ফাযায়েলে কুরআন
-আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম*
(শেষ কিস্তি)
৪). সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল নিদর্শন
কুরআনের অন্যতম মর্যাদা হল এটা সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল নিদর্শন। এর প্রতিটি হরফ, শব্দ, আয়াত এবং অর্থ হল সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের উপর প্রমাণ। এই সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল নিদর্শন, দলীল এবং অকাট্য প্রমাণ দ্বারা লাভ হয় হেদায়াত, সুপথ ও সৎপথ। আল্লাহ তা‘আলা এর দ্বারা তাঁর বান্দাদেরকে অন্ধকার তথা মূর্খতা, কুফরী এবং রায় বা দলীল বিহীন মতামত থেকে আলোর পথে অর্থাৎ হেদায়াত, সুদৃঢ় বিশ্বাস এবং ঈমানের দিকে নিয়ে আসেন। এর দ্বারা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে হুজ্জত প্রতিষ্ঠিত হয় এবং স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয় বিভ্রান্তদের বিভ্রান্তি। যালিম, হঠকারী এবং ফাসিক ছাড়া এ স্পষ্ট প্রমাণ কেউ অস্বীকার করতে পারে না। এটা মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওতের প্রকাশ্য দলীল। ইয়াহুদীদের বিশেষ জ্ঞান ভা-ার তাওরাতের গোপনীয় কথা, তাদের পরিবর্তনকৃত আহকাম, বনী ইসরাঈলদের খবর, তাদের কিতাবের ঐ সকল জ্ঞান, যা তাদের আলিম এবং প-িতগণ ছাড়া কেউ অবগত না ইত্যাদি সব কিছুই এই অলৌকিক কিতাব কুরআন মাজীদে তিনি বর্ণনা করেছেন। যা শুনে প্রত্যেক জীবিত অন্তর মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওতের সত্যতা স্বীকার করতে বাধ্য।[১] তাছাড়া এটা হালাল, হারাম, দ-াদেশ এবং বিধানের বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট বিবরণ।[২] এ কারণে কুরআন হল সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল নিদর্শন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ کَذٰلِکَ اَنۡزَلۡنٰہُ اٰیٰتٍۭ بَیِّنٰتٍ وَّ اَنَّ اللّٰہَ یَہۡدِیۡ مَنۡ یُّرِیۡدُ ‘এভাবেই আমরা সুস্পষ্ট নিদর্শনরূপে ওটা অবতীর্ণ করেছি, আর নিশ্চয় আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে সৎপথ প্রদর্শন করেন’ (সূরা আল-হাজ্জ : ১৬)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,لَقَدۡ اَنۡزَلۡنَاۤ اٰیٰتٍ مُّبَیِّنٰتٍ وَ اللّٰہُ یَہۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ ‘আমরা অবশ্যই সুস্পষ্ট নিদর্শন অবতীর্ণ করেছি। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল পথ প্রদর্শন করেন’ (সূরা আন-নূর : ৪৬)।
আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্ট, উজ্জ্বল আয়াত এবং অকাট্য প্রমাণাদীর মাধ্যমে কুফুরী, ভ্রষ্টতা, মূর্খতার অন্ধকার থেকে বের করে ঈমান, সুদৃঢ় বিশ্বাস, আলো এবং হেদায়াতের দিকে নিয়ে আসেন।[৩] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ہُوَ الَّذِیۡ یُنَزِّلُ عَلٰی عَبۡدِہٖۤ اٰیٰتٍۭ بَیِّنٰتٍ لِّیُخۡرِجَکُمۡ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوۡرِ وَ اِنَّ اللّٰہَ بِکُمۡ لَرَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ
‘তিনিই তাঁর বান্দার প্রতি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ অবতীর্ণ করেন, তোমাদেরকে সকল প্রকার অন্ধকার হতে আলোতে আনার জন্য। আর নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি করুণাময়; পরম দয়ালু’ (সূরা আল-হাদীদ : ৯)।
এই সুস্পষ্ট আয়াত সাবধানীদের জন্য উপদেশ। দুষ্কার্যকারী, আনাচারী এবং বিরুদ্ধাচরণকারী ছাড়া কেউ তা অস্বীকার করে না। আর অবিশ্বাসী ও অস্বীকারকারীদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ لَقَدۡ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکُمۡ اٰیٰتٍ مُّبَیِّنٰتٍ وَّ مَثَلًا مِّنَ الَّذِیۡنَ خَلَوۡا مِنۡ قَبۡلِکُمۡ وَ مَوۡعِظَۃً لِّلۡمُتَّقِیۡنَ
‘আমরা তোমাদের নিকট অবতীর্ণ করেছি সুস্পষ্ট বাক্য, তোমাদের পূর্ববর্তীদের দৃষ্টান্ত এবং সাবধানীদের জন্য উপদেশ’ (সূরা আন-নূর : ৩৪)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَ لَقَدۡ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکَ اٰیٰتٍۭ بَیِّنٰتٍ وَ مَا یَکۡفُرُ بِہَاۤ اِلَّا الۡفٰسِقُوۡنَ ‘এবং নিশ্চয় আমরা আপনার প্রতি উজ্জ্বল নিদর্শনসমূহ অবতীর্ণ করেছি এবং দুষ্কার্যকারী ব্যতীত কেউই তা অবিশ্বাস করবে না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৯৯)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
