মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ
-আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম*
(১৮তম কিস্তি)
আক্বীদা-৪ : শাফা‘আত চাওয়া
দেওবন্দীদের অন্যতম আক্বীদা হল, ‘নবী করীম (ﷺ)-এর কবরের কাছে হাযির হয়ে শাফা‘আতের দরখাস্ত করা এবং এভাবে বলা জায়েয যে, হযরত! আমার মাগফিরাতের জন্য শাফা‘আত করুন’।[১] তারা এটাও বিশ্বাস করে যে, প্রয়োজন পূর্ণ করা এবং দুঃখ, কষ্ট, বিপদ এবং ভয় ইত্যাদি দূর করার জন্য ইয়া রাসূলাল্লাহ অথবা ইয়া জীলানী! অথবা অন্য কারো নাম ধরে আহ্বান করা বৈধ। যেমনটা আশরাফ আলী থানবী বলেছেন যে, ‘আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, যে কেউ তাঁর কবরে গেছে তিনি তার সহযোগিতা করেছেন এবং ত্রুটিগুলো পূর্ণ করেছেন, আশ্রয়প্রার্থী যখনই তাঁর নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেছে, সে নিরাপদে ফিরে এসেছে এবং হতাশ হয়নি। আর যে কোন দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ তাঁর কবরের নিকট উপস্থিত হয়েছে, তিনি তার প্রয়োজন পূর্ণ করেছেন এবং বিপদগ্রস্ত মানুষ বিপদের সময় যখনই তাঁকে আহ্বান করেছে তখনই তাঁর পক্ষ থেকে সাহায্য ও সহজতা নেমে এসেছে’।[২]
পর্যালোচনা
মাতুরীদীদের শাখা দেওবন্দীসহ অন্যরা মৃত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ডাকতে সমস্যা মনে করে না এবং দু‘আর মাধ্যমে তাঁকে ডেকে সাহায্য চাওয়া যে শিরক, সেটাও তারা অস্বীকার করে। তাদের অন্যতম শায়খ হুসাইন আহমাদ মাদানী তার ‘শিহাবুছ ছাক্বিব’ নামক বইয়ে এমনটা উল্লেখ করেছেন।[৩]
জবাবে বলব যে, তাদের এমন বিশ্বাস বা নিকৃষ্ট আক্বীদা পোষণ করার অন্যতম কারণ হল তাওহীদ সম্পর্কে অজ্ঞতা। যে তাওহীদ নিয়ে মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে প্রেরণ করেছেন। তাঁকে এটাও নির্দেশ দিয়েছেন যে, তিনি যেন মানুষকে তাওহীদের দিকে আহ্বান করেন এবং সমস্ত ইবাদতকে মহান আল্লাহর জন্য একনিষ্ট করেন। অতঃপর তিনি মানুষদেরকে শিরক করতে এবং মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো শরণাপন্ন হতে নিষেধ করেছেন। তাছাড়া মৃতকে ডাকা শিরক। যেমন কারো এরূপ বলা যে, يا رسول الله أغثني ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য বা উদ্ধার করুন’। অথবা যে কোন দু‘আ বা ইবাদতের মধ্যে এ জাতীয় বাক্য ব্যবহার করে বলা।
মহান আল্লাহ আল-কুরআনের বহু আয়াতে বান্দাদেরকে তাওহীদ গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং তাঁর সাথে শিরক করাকে নিষেধ করেছেন। তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে ডাকা ভ্রষ্টতা। তারা আল্লাহ ছাড়া অন্য যাদেরকে ডাকে, তারা তাদের কোন কিছুর উত্তর দিতে সক্ষম না এবং তারা ভালো বা মন্দ করার মালিকও না। আর এরূপ বহু আয়াত রয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, وَّ اَنَّ الۡمَسٰجِدَ لِلّٰہِ فَلَا تَدۡعُوۡا مَعَ اللّٰہِ اَحَدًا ‘এবং নিশ্চয় সিজদার স্থানসমূহ (সমস্ত ইবাদত) আল্লাহরই জন্য। সুতরাং আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকেও ডেকো না’ (সূরা আল-জিন : ১৮)। মহান আল্লাহ তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে এবং তাঁর সাথেও অন্য কাউকে ডাকতে নিষেধ করেছেন। সেটা ফেরেশতা, নবী-রাসূল এবং সৃষ্টির মধ্যে হতে যে কেউ হোক না কেন!
