ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন
-মাইনুল ইসলাম মঈন*
(৪র্থ কিস্তি)
[৩য় কিস্তির পর]
০২. আছরের ছালাত
আছর শব্দটি বিকাল থেকে সূর্যের রং লাল বর্ণ হওয়া পর্যন্ত সময়কে বুঝায়। আর এটা হচ্ছে দিনের শেষ সময়। আছরের ছালাত ওয়াজিব হয় আছরের সময়ের সূত্রপাত হলে । এ ছালাতকেاَلصَّلَاةُ الْوُسْطٰى তথা ‘মধ্যবর্তী ছালাত’ও বলা হয়।
(১) আছরের ছালাতের গুরুত্ব ও ছেড়ে দেয়া হতে সর্তকীকরণ
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, حٰفِظُوۡا عَلَی الصَّلَوٰتِ وَ الصَّلٰوۃِ الۡوُسۡطٰی وَ قُوۡمُوۡا لِلّٰہِ قٰنِتِیۡنَ ‘তোমরা সমস্ত ছালাতের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষ করে মধ্যবর্তী ছালাতের প্রতি। আর তোমরা আল্লাহর সামনে বিনীতভাবে দণ্ডায়মান হও’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৩৮)।
বিশুদ্ধ অভিমতে মধ্যবর্তী ছালাত বলতে আছরের ছালাতকে বুঝানো হয়েছে। কেননা আহযাবের যুদ্ধে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যস্ত থাকায় (সময়মত ছালাত আদায় করতে না পারায়) তিনি বলেছেন,
شَغَلُونَا عَنِ الصَّلاَةِ الوُسْطَى) صلاة العصر( حَتَّى غَابَتِ الشَّمْسُ
‘তারা আমাদেরকে মধ্যবর্তী ছালাত তথা আছরের ছালাত হতে ব্যস্ত রেখেছে। এমনকি সূর্য অস্ত গেছে’।[১]
(২) আছরের ছালাত হেফাযতকারীর ছওয়াব দ্বিগুণ
আবূ বাছরাহ আল গিফারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে ‘মুখাম্মাস’ নামক স্থানে আছরের ছালাত পড়ালেন। অতঃপর বললেন,
إِنَّ هَذِهِ الصَّلَاةَ عُرِضَتْ عَلَى مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ فَضَيَّعُوْهَا فَمَنْ حَافَظَ عَلَيْهَا كَانَ لَهُ أَجْرُهُ مَرَّتَيْنِ وَلَا صَلَاةَ بَعْدَهَا حَتَّى يَطْلُعَ الشَّاهِدُ وَالشَّاهِدُ النَّجْمُ
‘এই ছালাত তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা তাকে নষ্ট করে ফেলেছে। অতএব যে ব্যক্তি আছরের ছালাত সংরক্ষণ করবে তাকে দ্বিগুণ নেকী দেয়া হবে। কেননা শাহেদ তথা তারকা উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তারপর কোন ছালাত নেই’।[২]
(৩) ফজর ও আছর ছালাত আদায়কারীকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না
ওমারা ইবনু রুবাইয়াহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি,
لَنْ يَلِجَ النَّارَ أَحَدٌ صَلَّى قَبْلَ طُلُوْعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوْبِهَا يَعْنِي الْفَجْرَ وَالْعَصْرَ
‘যে ব্যক্তি সূর্য উদিত হওয়ার পূর্বে ফজরের ছালাত আদায় করবে এবং সূর্যাস্তের পূর্বে আছরের ছালাত আদায় করবে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না’।[৩]
(৪) আছর ছালাত ত্যাগ করলে আমল বিনষ্ট হয়
রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, مَنْ تَرَكَ صَلاَةَ العَصْرِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ ‘যে ব্যক্তি আছরের ছালাত ছেড়ে দিল তার আমল বরবাদ হয়ে গেল’।[৪]
(৫) কারো আছর ছালাত ছুটে গেলে তার পরিবার ও মাল-সম্পদ হারিয়ে যাওয়ার নামান্তর
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, الَّذِيْ تَفُوتُهُ صَلَاةُ الْعَصْرِ كَأَنَّمَا وُتِرَ أَهْلَهُ وَمَالَهُ ‘যে ব্যক্তির আছরের ছালাত ছুটে গেল, তার পরিবার ও মাল সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেল’।[৫]
আছর ছালাতের প্রথম ওয়াক্ত
প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার সমপরিমাণ হলে, আছরের প্রথম ওয়াক্ত শুরু হয়। কিন্তু ইমাম আবু হানীফার প্রসিদ্ধ মত হল- যখন প্রত্যেক বস্তুর ছায়া দ্বিগুণ হবে। জমহুরের অভিমতের পক্ষে যোহরের শেষ সময় সংক্রান্ত পূর্বে উল্লেখিত হাদীসসমূহ দ্বারা প্রমাণ দেয়া হয়েছে।[৬]
