অল্পে তুষ্ট
-মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*
(২য় কিস্তি)
ছাহাবীগণের অল্পে তুষ্ট থাকার নমুনা
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পবিত্র অহীর আলোকে তাঁর ছাহাবীদের গড়ে তুলেছিলেন। তাঁদের জীবনাচরণের প্রতিটি ক্ষেত্রে মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শ বাস্তবে প্রস্ফুটিত হয়েছিল। অল্পতেই তাঁরা অনেক তুষ্ট হতেন। এজন্য শান্তিতে প্রাচুর্যময় ছিল তাঁদের জীবন। হাদীছে এসেছে, ফাযালাহ ইবনু ‘উবাইদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ إِذَا صَلَّى بِالنَّاسِ يَخِرُّ رِجَالٌ مِنْ قَامَتِهِمْ فِى الصَّلَاةِ مِنَ الْخَصَاصَةِ وَهُمْ أَصْحَابُ الصُّفَّةِ حَتَّى تَقُوْلَ الْأَعْرَابُ هَؤُلَاءِ مَجَانِيْنُ أَوْ مَجَانُوْنَ فَإِذَا صَلَّى رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم انْصَرَفَ إِلَيْهِمْ فَقَالَ لَوْ تَعْلَمُوْنَ مَا لَكُمْ عِنْدَ اللهِ لَأَحْبَبْتُمْ أَنْ تَزْدَادُوْا فَاقَةً وَحَاجَةً
‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন লোকদের ছালাত আদায় করাতেন, তখন কিছু লোক ক্ষুধার কারণে পড়ে যেতেন। আর তাঁরা ছিলেন আহলুছ ছুফ্ফাহ। এমনকি মরুবাসী বেদুঈনরা বলত, ‘এরা পাগল’। অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছালাত শেষ করে তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছে যা রয়েছে, তা যদি তোমরা জানতে, তাহলে তোমরা এর চাইতেও অভাব ও দারিদ্র্য পসন্দ করতে’।[১] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত,
أَنَّهُ مَرَّ بِقَوْمٍ بَيْنَ أَيْدِيْهِمْ شَاةٌ مَصْلِيَّةٌ فَدَعَوْهُ فَأَبَى أَنْ يَأْكُلَ قَالَ خَرَجَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مِنَ الدُّنْيَا وَلَمْ يَشْبَعْ مِنَ الْخُبْزِ الشَّعِيْرِ
‘একদা তিনি একদল লোকের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন, যাদের সামনে ভুনা বকরী ছিল। তারা তাঁকে (খেতে) ডাকল। তিনি খেতে রাজী হলেন না এবং বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন অথচ তিনি কোন দিন যবের রুটিও পেট পুরে খাননি’।[২]
আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর অল্পে তুষ্ট থাকার নমুনা
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর অসুস্থতা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন তিনি বলেন, খলীফা হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আমি কী পরিমাণ বাড়তি সম্পদ অর্জন করেছি তা হিসাব করো এবং পরবর্তী খলীফার কাছে পাঠিয়ে দাও। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, ‘আমরা তার সম্পদের একটি তালিকা তৈরি করি এবং দেখি যে, বাড়তি সম্পদ বলতে তার কাছে যা ছিল তা হচ্ছে একজন নুবিয়ান দাস। তিনি তার সন্তানদের দেখাশুনা করতেন। আর তার বাগানে পানি দেয়ার জন্য একটা উট ছিল। আমরা সেসব উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে পাঠিয়ে দিই। সেগুলো দেখে উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর চোখ ছলছল করে ওঠে। অতঃপর তিনি বলেন, رحمة الله على أبي بكر لقد أتعب من بعده تعبا شديدا ‘আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর উপর আল্লাহ দয়া বর্ষণ করুন। তিনি তাঁর পরবর্তীদের উপর অনেক কঠিন দায়িত্ব চাপিয়ে দিলেন’।[৩]