ইবনু জারীর ত্বাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, মহান আল্লাহ বলেন,فَلَا تَدۡعُوۡا مَعَ اللّٰہِ اَحَدًا ‘আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকেও ডেকো না’-এর অর্থ হল, তোমরা আল্লাহর সাথে কোন কিছুকেই শরীক করো না। বরং তাওহীদকে তাঁর জন্য একক কর এবং ইবাদতকে তাঁর জন্য একনিষ্ট কর’।[৪]
ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মহান আল্লাহ বান্দাদেরকে সকল ক্ষেত্রেই ইবাদতকে তাঁর জন্য একক করার নির্দেশ প্রদান করেছেন, তাঁর সাথে কাউকে ডাকতে এবং অংশীদার করতে নিষেধ করেছেন। অতঃপর তিনি ক্বাতাদাহ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, মহান আল্লাহ তাঁর নবী (ﷺ)-কে (ইবাদতকে) তাঁর জন্য একক করার নির্দেশ প্রদান করেছেন’।[৫] অতঃপর মহান আল্লাহ বলেন, قُلۡ اِنَّمَاۤ اَدۡعُوۡا رَبِّیۡ وَ لَاۤ اُشۡرِکُ بِہٖۤ اَحَدًا ‘বলুন, নিশ্চয় আমি আমার প্রতিপালককেই ডাকি এবং তাঁর সাথে কাউকেও শরীক করি না’।[৬]
এ আয়াত স্পষ্ট দলীল যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট দু‘আ করা শিরক। হুসাইন আহমাদ মাদানী সহ যারা ধারণা করে যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট দু‘আ করা শিরক নয়; এটা তাদের উপর বড় দলীল। আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট দু‘আ করার নিষেধাক্কার ব্যাপারে বহু আয়াত রয়েছে। আর এই নিষেধাক্কাগুলো আমভাবে এসেছে। সেটা ইবাদতের দু‘আ বা চাওয়ার দুু‘আ হোক না কেন! চাওয়ার দু‘আর মধ্যে রয়েছে যেমন, মৃতের নিকট হতে প্রয়োজন পূরণের দু‘আ করা, তাদের মাধ্যমে সাহায্য চাওয়া এবং তাদের দিকে মুখ ফিরানো ইত্যাদি।[৭]
হুসাইন আহমাদ মাদানীর আক্বীদা রদ করে শায়খ মুহাম্মাদ তাক্বীউদ্দীন হিলালী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
ويلك يا مشرك! فإذا لم يكن يا رسول الله! عبادة فأين العبادة؟ فإذا قلت : يا الله! ارحمني! فقد عبدت الله وإذا قلت يا رسول الله! أغثني! فقد عبدت الرسول و كفرت بالله والرسول برئ منك.
‘হে মুশরিক! তোমার জন্য ধ্বংস। ইয়া রাসূলুল্লাহ (হে আল্লাহর রাসূল)! বলা যদি ইবাদত না হয়, তাহলে ইবাদত কোথায়? যখন তুমি বলবে, ইয়া আল্লাহ (হে আল্লাহ)! আমার প্রতি রহম করুন; তখন তুমি আল্লাহর ইবাদত করলে। আর যখন তুমি বলবে, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন; তখন তুমি রাসূলের ইবাদত করলে এবং আল্লাহকে অস্বীকার করলে। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তোমার এমন কথা থেকে মুক্ত’।[৮]
