শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:২৮ পূর্বাহ্ন

সালাফী জামা‘আত বনাম ভ্রান্তদল সমূহ

-মাহবুবুর রহমান মাদানী*


ভূমিকা

সমস্ত প্রশংসা একমাত্র মহান আল্লাহর জন্য, যিনি আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন আর সৃষ্টি করেছেন অন্ধকার ও আলো। এতদসত্ত্বেও যারা কুফরী করেছে তারা তাদের প্রতিপালকের সমকক্ষ দাঁড় করিয়েছে। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর ওপর, তাঁর পরিবারবর্গ ও সকল ছাহাবী, তাবেঈন, তাবে‘ তাবেঈন এবং ক্বিয়ামাত পর্যন্ত তাঁদের পদাংক অনুসরণকারী মুমিনদের ওপর। ‘সালাফ’ সম্পর্কে কিছু লিখার চেষ্টা করেছি, যাতে করে নিজে তা থেকে উপকার নিতে পারি। অতঃপর পাঠকদের উপকার্থে আমার একান্ত প্রয়াস। 

শাব্দিক পরিচয়

‘মানহাজ’ শব্দের অর্থ হল- পথ, পন্থা পদ্ধতি। আর ‘সালাফ’ শব্দের অর্থ হল- অতীত, অগ্রগামী, পূর্ববর্তী। ‘সালাফ’ শব্দের দিকে সম্বন্ধ করে ‘সালাফী’ বলা হয়।  যেমন ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ)-এর দিকে সম্বন্ধ করে ‘মালিকী’ বলা হয়। ‘সালাফী মানহাজ’ অর্থ হল পূর্ববর্তীদের পথ বা মতাদর্শ। পবিত্র কুরআনের ৬ জায়গায় ‘সালাফ’ শব্দ এসেছে।[১] যেমন মহান আল্লাহ বলেন,  قُلۡ  لِّلَّذِیۡنَ  کَفَرُوۡۤا  اِنۡ یَّنۡتَہُوۡا یُغۡفَرۡ لَہُمۡ مَّا قَدۡ سَلَفَ ‘(হে নবী!) আপনি কাফিরদেরকে বলুন, তারা যদি কুফরি থেকে বিরত থাকে অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীনে ফিরে আসে; তবে পূর্বে যা হয়েছে তা আল্লাহ ক্ষমা করবেন’  (সূরা আল-আনফাল: ৫৬) । রাসূল (ﷺ) স্বয়ং ‘সালাফ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। একদা তিনি তাঁর মেয়ে ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে বলেছিলেন, فَإِنِّيْ نِعْمَ السَّلَفُ أَنَا    لَكِ ‘আমি তোমার জন্য উত্তম অগ্রগামী’ অর্থাৎ আমি তোমার পূর্বে গমনকারী, তুমি পরে আমার কাছে আগমন করবে’।[২]

পারিভাষিক পরিচয়

أن مفهوم السلف عند الإطلاق يراد به الصحابة الكرام والتابعون لهم بإحسان وأتباع التابعين من أهل القرون الثلاثة.

‘সালাফ বলতে সাধারণভাবে তিন সোনালী যুগের ছাহাবী কিরাম, তাবিঈগণ, যারা তাদের ইহসানের সাথে আনুগত্য করেন এবং তাবি‘ তাবিয়ীগণকে বুঝায়’।[৩] এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,

وَ السّٰبِقُوۡنَ الۡاَوَّلُوۡنَ  مِنَ الۡمُہٰجِرِیۡنَ وَ الۡاَنۡصَارِ وَ الَّذِیۡنَ اتَّبَعُوۡہُمۡ بِاِحۡسَانٍ ۙ رَّضِیَ اللّٰہُ عَنۡہُمۡ وَ رَضُوۡا عَنۡہُ وَ اَعَدَّ لَہُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ تَحۡتَہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَاۤ  اَبَدًا ؕ ذٰلِکَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ.

‘আর মুহাজির ও আনছারদের মধ্যে যারা প্রথম সারির অগ্রগামী আর যারা তাদেরকে যাবতীয় সৎকর্মে (কথায়, কাজে ও আক্বীদায় একনিষ্ঠভাবে) অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট আর তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, তাদের জন্য তিনি প্রস্তুত করে রেখেছেন জান্নাত যার তলদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এটাই হল মহান সফলতা’ (সূরা আত-তাওবাহ: ১০০)। হাদীছে রাসূল (ﷺ) বলেছেন,

خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِيْ، ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ، ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ، ثُمَّ يَجِيءُ أَقْوَامٌ تَسْبِقُ شَهَادَةُ أَحَدِهِمْ يَمِيْنَهُ، وَيَمِيْنُهُ شَهَادَتَهُ.