মৃত্যুশয্যায় আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে বলেন, ‘হে আয়েশা! আমার পরিবারে তুমিই আমার সবচেয়ে প্রিয়। তুমি আমার এক বাগান থেকে কিছু ফল এনেছ। ব্যাপারটা নিয়ে আমি অস্বস্তিতে ভুগছি। এগুলো ফিরিয়ে দাও’। তিনি বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে’। এরপর আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) সেগুলো ফিরিয়ে দেন। অতঃপর আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘দেখো আমাকে দায়িত্বশীল নিযুক্ত করার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি একটা (বাড়তি) দীনার বা দিরহামও নেইনি। সবচেয়ে নিম্ন মানের খাবার খেয়েছি; সাধারণ কাপড়চোপড় পরেছি। যুদ্ধলব্ধ সম্পদের বেলায় আমার কাছে আছে কেবল একজন আবিসিনিয়ান দাস। বাগানে পানি দেয়ার জন্য একটা উট। আর এই তাল গাছের শাখা। আমার মৃত্যুর পর এগুলো উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে পাঠিয়ে দিও, যেন আমার উপর কোন দায়ভার না থাকে। আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর দূত যখন এগুলো উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে নিয়ে যায়, তখন তিনি এতটাই অশ্রুসজল হয়ে পড়েছিলেন যে, তার কান্নার পানি মাটিতে গড়িয়ে পড়ছিল। তিনি তখন বলেন, আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর উপর আল্লাহ দয়া করুন। পরবর্তীদের উপর তিনি অনেক কঠিন দায়িত্ব চাপিয়ে দিলেন।[৪] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যখন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে, তখন তিনি বলেন, উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আমাকে (ভাতা হিসাবে) কোষাগার থেকে ৬০০০ দিরহাম নিতে বাধ্য করেছে। এর বিনিময়ে (অমুক স্থানে অবস্থিত) আমার বাগান নিয়ে নিন’।[৫]
অন্যত্র আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, যখন আমার পিতার মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত হল, তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘হে আমার প্রিয় কন্যা! আমি তোমাকে খায়বারের খেজুর দিয়েছিলাম, অথচ তুমি তা নিতে চাচ্ছিলে না। আমি এখন চাচ্ছি যে, তুমি সেগুলো আমাকে ফেরত দাও’। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন, ‘আমি তখন কেঁদে ফেললাম। বললাম, বাবা! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। পুরো খায়বার যদি স্বর্ণ হত, তবুও আমি তা আপনাকে ফেরত দিতাম’। তিনি তখন বললেন, ‘হে আমার প্রিয় কন্যা! তা আল্লাহ তা‘আলার হিসাবের মধ্যে রয়েছে। আমি কুরাইশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলাম এবং আমার প্রচুর সম্পদ ছিল। কিন্তু যখন খিলাফতের দায়িত্বে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, তখন ভাবলাম যে, আমার যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়ে আমি বেশি সম্পদ গ্রহণ করব না। হে প্রিয় কন্যা! আমার সম্পদের মধ্যে রয়েছে এই কাতওয়ানি আলখাল্লা, একটি দুধ দোহনের পাত্র এবং একটি গোলাম। আমার মৃত্যুবরণ করার পর দ্রুত এগুলো উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে পৌঁছে দেবে। হে প্রিয় কন্যা! এগুলো হল আমার কাপড়, তোমরা এগুলো দিয়ে আমার কাফন পরাবে’। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন, ‘আমি তখন কেঁদে ফেলে বললাম, আব্বা! আমাদের তো এর চেয়ে বেশি কিছু আছে অর্থাৎ নতুন কাপড় কেনার সামর্থ্য আছে। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন। তা তো পরবর্তী মানুষদের বেশি প্রয়োজন’। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, আমার বাবার মৃত্যুর পর আমি ঐ জিনিসগুলো উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে পাঠিয়ে দিলাম। তখন তিনি বললেন, ‘তোমার পিতা তাঁর ব্যাপারে কারও জন্য সমালোচনা করার সুযোগ রেখে যেতে চাননি’।[৬]
উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর অল্পে তুষ্ট থাকার নমুনা
মুছ‘আব ইবনু সা‘দ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন উম্মুল মুমিনীন হাফছা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর পিতা উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ঘরে ঢুকে দেখেন যে, তিনি কী কঠিন জীবন-যাপন করছেন। পিতার এই অবস্থা দেখে তিনি বললেন,
يَا أَمِيْرَ الْمُؤْمِنِيْنَ إِنَّهُ قَدْ أَوْسَعَ اللهُ الرِّزْقَ وَفَتَحَ عَلَيْكَ الْأَرْضَ وَأَكْثَرَ مِنَ الْخَيْرِ فَلَوْ طَعِمْتَ طَعَامًا أَلْيَنَ مِنْ طَعَامِكِ وَلَبِسَتْ لِبَاسًا أَلْيَنَ مِنْ لِبَاسِكَ. فَقَالَ سَأُخَاصِمُكِ إِلَى نَفْسِكِ أَمَا تَذْكُرِيْنَ مَا كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَلْقَى مِنْ شِدَّةَ الْعَيْشِ؟ قَالَ فَمَا زَالَ يُذَكِّرُهَا حَتَّى أَبْكَاهَا ثُمَّ قَالَ إِنِّيْ قَدْ قُلْتُ لَكِ إِنِّيْ وَاللهِ لَئِنِ اسْتَطَعْتُ لَأُشَارِكَنَّهُمَا فِيْ عَيْشِهِمَا الشَّدِيْدِ لَعَلِّي أَلْقَى مَعَهُمَا عَيْشَهُمَا الرَّخِيَّ
‘হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহ তো আমাদেরকে অনেক স্বচ্ছলতা দিয়েছেন। আপনাকে অঢেল জীবিকা দিয়েছেন। তাহলে আপনি ভাল ভাল খাবার খান না কেন? এর চেয়ে ভাল পোশাক পরিধান করেন না কেন? তখন তিনি বললেন, তুমিই বল এটা ঠিক না বেঠিক? অতঃপর উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথা বললেন। যে কঠিন রুক্ষ জীবন তিনি কাটিয়েছেন সেগুলো বলতে লাগলেন। হাফছার সঙ্গে কী জীর্ণ জীবন পার করেছেন সেগুলো মনে করিয়ে দিলেন। অতীতের কথা মনে পড়তে হাফছাও বেদনাকাতর হয়ে পড়লেন। খলীফা বললেন, আমার পূর্ববর্তী দুই সঙ্গী (মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)) একটা পথ অনুসরণ করেছেন। আমি যদি তাদের পথ অনুসরণ করি, আশা করি (জান্নাতে) তাদের বিলাসী জীবনে নিজেকে শামিল পাব’।[৭]
ইসলামী খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করে প্রথমদিকে খলীফা উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বায়তুল মাল থেকে কোন বেতনভাতা নিতেন না। কিন্তু রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় একসময় তার নিজের ব্যবসায় আর ঠিকমত সময় দিতে পারছিলেন না। ফলে ধীরে ধীরে তিনি অর্থসংকটে পড়েন। এ অবস্থায় কী করবেন তা নিয়ে ছাহাবীদের সাথে পরামর্শ গ্রহণের জন্য বললেন, এই দায়িত্বের কারণে আমার জীবিকা অর্জন ব্যাঘাত ঘটছে। এখন কী করা উচিত আমার? উছমান ইবনু আফফান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, নিজে খান, অন্যদেরকেও খাওয়ান। সাঈদ ইবনু যাইদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) একই কথা বললেন। আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী বল? তিনি বললেন, সকালের নাশতা আর রাতের খাবার। উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাই করলেন। অতঃপর বায়তুল মাল থেকে নেয়ার বিষয়টা ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘বায়তুল মাল থেকে আমার নেয়ার অধিকার হল- ইয়াতীমের দেখাশুনার করার মত আমি মনে করি। ওটা ছাড়া যদি আমার চলে তাহলে আমি নেব না। কিন্তু নিতান্তই দরকার পড়লে যতটুকু প্রয়োজন ততটকুই শুধু নেব’।[৮]
