মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৮:৪৫ অপরাহ্ন

তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায়

-আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম*


(শেষ কিস্তি)

পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর নিকট আত্মসমর্পণ করা

‘আত্মসমর্পণ’ বাংলা শব্দ। আবরী হল إستسلام ।[১] শরী‘আতের পরিভাষায় ইসলাম হল- ‘আল্লাহর তাওহীদ তথা তাঁর এককত্বের নিকট আত্মসমর্পণ করা, আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করা এবং শিরক ও তার অনুসারীবৃন্দ হতে বিশুদ্ধ হওয়া’।[২] আর মুসলিম হল আত্মসমর্পণকারী অর্থাৎ যে আল্লাহর তাওহীদের নিকট আত্মসমর্পণ করে, সকল বিষয়ে তাঁর অনুগত হয় এবং শিরক থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে।

ইসলাম আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত জীবন ব্যবস্থা (সূরা আলে-‘ইমরান : ১৯)। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জন্য ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ করেছেন (সূরা আল-মায়িদাহ : ৩)। তিনি তাঁর অভিমুখী হতে এবং তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন (সূরা আয-যুমার : ৫৪)। এমনকি নবী-রাসূলগণকেও বিশ্ব জগতের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ প্রদান করেছিলেন (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৩১-১৩২)। যার কারণে আদম সন্তানদেরকে আত্মসমর্পণকারী না হয়ে মৃত্যুবরণ করতে নিষেধ করেছেন (সূরা আলে-‘ইমরান : ১০২)। কেননা আসমান-যমীনের সকল কিছুই তাঁর অনুগত (সূরা আলে-‘ইমরান : ৮৩)। এ কারণে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায় হল- পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর নিকট আত্মসমর্পণ করা। অহীর বিধানের নিকট আত্মসমর্পণ ছাড়া কখনোই তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

কেননা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর সিদ্ধান্তের বাইরে কোন ব্যক্তি অন্য কোন সিদ্ধান্তের নিকট আত্মসমর্পণ করতে পারে না। কারণ এ দু’টির বাইরে বান্দার সিদ্ধান্ত দেয়া এবং নেয়ার কোন ইখতিয়ার নেই। যে ব্যক্তি এ দু’টি জিনিসের নিকট আত্মসমর্পণ না করে অমান্য করবে সে পথভ্রষ্ট হবে এবং তাওহীদ বিনষ্ট হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ مَا کَانَ لِمُؤۡمِنٍ وَّ لَا مُؤۡمِنَۃٍ اِذَا قَضَی اللّٰہُ وَ رَسُوۡلُہٗۤ اَمۡرًا اَنۡ یَّکُوۡنَ لَہُمُ الۡخِیَرَۃُ مِنۡ اَمۡرِہِمۡ وَ مَنۡ یَّعۡصِ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلًا مُّبِیۡنًا

‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিলে কোন মুমিন পুরুষ বা কোন মুমিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকে না। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করবে, সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে’ (সূরা আল-আহযাব : ৩৬)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَلَا وَ رَبِّکَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ حَتّٰی یُحَکِّمُوۡکَ فِیۡمَا شَجَرَ بَیۡنَہُمۡ ثُمَّ لَا یَجِدُوۡا فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ حَرَجًا مِّمَّا قَضَیۡتَ وَ یُسَلِّمُوۡا تَسۡلِیۡمًا

‘অতএব আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা কখনও মুমিন হতে পারবে না, যে পর্যন্ত আপনাকে তাদের সমস্ত আভ্যন্তরীণ বিরোধের বিচারক হিসাবে মেনে না নিবে, তৎপর আপনি যে বিচার করবেন তা দ্বিধাহীন অন্তরে গ্রহণ না করবে এবং ওটা শান্তভাবে পরিগ্রহণ না করবে’ (সূরা আন-নিসা : ৬৫)।

এছাড়াও পবিত্র কুরআন এবং ছহীহ সুন্নাহ এমন এক মানদণ্ড, যা আঁকড়ে ধরলে আদম সন্তান কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّىْ قَدْ تَرَكْتُ فِيْكُمْ مَا إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ فَلَنْ تَضِلُّوْا أبَدًا كِتَابَ اللهِ وَ سُنَّةَ نَبِيِّهِ صلى الله عليه وسلم

