বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:২২ অপরাহ্ন

পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব

-মূল : ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ)
-অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান*


(শেষ কিস্তি) 

আহলে কিতাবদের সাথে ওলামা সু‘দের সাদৃশ্য

এখানে চিন্তার বিষয় যে, কেন আল্লাহ তা‘আলা আহলে কিতাবদেরকে ভর্ৎসনা করলেন? তিনি আহলে কিতাবদেরকে অন্তর শক্ত হওয়ার কারণে ভর্ৎসনা করেছেন। কেননা তাদের নিকট কিতাব অবতরণ এবং গরুর সামান্য গোশত নিক্ষেপের দ্বারা নিহত ব্যক্তিকে জীবিত করার মত নিদর্শনাবলী প্রত্যক্ষ করার পরও তারা হঠকারিতা করেছিল। অতঃপর এক্ষেত্রে তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা হতে আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে এরশাদ হচ্ছে-

اَلَمۡ یَاۡنِ  لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا  اَنۡ  تَخۡشَعَ قُلُوۡبُہُمۡ  لِذِکۡرِ اللّٰہِ  وَ مَا  نَزَلَ مِنَ الۡحَقِّ  ۙ  وَ لَا یَکُوۡنُوۡا کَالَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ مِنۡ قَبۡلُ فَطَالَ عَلَیۡہِمُ  الۡاَمَدُ فَقَسَتۡ قُلُوۡبُہُمۡ ؕ وَ کَثِیۡرٌ  مِّنۡہُمۡ فٰسِقُوۡنَ

‘যারা ঈমান এনেছে তাদের হৃদয় কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে, তার কারণে বিগলিত হওয়ার সময় হয়নি? আর তারা যেন তাদের মত না হয়, যাদেরকে ইতঃপূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল, তারপর তাদের উপর দিয়ে সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর তাদের অন্তরসমূহ কঠিন হয়ে গেছে। আর তাদের অধিকাংশই পাপাচারী’ (সূরা আল-হাদীদ : ১৬)। অন্য স্থানেও তিনি তাদের অন্তর শক্ত হওয়ার কারণ বর্ণনা করেছেন।  যেমন মহান আল্লাহ বলেন,

فَبِمَا نَقۡضِہِمۡ مِّیۡثَاقَہُمۡ لَعَنّٰہُمۡ وَ جَعَلۡنَا قُلُوۡبَہُمۡ قٰسِیَۃً

‘সুতরাং তারা তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে আমরা তাদেরকে অভিসম্পাত করেছি এবং তাদের অন্তরসমূহকে কঠোর করে দিয়েছি’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ১৩)।

আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিচ্ছেন যে, তাদের অন্তর কঠিন হওয়াটা ছিল তাদের শাস্তি স্বরূপ, কারণ তারা আল্লাহর অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছিল। আর তাহল, আল্লাহর আদেশের বিরোধিতা করা এবং তার নিষিদ্ধ বিষয়সমূহকে বাস্তবায়ন করা। এগুলো তারা করেছে, তাদের থেকে এমর্মে আল্লাহর অঙ্গীকার গ্রহণের পরও যে, তারা এসব কিছু করবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یُحَرِّفُوۡنَ الۡکَلِمَ عَنۡ مَّوَاضِعِہٖ ۙ وَ نَسُوۡا حَظًّا مِّمَّا ذُکِّرُوۡا بِہٖ

‘তারা শব্দগুলোকে আপন স্থান থেকে বিচ্যুত করে এবং তাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছে, তার একটি অংশ তারা ভুলে গিয়েছে’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ১৩ )। তিনি উল্লেখ করেন যে, দু’টি নিকৃষ্ট বৈশিষ্ট্যের কারণে তাদের অন্তর কঠিন হয়ে গিয়েছিল-

  • শব্দগুলোকে স্ব স্ব স্থান থেকে বিচ্যুত করা।
  • তাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছে, তার কতকাংশ ভুলে যাওয়া।
এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল- তাদেরকে যেসব প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় ও সুন্দর সুন্দর উপদেশমালা দেয়া হয়েছে। তার একটি অংশকে তাদের কর্তৃক পরিত্যাগ ও অবহেলা করা। তাই তারা তা ভুলে গেছে, তার প্রতি আমল করা ছেড়ে দিয়েছে এবং তা উপেক্ষা করেছে।

আহলে কিতাবদের সাথে সাদৃশ্য রাখার কারণে আমাদের যেসব আলেমগণ পথভ্রষ্ট হয়েছে তাদের মধ্যেও এ দু’টি বিষয় বিদ্যমান।

এক. শব্দগুলোকে আপন স্থান থেকে পরিবর্তন করা। যে ব্যক্তি আমল না করার জন্য জ্ঞানী হয়, তার অন্তর শক্ত হয়ে যায়। তারপর সে আর আমলে মনোনিবেশ করতে পারে না, বরং সে ব্যস্ত হয়ে যায় কুরআন ও সুন্নাহর শব্দগুলোকে আপন স্থান থেকে বিচ্যুত করার কাজে। আর অসম্ভাব্য ভাষার রূপক অর্থে কিংবা তার অনুরূপ বিষয়ে শব্দগুলো ব্যবহার করার জন্য সে সূক্ষ্ম কৌশল শুরু করে। অতঃপর যখন কুরআনের শব্দগুলোকে আক্রমণ করা সম্ভব না হয় তখন সুন্নাহর শব্দগুচ্ছে আক্রমণ করতে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে যে কুরআন ও হাদীছকে আঁকড়ে ধরে এবং তার বুঝানুযায়ী তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করে, তাকে সে নিন্দা করা শুরু করে এমনকি তাকে জাহেল অথবা গুরুত্বহীন বক্তা হিসাবেও নামকরণ করে। বিশেষ করে বিভন্ন ধর্মের মূলনীতি নিয়ে সমালোচনাকারী, আহলুর রায়দের ফক্বীহ, দার্শনিকদের ছূফী এবং যুক্তিবাদীদের মধ্যে এটা অধিক লক্ষ্য করা যায়।

