রিষ্টান, মক্কার কুরাইশরা ও রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই ছিয়াম রাখতেন। পরে মদীনায় হিজরতের পর এদিনে তিনি নিজেও ছিয়াম পালন করেন এবং ছাহাবীগণকেও ছিয়াম পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।[৭] শুধু তাই নয় ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَدِمَ الْمَدِيْنَةَ فَوَجَدَ الْيَهُوْدَ صِيَامًا يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ فَقَالَ لَهُمْ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا هَذَا الْيَوْمُ الَّذِيْ تَصُوْمُوْنَهُ؟ فَقَالُوْا هَذَا يَوْمٌ عَظِيْمٌ أَنْجَى اللهُ فِيْهِ مُوْسَى وَقَوْمَهُ وَغَرَّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ فَصَامَهُ مُوْسَى شُكْرًا فَنَحْنُ نَصُوْمُهُ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَنَحْنُ أَحَقُّ وَأَوْلَى بِمُوْسَى مِنْكُمْ فَصَامَهُ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ  وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ

‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন হিজরত করে মদীনায় আগমন করলেন, তখন তিনি ইহুদীদের আশূরার ছিয়াম পালন করতে দেখলেন। ফলে তাদেরকে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, এটা তোমাদের কিসের ছিয়াম? তাঁরা বলল, এটি একটি মহান দিন। এই দিনেই আল্লাহ তা‘আলা মূসা ও তার জাতিকে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফের‘আউন ও তার সম্প্রদায়কে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এজন্য শুকরিয়া হিসাবে মূসা (আলাইহিস সালাম) এদিন ছিয়াম পালন করেন। তাই আমরাও এদিন ছিয়াম পালন করি। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে আমরাই বেশি হক্বদার ও বেশি নিকটবর্তী। অতঃপর তিনি ছিয়াম রাখেন ও সকলকে ছিয়াম রাখার নির্দেশ দেন।[৮] (যা তিনি পূর্ব থেকেই রাখতেন।)

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ছাহাবায়ে কেরাম আশূরার ছিয়ামকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন নিম্নের হাদীছের দিকে দৃষ্টিপাত করলে তা আরো স্পষ্ট হবে। রুবাঈ বিনতে মু‘আব্বিয বিন আফরা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَرْسَلَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ غَدَاةَ عَاشُوْرَاءَ إِلَى قُرَى الْأَنْصَارِ الَّتِيْ حَوْلَ الْمَدِيْنَةِ مَنْ كَانَ أَصْبَحَ صَائِمًا فَلْيُتِمَّ صَوْمَهُ وَمَنْ كَانَ أَصْبَحَ مُفْطِرًا فَلْيُتِمَّ بَقِيَّةَ يَوْمِهِ فَكُنَّا بَعْدَ ذَلِكَ نَصُوْمُهُ وَنُصَوِّمُ صِبْيَانَنَا الصِّغَارَ مِنْهُمْ إِنْ شَاءَ اللهُ وَنَذْهَبُ إِلَى الْمَسْجِدِ فَنَجْعَلُ لَهُمُ اللُّعْبَةَ مِنَ الْعِهْنِ فَإِذَا بَكَى أَحَدُهُمْ عَلَى الطَّعَامِ أَعْطَيْنَاهَا إِيَّاهُ عِنْدَ الْإِفْطَارِ

‘আশূরার দিন সকালে রাসূলুুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনার পার্শ্ববর্তী আনছারদের গ্রামসমূহে ঘোষকদের পাঠিয়ে বললেন, যে ব্যক্তি ছিয়াম অবস্থায় সকাল করেছে, সে যেন ছিয়াম পূর্ণ করে। আর যে ব্যক্তি ছিয়াম না রেখে সকাল করেছে, সে যেন বাকী দিনটা ঐভাবে (না খেয়ে) অতিবাহিত করে। অতঃপর আমরা এরপর থেকে এদিন ছিয়াম রাখতাম ও আমাদের ছোট বাচ্চাদের ছিয়াম রাখাতাম। আমরা তাদের জন্য পশমের খেলনা বানিয়ে রাখতাম ও তা সাথে নিয়ে যেতাম। যখন তাদের কেউ খাওয়ার জন্য কাঁদত তখন তাকে ওটা দিতাম, (এভাবে খেলতে খেলতে) ইফতারের সময় হয়ে যেত’।[৯]

করণীয়

আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু মূসা (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর সম্প্রদায়কে যালিম ফের‘আউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন তাই আশূরাকে কেন্দ্র করে আমাদের একমাত্র করণীয় হল- মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর মত আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়াস্বরূপ ছিয়াম পালন করা। আর সেটা মুহাররমের ৯ ও ১০ তারিখ অথবা ১০ ও ১১ তারিখ অথবা কমপক্ষে ১০ তারিখ। আশূরাকে কেন্দ্র করে এ ছাড়া আর কোন ধরনের আমল বা আচার-অনুষ্ঠান শরী‘আত সম্মত নয়।

