ঈদুল ফিতরে করণীয় ও বর্জনীয়
-আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ*
ভূমিকা
মাহে রামাযান একটি ঈমানী পাঠশালা, সারা বছরের পাথেয় উপার্জন, সারা জীবনের মাকছাদকে শানিত করার জন্যে এটি একটি রূহানি ময়দান। যেখানে স্বচ্ছতা পায় অন্তরাত্মা। মানসিক প্রশান্তিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠে মুমিনের হৃদয়। আমল, শরী‘আত পরিপন্থী আচার-ব্যবহার পরিত্যাগ করে চরিত্র সংশোধন করে নিতে পারে। এর পরই আসে ঈদুল ফিতর, যেদিন ভ্রাতৃত্ব, ভালবাসা আর আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে মুসলিম জাহান। পারস্পরিক শত্রুতা, হিংসা-বিদ্বেষ ও বিভক্তি-বিভেদ ভুলে সকলেই সমবেত হয় ঈদগাহে।
ঈদুল ফিতর-এর পরিচয়
‘ঈদুল ফিতর’ আরবী (عيد) ‘ঈদ’ ও (الفطر ) ‘ফিতর’ শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে গঠিত। ‘ঈদ’-এর আভিধানিক অর্থ উৎসব, পর্ব, ঋতু, মৌসুম,[১] খুশি, আনন্দ ইত্যাদি। শব্দটি আরবী عود মাছদার থেকে উৎপত্তি হওয়ায় এর অন্য অর্থ হল, প্রত্যাবর্তন, প্রত্যাগমন।[২] আর الفطر ‘ফিতর’ অর্থ হল ছিয়াম ভঙ্গকরণ, ইফতার ইত্যাদি।[৩] সুতরাং عيد الفطر ‘ঈদুল ফিতর’ অর্থ হচ্ছে- ছিয়াম ভঙ্গকরণের আনন্দ বা রামাযান পরবর্তী খুশির পর্ব।
ঈদুল ফিতর-এর প্রচলন
২য় হিজরী সনে ছিয়াম ফরয হওয়ার সাথে সাথে ‘ঈদুল ফিতর’-এর প্রচলন হয়।[৪] তবে এর পিছনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক পেক্ষাপট। ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ২য় হিজরী সনে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় হিজরত করার পরে দেখলেন যে, মদীনাবাসী বছরে উক্ত দু’দিন খেলাধুলা ও আনন্দ করে থাকে। তখন তিনি তাদেরকে উক্ত দু’দিন উৎসব পালন করতে নিষেধ করেন এবং ‘ঈদুল ফিতর’ ও ‘ঈদুল আযহা’-কে মুসলিমদের জন্য আনন্দের দিন নির্ধারণ করেন। তিনি বলেন, قَدْ أَبْدَلَكُمُ اللهُ بِهِمَا خَيْرًا مِنْهَا يَوْمُ الْأَضْحَى وَيَوْمُ الْفِطْرِ ‘আল্লাহ তোমাদের ঐ দু’দিনের বদলে দু’টি মহান খুশির দিন প্রদান করেছেন ‘ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর’।[৫]
ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
‘ঈদুল ফিতর’ মুসলিম উম্মাহর নিকট অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। এ দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য হল- (১). ঈদুল ফিতর মুসলিমদের অন্তরে ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দের প্রশিক্ষণী চেতনাকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে। (২). এ দিন ছোট-বড়, ধনী-গরীব, শত্রু-মিত্র, ইয়াতীম-নিঃস্ব, রাজা-প্রজা সর্বোপরি সকলের মাঝে সাম্য ও ঐক্য সুদৃঢ়করণের দিন। (৩). গরীব-দুঃখীর দুঃখ-দুর্দশা দূরীকরণ এবং নিজেকে ও নিজের অর্থ-সম্পদকে কলুষমুক্ত ও পূত-পবিত্র করণের জন্য মানুষ রামাযান মাসে যে ‘যাকাত’ ও ‘ছাদাক্বাতুল ফিতর’ প্রদান করে তারই আত্মিক তৃপ্তি অর্জন ও আনন্দ প্রকাশের দিন ঈদুল ফিতর। (৪). এ দিন ‘লাইলাতুল ক্বদর’-এর সামান্য ইবাদতের বিনিময়ে হাযার হাযার রজনীর ইবাদতের সমতুল্য নেকী প্রদানের কারণে দু’রাক‘আত ছালাত আদায়ের মাধ্যমে মহান স্রষ্টার প্রতি শুকরিয়া প্রকাশের দিন।
ঈদের দিনের করণীয়সমূহ
(১) ঈদের দিন গোসল করা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া :