‘সর্বোত্তম যুগ হল আমার যুগ। অতঃপর তার পরের যুগ। অতঃপর তার পরের যুগ। এরপর এমন সব ব্যক্তি আসবে যারা কসম করার আগেই সাক্ষ্য দিবে, আবার সাক্ষ্য দেয়ার আগে কসম করে বসবে’।[৪]

উপরিউক্ত আয়াত ও হাদীছ থেকে জানা গেল যে, রাসূল (ﷺ)-এর ছাহাবীগণ, তাবিঈনগণ ও তাবি‘ তাবিঈনগণকে প্রকৃতপক্ষে সালাফ বা অগ্রগামী দল বলা হয়। কারণ রাসূল (ﷺ)-এর পরেই তারাই ছিলেন উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। এই জন্য তাদেরকে বলা হয় সালাফুছ ছালিহ বা নেক্কার অগ্রবর্তী দল। এর মাধ্যমে সালাফুত ত্বালিহ তথা খারাপ অগ্রবর্তী দল বের হয়ে যায়। সালাফদের পথ হল সর্বাধিক নিরাপদ, সর্বাধিক জ্ঞান সম্পন্ন, অত্যধিক সুস্পষ্ট এবং অধিক সুদৃঢ়, শক্ত ও মজবুত।

‘আহলুস সালাফ’-এর সমার্থক নামসমূহ

অর্থের দিক দিয়ে সকল নামের মর্মার্থ এক ও অভিন্ন।

১- জামা‘আতুস সালাফিয়্যাহ

‘আহলুস সালাফ’-এর একটি নাম হল ‘জামা‘আতুস সালাফিয়্যাহ’। কেননা তারা ঐক্যভাবে সালাফদের মানহাজকে অনুসরণ করেন, তাই তারা উক্ত নামে অভিহিত। মহান আল্লাহ বলেন, وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰہِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا ‘তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধর এবং দলাদলি কর না’ (সূরা আলে ইমরান: ১০৩)। জামা‘আতুস সালাফিয়্যাহ নাম আরব দেশসমূহে বেশি পরিচিত। জামা‘আত বলা হয় মানুষের ঐক্যবদ্ধ একটি দলকে। মূলত জামা‘আত বলতে হকের উপর ঐক্যবদ্ধ লোকদেরকে বুঝায়। সংখ্যা কম হোক বা বেশী হোক। যেমন ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ছিলেন একাই একটি উম্মাত বা জামা‘আতের সমান (সূরা আন-নাহল: ১২০)। সংখ্যা বেশী হলেও যারা আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত থেকে দূরে তাদেরকে শরী‘আতের পরিভাষায় জামা‘আত বলা হয় না। এই জন্য রাসূল (ﷺ) জামা‘আতের সংজ্ঞায় বলেন, আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপর আছি তার উপর যারা থাকবে তারাই জামা‘আত।[৫]

২- আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত

ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আহলুস সুন্নাহ্ ওয়াল জামা‘আত হল পুরনো মাযহাব, যা ইমাম আবূ হানীফা, মালিক, শাফিয়ী ও আহমাদ (রাহিমাহুমুল্লাহ)-কে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি করার পূর্বেই পরিচিত ছিল’।[৬] তিনি আরও বলেন, ‘বিদ‘আত যেমন বিচ্ছিন্নতার সাথে সংযুক্ত, তেমনি সুন্নাহ হল জামা‘আতের সাথে সংযুক্ত’।[৭] রাসূল (ﷺ) এবং তাঁর  ছাহাবীগণ যার উপর ছিলেন তার উপর যারা আক্বীদায়, কথায় ও আমলে থাকবেন তারাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত। তারা যেহেতু সবকিছু বাদ দিয়ে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে কুরআন-সুন্নাতকেই অগ্রাধিকার ও প্রাধান্য দেয় এবং মেনে চলেন, সেই কারণে তাদেরকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত বলা হয়।