‘হে মানবম-লী! আমি তোমাদের মধ্যে যা ছেড়ে যাচ্ছি, তা যদি তোমরা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাক, তবে কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হল- আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত’।[৩]

নবী-রাসূলগণের আত্মসমর্পণের স্বীকৃতি
আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক নবী-রাসূলকে কেবল তাঁর তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রেরণ করেছিলেন। যারা সকলেই একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলার নিকট আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তাঁরা ছিলেন নিজ নিজ উম্মতের প্রথম আত্মসমর্পণকারী এবং তাঁরাও সে ঘোষণা প্রদান করেছিলেন। ফলে তারা সকলেই আল্লাহর তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নিম্নে নবী-রাসূলগণ কিভাবে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করেছিলেন তার একটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হল-

আল্লাহ তা‘আলা নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আত্মসমর্পণের নিদের্শ প্রদান করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلۡ اِنَّنِیۡ ہَدٰىنِیۡ رَبِّیۡۤ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ دِیۡنًا قِیَمًا مِّلَّۃَ اِبۡرٰہِیۡمَ حَنِیۡفًا وَ مَا کَانَ مِنَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ – قُلۡ اِنَّ صَلَاتِیۡ وَ نُسُکِیۡ وَ مَحۡیَایَ وَ مَمَاتِیۡ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ – لَا شَرِیۡکَ لَہٗ وَ بِذٰلِکَ اُمِرۡتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الۡمُسۡلِمِیۡنَ

‘(হে মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)!) আপনি বলুন, নিঃসন্দেহে আমার প্রতিপালক আমাকে সঠিক ও নির্ভুল পথে পরিচালিত করেছেন, ওটাই সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন এবং ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর অবলম্বিত আদর্শ যা তিনি ঐকান্তিক নিষ্ঠার সাথে গ্রহণ করেছিলেন। আর তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। আপনি বলে দিন, আমার ছালাত, আমার সকল কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সব কিছু সারা জাহানের রব আল্লাহর জন্য। তাঁর কোন শরীক নেই, আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি, আর আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে আমিই হলাম প্রথম’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৬১-১৬৩)। অর্থাৎ আমিই আমার উম্মতের মধ্যে প্রথম তাওহীদের স্বীকৃতি প্রদানকারী, আত্মসমর্পণকারী এবং আল্লাহর অনুগত।[৪]

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলগণই ছিলেন আত্মসমর্পণকারী। কেননা তাদের সকলের দাওয়াত ছিল এককভাবে আল্লাহর ইবাদত করা, যার কোন শরীক নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ مِنۡ رَّسُوۡلٍ اِلَّا نُوۡحِیۡۤ اِلَیۡہِ اَنَّہٗ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّاۤ اَنَا فَاعۡبُدُوۡنِ

‘আমরা আপনার পূর্বে কোন রাসূল প্রেরণ করিনি তাঁর প্রতি এ অহী প্রেরণ ব্যতীত যে, আমি ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই। সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত কর’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ২৫)।

আল্লাহ তা‘আলা নূহ (আলাইহিস সালাম)-কে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি আল্লাহর নির্দেশের ঘোষণা প্রদান করে বলেন, وَ اُمِرۡتُ اَنۡ اَکُوۡنَ مِنَ الۡمُسۡلِمِیۡنَ ‘আর আমাকে আদেশ করা হয়েছে যে, আমি যেন আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত থাকি’ (সূরা ইউনুস : ৭২)। ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ও ই‘য়াকূব (আলাইহিস সালাম) স্বীয় সন্তানদেরকে আত্মসমর্পণকারী হওয়ার জন্য সদুপদেশ প্রদান করেন এবং আত্মসমর্পণকারী না হয়ে মৃত্যুবরণ করতে নিষেধ করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ وَصّٰی بِہَاۤ اِبۡرٰہٖمُ بَنِیۡہِ وَ یَعۡقُوۡبُ یٰبَنِیَّ اِنَّ اللّٰہَ اصۡطَفٰی لَکُمُ الدِّیۡنَ فَلَا تَمُوۡتُنَّ اِلَّا وَ اَنۡتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ 

