সালাফী মানহাজের মূলনীতিসমূহ
-আব্দুল গাফফার মাদানী*
(৩য় কিস্তি)
ভ্রান্ত ফের্কাসমূহের দৃষ্টিতে ঈমান
খারেজীগণ তিনটি বিষয়কেই (অর্থাৎ হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়ন) ঈমানের মূল হিসাবে গণ্য করেন, সেকারণে কাবীরা গোনাহগার ব্যক্তি তাদের মতে কাফের ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী।
মুরজিয়াদের বারোটি উপদলের মধ্যে কাররামিয়াগণ বিশ্বাস ও আমল ছাড়াই কেবল মুখের ‘স্বীকৃতি’-কেই ঈমানের জন্য যথেষ্ট মনে করেন। আর সাধারণ মুরজিয়াগণ ‘বিশ্বাস ও স্বীকৃতি’-কে ঈমান বলে থাকেন।[১]
ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) ও কিছু সংখ্যক ফক্বীহ ‘আমল’-কে ঈমানের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করেননি; বরং ‘ঈমানের বাস্তব পদ্ধতি’ (شرائع الإيمان) বলে মনে করেন।
কুরআন-সুন্নাহ থেকে ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধির দলীল
কুরআন-হাদীছের বিভিন্ন দলীল দ্বারা সাব্যস্ত হয় যে, ঈমান বাড়ে ও কমে। কুরআন থেকে দলীল, মহান আল্লাহ বলেন,
اَلَّذِیۡنَ قَالَ لَہُمُ النَّاسُ اِنَّ النَّاسَ قَدۡ جَمَعُوۡا لَکُمۡ فَاخۡشَوۡہُمۡ فَزَادَہُمۡ اِیۡمَانًا ٭ۖ وَّ قَالُوۡا حَسۡبُنَا اللّٰہُ وَ نِعۡمَ الۡوَکِیۡلُ.
‘যাদেরকে লোকেরা বলেছিল, নিশ্চয় তোমাদের বিরুদ্ধে লোকজন সমবেত হয়েছে, অতএব তোমরা তাদেরকে ভয় কর। এতে তাদের বিশ্বাস আরো বৃদ্ধি হয়েছিল এবং তারা বলেছিল, আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক’ (সূরা আলে ইমরান : ১৭৩)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘নিশ্চয় মুমিনরা এরূপ যে, যখন তাদের সামনে আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তরসমূহ ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে, আর যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন সেই আয়াতসমূহ তাদের ঈমানকে বৃদ্ধি করে দেয়। আর তারা তাদের প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে’ (সূরা আনফাল : ২)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,
وَ اِذَا مَاۤ اُنۡزِلَتۡ سُوۡرَۃٌ فَمِنۡہُمۡ مَّنۡ یَّقُوۡلُ اَیُّکُمۡ زَادَتۡہُ ہٰذِہٖۤ اِیۡمَانًا ۚ فَاَمَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا فَزَادَتۡہُمۡ اِیۡمَانًا وَّ ہُمۡ یَسۡتَبۡشِرُوۡنَ.
‘আর যখন কোন সূরা অবতীর্ণ হয় তখন তাদের মধ্যে কিছু লোক বলে, তোমাদের মধ্যে এই সূরা কার ঈমান বৃদ্ধি করল? অনন্তর যেসব লোক ঈমান এনেছে, এই সূরা তাদের ঈমানকে বর্ধিত করেছে এবং তারাই আনন্দ লাভ করেছে’ (সূরা আত-তাওবা : ১২৪)।
হাফেয ইবনে কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ আয়াতটিই সর্বাধিক বড় দলীল যে, ঈমান বাড়ে এবং কমে। আর এটিই হচ্ছে অধিকাংশ উত্তরসূরী ও পূর্বসূরী বিদ্বান এবং ওলামা ও আইম্মায়ে কেরামর অভিমত।[২]
হেদায়াত বৃদ্ধি : হেদায়াত হচ্ছে ঈমান। মহান আল্লাহ বলেন,
وَ یَزِیۡدُ اللّٰہُ الَّذِیۡنَ اہۡتَدَوۡا ہُدًی ؕ وَ الۡبٰقِیٰتُ الصّٰلِحٰتُ خَیۡرٌ عِنۡدَ رَبِّکَ ثَوَابًا وَّ خَیۡرٌ مَّرَدًّا.