….وَقْتُ الظُّهْرِ إِذَا زَالَتِ الشَّمْسُ وَكَانَ ظِلُّ الرَّجُلِ كَطُوْلِهِ مَا لَمْ يَحْضُرِ الْعَصْرُ وَوَقْتُ الْعَصْرِ مَا لَمْ تَصْفَرَّ الشَّمْسُ
‘যোহরের সময় হল- যখন সূর্য ঢলে যাবে। আর এর শেষ সময় হল- আছরের সময় হওয়ার আগ পর্যন্ত, যখন কোন ব্যক্তির ছায়া তার সমপরিমাণ হয়। আর আছরের সময় সূর্য হলুদ বর্ণ হওয়া পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে….’।[৭] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, كَانَ يُصَلِّي الْعَصْرَ بِمِثْلِهِ سَوَاءً ‘রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আছর ছালাত আদায় করতেন, যখন বস্তুর ছায়া সমান হত’।[৮] অতঃপর তিনি ثُمَّ صَلَّى الْعَصْرَ حِينَ كَانَ الْفَيْءُ قَدْرَ الشِّرَاكِ وَظِلِّ الرَّجُلِ ‘আছরের ছালাত আদায় করলেন, যখন ছায়া জুতার ফিতা ও কোন ব্যক্তির সমপরিমাণ হল’।[৯]
আছর ছালাতের শেষ সময়
আছরের শেষ সময় সংক্রান্ত হাদীছসমূহে বাহ্যিকভাবে বৈপরীত্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিন ধরণের হাদীছ লক্ষ্য করা যায়। যেমন,
১. কোন বস্তুর ছায়া তার দ্বিগুণ হলে : যেমন, জাবির (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাদীছ, যাতে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) প্রথম দিনে আছরের ছলাত আদায় করলেন, যখন প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার সমপরিমাণ হয় এবং দ্বিতীয় দিন ছালাত আদায় করলেন, যখন কোন বস্তুর ছায়া তার দ্বিগুণ হয়। পরিশেষে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) বললেন, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের সময় হচ্ছে এ দু’সময়ের মধ্যবর্তী’।[১০] এটি ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) -এর অভিমত (কিন্তু তা হচ্ছে ছালাতের উত্তম সময় নির্বাচনের ক্ষেত্রে)। ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ)-এর দু’টি অভিমতের একটি অভিমত এটিই।[১১]
২. সূর্যের রং হলুদ বা বিবর্ণ হলে : আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর মারফূ সূত্রে বর্ণিত হাদীছ,
فَإِذَا صَلَّيْتُمُ الْعَصْرَ فَإِنَّهُ وَقْتٌ إِلَى أَنْ تَصْفَرَّ الشَّمْسُ
‘সূর্যের রং হলুদ বর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আছরের সময় বহাল থাকে’।[১২] এটি ইমাম আহমাদ, আবূ ছাওর ও ইমাম মালিকের অভিমত।[১৩]
অনুরূপভাবে ছলাতের সময়সূচী সম্পর্কে জিজ্ঞেসকারী ব্যক্তির ঘটনায় বর্ণিত আবূ মুসা আল আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাদীছ। সেখানে রয়েছে, রসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রথম দিনে এমন সময় আছরের ছলাত আদায় করলেন যে, সূর্য তখনও উপরে ছিল এবং দ্বিতীয় দিনে দেরি করে পড়লেন। ছলাত শেষে জিজ্ঞেসকারী বলল, তখন সূর্য লাল বর্র্ণ হয়েছিল’।[১৪]
৩. সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত :
আবু হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, مَنْ أَدْرَكَ رَكْعَةً مِنَ العَصْرِ قَبْلَ أَنْ تَغْرُبَ الشَّمْسُ فَقَدْ أَدْرَكَ العَصْرَ ‘যে ব্যক্তি সূর্যাস্তের পূর্বে আছরের এক রাক‘আত ছালাত আদায় করার সুযোগ পেল সে আছরের ছালাত পেল’।[১৫]
ইমাম ইসহাক ও আহলে যাহির এর মতে, আছরের শেষ সময় হচ্ছে সূর্য ডোবার পূর্বে এক রাক‘আত ছলাত আদায় করার সময় পাওয়া পর্যন্ত।[১৬]