ঈদের দিন প্রত্যুষে ওযূ ও গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা অর্জন করত ঈদগাহে গমন করা মুস্তাহাব। হাদীছে এসেছে- নাফে‘ থেকে বর্ণিত, أَنَّ عَبْدَ اللهِ بْنَ عُمَرَ كَانَ يَغْتَسِلُ يَوْمَ الْفِطْرِ قَبْلَ أَنْ يَغْدُوَ إِلَى الْمُصَلَّى ‘নিশ্চয় আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) ঈদুল ফিতরের দিন প্রত্যুষে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন’।[৬]
(২) সর্বোত্তম পোশাক পরিধান ও সাজসজ্জা গ্রহণ করা :
পুরুষরা ঈদুল ফিতরের দিন সকালে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করে সুসজ্জিত হয়ে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। এর সমর্থনে নিম্নোক্ত হাদীছটি উল্লেখ করা যেতে পারে। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘বাজারে বিক্রি হচ্ছিল এমন একটি রেশমী জুব্বা নিয়ে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এটি ক্রয় করে নিন। ঈদের সময় এবং প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এটি দিয়ে নিজেকে সজ্জিত করবেন’।[৭] এই হাদীছ থেকে বুঝা যায় ঈদের দিন সুসজ্জিত হওয়া যায়।[৮] ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, كَانَ يَلْبَسُ يَوْمَ الْعِيْدِ بُرْدَةً حُمَرَاءَ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈদের দিন লাল চাদর পরিধান করতেন’।[৯]
মহিলারা অভ্যন্তরীণভাবে সুসজ্জিত হবে, তবে সুগন্ধি মেখে ও বাহ্যিক সৌন্দর্য প্রদর্শনী করে বের হবে না। তারা বড় ওড়না বা চাদরে আবৃত হয়ে পর্দা সহকারে বের হবে। কারো ওড়না বা চাদর না থাকলে অন্য কোন বোনের ওড়নায় বা চাদরে শামিল হয়ে বের হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, لِتُلْبِسْهَا صَاحِبَتُهَا مِنْ جِلْبَابِهَا ‘তার সাথী তাকে নিজের চাদর দ্বারা আবৃত করে নিয়ে যাবে’।[১০]
(৩) ছাদাক্বাতুল ফিতর প্রদান করা :
ঈদুল ফিতরের দিনে অন্যতম প্রধান কাজ হল, ফিতরা প্রদান করা। ছোট-বড়, নর-নারী, স্বাধীন-পরাধীন (গোলাম) প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির[১১] পক্ষ থেকে এক ছা‘ (প্রায় ২.৫০ কেজি চাউল) পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য ফিতরা হিসাবে আদায় করা ফরয। আবু সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে এক ছা‘ খাদ্য দ্রব্য ফিতরা হিসাবে প্রদান করতাম। আর আমাদের খাদ্য দ্রব্য ছিল যব, কিশমিশ, পনীর এবং খেজুর।[১২] উল্লেখ্য যে, ঈদুল ফিতরের দিন সকালে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বেই ফিতরা আদায় করতে হবে। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈদের মাঠে যাওয়ার পূর্বে ফিতরা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন’।[১৩] তবে ২/১ দিন পূর্বেও প্রদান করা বৈধ।[১৪]
(৪) কিছু খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া :
ঈদুল ফিতরের দিন সকালে ছালাতের জন্য ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে বিজোড় সংখ্যক খেজুর কিংবা অন্য কিছু খেয়ে বের হওয়া সুন্নাত। পক্ষান্তরে ঈদুল আযহার দিনে কিছু না খেয়ে বের হওয়া সুন্নাত। এটাই ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর আমল। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَغْدُوْ يَوْمَ الْفِطْرِ حَتَّى يَأْكُلَ تَمَرَاتٍ وَيَأْكُلُهُنَّ وِتْرًا ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈদুল ফিতরের দিন (বাড়ি থেকে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে) বের হতেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি বিজোড় সংখ্যক খেজুর খেতেন’।[১৫] বুরায়দা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَخْرُجُ يَوْمَ الفِطْرِ حَتَّى يَطْعَمَ وَلَا يَطْعَمُ يَوْمَ الأَضْحَى حَتَّى يُصَلِّيَ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈদুল ফিতরের দিন কিছু না খেয়ে বের হতেন না। এবং ঈদুল আযহার দিন ছালাত আদায় না করা পর্যন্ত কিছু খেতেন না’।[১৬]