অন্য বর্ণনায় উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বায়তুল মাল থেকে কী পরিমাণ মাল নিতেন তার বিবরণ এসেছে।
مَا تَرَوْنَهُ يَحِلُّ لِيْ مِنْ مَالِ اللهِ أَوْ قَالَ مِنْ هَذَا الْمَالِ؟ قَالَ قُلْنَا أَمِيْرُ الْمُؤْمِنِيْنَ أَعْلَمُ بِذَلِكَ مِنَّا فَقَالَ إِنْ شِئْتُمْ أَخْبَرْتُكُمْ مَا أَسْتَحِلُّ مِنْهُ مَا أَحُجُّ وَأَعْتَمِرُ عَلَيْهِ مِنَ الظَّهْرِ وَحُلَّتِي فِي الشِّتَاءِ وَحُلَّتِيْ فِي الصَّيْفِ وَقُوْتَ عِيَالِي وَشِبَعِيْ وَسَهْمِيْ فِي الْمُسْلِمِيْنَ فَإِنَّمَا أَنَا رَجُلٌ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ. قَالَ مَعْمَرٌ وَإِنَّمَا كَانَ الَّذِيْ يَحُجُّ عَلَيْهِ وَيَعْتَمِرُ بَعِيْرًا وَاحِدًا
‘একদা বেশ কিছু ছাহাবীর নিকট তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর সম্পদের কতটুকু আমার জন্য অনুমোদিত বলে আপনারা মনে করেন? তারা বলল, এ ব্যাপারে আমীরুল মুমিনীনই আমাদের চেয়ে ভাল জানেন। তখন তিনি বললেন, আপনারা যদি চান, তাহলে বলি আমার জন্য কতটুকু অনুমোদিত : হজ্জ-ওমরায় যাওয়ার জন্য একটি বাহন। শীত ও গ্রীষ্মে একটি করে কাপড়। আমার পরিবার পোষ্যদের জন্য যথেষ্ট খাবার। আর অন্য যেকোন মুসলিম যতটুকু ভাতা পান ঠিক ততটুকু। আমি নিজেও সাধারণ একজন মুসলিম ছাড়া আর কিছু নই। মু‘আম্মার বলেন, হজ্জ ও ওমরায় তিনি একটিমাত্র উট নিয়ে যেতেন’।[৯]
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, মালিক ইবনু আওস ইবনুল হাদাছান (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
ذَكَرَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ يَوْمًا الْفَىْءَ فَقَالَ مَا أَنَا بِأَحَقَّ بِهَذَا الْفَىْءِ مِنْكُمْ وَمَا أَحَدٌ مِنَّا بِأَحَقَّ بِهِ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا أَنَّا عَلَى مَنَازِلِنَا مِنْ كِتَابِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ وَقَسْمِ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَالرَّجُلُ وَقِدَمُهُ وَالرَّجُلُ وَبَلَاؤُهُ وَالرَّجُلُ وَعِيَالُهُ وَالرَّجُلُ وَحَاجَتُهُ
‘একদা উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ফাই সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ফাই প্রাপ্তির বিষয়ে আমি তোমাদের চাইতে অগ্রাধিকারী নই এবং এ বিষয়ে আমাদের কেউই কারোর চাইতে অগ্রাধিকারী নয়। বরং মহান আল্লাহর কিতাব ও তার রাসূলের পদ্ধতি মোতাবেক আমরা নিজ নিজ অবস্থানে রয়েছি। সুতরাং ব্যক্তি ও তার প্রাচীনত্ব, ব্যক্তি ও তার বীরত্ব, ব্যক্তি ও তার সন্তান এবং ব্যক্তি ও তার প্রয়োজন এসব বিবেচনা করে তা বণ্টন হবে’।[১০]
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাবী‘ ইবনু যিয়াদ আল-হারিছী (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত,