بَلۡ ہُوَ اٰیٰتٌۢ بَیِّنٰتٌ فِیۡ صُدُوۡرِ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡعِلۡمَ وَ مَا یَجۡحَدُ بِاٰیٰتِنَاۤ اِلَّا الظّٰلِمُوۡنَ
‘বরং যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে, তাদের অন্তরে এ (কুরআন) স্পষ্ট নিদর্শন। কেবল অনাচারীরাই আমাদের নিদর্শনকে অস্বীকার করে’ (সূরা আল-‘আনকাবূত : ৪৯)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّ الَّذِیۡنَ یُحَآدُّوۡنَ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ کُبِتُوۡا کَمَا کُبِتَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ وَ قَدۡ اَنۡزَلۡنَاۤ اٰیٰتٍۭ بَیِّنٰتٍ وَ لِلۡکٰفِرِیۡنَ عَذَابٌ مُّہِیۡنٌ
‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাদেরকে অপদস্থ করা হবে, যেমন অপদস্থ করা হয়েছে পূর্ববর্তীদেরকে। অবশ্যই আমরা সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ অবতীর্ণ করেছি। আর অবিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি’ (সূরা আল-মুজাদালাহ : ৫)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّ الَّذِیۡنَ یَکۡتُمُوۡنَ مَاۤ اَنۡزَلۡنَا مِنَ الۡبَیِّنٰتِ وَ الۡہُدٰی مِنۡۢ بَعۡدِ مَا بَیَّنّٰہُ لِلنَّاسِ فِی الۡکِتٰبِ اُولٰٓئِکَ یَلۡعَنُہُمُ اللّٰہُ وَ یَلۡعَنُہُمُ اللّٰعِنُوۡنَ
‘আমরা যেসব উজ্জ্বল নিদর্শন ও পথ-নির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, আমরা ঐ গুলোকে মানুষের নিকট প্রকাশ করার পরও যারা ঐসব বিষয়কে গোপন করে, আল্লাহ তাদেরকে অভিসম্পাত করেন এবং অভিসম্পাত কারীগণও তাদেরকে অভিসম্পাত করে থাকে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৫৯)।
ইয়াহূদী আলেম সম্প্রদায় আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান গোপন করত। তারা সর্বসাধারণ্যে প্রচার করার পরিবর্তে ইলমে দ্বীনকে একটি সীমিত ধর্মীয় পেশাদার গোষ্ঠীর মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছিল। সাধারণ জনগণকে এ জ্ঞান থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। এমনকি এ গোষ্ঠীর লোকগুলো নিজেদের জনপ্রিয়তা অব্যাহত রাখার জন্য ভ্রষ্টতা ও শরী‘আত বিরোধী কর্মকা- ছড়িয়ে পড়তে নিজেদের কথা ও কাজের সাহায্যে অথবা নীরব সমর্থনের মাধ্যমে বৈধতার ছাড়পত্র দান করত। উপরিউক্ত আয়াতে এ ধরণের প্রবণতা থেকে মুসলিমদেরকে দূরে থাকার তাকীদ দেয়া হয়েছে। কারণ কুরআন সুস্পষ্ট এবং উজ্জ্বল নিদর্শন।
এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর যে সমস্ত প্রকৃষ্ট হেদায়াত নাযিল হয়েছে, সেগুলো মানুষের কাছে গোপন করা এত কঠিন হারাম ও মহাপাপ, যার জন্য আল্লাহ তা‘আলা নিজেও লা‘নত বা অভিসম্পাত করে থাকেন এবং সমগ্র সৃষ্টিও অভিসম্পাত করে। কেননা যে জ্ঞানের প্রচার ও প্রসার করা যরূরী, তা গোপন করা হারাম। এ জন্যই এরশাদ হচ্ছে যে, সত্যকে গোপনকারীরা অভিশপ্ত। যেমন প্রত্যেক জিনিস ঐ আলেমের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে যিনি জনসাধারণের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার কথাগুলো প্রচার করেন। এমনকি পানির মাছ এবং আকাশের পাখিরাও তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। অনুরূপভাবে যারা সত্য কথা জেনে শুনে গোপন করে এবং বোকা ও বধির হওয়ার ভান করে তাদের প্রতি প্রত্যেক জিনিসই অভিশাপ দিয়ে থাকে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৫৯)।[৪] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّ الَّذِیۡنَ یَکۡتُمُوۡنَ مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ یَشۡتَرُوۡنَ بِہٖ ثَمَنًا قَلِیۡلًا اُولٰٓئِکَ مَا یَاۡکُلُوۡنَ فِیۡ بُطُوۡنِہِمۡ اِلَّا النَّارَ وَ لَا یُکَلِّمُہُمُ اللّٰہُ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ وَ لَا یُزَکِّیۡہِمۡ وَ لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ
‘নিশ্চয় যারা গোপন করে আল্লাহর কিতাব হতে যা অবতীর্ণ করেছেন তা এবং এর বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে, তারা তাদের নিজেদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছুই খায় না। আর ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৭৪)।