(৫) তাকবীর পাঠ করা :
ঈদুল ফিতরের দিন সকালে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়া থেকে খুৎবা শুরুর পূর্ব পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতে হয়।[১৭] খত্বীব বা ইমামের সাথে সাথে উপস্থিত সকলে সমস্বরে তাকবীর পাঠ করতে পারেন।[১৮] যুহরী (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত, ‘নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে পৌঁছে ছালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবীর বলতেন। যখন ছালাত আদায় করতেন, তারপর আর তাকবীর বলতেন না’।[১৯] আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) ঈদের তাকবীরে নিম্নোক্ত দু‘আ পড়তেন,
اَللّٰہُ أَكْبَرُ اَللهُ أَكْبَرُ لَا إِ لٰہَ إِلَّا اللهَ وَ اللهُ أَكْبَرُ اَللهُ أَكْبَرُ وَ لِلهِ الْحَمْدُ
উচ্চারণ : ‘আল্ল-হু আকবার আল্লা-হু আকবার লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু, ওয়াল্লাহু আকবার আল্লা-হু আকবার ওয়া লিল্লা-হিল হাম্দ’।[২০] উল্লেখ্য যে, মহিলারা নিঃশব্দে তাকবীর পাঠ করবে।[২১]
(৬) ঈদের জামা‘আতে মহিলাদের অংশগ্রহণ করা :
নারী-পুরুষ সকলের জন্য ঈদের ছালাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পুরুষের পাশাপাশি স্বীয় উম্মতের সকল মুসলিম মহিলাকে, এমনকি ঋতুবতী মহিলাদেরকেও ঈদের মাঠে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর ঋতুবতীদেরকে শুধু খুৎবা শ্রবণ এবং মুখে তাকবীর, তাহলীল, আমীন আমীন বলার পরামর্শ দিয়েছেন।[২২] উল্লেখ্য যে, ঈদের জামা‘আতে পুরুষদের পিছনে পর্দার সাথে মহিলাগণ প্রত্যেকে বড় চাদরে আবৃত হয়ে যোগদান করবেন। ঋতুবতী মহিলাগণ কাতার থেকে সরে এক পার্শ্বে গিয়ে বসবেন এবং কেবল খুৎবা শ্রবণ করবেন ও খত্বীবের সাথে দু‘আয় শরীক হবেন।[২৩]
(৭) ঈদগাহে গমনাগমনে পথ পরিবর্তন করা :
ঈদগাহে পায়ে হেঁটে এক পথে যাওয়া এবং ভিন্ন পথে ফিরে আসা সুন্নাত। আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا خَرَجَ يَوْمَ الْعِيْدِ فِىْ طَرِيْقٍ رَجَعَ فِىْ غَيْرهِ ‘নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈদের দিনে এক পথ দিয়ে যেতেন এবং অন্য পথ দিয়ে ফিরে আসতেন’।[২৪]
(৮) পায়ে হেঁটে ঈদগাহে গমন করা, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া যানবাহনে করে গমন না করা :
সুন্নাত হল- পায়ে হেঁটে ঈদগাহে গমন করা। ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْرُجُ إِلَى الْعِيْدِ مَاشِيًا وَيَرْجِعُ مَاشِيًا ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পায়ে হেঁটে ঈদগাহে গমন ও প্রত্যাবর্তন করতেন’।[২৫] তাই ঈদগাহ যদি নিকটবর্তী হয়, তাহলে পায়ে হেঁটে গমন করা সুন্নাহ। তবে ঈদগাহ যদি অনেক দূরবর্তী হয় সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে যানবাহনে করে গমন করাতে কোন সমস্যা নেই। আল্লাহই অধিক অবগত।[২৬]
(৯) ময়দানে ছালাত আদায় করা :