এর সমন্বয় সাধনে বলা যায়, জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-এর হাদীছটি উত্তম সময় নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ইবনু আমরের হাদীছটি জায়েয সময়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এর হাদীছটি ওযর ও সমস্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সুতরাং আছরের ছালাতের উত্তম শেষ সময় হচ্ছে- প্রত্যেক বস্তুর মূল ছায়া ব্যতীত তার দ্বিগুণ ছায়া হওয়া থেকে সূর্যের রং হলুদ হওয়া পর্যন্ত। বিনা কারণে এ সময়ের পরে ছালাত আদায় করা নিন্দনীয়। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
تِلْكَ صَلَاةُ الْمُنَافِقِ، يَجْلِسُ يَرْقُبُ الشَّمْسَ حَتَّى إِذَا كَانَتْ بَيْنَ قَرْنَيِ الشَّيْطَانِ، قَامَ فَنَقَرَهَا أَرْبَعًا، لَا يَذْكُرُ اللهَ فِيهَا إِلَّا قَلِيلًا
‘এটা মুনাফিকের ছালাত। যে বসে বসে সূর্যের (ডোবার) অপেক্ষা করতে থাকে। এমনকি যখন সূর্য শয়তানের দু’শিং এর মাঝে এসে যায়, তখন উঠে চারটি ঠোকর মারে। এতে সে কম সময় আল্লাহকে স্মরণ করল।[১৭] কিন্তু যদি একান্ত যরূরী ও সমস্যা থাকে, তখন সূর্য ডোবার পূর্বে এক রাক‘আত ছালাত আদায় করাতে পারলে মাকরূহ হবে না, বরং তা জায়েয। আল্লাহ সর্বাধিক জ্ঞাত।[১৮]
ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মন্তব্য
ছহীহ মুসলিমের টীকায় তিনি বলেন, ‘আমাদের ইমামগণ বলেছেন, আছরের ওয়াক্ত পাঁচ প্রকার। যথা ১. উত্তম ওয়াক্ত ২. মুস্তাহাব ওয়াক্ত ৩. জায়েয ওয়াক্ত কিন্তু মাকরূহ নয় ৪. জায়েয কিন্তু মাকরূহ ওয়াক্ত ৫. ওযরের ওয়াক্ত। আর উত্তম ওয়াক্ত হল প্রথম ওয়াক্ত। মুস্তাহাব ওয়াক্ত হল, ছায়া দ্বিগুণ হওয়া পর্যন্ত। সূর্য হলুদ হওয়া পর্যন্ত বৈধ ওয়াক্ত, মাকরূহ নয়। হলুদ হওয়া থেকে অস্ত যাওয়া পর্যন্ত বৈধ তবে মাকরূহ। আর সফর কিংবা বৃষ্টির কারণে যে ব্যক্তি যোহর ও আছরকে যোহেরের সময়ে একত্রিত করে, তার জন্য যোহরের ওয়াক্তটা ওযরের ওয়াক্ত। এই পাঁচ ওয়াক্তেই আছরের ছালাত আদায় করা যাবে এবং এর কোনটাই ক্বাযা গণ্য হবে না। কিন্তু সূর্য অস্ত গেলে তখন ক্বাযা গণ্য হবে’।[১৯]
উল্লেখ্য, কেউ যদি বাধ্য হয়ে যরূরী কোন কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে সাধারণ সময়ে আছরের ছালাত আদায় করতে না পারে। যেমন রোগীর ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ করা (সূর্য হলুদ হওয়ার আগে ছালাত আদায় করা হয়তো অসম্ভব নয়; কিন্তু কষ্টকর) তাহলে তার জন্য সূর্য ডুবার পূর্ব মুহূর্তে আছরের ছালাত আদায় করা বৈধ। এতে সে ব্যক্তি গুনাহগার হবে না। কেননা এটা যরূরী বা ওযরের সময়। সুতরাং কেউ যদি বাধ্য হয়, তাহলে সূর্য ডুবার পূর্ব পর্যন্ত তার জন্য আছরের সময় থাকবে।
আছরের ছলাত তাড়াতাড়ি পড়াই সুন্নাত
(১) আবূ বারযাহ্ এর হাদীছ:
…وَالعَصْرَ وَأَحَدُنَا يَذْهَبُ إِلَى أَقْصَى المَدِينَةِ، رَجَعَ وَالشَّمْسُ حَيَّةٌ…
‘…. তিনি আছরের ছালাত আদায় করতেন এমন সময় যে, আমাদের কেউ মদীনার শেষ প্রান্তে পৌঁছে আবার ফিরে আসতে পারত, তখনও সূর্য সতেজ থাকত….’।[২০]
(২) আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي العَصْرَ وَالشَّمْسُ مُرْتَفِعَةٌ حَيَّةٌ فَيَذْهَبُ الذَّاهِبُ إِلَى العَوَالِي فَيَأْتِيهِمْ وَالشَّمْسُ مُرْتَفِعَةٌ وَبَعْضُ العَوَالِي مِنَ المَدِيْنَةِ عَلَى أَرْبَعَةِ أَمْيَالٍ أَوْ نَحْوِهِ
‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আছরের ছালাত এমন সময় আদায় করতেন যে, সূর্য তখনও উপরে উজ্জ্বল অবস্থায় বিরাজমান থাকত। ছালাত শেষ করে কোন গমনকারী আওয়ালীর দিকে বের হয়ে তাদের নিকট পৌঁছত এবং তখনও সূর্য উপরে থাকত।[২১] আর আওয়ালীর কোন কোন অংশ ছিল মদীনা হতে চার মাইল দূরত্বে। ৪ মাঈল = ১৬ হাজার হাত বা প্রায় ৭ কিমি।[২২]
(৩) আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كُنَّا نُصَلِّي العَصْرَ ثُمَّ يَذْهَبُ الذَّاهِبُ مِنَّا إِلَى قُبَاءٍ، فَيَأْتِيهِمْ وَالشَّمْسُ مُرْتَفِعَةٌ.