মৃত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট সাহায্য, সহযোগিতা এবং শাফা‘আত চাওয়ার এমন তরীকা শিরকী তরীকা। কেননা নবী করীম (ﷺ)-এর দরবারে মাগফিরাতের সুপারিশ চাওয়ার বিশ্বাসটা তিনি ইলাহী গুণে গুণান্বিত হওয়ার আক্বীদা পোষণ করা ছাড়া সম্ভব নয় (নাউযুবিল্লাহ)। মাটির নিচের ব্যক্তি কবরের পাশে দাঁড়ানো ব্যক্তির দু‘আ ও ফরিয়াদ সে সময় শুনতে পারে যখন তার মধ্যে আল্লাহর গুণ ‘সর্বশ্রোতা’ থাকবে। অথচ আল্লাহর অন্যান্য গুণের মত এই গুণও শুধু তাঁর জন্যই খাছ, যা কোন মানুষের মধ্যে নেই। নবী করীম (ﷺ) সমস্ত মানুষের চেয়ে উত্তম হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মধ্যেও এই গুণ নেই। তাইতো এই গুণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মধ্যে আছে মনে করে যে ব্যক্তি তাঁর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে শাফা‘আত তলব করে থাকে, সে মুশরিক। সে এ ধরনের দু‘আর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার গুণের সঙ্গে শরীক স্থাপন করেছে। আর আল্লাহ তা‘আলার সত্তা বা গুণে গাইরুল্লাহকে শরীক মনে করার নাম শিরক। আর শিরকের পরিণাম ভয়াবহ। কারণগুলো নিম্নরূপ :
১. শিরক পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় পাপ (সূরা আন-নিসা : ৪৮; লুক্বমান : ১৩)।[৯] ২. শিরক ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ (সূরা আন-নিসা : ১১৬ ও ৪৮)।[১০] ৩. শিরক জীবনের যাবতীয় কৃত আমল ধ্বংস করে দেয় (সূরা আল-আন‘আম : ৮৮; সূরা আয-যুমার : ৬৫)। ৪. শিরককারীকে আল্লাহ প্রত্যাখান করেন।[১১] ৫. শিরককারী অপবিত্র (সূরা আত-তাওবা : ২৮)। ৬. শিরক ধ্বংস ও বিপর্যয়ের কারণ (সূরা আল-হাজ্জ : ৩১)। ৭. মুশরিকদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়া নিষিদ্ধ (সূরা আত-তাওবা : ১১৩)। ৮. ক্বিয়ামতের দিন শিরক চরম এক ব্যর্থতা (সূরা আল-কাহাফ : ৫২)। ৯. শিরককারীর জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শাফা‘আত করবেন না।[১২] এবং ১০. শিরককারীর জন্য জান্নাত হারাম (সূরা আল-মায়িদা : ৭২)।[১৩]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট সাহায্য, সহযোগিতা এবং আশ্রয় চেয়ে দু‘আ করা যদি শিরক হয়, তাহলে আব্দুল ক্বাদীর জিলানী সহ যেসব পীর, অলী-আওলীয়া, মাযার, খানকা ইত্যাদিতে যে সাহায্য, সহযোগিতা এবং আশ্রয় চেয়ে দু‘আ করা, ডাকা, নযর পেশ করা এবং মানত করা হয়, সেগুলোর তো অস্তিত্বই নেই। অতএব, দেওবন্দীরা শাফা‘আতের নামে যে ভ্রান্তি ধারণা পোষণ করে, এমন শিরকী আক্বীদা থেকে তাওবা করে সঠিক আক্বীদা পোষণ করা ফরয। তা না করলে আখেরাতে ভয়াবহ শাস্তি ভোগ করতে হবে। মহান আল্লাহ দেওবন্দীদের এমন ভ্রান্ত আক্বীদা থেকে মুসলিম উম্মাহকে হেফাযত করুন-আমীন!!