৩- আহলুল হাদীছ

যারা কুরআন ও সুন্নাহর ধারক ও বাহক এবং যারা কুরআন ও সুন্নাহকে সালাফদের বুঝ অনুযায়ী বুঝেন তারাই আহলুল হাদীছ। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনকেও হাদীছ বলেছেন। অপর পক্ষে রাসূল (ﷺ)-এর কথা, কর্ম ও সমর্থনকেও হাদীছ বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اَللّٰہُ  نَزَّلَ  اَحۡسَنَ الۡحَدِیۡثِ  ‘তিনি আল্লাহ উত্তম হাদীছ অবতীর্ণ করেছেন’ (সূরা আয-যুমার: ২৩)। ফলে উভয় অর্থ তাদের মধ্যে পাওয়ার কারণে তাদেরকে ‘আহলুল হাদীছ’ বলা হয়। রাসূল (ﷺ) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّيْ قَدْ تَرَكْتُ فِيْكُمْ مَا إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ فَلَنْ تَضِلُّوْا أَبَدًا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ ﷺ.

‘হে মানুষসকল! নিশ্চয় আমি তোমাদের মাঝে যা ছেড়ে যাচ্ছি, যতক্ষণ তা আঁকড়ে ধরে রাখবে ততক্ষণ পর্যন্ত বিভ্রান্ত বা পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হল আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবী (ﷺ)-এর সুন্নাত’।[৮] আহলুল হাদীছ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, মালদ্বীপ ও ইন্ডিয়াতে সুপরিচিত।[৯]

৪- জামা‘আতুল মুহাম্মাদিয়্যাহ

যারা একমাত্র মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর কথাকে সবার উপরে প্রাধান্য দেয়, নির্দিষ্ট কোন মাযহাব মানে না এবং বিদ‘আতকে প্রশ্রয় দেয় না তারাই মুহাম্মাদী। প্রচলিত চার ইমামকেই তারা সম্মান করেন, তবে কোনভাইে তাদের অন্ধ অনুসরণ করেন না। উক্ত নাম পাকিস্তান, ইন্ডিয়া, নেপাল, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশে বেশি পরিচিত।[১০]

৫- আহলুল আছার

‘আছার’ অর্থ হাদীছ আবার ছাহাবীদের কথা ও কাজকেও আছার বলা হয়। যেহেতু তারা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাতকে ও ছাহাবাদের পথকে আঁকড়ে ধরেন তাই তারা উক্ত নামে পরিচিত। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِيْ، وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ، عَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ ‘তোমরা আমার সুন্নাত এবং খুলাফয়ে রাশিদীনের সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং উহার উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে’।[১১] 

৬- জামা‘আতু আনছারুস সুন্নাহ বা সুন্নাহর সাহায্যকারী দল

যারা একনিষ্ঠ তাওহীদ ও ছহীহ সুন্নাহর উপর প্রতিষ্ঠিত। উক্ত জামা‘আত মিছর, সিরিয়া, সুদান, মরক্কো, নাইজিরিয়া, থাইলান ও লাইবেরিয়াতে পরিচিত।[১২]

৭- আত-ত্বায়িফাহ আল-মানছূরাহ বা সাহায্যপ্রাপ্ত দল

রাসূল (ﷺ) বলেছেন, لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِيْ مَنْصُوْرِيْنَ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى تَقُوْمَ السَّاعَةُ ‘আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল চিরকাল সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে থাকবে। যারা তাদের (উপেক্ষা ও বিরোধিতা) অপমানিত করতে চায় তারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না’।[১৩] রাসূল (ﷺ) আরও বলেন, إِنَّ اللهَ يَبْعَثُ لِهَذِهِ الْأُمَّةِ عَلَى رَأْسِ كُلِّ مِائَةِ سَنَةٍ مَنْ يُجَدِّدُ لَهَا دِيْنَهَا ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মতের জন্য প্রতি শতাব্দীতে এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন, যিনি দ্বীনের সংস্কার সাধন করবেন’।[১৪]