‘আমরা আছরের ছালাত আদায় করতাম অতঃপর আমাদের কোন গমনকারী কুবার দিকে যেত এবং সূর্য যথেষ্ট উপরে থাকতেই সে তাদের নিকট পৌঁছে যেত’।[২৩] মদীনা থেকে কুবা মসজিদের দূরত্ব ৫ কি.মি. তথা ৩.১০ মাইল।
(৪) উসামাহ ইবনু যায়িদ আল-লাইসী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত,
… وَرَأَيْتُهُ يُصَلِّي الْعَصْرَ وَالشَّمْسُ مُرْتَفِعَةٌ بَيْضَاءُ قَبْلَ أَنْ تَدْخُلَهَا الصُّفْرَةُ، فَيَنْصَرِفُ الرَّجُلُ مِنَ الصَّلَاةِ، فَيَأْتِي ذَا الْحُلَيْفَةِ قَبْلَ غُرُوبِ الشَّمْسِ،…
‘…আমি তাঁকে ঐ সময় আছরের ছালাত আদায় করতে দেখেছি যখন সূর্য উপরে উজ্জ্বল বর্ণ অবস্থায় থাকত, তখনো তাতে হলুদ রং আসেনি। কোন ব্যক্তি আছরের ছালাত আদায় করে সূর্য ডুবার পূর্বেই যুলহুলায়ফাহ নামক স্থানে পৌঁছে যেত…’।[২৪]
মদীনা থেকে যুলহুলায়ফার দূরত্ব ৬ মাইল। আছরের ছালাতের পর (উটে) আরাহেী দ্রুত চললে সূর্যাস্তের পূর্বে ছয় মাইল (৯.৬৫ কি.মি.) অতিক্রম করা সম্ভব। হাফেয ইবনু হাজার (রাহিমাহুল্লাহ) এই হাদীছ সম্পর্কে লিখেছেন,
قَالَ النَّوَوِيُّ فِي الْحَدِيثِ الْمُبَادَرَةُ بِصَلَاةِ الْعَصْرِ فِي أَوَّلِ وَقْتِهَا لِأَنَّهُ لَا يُمْكِنُ أَنْ يَذْهَبَ بَعْدَ صَلَاةِ الْعَصْرِ مِيلَيْنِ أَوْ أَكْثَرَ وَالشَّمْسُ لَمْ تَتَغَيَّرْ فَفِيهِ دَلِيلٌ لِلْجُمْهُورِ فِي أَنَّ أَوَّلَ وَقْتِ الْعَصْرِ مَصِيرُ ظِلِّ كُلِّ شَيْءٍ مِثْلَهُ خِلَافًا لِأَبِي حَنِيفَةَ
‘ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, হাদীছটি দ্বারা আছরের ছালাত প্রথম ওয়াক্তে আদায়ের দাবি করে। অন্যথা আছরের ছলাতের পরে এটা অসম্ভব যে, দুই মাইল বা তার থেকে বেশি চলার পরেও সূর্যের (রং) পরিবর্তন হবে না। এ থেকেই অধিকাংশ ইমাম ও মুহাদ্দিছের দলীল রয়েছে যে, আছরের ছালাতের আওয়াল ওয়াক্ত হল, প্রত্যেক বস্তুর ছায়া সমপরিমাণ হলে। এক্ষেত্রে কেবল আবু হানীফার বিরোধিতা আছে’।[২৫] ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,
الْمُبَادَرَةُ لِصَلَاةِ الْعَصْرِ أَوَّلَ وَقْتِهَا لِأَنَّهُ لَا يُمْكِنُ أَنْ يَذْهَبَ بَعْدَ صَلَاةِ الْعَصْرِ مِيلَيْنِ وَثَلَاثَةً وَالشَّمْسُ بَعْدُ لَمْ تَتَغَيَّرْ بِصُفْرَةٍ وَنَحْوِهَا إِلَّا إِذَا صَلَّى الْعَصْرَ حِينَ صَارَ ظِلُّ الشَّيْءِ مِثْلَهُ وَلَا يَكَادُ يَحْصُلُ هَذَا إِلَّا فِي الْأَيَّامِ الطَّوِيلَةِ
‘এটা অসম্ভব যে, আছরের ছালাতের পর দুই বা তিন মাইল চলার পর সূর্যের (রং) হলুদ হয়ে পরিবর্তিত হবে না, তবে যদি আছরের ছালাত তখন পড়া হয় যখন প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার সমান হয়’।[২৬]
(৫) রাফে‘ ইবনু খাদীজ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كُنَّا نُصَلِّي مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ العَصْرَ فَنَنْحَرُ جَزُوْرًا فَتُقْسَمُ عَشْرَ قِسَمٍ فَنَأْكُلُ لَحْمًا نَضِيْجًا قَبْلَ أَنْ تَغْرُبَ الشَّمْسُ
‘আমরা রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর সাথে আছরের ছালাত আদায় করতাম। অতঃপর উট যব্হ করে তা দশ ভাগ করতাম। এরপর সূর্য ডোবার পূর্বে আমরা তা ভূনা করে গোশত খেতাম’।[২৭] মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (রাহিমাহুল্লাহ) লিখেছেন,