أَنَّهُ وَفْدَ إِلَى عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ فَأَعْجَبَتْهُ هَيْئَتُهُ وَنَحْوُهُ فَشَكَا عُمَرُ طَعَامًا غَلِيْظًا أَكَلَهُ فَقَالَ الرَّبِيْعُ يَا أَمِيْرَ الْمُؤْمِنِيْنَ إِنَّ أَحَقَّ النَّاسِ بِطَعَامٍ لَيِّنٍ وَمَرْكَبٍ لَيِّنٍ وَمَلْبَسٍ لَيِّنٍ لَأَنْتَ فَرَفَعَ عُمَرُ جَرِيْدَةً مَعَهُ فَضَرَبَ بِهَا رَأْسَهُ وَقَالَ أَمَا وَاللهِ مَا أُرَاكَ أَرَدْتَ بِهَا اللهَ وَمَا أَرَدْتَ بِهَا إِلَّا مُقَارَبَتِيْ إِنْ كُنْتُ لَأَحْسِبُ أَنَّ فِيْكَ وَيْحَكَ هَلْ تَدْرِيْ مَا مَثَلِي وَمَثَلُ هَؤُلَاءِ ؟ قَالَ وَمَا مَثَلُكَ وَمَثَلُهُمْ؟ قَالَ مِثْلُ قَوْمٍ سَافَرُوْا فَدَفِعُوْا نَفَقَاتِهِمْ إِلَى رَجُلٍ مِنْهُمْ فَقَالُوْا لَهُ أَنْفِقْ عَلَيْنَا فَهَلْ يَحِلُّ لَهُ أَنْ يَسْتَأْثِرَ مِنْهَا بِشَيْءٍ؟ قَالَ لَا يَا أَمِيْرَ الْمُؤْمِنِيْنَ قَالَ فَكَذَلِكَ مَثَلِيْ وَمَثَلُهُمْ
‘তিনি উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর পোশাক-পরিচ্ছেদ আর ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তিনি খুব সাধারণ খাবার-দাবার খাচ্ছিলেন। তিনি ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে অভিযোগ করে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! কেউ যদি সবচেয়ে ভাল খাবার, সেরা বাহন আর সুন্দর পোশাকের আসল দাবিদার হয়, সেটা তো আপনি (তাহলে আপনার অবস্থা এরূপ কেন?)। তখন উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে একটি খেজুরের ডাল ছিল। সেটা দিয়ে তিনি রাবী‘র মাথায় আলতোভাবে টোকা মেরে বললেন, আল্লাহর কসম! তুমি কথাগুলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বলছ, না-কি আমাকে খুশি করার জন্য বলছ। আমি ভেবেছিলাম, তুমি এমন মানুষ নও। দুর্ভোগ তোমার জন্য। সাধারণ মুসলিমদের সাথে আমার তুলনা হল কেবলই এমন যে, যেন কিছু লোক একসাথে সফরে বের হয়েছে। সবাই মিলে একজনের কাছে তাদের টাকা-পয়সা আমানত রেখেছে। তাকে বলেছে, এগুলো আমাদের জন্য খরচ করবেন। এখন তার কি উচিত হবে নিজের পেছনে এগুলো খরচ করা? রাবী‘ বললেন, না। উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আমার আর তাদের ব্যাপারটা এরকমই’।[১১]
ইসলামী সাম্রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণের পর একদিন উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যে লুঙ্গী পরে জুমু‘আর খুৎবাহ দিচ্ছিলেন, তাতে ১২টি তালি ছিল। তিনি কা‘বা ঘর ত্বাওয়াফের সময় ১২টি তালি দেয়া এক লুঙ্গী পরে ছিলেন। তন্মধ্যে একটি লাল চামড়া দিয়ে তালি লাগানো ছিল।[১২]
আব্দুল্লাহ ইবনু আমির ইবনু রাবী‘আ (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘মদীনা থেকে মক্কায় একবার আমি ও উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হজ্জে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে আবার মদীনায় ফিরে আসি। পথে তার জন্য কোন তাঁবু খাটানো হয়নি। তিনি গাছের সাথে একটা মাদুর ঝুলিয়ে রেখে তার ছায়ায় বসেই বিশ্রাম নিতেন’।[১৩] সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! শুরুর দিকে যারা হিজরত করেছিলেন উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাদের মধ্যে ছিলেন না। কিন্তু আমি জানি তারপরও তিনি কেন আমাদের সবার সেরা। কারণ দুনিয়াবী বিষয়ে আমাদের সবার থেকে তিনি অধিক সংযমী ছিলেন’।[১৪]
সুধী পাঠক! দুনিয়াতেই জান্নাতের অধিকারী হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়া মহান দুই ছাহাবীর জীবন-যাপন যদি এরূপ হয় এবং অল্পে তুষ্ট থাকার দৃষ্টান্ত যদি এরূপ হয়, তাহলে বর্তমানে ফেতনার যুগে মুসলিমদেরকে এ ব্যাপারে কত অগ্রগামী হওয়া প্রয়োজন, সেটা বিবেচ্য বিষয়।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