‘আর যারা সৎ পথে চলে আল্লাহ তাদেরকে অধিক হেদায়াত দান করেন এবং স্থায়ী সৎকর্ম আপনার প্রতিপালকের পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং প্রতিদান হিসাবেও শ্রেষ্ঠ’ (সূরা মারিয়াম : ৭৬)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, وَ الَّذِیۡنَ اہۡتَدَوۡا زَادَہُمۡ ہُدًی وَّ اٰتٰہُمۡ تَقۡوٰىہُمۡ ‘যারা সৎপথ অবলম্বন করে আল্লাহ তাদের হেদায়াত বৃদ্ধি করেন এবং তাদেরকে তাক্বওয়া দান করেন’ (সূরা মুহাম্মাদ : ১৭)।
আছহাফে কাহ্ফ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, اِنَّہُمۡ فِتۡیَۃٌ اٰمَنُوۡا بِرَبِّہِمۡ وَ زِدۡنٰہُمۡ ہُدًی ‘তারা ছিল কয়েকজন যুবক, তাঁরা তাঁদের প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমরা তাদের সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেছিলাম’ (সূরা আল-কাহফ : ১৩)। এ আয়াতগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, ঈমান বাড়ে ও কমে।[৩]
ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধির প্রমাণে হাদীছ
ঈমান বাড়ে ও কমে এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বহু প্রমাণ রয়েছে। ইতিপূর্বে আমরা কুরআনের দলীলগুলো উপস্থাপন করেছি। নি¤েœ হাদীছ থেকে দলীল পেশ করা হল।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ ঃ قَالَ النَّبِىُّ ﷺ لَا يَزْنِى الزَّانِىْ حِيْنَ يَزْنِى وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلَا يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِيْنَ يَشْرَبُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلَا يَسْرِقُ حِيْنَ يَسْرِقُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلَا يَنْتَهِبُ نُهْبَةً يَرْفَعُ النَّاسُ إِلَيْهِ فِيْهَا أَبْصَارَهُمْ حِيْنَ يَنْتَهِبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ.
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, কোন ব্যভিচারী মুমিন অবস্থায় ব্যভিচার করে না এবং কোন মদ্যপায়ী মুমিন অবস্থায় মদ পান করে না। কোন চোর মুমিন অবস্থায় চুরি করে না। কোন লুটেরা লুটতরাজ করে না মুমিন অবস্থায়, যখন সে লুটতরাজ করে তখন তার প্রতি লোকজন চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে।[৪]
হাদীছটি থেকে প্রমাণিত হয় যে, ঈমান কমে ও বাড়ে। কোন মুমিন ব্যক্তি যখন পাপে পতিত হয় তখন তার ঈমান কমে যায়। আবার যখন সে তওবা করে পাপ থেকে ফিরে আসে, তখন তার ঈমান বাড়ে। আব্দুল্লাহ বিন ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমার পিতা থেকে শুনেছি তাঁকে ইরজা (মুরজিয়া, যারা ঈমানকে আমলের অন্তর্ভুক্ত মনে করে না) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আমরা ঈমান সম্পর্কে বলব যে, কথা ও আমলের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা, সেটা কমে ও বাড়ে। যখন (কোন মুমিন ব্যক্তি) যেনা করে ও মদ পান করে তখন তার ঈমান কমে যায়।[৫]
মোটকথা, কোন মুমিন ব্যক্তি বড় পাপ করলে তার ঈমান কমে যায়। তবে সে কাফের হয়ে যায় না। যেমন খারিজীরা এরূপ পাপে পতিত হওয়ার কারণে (মুসলিম ব্যক্তিদের) কাফের ধারণা করে থাকে।[৬]
উল্লেখ্য যে, কোন মুমিন ব্যক্তি কাবীরা গোনাহ করলে (বড় শিরক ব্যতীত) এবং তওবা ছাড়া মারা গেলে সেটা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি ইচ্ছা করলে তার পাপ পরিমাণ শাস্তি দিয়ে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।[৭]
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ ঃ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ اَلْإِيْمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُوْنَ أَوْ بِضْعٌ وَسِتُّوْنَ شُعْبَةً فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الأَذَى عَنِ الطَّرِيْقِ وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الْإِيْمَانِ.
