বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪৪ অপরাহ্ন

ইসলামের দৃষ্টিতে রোগর চিকিৎসা

-মাহবুবুর রহমান মাদানী*




চিকিৎসা শাস্ত্রের মৌলিক উদ্দেশ্য তিনটি। ক- শারীরিক সুস্থতার সংরক্ষণ, খ- দুর্ভোগ ও কষ্ট লাঘব এবং গ- শরীর হতে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা। কুরআন ও ছহীহ হাদীছে দুই প্রকার চিকিৎসার আলোচনা এসেছে। ১. শারীরিক চিকিৎসা। শারীরিক ব্যাধির চিকিৎসার বিষয়টি ছহীহ হাদীছে বিভিন্নভাবে এসেছে। ২. অন্তরের চিকিৎসা, যার মৌলিক উপাদান হচ্ছে মহা গ্রন্থ আল-কুরআন। আর ঝাড়ফুঁকও শরী‘আতে ইহা একটি বাস্তবসম্মত ও পরীক্ষিত চিকিৎসা ব্যবস্থা।

সুস্থতার গুরুত্ব

ইসলাম সুস্থতার উপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَّ کُلُوۡا وَ اشۡرَبُوۡا وَ لَا  تُسۡرِفُوۡا ۚ اِنَّہٗ لَا  یُحِبُّ الۡمُسۡرِفِیۡنَ ‘আর খাও ও পান কর এবং অপব্যয় কর না। তিনি অপব্যয়কারীকে পসন্দ করেন না’ (সূরা আ‘রাফ: ৩১)। খাদ্যের পরিমাণ ও তা গ্রহণের পদ্ধতি তাই হওয়া উচিত, যা দ্বারা শরীর ও স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে। আল্লাহর বাণী- ‘খাও, পান কর এবং অপচয় কর না’ এই বাক্যের মধ্যে স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টি জড়িত। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানাহার গ্রহণ করলে, তা অপচয় ধরা হয়েছে। তাই অতিরিক্ত পানাহার গ্রহণ এবং পরিমাণ মত পানাহার না গ্রহণ উভয়টিই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং রেসু-ব্যাধির কারণ। আর সুস্বাস্থ্য ও বিপদাপদ মুক্ত থাকাটা আল্লাহর নিয়া‘মাতের মধ্যে সবচেয়ে বড় নে‘মত। তাই সকলের উচিত এটির পরিচর্যা করা এবং একে ক্ষতিকর বিষয় হতে রক্ষা করা।

রাসূল (ﷺ) বলেছেন, نِعْمَتَانِ مَغْبُوْنٌ فِيْهِمَا كَثِيْرٌ مِنَ النَّاسِ: الصِّحَّةُ وَالفَرَاغُ ‘এমন দু’টি  নে‘মত রয়েছে, যাতে অধিকাংশ লোক প্রতারিত ও অমনোযোগী হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে সুস্বাস্থ্য আর অপরটি হচ্ছে অবসরতা’।[১] অন্যত্র নবী (ﷺ) বলেছেন, مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمْ آمِنًا فِيْ سِرْبِهِ مُعَافًى فِيْ جَسَدِهِ عِنْدَهُ قُوْتُ يَوْمِهِ فَكَأَنَّمَا حِيْزَتْ لَهُ الدُّنْيَا ‘যে ব্যক্তি সুস্থ ও স্বীয় বাসস্থানে নিরাপদ অবস্থায় সকালে ঘুম থেকে উঠল এবং তার কাছে এক দিনের পানাহারও বিদ্যমান রয়েছে, তাকে দুনিয়ার সমস্ত সম্পদই দেয়া হয়েছে’।[২] আমর ইবনু মায়মূন আল-আওদী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, একদা রাসূল (ﷺ) জনৈক ব্যক্তিকে উপদেশ স্বরূপ বললেন,

اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ: شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ

‘পাঁচটি জিনিস আসার পূর্বে পাঁচটি কাজকে বড় সম্পদ মনে কর। ১. তোমার বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনকে, ২. অসুস্থ হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে, ৩. দরিদ্রতার পূর্বে অভাবমুক্ত থাকাকে, ৪. ব্যস্ততার পূর্বে অবসর সময়কে এবং ৫. মৃত্যুর পূর্বে হায়াত বা জীবনকে’।[৩]