* পি-এইচ.ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র :
[১]. তিরমিযী, হা/২৩৬৮; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৭২৪৫; সনদ ছহীহ, ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩৩০৬।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪১৪; মিশকাত, হা/৫২৩৮।
[৩]. আব্দুর রহমান ইবনু আলী ইবনু মুহাম্মাদ আবুল ফারজ ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়াহ (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফাহ, ২য় সংস্করণ, ১৩৯৯ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ২৬৫।
[৪]. ড. মুহাম্মাদ আছ-ছাল্লাবী, আবু বকর ছিদ্দীক্ব রাযিয়াল্লাহু আনহু, ৫ম অংশ, পৃ. ১১০; আত-ত্বাবাক্বাতু লি ইবনি সা‘দ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪৬-১৪৭, সনদ ছিক্বাহ।
[৫]. আবুল ফারজ আব্দুর রহমান ইবনু আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনুল জাওযী, আল-মুনতাযামু ফী তারীখিল মুলূকি ওয়াল উমাম, ৪র্থ খণ্ড (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, তাবি), পৃ. ১২৭; মাহমূদ আল-মিছরী, আছহাবুল রাসূল (ছা.), ১ম খণ্ড (কায়রো : মাকতাবাতু আবী বকর আছ-ছিদ্দীক, ২য় সংস্করণ ১৪২৩ হি./২০০২ খ্রি.), পৃ. ৯১-৯৩।
[৬]. ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৩০৩৬, সনদ ছহীহ; আল-মুনতাযামু ফী তারীখিল মুলূকি ওয়াল উমাম, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১২৬-১২৭।
[৭]. মুহাম্মাদ ইবনু সা‘দ আবু আব্দুল্লাহ আল-বাছীরী, আত-ত্বাবাক্বাতুল কুবরা (বৈরূত : দারু ছাদির, ১ম সংস্করণ, ১৯৬৮ খ্রি.), ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৭৭, হা/৩৮১০ ।
[৮]. ড. ইয়াহইয়া ইবনু ইবরাহীম আল-ইয়াহইয়া, আল-খিলাফাতুর রাশিদাহ (দারুল হিজরাহ, তাবি), পৃ. ২৭০।
[৯]. মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হা/২০০৪৬; ইমাম বাগাভী, শারহুস সুন্নাহ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৮৪।
[১০]. আবূ দাঊদ, হা/২৯৫০ ‘কর, ফাই ও প্রশাসক’ অধ্যায়-২০, ‘নাগরিকদের প্রয়োজনকালে ইমামের দায়িত্ব এবং তাদের থেকে তার বিচ্ছিন্ন থাকা’-অনুচ্ছেদ-১৩, সনদ মাওকূফ সূত্রে হাসান।
[১১]. আত-ত্বাবাক্বাতুল কুবরা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৮০-২৮১, হা/৩৮১৯; ইউসুফ ইবনু হাসান ইবনু আব্দুল হাদী আল-মুবাররাদ, মাহযুছ ছাওয়াবি ফী ফাযাইলি আমীরিল মুমিনীন ‘উমার ইবনিল খাত্ত্বাব (মদীনা, সঊদী আরব : ইমাদাতুল বাহাছ আল-ইলমী বিল জামি‘আতিল ইসলামিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪২০ হি./২০০০ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৮২-৩৮৩, সনদ ছহীহ।
[১২]. মাহযুছ ছাওয়াবি ফী ফাযাইলি আমীরিল মুমিনীন ওমর ইবনিল খাত্ত্বাব, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৬৬, সনদ ছহীহ।
[১৩]. আত-ত্বাবাক্বাতুল কুবরা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৭৯; ড. আলী মুহাম্মাদ আছ-ছাল্লাবী, আমীরুল মুমিনীন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৫৮; মাহযুছ ছাওয়াবি ফী ফাযাইলি আমীরিল মুমিনীন ওমর ইবনিল খাত্ত্বাব, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৬৯, সনদ ছহীহ।
[১৪]. মুছান্নাফে ইবনু আবী শায়বা, হা/৩২৬৭৫, ৩৫৬০১; আমীরুল মুমিনীন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৫৮, সনদ ছহীহ।