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ঈমানের সত্তর অথবা ষাটের অধিক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোত্তম শাখা হল তাওহীদের ঘোষণা এ মর্মে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মা‘বূদ নেই। আর সর্বনি¤œ হল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করা। আর লজ্জাও ঈমানের একটি শাখা।[৮]
অতএব বুঝা যাচ্ছে ঈমানের সর্বোচ্চ ও সর্বনি¤œ শাখা রয়েছে। এ হাদীছ প্রমাণ করে যে, ঈমান বাড়ে এবং কমে। হাদীছটি থেকে স্পষ্ট আরো বুঝা যায় যে, ঈমানের একটি অঙ্গ অপর অঙ্গ থেকে ভিন্ন হয়। আরো জানা যায় যে, মানুষ ঈমানের দিক দিয়ে অন্যের থেকে অনেক উপরে হতে পারে। অতএব যে ব্যক্তি ধারণা করে যে, ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না সে তার জ্ঞান ও শরী‘আতের দলীলের বিরোধিতা করে।[৯]
عَنْ أَنَسٍ ঃ عَنِ النَّبِىِّ ﷺ قَالَ يَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَفِىْ قَلْبِهِ وَزْنُ شَعِيْرَةٍ مِنْ خَيْرٍ، وَيَخْرُجُ مِنَ النَّارِ، مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَفِىْ قَلْبِهِ وَزْنُ بُرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ، وَيَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَفِىْ قَلْبِهِ وَزْنُ ذَرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ.
আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ﷺ) বলেন, যে ব্যক্তি ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলবে এবং তার অন্তরে একটি যব পরিমাণ পুণ্যও বিদ্যমান থাকবে, তাকে জাহান্নাম হতে বের করা হবে। যে ব্যক্তি ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলবে এবং তার অন্তরে একটি গম পরিমাণও পুণ্য বিদ্যমান থাকবে, তাকে জাহান্নাম হতে বের করা হবে। যে ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলবে এবং তার অন্তরে একটি অণু পরিমাণও নেকী থাকবে, তাকেও জাহান্নাম হতে বের করা হবে।[১০]
ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি সম্পর্কে সালাফে ছালেহীনের বক্তব্য
(ক) ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর সাথীদের বলতেন,هَلِمُّوْا نَزْدَادُ إِيْمَانًا ‘এসো আমরা আমাদের ঈমান বৃদ্ধি করি’।[১১]
(খ) আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) দু‘আতে বলতেন,اَللهم زِدْنِيْ إِيْمَانًا وَيَقِيْنًا ‘হে আল্লাহ! আমার ঈমান ও প্রত্যয় বৃদ্ধি করে দাও’।[১২]
(গ) মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর সাথীকে বলতেন, اجْلِسْ بِنَا نُؤْمِنُ سَاعَةً، يَعْنِي نَذْكُرُ اللهَ ‘আমাদের সাথে বস, আমরা আল্লাহর প্রতি কিছুক্ষণ ঈমান আনি। অর্থাৎ আল্লাহকে স্মরণ করি’।[১৩]
(ঘ) আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, اَلْإِيْمَانُ يَزِيْدُ وَيَنْقُصُ ‘ঈমান বাড়ে এবং কমে’।[১৪]
(ঙ) ওমাইর বিন হাবীব আল-খাতামী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,
اَلْإِيْمَان يَزِيْدُ وَيَنْقُصُ. قِيلَ: وَمَا زِيَادَتُهُ وَنُقْصَانُهُ ؟ قَالَ : إِذَا ذَكَرْنَا اللهَ عَزَّ وَجَلَّ وَحَمِدْنَاهُ وَسَبَّحْنَاهُ فَذَلِكَ زِيَادَتُهُ وَإِذَا غَفَلْنَا وَضَيَّعْنَا وَنَسِينَا. فَذَلِكَ نُقْصَانه.