উন্মুক্ত ময়দানে ঈদের ছালাত জামা‘আত সহকারে আদায় করা সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও খুলাফায়ে রাশেদীন সর্বদা ঈদের ছালাত উন্মুক্ত ময়দানে আদায় করতেন। তাঁদের ঈদের ময়দানটি ছিল মদীনার মসজিদে নববীর পূর্ব দরজা বরাবর মাত্র পাঁচশ’ গজ (الف ذراع) দূরে ‘বাত্বহান’ সমতল ভূমিতে অবস্থিত।[২৭] অন্যান্য মসজিদের চেয়ে এক হাযার গুণ বেশি নেকী এবং অতি নিকটবর্তী হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা কখনো মসজিদে নববীতে ঈদের ছালাত আদায় করেননি। একটি ‘যঈফ’ বর্ণনায় আছে যে, তিনি একবার মাত্র বৃষ্টির কারণে মসজিদে নববীতে ঈদের ছালাত আদায় করেছিলেন।[২৮]
(১০) দান-ছাদাক্বাহ করা :
দান-ছাদাক্বাহ ঈদের দিনের অন্যতম নফল ইবাদত। এ দিনে দান-ছাদাক্বাহর গুরুত্ব এতই বেশি যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেই খুৎবা শেষ করে বেলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে নিয়ে মহিলাদের নিকট যেতেন ও তাদেরকে দান-ছাদাক্বাহর নির্দেশ দিতেন। মহিলারা নেকীর উদ্দেশ্যে নিজেদের গহনা খুলে বেলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাতে দান করতেন। একদা আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে কখনও ঈদের ছালাতে উপস্থিত ছিলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হতেন (ও প্রথমে) ছালাত আদায় করতেন। তারপর খুৎবা দিতেন। রাবী বলেন, তিনি আযান বা ইক্বামতের কথা উল্লেখ করেননি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহিলাদের নিকটে আসতেন, তাদেরকে উপদেশ দিতেন ও দান-ছাদাক্বাহ করার নির্দেশ দিতেন। আমি মহিলাদেরকে দেখতাম, তারা নিজেদের কান ও গলার দিকে হাত বাড়াতেন এবং গহনা খুলে বেলালের নিকট দিতেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও বেলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বাড়ী ফিরে আসতেন’।[২৯]
(১১) সুন্নাতী পদ্ধতিতে পরস্পরে কুশল বিনিময় করা :
ঈদের দিন ছাহাবায়ে কেরাম পরস্পরে সাক্ষাৎ হলে বলতেন, تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكَ ‘তাক্বাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’। অর্থাৎ ‘আল্লাহ আমাদের ও আপনার পক্ষ হতে কবুল করুন!’[৩০] উল্লেখ্য যে, ঈদ মাঠে বা ঈদের দিন পরস্পর কোলাকুলি শরী‘আত সম্মত নয়। তবে সফর থেকে বা বাইর থেকে আগন্তুকের সাথে কোলাকুলি করা যায়।[৩১]
ঈদের দিনে বর্জনীয় আমলসমূহ
(১) মক্কা বা সঊদীর অনুকরণে ঈদ পালন :
পৃথিবীর সর্বত্র একই দিনে ছিয়াম ও ঈদ পালনে একশ্রেণীর মানুষ অতি উৎসাহী। অথচ এটা অযৌক্তিক দাবী। শরী‘আতের সাথে সাংঘর্ষিক। মহান আল্লাহ বলেন, فَمَنۡ شَہِدَ مِنۡکُمُ الشَّہۡرَ فَلۡیَصُمۡہُ ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি (রামাযান) মাস পাবে, সে যেন এ মাসের ছিয়াম রাখে’ (সূরাহ আল-বাক্বারাহ : ১৮৫)। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, صُوْمُوْا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوْا لِرُؤْيَتِهِ ‘তোমরা চাঁদ দেখে ছিয়াম রাখ ও চাঁদ দেখে ছিয়াম ছাড়’।[৩২] উল্লেখিত আয়াত ও হাদীছসহ অন্যান্য হাদীছ এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, সারা দুনিয়ার মানুষ একই দিনে ও একই সময়ে চাঁদ দেখতে পায় না। আর এটাই স্বাভাবিক। কারণ কোন দেশে যখন ফজরের সময় হয় অন্য দেশে তখন গভীর রাত থাকে, আবার কোন দেশে যখন সন্ধ্যা হয় অন্য দেশে তখন মধ্যরাত হয়। তাইতো মক্কা বা সঊদী আরবে যখন সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা যায়, ঢাকায় তখন সন্ধ্যা অতিবাহিত হয়ে ৩ ঘণ্টা রাত হয়। তখন ঢাকার লোকদের এ কথা বলা যায় না যে, তোমরা চাঁদ না দেখেও ছিয়াম রাখ বা ঈদ কর? ফলে স্বাভাবিকভাবেই ঢাকার ছিয়াম ও ঈদ, মক্কা বা সঊদী আরবের একদিন পরে চাঁদ দেখে হবে। কেননা যোহরের ছালাত যেমন ফজরের সময় আদায় করা যায় না, তেমনি মক্কা বা সঊদী আরবের সঙ্গে ঢাকা মিলাতে গিয়ে একদিন পরের ছিয়াম ও ঈদ একদিন আগে করা যায় না। এটি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদেশের স্পষ্ট লংঘন।