প্রত্যেক মানুষের সুস্থতা ও অসুস্থতা আল্লাহর পক্ষ হতে লিখিত ভাগ্যলিপির অংশ। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য একদিকে যেমন রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি করেছেন, তেমনি অপর দিকে ইহার প্রতিকার-নিরাময়েরও ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন। ফলে রোগের জন্য চিকিৎসা করানো ও ঔষধ সেবন করা শরী‘আতের পরিপন্থী নয়। কুরআন দুই ধরণের ব্যাধি ভাল করে দেয়। যথা: ১. অন্তরের ব্যাধি। যেমন- যাদের অন্তরে তাওহীদ, রিসালাত ও সঠিক আক্বীদা সম্পর্কে সন্দেহ, সংশয় ও নিফাক রয়েছে এবং পর¯পরের মধ্যে মতবিরোধ ও ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি রয়েছে তাদের জন্য কুরআন সফল চিকিৎসা। ২. দৈহিক রোগ-ব্যাধি। যেমন- জ্বর-সর্দি, ব্যথা, পেটের রোগ ইত্যাদি রোগের জন্যও কুরআন হচ্ছে উত্তম চিকিৎসা। কুরআন দ্বারা চিকিৎসার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ قَدۡ جَآءَتۡکُمۡ  مَّوۡعِظَۃٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ شِفَآءٌ لِّمَا فِی الصُّدُوۡرِ ۬ۙ وَ ہُدًی  وَّ رَحۡمَۃٌ   لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ

‘হে মানুষ সকল! তোমাদের রবের নিকট থেকে তোমাদের কাছে এসেছে নাছীহাত আর তোমাদের অন্তরে যা আছে তার নিরাময়, আর মুমিনদের জন্য সঠিক পথের দিশা ও রহমত’ (সূরা ইউনুস: ৫৭)। মহান আল্লাহ বলেন, وَ نُنَزِّلُ مِنَ الۡقُرۡاٰنِ مَا ہُوَ شِفَآءٌ وَّ رَحۡمَۃٌ  لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ ۙ وَ لَا یَزِیۡدُ الظّٰلِمِیۡنَ   اِلَّا  خَسَارًا ‘আমরা কুরআন হতে এমন কিছু অবতীর্ণ করি যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত, কিন্তু তা যালিমদের জন্য ক্ষতিই বৃদ্ধি করে’ (সূরা বানী ইসরাঈল: ৮২)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ آمَنُوا هُدًى وَشِفَاءٌ “বল! যারা ঈমান আনে তাদের জন্য এ কুরআন হল সঠিক পথের দিশারী ও আরোগ্য” (সূরা আল-ফুছছিলাত: ৪৪)। পক্ষান্তরে কুরআন কাফিরদের জন্য রোগ বৃদ্ধি করে। কারণ তারা কুরআন দ্বারা উপকার নেয়া বিশ্বাস করে না।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে রাসূল (ﷺ) বলেছেন, مَا أَنْزَلَ اللهُ دَاءً إِلَّا أَنْزَلَ لَهُ شِفَاءً ‘আল্লাহ তা‘আলা এমন কোন রোগ অবতীর্ণ করেননি, যার ঔষধ সৃষ্টি করেননি’।[৪] জাবির (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন,لِكُلِّ دَاءٍ دَوَاءٌ، فَإِذَا أُصِيْبَ دَوَاءُ الدَّاءِ بَرَأَ بِإِذْنِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ ‘প্রত্যেক রোগের জন্য ঔষধ রয়েছে। সুতরাং সঠিক ঔষধ যখন রোগের জন্য প্রয়োগ হয়, তখন আল্লাহর নির্দেশে রোগী রোগমুক্ত হয়ে যায়’।[৫] উক্ববাহ ইবনু আমির আল-জুহানী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, لَا تُكْرِهُوا مَرْضَاكُمْ عَلَى الطَّعَامِ فَإِنَّ اللهَ يُطْعِمُهُمْ وَيَسْقِيْهِمْ ‘তোমরা রোগীদেরকে পানাহারের জন্য জবরদস্তি বা পিড়াপিড়ি কর না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে খাওয়ান এবং পান করান’।[৬]