‘ঈমান বাড়ে ও কমে। বলা হল, তার কিভাবে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে? তিনি বললেন, আমরা যখন আল্লাহর যিক্র করি, তাঁর প্রশংসা করি, তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করি, তখন সেটি বাড়ে। আর যখন আমরা অলসতা করি, যিক্র থেকে গাফেল হই, ভুলে যাই তখন সেটি কমে’।[১৫]
(চ) ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) আদী ইবনু আদী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নিকট এক পত্রে লিখেছিলেন, ‘ঈমানের কতকগুলো হুকুম-আহকাম, বিধি-নিষেধ ফরয এবং কতকগুলো সুন্নাত রয়েছে। যে এগুলো পরিপূর্ণ রূপে আদায় করে তার ঈমান পূর্ণ হয়। আর যে এগুলো পূর্ণভাবে আদায় করে না, তার ঈমান অপূর্ণাঙ্গ হয়’।[১৬]
(ছ) আব্দুর রহমান বিন ওমর আল-আওযাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
اَلْإِيْمَانُ قَوْلٌ وَعَمَلٌ وَيَزِيْدُ وَيَنْقُصُ فَمَنْ زَعَمَ أَنَّ الإِيْمَانَ يَزِيْدُ وَلَا يَنْقُصُ فَاحْذَرُوْهُ فَأِنَّهُ مُبْتَدِعٌ.
‘ঈমান হল কথা ও কর্মের সমন্বিত রূপ, যা বাড়ে ও কমে। যে ধারণা করে যে ঈমান শুধু বাড়ে, কমে না, তার থেকে তোমরা সতর্ক থাক। কেননা সে বিদ‘আতী’।[১৭]
(জ) আওযাঈ (রাহিমাহুল্লাহ)-কে ঈমান বাড়ে কি-না এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, نَعَمْ حَتَّى يَكُوْنَ كَالْجِبَالِ قِيْلَ فَيَنْقُصُ؟ قَالَ نَعَمْ، حَتَّى يَبْقٰى مِنْهُ شَيْئٌ ‘হ্যাঁ বাড়ে, এমনকি সেটি পাহাড় সমতুল্য হয়ে যায়। জিজ্ঞেস করা হল, অতঃপর সেটি কি কমে? তিনি বললেন, হ্যাঁ! এমনকি তার যৎসামান্যই অবশিষ্ট থাকে’।[১৮]
(ঝ) সুফয়ান ছাওরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, اَلْإِيْمَانُ يَزِيْدُ وَيَنْقُصُ ‘ঈমান বাড়ে ও কমে’।[১৯]
(ঞ) আব্দুর রায্যাক শায়বানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি মা‘মার, সুফয়ান ছাওরী, মালেক বিন আনাস, ইবনে জুরাইজ এবং সুফয়ান বিন উয়াইনা থেকে শুনেছি, তারা সবাই বলেন, اَلْإِيْمَانُ قَوْلٌ وَعَمَلٌ وَيَزِيْدُ وَيَنْقُصُ ‘ঈমান হল কথা ও কর্মের সমন্বিত রূপ, যা বাড়ে ও কমে’।[২০]
(ট) ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, اَلْإِيْمَانُ قَوْلٌ وَعَمَلٌ وَيَزِيْدُ وَيَنْقُصُ ‘ঈমান হল কথা ও কমের্র সমন্বিত রূপ, যা বাড়ে ও কমে’।[২১]