‘আর ইবরাহীম ও ই‘য়াকূব স্বীয় সন্তানগণকে সদুপদেশ প্রদান করেছিলেন, হে আমার বংশধর! নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য এই দ্বীন মনোনীত করেছেন, অতএব তোমরা আত্মসমর্পণকারী না হয়ে মৃত্যুবরণ কর না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৩২)। ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) বলেছিলেন,

رَبِّ قَدۡ اٰتَیۡتَنِیۡ مِنَ الۡمُلۡکِ وَ عَلَّمۡتَنِیۡ مِنۡ تَاۡوِیۡلِ الۡاَحَادِیۡثِ فَاطِرَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ اَنۡتَ وَلِیّٖ فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ تَوَفَّنِیۡ مُسۡلِمًا وَّ اَلۡحِقۡنِیۡ بِالصّٰلِحِیۡنَ 

‘হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে রাজ্য দান করেছেন এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছেন; হে আকাশম-লী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা! আপনিই ইহলোক ও পরলোকে আমার অভিভাবক, আপনি আমাকে আত্মসমর্পণকারী হিসাবে মৃত্যু দান করুন এবং আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত করুন’ (সূরা ইউসুফ : ১০১)। সুলায়মান (আলাইহিস সালাম) আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তিনি তাঁর আত্মসমর্পণের স্বীকৃতি প্রদান করে বলেন,

وَ اُوۡتِیۡنَا الۡعِلۡمَ مِنۡ قَبۡلِہَا وَ کُنَّا مُسۡلِمِیۡنَ

‘আমাদেরকে ইতিপূর্বে প্রকৃত জ্ঞান দান করা হয়েছে এবং আমরা আত্মসমর্পণ করেছি’ (সূরা আন-নামল : ৪৪)। আল্লাহর নবীগণ সবাই আত্মসমর্পণকারী ছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنَا التَّوۡرٰىۃَ فِیۡہَا ہُدًی وَّ نُوۡرٌ یَحۡکُمُ بِہَا النَّبِیُّوۡنَ الَّذِیۡنَ اَسۡلَمُوۡا

‘নিশ্চয় আমরা তাওরাত অবতীর্ণ করেছি, যাতে হেদায়াত এবং আলো ছিল, আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণকারী নবীগণ তদনুযায়ী ইহূদীদেরকে আদেশ করতেন’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৪৪)।

পবিত্র কুরআনে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর আত্মসমর্পণের বিশদ বর্ণনা উপস্থাপন করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِذۡ قَالَ لَہٗ رَبُّہٗۤ اَسۡلِمۡ قَالَ اَسۡلَمۡتُ لِرَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ‘ইবরাহীমকে তাঁর প্রভু যখন আদেশ করেন তুমি আত্মসমর্পণ কর, তখন তিনি বললেন, আমি জগৎসমূহের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করলাম’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৩১)। ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর এই আত্মনিবেদন আংশিক বা সীমাবদ্ধ ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,اِذۡ جَآءَ رَبَّہٗ بِقَلۡبٍ سَلِیۡمٍ ‘প্রশান্ত আত্মা নিয়েই তিনি তাঁর প্রভুর নিকটে উপস্থিত হয়েছিলেন’ (সূরা আছ-ছাফফাত : ৮৪)।

আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে মূর্তিপূজারী পিতাকে তাওহীদের দাওয়াত দেয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি আল্লাহর নির্দেশের নিকট আত্মসমর্পণ করে পিতাকে দাওয়াত দিলেন (সূরা মারইয়াম : ৪১-৪৫)। বিপরীত দিকে পিতা ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-কে পাথর মেরে মাথা চূর্ণ করে দেয়ার হুমকি দিল এবং পরিবার থেকে বহিস্কার করল (সূরা মারইয়াম : ৪৬)। আল্লাহর নির্দেশে কওমের প্রতি তাওহীদের দাওয়াত দিলেন (সূরা আনকাবূত : ১৬-১৭), মূর্তি ভাঙ্গলেন (সূরা আছ-ছাফফাত : ৯১-৯৩) এবং নমরূদের সঙ্গে বিতর্ক লিপ্ত হলেন (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৫৮)। ফলশ্রুতিতে সমাজ এবং রাষ্ট্র তাঁকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার নির্দেশ জারি করল (সূরা আল-আম্বিয়া : ৬৮)। বস্তুত এই কঠিন মুহূর্তের পরীক্ষায় জয়লাভ করার পুরস্কারস্বরূপ সাথে সাথে আল্লাহর নির্দেশ এল, یٰنَارُ کُوۡنِیۡ بَرۡدًا وَّ سَلٰمًا عَلٰۤی اِبۡرٰہِیۡمَ ‘হে আগুন! ঠাণ্ডা হয়ে যাও এবং ইবরাহীমের উপরে শান্তিদায়ক হয়ে যাও’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ৬৯)।

আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-কে জন্মভূমি বাবেল শহর থেকে ভিন্ন শহর কেন‘আনে হিজরতের নির্দেশ দিলেন, তিনি তা মেনে নিলেন (সূরা আছ-ছাফফাত : ৯৯)। কেন‘আনী জীবনে কঠিন দুর্ভিক্ষে তাড়িত হয়ে জীবিকার সন্ধানে মিসরে হিজরত করেন এবং সেখানকার লম্পট সম্রাট ফেরাঊনের কুদৃষ্টিতে পড়ে স্ত্রী সারা।[৫] মিশরের কঠিন বিপদ থেকে আল্লাহ রক্ষা করার পর পুনরায় কেন‘আনে প্রত্যাবর্তন করার বৎসরাধিককাল পরে প্রথম সন্তান ইসমাঈলের জন্মলাভ করার পর শিশু সন্তান ও তার মা হাজেরাকে মক্কার পাহাড়ী উপত্যকায় নিঃসঙ্গভাবে রেখে আসার এলাহী নির্দেশ লাভ করেন (সূরা ইবরাহীম : ৩৭)।[৬] আল্লাহ তা‘আলা অন্যূন ৮০ বছর বয়সে তাঁকে খাৎনা করার নির্দেশ প্রদান করলেন। আদেশ পাওয়ার সাথে সাথে দেরী না করে নিজেই নিজের খাৎনার কাজ সম্পন্ন করলেন।[৭] আবারও আল্লাহ তা‘আলা তাঁর একমাত্র ১৩/১৪ বছরের শিশু পুত্র ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম)-কে কুরবানী করার নির্দেশ প্রদান করলেন (সূরা আছ-ছফফাত : ১০২)। অতঃপর (পিতা-পুত্র) উভয়ে আত্মসমর্পণ করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে শায়িত করল। তখন আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-কে ডাক দিয়ে বললেন,

وَ نَادَیۡنٰہُ اَنۡ یّٰۤاِبۡرٰہِیۡمُ -قَدۡ صَدَّقۡتَ الرُّءۡیَا اِنَّا کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡمُحۡسِنِیۡنَ

‘হে ইবরাহীম! তুমি তোমার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছ। আমরা এভাবেই সৎকর্মশীলগণের প্রতিদান দিয়ে থাকি’ (সূরা আছ-ছফফাত : ১০৪-১০৫)। ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) এভাবেই আল্লাহর প্রত্যেকটি নির্দেশের প্রতি আত্মসমর্পণ করেছিলেন। যার কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে মুসলিম জাতির নেতা নির্ধারণ করেছেন (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১২৪) এবং তাঁকে অনুকরণীয় আদর্শ হিসাবে উল্লেখ করেছেন (সূরা আল-মুমতাহিনা : ৪)।

ছাহাবীদের আত্মসমর্পণ
নবী-রাসূলগণের ন্যায় ছাহাবীগণও ছিলেন কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর নিকট অনুগত। তারা কুরআন-সুন্নাহকে যেমনভাবে ভালবাসতেন, ঠিক তেমনভাবে এ দু’টির প্রতি পূর্ণ অনুগত ছিলেন। নিম্নে তাদের আত্মসমর্পণের কিছু দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হল-

