সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ১১:৫৯ অপরাহ্ন

শারঈ মানদন্ডে শবেবরাত

-আল-ইখলাছ ডেস্ক



বর্তমান সমাজে বিদ‘আতী আমলগুলোর মধ্যে অন্যতম হল প্রচলিত শবেবরাত। শা‘বান মাসের সুন্নাতকে পদদলিত করে সমাজে আমলের নামে এই বিত‘আত চালু আছে। তাই এই শবেবরাত থেকে সাবধান থাকা একান্ত কর্তব্য।

শবেবরাত-এর উৎপত্তি

‘শবেবরাত’ শব্দটি যৌগিক। দু’টি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। একটি ‘শব’ অন্যটি ‘বরাত’। শব শব্দটি ফার্সী ভাষা থেকে গৃহীত, যার অর্থ রাত বা রজনী। আর বরাত শব্দটি আরবী ভাষা থেকে গৃহীত, যার অর্থ বিমুক্তি, সম্পর্কহীনতা, মুক্ত হওয়া, নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের দেশে ‘বরাত’ শব্দটিকে ‘ভাগ্য’ বা ‘সৌভাগ্য’ অর্থে ব্যবহার করা হয়, যা ঠিক নয়। অন্যদিকে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কোথাও ‘শবেবরাত’ বা ‘লাইলাতুল বারাআত’ পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়নি। ছাহাবী-তাবেঈগণের যুগেও তারা এই শব্দটিকে ব্যবহার করেননি। সর্বপ্রথম ৪৪৮ হিজরীতে জেরুযালেমের বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদে মধ্য শা‘বানের রজনীতে ‘ছালাতুল আলফিয়া’ নামে নতুন একটি ইবাদত চালু হয়। এর জন্য ব্যাপক আলোকসজ্জাও করা হত। এ ছালাতের সাথে অনেক পাপাচার ও সীমালঙ্ঘন প্রকাশ পেতে থাকে। ফলে নেক্কার-পরহেযগার ব্যক্তিগণ আল্লাহর গযবের ভয়ে জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিলেন।[১]

ধর্মীয় ভিত্তি

আরবী শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রিতে শবেবরাত উদযাপন করা হয়। যার পেছনে কয়েকটি দিক ধর্মীয় ভিত্তি উপস্থাপন করা হয়।

(১) কুরআন অবতীর্ণ :

শবেবরাত পালনকারীরা মনে করে যে, ১৪ই শা‘বান দিবাগত রাত হল কুরআন অবতীর্ণের রজনী। এর ধর্মীয় ভীত্তি হল কুরআনের একটি আয়াত। তারা নিম্নের আয়াতকে শবেবরাতের দলীল হিসাবে ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنٰہُ فِیۡ لَیۡلَۃٍ مُّبٰرَکَۃٍ اِنَّا کُنَّا مُنۡذِرِیۡنَ- فِیۡہَا یُفۡرَقُ کُلُّ اَمۡرٍ حَکِیۡمٍ

‘আমি একে (কুরআন) নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়’ (সূরা আদ-দুখান : ৩-৪)।
পর্যালোচনা : তাদের উক্ত দাবী সঠিক নয়। কেননা এ আয়াতে বর্ণিত ‘বরকতময় রজনী’ দ্বারা রামাযানের ক্বদরের রাতকেই বুঝানো হয়েছে। যেমন,

(১) ইমাম বাগাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, هي ليلة القدر أنزل الله القرآن في ليلة القد ‘(বরকতময় রজনী) হল লায়লাতুল ক্বদর। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনকে লায়লাতুল ক্বদরে নাযিল করেছেন’।[২] (২) আল্লামা কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, اليلة المباركة ليلة القدر ‘বরকতময় রজনী দ্বারা লায়লাতুল ক্বদর উদ্দেশ্য’।[৩] (৩) হাফেয ইবনে কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, إنه أنزله في ليلة مباركة وهي ليلة القدر كما قال تعالى إِنَّا أَنزلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ ‘নিশ্চয় তিনি কুরআনকে বরকতময় রজনীতে নাযিল করেছেন। আর সেই (বরকতময় রজনী) হল লায়লাতুল ক্বদর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি কুরআনকে নাযিল করেছি লায়লাতুল ক্বদরে’ (সূরা আল-ক্বদর : ১)।[৪]