قَالَ ابْنُ الْهُمَامِ فِي شَرْحِ الْهِدَايَةِ: إِذَا صَلَّى الْعَصْرَ قَبْلَ تَغَيُّرِ الشَّمْسِ أَمْكَنَ فِي الْبَاقِي إِلَى الْغُرُوبِ مِثْلَ هَذَا الْعَمَلِ، وَمَنْ شَاهَدَ الْمَهَرَةَ مِنَ الطَّبَّاخِينَ مَعَ الرُّؤَسَاءِ لَمْ يَسْتَبْعِدْ ذَلِكَ
‘ইবনুল হুমাম (রাহিমাহুল্লাহ) হানাফী ফিক্হ ‘আল-হিদায়া’র ব্যাখ্যায় (ফাৎহুল কাদীরে) লিখেছেন, যখন আছরের ছালাত সূর্যের রং (তেজ) পরিবর্তন করার পূবে আদায় করা হয়, তখন এ ধরনের কাজ মাগরিবের পূর্বে সম্পন্ন করা যাবে। রান্নার সরঞ্জামাদির উপস্থিতিতে দক্ষ বাবুর্চিকে যে ব্যক্তি এ কাজ করতে দেখেছে, সে এটা অসম্ভব মনে করবে না’।[২৮]
(৬) আয়িশাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلَّى الْعَصْرَ وَالشَّمْسُ فِىْ حُجْرَتِهَا لَمْ يَظْهَرِ الْفَىْءُ مِنْ حُجْرَتِهَا
‘আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন সময় আছরের ছালাত আদায় করেছেন যে, সূর্যরশ্মি তখনো তাঁর ঘরের মধ্যে ছিল, আর ছায়া তখনো তার ঘর হতে বেরিয়ে পড়েনি’।[২৯] উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু হাজার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,
وَالْمُسْتَفَادُ مِنْ هَذَا الْحَدِيثِ تَعْجِيلُ صَلَاةِ الْعَصْرِ فِي أَوَّلِ وَقْتِهَا وَهَذَا هُوَ الَّذِي فَهِمَتْهُ عَائِشَةُ
‘এই হাদীছ থেকে অর্জিত ফায়দা হলে, আছরের ছালাত তাড়াতাড়ি প্রথম ওয়াক্তে আদায় করতে হবে। আর এটাই অয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর বুঝ’।[৩০] অতঃপর তিনি লিখেছেন,
وَشَذَّ الطَّحَاوِيّ فَقَالَ لَا دَلَالَةَ فِيهِ عَلَى التَّعْجِيلِ لِاحْتِمَالِ أَنَّ الْحُجْرَةَ كَانَتْ قَصِيرَةَ الْجِدَارِ فَلَمْ تَكُنِ الشَّمْسُ تَحْتَجِبُ عَنْهَا إِلَّا بِقُرْبِ غُرُوبِهَا فَيَدُلُّ عَلَى التَّأْخِيرِ لَا عَلَى التَّعْجِيلِ وَتُعُقِّبَ بِأَنَّ الَّذِي ذَكَرَهُ مِنَ الِاحْتِمَالِ إِنَّمَا يُتَصَوَّرُ مَعَ اتِّسَاعِ الْحُجْرَةِ وَقَدْ عُرِفَ بِالِاسْتِفَاضَةِ وَالْمُشَاهَدَةِ أَنَّ حُجَرَ أَزْوَاجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمْ تَكُنْ مُتَّسِعَةً وَلَا يَكُونُ ضَوْءُ الشَّمْسِ بَاقِيًا فِي قَعْرِ الْحُجْرَةِ الصَّغِيرَةِ إِلَّا وَالشَّمْسُ قَائِمَةٌ مُرْتَفِعَةٌ وَإِلَّا مَتَى مَالَتْ جِدًّا ارْتَفَعَ ضَوْؤُهَا عَنْ قَاعِ الْحُجْرَةِ وَلَوْ كَانَتِ الْجُدُرُ قَصِيرَةً قَالَ النَّوَوِيُّ كَانَتِ الْحُجْرَةُ ضَيِّقَةَ الْعَرْصَةِ قَصِيرَةَ الْجِدَارِ بِحَيْثُ كَانَ طُولُ جِدَارِهَا أَقَلَّ مِنْ مَسَافَةِ الْعَرْصَةِ بِشَيْءٍ يَسِيرٍ فَإِذَا صَارَ ظِلُّ الْجِدَارِ مِثْلَهُ كَانَتِ الشَّمْسُ بَعْدُ فِي أَوَاخِرِ الْعَرْصَةِ اه وَكَأَنَّ الْمُؤَلِّفَ لَمَّا لَمْ يَقَعْ لَهُ حَدِيثٌ عَلَى شَرْطِهِ فِي تَعْيِينِ أَوَّلِ وَقْتِ الْعَصْرِ وَهُوَ مَصِيرُ ظِلِّ كُلِّ شَيْءٍ مِثْلَهُ اسْتَغْنَى بِهَذَا الْحَدِيثِ الدَّالِّ عَلَى ذَلِكَ بِطَرِيقِ الِاسْتِنْبَاطِ وَقَدْ أَخْرَجَ مُسْلِمٌ عِدَّةَ أَحَادِيثَ مُصَرَّحَةً بِالْمَقْصُودِ وَلَمْ يُنْقَلْ عَنْ أَحَدٍ مِنْ أَهْلِ الْعِلْمِ مُخَالَفَةٌ فِي