ইসলামী শরী‘আতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শাফা‘আত
ইসলামী শরী‘আতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পক্ষ থেকে শাফা‘আত প্রমাণিত। এই শাফা‘আত হবে পরকালে, দুনিয়াবী জীবনে নয়। আখেরাতে তিনি তাঁর উম্মাতের জন্য শাফা‘আত তথা সুপারিশ করবেন। পথভ্রষ্ট ও ভ্রান্তরা এই সুপারিশ বা শাফা‘আতকে দুনিয়াবী জীবনে ‘অসীলা গ্রহণ করা’র পক্ষের দলীল হিসাবে পেশ করে থাকে। যা ভ্রান্ত আক্বীদার অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কয়েকভাবে শাফা‘আত করবেন। এতে কোন সন্দেহ নেই। এই শাফা‘আতের কোনটিই তাকে মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করার পক্ষে দলীল নয়।
নবী করীম (ﷺ) ক্বিয়ামাতের দিন শাফা‘আত করবেন। প্রথমে হাশরের মাঠে অবস্থানকারী সকল মানুষের জন্য শাফা‘আত করবেন। আদম (আলাইহিস সালাম), নূহ (আলাইহিস সালাম), ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম), মূসা (আলাইহিস সালাম) এবং সমস্ত নবীই সেদিন আল্লাহর নিকট শাফা‘আত করতে অক্ষমতা প্রকাশ করার পর শাফা‘আতের বিষয়টি পরিশেষে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নিকট ফিরে আসবে। এরপর জান্নাতবাসীদের জান্নাতে প্রবেশ করানোর জন্য শাফা‘আত করবেন। এ দু’টি শাফা‘আত নবী করীম (ﷺ)-এর জন্য খাছ। এরপর শাফা‘আত করবেন ঐসব লোকের ব্যাপারে, যাদের জন্য জাহান্নাম আবশ্যক হয়ে যাবে। সুতরাং যাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যাবে, তাদের জন্য তিনি সুপারিশ করবেন, তাদেরকে যেন জাহান্নামে প্রবেশ করানো না হয়। তিনি আরো সুপারিশ করবেন ঐ সব লোকের জন্য, যারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। তাদেরকে সেখান থেকে বের করার সুপারিশ করবেন।[১৪]
নবী করীম (ﷺ) প্রথম শাফা‘আতটি করবেন হাশরের মাঠে অবস্থানকারী সকল মানুষের জন্য। যাতে তাদের মধ্যে দ্রুত ফায়সালা করা হয়। আদম (আলাইহিস সালাম), নূহ (আলাইহিস সালাম), ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম), মূসা (আলাইহিস সালাম) এবং সমস্ত নবীই সেদিন আল্লাহর নিকট শাফা‘আত করতে অক্ষমতা প্রকাশ করবেন। তারা সকলেই বলবেন, إِنَّ رَبِّىْ قَدْ غَضِبَ الْيَوْمَ غَضَبًا لَمْ يَغْضَبْ قَبْلَهُ مِثْلَهُ وَلَنْ يَغْضَبَ بَعْدَهُ مِثْلَهُ ‘আমার রব আজ ভীষণ রাগান্বিত, যার আগেও কোন দিন এরূপ রাগান্বিত হননি, আর পরেও কোনদিন এরূপ রাগান্বিত হবেন না’।[১৫] এরপর শাফা‘আতের বিষয়টি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নিকট ফিরে আসবে। এ শাফা‘আত হবে মাক্বামে মাহমূদে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, عَسٰۤی اَنۡ یَّبۡعَثَکَ رَبُّکَ مَقَامًا مَّحۡمُوۡدًا ‘আশা করা যায় আপনার প্রতিপালক অচিরেই আপনাকে মাহ্মূদ নামক স্থানে পৌঁছাবেন’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৭৯)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শাফা‘আতকে মাকামে মাহমূদ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।[১৬]
