বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:১৭ অপরাহ্ন

মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ

-আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম*


(২য় কিস্তি)

মাতুরীদীদের নিকট ঈমান

মাতুরীদীদের নিকট ঈমান হল শুধু অন্তরে বিশ্বাস করার নাম। মৌখিক স্বীকৃতি এবং আমলে বাস্তবায়ন ঈমানের অন্তর্ভুক্ত নয়। তাছাড়া তারা এটাও বিশ্বাস করে যে, ঈমানের কোন হ্রাস-বৃদ্ধি নেই। তারা বলে,أَنَّ الْاِيْمَانَ هُوَ التَّصْدِيْقُ وَأَنَّهُ لَا يَزِيْدُ وَلَا يَنْقُصُ ‘ঈমান হল অন্তরের বিশ্বাস। ঈমানের কোন হ্রাস-বৃদ্ধি নেই’।[১]

পর্যালোচনা

মাতুরীদীদের ঈমানের পরিচয় আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের সম্পূর্ণ বিপরীত।

‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত’-এর নিকট ঈমান

‘আল-ঈমান’ (الإيمان) শব্দটি বাবেإفعال -এর মাছদার। অভিধানিক অর্থ-اَلتَّصْدِيْقُ  ‘আন্তরিক বিশ্বাস’,اَلْإِقْرَارُ وَالطَّمَأْنِيْنَةُ ‘স্বীকৃতি ও প্রশান্তি’। শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (মৃ. ৭২৮ হি.) শেষোক্ত অর্থটাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কেননা হৃদয়ে যখন আন্তরিক বিশ্বাস ও বশ্যতা স্থান পায়, তখনই কেবল স্বীকৃতি ও প্রশান্তি অর্জিত হয়।[২] শরী‘আতের পরিভাষায় ঈমান হল,

تصديق بالجنان وإقرار باللسان وعمل بالأركان يزيد بالطاعة وينقص بالعصيان .

‘অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি এবং কর্মে সম্পাদন করা। আনুগত্যে ঈমান বাড়ে এবং পাপাচারে ঈমান কমে’।[৩] ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ বলেন,

اِلْإِيْمَانُ قَوْلٌ وَعَمَلٌ قَوْلُ الْقَلْبِ وَاللِّسَانِ وَعَمَلُ الْقَلْبِ وَاللِّسَانِ وَالْجَوَارِحِ وَأَنَّ الْإِيْمَانَ يَزِيْدُ بِالطَّاعَةِ وَيَنْقُصُ بِالْمَعْصِيَةِ.

‘ঈমান হল স্বীকারোক্তি ও আমলের নাম। অন্তরের স্বীকৃতি, মুখের স্বীকৃতি, অন্তরের আমল, মুখের আমল এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল’।[৪] এগুলোর সমষ্টির নাম যে ঈমান, কুরআন ও ছহীহ হাদীছে তার বহু দলীল-প্রমাণ আছে। যেমন-

১. অন্তরের স্বীকৃতি : অন্তরের স্বীকৃতি বলতে অন্তর বা হৃদয় দ্বারা সত্যায়ন ও দৃঢ় বিশ্বাসকে বুঝায়; যা অন্তর ছাড়া সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ الَّذِیۡ جَآءَ  بِالصِّدۡقِ وَ صَدَّقَ بِہٖۤ اُولٰٓئِکَ ہُمُ  الۡمُتَّقُوۡنَ   - لَہُمۡ مَّا یَشَآءُوۡنَ عِنۡدَ  رَبِّہِمۡ ؕ ذٰلِکَ جَزٰٓؤُا الۡمُحۡسِنِیۡنَ.

‘আর যে সত্য নিয়ে এসেছে এবং সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে, তারাই তো মুত্তাক্বী। তারা যা চাইবে সব কিছুই আছে তাদের প্রতিপালকের নিকট। এটাই সৎকর্মশীলদের পুরস্কার’ (সূরা আয-যুমার : ৩৩-৩৪)।