(ক) ক্বিবলা পরিবর্তনের ঘটনা

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ১৬/১৭ মাস পর্যন্ত বায়তুল মাকদেসের দিকে মুখ করে ছালাত আদায় করেছেন। কা‘বা ঘর তাঁর ক্বিবলা হোক এটাই তাঁর মনের বাসনা ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قَدۡ نَرٰی تَقَلُّبَ وَجۡہِکَ فِی السَّمَآءِ فَلَنُوَلِّیَنَّکَ قِبۡلَۃً تَرۡضٰہَا فَوَلِّ وَجۡہَکَ شَطۡرَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ

‘নিশ্চয় আমরা আকাশের দিকে আপনার মুখম-ল উত্তোলন অবলোকন করেছি। তাই আমরা আপনাকে ঐ ক্বিবলামুখীই করাচ্ছি, যা আপনি কামনা করেন। অতএব আপনি মাসজিদুল হারামের দিকে আপনার মুখমণ্ডল ফিরিয়ে দিন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৪৪)।

আল্লাহর নির্দেশ প্রাপ্তির পর তিনি কা‘বার দিকে মুখ করে প্রথম আছরের ছালাত আদায় করেন। যেসব লোক তাঁর সাথে ছালাত আদায় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন ছাহাবী আনছারদের এক মসজিদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানকার লোকেরা রুকূ অবস্থায় ছিলেন। ঐ ছাহাবী বলেন,

أَشْهَدُ بِاللهِ لَقَدْ صَلَّيْتُ مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قِبَلَ مَكَّةَ فَدَارُوْا كَمَا هُمْ قِبَلَ الْبَيْتِ

‘আল্লাহর শপথ! আমি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে কা‘বার দিকে মুখ করে ছালাত আদায় করেছি। এ কথা শুনামাত্রই ঐসব লোক ঐ অবস্থায়ই কা‘বার দিকে মুখ করেন’।[৮]

আসলে ক্বিবলা পরিবর্তনের নির্দেশের পেছনে মূল কারণটি হল অহীর বিধানের নিকট আত্মসমর্পণ করা। আল্লাহর আদেশকে শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরা। তাঁর নির্দেশকে বিনা বাক্য ব্যয়ে সময় ক্ষেপণ না করে তৎক্ষণাৎ পালন করা। কারণ আমরা তাঁর বান্দা, আমাদের উপর তাঁরই কর্তৃত্ব, তিনি যা বলবেন তা পালন করাই আমাদের কর্তব্য। তাঁর নির্দেশনার মধ্যে আত্মসপর্ণকারীর চিত্র পরিস্ফুটিত হয় এবং কে তাঁর নির্দেশের অস্বীকারকারী তা তিনি অবগত হোন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ مَا جَعَلۡنَا الۡقِبۡلَۃَ الَّتِیۡ کُنۡتَ عَلَیۡہَاۤ اِلَّا لِنَعۡلَمَ مَنۡ یَّتَّبِعُ الرَّسُوۡلَ مِمَّنۡ یَّنۡقَلِبُ عَلٰی عَقِبَیۡہِ

‘আপনি যে ক্বিবলার দিকে ছিলেন, তা আমরা এজন্য নির্ধারণ করেছিলাম যে, কে রাসূলের অনুসরণ করে আর কে তা হতে স্বীয় পদদ্বয়ের গোড়ালী প্রদর্শন করে ফিরে যায় আমরা তা জেনে নেবো’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৪৩)।

(খ) বানী তামীম গোত্রের ঘটনা

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কণ্ঠস্বরের উপর কণ্ঠস্বর উঁচু করা হারাম (সূরা আল-হুজরাত : ২)। ছাহাবীদের এটা জানা ছিল না। কিন্তু যখন তারা তা অবগত হয়েছে, তখন থেকে তারা অহীর বিধানের নিকট আত্মসমর্পণ করেছেন। যেমন,