হিসাবের পর জান্নাতীদেরকে দ্রুত জান্নাতে প্রবেশের অনুমতির জন্য নবী করীম (ﷺ) আল্লাহর নিকট শাফা‘আত করবেন। হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুুল্লাহ (ﷺ) বলেন, أَنَا سَيِّدُ وَلَدِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَأَوَّلُ مَنْ يَنْشَقُّ عَنْهُ الْقَبْرُ وَأَوَّلُ شَافِعٍ وَأَوَّلُ مُشَفَّعٍ ‘ক্বিয়ামতের দিন আমি আদম সন্তানদের সর্দার হব। আমিই সকলের আগে কবর হতে উত্থিত হব। সকলের পূর্বে আমিই সুপারিশ করব এবং সর্বপ্রথম আমার শাফা‘আত কবুল করা হবে।[১৭] আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,آتِي بَابَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَأَسْتَفْتِحُ فَيَقُوْلُ الْخَازِنُ مَنْ أَنْتَ؟ فَأَقُوْلُ مُحَمَّدٌ ﷺ فَيَقُوْلُ بِكَ أُمِرْتُ أَنْ لَاأَفْتَحَ لِأَحَدٍ قَبْلَكَ ‘ক্বিয়ামতের দিন আমি জান্নাতের দরজায় এসে তা খোলার জন্য বলব। তখন জান্নাতের পাহারাদার বলবে আপনি কে? আমি বলব, মুহাম্মাদ (ﷺ)! তখন পাহারাদার বলবে, আপনার সম্পর্কে আমাকে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, আপনার পূর্বে আমি যেন অন্য কারও জন্য এই দরজা না খুলি।[১৮] আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেন, أَنَا أَوَّلُ شَفِيْعٍ فِي الْجَنَّةِ ‘আমিই সর্বপ্রথম জান্নাতের জন্য শাফা‘আতকারী’।[১৯]
জাহান্নামে প্রবেশকারী তাওহীদপন্থী একদল পাপী লোককে তা থেকে বের করার জন্য তিনি শাফা‘আত করবেন। হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
إِذَا دَخَلَ أَهْلُ الْجَنَّةِ الْجَنَّةَ وَأَهْلُ النَّارِ النَّارَ يَقُوْلُ اللهُ تَعَالَى مَنْ كَانَ فِيْ قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ مِنْ إِيْمَانٍ فَأَخْرِجُوْهُ فَيَخْرُجُوْنَ قَدِ امْتَحَشُوْا وَعَادُوْا حُمَمًا فَيُلْقَوْنَ فِيْ نَهْرِ الْحَيَاةِ فَيَنْبُتُوْنَ كَمَا تَنْبُتُ الْحِبَّةُ فِيْ حَمِيْلِ السَّيْلِ أَلَمْ تَرَوْا أَنَّهَا تَخْرُجُ صَفْرَاءَ مُلْتَوِيَةً
‘যখন জান্নাতীগণ জান্নাতে এবং জাহান্নামীগণ জাহান্নাম প্রবেশ করবে, তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান আছে তাকে জাহান্নাম হতে বের করে আন। তাদেরকে এমন অবস্থায় বের করা হবে যে, তারা পুড়ে কালো কয়লায় পরিণত হয়ে গেছে। অতঃপর তাদেরকে হায়াত নামক নহরে ফেলে দেয়া হবে তারা স্রোতের ধারে যেমন ঘাসের বীজ গজায় তেমনি স্বচ্ছে সুন্দর হয়ে উঠবে। তোমরা কি দেখ না উক্ত গাছগুলো হলুদ রং জড়িত অবস্থায় অঙ্কুরিত হয়?[২০]
এছাড়াও নবীগণ, ফেরেশতাগণ, ছিদ্দীকগণ, শহীদগণ এবং অন্যান্যরা শাফা‘আত করবেন।[২১] কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দলীলের আলোকে প্রমাণিত যে, আট শ্রেণীর মানুষের জন্য শাফা‘আত করা হবে। আট শ্রেণীর মধ্যে প্রথম তিন প্রকার রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্য খাছ এবং শেষোক্ত পাঁচ প্রকারের শাফা‘আত করার মধ্যে নবী করীম (ﷺ) সহ আরো অনেকেই শরীক থাকবেন। যেমন অন্য নবীগণ, ফেরেশতাগণ, ছিদ্দীকগণ, শহীদগণ এবং মুমিনগণ। হাদীছে এসেছে, ক্বিয়ামতের ময়দানে আল্লাহ তা‘আলা বলবেন,شُفِّعَتِ الْمَلَائِكَةُ وَشُفِّعَ النَّبِيُّوْنَ وَشُفِّعَ الْمُؤْمِنُوْنَ وَلَمْ يَبْقَ إِلَّا أَرْحَمُ الرَّاحِمِيْنَ ‘ফেরেশতাগণ, নবীগণ এবং মুমিনগণ সকলেই শাফা‘আত করেছেন, এখন আমি পরম দয়ালু ব্যতীত আর কেউ বাকী নেই।[২২]
আর এগুলো শাফা‘আতের জন্য দু’টি শর্ত রয়েছে। দু’টি শর্ত ছাড়া শাফা‘আত হবে না।