তবে ইকরামা হতে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা মুফাসসিরগণ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা তার মত সঠিক নয় বলে উল্লেখ করেছেন।

আল্লামা শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে ‘লায়লাতুল মুবারাক’ দ্বারা এখানে লায়লাতুল ক্বদর উদ্দেশ্য, নিছফে শা‘বান নয়, যা অধিকাংশ আলেমের অভিমত। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এখানে তাঁর বর্ণনা সংক্ষিপ্তাকারে করলেও, সূরা বাক্বারায় তাঁর বাণী, شَہۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡہِ الۡقُرۡاٰنُ ‘রামাযান মাস- যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৫) দ্বারা তা স্পষ্ট করেছেন’।[৫]

আল্লামা কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, والليلة المباركة ليلة القدر ويقال ليلة النصف من شعبان ‘বরকতময় রজনী’ দ্বারা লায়লাতুল ক্বদর উদ্দেশ্য। অন্য একটি অভিমতে, এর দ্বারা অর্ধ শা‘বান উদ্দেশ্য। তিনি অনেক মতামত তুলে ধরার পর বলেন, والأول أصح لقوله تعالى إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ ‘প্রথম অভিমতই (অর্থাৎ লায়লাতুল ক্বদর) অধিক বিশুদ্ধ। আল্লাহর বানী, ‘নিশ্চয় আমি কুরআনকে নাযিল করেছি লায়লাতুল ক্বদরে’ (সূরা আল-ক্বদর : ১)।[৬]

আল্লামা জারীর আত-তাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর বলেন, ‘বরকতময় রজনী অর্থাৎ ঐ রজনী হল লায়লাতুল ক্বদর। আল্লাহ তা‘আলা এই কুরআনকে উম্মুল কিতাব হতে লায়লাতুল ক্বদরে অবতীর্ণ করেছেন। অন্যরা বলেন, বরং তা অর্ধ শা‘বানে নাযিল করেছেন। সঠিক মত হল এই বিষয়ে, তাদের মত যারা বলেন, লায়লাতুল মুবারক হল, লায়লাতুল ক্বদর’।[৭]

(২) বান্দার গোনাহ মাফ :

শবেবরাতে বান্দার গুনাহ ক্ষমা করা হয়, এটা তাদের অন্যতম বিশ্বাস। অথচ তাদের এই বিশ্বাসের মূলে রয়েছে কিছু দুর্বল ও অস্বীকৃত হাদীছ।

ألف) عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ فَقَدْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْلَةً فَخَرَجْتُ فَإِذَا هُوَ بِالْبَقِيعِ فَقَالَ أَكُنْتِ تَخَافِينَ أَنْ يَحِيفَ اللهُ عَلَيْكِ وَرَسُولُهُ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ إِنِّى ظَنَنْتُ أَنَّكَ أَتَيْتَ بَعْضَ نِسَائِكَ فَقَالَ إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَنْزِلُ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا فَيَغْفِرُ لأَكْثَرَ مِنْ عَدَدِ شَعْرِ غَنَمِ كَلْبٍ

(ক) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, কোন একরাতে আমি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে (বিছানায়) না পেয়ে তাঁর খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। অতঃপর তাঁকে বাক্বী কবরস্থানে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, হে আয়েশা! তোমার কি আশঙ্কা, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার উপর অবিচার করবেন? আমি বললাম, বরং আমি ভেবেছি আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রীর নিকট গিয়েছেন। তখন তিনি বললেন, মহান আল্লাহ ১৫ই শা‘বানের রাতে দুনিয়ার নিকটস্থ আকাশে অবতরণ করেন এবং কালব গোত্রের বকরীর পশমের চেয়ে অধিক লোককে ক্ষমা করেন’।[৮]
পর্যালোচনা : হাদীছটি সনদগত ভাবে দুর্বল।[৯] এই হাদীছে হাজ্জাজ নামে একজন রাবী রয়েছে, যিনি মুদাল্লিস রাবী।[১০]