সুস্থতা ও নিরাপত্তা থাকার জন্য প্রার্থনা

আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমাদেরকে সুস্থতা এবং নিরাপত্তা থাকার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে বলেছেন, سَلُوا اللهَ الْعَفْوَ وَالْعَافِيَةَ فَإِنَّ أَحَدًا لَمْ يُعْطَ بَعْدَ الْيَقِيْنِ خَيْرًا مِنَ الْعَافِيَةِ ‘তোমরা আল্লাহর নিকট ক্ষমা, সুস্থতা এবং নিরাপত্তা প্রার্থনা কর। কেননা ঈমানের পর সুস্থতার চেয়ে উত্তম নে‘মত কাউকেই প্রদান করা হয়নি’।[৭]

নিরাপত্তার জন্য পঠিত দু‘আ

রাসূল (ﷺ) সুস্থতা ও নিরাপত্তা চেয়ে নিয়মিত সকাল-সন্ধ্যায় দু’আ করতেন। দু‘আটি নিম্নরূপ:

اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ الْعَافِيَةَ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ الْعَفْوَ وَالْعَافِيَةَ فِيْ دِيْنِيْ وَدُنْيَايَ وَأَهْلِيْ وَمَالِيْ اللَّهُمَّ اسْتُرْ عَوْرَاتِيْ وَآمِنْ رَوْعَاتِيْ اللَّهُمَّ احْفَظْنِيْ مِنْ بَيْنِ يَدِي وَمِنْ خَلْفِيْ وَعَنْ يَمِيْنِيْ وَعَنْ شِمَالِيْ وَمِنْ فَوْقِيْ وَأَعُوْذُ بِعَظَمَتِكَ أَنْ أُغْتَالَ مِنْ تَحْتِيْ 

‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে দুনিয়ায় সুস্থতা ও নিরাপত্তা এবং পরকালের নিরাপত্তা চাই। হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আমার দ্বীন, দুনিয়া, পরিবার-পরিজন, ধন-স¤পদ সম্পর্কে নিরাপত্তা চাই। হে আল্লাহ! আপনি আমার দোষ-ত্রুটিগুলো গোপন রাখুন এবং ভীতিকর বিষয় হতে আমাকে নিরাপত্তা রাখুন। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আমার সামনের দিক হতে, পেছনের দিক হতে, আমার ডান দিক হতে, আমার বাম দিক হতে, আমার ওপর হতে আমাকে হিফাযত করুন। হে আল্লাহ! আমি মাটিতে ধসে যাওয়া (ভূমিধ্বস) হতে আপনার মর্যাদার কাছে আশ্রয় চাই’।[৮]

রোগী দেখতে গিয়ে তার সুস্থতা চেয়ে যে দু’আ পড়তে হয়

আবূ মূসা আল-আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন রোগীকে দেখতে গেল যার অন্তিম সময় আসেনি, সে যেন তার সামনে সাতবার এই দু’আ পাঠ করে ঝাড়া দেয়,

 أَسْأَلُ اللهَ الْعَظِيْمَ رَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ أَنْ يَشْفِيَكَ

‘আমি মহান আরশের রব মহামহিম আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি যেন তোমাকে রোগমুক্তি দেন’, তাহলে আল্লাহ তাকে উক্ত রোগ হতে মুক্তি দিবেন’।[৯]

অসুস্থতার সময় দান-ছদাকার দ্বারা রোগের চিকিৎসা নেয়া

রাসূল (ﷺ) বলেছেন, دَاوُوْا مَرْضَاكُمْ بِالصَّدَقَةِ ‘তোমরা ছাদাক্বার মাধ্যমে তোমাদের রোগীদের চিকিৎসা কর’।[১০] তাই কারো কোন অসুখ হলে সেই অবস্থায় ছাদাক্বাহ করা উচিত।