৯ ও ১০ তারিখে ছিয়াম রাখার ব্যাপারে হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا يَقُوْلُ حِيْنَ صَامَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّهُ يَوْمٌ تُعَظِّمُهُ الْيَهُوْدُ وَالنَّصَارَى فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ إِنْ شَاءَ اللهُ صُمْنَا الْيَوْمَ التَّاسِعَ قَالَ فَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ حَتَّى تُوُفِّيَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ

আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আশূরার ছিয়াম রাখেন ও রাখার জন্য নির্দেশ দেন। (পরবর্তীতে) ছাহাবায়ে কেরাম বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এটি এমন একটি দিন যাকে ইহুদী ও খ্রিষ্টানরা সম্মান করে। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আল্লাহ চাহেন তো যখন আগামী বছর আসবে তখন আমরা নবম তারিখেও ছিয়াম রাখব। রাবী বলেন, কিন্তু পরের বছর আশূরা আসার পূর্বেই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মৃত্যুবরণ করেন।[১০]

অপর হাদীছে তিনি নবম তারিখে ছিয়াম রাখার ব্যাপারে দৃঢ়তা ব্যক্ত করেছেন। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, لَئِنْ بَقِيْتُ إِلَى قَابِلٍ لَأَصُوْمَنَّ التَّاسِعَ ‘যদি আগামী (বছর) বেঁচে থাকি তবে অবশ্যই নবম তারিখেও ছিয়াম রাখব’।[১১]

১০ ও ১১ তারিখে ছিয়াম রাখার ব্যাপারে হাদীছে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ  صُوْمُوْا يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ وَ خَالِفُوا الْيَهُوْدَ صُوْمُوْا قَبْلَهُ يَوْمًا أَوْ بَعْدَهُ يَوْمًا

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা আশূরার দিন ছিয়াম রাখ এবং ইহুদীদের বিপরীত কর। তোমরা আশূরার সাথে তার পূর্বের একদিন অথবা পরের একদিন ছিয়াম পালন কর’।[১২]

সুধী পাঠক! উপরিউক্ত দুই ধরনের হাদীছ পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় যে, নবম ও দশম তারিখে ছিয়াম রাখা সর্বোত্তম। তবে দশম ও একাদশ তারিখেও ছিয়াম রাখা যায়। আবার রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেহেতু শুধু দশম তারিখে ছিয়াম রেখেছিলেন। তাই শুধু দশম তারিখেও ছিয়াম রাখা যায়।

বর্জনীয়

আশূরাকে কেন্দ্র করে ছিয়াম রাখা ছাড়া অন্য কোন আয়োজন বা আমল সবই বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত। তাই তা সবই বর্জনীয়। আমাদের দেশে এ দিনকে কেন্দ্র করে সরকারী ছুটি ঘোষিত হয় ও সরকারীভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শী‘আ-সুন্নী মিলে নানা বিদ‘আতে লিপ্ত হয়। শী‘আরা তাযিয়া মিছিল বের করে, হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কল্পিত কবর রচনা করে। এমনকি তারা বুক ও গাল চাপড়ে মাতম করে এবং গায়ের কাপড় ছিড়ে ফেলে, যা ইসলামী শরী‘আতের সম্পূর্ণ বিরোধী। হদীছে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَطَمَ الْخُدُوْدَ وَشَقَّ الْجُيُوْبَ وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ

আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয় যে গালে আঘাত করে, বুকের কাপড় ছিড়ে ফেলে ও জাহেলী যুগের ন্যায় মাতম করে’।[১৩] তাছাড়া অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন, أَنَا بَرِىءٌ مِمَّنْ حَلَقَ وَسَلَقَ وَخَرَقَ ‘আমি ঐ ব্যক্তি হতে দায়মুক্ত, যে ব্যক্তি শোকে মাথা মুণ্ডন করে, উচ্চৈঃস্বরে কাঁদে ও বুকের কাপড় ছিড়ে ফেলে’।[১৪]

এছাড়া তারা যে চরম ধৃষ্টতার পরিচয় দেয় তা হল- তারা আবূ বকর, ওমর, ওছমান ও আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-সহ অনেক জালীলুল ক্বদর ছাহাবীকে গালি দেয়। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাহাবীদেরকে গালি দিতে স্পষ্টভাবে নিষেধ করেছেন, তিনি বলেন,

لَا تَسُبُّوْا أَصْحَابِيْ فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلَا نَصِيْفَهُ

‘তোমরা আমার ছাহাবীদের গালি দিয়ো না। কেননা (তারা এত বেশি মর্যাদাবান যে,) তোমাদের কেউ যদি ওহুদ পাহাড় সমপরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে তবুও তাদের এক মুদ অথবা অর্ধমুদ পরিমাণ ব্যয়ের সমান মর্যাদায় পৌঁছতে পারবে না’।[১৫]

এই মাতম, তাজিয়া ও মর্সিয়া শোকানুষ্ঠান করা, হায় হুসেন! হায় ফাতিমা! হায় আলী! এগুলো সবই জাহেলী প্রথা ও শিরক। এটা সর্বপ্রথম আব্বাসীয় খলীফা মুতী বিন মুক্বতাদিরের শাসনামলে মিশরের প্রখ্যাত শী‘আ আমীর মুঈযুদ্দৌলা ৩৫২ হিজরীতে চালু করে এবং সরকারীভাবে ছুটি ঘোষণা করে ও সমস্ত দোকান-পাট বন্ধ রেখে শোক প্রকাশের জন্য ফরমান জারি করে।[১৬] শুধু তাই নয় তারা আশূরার ছিয়ামকে বাতিল করার জন্য জাল হাদীছ পর্যন্ত বানিয়েছে। যেমন,