ইবনু আবি মুলায়কাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, উত্তম দু’ব্যক্তি আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট কণ্ঠস্বর উঁচু করে ধ্বংস হওয়ার দ্বার প্রান্তে উপনীত হয়েছিলেন। যখন বানী তামীম গোত্রের একদল লোক নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসেছিল। তাদের একজন বানী মাজাশ গোত্রের আকরা ইবনু হাবিসকে নির্বাচন করার জন্য প্রস্তাব করল এবং অপরজন অন্যজনের নাম প্রস্তাব করল। নাফি‘ বলেন, এ লোকটির নাম আমার মনে নেই। তখন আবূ বকর ছিদ্দীক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন, আপনার ইচ্ছা হল কেবল আমার বিরোধিতা করা। তিনি বললেন, না, আপনার বিরোধীতা করার ইচ্ছা আমার নেই। এ ব্যাপারটি নিয়ে তাঁদের আওয়াজ উঁচু হয়ে গেল। তখন আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর গলার আওয়াজের উপর নিজেদের গলার আওয়াজ উঁচু করবে না’ শেষ পর্যন্ত। ইবনু যুবাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এত আস্তে কথা বলতেন যে, দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস না করা পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা শুনতে পেতেন না।[৯]

আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাবিত ইবনু ক্বায়স (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে খুঁজে পেলেন না। একজন ছাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি আপনার কাছে তাঁর সংবাদ নিয়ে আসছি। তারপর লোকটি তাঁর কাছে গিয়ে দেখলেন যে, তিনি তাঁর ঘরে মাথা নীচু করে বসে আছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কী অবস্থা? তিনি বললেন, খারাপ। কারণ এই (অধম) তার আওয়াজ নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আওয়াজের চেয়ে উঁচু করে কথা বলত। ফলে তার আমল বরবাদ হয়ে গেছে এবং সে জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। তারপর লোকটি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে ফিরে এসে খবর দিলেন যে, তিনি এমন এমন কথা বলছেন। মূসা বলেন, এরপর লোকটি এক মহাসুসংবাদ নিয়ে তাঁর কাছে ফিরে গেলেন (এবং বললেন) নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বলেছেন, তুমি যাও এবং তাকে বল, তুমি জাহান্নামী নও, বরং তুমি জান্নাতীদের অন্তুর্ভুক্ত।[১০]

(গ) মদ হারাম হওয়ার ঘটনা

চিরাচরিত প্রথানুযায়ী ইসলামের প্রথম যুগেও মদ্যপান স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। ছাহাবীগণও আহারাদীর পর যথারীতি মদ্যপান করতেন এবং ঐ অবস্থায় ছালাত আদায় করতেন।[১১] এমনকি তাদের মধ্যে মদ্যপানের প্রতিযোগিতাও চলত।[১২] কিন্তু যখন আল্লাহ তা‘আলা মদ সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করলেন (সূরা আল-মায়িদাহ : ৯০-৯১), তখন তারা তাদের চিরাচরিত অভ্যাসকে পরিত্যাগ করে অহীর বিধানের নিকট আত্মসমর্পণ করলেন। হাদীছে এসেছে,

আবু সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মদীনায় খুৎবাহ দিতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, হে মানবম-লী! নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা মদের ব্যাপারে বিধান পেশ করবেন। আল্লাহ এ বিষয়ে অচিরেই নির্দেশনা প্রদান করবেন। তাই যার কাছে মদের অবশিষ্ট কিছু আছে, সে যেন তা বিক্রি করে দেয় এবং তা থেকে উপকার লাভ করে। রাবী বলেন, কিছুদিন পরেই তিনি বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ মদকে হারাম করেছেন। অতএব কারো কাছে মদ থাকা অবস্থায় যদি এই আয়াত পৌঁছে, তবে সে যেন তা পান না করে এবং বিক্রি না করে। অতঃপর যাদের কাছে মদ ছিল তারা মদীনার রাস্তার দিকে নিয়ে গেল এবং ঢেলে ফেলল’।[১৩]

আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবু ত্বালহা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বাড়ীতে জনগণকে পানি পান করাচ্ছিলাম। সেদিন তাদের মদ ছিল অত্যন্ত দামী। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন আহ্বানকারীকে নির্দেশ দিলেন যে, তুমি ঘোষণা কর, সাবধান! নিশ্চয় মদ্যপানকে হারাম করা হয়েছে। তখন আবু ত্বালহা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আমাকে বললেন, তুমি বের হও এবং মদ ঢেলে ফেল। তাই আমি বের হলাম এবং মদ ঢেলে ফেললাম। এতে মদীনার রাস্তায় মদের স্রোত প্রবাহিত হল। এ সময় কতিপয় লোক বলল, যাদের পেটে মদ রয়েছে, তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। তখন আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেন, ‘যারা ঈমান আনয়ন করে ও সৎকর্ম করে, এরূপ লোকদের উপর কোন গুনাহ নেই, যা তারা পানাহার করেছে।[১৪]

(ঘ) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মৃত্যুর ঘটনা

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মারা যান তখন ছাহাবীগণ তাঁদের প্রাণপ্রিয় রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিয়োগব্যথা সহ্য করতে পারছিলেন না। অনেকে দিগি¦দিক জ্ঞানহারা হয়ে এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করতে থাকেন। অনেকে জঙ্গলে চলে যান। তারা ধারণা করেছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মারা যাননি। বরং স্বীয় প্রতিপালকের নিকটে গমন করেছেন। যেমন মূসা (আলাইহিস সালাম) নিজ সম্প্রদায় থেকে ৪০ দিন অনুপস্থিত থাকার পর পুনরায় ফিরে এসেছিলেন। যেমনটা ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

وَاللهِ لَيَرْجِعَنَّ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَمَا رَجَعَ مُوْسَى فَلْيَقْطَعَنَّ أَيْدِي رِجَالٍ وَأَرْجُلَهُمْ زَعَمُوْا أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَاتَ

‘আল্লাহর কসম! আল্লাহর রাসূল অবশ্যই ফিরে আসবেন। যেমন মূসা (আলাইহিস সালাম) ফিরে এসেছিলেন। অতঃপর অবশ্যই ঐসব লোকের হাত-পা কেটে দেবেন, যারা ধারণা করছে যে, তিনি মারা গেছেন।[১৫]

অথচ ‘মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন রাসূল মাত্র। তিনিও মারা যাবেন। আল্লাহ কুরআনে তা উল্লেখ করেছেন। ছাহাবীগণ আয়াতটি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। কিন্তু যখন তা শ্রবণ করলেন, তখন তারা পবিত্র কুরআনের নিকট আত্মসমর্পণ করলেন। হাদীছে এসেছে,

‘আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যখন বের হলেন, তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) লোকদের সাথে কথা বলছিলেন। তিনি বললেন, হে ওমর! আপনি বসুন। তিনি বসতে অস্বীকার করলেন। লোকেরা ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট থেকে আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে আগমন করল। অতঃপর আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হামদ ও ছানার পর বললেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইবাদত করতে চায়, সে যেন জেনে নেয়, মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মারা গেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করতে চায়, সে যেন জেনে রাখে আল্লাহ জীবিত, তিনি কখনও মৃত্যুবরণ করবেন না। আল্লাহ বলেন, ‘মুহাম্মাদ একজন রাসূল মাত্র। তাঁর পূর্বে অনেক রাসূল গত হয়েছেন। সুতরাং যদি তিনি মারা যান অথবা নিহত হন, তবে কি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? আর যে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে, সে কখনও আল্লাহর ক্ষতি করতে পারবে না। বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারীদেরকে পুরস্কৃত করবেন’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৪৪)। রাবী বলেন, আল্লাহর শপথ! মানুষ যেন জানতই না আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেছেন। অবশেষে আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আয়াতটি পাঠ করলেন। অতঃপর প্রত্যেকেই আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট থেকে এই আয়াত বুঝতে পারলেন। যে ব্যক্তিই এটি বেশী শুনেছে সেই পাঠ করেছে। বর্ণনাকারী বলেন, সাঈদ ইবনু মুসাইয়াব আমাকে বলেছেন, ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আল্লাহর কসম! আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছাড়া অন্য কারো কাছে এই আয়াত আমি শুনিনি। তখন আমি বুঝতে পারলাম। অবশেষে আমার দুই পা ফসকে গেল এবং মাটির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম, যখন বুঝতে পারলাম যে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মারা গেছেন’।[১৬]