প্রথম শর্ত : শাফা‘আতকারীকে শাফা‘আত করার পূর্বে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে শাফা‘আতের অনুমতি লাভ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, مَنۡ ذَا الَّذِیۡ یَشۡفَعُ عِنۡدَہٗۤ اِلَّا بِاِذۡنِہٖ ‘এমন কে আছে যে, তাঁর অনুমতি ব্যতিত তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে?’ (সূরা বাক্বারাহ : ২৫৫)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, مَا مِنۡ شَفِیۡعٍ اِلَّا مِنۡۢ بَعۡدِ اِذۡنِہٖ ‘কোন শাফা‘আতকারী এমন নেই, যে তাঁর অনুমতি ছাড়া শাফা‘আত করতে পারে’ (সূরা ইউসুফ : ৩)।
দ্বিতীয় শর্ত : যার জন্য সুপারিশ করা হবে তার প্রতি আল্লাহ্র সন্তুষ্টি থাকা অপরিহার্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَا یَشۡفَعُوۡنَ ۙ اِلَّا لِمَنِ ارۡتَضٰی ‘তারা (ফেরেশতাগণ) শাফা‘আত করে শুধু তাদের জন্যে যাদের প্রতি তিনি (আল্লাহ) সন্তুষ্ট’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ২৮)।
উপরিউক্ত দু’টি শর্ত সূরা নাজমের ২৬ নং আয়াতে একসাথে এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ کَمۡ مِّنۡ مَّلَکٍ فِی السَّمٰوٰتِ لَا تُغۡنِیۡ شَفَاعَتُہُمۡ شَیۡئًا اِلَّا مِنۡۢ بَعۡدِ اَنۡ یَّاۡذَنَ اللّٰہُ لِمَنۡ یَّشَآءُ وَ یَرۡضٰی ‘আকাশসমূহে কত ফেরেশতা রয়েছে! তাদের কোন সুপারিশ কাজে আসবে না যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি না দেন’ (সূরা আন-নাজম : ২৬)।
অতএব, উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সহ অন্যান্য নবী, ফেরেশতা, শহীদ, ছিদ্দীক এবং মুমিনদের শাফা‘আত প্রমাণিত। তবে তা হবে আখেরাতে; দুনিয়াবী জীবনে নয়। আর দুনিয়াবী জীবনে শাফা‘আতের অধিকারী বা সাহায্যকারী বা আশ্রয়গ্রহণকারী মনে করে তাদের নিকট দু‘আ করা বা সাহায্য চাওয়ার যে আক্বীদা; তা স্পষ্ট কুফরী আক্বীদা এবং আল্লাহর সাথে অংশীদার নির্ধারণ করার আক্বীদা। যা থেকে বিরত থাকতে হবে। মহান আল্লাহ দেওবন্দীদের এমন ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণ করা থেকে তাদেরকে হেদায়াত দান করুন এবং তাদের থেকে আমাদেরকে হেফাযত করুন-আমীন!!
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র :
[১]. আক্বাঈদে উলামায়ে দেওবন্দ, পৃ. ১০; গৃহীত : আব্দুল্লাহ মাহমূদ বিন শামসুল হক, ‘দেওবন্দী ও ব্রেলভী তরীকা : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা’, ছিরাতে মুস্তাক্বীম, ইসলাম বনাম ফের্কাবন্দী, পর্ব-৫ (ঢাকা : ইসলামিক রিসার্চ এ্যান্ড রিফরমেশন সেন্টার, জুলাই ২০১৯ খৃ.), পৃ. ৩৭৬।
[২]. আবূ উসামা সায়্যিদ ত্বালিবির রহমান, ‘আক্বাইদু ‘উলামাই দেওবন্দ মিন কিতাবি দেওবন্দিয়া (করাচি : দারুল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ, ১৪১৭ হি.), পৃ. ৩৯; সংকলক : ‘আলাবিয়্যু ইবনু আব্দিল ক্বাদির আস-সাক্বাফী, মাওসূ‘আতুল ফিরাক্বিল মুনতাসিবাতি লিল ইসলাম, ৮ম খণ্ড (ডোরার নেট (ফড়ৎধৎ.হবঃ), ১৪৩৩ হি.) পৃ. ৪৫৯। যেমন আশরাফ আলী থানবী বলেন, يقول الشيخ أشرف علي التانوي : أحلف بالله أنه ما ذهب أحد إلى قبره الشريف - صلى الله عليه وسلم- إلا جبر كسره، وتلافي نقصانه، وما لاذ به لائذ إلا رجع آمناً وما خاب رجاءه. وما حضر عند قبره الشريف عائل فقير إلا قضيت حوائجه، وما دعاه محزون عند حادثة نزلت به إلى أجابه العون والتيسير منه صلى الله عليه وسلم".