ب) عَنْ عَلِىِّ بْنِ أَبِى طَالِبٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَقُومُوا لَيْلَهَا وَصُومُوا يَوْمَهَا. فَإِنَّ اللهَ يَنْزِلُ فِيهَا لِغُرُوبِ الشَّمْسِ إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا فَيَقُولُ أَلاَ مِنْ مُسْتَغْفِرٍ فَأَغْفِرَ لَهُ أَلاَ مُسْتَرْزِقٌ فَأَرْزُقَهُ أَلاَ مُبْتَلًى فَأُعَافِيَهُ أَلاَ كَذَا أَلاَ كَذَا حَتَّى يَطْلُعَ الْفَجْرُ

(খ) আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ১৫-ই শা‘বানের রাত আসলে তোমরা ঐ রাত্রিতে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করবে এবং ঐ দিন ছিয়াম পালন করবে। কেননা ঐ দিন সূর্য ডোবার পর আল্লাহ দুনিয়ার নিকটস্থ আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, আছে কি কোন ক্ষমাপ্রার্থী? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। আছে কি কোন রিযিক্বপ্রার্থী? আমি তাকে রিযিক্ব প্রদান করব। আছে কি কোন অসুস্থ ব্যক্তি? আমি তাকে সুস্থতা দান করব। ফজরের সময় হওয়া পর্যন্ত তিনি এভাবেই বলতে থাকেন’।[১১]
পর্যালোচনা : উক্ত হাদীছের সনদ জাল।[১২] তাছাড়া হাদীছটির সনদ সকল মুহাদ্দিছের ঐকমত্যে ভিত্তিহীন ও দুর্বল।[১৩]

ج) عَنْ أَبِى مُوسَى الأَشْعَرِىِّ عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ اللهَ لَيَطَّلِعُ فِى لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلاَّ لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ

(গ) আবু মূসা আল-আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, মহান আল্লাহ মধ্য শা‘বানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষপোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন’।[১৪]
পর্যালোচনা : উক্ত হাদীছের সনদে আব্দুল্লাহ ইবনু লাহিয়া রয়েছে। তিনি হাদীছ জালকারী।[১৫]

উপরিউক্ত দুর্বল ও বানোয়াট দলীলের উপর ভিত্তি করে বর্তমান সমাজে শবেবরাতের নামে ভ্রান্ত কিছু আক্বীদা ও আমল চালু আছে। অথচ হাদীছে প্রত্যেক রাতের কথা এসেছে, আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, মহান আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেন, কে আমায় ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আমার কাছে চাইবে? তাকে তা দিয়ে দিব। কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে? তাকে আমি ক্ষমা করে দিব’।[১৬]

(৩) আগামী এক বছরের জন্য ভালমন্দ তাক্বদীর নির্ধারিত হওয়া :

শবেবরাতপন্থীদের আরেকটি শক্ত দলীল হল- তারা বিশ্বাস করে প্রতিবছর এই রাতে ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয়।
পর্যালোচনা : উক্ত বক্তব্যের কোন ছহীহ ভিত্তি নেই। যা কিছু আছে সবই বানোয়াট, ভিত্তিহীন এবং মনগড়া কল্পিত কাহিনী এবং কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বিরোধী। হাফেয ইবনু কাছীর বলেন, تقطع الآجال من شعبان إلى شعبان حتى إن الرجل لينكح ويولد له فهو حديث مرسل ومثله لا يعارض به النصوص. ‘শবেবরাতের রাতে এক শা‘বান হতে আরেক শা‘বান পর্যন্ত বান্দার জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ-শাদী ইত্যাদি লিপিবদ্ধ হয় বলে’ যে হাদীছ প্রচারিত আছে, তা ‘মুরসাল’। এরূপ হাদীছ দ্বারা কুরআনের বিরোধিতা করা যায় না’।[১৭] তাছাড়া এই আক্বীদা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বিরোধী।[১৮]