অন্তর যেমন সত্যায়নের জায়গা। অনুরূপ সন্দেহ পোষণেরও জায়গা। মানুষের অন্তরের কথা বা স্বীকৃতি এবং মুখের স্বীকৃতি এক জিনিস নয়। এ কারণে ঈমানের প্রথম ও প্রধান স্বীকৃতি হল অন্তরের স্বীকৃতি। অন্তর থেকে আল্লাহ ও তাঁর বিধান এবং রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর শরী‘আত সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাসকারী হল মুমিন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّمَا  الۡمُؤۡمِنُوۡنَ  الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِاللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ  ثُمَّ لَمۡ یَرۡتَابُوۡا ‘কেবল তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, অতঃপর সন্দেহ পোষণ করেনি’ (সূরা আল-হুজুরাত :১৫)। অর্থাৎ মুমিন তারাই, যারা আল্লাহ ও রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সত্য বলে মেনে নেয় এবং সন্দেহ পোষণ করে না। আল্লাহর এককত্বে, নবীর নবুওতের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে না। নিজের জীবনের উপর আল্লাহ এবং রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্যকে আবশ্যক করে নেয় এবং আল্লাহ যা ফরয করেছেন, সন্দেহাতীতভাবে তার প্রতি আমল করে। মহান আল্লাহ সন্দেহ-সংশয় পোষণকারীদের সম্বন্ধে বলেন,یَقُوۡلُوۡنَ بِاَفۡوَاہِہِمۡ مَّا لَیۡسَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ ‘তাদের অন্তরে যা নেই, তা-ই তারা তাদের মুখে বলে থাকে’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৬৭)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 یٰۤاَیُّہَا الرَّسُوۡلُ لَا یَحۡزُنۡکَ الَّذِیۡنَ یُسَارِعُوۡنَ فِی الۡکُفۡرِ مِنَ الَّذِیۡنَ قَالُوۡۤا اٰمَنَّا بِاَفۡوَاہِہِمۡ وَ لَمۡ تُؤۡمِنۡ قُلُوۡبُہُمۡ .

‘হে রাসূল! যারা কুফুরীর দিকে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছে, (তাদের এ কর্ম) আপনাকে যেন চিন্তিত না করে। যারা মুখে বলে ঈমান এনেছি; কিন্তু তাদের অন্তর ঈমান আনেনি’ (সূরা আল-মায়েদাহ : ৪১)।

আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, জান্নাতবাসীরা জান্নাতে এবং জাহান্নামীরা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের বলবেন, أَخْرِجُوْا مِنَ النَّارِ مَنْ كَانَ فِيْ قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ مِنْ إِيْمَانٍ ‘যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান আছে, তাকে জাহান্নাম থেকে বের কর’।[৫] আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِىْ قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ مِنْ كِبْرٍ وَلَا يَدْخُلُ النَّارَ مَنْ كَانَ فِىْ قَلْبِهِ مِثْقَالُ خَرْدَلَةٍ مِنْ إِيْمَانٍ.

‘যার অন্তরে সরিষা দানা পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং যার অন্তরে সরিষা দানা পরিমাণ ঈমান থাকবে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না’।[৬]

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,مَا مِنْ أَحَدٍ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ صِدْقًا مِنْ قَلْبِهِ إِلَّا حَرَّمَهُ اللهُ عَلَى النَّارِ ‘এমন কেউ কি নেই, যে ব্যক্তি অন্তরের সাথে সত্য জেনে একথা ঘোষণা করবে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামকে হারাম করে দিবেন’।[৭] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন,مَنْ مَاتَ وَهُوَ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ صَادِقًا مِنْ قَلْبِهِ دَخَلَ الْجَنَّةَ ‘যে ব্যক্তি অন্তরের সত্যবাদিতার সাথে ‘আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল -এ কথার সাক্ষ্য দিবে, এমতাবস্থায় মারা গেলে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[৮] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন,يَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَكَانَ فِيْ قَلْبِهِ مِنَ الخَيْرِ مَا يَزِنُ شَعِيْرَةً ‘যে ব্যক্তি ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু’ পড়েছে এবং তার অন্তরে একটি যবের ওযন পরিমাণ কল্যাণ (ঈমান) আছে, সে জাহান্নামের আগুন থেকে বের হয়ে আসবে’।[৯]