দুই. তাদেরকে যতটুকু উপকারী জ্ঞান দেয়া হয়েছে তার একটি অংশ তারা ভুলে গেছে। ফলে তাদের অন্তর আর উপদেশ গ্রহণ করে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এমন বিষয় শিক্ষা দেয়, যা তাকে কাঁদাবে এবং তার অন্তর নরম করবে, তাকে সে নিন্দা করে আর গল্পকার হিসাবে অবহিত করে।

আহলুর রায় তাদের কিতাবসমূহে নিজেদের শায়খদের থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ‘ইলমের ফলাফল হচ্ছে, তা তার মর্যাদার উপর প্রমাণ বহন করে। অতএব যে তাফসীর নিয়ে ব্যস্ত থাকবে তার শেষ গন্তব্য হল, সে মানুষকে কাহিনী শুনাবে এবং তাদেরকে উপদেশ দিবে। আর যে তাদের রায় ও তাদের জ্ঞান নিয়ে ব্যস্ত থাকবে সে ফৎওয়া দিবে, বিচার ফায়ছালা করবে এবং মানুষকে শিক্ষা দিবে।

আখিরাতে এই সকল লোকেরা তাদের অংশ থেকেই পাবে। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یَعۡلَمُوۡنَ ظَاہِرًا مِّنَ  الۡحَیٰوۃِ  الدُّنۡیَا ۚۖ وَ ہُمۡ عَنِ الۡاٰخِرَۃِ   ہُمۡ  غٰفِلُوۡنَ

‘তারা পার্থিব জীবনের বাহ্যিক দিক সম্পর্কে জানে, আর আখিরাত সম্পর্কে তারা গাফিল’ (সূরা আর-রূম : ৭)।

দুনিয়া ও তার প্রাচুর্য্যরে প্রতি ভালোবাসাই তাদেরকে একাজে উদ্বুদ্ধ করেছে। তারা যদি দুনিয়া থেকে বিমুখ হয়ে আখেরাতমুখী হত, আল্লাহর বান্দা এবং তাদের নিজেদেরকে সদুপদেশ দিত, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলের উপর যা অবতীর্ণ করেছেন তারা তা আঁকড়ে ধরতে পারত এবং মানুষকেও তা আঁকড়ে ধরতে বাধ্য করত। তখন আর অধিকাংশ মানুষ তাক্বওয়া থেকে বের হয়ে যেত না। বরং তাদের জন্য কুরআন ও সুন্নাহর দলীলই যথেষ্ট হত।
তবে তাদের মধ্যে থেকে যে অল্প সংখ্যক কুরআন-সুন্নাহ থেকে বের হয়ে যাবে তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা দলীলের অর্থসমূহ বুঝে এমন ব্যক্তিকে নির্ধারিত করে দিবেন যার দ্বারা সে দলীল থেকে বিমুখ ব্যক্তিকে প্রতিহত করে তাকে দলীলের দিকে ফিরিয়ে আনতে পারবে। আর দলীলের মাধ্যমেই সে তাদের জন্ম দেয়া সেই সকল বাতিল শাখা-প্রশাখা ও হারাম অপকৌশল থেকে অমুখাপেক্ষী হয়ে যাবে, যার কারণে সূদ ও অন্যান্য হারাম কাজের দরজা উন্মোচন করা হয়েছে এবং নিকৃষ্ট অপকৌশলের মাধ্যমে আল্লাহর হারাম সমূহকে হালাল করা হয়েছে, যেমনটি করেছিল আহলে কিতাবরা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَہَدَی اللّٰہُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لِمَا اخۡتَلَفُوۡا فِیۡہِ مِنَ الۡحَقِّ بِاِذۡنِہٖ ؕ وَ اللّٰہُ  یَہۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ  اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ

‘অতঃপর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মুমিনদেরকে হেদায়াত দিলেন সেই সত্য বিষযে, যে ব্যাপারে তারা মতবিরোধ করছিল। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন সরল পথ বাতলে দেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২১৩)।

وَصَلَّي اللهُ عَلٰي سَيِّدِنَا مُحَمَّدِ وَّآلِهِ وَصَحْبِهِ وَسَلَّمَ تَسْلِيْمًا كَثِيْرًا إِلٰي يَوْمِ الدِّيْنِ وَحَسْبُنَا اللهِ وَنِعْمَ الْوَكِيْلِ

 
* অধ্যয়নরত, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মদীনা মুনাওয়ারাহ, সঊদী আরব।




প্রসঙ্গসমূহ »: বিবিধ নবী-রাসূল
বিদ‘আত পরিচিতি (২৬তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ঈদুল ফিতরে করণীয় ও বর্জনীয় - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
দলাদলির কুপ্রভাব : উত্তরণের উপায় (শেষ কিস্তি) - শায়খ মতিউর রহমান মাদানী
বিদ‘আত পরিচিতি (১৯তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ভ্রান্ত ফের্কাসমূহের ঈমান বনাম আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ঈমান : একটি পর্যালোচনা (শেষ কিস্তি) - ড. আব্দুল্লাহিল কাফী বিন লুৎফর রহমান মাদানী
কুরবানীর মাসায়েল - আল-ইখলাছ ডেস্ক
বিদ‘আত পরিচিতি (৫ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২৪তম কিস্তি)   - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
কুরবানীর মাসায়েল - আল-ইখলাছ ডেস্ক
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৬ষ্ঠ কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা (৪র্থ কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির

ফেসবুক পেজ