(৪) ১০০ রাক‘আত ছালাত :

জীবনের সমস্ত গোনাহকে ক্ষমা করিয়ে নেওয়ার জন্য এই রাত্রিতে ১০০ রাক‘আত ছালাত আদায় করা হয়।
পর্যালোচনা : অথচ উক্ত মর্মে বর্ণিত হাদীছটি মওযূ‘ বা জাল।[১৯]

(৫) রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দান্দান মুবারক শহীদ :

তারা মনে করে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ওহুদ যুদ্ধে আহত হন এবং তাঁর দাঁত ভেঙ্গে যায়, তখন তিনি হালুয়া খেয়েছিলেন’ তাই এ রাতে হালুয়া-রুটি তৈরি ও বিতরণ করা হয় এবং খাওয়া হয়।
পর্যালোচনা : উক্ত বক্তব্যও বাস্তবতার বিরোধী। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দাঁত ভেঙ্গে ছিল ওহুদের যুদ্ধে, যা শাওয়াল মাসে সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু শবেবরাত পালন করা হচ্ছে শা‘বান মাসে।

অন্যান্য বিদ‘আত : উক্ত বিদ‘আত ছাড়াও আরও কিছু বিদ‘আত লক্ষ্য করা যায়। তা হল-
(১) ‘অর্ধ শা‘বান’-এর রাত্রিকে ‘ভাগ্য রজনী’ বলে মনে করা
(২) বয়স ও রূযী বৃদ্ধির ধারণা করা
(৩) হালুয়া-রুটি ও রকমারী খাদ্য প্রস্তুত করা
(৪) বিধবা মহিলাদের মৃত স্বামীর আগমনের ভ্রান্ত ধারণা
(৫) ব্যাপকভাবে পাড়া-গ্রাম ও শহর-মহল্লায় আলোক সজ্জা ও আগুন জ্বালানো
(৬) শবেবরাতের রাত্রি জাগরণ করা
(৭) ফযীলতের আশায় গোসল করা ইত্যাদি।
এগুলো সবই মূর্খতা ও নিকৃষ্ট বিদ‘আত।

শা‘বান মাসের সুন্নাতী আমল

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ছাহাবীগণ শা‘বান মাসে বেশি বেশি নফল ছিয়াম পালন করতেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُوْمُ حَتَّى نَقُوْلَ لَا يُفْطِرُ وَيُفْطِرُ حَتَّى نَقُوْلَ لَا يَصُوْمُ فَمَا رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اسْتَكْمَلَ صِيَامَ شَهْرٍ إِلَّا رَمَضَانَ وَمَا رَأَيْتُهُ أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ فِيْ شَعْبَانَ

‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমনভাবে নফল ছিয়াম পালন করতেন যে, আমরা ধরে নিতাম তিনি আর বিরতি দেবেন না। আবার এমনভাবে ছিয়াম পরিত্যাগ করতেন যে, আমরা মনে করতাম তিনি আর ছিয়াম পালন করবেন না। রামাযান ব্যতীত অন্য কোন মাসে তাকে পূর্ণ মাস ছিয়াম পালন করতে দেখিনি। আর শা‘বান মাস ব্যতীত অন্য মাসে অধিক পরিমাণে নফল ছিয়াম পালন করতে দেখিনি’।[২০]