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, مَنْ سُئِلَ عَنْ عِلْمٍ فَكَتَمَهُ أَلْجَمَهُ اللهُ بِلِجَامٍ مِنْ نَارٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘যে লোক দ্বীনের কোন বিধানের বিষয় জানা সত্ত্বেও তা জিজ্ঞেস করলে গোপন করবে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তার মুখে আগুনের লাগাম পরিয়ে দিবেন’।[৫] ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,وَاللهِ لَأُحَدِّثَنَّكُمْ حَدِيْثًا لَوْلَا آيَةٌ فِىْ كِتَابِ اللهِ مَا حَدَّثْتُكُمْ ‘আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই তোমাদেরকে একটি হাদীছ শুনাব, যদি আল্লাহর কিতাবে একটি আয়াত না থাকত তাহলে আমি তোমাদেরকে হাদীছটি শুনাতাম না’।[৬] আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, وَايْمُ اللهِ لَوْلَا آيَةٌ فِىْ كِتَابِ اللهِ مَا حَدَّثْتُكُمْ بِشَىْءٍ أَبَدًا ‘আল্লাহর কসম! যদি আল্লাহর কিতাবে একটি আয়াত না থাকত তাহলে আমি তোমাদের নিকট কখনোই কোন হাদীছ বর্ণনা করতাম না’। অতঃপর তিনি তেলাওয়াত করেন (اِنَّ الَّذِیۡنَ یَکۡتُمُوۡنَ مَاۤ اَنۡزَلۡنَا مِنَ الۡبَیِّنٰتِ وَ الۡہُدٰی)।[৭]
অতএব পরিশেষে বলা যায় যে, কুরআন হল সুস্পষ্ট ও উজ্জল নিদর্শন। তার দ্বারা বাতিল থেকে হক্ব স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাতে আর কোন অস্পষ্টতা থাকতে পারে না। তা সত্য বলে মেনে নেয়ার ব্যাপারে মনের কোণে কোন প্রকার সংশয়, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব বা কুণ্ঠাবোধ থাকতে পারে না। যেহেতু তা পরম করুণাময় মহাজ্ঞানীর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল করা হয়েছে। এর পরে আর কারো কোন ওযর, আপত্তি, অজুহাত থাকতে পারে না। যেহেতু এ হল প্রত্যেক মানুষের প্রমাণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لِّیَہۡلِکَ مَنۡ ہَلَکَ عَنۡۢ بَیِّنَۃٍ وَّ یَحۡیٰی مَنۡ حَیَّ عَنۡۢ بَیِّنَۃٍ وَ اِنَّ اللّٰہَ لَسَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ ‘যে কেউ ধ্বংস হবে, সে যেন স্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে ধ্বংস হয় এবং যে জীবিত থাকবে, সে যেন স্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে জীবিত থাকে। আর নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (সূরা আল-আনফাল : ৪২)।
৫). সত্য কিতাব
আল-কুরআনের অন্যতম মর্যাদা হল এটা সত্য কিতাব। কুরআনের বাণী চিরন্তন সত্য। এটা আল্লাহর কালাম। এটা চির সত্য ও মহাসত্য কিতাব। এটা সত্য দলীল।[৮] যা মানুষকে হেদায়াতের পথ দেখায়, সত্যকে মিথ্যা থেকে এবং হেদায়াতকে ভ্রষ্টতা থেকে প্রকাশ ও স্পষ্ট করে।[৯] আল্লাহ তা‘আলা এটাকে অবতীর্ণ করে সত্যকে প্রকাশ করেছেন এবং অসত্যকে দূর করেছেন।[১০] কুরআনে কোন অবাস্তব, অসত্য কথা ও বিধান নেই। বাতিল এতে অনুপ্রবেশ করতে পারে না। এ কারণেই কুরআন হল (اَلۡحَقُّ) বা সত্য কিতাব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ بِالۡحَقِّ اَنۡزَلۡنٰہُ وَ بِالۡحَقِّ نَزَلَ وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ اِلَّا مُبَشِّرًا وَّ نَذِیۡرًا ‘আমরা সত্যসহই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং সত্যসহই তা অবতীর্ণ হয়েছে; আমরা তো আপনাকে শুধু সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ১০৫)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
تِلۡکَ اٰیٰتُ اللّٰہِ نَتۡلُوۡہَا عَلَیۡکَ بِالۡحَقِّ فَبِاَیِّ حَدِیۡثٍۭ بَعۡدَ اللّٰہِ وَ اٰیٰتِہٖ یُؤۡمِنُوۡنَ
‘এগুলো আল্লাহর আয়াত, যা আমরা আপনার নিকট হক্বসহ আবৃত্তি করছি, সুতরাং আল্লাহ ও তাঁর আয়াতের পরিবর্তে ওরা আর কোন্ বাণীতে বিশ্বাস করবে’? (সূরা আল-জাছিয়াহ : ৬)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ذٰلِکَ بِاَنَّ اللّٰہَ نَزَّلَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ وَ اِنَّ الَّذِیۡنَ اخۡتَلَفُوۡا فِی الۡکِتٰبِ لَفِیۡ شِقَاقٍۭ بَعِیۡدٍ