৮- আল-গুরাবা

‘গুরাবা’ শব্দটি ‘গরীব’ শব্দের বহুবচন। ‘গরীব’ আরবী শব্দ। অর্থ হল অপরিচিত, মুসাফির মানুষ। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, إِنَّ الإِسْلَامَ بَدَأَ غَرِيْبًا وَسَيَعُوْدُ غَرِيْبًا كَمَا بَدَأَ، فَطُوْبَى لِلْغُرَبَاءِ ‘দ্বীন ইসলাম নিঃসঙ্গ অপরিচিত মুসাফিরের ন্যায় অল্প সংখ্যক লোক দ্বারা যাত্রা শুরু করেছিল। আবার সেইভাবেই প্রত্যাবর্তন করবে যেভাবে যাত্রা শুরু করেছিল। অতএব সে সকল অল্প সংখ্যক মুসাফির লোকদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে’।[১৫] অর্থাৎ প্রাথমিক যুগে ইসলামের জয়যাত্রা অল্প সংখ্যক লোক নিয়ে মদীনা থেকে শুরু হয়েছিল। ক্বিয়ামতের পূর্বে আবার একই অবস্থায় মদীনায় ফিরে যাবে।

৯- আল-ফিরকাতুন নাজিয়াহ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল

রাসূল (ﷺ) বলেছেন, إِنَّ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ افْتَرَقَتْ عَلَى إِحْدَى وَسَبْعِيْنَ فِرْقَةً، وَإِنَّ أُمَّتِيْ سَتَفْتَرِقُ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ فِرْقَةً، كُلُّهَا فِي النَّارِ، إِلَّا وَاحِدَةً وَهِيَ: الْجَمَاعَةُ ‘বনী ইসরাঈলরা (মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর জাতিকে বনী ইসরাঈল বলা হয়) ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আর আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। এক দল ব্যতীত সকল দলই জাহান্নামে যাবে। ছাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! সে দল কোন্টি (যারা জান্নাতে যাবে)? তিনি বললেন, আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপর আছি তার উপর যারা থাকবে’।[১৬] তারা হল মুক্তিপ্রাপ্ত দল, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত।[১৭]

বর্তমান সালাফী কারা

বর্তমান সালাফী বলতে যারা কুরআন-হাদীছ বুঝার ক্ষেত্রে, তা আক্বীদার বিষয় হোক বা আমলের বিষয় হোক সোনালী তিন যুগের লোকদের তথা ছাহাবী, তাবেঈ ও তাবে‘ তাবেযীগণের কর্মপদ্ধতি ও মতাদর্শের অনুসারী হবে তারাই ‘সালাফী’ বা ‘আহলুস সালাফ’ নামে অবহিত হবেন। আহল অর্থ ধারক-বাহক ও অনুসারীগণ অর্থাৎ যারা সালাফদের মতাদর্শ ধারণ ও অনুসরণ করেন তারা আহলুস সালাফ।

কেন আমরা ‘সালাফী’ পরিচয় দিব?

পৃথিবীতে বিভিন্ন বিদ‘আতী দলের ছড়াছড়ি বিদ্যমান। যেমন খারিজী, শী‘আ-রাফিযী, জাহমিয়্যা, মুতাযিলী, আশ‘আরী, মাতুরিদী, কাদারিয়্যা, জাবরিয়্যা, নকশাবান্দিয়া, দেওবান্দী, বেরলভী, ছূফী, ইখওয়ানী, জামায়াতী, তাবলীগী, পীর-মুরিদী। আর তাদের সকলের দাবীই হল সে মুসলিম। তখন সঠিক মতাদর্শের তথা তিন সোনালী যুগের লোকদের তথা ছাহাবী, তাবেঈ ও তাবে‘ তাবেঈগণের মানহাজের ওপর প্রতিষ্ঠিত মুসলিমের একটা সতন্ত্র পরিচয় থাকাটা একান্ত যরুরী। যাতে উক্ত সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত দলকে সকলের মাধ্যে সহজে চেনা যায়।

সালাফী মানহাজ ও মতাদর্শ

ক্স    আল্লাহ সম্পর্কে তাদের মতাদর্শ: তারা বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ আরশের ওপর সমুন্নত ও তাঁর আকার রয়েছে এবং তিনি নিরাকার ও সর্বত্র বিরাজমান নন।

ক্স    রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কে তাদের মতাদর্শ: রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ) নূরের তৈরি নন বরং তিনি মাটির তৈরি। তারা মুহাম্মাদ (ﷺ) অন্যান্য নবী-রাসূলের ন্যায় মৃত্যুবরণ করেছেন বলে বিশ্বাস করেন। তাদের একমাত্র অনুসরণীয় ব্যক্তি হলেন মুহাম্মাদ (ﷺ) এবং তারা কোন ইমাম, পীর, আওলিয়া বা আলিমের অন্ধ অনুকরণ করেন না।