সুধী পাঠক! উপরিউক্ত ঘটনাগুলো প্রমাণ করে আল্লাহর নির্দেশ নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাহাবায়ে কেরাম কিভাবে তার প্রতি আত্মসমর্পণ করেছেন এবং আমল করেছেন। তাঁরা বিন্দুমাত্র বিলম্ব করেননি। তাদের এই দ্বিধাহীন নিঃস্বার্থ আত্মসমর্পণ ইসলামের অনুপম আদর্শকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। অতএব তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ অন্যতম প্রধান শর্ত। ছাহাবায়ে কেরাম এই মূলনীতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বাস্তবায়ন করেছিলেন। তাদের ন্যায় আমাদেরকেও অনুরূপ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর নিকট আত্মসমর্পণ করতে হবে, তাহলে দুনিয়াতে যেমন কল্যাণের অধিকারী হব, আখেরাতেও চিরস্থায়ী কল্যাণ লাভ করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর নিকট আত্মসমর্পণ করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!

* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র : 
[১]. ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৫৪।
[২]. মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব ইবনু আলী আল-ইয়ামানী, আল-ক্বাওলুল মুফীদ ফী আদিল্লাতিত তাওহীদ (বৈরূত : দারু ইবনি হাযম, ১৪২৭ হি./২০০৬ খৃ.), পৃ. ৪৩।
[৩]. হাকিম, হা/৩১৮।
[৪]. জা‘মিঊল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন, ১২তম খণ্ড, পৃ. ২৮৩।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/২২১৭, ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১০০।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৩৬৪, ‘নবীগণ (আলাইহিস সালাম)-এর হাদীছসমূহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৯।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৩৫৬, ‘নবীগণ (আলাইহিস সালাম)-এর হাদীছসমূহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৮।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৭২৫২, ‘খবরে আহাদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১; তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫২।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৮৪৫, ‘কুরআন মাজীদের তাফসীর’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৯।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৮৪৬, ‘কুরআন মাজীদের তাফসীর’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৯।
[১১]. মুস্তাদরাক হাকিম, হা/৭২২০, ইমাম যাহাবী ঢ় স্বীয় ‘তালখীছ’ গ্রন্থে ছহীহ বলেছেন।
[১২]. নাসাঈ, হা/৫৫৪০; মুস্তাদরাক হাকিম, হা/৩১০১; আলবানী (রহ.)-এর মতে, ছহীহ এবং ইমাম যাহাবী (রহ.) স্বীয় ‘তালখীছ’ গ্রন্থে ইমাম বুখারী (রহ.) ও ইমাম মুসলিম (রহ.)-এর শর্তানুসারে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
[১৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৭৮, ‘মুসাক্বাত’ অধ্যায়, ‘মদ বিক্রয় করা হারাম’ অনুচ্ছেদ-১২।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/২৪৬৪, ‘মাযালিম’ অধ্যায়, ‘রাস্তায় মদ ঢেলে ফেলা’ অনুচ্ছেদ-৩১; সূরা আল-মায়িদাহ : ৯৩।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৬৬৭, ‘ছাহাবীগণ (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-এর মর্যাদা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬; আব্দুল মালিক ইবনু হিশাম, ছিরাত ইবনু হিশাম (বৈরূত : দারুল জীল, ১৪১১ হি.), ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৭৫।
[১৬]. ছহীছ বুখারী, হা/৪৪৫৪, ‘মাগাযী’ অধ্যায়, ‘রাসূল ফ-এর অসুস্থতা ও মৃত্যু’ অনুচ্ছেদ-৮৩।




ইসলামে রোগ ও আরোগ্য (২য় কিস্তি) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৮ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
বিদায় হজ্জের ভাষণ : তাৎপর্য ও মূল্যায়ন - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন
আল-কুরআন তেলাওয়াতের আদব - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইবাদতের দাবী - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও তার সমাধান (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
আল্লাহর ভালোবাসা - ড. মুস্তফা মনজুর
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৫ম কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (৮ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৫ম কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির

ফেসবুক পেজ