‘(তাদের প্রতি শাস্তির আদেশ দেয়া হয়েছে) এজন্য যে, আল্লাহই কিতাবকে সত্যরূপে অবতীর্ণ করেছেন আর যারা কিতাব সম্বন্ধে মতভেদ করেছে তারা চরম মতভেদে পড়ে আছে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৭৬)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, تِلۡکَ اٰیٰتُ اللّٰہِ نَتۡلُوۡہَا عَلَیۡکَ بِالۡحَقِّ وَ اِنَّکَ لَمِنَ الۡمُرۡسَلِیۡنَ ‘এসব আল্লাহরই আয়াত, যা আমরা আপনাকে সঠিকভাবে পড়িয়ে শুনাচ্ছি এবং নিশ্চয় আপনি রাসূলগণের অন্তর্ভুক্ত’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৫২)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ ہُوَ الۡحَقُّ مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَہُمۡ ‘এটা সত্য, তাদের সাথে যা আছে এটা তারই সত্যায়িতকারী’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৯১)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اِنَّ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ لَیَعۡلَمُوۡنَ اَنَّہُ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّہِمۡ ‘এবং নিশ্চয় যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তারা অবশ্যই অবগত আছে যে, নিশ্চয় এটা তাদের প্রতিপালকের নিকট হতে সত্য’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৪৪)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اَلۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّکَ فَلَا تَکُوۡنَنَّ مِنَ الۡمُمۡتَرِیۡنَ ‘সত্য আপনার রব-এর কাছ থেকে পাঠানো। কাজেই আপনি সন্দেহবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৪৭)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,نَزَّلَ عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡہِ وَ اَنۡزَلَ التَّوۡرٰىۃَ وَ الۡاِنۡجِیۡلَ ‘তিনি হক্ব সহ আপনার প্রতি গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন যা পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যতা প্রতিপাদনকারী এবং তিনি তাওরাত ও ইঞ্জীল অবতীর্ণ করেছিলেন’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ৩)।
আল্লাহ তা‘আলা যেমন আল-কুরআনকে সত্য কিতাব করে অবতীর্ণ করেছেন। অনুরূপভাবে মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সেই সত্য সহ সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শকরূপে প্রেরণ করেছেন। যাতে তিনি সে অনুসারে মানুষের মাঝে বিচার ফায়সালা করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ بِالۡحَقِّ بَشِیۡرًا وَّ نَذِیۡرًا ‘নিশ্চয় আমরা আপনাকে সত্য সহ সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শক-রূপে (সতর্ককারীরূপে) প্রেরণ করেছি’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১১৯)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ لِتَحۡکُمَ بَیۡنَ النَّاسِ بِمَاۤ اَرٰىکَ اللّٰہُ ‘অবশ্যই আমরা সত্য সহকারে আপনার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যেন আপনি যা আল্লাহ আপনাকে জানিয়েছেন, সে অনুসারে মানুষের মধ্যে বিচার ফায়সালা করেন’ (সূরা আন-নিসা : ১০৫)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡہِ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ مُہَیۡمِنًا عَلَیۡہِ
‘আর আমরা সত্য বিধানসহ আপনার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি যা পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যায়নকারী ও সংরক্ষক’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৪৮)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلۡ نَزَّلَہٗ رُوۡحُ الۡقُدُسِ مِنۡ رَّبِّکَ بِالۡحَقِّ ‘(হে নবী!) বলুন! এ কুরআন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে রুহুল কুদূস (জিবরীল) সত্য সহকারে অবতীর্ণ করেছেন’ (সূরা আন-নাহল : ১০২)।
কুরআন এমনি এক হক্ব ও মহাসত্য কিতাব, যাতে কোন বক্রতা নেই। বাতিল, অসত্য কথা নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ اِنَّہٗ لَکِتٰبٌ عَزِیۡزٌ - لَّا یَاۡتِیۡہِ الۡبَاطِلُ مِنۡۢ بَیۡنِ یَدَیۡہِ وَ لَا مِنۡ خَلۡفِہٖ تَنۡزِیۡلٌ مِّنۡ حَکِیۡمٍ حَمِیۡدٍ
‘আর এ তো অবশ্যই এক সম্মানিত কিতাব। বাতিল এতে অনুপ্রবেশ করতে পারে না, সামনে থেকেও না, পিছন থেকেও না। এটা প্রজ্ঞাময়, চিরপ্রশংসিতের কাছ থেকে নাযিলকৃত’ (সূরা হা-মীম আস-সাজদাহ : ৪১-৪২)।
এ কুরআনে বাতিল বলতে কিছু নেই। না কেউ তাতে বাতিল প্রবেশ করাতে পারে। যেহেতু এটা প্রজ্ঞাময়, হিকমতময়, প্রশংসিত ও সম্মানিত আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ। এ কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় থেকে বিকৃতি হয়নি এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত কেউ করতেও পারবে না। এটাতে কোন প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন বা বিয়োজন করার পথ নেই। যেহেতু তার শব্দ ও অর্থ মহান প্রতিপালক কর্তৃক সুরক্ষিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,اِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا الذِّکۡرَ وَ اِنَّا لَہٗ لَحٰفِظُوۡنَ ‘নিশ্চয় আমরা কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমরাই ওর সংরক্ষক’ (সূরা আল-হিজর : ৯)।