প্রাকৃতিক জিনিস দ্বারা চিকিৎসা

১- কালজিরা দ্বারা চিকিৎসা

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, إِنَّ هَذِهِ الحَبَّةَ السَّوْدَاءَ شِفَاءٌ مِنْ كُلِّ دَاءٍ، إِلَّا مِنَ السَّامِ ‘এই কালজিরার মধ্যে একমাত্র মৃত্যু ছাড়া সকল রোগের চিকিৎসা রয়েছে’।[১১] কালজিরার ব্যবহার বিশেষভাবে সর্দি, কাশি, কফ ও ইত্যাদি রোগের জন্য খুবই উপকারী। আর কন্ঠ স্বর নষ্ট হলে কালজিরা চিবিয়ে খেলে তা ঠিক হয়ে যায়।

২- ঠাণ্ডা পানি দ্বারা জ্বরের চিকিৎসা

আয়েশা ও রাফি ইবনু খাদীজ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, اَلْحُمَّى مِنْ فَيْحِ جَهَنَّمَ فَأَبْرِدُوْهَا بِالْمَاءِ ‘জ্বরের উৎপত্তি জাহান্নামের তাপ হতে। সুতরাং তোমরা পানি দ্বারা ইহা ঠাণ্ডা কর’।[১২] কারণ জাগতিক সকল তাপের উৎস জাহান্নাম। সেখান হতে সকল প্রকার গরম ও উত্তাপের সৃষ্টি হয়। তাই সূর্যের উত্তাপের উৎসও জাহান্নামের আগুন থেকে। জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর পানি ও বরফের ব্যবহার বর্তমানে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত এবং একটি সাধারণ চিকিৎসা।

৩- মধু দ্বারা পেটের রোগের চিকিৎসা

মধুর বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, فِیۡہِ شِفَآءٌ لِّلنَّاسِ ‘তাতে রয়েছে মানুষের জন্য নিরাময়’ (সূরা আন-নাহল: ৬৯)। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ¯পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন; মধু অবশ্যই রোগের আরোগ্যদানকারী। আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত প্রাকৃতিক এক পানীয়। তাই রাসূল (ﷺ) মিষ্টি ও মধু পান করতেন।[১৩]

আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, একদা এক ব্যক্তি রাসূল (ﷺ)-এর নিকট এসে বলল, আমার ভাইয়ের পেটে অসুখ (পাতলা পায়খানা) হয়েছে। তখন রাসূল (ﷺ) বললেন, তাকে মধু পান করাও। সে মধু পান করাল। সে আবার এসে বললে, তিনি বললেন, তাকে মধু পান করাও। অতঃপর তৃতীয়বার আসলে তিনি বললেন, তাকে মধু পান করাও। এরপর লোকটি এসে বলল, আমি অনুরূপই করেছি। তখন নবী (ﷺ) বললেন, صَدَقَ اللهُ، وَكَذَبَ بَطْنُ أَخِيْكَ، اسْقِهِ عَسَلًا فَسَقَاهُ فَبَرَأَ ‘আল্লাহ সত্য বলেছেন, কিন্তু তোমার ভাইয়ের পেট মিথ্যা বলছে। তাকে মধু পান করাও’। অতঃপর সে তাকে মধু পান করাল। ফলে সে রোগমুক্ত হল।[১৪]

৪- ব্যাঙের ছাতার পানি দ্বারা চক্ষুরোগের চিকিৎসা

সাঈদ ইবনু যায়িদ ইবনে আমর ইবনে নুফাইল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন,الْكَمْأَةُ مِنَ الْمَنِّ الَّذِي أَنْزَلَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى عَلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ، وَمَاؤُهَا شِفَاءٌ لِلْعَيْنِ ‘ছত্রাক বা ব্যাঙের ছাতা হল ‘মান্না’ নামক আসমানী খাদ্যের অন্তর্ভুক্ত যা আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের আহারের জন্য অবতীর্ণ করেছিলেন। তার পানি চক্ষুরোগের নিরাময়’।[১৫] আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি তিনটি অথবা পাঁচটি অথবা সাতটি ব্যাঙ্গের ছাতা নিয়ে তার রস নিংড়িয়ে একটি বোতলের মধ্যে রাখলাম। অতঃপর আমার এক রাতকানা দাসীর চোখের মধ্যে সে পানি সুরমার সাথে ব্যবহার করলাম। তাতে সে আরোগ্য লাভ করল।[১৬]