এ কারণে শা‘বান মাসের সুন্নাতী আমল হল বেশি বেশি ছিয়াম পালন করা। তবে যারা শা‘বানের প্রথম থেকে নিয়মিত ছিয়াম পালন করেন, তাদের জন্য শেষার্ধে ছিয়াম পালন করা উচিত নয়। কেননা আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, إِذَا انْتَصَفَ شَعْبَانُ فَلَا تَصُوْمُوْا ‘যখন শা‘বান মাস অর্ধেক অতিবাহিত হয়, তখন তোমরা আর (নফল) ছিয়াম রেখো না’।[২১] অবশ্য যদি কেউ অভ্যস্ত হন বা মানত করে থাকেন, তারা শেষের দিকেও ছিয়াম পালন করতে পারবেন।[২২]

ফযীলত

উসামা বিন যায়েদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করলাম, শা‘বান মাসে আপনি যে পরিমাণ ছিয়াম রাখেন, অন্য কোন মাসে আপনাকে এত ছিয়াম রাখতে দেখি না! তিনি বললেন, ‘রজব ও রামাযান মাসের মধ্যবর্তী শা‘বান মাস সম্পর্কে লোকজন গাফেল থাকে; অথচ এ মাসে মানুষের আমল আল্লাহ রব্বুল আ‘লামীনের দরবারে উপস্থাপন করা হয়, আর আমি এটাই ভালবাসি যে, আমার আমল এমন অবস্থায় উপস্থাপিত হোক যখন আমি ছিয়াম পালনকারী’।[২৩] এছাড়া শা‘বান মাসের একদিনের নফল ছিয়াম অন্য মাসের দুই দিনের ছিয়ামের সমান। যেমন ইমরান বিন হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বা অন্য কাউকে বলেছেন, أَصُمْتَ مِنْ سَرَرِ شَعْبَانَ قَالَ لَا قَالَ فَإِذَا أَفْطَرْتَ فَصُمْ يَوْمَيْنِ ‘তুমি কি শা‘বানের গোপনভাগে (শেষে) ছিয়াম রেখেছ? তিনি বললেন, না। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, যখন তুমি (রামাযানের ছিয়াম থেকে) শেষ করবে, তখন দুইদিন ছিয়াম রেখে দিবে’।[২৪] অন্য বর্ণনায় এসেছে, فَإِذَا أَفْطَرْتَ رَمَضَانَ فَصُمْ مَكَانَ ذَلِكَ الْيَوْمِ يَوْمَيْنِ ‘যখন তুমি রামাযানের ছিয়াম শেষ করবে, তখন ঐ দিনের স্থানে দুই দিন ছিয়াম রাখবে’।[২৫]

পরিশেষে বলা যায় যে, শা‘বান মাসে অধিক হারে নফল ছিয়াম পালন করা সুন্নাত। কিন্তু শুধু ১৫ই শা‘বান একদিন শবেবরাতের নিয়তে ছিয়াম পালন করা বিদ‘আত। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে শবেবরাত নামক বিদ‘আতকে পরিহার করে শা‘বান মাসের সুন্নাতী আমল করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!