ذَلِكَ إِلَّا عَنْ أَبِي حَنِيفَةَ فَالْمَشْهُورُ عَنْهُ أَنَّهُ قَالَ أَوَّلُ وَقْتِ الْعَصْرِ مَصِيرُ ظِلِّ كُلِّ شَيْءٍ مِثْلَيْهِ بِالتَّثْنِيَةِ قَالَ الْقُرْطُبِيُّ خَالَفَهُ النَّاسُ كُلُّهُمْ فِي ذَلِكَ حَتَّى أَصْحَابُهُ يَعْنِي الْآخِذِينَ عَنْهُ وَإِلَّا فَقَدِ انْتَصَرَ لَهُ جَمَاعَةٌ مِمَّنْ جَاءَ بَعْدَهُمْ فَقَالُوا ثَبَتَ الْأَمْرُ بِالْإِبْرَادِ وَلَا يَحْصُلُ إِلَّا بَعْدَ ذَهَابِ اشْتِدَادِ الْحَرِّ وَلَا يَذْهَبُ فِي تِلْكَ الْبِلَادِ إِلَّا بَعْدَ أَنْ يَصِيرَ ظِلُّ الشَّيْءِ مِثْلَيْهِ فَيَكُونُ أَوَّلُ وَقْتِ الْعَصْرِ مَصِيرَ الظِّلِّ مِثْلَيْهِ وَحِكَايَةُ مِثْلِ هَذَا تُغْنِي عَنْ رده
‘কিন্তু তাহাবী’র (হানাফী (রাহিমাহুল্লাহ)) বিচ্যুত মত হলো, তিনি বলেছেন, আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর হাদীছ দ্বারা আছরের ছালাত তাড়াতাড়ি আদায় করার দলীল নেই। কেননা কক্ষ খুবই নীচু ছিল। ফলে সূর্য (আলো) তখনও ঘর থেকে বের হত না যতক্ষণ না তার প্রখরতা কমে গিয়ে সূর্যাস্তের নিকটবর্তী হত। অতএব দেরিতে (আছর) আদায় করার দলীল হয়, তাড়াতাড়ি নয়।[৩১] এর জবাব হল, তাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর দাবির সম্ভবনাটা তখন হতে পারে, যখন কক্ষ প্রশস্ত হয়। অথচ আমরা প্রসিদ্ধতা ও অবলোকনের মাধ্যমে জানতে পারি যে, নবী করীম (আলাইহিস সালাম)-এর স্ত্রীর ঘরটি প্রশস্ত ছিল না, বরং সংকীর্ণ ও ছোট ছিল। ফলে ছোট ঘরে ততক্ষণ পর্যন্ত আলো থাকবে যতক্ষণ সূর্য খুব উঁচুতে অবস্থান করে। এরূপ না হলে তখন আলো থাকবে না যখন সূর্য একেবারেই ঢলে যাবে, যদিও দেওয়াল খাটো হয়। ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) লিখেছেন, ঘরের চতুরের পরিধি ছিল সংকীর্ণ, দেওয়াল ছিল নিকটবর্তী, উচ্চতার দিক থেকে দেওয়ালের প্রশস্ততা কিছু কম ছিল। ফলে যখন ছায়া দেওয়ালের সমান হত, তখন সূর্যের আলো দেওয়ালের শেষাংশে চলে যেত। সম্ভবত আছরের ওয়াক্ত ছায়া সমপরিমাণ হলে শুরু হয়- এ সম্পর্কে ইমাম বুখারী, তার শর্তানুসারে কোন হাদীছ না পাওয়ার দরুন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর হাদীছ দ্বারা মাসআলা উদঘাটন করেছেন। আর ইমাম মুসলিম এ সম্পর্কে কিছু সুস্পষ্ট হাদীছ বর্ণনা করেছেন। কোন আলেম থেকে এর বিরাধেী বক্তব্য নেই। তবে ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে প্রসিদ্ধ উক্তি রয়েছে যে, আছরের ওয়াক্ত ছায়া দ্বিগুণ হওয়ার পর শুরু হয়। ইমাম কুরতুবী বলেছেন, সমস্ত মানুষ (আলেমগণ) তাঁর বিরোধিতা করেছেন, অর্থাৎ তাদের নিকট আছরের ওয়াক্ত এক ছায়া থেকে শুরু হয়ে যায়। এমনকি ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ)- এর দুই শিষ্যও তাঁর বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু ইমাম আবু হানীফার পরবর্তী অনুসারীরা তার পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে বলেছেন, ইরাদ বা ঠাণ্ডায় ছালাত আদায় প্রমাণিত। আর কঠিন তাপ দূর না হওয়া পর্যন্ত ঠাণ্ডা হবে না এবং আরব দেশগুলোতে বস্তুর ছায়া দ্বিগুণ না হওয়া পর্যন্ত তাপ দূর হয় না। অতএব প্রমাণিত হল, বস্তুর ছায়া দ্বিগুণ হলে আছরের ছালাতের আওয়াল ওয়াক্ত শুরু হয়। তবে এ ধরনের আলোচনার জবাব নিস্প্রয়াজেন’।[৩২]