(২) শরী‘আত বিরোধী অনুষ্ঠানাদি বর্জন :
ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদের আনন্দে আত্মহারা হয়ে আজকের যুবসমাজ পটকাবাজি, আতশবাজি, ক্যাসেটবাজি, গান-বাজনা, বেহায়াপনা, নগ্নতা চরিত্র বিধ্বংসী ভিডিও-সিডি এবং সিনেমা প্রদর্শনীতে লিপ্ত হয়। অথচ দফ ব্যতীত সকল গান-বাজনাকে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শয়তানী বাদ্যযন্ত্র হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, اَلْجَرَسُ مَزَامِيْرُ الشَّيْطَانِ ‘বাজনা, ঘণ্টা বা ঝুমঝুমি হল শয়তানের বাদ্যযন্ত্র’।[৩৩]
আবার শহর-বন্দর ও প্রত্যন্ত অঞ্চলসমূহে যাত্রা, নাটক, গোল্লাছুট, ঘোড়াছুট, নৌকাবায়েজ ও লটারীসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অংশগ্রহণকারী বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কারও বিতরণ করা হয়। ইসলাম এগুলোকে এক কথায় ‘জুয়া’ আখ্যায়িত করে সবগুলোকে হারাম ঘোষণা করেছে (সূরা আল-মায়েদাহ : ৯০)।
(৩) খুৎবা শেষান্তে সম্মিলিত মুনাজাত :
ঈদের ছালাতের খুৎবা শেষান্তে ইমাম-মুছল্লী সকলে মিলে সম্মিলিতভাবে হাত তুলে মুনাজাত করার যে বিধান চালু রয়েছে, তা বিদ‘আত। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ছাহাবায়ে কেরামের যুগে এ ধরনের আমলের কোন ভিত্তি ছিল না এবং এর প্রমাণে তাদের থেকে কোন দলীলও নেই। উল্লেখ্য যে, ‘তারা যেন মুসলিমদের জামা‘আত ও দু‘আয় শরীক হতে পারে’[৩৪] এই হাদীছ থেকে সম্মিলিত মুনাজাত প্রমাণ করতে চান। অথচ এটা অপব্যাখ্যা। মিশকাতের ভাষ্যকার ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাদীছের শেষে বর্ণিত دعوة المسلمين কথাটি ‘আম’। এর দ্বারা ইমামের খুৎবা ও ওয়ায-নছীহত শ্রবণে শরীক হওয়ার কথা বুঝানো হয়েছে।[৩৫] উল্লেখ্য, নির্দিষ্ট করে ঈদে কবর যিয়ারত করাও বিদ‘আত।
(৪) ঈদগাহে জলদি আসার জন্য মাইকে আহ্বান :
বর্তমানে বিভিন্ন সমাজে এমনকি বলা যায় সর্বমহলে ঈদের দিন সকাল হতে না হতেই মসজিদ, মক্তব ও ঈদগাহে মাইক বা সাউন্ড বক্স লাগিয়ে তাকবীর পাঠ, ইসলামী জাগরণী বা সঙ্গীত পরিবেশন, দিকনির্দেশনামূলক কথা-বার্তা এবং মুছল্লীদেরকে জলদি বা তাড়াতাড়ি আসার জন্য বারবার আহ্বান করা হয়। কিন্তু ঈদগাহে বের হওয়ার সময় উচ্চকণ্ঠে তাকবীর এবং পৌঁছানোর পরেও তাকবীরধ্বনি ব্যতীত কাউকে এভাবে আহ্বান করা ঠিক নয়। জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘ঈদুল ফিতরের দিন যখন ইমাম বের হয় তখন ছালাতের জন্য কোন আযান নেই, এক্বামত নেই, আহ্বান নেই, এবং অন্যকিছুই (যায়েয) নেই। মোটকথা, সে দিন নিদা বা আহবান, এক্বামত কিছুই নেই’।[৩৬]
উপসংহার
পরিশেষে উদাত্ত আহ্বান জানাই, হে মুসলিম! ঈদ মানেই শুধু আনন্দ নয়। বরং আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রদর্শিত বিধানাবলীর আলোকে আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে সর্বদা আত্মনিয়োগ করা কর্তব্য। অতএব আসুন তওবাহ করি, অনুতপ্ত হই, পাপ থেকে ফিরে আসি। নিজের জন্য, আত্মীয়-স্বজনদের জন্য ও গোটা মুসলিম উম্মাহর জন্য দু‘আ করি। আল্লাহ যেন আমাদের ঈদকে কবুল করেন-আমীন!