[১]. মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী, মিরক্বাতুল মাফাতীহ শরহে মিশকাতুল মাছাবীহ (দেওবন্দ : আশরাফী ছাপা, তাবি) ৩/৩৫০ পৃঃ; মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, শবেবরাত (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ৩য় সংস্করণ, ডিসেম্বর ১৯৯৮), পৃঃ ১০।
[২]. আবু মুহাম্মাদ হুসাইন ইবনু মাসঊদ আল-বাগাবী, তাফসীরে বাগাবী ৭/২২৭ পৃঃ।
[৩]. আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনু আবুবকর ইবনু ফারহুল আনছারী শামসুদ্দীন কুরতুবী, ‘আল-জা‘মেঈ লি-আহকামিল কুরআন (রিয়াদ : দারুল আলিমিল কুতুব, তাবি) ১৬/১২৫ পৃঃ।
[৪]. তাফসীর ইবনে কাছীর ৭/২৪৫ পৃঃ।
[৫]. মুহাম্মাদ শাওক্বানী, তাফসীরে ফাৎহুল ক্বাদীর, ৬/৪২২ পৃঃ।
[৬]. শামসুদ্দীন কুরতুবী, ‘আল-জা‘মেঈ লি-আহকামীল কুরআন ১৬/১২৫ পৃঃ।
[৭]. ইমাম জারীর আত-তাবারী, জামেউল কুরআন ফী তাবীলিল কুরআন ৮/২২ পৃঃ।
[৮]. তিরমিযী হা/৭৩৯; ইবনু মাজাহ হা/১৩৮৯; মুসনাদে আহমাদ হা/২৬৭৭১; মিশকাত হা/১২৯৯।
[৯]. তিরমিযী হা/৭৩৯; তাহক্বীক আলবানী ২/২৩৯ পৃঃ; তিরমিযী হা/৭৪৪, ৩/২৫৯ পৃঃ।
[১০]. আলবানী, সিলসীলা ছহীহাহ ৩/২১৮ পৃঃ। শায়খ আলবানী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, لكن حجاج و هو ابن أرطأة مدلس
[১১]. ইবনে মাজাহ হা/১৪৫১, ৪/৩৭২ পৃঃ।
[১২]. আলবানী, সিলসিলা যঈফাহ হা/২১৩২, ৫/১৫৪ পৃঃ।
[১৩]. ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ), আত-তাক্বরীবুত তাহযীব, তাহক্বীক্ব : শায়খ খলীল মামূন শীহা (বৈরূত : দারুল মা‘রেফাহ, ২য় সংস্করণ ১৪১৭ হিঃ/১৯৯৭ খ্রিঃ) ২/৪০৫ পৃঃ, রাবী নং-৯০৭০।
[১৪]. ইবনু মাজাহ হা/১৪৫৩
[১৫]. তাক্বরীবুত তাহযীব ১/৪১৭ পৃঃ, রাবী নং-৩৯৪৫।
[১৬]. বুখারী হা/১১৪৫, মুসলিম হা/১৬৮, ইবনু মাজাহ হা/১৩৬৬, মিশকাত হা/১১৪৫।
[১৭]. তাফসীর ইবনে কাছীর ৭/২৪৬ পৃঃ।
[১৮]. সূরা আল-ক্বামার : ৫২-৫৩; ছহীহ বুখারী হা/৫০৭৬; ছহীহ মুসলিম হা/২৬৫৩; মিশকাত হা/৭৯, ৮৮।
[১৯]. আত-তাহযীরু মিনাল বিদ‘আ ২৫ পৃঃ; ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব অনূদিত ‘বিদ‘আত হতে সাবধান’ গ্রন্থ দ্র.।
[২০]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯৬৯।
[২১]. আবূ দাঊদ, হা/২৩৩৭; মিশকাত, হা/১৯৭৪।
[২২]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯১৪; মিশকাত, হা/১৯৭৩, ২০৩৮।
[২৩]. নাসাঈ, হা/২৩৫৭, সনদ হাসান।
[২৪]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯৮৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬১।
[২৫]. ত্বাবারাণী কাবীর, হা/২২০; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬১; ফাৎহুল বারী, হা/১৯৮৩-এর আলোচনা দ্রঃ।




হাদীছ বর্ণনায় আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর অবদান - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
সালাফী মানহাজ অনুসরণের মর্যাদা - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মসজিদ: ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
তারুণ্যের উপর সন্ত্রাসবাদের  হিংস্র ছোবল : প্রতিকারের উপায় (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (৪র্থ কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
বিদ‘আত পরিচিতি (১০ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মুসলিম বিভক্তির কারণ ও প্রতিকার (শেষ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ - অনুবাদ : মুহাম্মদ ইমরান বিন ইদরিস
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
রজব মাসের বিধানসমূহ - অনুবাদ : ইউনুস বিন আহসান
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (ত্রয়োদশ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইসলামী সংগঠন ও তরুণ-যুবক-ছাত্র - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন

ফেসবুক পেজ