(ঠ) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
اَلْإِيْمَانُ بَعْضُهُ أَفْضَلُ مِنْ بَعْضٍ وَيَزِيْدُ وَيَنْقُصُ وَزِيَادَتُهُ فِي الْعَمَلِ وَنُقْصَانَهُ فِيْ تَرْكِ الْعَمَلِ
‘ঈমানের কিছু অংশ কিছু অংশ থেকে উত্তম। সেটি বাড়ে ও কমে। আমলের মাধ্যমে তা বৃদ্ধি হয় এবং আমল ছেড়ে দিলে তা হ্রাস প্রায়’।[২২] তিনি আরো বলেন, اَلْإِيْمَانُ قَوْلٌ وَعَمَلٌ وَيَزِيْدُ وَيَنْقُصُ إِذَا عَمِلْتَ الْخَيْرَ زَادَ وَإِذَا ضَعْتَ نَقَصَ ‘ঈমান হল কথা ও কমের্র সমন্বিত রূপ, যা বাড়ে ও কমে। যখন তুমি ভালো আমল করবে তখন তা বৃদ্ধি পাবে এবং (খারাপ আমল দ্বারা) নষ্ট করলে কমে যাবে’।[২৩]
পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ এবং সালাফে ছালেহীনের কথা থেকে বুঝা যায়, ঈমান শুধু অন্তরের বিশ্বাস কিংবা মুখে স্বীকৃতির বিষয় নয়, বরং বিশ্বাস, স্বীকৃতি এবং ভাল কাজের সমন্বিত রূপই হল ঈমান, যা ভালো কাজের দ্বারা বাড়ে এবং মন্দ কাজের দ্বারা কমে। এমনকি পর্যায়ক্রমে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
৮. কুরআন আল্লাহর সৃষ্টি নয় বরং তাঁর কালাম
বিভিন্ন ফের্কায়ে বাতেলার দৃষ্টিতে কুরআন হল, আল্লাহর সৃষ্টি মাখলূক, কালাম নয়। পক্ষান্তরে নাজাতপ্রাপ্তদলের আক্বীদা হল, কুরআন আল্লাহর কালাম, সৃষ্টি নয়। ইমাম ত্বাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
وَإِنَّ الْقُرْآنَ كَلَامُ اللهِ مِنْهُ بَدَا بِلَا كَيْفِيَّةٍ قَوْلًا وَأَنْزَلَهُ عَلَى رَسُوْلِهِ وَحْيًا وَصَدَّقَهُ الْمُؤْمِنُوْنَ عَلَى ذَلِكَ حَقًّا وَأَيْقَنُوْا أَنَّهُ كَلَامُ اللهِ تَعَالَى بِالْحَقِيْقَةِ، لَيْسَ بِمَخْلُوْقٍ كَكَلَامِ الْبَرِيَّةِ. فَمَنْ سَمِعَهُ فَزَعَمَ أَنَّهُ كَلَامُ الْبَشَرِ فَقَدْ كَفَرَ وَقَدْ ذَمَّهُ اللهُ وَعَابَهُ وَأَوْعَدَهُ بِسَقَرَ حَيْثُ قَالَ تَعَالَى: (سَاُصۡلِیۡہِ سَقَرَ) فَلَمَّا أَوْعَدَ اللهُ بِسَقَرَ لِمَنْ قَالَ: إِنْ هَذَا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِ عَلِمْنَا وَأَيْقَنَّا أَنَّهُ قَوْلُ خَالِقِ الْبَشَرِ، وَلَا يُشْبِهُ قَوْلَ الْبَشَرِ.