(৭) আলা ইবনু আব্দুর রহমান (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত,
أَنَّهُ دَخَلَ عَلَى أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ فِىْ دَارِهِ بِالْبَصْرَةِ حِيْنَ انْصَرَفَ مِنَ الظُّهْرِ وَدَارُهُ بِجَنْبِ الْمَسْجِدِ فَلَمَّا دَخَلْنَا عَلَيْهِ قَالَ أَصَلَّيْتُمُ الْعَصْرَ فَقُلْنَا لَهُ إِنَّمَا انْصَرَفْنَا السَّاعَةَ مِنَ الظُّهْرِ قَالَ فَصَلُّوا الْعَصْرَ فَقُمْنَا فَصَلَّيْنَا فَلَمَّا انْصَرَفْنَا قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ تِلْكَ صَلاَةُ الْمُنَافِقِ يَجْلِسُ يَرْقُبُ الشَّمْسَ حَتَّى إِذَا كَانَتْ بَيْنَ قَرْنَىِ الشَّيْطَانِ قَامَ فَنَقَرَهَا أَرْبَعًا لاَ يَذْكُرُ اللهَ فِيْهَا إِلاَّ قَلِيْلاً
‘তিনি একদিন আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বসরাস্থ বাড়ীতে গেলেন। আর বাড়ীটি মসজিদের পাশেই অবস্থিত ছিল। তিনি (আলা ইবনু আব্দুর রহমান) তখন সবেমাত্র যোহরের ছালাত আদায় করছেন। আলা ইবনু আব্দুর রহমান বলেন, আমরা তাঁর (আনাস ইবনু মালিকের) কাছে গেলে তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি আছরের ছালাত আদায় করছ? আমরা জবাবে তাকে বললাম, আমরা এই মাত্র যোহরের ছালাত আদায় করে আসলাম। এ কথা শুনে তিনি বললেন, যাও আছরের ছালাত আদায় করে আসো। এরপর আমরা গিয়ে আছরের ছালাত আদায় করে তার কাছে ফিরে আসলে তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেনঃ ঐ ছালাত হল মুনাফিকের ছালাত যে বসে বসে সূর্যের প্রতি তাকাতে থাকে আর যখন তা অস্তপ্রায় হয়ে যায়, তখন উঠে গিয়ে চারবার ঠোকর মেরে আসে। এভাবে সে আল্লাহকে কমই স্মরণ করতে পারে’।[৩৩]
উক্ত হাদীছে মুনাফিকদের তিনটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। যথা :
(ক) ছালাতের ওয়াক্ত হওয়া সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করা।
(খ) সূর্য হলুদ হওয়ার অপেক্ষা করা এবং
(গ) ক্ষেত্রবিশেষে যখন সূর্য শয়তানের দুই শিঙের মধ্যস্থলে যায়’ বা সূর্যাস্তের কাছাকাছি সময়ে পৌঁছে যায়, তখন চার রাক‘আত ছালাত পড়ে।
আছরের ছালাতের ক্ষেত্রে উক্ত তিনটি বৈশিষ্ট্যের যে কোন একটি ইচ্ছাকৃত স্থায়ীভাবে হলে সেটাকে মুনাফিকের একটি বৈশিষ্ট্য বলা যাবে।
মেঘাচ্ছন্ন দিনে আছরের ছালাত তাড়াতাড়ি আদায় করার গুরুত্ব
আবূ মালীহ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা মেঘলা দিনে কোন এক যুদ্ধে বুরাইদার সঙ্গে ছিলাম। বুরাইদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, তোমরা তাড়াতাড়ি আছরের ছালাত পড়ে নাও। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, مَنْ تَرَكَ صَلاَةَ العَصْرِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ ‘যে ব্যক্তি আছরের ছালাত ছেড়ে দেয় তার আমল বিনষ্ট হয়ে যায়’।[৩৪]
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
* এম.ফিল গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; শিক্ষক, মহব্বতপুর দারুল উলূম আলিম মাদরাসা, মোহনপুর, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র:-
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/২৯৩১; ছহীহ মুসলিম, হা/৬২৭।