৫- সুরমা দ্বারা চোখের চিকিৎসা

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, اكْتَحِلُوا بِالإِثْمِدِ فَإِنَّهُ يَجْلُو البَصَرَ، وَيُنْبِتُ الشَّعْرَ ‘তোমরা ‘ইছমিদ’ সুরমা ব্যবহার কর। কারণ তা চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি করে এবং অধিক ভ্রুউৎপন্ন করে’। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, مَذْهَبَةٌ لِلْقَذَى ‘চোখ পরিষ্কার রাখে’। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, নবী (ﷺ)-এর একটি সুরমাদানী ছিল। প্রত্যেক রাতে তিনি ডান চোখে তিনবার এবং বাম চোখে তিনবার সুরমা লাগাতেন।[১৭] ‘ইছমিদ’ হল প্রসিদ্ধ খনিজ পাথর। কেউ বলেন, ইহা ইস্পাহানী কাল সুরমা (ফাইযুল কাদীর)। উক্ত উপকারের কথা বর্তমান বিজ্ঞানেও তা প্রমাণিত। এটা ছাড়াও গবেষণায় আরও কিছু উপকারিতার কথা জানা যায়। যথা: ১. সুরমা অত্যন্ত কার্যকরী জীবাণুনাশক। ২. চোখে জ্বালাপোড়া খুব কম হয়। ৩. চোখের প্রবেশকৃত ধুলাবালী নিঃসরণে কার্যকর ভূমিকা রাখে। 

৬- আজওয়া খেজুর দ্বারা বিষের চিকিৎসা

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, الْعَجْوَةُ مِنَ الْجَنَّةِ، وَهِيَ شِفَاءٌ مِنَ السَّمِّ ‘আজওয়া হল জান্নাতের খেজুর এবং বিষের প্রতিষেধক’।[১৮] অন্যত্র রাসূল (ﷺ) বলেছেন,

مَنْ تَصَبَّحَ كُلَّ يَوْمٍ سَبْعَ تَمَرَاتٍ عَجْوَةً، لَمْ يَضُرَّهُ فِيْ ذَلِكَ اليَوْمِ سُمٌّ وَلَا سِحْرٌ

‘যে ব্যক্তি প্রত্যহ সকালে সাতটি আজওয়া খেজুর খাবে, সেদিন কোন ধরণের বিষ ও যাদু তাকে ক্ষতি করতে পারবে না’।[১৯]

৭- ভারতীয় চন্দন কাঠ দ্বারা চিকিৎসা

উম্মু কাইস বিনতে মিহসান (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, عَلَيْكُمْ بِهَذَا العُودِ الهِنْدِيِّ، فَإِنَّ فِيْهِ سَبْعَةَ أَشْفِيَةٍ ‘তোমরা ভারতীয় এই চন্দন কাঠ (চিকিৎসায়) ব্যবহার করবে। কেননা তাতে সাতটি আরোগ্য রয়েছে’। তার মধ্যে একটি হল পাঁজরের ব্যথা বা পক্ষাঘাত রোগ। তা দূর করার জন্য মুখ দিয়ে খাওয়াতে হবে। বাচ্চাদের আল-জিহবা ফুলার ব্যথা হলে ইহা ঘষিয়ে পানির সাথে মিশ্রিত করে ফোঁটা ফোঁটা নাকের ভিতরে দেবে। আর শ্বাসনালীর ব্যথার জন্য এর (ধোঁয়া) নাক দিয়ে টেনে নেয়া যায়’।[২০]