১. ইমাম রেজাকে আশূরার ছিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এ দিনে এজিদ পরিবার হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও তাঁর পরিবারের শাহাদাতে আনন্দ-উল্লাস করে ছিয়াম রেখেছিল। অতএব যে এই দিনে ছিয়াম রাখবে সে ক্বিয়ামতের দিন বক্র অন্তর নিয়ে উপস্থিত হবে’।[১৭]

২. ‘যে এই দিনে ছিয়াম রাখবে তার অবস্থা এজিদের পরিবারের অবস্থা হবে। অর্থাৎ জাহান্নামে প্রবেশ করবে’।[১৮]

অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নামে ইচ্ছাকৃত কোন হাদীছ বানানোর ব্যাপারে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারী দিয়েছেন। যেমন,

عَنِ الْمُغِيْرَةِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ إِنَّ كَذِبًا عَلَيَّ لَيْسَ كَكَذِبٍ عَلَى أَحَدٍ مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ

মুগীরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, ‘নিশ্চয় আমার প্রতি মিথ্যারোপ করা সাধারণ কারো উপর মিথ্যারোপের ন্যায় নয়। যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত আমার প্রতি মিথ্যারোপ করবে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়’।[১৯]

উপসংহার

আশূরা ও মুহাররমকে কারবালার সাথে জুড়ে দিয়ে আরো অনেক বিদ‘আত সমাজে প্রচলিত আছে। আমাদের মনে রাখা যরূরী যে, আশূরার সাথে কারবালার দূরতম কোন সম্পর্কও নেই। আর মুহাররম মাসের নবম ও দশম তারিখে ছিয়াম রাখা ছাড়া আশূরা কেন্দ্রিক যা কিছু করা হয় তা সবই ভিত্তিহীন। তাই এগুলো বর্জন করা আমাদের জন্য আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!!


*শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬২।
[২]. আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনু কাছীর আদ-দিমাস্কী, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম (দারু ত্বাইয়েবা, ২য় সংস্করণ, ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ৯।
[৩]. ছহীহ মুসলিম হা/১১৬৩।
[৪]. ফাতাওয়া আল-আযহার, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৩৬১।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬২।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৩০।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/২০০২; ছহীহ মুসলিম, হা/১১২৫।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৩৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৩০।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯৬০; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৩৬।
[১০]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৩৪; আবূ দাঊদ, হা/২৪৪৫, সনদ ছহীহ।
[১১]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৩৪।
[১২]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা, হা/২০৯৫; আলবানী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, হাদীছটির সনদে ইবনু আবী লায়লা নামক রাবী থাকায় হাদীছটি দুর্বল। কেননা তার মুখস্থ শক্তি দুর্বল। তবে ইমাম ত্বাহাবী ও বায়হাক্বীর নিকটে হাদীছটি মাওকূফ সূত্রে ছহীহ।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/১২৯৪, ১২৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৫।
[১৪]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৪।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৬৭৩; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৪০।
[১৬]. ইবনুল আছীর, আল-কামিল ফিত তারীখ (বৈরূত : দারুল কিতাবিল ‘আরাবী, ১ম সংস্করণ, ১৪১৭ হি./১৯৯৭ খ্রি. হিজরী ক্রমিক ৩৫২ বর্ষ মুহাররম মাস, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৪৫।
[১৭]. ছিয়ামু ‘আশূরা, পৃ. ১১৭-১১৮; মান ক্বাতালাল হুসাইন, পৃ. ৯৫; আশুরা ও কারবালা, পৃ. ২১।
[১৮]. ছিয়ামু ‘আশুরা, পৃ. ১১৮; মান ক্বাতালাল হুসাইন, পৃ. ৯৫; আশুরা ও কারবালা, পৃ. ২২।
[১৯]. ছহীহ বুখারী, হা/১২৯১; ছহীহ মুসলিম, হা/৩।




রজব মাসের বিধানসমূহ - অনুবাদ : ইউনুস বিন আহসান
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৭ম কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
ভ্রান্ত ফের্কাসমূহের ঈমান বনাম আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ঈমান : একটি পর্যালোচনা - ড. আব্দুল্লাহিল কাফী বিন লুৎফর রহমান মাদানী
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব ও মূল্যায়ন - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩টি উপায় (শেষ কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
কেমন ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রামাযানের দিনগুলো? - শরীফ বিন আব্দুস সামাদ
মীলাদুন্নবী ও আমাদের অবস্থান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
কুরআন মাজীদের উপর বিদ‘আতের আবরণ - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
মুসলিম বিভক্তির কারণ ও প্রতিকার (শেষ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
রামাযানে দাওয়াতী কাজের গুরুত্ব ও প্রভাব - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন

ফেসবুক পেজ