[২]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৩০।
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৩৪
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫৩; নাসাঈ, হা/৪৭৪।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫২; ছহীহ মুসলিম, হা/৬২৬।
[৬]. যাওয়াহিবুল ইকলিল, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩২; মুগনিল মুহতাজ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২১; আল-মুগনী, ১ম খ-,পৃ. ৩৭৫; ফাৎহুল কাদীর, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯৫।
[৭]. ছহীহ মুসলিম ৬১২।
[৮] ছহীহ মুসলিম, হা/৬২১।
[৯]. নাসাঈ, হা/৫২৪; সনদ ছহীহ, ইরওয়াউল গালীল, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৭০।
[১০]. নাসাঈ, হা/৫১৩, সনদ ছহীহ।
[১১]. বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৬, আল-উম্ম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৩।
[১২]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬১২।
[১৩]. বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৬; আল-মুগনী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৭৬।
[১৪]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬১৪; আবূ দাঊদ, হা/৩৯৫; বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৬; আল-মুগনী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৭৬; আল আওসাত্ব (২/৩৩১) এ মর্মে ছয়টি মতামত রয়েছে।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৯; ছহীহ মুসলিম, হা/৬০৮।
[১৬]. বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৬; আওসাত্ব, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৩২; আল মুহাল্লা।
[১৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬২২; আবূ দাঊদ, হা/৪০৯; তিরমিযী, হা/১৬০; নাসাঈ, হা/৫১১।
[১৮]. ছহীহ ফিকহুস সুন্নাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৪০।
[১৯]. ফিকহুস সুন্নাহ, বাংলা, পৃ. ১০০।
[২০]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪১।
[২১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫০; ছহীহ মুসলিম, হা/৬২১।
[২২]. স্বালাতে মুবাশ্শির, পৃ. ৭১।
[২৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫১।
[২৪]. আবূ দাঊদ, হা/৩৯৪।
[২৫]. হাফেয ইবুন হাজার, ফাৎহুল বারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৯।
[২৬]. ইমাম নববী, শারহে মুসলিম, ৫ম খণ্ড, পৃ. ১২২।
[২৭]. ছহীহ বুখারী, হা/২৪৮৫; ছহীহ মুসলিম, হা/৬২৫।
[২৮]. মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী, মিরকাতুল মাফাতীহ শরহু মিশকাতুল মাছাবীহ, ২য় খ-, পৃ. ৫৩৭, হা/৬১৫-এর ব্যাখ্যা।
[২৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৪৫।
[৩০]. ফাৎহুল বারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৫।
[৩১]. তাহাবী (ইফা), হা/১০৫৮-এর পরবর্তী মন্তব্য।
[৩২]. ফাৎহুল বারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৫, হা/৫৪৬-এর ব্যাখ্যা।
[৩৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬২২।
[৩৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫৩; নাসাঈ, হা/৪৭৪।