৮- যমযম পানির উপকারিতা ও তা দ্বারা রোগের চিকিৎসা

১. ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, خَيْرُ مَاءٍ عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ مَاءُ زَمْزَمَ فِيْهِ طَعَامٌ مِنَ الطُّعْمِ وَشِفَاءٌ مِنَ السُّقْمِ ‘মাটির ওপর সবচেয়ে উত্তম পানি হচ্ছে যমযমের পানি। যাতে রয়েছে ক্ষুধা নিবারণের খাদ্য এবং রোগ নিরাময়ের ঔষধ’।[২১]

২. জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, مَاءُ زَمْزَمَ لِمَا شُرِبَ لَهُ ‘যমযমের পানি যে উপকার লাভের আশায় পান করা হবে, তা অর্জিত হবে’।[২২]

অনেক নেক্কার ও আলেমগণ নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য অর্জন ও প্রয়োজন পুরণে যমযম পানি পান করে তারা ফল পেয়েছেন। যেমন তাদের মধ্যে একজন ইমাম শাফিয়ী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তিনি ইল্মের জন্য যমযম পানি পান করেছিলেন, ফলে তার কাক্সিক্ষত আশা পূরণ হয়েছিল।

৩. আবূ যার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদা রাসূল (ﷺ) আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কতদিন যাবৎ এখানে (মক্কায়) অবস্থান করছ? আমি বললাম, আমি এখানে ত্রিশটি রাত-দিন যাবৎ আছি। তিনি বললেন, তোমাকে কে খাদ্য দিত? আমি বললাম, مَا كَانَ لِيْ طَعَامٌ وَلَا شَرَابٌ إِلَّا مَاءَ زَمْزَمَ ‘যমযম কূপের পানি ব্যতীত আমার জন্য অন্য কোন খাদ্য ছিল না’। এ পানি পান করেই আমি স্থলদেহী-মোটা হয়ে গেছি, এমনকি আমার পেটের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে এবং আমি কক্ষনো ক্ষুধার কোন দুর্বলতা বুঝতে পারিনি। তখন রাসূল (ﷺ) বললেন,إِنَّهَا مُبَارَكَةٌ، وَهِيَ طَعَامُ طُعْمٍ وَشِفَاءُ سُقْمٍ ‘এ পানি অতিশয় বরকতময় ও প্রাচুর্যময় এবং তা অন্যান্য খাবারের মত তা পেট পূর্ণ করে দেয়’।[২৩]

৪. যমযমের পানি অসুস্থ ব্যক্তির ওপর  ঢেলে দেওয়া ও পান করানো

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, وَكَانَ يَصُبُّ عَلَى الْمَرْضَى وَيَسْقِيْهِمْ ‘রাসূল (ﷺ) অসুস্থ ব্যক্তির ওপর যমযমের পানি ঢালতেন এবং তাদেরকে পান করাতেন’।[২৪]

৯- লবন মিশ্রিত পানি দ্বারা চিকিৎসা

আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোন এক রাতে রাসূল (ﷺ) ছলাত আদায় অবস্থায় তাঁকে বিচ্ছু দংশন করলে তিনি লবন ও পানি নিয়ে এক পাত্রে মিশিয়ে তা দংশিত স্থানে পানি ঢাললেন ও মুছলেন এবং সূরা ফালাক্ব ও নাস দ্বারা ঝাড়া দিলেন’।[২৫] এমনকি লবন মিশ্রিত হালকা গরম পানি দ্বারা জ্বালা পোড়া ও ব্যথা ভাল হয়, যা পরীক্ষিত।

১০- যায়তুন তেল দ্বারা চিকিৎসা

আবূ উসায়দ আল-আনছারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, كَلُوا الزَّيْتَ وَادَّهِنُوْا بِهِ فَإِنَّهُ مِنْ شَجَرَةٍ مُبَارَكَةٍ ‘তোমরা যায়তুনের তেল খাও এবং তা শরীরে মালিশ কর। কারণ তা একটি কল্যাণময় বৃক্ষ হতে নির্গত’।[২৬] এখানে ‘বরকতপূর্ণ গাছ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল, অধিক পরিমাণে উপকার পাওয়া (তুহফাতুল আহওয়াযী)। যায়তুন ফল খেলে রুচি বাড়ে। আর তার তেল ভর্তা, ডাল ও রান্না করা তরকারীতে কয়েক ফোঁটা ঢেলে দিয়ে খেতে খুবই সুস্বাদু ও মজা, যা পরীক্ষিত।