‘নিশ্চয় কুরআন আল্লাহর ‘কালাম’ বা কথা সৃষ্টি কোন বস্তু নয়। তবে এর কোন ধরন নির্ধারণ করা যাবে না। এ কালামকে তিনি তার রাসূলের প্রতি অহী হিসাবে নাযিল করেছেন। আর ঈমানদারগণ তাকে এ ব্যাপারে সত্যবাদী বলে মেনে নিয়েছে। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, এটি সত্যিই আল্লাহর কালাম, কোন সৃষ্টির কথার মত সৃষ্টি নয়। অতএব, যে ব্যক্তি কুরআন শুনে তাকে মানুষের কালাম বলে ধারণা করবে, সে কাফের হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা তার নিন্দা করেছেন, তাকে দোষারোপ করেছেন এবং তাকে জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন, سَاُصۡلِیۡہِ سَقَرَ ‘‘শীঘ্রই তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব’ (সূরা আল-মুদ্দাস্সির : ২৬)।
সুতরাং যে বলে, اِنۡ ہٰذَاۤ اِلَّا قَوۡلُ الۡبَشَرِ ‘এটাতো মানুষের কথা ছাড়া আর কিছুই নয়, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য সাকার নামক জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করেছেন। অতএব, আমরা জেনে নিলাম ও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করলাম যে, এ কুরআন মানুষের সৃষ্টিকর্তার কালাম। আর তা কোন মানুষের কথার সাথে সাদৃশ্য রাখে না।
আল্লাহর কালাম সম্পর্কিত মাসআলায় বিভিন্ন ফের্কার মতভেদ
(ক) আল্লাহর কালাম বলতে এমন অর্থ উদ্দেশ্য, যা সক্রিয় সত্তা, আল্লাহ তা‘আলা বা অন্য কারো পক্ষ হতে মানুষের অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করে। এটি নাস্তিক, বে-দ্বীন ও দার্শনিকদের মত।
(খ) কুরআন আল্লাহর কালাম নয়; বরং এটি মাখলূক। আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তার বাইরে একে আলাদা করে সৃষ্টি করেছেন। এটি মু‘তাযিলাদের মত।
(গ) আল্লাহর কালাম এমন একটি অর্থ, যা আল্লাহর সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত। এটিকেই আল্লাহর আদেশ, নিষেধ ও সংবাদ বলা হয়। আরবীতে আল্লাহর এ কালামকে প্রকাশ করা হলে তাকে কুরআন বলা হয়। ইবরানী ভাষায় ব্যাখ্যা করা হলে তাকে তাওরাত বলা হয়। ইবনে কুল্লাব এবং আশ‘আরীদের মধ্য থেকে যারা তার অনুসরণ করেছে, এটি তাদেরই মত।
(ঘ) কালামের অক্ষর ও শব্দ রয়েছে, যা আল্লাহ তা‘আলার সত্তার সাথে অনাদিতেই একত্রিত অবস্থায় বিদ্যমান। যুক্তিবাদীদের এক শ্রেণী এবং মুহাদ্দিছদের একটি দলও এ কথা বলেছেন।
(ঙ) আল্লাহর কালামের অক্ষর, শব্দ ও আওয়াজ রয়েছে। তবে প্রথমে তিনি কথা বলার বিশেষণে বিশেষিত ছিলেন না; অতঃপর তিনি নিজের সাথে তাকে মিলিয়েছেন এবং কথা বলেছেন। কার্রামিয়া সম্প্রদায় এ কথা বলেছে।
(চ) আল্লাহর কালাম দ্বারা তাঁর ঐ ইলম উদ্দেশ্য, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং ঐ ইচ্ছা উদ্দেশ্য, যা তাঁর সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। মু‘তাবার গ্রন্থকার এ কথা বলেছেন। ফখরুদ্দীন রাযিও তার অন্যতম গ্রন্থ ‘মাতালেবে আলীয়াতে’ এ মতকে সমর্থন করেছেন।