[৩]. ‘আক্বাইদু ‘উলামাই দেওবন্দ মিন কিতাবি দেওবন্দিয়া, পৃ. ৪০।
[৪]. আবূ জা‘ফর আত-ত্বাবারী, জামিঊল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন, তাহক্বীক্ব : আহমাদ মুহাম্মাদ শাকির, ২৩তম খণ্ড (মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১৪২০ হি.), পৃ. ৬৬৫।
[৫]. আবূল ফিদা ইসমাঈল ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, তাহক্বীক্ব : সামী ইবনু মুহাম্মাদ সালামাহ, ৮ম খণ্ড (দারুত ত্বায়্যিব, ১৪২০ হি.), পৃ. ২২৪।
[৬]. হামূদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু হামূদ আত-তুওইজারী, আল-ক্বওলুল বালীগ ফী তাহযীরি মিন জামা‘আতিত তাবলীগ (দারুত ছামীঈ, ১৪১৪ হি.), পৃ. ৯০।
[৭]. আল-ক্বওলুল বালীগ ফী তাহযীরি মিন জামা‘আতিত তাবলীগ, পৃ. ৯০।
[৮]. আল-ক্বওলুল বালীগ ফী তাহযীরি মিন জামা‘আতিত তাবলীগ, পৃ. ৯০।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৫৪, ৪৪৭৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৭, ২৬৯; আবূ দাঊদ, হা/২৩১০; তিরমিযী, হা/৩১৮২; নাসাঈ হা/৪০১৩; মিশকাত, হা/৫১।
[১০]. তিরমিযী, হা/৩৫৪০; মিশকাত, হা/ ২৩৩৬; সনদ ছহীহ।
[১১]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭৬৬৬; মিশকাত, হা/৫৩১৫।
[১২]. তিরমিযী, হা/২৪৪১, সনদ ছহীহ।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/১২৩৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৯; মিশকাত, হা/৩৮।
[১৪]. ড. ছালেহ আল ফাওযান, শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বীয়া; অনুবাদ : আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী (রাজশাহী : ওয়াহীদিয়া ইসলামিয়া লাইব্রেরী, ২০১৫ খৃ.), পৃ. ৩০৭।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৭১২, ‘কুরআন মাজীদের তাফসীর’ অধ্যায়, ‘আল্লাহ্র বাণী : তোমরা তো তাদের সন্তান যাদের আমি নূহ (আলাইহিস সালাম) -এর সঙ্গে আরোহণ করিয়েছিলাম। নিশ্চয় নূহ (আলাইহিস সালাম) ছিল শোকরগুজার বান্দা’ অনুচ্ছেদ; ছহীহ মুসলিম, হা/১৯৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৬২১; তিরমিযী, হা/২৪৩৪; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৬৪৬৫; মিশকাত, হা/৫৫৭২।
[১৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৪৪০, ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, ‘আল্লাহ্র বাণী : কতক মুখ সেদিন উজ্জ্বল হবে। তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে’ অনুচ্ছেদ; ছহীহ মুসলিম, হা/১৯৩, ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘নিম্ন জান্নাতী, তথায় তার মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত, হা/৫৫৭২।
[১৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/২২৭৮; মিশকাত, হা/৫৭৪১।
[১৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৯৭; মিশকাত, হা/৫৭৪৩।
[১৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৯৬; মিশকাত, হা/৫৭৪৪।
[২০]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৫৬০; ‘সদয় হওয়া’ অধ্যায়, জান্নাত ও জাহান্নাম-এর বিবরণ’ অনুচ্ছেদ; ছহীহ মুসলিম, ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘শাফা‘আত ও তাওহীদবাদীদের জাহান্নাম থেকে উদ্ধার লাভের প্রমাণ’ অনুচ্ছেদ; হা/১৮৪; মিশকাত, হা/৫৫৮০।
[২১]. শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বীয়া, পৃ. ৩০৭।
[২২]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৪৩৯, ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, ‘ক্বিয়ামতের দিনে নবী ও অপরাপরের সঙ্গে মহান আল্লাহ্র কথাবার্তা’ অনুচ্ছেদ; ছহীহ মুসলিম, ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘মহান আল্লাহ্র দর্শন পথের জ্ঞান’ অনুচ্ছেদ; হা/১৮৩।