এমনকি অহীবাহক জিবরীল (আলাইহিস সালাম) এবং কুরআনের ধারক মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাতে কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন বা বিয়োজন কিছুই করার ইখতিয়ার ছিল না এবং তার সক্ষমও ছিল না। যেহেতু এ কুরআন হক্বসহ অবতীর্ণ। বাতিল তাকে স্পর্শ করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ بِالۡحَقِّ اَنۡزَلۡنٰہُ وَ بِالۡحَقِّ نَزَلَ وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ اِلَّا مُبَشِّرًا وَّ نَذِیۡرًا ‘আমরা সত্যসহই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং সত্যসহই তা অবতীর্ণ হয়েছে; আমরা তো আপনাকে শুধু সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ১০৫)।
এরপরও বহু হতভাগা মানুষ কুরআনের বাণীতে সন্দেহ পোষণ করে। কুরআনের আয়াতকে تحريف (পরিবর্তন)[১১],
تعطيل (অস্বীকার ও বাতিল)[১২], تكييف (পদ্ধতি ও ধরণ বর্ণনা)[১৩] এবং تمثيل (উদাহরণ, উপমা ও দৃষ্টান্ত পেশ) করে।[১৪] অথচ এটা আল্লাহর কালাম বা কথা। তাঁর কথা মিথ্যা নয়। তিনি হলেন অধিক সত্যবাদী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَللّٰہُ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ لَیَجۡمَعَنَّکُمۡ اِلٰی یَوۡمِ الۡقِیٰمَۃِ لَا رَیۡبَ فِیۡہِ وَ مَنۡ اَصۡدَقُ مِنَ اللّٰہِ حَدِیۡثًا
‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য মা‘বূদ নেই। নিশ্চয় তিনি তোমাদেরকে শেষ বিচারের দিন একত্র করবেন এতে কোন সন্দেহ নেই। আর কথায় আল্লাহ অপেক্ষা অধিক সত্যবাদী কে আছে’? (সূরা আন-নিসা : ৮৭)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ سَنُدۡخِلُہُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَاۤ اَبَدًا وَعۡدَ اللّٰہِ حَقًّا وَ مَنۡ اَصۡدَقُ مِنَ اللّٰہِ قِیۡلًا
‘যারা বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে, তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশাধিকার দান করব; যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। আর কে আছে আল্লাহ অপেক্ষা অধিক সত্যবাদী’ (সূরা আন-নিসা : ১২২)।
মহান আল্লাহ যে খবর দিয়েছেন তা সত্য, তাঁর বলা কথা চির সত্য, চিরন্তন সত্য। তাঁর বাণী অমোঘ ও অব্যর্থ। তাঁর কথার বিপরীত যে কথা তা মিথ্যা, যে বিশ্বাস তাঁর বিবরণের বিরোধী তা বাতিল এবং যে বিধান তাঁর দেয়া বিধানের পরিপন্থী তা অসত্য। যে ধারণা তাঁর বর্ণনার বিপরীত, তা অবাস্তব। অর্থাৎ আল্লাহর কালাম সত্যতা, ইনসাফ ও সমতার দিক দিয়ে সম্পূর্ণ ও পরিপূর্ণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَ تَمَّتۡ کَلِمَتُ رَبِّکَ صِدۡقًا وَّ عَدۡلًا لَا مُبَدِّلَ لِکَلِمٰتِہٖ وَ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ ‘সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে তোমার প্রতিপালকের বাণী সম্পূর্ণ এবং তাঁর বাক্য পরিবর্তন করার কেউ নেই। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (সূরা আল-আন‘আম : ১১৫)।
কুরআনের যেসব ঘটনা, অবস্থা, ওয়াদা ও ভীতি বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো সবই সত্য ও নির্ভুল। এগুলোতে কোনরূপ ভ্রান্তির সম্ভাবণা নেই। আর আল্লাহ তা‘আলার সব বিধান ন্যায়বিচার ভিত্তিক। তাঁর বিধান সুবিচার ও সমতার উপর ভিত্তিশীল। এতে কারে প্রতি কোন অবিচার নেই এবং এমন কোন কঠোরতাও নেই, যা মানুষ সহ্য করতে পারে না। এ কারণে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বিবৃত সকল বিবরণ চির সত্য, চিরন্তর সত্য এবং এর সকল প্রকার আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধান সম্পূর্ণভাবে ন্যায়পরায়ণ। এর চাইতে সত্য এবং এর চাইতে ন্যায়পরায়ণ অন্য কোন বাণী হতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلۡ صَدَقَ اللّٰہُ فَاتَّبِعُوۡا مِلَّۃَ اِبۡرٰہِیۡمَ حَنِیۡفًا وَ مَا کَانَ مِنَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ ‘(হে নবী!) বলুন! আল্লাহ সত্য বলেছেন। সুতরাং তোমরা একনিষ্ঠভাবে ইবরাহীমের মিল্লাত অনুসরণ কর, আর তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ৯৫)।
নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুৎবার শুরুতে বলতেন,إِنَّ أَصْدَقَ الْحَدِيْثِ كِتَابُ اللهِ وَأَحْسَنَ الْهَدْىِ هَدْىُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘অতঃপর (বলি যে), সবচেয়ে সত্য বাণী হল আল্লাহর কিতাব এবং সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ পন্থা হল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পন্থা’।[১৫] আবূ মূসা আল-আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
إِنَّمَا مَثَلِىْ وَمَثَلُ مَا بَعَثَنِىْ اللهُ بِهِ كَمَثَلِ رَجُلٍ أَتَى قَوْمًا فَقَالَ يَا قَوْمِ إِنِّىْ رَأَيْتُ الْجَيْشَ بِعَيْنَىَّ وَإِنِّىْ أَنَا النَّذِيْرُ الْعُرْيَانُ فَالنَّجَاءَ النَّجَاءَ فَأَطَاعَهُ طَائِفَةٌ مِّنْ قَوْمِهِ فَأَدْلَجُوْا فَانْطَلَقُوْا عَلَىْ مَهَلِهِمْ فَنَجَوْا وَكَذَّبَتْ طَائِفَةٌ مِّنْهُمْ فَأَصْبَحُوْا مَكَانَهُمْ فَصَبَّحَهُمُ الْجَيْشُ فَأَهْلَكَهُمْ وَاجْتَاحَهُمْ فَذَلِكَ مَثَلُ مَنْ أَطَاعَنِىْ فَاتَّبَعَ مَا جِئْتُ بِهِ مَنْ عَصَانِىْ وَكَذَّبَ جِئْتُ بِهِ مِنَ الْحَقِّ
‘আমার এবং যেসব বিষয় নিয়ে আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন তার উদাহরণ হল, এক ব্যক্তির ন্যায়, যে তাঁর কওমের নিকট আগমন করল এবং বলল, হে আমার কওম! আমি আমার এই দুই চোখ দিয়ে শত্রুসৈন্য দেখে এসেছি এবং আমি তোমাদের জন্য ‘উলঙ্গ সতর্ককারী’। অতএব বাঁচার জন্য জলদি কর, জলদি কর! কওমের একদল লোক তাঁর কথা মেনে নিয়ে রাতেই চলে গেল। তাতে তারা ধীরে সুস্থে যেতে পারল এবং বেঁচে গেল। পক্ষান্তরে অপরদল যারা তার কথা মিথ্যা মনে করল, তারা নিজেদের স্থানেই সকাল করল। ফলে ভোরেই শত্রু তাদের উপরে আপতিত হল এবং তাদেরকে ধ্বংস করল ও সমূলে উৎখাত করল। এটি হল সেই ব্যক্তির উদাহরণ, যে আমার আনুগত্য করল ও আমি যা এনেছি তাঁর অনুসরণ করল এবং যে আমার অবাধ্য হয়েছে ও আমি যে সত্য নিয়ে আগমন করেছি, তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল’।[১৬]
* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র :
[১]. জামি‘ঊল বায়ান ফী তা‘বীলিল কুরআন, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩০৪; তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৪।
[২]. মুহীউস সুন্নাহ ইবনু মাসঊদ আল-বাগাবী, মা‘আলিমুত তানযীল (দারুত ত্বয়্যিব, ৪র্থ সংস্করণ, ১৪১৭ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৬।
[৩]. জামি‘ঊল বায়ান ফী তা‘বীলিল কুরআন, ২২তম খণ্ড, পৃ. ৩৯১; তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৮ম খণ্ড, পৃ. ১২।
[৪]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৭২; তিরমিযী, হা/২৬৮২; ইবনু মাজাহ, হা/২২৩, সনদ ছহীহ।
[৫]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৮০৩৫; আবূ দাঊদ, হা/৩৬৫৮; ইবনু মাজাহ, হা/২৬৪; মুসতাদরাক হাকিম, হা/৩৪৪, সনদ ছহীহ।
[৬]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৪০০; ছহীহ মুসলিম, হা/২২৭।
[৭]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৬৯১, সনদ ছহীহ।
[৮]. আল-জামিঊ লি-আহকামিল কুরআন, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩৭।
[৯]. তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৮২।
[১০]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৮৪।
[১১]. تحريف (পরিবর্তন) : তাহরীফ হল কোন জিনিসকে তার স্বরূপ বা আসল অবস্থান থেকে সরিয়ে ফেলা। এটা দু’ প্রকার। (ক) শাব্দিক পরিবর্তন (খ) অর্থ ও তাৎপর্যগত পরিবর্তন।
(ক) শাব্দিক পরিবর্তন : কোন শব্দে কিছু বৃদ্ধি করা অথবা কমিয়ে দেয়া, কিংবা শব্দের কোনো হরকত পরিবর্তন করে ফেলা। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী اَلرَّحۡمٰنُ عَلَی الۡعَرۡشِ اسۡتَوٰی ‘দয়াময় (আল্লাহ) আরশে সমুন্নত হয়েছেন’। এ আয়াতটির اسۡتَوٰی শব্দটিকে পরিবর্তন করে استولى বলা। (اسۡتَوٰی) অর্থাৎ আল্লাহর আয়াতের মধ্যে একটি অক্ষর তথা ي এবং و -এর মাঝখানে لام অক্ষর বাড়িয়ে দিয়ে اسۡتَوٰی শব্দটিকে পরিবর্তন করে استولى বলা। জাহমিয়ারা কুরআনের اسۡتَوٰی শব্দটিতে লাম বাড়িয়ে বলত استولى । মাতুরীদিরা اسۡتَوٰی তথা আল্লাহর আরশের উপর সমুন্নত হওয়াকে অস্বীকার করে বলে, أنه مستول على العرش وعلى جميع العالم ‘তিনি আরশ এবং সৃষ্টিজগতের উপর কর্তৃত্ব লাভকারী বা প্রভাব বিস্তারকারী’। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَّ جَآءَ رَبُّکَ ‘এবং তোমার রব আগমন করবেন’। এ আয়াতের মধ্যে একটি শব্দ বাড়িয়ে, وَّ جَآءَ أَمْرُ رَبُّکَ ‘এবং তোমার রবের আদেশ আগমন করবে’ বলা। দ্রষ্টব্য : শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বীয়া, পৃ. ৩৪; কিতাবু উসূলিল ঈমান ফী যূইল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ, পৃ. ৯৮; আবুল উসরা মুহাম্মাদ আল-বাযদূবী, উছূলুদ দ্বীন (কায়রো : মাকতাবাতুল আযহারী, ১৪২৪ হি./২০০৩ খৃ), পৃ. ৪১; শামসুদ্দীন সালাফী আল-আফগানী, আদা’ঊ মাতুরীদিয়াতি লিল আক্বীদাতিত সালাফিয়্যা আল-মাতুরীদিয়া- আল-মাতুরীদিয়া ওয়া মাওক্বিফুহুম মিন তাওহীদিল আসমা’ই ওয়াছ সিফাত, ১ম খণ্ড (ত্বায়েফ : মাকতাবাতুছ ছিদ্দীক, ২য় সংস্করণ, ১৪১৯ হি./ ১৯৯৮ খৃ.), পৃ. ৫১৫; শায়খুল ইমাম মাইমূন ইবনু মুহাম্মাদ আন-নাসাফী, বাহরুল কালাম ; তাহক্বীক : ড. ওলীউদ্দীন মুহাম্মাদ ছালিহ আল-ফুরফূর (মাকতাবাতু দারুল ফুরফূর, ২য় সংস্করণ, ১৪২১ হি.), পৃ. ১১০; ড. সালিহ আল ফাওযান, শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বীয়া; অনুবাদ : আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী (রাজশাহী : ওয়াহীদিয়া ইসলামিয়া লাইব্রেরী, ২০১৫ খৃ.), পৃ. ৩৪; তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরিল কালামিল মান্নান, পৃ. ৯৪।
(ক) শাব্দিক পরিবর্তন : কোন শব্দে কিছু বৃদ্ধি করা অথবা কমিয়ে দেয়া, কিংবা শব্দের কোনো হরকত পরিবর্তন করে ফেলা। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী اَلرَّحۡمٰنُ عَلَی الۡعَرۡشِ اسۡتَوٰی ‘দয়াময় (আল্লাহ) আরশে সমুন্নত হয়েছেন’। এ আয়াতটির اسۡتَوٰی শব্দটিকে পরিবর্তন করে استولى বলা। (اسۡتَوٰی) অর্থাৎ আল্লাহর আয়াতের মধ্যে একটি অক্ষর তথা ي এবং و -এর মাঝখানে لام অক্ষর বাড়িয়ে দিয়ে اسۡتَوٰی শব্দটিকে পরিবর্তন করে استولى বলা। জাহমিয়ারা কুরআনের اسۡتَوٰی শব্দটিতে লাম বাড়িয়ে বলত استولى । মাতুরীদিরা اسۡتَوٰی তথা আল্লাহর আরশের উপর সমুন্নত হওয়াকে অস্বীকার করে বলে, أنه مستول على العرش وعلى جميع العالم ‘তিনি আরশ এবং সৃষ্টিজগতের উপর কর্তৃত্ব লাভকারী বা প্রভাব বিস্তারকারী’। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَّ جَآءَ رَبُّکَ ‘এবং তোমার রব আগমন করবেন’। এ আয়াতের মধ্যে একটি শব্দ বাড়িয়ে, وَّ جَآءَ أَمْرُ رَبُّکَ ‘এবং তোমার রবের আদেশ আগমন করবে’ বলা। দ্রষ্টব্য : শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বীয়া, পৃ. ৩৪; কিতাবু উসূলিল ঈমান ফী যূইল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ, পৃ. ৯৮; আবুল উসরা মুহাম্মাদ আল-বাযদূবী, উছূলুদ দ্বীন (কায়রো : মাকতাবাতুল আযহারী, ১৪২৪ হি./২০০৩ খৃ), পৃ. ৪১; শামসুদ্দীন সালাফী আল-আফগানী, আদা’ঊ মাতুরীদিয়াতি লিল আক্বীদাতিত সালাফিয়্যা আল-মাতুরীদিয়া- আল-মাতুরীদিয়া ওয়া মাওক্বিফুহুম মিন তাওহীদিল আসমা’ই ওয়াছ সিফাত, ১ম খণ্ড (ত্বায়েফ : মাকতাবাতুছ ছিদ্দীক, ২য় সংস্করণ, ১৪১৯ হি./ ১৯৯৮ খৃ.), পৃ. ৫১৫; শায়খুল ইমাম মাইমূন ইবনু মুহাম্মাদ আন-নাসাফী, বাহরুল কালাম ; তাহক্বীক : ড. ওলীউদ্দীন মুহাম্মাদ ছালিহ আল-ফুরফূর (মাকতাবাতু দারুল ফুরফূর, ২য় সংস্করণ, ১৪২১ হি.), পৃ. ১১০; ড. সালিহ আল ফাওযান, শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বীয়া; অনুবাদ : আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী (রাজশাহী : ওয়াহীদিয়া ইসলামিয়া লাইব্রেরী, ২০১৫ খৃ.), পৃ. ৩৪; তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরিল কালামিল মান্নান, পৃ. ৯৪।