২. মুখের স্বীকৃতি : কালেমা শাহাদত তথা ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু’ এবং ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এই শাহাদাতাইন মুখে বলা এবং এতদুভয়ের অপরিহার্য বিষয়সমূহকে স্বীকৃতি প্রদানই হচ্ছে মুখের স্বীকৃতি; যা মুখ দ্বারা সম্ভব না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُوۡلُوۡۤا اٰمَنَّا بِاللّٰہِ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡنَا وَ مَاۤ اُنۡزِلَ  اِلٰۤی  اِبۡرٰہٖمَ  وَ  اِسۡمٰعِیۡلَ وَ  اِسۡحٰقَ وَ یَعۡقُوۡبَ وَ الۡاَسۡبَاطِ وَ مَاۤ اُوۡتِیَ مُوۡسٰی وَ عِیۡسٰی وَ مَاۤ اُوۡتِیَ النَّبِیُّوۡنَ مِنۡ  رَّبِّہِمۡ ۚ  لَا نُفَرِّقُ بَیۡنَ اَحَدٍ مِّنۡہُمۡ ۫ۖ وَ نَحۡنُ لَہٗ مُسۡلِمُوۡنَ.

‘তোমরা বল, আমরা আল্লাহর প্রতি এবং যা আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে আর যা ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়াকূব ও তদীয় বংশধরগণের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল এবং যা মূসা ও ঈসাকে প্রদান করা হয়েছিল এবং অন্যান্য নবীগণকে তাদের রব হতে যা প্রদত্ত হয়েছিল, সেসবের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা তাদের কারো মধ্যে তারতম্য করি না। আর আমরা তাঁরই অনুগত’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৩৬)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اٰمَنَ الرَّسُوۡلُ بِمَاۤ  اُنۡزِلَ اِلَیۡہِ مِنۡ رَّبِّہٖ وَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ  کُلٌّ اٰمَنَ بِاللّٰہِ وَ مَلٰٓئِکَتِہٖ وَ کُتُبِہٖ وَ رُسُلِہٖ  لَا نُفَرِّقُ بَیۡنَ  اَحَدٍ مِّنۡ رُّسُلِہٖ وَ قَالُوۡا سَمِعۡنَا وَ اَطَعۡنَا ٭۫ غُفۡرَانَکَ رَبَّنَا وَ اِلَیۡکَ الۡمَصِیۡرُ.  

‘রাসূল তাঁর প্রতিপালক হতে তাঁর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা বিশ্বাস করেন এবং মুমিনগণও (বিশ্বাস করেন); তাঁরা সবাই আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাগণের উপর, তাঁর কিতাবসমূহের উপর এবং তাঁর রাসূলগণের উপর ঈমান এনেছে। আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কাউকেও পার্থক্য করি না, (ঈমান আনার ক্ষেত্রে) তারা বলে, আমরা শ্রবণ করলাম ও স্বীকার করলাম, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনারই নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আপনারই দিকে চূড়ান্ত প্রত্যাবর্তন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৮৫)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَ  اِذَا یُتۡلٰی عَلَیۡہِمۡ  قَالُوۡۤا اٰمَنَّا بِہٖۤ  اِنَّہُ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّنَاۤ  اِنَّا کُنَّا مِنۡ قَبۡلِہٖ مُسۡلِمِیۡنَ ‘আর যখন তাদের নিকট তা তেলাওয়াত করা হয়, তখন তারা বলে, আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি, নিশ্চয় তা আমাদের রবের পক্ষ থেকে আগত সত্য। আমরাতো পূর্বেও আত্মসমর্পণকারী ছিলাম’ (সূরা আল-ক্বাছাছ : ৫৩)।

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوْا أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ ‘আমাকে লোকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার আদেশ করা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা একথার সাক্ষ্য প্রদান করে যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল’।[১০]

উসামা ইবনু যায়েদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে জুহাইনা গোত্রের লোকদের বিরুদ্ধে পাঠালেন। অতঃপর যখন আমি তাদের এক ব্যক্তির সম্মুখীন হয়ে তরবারী দ্বারা আঘাত করতে উদ্যত হলাম, তখন সে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’ বলে বসল। কিন্তু আমি তাকে আঘাত করলাম এবং তাকে হত্যা করে ফেললাম। পরে আমি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে এসে উক্ত ঘটনাটি জানালাম। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার কথা শুনে বললেন, ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’ দ্বারা সাক্ষ্য প্রদান করার পরও কি তুমি তাকে হত্যা করেছ? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! সে নিজের জান বাঁচানোর জন্য এরূপ বলেছে। তখন তিনি বললেন, فَهَلَّا شقَقْتَ عَنْ قَلْبِهِ ‘তুমি তার অন্তর চিরে দেখলে না কেন’?[১১]