ক্স    দ্বীন সম্পর্কে তাদের মতাদর্শ: তারা আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধান নিয়েই সন্তষ্ট। তারা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ এবং ঈমানের ছয়টি রুকনকে ফরয বা আবশ্যক হিসাবে গ্রহণ করে থাকেন। তারা মাযার, খানকা, কবর, মূর্তি বা ভাস্কর্যপূজাকে বড় শিরক বলে বিশ্বাস করেন। তারা যে কোন মাসআলার ক্ষেত্রে  সর্বাগে কুরআন-সুন্নাহকেই অনুসরণ করেন।

ক্স    ইমামদের সম্পর্কে তাদের মতাদর্শ: সর্বজনস্বীকৃত কোন ইমাম, রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাতের তা ছোট বা বড় হোক, খিলাফ বা বিপরীত করেননি। রাসূল (ﷺ)-এর অনুসরণ করা ওয়াজিব হওয়া সম্পর্কে তাঁরা সুনিশ্চিতভাবে একমত ছিলেন। আর এই ব্যাপারেও তাঁরা  ঐক্যমত যে, রাসূল (ﷺ)-এর বাণী ছাড়া অন্য যে কোন লোকের বাণী বা উক্তি গ্রহণও করা যেতে পারে আবার প্রত্যাখ্যানও করা যেতে পারে। অর্থাৎ যদি তাঁদের কথা শুদ্ধ হয়, তবে তা গৃহীত হবে। আর যদি ভুল হয়, তবে তা প্রত্যাখ্যাত হবে (রফউল মালাম ‘আনিল আয়িম্মাতিল আলাম, ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ.)।

(ইনশাআল্লাহ আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)



* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহী।

[১]. সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৭৫; সূরা আন-নিসা: ২২-২৩; সূরা আল-মায়িদাহ: ৯৫; সূরা আল-আনফাল: ৩৮ এবং সূরা আল-যুখরুফ: ৫৬।

[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৬২৮৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৫০; মিশকাত, হা/৬১২৯।

[৩]. মাওসূ‘আতুল ফিরাকিল মুনতাসিবাতিল ইসলাম, মাওসূ‘আতুল মুইয়াসসার ফিল আদয়ান, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৯।

[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৫২; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৩৩।

[৫]. তিরমিযী, হা/১৫৪০; মিশকাত, হা/১৬৩।

[৬]. মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৯৫।

[৭]. আল-ইস্তিক্বামাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪২।

[৮]. হাকিম, আল-মুসতাদরাকু ‘আলাছ ছহীহাইন, হা/৩১৮, সনদ ছহীহ।

[৯]. মাওসূ‘আতুল মু-ইয়াসসার ফিল আদয়ান, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৯।

[১০]. মাওসূ‘আতুল মু-ইয়াসসার ফিল আদয়ান, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮২।

[১১]. ইবনু মাজাহ, হা/৪২; তিরমিযী, হা/২৮৯১।

[১২]. মাওসূ‘আতুল মু-ইয়াসসার ফিল আদয়ান, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮২।

[১৩]. তিরমিযী, হা/২১৯২।

[১৪]. আবূ দাঊদ,  হা/৪২৪১।

[১৫]. তিরমিযী, হা/২৬২৯; মিশকাত, হা/১৬২।

[১৬]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৯৯৩; তিরমিযী, হা/১৫৪০; মিশকাত, হা/১৬৩।

[১৭]. শারহু লুম‘আতিল ই‘তিক্বাদ আহমাদ ইবনু উমার হাজ্মী, ১০ম খণ্ড, পৃ. ২০।




প্রসঙ্গসমূহ »: সালাফে ছালেহীন
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৪র্থ কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
বিদ‘আত পরিচিতি (৭ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামী শিষ্টাচার (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (৬ষ্ঠ কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৫ম কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
বাউল মতবাদ (শেষ কিস্তি) - গোলাম রহমান
ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ১১ রাক‘আতের নির্দেশ দিয়েছিলেন (শেষ কিস্তি) - ব্রাদার রাহুল হোসেন (রুহুল আমিন)
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী - আব্দুল গাফফার মাদানী
আধুনিক যুগে দাওয়াতী কাজের পদ্ধতি (শেষ কিস্তি) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম (২য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
বিদ‘আত পরিচিতি (১৪তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান

ফেসবুক পেজ