(ছ) আল্লাহর কালাম এমন অর্থ বহন করে, যা আল্লাহ তা‘আলার সত্তার সাথে যুক্ত রয়েছে এবং তিনি এটি অন্যের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। আবূ মানসূর আল-মাতুরীদী এ কথা বলেছেন।
(জ) আল্লাহর কালাম এমন একটি যৌগিক বিষয়, যা তার সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত অনাদি অর্থ এবং তিনি অন্যের মধ্যে যে আওয়াজ সৃষ্টি করেন তার সমন্বয়ে গঠিত। এটিই আবুল মা‘আলী আল-জুওয়াইনী এবং তার অনুসারীদের মত।
(ঝ) আল্লাহ তা‘আলা অনাদি থেকেই যখন ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা কথা বলার বিশেষণে বিশেষিত। তিনি এ বিশেষণের মাধ্যমে এমন আওয়াজের সাথে কথা বলেন, যা শুনা যায়। কথা বলা বিশেষণ আল্লাহ তা‘আলার অনাদি ছিফাতের মধ্যে গণ্য। যদিও নির্দিষ্ট শব্দে কথা বলা কাদীম বা অনাদি নয়। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ইমামদের থেকে এ কথাই বর্ণিত হয়েছে।[২৪]
(ইনশাআল্লাহ আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
* শিক্ষক, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাঘা, রাজশাহী।
[১] .ইবনু মানদাহ, ১ম খ-, পৃ. ৩৩৮-৩৩৯।
[২] . তাফসীর ইবনে কাছীর, ৪র্থ খ-, পৃ. ২৫৪।
[৩] . প্রাগুক্ত, ৫ম খ-, পৃ. ১৪৬।
[৪] .ছহীহ বুখারী, হা/২৪৭৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২০২।
[৫] . আব্দুল্লাহ, আস-সুন্নাহ, ১ম খ-, পৃ. ৩০৭।
[৬] . ইবনু আব্দিল বার্র, আত-তামহীদ, ৯ম খ-, পৃ. ২৪৩।
[৭] . ইমাম নববী, শরহে ছহীহ মুসলিম, ২য় খ-, পৃ. ৪১।
[৮] . ছহীহ বুখারী, হা/৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৩।
[৯] . তাওযীহুল বায়ান লি শাজারাতিল ঈমান, পৃ. ১৪।
[১০] . ছহীহ বুখারী, হা/৪৪; ছহীহ মুসলিম, হা/৪৭৮।
[১১] . মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, ১১তম খ-, পৃ. ২৬।
[১২] .শারহু ইতেক্বাদ, ৫ম খ-, পৃ. ১০১৩; হা/১৭০৪; ইবনে হাজার, ফাৎহুল বারী, ১ম খ-, পৃ. ৪৮, সনদ ছহীহ।
[১৩] . শারহু ই‘তিক্বাদ, ৫ম খ-, পৃ. ১০১৪, হা/১৭০৭; ফাৎহুল বারী, ১ম খ-, পৃ. ৪৫, সনদ ছহীহ।
[১৪] . শারহু ই‘তিক্বাদ, ৫ম খ-, পৃ. ১০১৬, হা/১৭১১।
[১৫] . প্রাগুক্ত, ৫ম খ-, পৃ. ১০২০, হা/১৭২১।
[১৬] . ছহীহ বুখারী, ‘ঈমান’ অধ্যায়, পৃ. ৪।
[১৭] . আশ-শারী‘আহ, পৃ. ১১৭; শারহু ই‘তিক্বাদ, ৫ম খ-, পৃ. ১০৩০, হা/১৭৩৯, সনদ মাক্ববুল।
[১৮] . শারহু ই‘তিক্বাদ, ৫ম খ-, পৃ. ১০৩০, হা/১৭৪০।
[১৯] . প্রাগুক্ত।
[২০] . শারহু ই‘তিক্বাদ, ৫ম খ-, পৃ. ১০৩৯, হা/১৭৩৫।
[২১] . আল-হিলইয়া, ১০ম খ-, পৃ. ১১৫; ফাৎহুল বারী, ১ম খ-, পৃ. ৪৭।
[২২] . আল-খাল্লাল, আস-সুন্নাহ, ২য় খ-, পৃ. ৬৭৮, হা/১০০৮।
[২৩] . আস-সুন্নাহ, ২য় খ-, পৃ. ৬৮০, হা/১০১৩।
[২৪] .শারহুল আক্বীদাতিত তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১০৩-১০৬।
প্রসঙ্গসমূহ »:
সালাফে ছালেহীন