(ইনশাআল্লাহ আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)


*শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪১২; মিশকাত, হা/৫১৫৫।
[২]. তিরমিযী, হা/২৩৪৬; মিশকাত, হা/৫১৯১; সিলসিলাহ ছহীহাহ, হা/২৩১৮।
[৩]. বাইহাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/১০২৪৮; নাসাঈ, সুনানুল কুবরা, হা/১১৮৩২; মিশকাত, হা/৫১৭৪; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামি‘, হা/১০৭৭।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৭৮।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/২২০৭; মিশকাত, হা/৪৫১৫।
[৬]. তিরমিযী, হা/২০৪০; মিশকাত, হা/৪৫৩৩, সনদ ছহীহ।
[৭]. তিরমিযী, হা/৩৫৫৮; মিশকাত, হা/২৪৮৯, সনদ ছহীহ।
[৮]. আবূ দাঊদ, হা/৫০৭৪; মিশকাত, হা/২৩৯৭, সনদ ছহীহ।
[৯]. আবূ দাঊদ, হা/৩১০৬; তিরমিযী, হা/২০৮৩; মিশকাত, হা/১৫৫৩, সনদ ছহীহ।
[১০]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/৬৫৯৩; ছহীহ আত-তারগীব, হা/৭৪৪।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৮৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২২১৫; মিশকাত, হা/৪৫২০।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২৬৩; ছহীহ মুসলিম, হা/২২০৯।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৯৭২।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৮৪; ছহীহ মুসলিম, হা/২২১৭; মিশকাত, ৪৫২৪।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৪৭৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২০৪৯; মিশকাত, ৪১৮৪।
[১৬]. তিরমিযী, হা/২০৬৮; ইবনু মাজাহ, হা/৩৪৫৩; মিশকাত, হা/৪৫৬৯, সনদ ছহীহ।
[১৭]. তিরমিযী, হা/১৭৫৭; মিশকাত, হা/৪৪৭২; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৬৬৫।
[১৮]. তিরমিযী, হা/২০৬৮; ইবনু মাজাহ, হা/৩৪৫৫; মিশকাত, হা/৪৫৬৯, সনদ ছহীহ।
[১৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪৪৫; আবূ দাঊদ, হা/৩৮৭৬।
[২০]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৯২; ছহীহ মুসলিম, হা/২২১৪ মিশকাত, হা/ ৪৫২৪।
[২১]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৩৯১২; সিলসিলাহ ছহীহা হা. ১০৫৬, তিরমিযী হা. ৯৬৩।
[২২]. ইবনু মাজাহ, হা/৩০৬২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৪৪৩৫, সনদ ছহীহ।
[২৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৭৩; ‘আবূ যার প-এর ফযীলত’ অধ্যায়, মা‘রিফাতুস সুনান ওয়াল আছার, হা/১০৩২০।
[২৪]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/৯৭৬৮; সিলসিলাহ ছহীহাহ, হা/৮৮৩; তিরমিযী, হা/৯৬৩।
[২৫]. বায়হাকী, শু‘আবুল ঈমান, হা/২৩৪০; মিশকাত, হা/৪৫৬৭, সনদ ছহীহ।
[২৬]. তিরমিযী, হা/১৮৫১; ইবনু মাজাহ, হা/৩৩১৯; মিশকাত, হা/৪২২১, সনদ ছহীহ।




প্রসঙ্গসমূহ »: চিকিৎসা
ফাযায়েলে কুরআন (৭ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
হজ্জ ও ওমরার সঠিক পদ্ধতি - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম (৫ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৭ম কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১৪তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ (৩য় কিস্তি) - ড. মেসবাহুল ইসলাম
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
বিদ‘আত পরিচিতি (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
আধুনিক যুগে দাওয়াতী কাজের পদ্ধতি (২য় কিস্তি) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
সালাফী মানহাজের মূলনীতিসমূহ (৩য় কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (২য় কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৩য় কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন

ফেসবুক পেজ