* এম. এ, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র :
[১]. ড. ফজলুর রহমান, আল-মু‘জামুল ওয়াফী, আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধান (ঢাকা : রিয়াদ প্রকাশনী, ১৪শ সংস্করণ), পৃ. ৭১৯।
[২]. আল-মু‘জামুল ওয়াফী, পৃ. ৭১৭।
[৩]. আল-মু‘জামুল ওয়াফী, পৃ. ৭৬১; ড. ইবরাহীম আনীস ও সহযোগীবৃন্দ, আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব (ইস্তাম্বুল : আল-মাকতাবাতুল ইসলামিয়্যাহ, তা.বি), ১ম খ-, পৃ. ২৬৬।
[৪]. ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতুম (রিয়াদ : দারুস সালাম ১৪১৪ হি./১৯৯৪ খ্রি.), পৃ. ২৩১-৩২।
[৫]. আবূ দাঊদ, হা/১১৩৪; মিশকাত, হা/১৪৩৯, সনদ ছহীহ।
[৬]. মুওয়াত্তা মালেক, হা/৬০৯; সনদ ছহীহ, মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হা/৫৭৫৪।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৯৪৮।
[৮]. হাশিয়ায়ে সিন্দী লিন নাসাঈ, ৩য় খ-, পৃ. ১৮১।
[৯]. আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১২৭৯।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২৪; ছহীহ মুসলিম, হা/৮৯০।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/১৫১১।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/১৫১০, ১৫০৯ ।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/১৫০৯, ছহীহ মুসলিম, হা/৯৮৬।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/১৫১১।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৯৫৩।
[১৬]. তিরমিযী, হা/৫৪২; ইবনু মাজাহ, হা/১৭৫৬, সনদ ছহীহ।
[১৭]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, সনদ ছহীহ, ইরওয়াউল গালীল (বৈরূত : ১৪০৫ হি./১৯৮৫ খ্রি.), ৩য় খণ্ড, পৃ. ১২৫।
[১৮]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, সনদ ছহীহ, ইরওয়াউল গালীল, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১২১; দারাকুৎনী, হা/১৬৯৬, ১৭০০।
[১৯]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৮৭; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৭১, আলবানী বলেন, যদিও হাদীছটি মুরসাল কিন্তু এর অনেকগুলো শাহেদ হাদীছ থাকার কারণে এটি ছহীহ।
[২০]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, হা/৫৬৯৭; সনদ ছহীহ, ইরওয়াউল গালীল, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১২৫।
[২১]. তাফসীরে কুরতুবী, ২য় খ-, পৃ. ৩০৭, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২-৪; বায়হাক্বী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩১৬।
[২২]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৫১; মিশকাত, হা/১৪৩১।
[২৩]. প্রাগুক্ত।
[২৪]. তিরমিযী, হা/৫৪১; মিশকাত, হা/১৪৪৭, সনদ ছহীহ।
[২৫]. ইবনু মাজাহ, হা/১২৯৫; সনদ হাসান।
[২৬]. ছহীহ ফিকহুস সুন্নাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬০৫।
[২৭]. ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১ম খ-, পৃ. ২৩৭-৩৮; মির‘আতুল মাফাতীহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩২৭; ঐ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২২।
[২৮]. যঈফ আবূ দাঊদ, হা/১১৬০; মিশকাত, হা/১৪৪৮ সনদ ‘যঈফ’।
[২৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২৪৯; মিশকাত, হা/১৪২৯।
[৩০]. আলবানী, তামামুল মিন্নাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৪, সনদ হাসান; ছহীহ ফিকহুস সুন্নাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬০৮।
[৩১]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩০৬৭; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৬০।
[৩২]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯০৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৮১; মিশকাত, হা/১৯৭০।
[৩৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/২১১৪; মিশকাত, হা/৩৮৯৫।
[৩৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৫১; মিশকাত, হা/১৪৩১।
[৩৫]. ড. মুযাফফর বিন মুহসিন, শারঈ মানদন্ডে মুনাজাত ও দু‘আ (রাজশাহী : আছ-ছিরাত প্রকাশনী, ৩য় সংস্করণ ২০১৭), পৃ. ১১৬।
[৩৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৮৬; মিশকাত, হা/১৪৫১।