৩. অন্তরের আমল : অন্তরের আমল হল, অপ্রকাশ্য কথা ও আমল। যেগুলোকে ইবাদতে কলবিয়্যা বা অভ্যন্তরীণ ইবাদত বলা হয়। অন্তর ছাড়া যে আমল করা সম্ভব নয়, সেগুলোই অন্তরের আমল। অন্তরের আমল দ্বীনের মূলনীতি, দ্বীনের মৌলভিত্তি। অন্তরের আমলের উদাহরণ হল, নিয়ত, আল্লাহর সন্তÍষ্টির জন্য ইখলাছ অবলম্বন করা, তাঁর শোকর আদায় করা, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসা, আল্লাহর জন্য আত্মসমর্পণ করা, আল্লাহর উপর ভরসা করা, আল্লাহর নিকট আশা-আকাক্সক্ষা করা, তাঁর হুকুমের উপর ধৈর্যধারণ করা, তাঁকে ভয় করা, তাঁর রহমতের আশা করা, আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা, আল্লাহর শোকর আদায় করা, ধৈর্যধারণ করা, ধার্মিকতা অবলম্বন করা, আত্মসমালোচনা করা ইত্যাদি অন্তরের আমলের অন্তর্ভুক্ত। এ সকল আমল সকল সৃষ্টির ওপর সকল আইম্মায়ে দ্বীনের ঐকমত্যে ফরয। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَ لَا تَطۡرُدِ الَّذِیۡنَ یَدۡعُوۡنَ رَبَّہُمۡ بِالۡغَدٰوۃِ  وَ الۡعَشِیِّ  یُرِیۡدُوۡنَ وَجۡہَہٗ  ‘আর যেসব লোক সকাল-সন্ধ্যায় তাদের রবের ইবাদত করে এবং এর মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদেরকে আপনি দূরে সরিয়ে দিয়েন না’ (সূরা আল-আন‘আম : ৫২)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الَّذِیۡنَ اِذَا ذُکِرَ اللّٰہُ وَجِلَتۡ قُلُوۡبُہُمۡ وَ اِذَا تُلِیَتۡ عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتُہٗ زَادَتۡہُمۡ  اِیۡمَانًا وَّ عَلٰی رَبِّہِمۡ یَتَوَکَّلُوۡنَ.

‘মুমিন তো কেবল তারাই, যাদের সামনে যখন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন তাদের অন্তরসমূহ ভীত হয়ে পড়ে। আর যখন তাদের সামনে তার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা হয়, তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে দেয় এবং তারা তাদের রবের উপর ভরসা করে’ (সূরা আল-আনফাল : ২)।

ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘প্রত্যেক কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক মানুষের জন্য তাই রয়েছে, যার জন্য সে নিয়ত করে। সুতরাং যে ব্যক্তির হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হবে, তার হিজরত আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দিকেই গণ্য হবে। আর যার হিজরত দুনিয়া লাভের আশায় কিংবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হবে, তার হিজরত সে দিকেই গণ্য হবে, যার জন্য সে হিজরত করেছে’।[১২]

আনাস ইবনু মালেক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! ক্বিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? তিনি বললেন, ‘তুমি এর জন্য কী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছ?’ লোকটি বললেন, এর জন্য আমি বেশি ছালাত, ছিয়াম ও দান-ছাদাক্বা প্রস্তুত করতে পারিনি; তবে আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ভালোবাসি। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, أَنْتَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ ‘যাকে তুমি ভালোবাস, তুমি তাঁর সাথেই থাকবে’।[১৩]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

*পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র :
[১]. আদা’ঊ মাতুরীদিয়াতি লিল আক্বীদাতিস সালাফিয়্যা আল-মাতুরীদিয়া, ১ম খ-, পৃ. ৪৭৭।
[২]. আব্দুল আলীম ইবনে কাওছার মাদানী, ঈমানের মূলনীতি (রাজশাহী : আছ-ছিরাত প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারী ২০১৮ খৃ.), পৃ. ১০; দ্রষ্টব্য : আছ-ছরেমুল মাসলূল, প্রকাশক : সঊদী বোর্ডার গার্ড, তা. বি.), পৃ. ৫১৯।
[৩]. ইবনু ঈসা, তাওযীহুল কাফিয়্যাহ আশ-শাফিয়্যাহ, ২য় খ-, পৃ. ১৩৯; ইবনু আবুল ‘ইয্ আল-হানাফী, শারহুল ‘আক্বীদাতিত ত্বাহাবী (মিশর : দারুস সালাম, ১৪২৬ হি./ ২০০৫ খ্রি.), পৃ. ৫৭; আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল মুহসিন আল-বদর, যিয়াদাতুল ঈমান ওয়া নুক্বছানিহি ওয়া হুকমিল ইসতিছনাই ফীহ (রিয়ায : মাকতাবাতু দারিল কলম, ১ম সংস্করণ ১৪১৬ হি./১৯৯৬ খ্রি.), পৃ. ১১০; ছালিহ আল-ফাওযান আল-ফাওযান, ই‘আনাতুল মুসতাফীদ বিশারহি কিতাবিত তাওহীদ (মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ৩য় সংস্করণ, ১৪২৩ হি./ ২০০২ খ্রি.), ২য় খ-, পৃ. ৭৯।
[৪]. ইবনু তাইমিয়াহ, আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বীয়া, পৃ. ২৪; ইবনু তাইমিয়াহ, ফাতাওয়া আল-কুবরা (দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৪০৮ হি./১৯৮৭ খৃ.), ৫ম খ-, পৃ. ২৪১; ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, (দারুল ওয়াফা, ৩য় সংস্করণ, তাবি.) ৩য় খ-, পৃ. ১৫১; ছালিহ আল-ফাওযান আল-ফাওযান, শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বীয়া, পৃ. ১৩৪।
    ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, সত্তর জন তাবেঈ, মুসলিমদের ইমামগণ এবং পূর্ববর্তী ফক্বীহগণ সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, الإيمان قول وعمل يزيد بالطاعة وينقص بالمعصية ‘ঈমান হল স্বীকারোক্তি ও আমলের নাম। আনুগত্যে ঈমান বাড়ে এবং পাপাচারে ঈমান কমে’। ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, পূর্ববর্তী আলেমদের মধ্য থেকে এক হাজারের অধিক আলেমের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। তারা সকলেই বলেছেন, ‘ঈমান হল স্বীকারোক্তি ও আমলের নাম’। ইবনু আবূ হাতিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, আমি আমার পিতা এবং আবূ যুর‘আ-কে ‘আহলুস সুন্নাহ’-এর মাযহাব, তাদের যুগের আলেমগণ এবং তাদের বিশ্বাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তারা বলেছেন, আমরা হিজাজ, ইরাক, মিশর, শাম এবং ইয়ামানের আলেমদের পেয়েছি, তাদের মাযহাব হল, ‘ঈমান হল স্বীকারোক্তি ও আমলের নাম। সৎ আমলের মাধ্যমে ঈমান বাড়ে এবং পাপাচারের কারণে ঈমান কমে’। ইমাম বাগাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ছাহাবী, তাবেঈ এবং তাদের পরবর্তী আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আলেমগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, أن الأعمال من الإيمان ‘আমল ঈমানের অংশ’। দ্রষ্টব্য : মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রহমান আল-খামীস, উছূলুদ দ্বীন ঈনদাল ইমাম আবী হানীফা (সঊদী আরব : দারুছ ছামীঈ, তাবি.), পৃ. ৩৮৬।  

[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/২২, ৬৫৬০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৪; মিশকাত, হা/৫৫৮০।
[৬]. আবূ দাঊদ, হা/৪০৯১; তিরমিযী, হা/১৯৯৮; ইবনু মাজাহ, হা/৫৯।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/১২৮; ছহীহ মুসলিম, হা/৩২। 
[৮]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২২০৫৬, সনদ ছহীহ। 
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৪১০।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/২৫; ছহীহ মুসলিম, হা/৩৬।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৮৭২; ছহীহ মুসলিম, হা/৯৬; আবূ দাঊদ, হা/২৬৪৩; মিশকাত, হা/৩৪৫০।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/১; ছহীহ মুসলিম, হা/১৯০৭, ‘ইমারত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৫; মিশকাত, হা/১।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৭১৫৩।




সর্বশ্রেষ্ঠ আমল - হাফেয আবূ তাহের বিন মজিবুর রহমান
তওবার গুরুত্ব ও ফযীলত - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
আল-কুরআনের প্রতি ঈমান আনয়নের স্বরূপ - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
বিদ‘আত পরিচিতি (৭ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
মূর্তিপূজার ইতিহাস - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৪র্থ কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
সদাচরণের প্রতিদান ও দুশ্চরিত্রের পরিণাম - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
কালো কলপ ব্যবহারের শারঈ বিধান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান

ফেসবুক পেজ