(খ) অর্থ ও তাৎপর্যগত পরিবর্তন : আর তা হল, আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতসমূহের অর্থকে পরিবর্তন করে ফেলা। যেসব শব্দের মধ্যে আল্লাহর ছিফাতের বর্ণনা এসেছে, সেগুলোর আসল অর্থ পরিবর্তন করে অন্য অর্থ প্রদান করা। যেমন আল্লাহ তা‘আলার اليد (যার অর্থ হাত) শব্দটিকে শক্তি বা অনুগ্রহ দ্বারা ব্যাখ্যা করা। الرحمة (দয়া করা) আল্লাহর ছিফাতসমূহের অন্যতম একটি ছিফাত। কিন্তু বিদ‘আতীরা এটিকে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করে না। তারা বলে রহমত অর্থ নে‘মত প্রদানের ইচ্ছা করা। এমনকি তাদের মতে আল্লাহ তা‘আলা ক্রোধান্বিত হওয়ার অর্থ শাস্তি দেয়ার ইচ্ছা করা। দ্র. শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বীয়া, পৃ. ৩৪; কিতাবু উসূলিল ঈমান ফী যূইল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ, পৃ. ৯৮; আল্লামা কাযী কামালুদ্দীন আহমাদ আল-বায়াযী আল-হানাফী, ইশারাতুল মারাম মিন ইবারাতিল ইমাম, তাহক্বীক : শাইখ ইউসুফ আব্দুর রাযযাক আশ-শাফেঈ এবং ইমাম কাওছারী (পাকিস্তান : যমযম প্রকাশনী, ১৪২৫ হি./২০০৪ খৃ.), পৃ. ১৮৯; আদা’ঊ মাতুরীদিয়াতি লিল আক্বীদাতিত সালাফিয়্যা আল-মাতুরীদিয়া- আল-মাতুরীদিয়া ওয়া মাওক্বিফুহুম মিন তাওহীদিল আসমা’ই ওয়াছ সিফাত, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৫৫।
[১২]. تعطيل (অস্বীকার ও বাতিল) : তা‘তীল হল আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলী অস্বীকার করা। যেমন মু‘তাযিলারা আল্লাহর গুণাবলী অস্বীকার করে। দ্র. শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বীয়া, পৃ. ৩৫; কিতাবু উসূলিল ঈমান ফী যূইল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ, পৃ. ৯৯; ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৮৭।
[১৩]. تكييف (পদ্ধতি ও ধরন বর্ণনা) : আল্লাহর ছিফাতের কাইফিয়াত বর্ণনা করার অর্থ হল উহার জন্য নির্দিষ্ট ধরন ও কায়া নির্ধারণ করা এবং তার জন্য বিশেষ কোন অবস্থা স্থির করা। যে অবয়ব ও আকৃতির উপর গুণাবলী বিদ্যমান রয়েছে, তা নির্দিষ্ট করা। যেমন তাওহীদের এ প্রকারের ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত কিছু লোকের কর্ম, যারা আল্লাহর গুণাবলির অবয়ব দান করছে। তারা বলছে, তাঁর (আল্লাহর) হাতের অবয়ব হল এমন এমন এবং তাঁর আরোহণ হল এই এই আকৃতিতে। নিশ্চয় এটা বাতিল। কেননা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউই তাঁর গুণাবলির অবয়ব সম্পর্কে জ্ঞাত না। আর সৃষ্টজগতের সবাই সে সম্পর্কে অজ্ঞ এবং তা উপলব্ধি করতে অক্ষম। ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯ হি.)-কে যখন اَلرَّحۡمٰنُ عَلَی الۡعَرۡشِ اسۡتَوٰی ‘দয়াময় (আল্লাহ) আরশে সমুন্নত হয়েছেন’। আল্লাহ তা‘আলার এই বাণী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল كيف استوى আল্লাহ তা‘আলা কিভাবে আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন? জবাবে ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯ হি.) বলেন, الاستواء معلوم والكيف مجهول والإيمان به واجب والسؤال عنه بدعة ‘আরশের উপরে আল্লাহর সমুন্নত হওয়া জানা বিষয়। এর পদ্ধতি কেউ অবগত নয়। তার উপর ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব। তবে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা বিদ‘আত। দ্র. মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রহমান আল-খুমাইস, উছূলুদ দ্বীন ইনদাল ইমাম আবূ হানীফা (দারু সমীঈ : আল-মামলাকাতুল ‘আরাবিয়্যাতুস সঊদীয়্যা, ১৪১৬ হি./১৯৯৬ খৃ.), পৃ. ২৪; মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওহাব, উছূলুল ঈমান (রিয়াদ : ওযারাতুশ শুয়ূনিল ইসলামিয়্যা ওয়াল আওক্বাফ ওয়াদ দাওয়াত ওয়াল ইরশাদ, ৪র্থ সংস্করণ, ১৪২০), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৩; ড. ছলিহ ইবনু ফাওযান ইবনু ফাওযান, আল-ইরশাদ ইলা ছহীহিল ই‘তিকাদ, অনুবাদ : শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী ( রাজশাহী : মাকতাবাতুস সুন্নাহ, ২০১৭ খৃ.), পৃ. ২৩৮; শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বীয়া, পৃ. ৩৫।
[১৪]. تمثيل (উদাহরণ, উপমা ও দৃষ্টান্ত) : তা হল আল্লাহর ছিফাতের ক্ষেত্রে সাদৃশ্য ও উপমা নির্ধারণ করা। যেমন কারো একথা বলা যে, আমাদের শ্রবণের মতই আল্লাহর শ্রবণ, আমাদের মুখমণ্ডলের মতই তাঁর মুখমণ্ডল। আমাদের হাতের মতই তাঁর হাত। আল্লাহ তা‘আলা সেসব থেকে পবিত্র ও মহান। মুশাব্বিহারা আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য করে এবং তাকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করে। দ্র. আল-ইরশাদ ইলা ছহীহিল ই‘তিকাদ, পৃ. ২৪৮
[১৫]. নাসাঈ, হা/১৫৭৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৪৩৭৩; ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ, হা/১৭৮৫, সনদ ছহীহ।
[১৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৭২৮৩, ‘ই‘তিছাম’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২; ছহীহ মুসলিম, হা/২২৮৩।