ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায়
-মূল : মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ
-অনুবাদক : আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
(৪র্থ কিস্তি)
ছালাতের কিরাআত আয়াত-আয়াত করে পড়া অর্থাৎ থেমে-থেমে পড়া।
ছালাতে তিলাওয়াতকৃত আয়াত সমূহ থেমে-থেমে পাঠ করার দ্বারা উদ্দেশ্য হল, আয়াতের অর্থ বোধগম্য হওয়া এবং তা নিয়ে গভীর চিন্তা করা অধিকতর সহজ হওয়া। আর এটাই নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত। যেমনটি উম্মে সালামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কিরাআতের ধরন বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,
قِرَاءَةُ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ وَفِيْ رِوَايَةٍ ثُمَّ يَقِفُ ثُمَّ يَقُوْلُ اَلۡحَمۡدُ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ – الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ ثُمَّ يَقُوْلُ مٰلِکِ یَوۡمِ الدِّیۡنِ يَقْطَعُ قِرَاءَتَهُ آيَةً آيَةً
‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কিরাআতের ধরন হল, রাসূলুল্লাহ بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ বলে থেমে যেতেন, অতঃপর اَلۡحَمۡدُ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ এবং الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ বলতেন। অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি থেমে যেতেন, অতঃপর বলতেন, مٰلِکِ یَوۡمِ الدِّیۡنِ -তিনি এভাবে তার কিরাআতকে এক আয়াত-এক আয়াত করে তিলাওয়াত করতেন’।[১] অতএব প্রত্যেক আয়াতের মাথায় ওয়াকফ বা বিরতি দেয়া সুন্নাত। যদিও পঠিত আয়াতের অর্থ পূর্ববর্তী আয়াতের অর্থের সাথে সম্পৃক্ত হয়।
তারতীলের সাথে এবং উত্তম কণ্ঠে তিলাওয়াত করা।
যেমন মহান আল্লাহ বলেন,
وَ رَتِّلِ الۡقُرۡاٰنَ تَرۡتِیۡلًا
‘কুরআন তিলাওয়াত কর ধীরে ধীরে, (থেমে থেমে সুন্দরভাবে)’ (সূরা আল-মুয্যাম্মিল : ৪)। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কিরাআতের ধরন ছিল বিস্তৃত। অর্থাৎ তিনি এক শব্দ এক শব্দ করে তিলাওয়াত করতেন।[২] অপর বর্ণনায় আছে,
وَكَانَ صلى الله عليه وسلم يَقْرَأُ بِالسُّوْرَةِ فَيُرَتِّلُهَا حَتَّى تَكُوْنَ أَطْوَلَ مِنْ أَطْوَلَ مِنْهَا
‘নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন কোন সূরা পাঠ করতেন, তখন তারতীল সহকারে (থেমে থেমে সুন্দরভাবে) পাঠ করতেন, এমনকি তার পরিসর দীর্ঘ থেকে অনেক দীর্ঘ হত’।[৩] এভাবে তারতীলের সাথে তিলাওয়াত করা এবং থেমে-থেমে পাঠ করা ছালাতে গভীর চিন্তা করা এবং খুশূ‘-খুযূ‘ ও বিনয়াবনত বৃদ্ধিতে ব্যাপক সহায়তা করে।
পক্ষান্তরে তাড়াহুড়া এবং দ্রুত পাঠ করা ছালাত গভীর চিন্তা এবং খুশূ‘-খুযূ‘র সম্পূর্ণ বিপরীত। ছালাতে খুশূ‘-খুযূ‘ আনয়নে আরও যে জিনিসটি ব্যাপকভাবে সহায়তা করে তাহল, কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজকে উত্তম এবং সুন্দর করা। এ ব্যাপারে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপদেশ প্রদান করেছেন। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণী,
زَيِّنُوْا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ فَإِنَّ الصَّوْتَ الْحَسَنَ يَزِيْدُ الْقُرْآنَ حُسْنًا
‘তোমরা তোমাদের কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজকে উত্তম, সুন্দর কর। কেননা উত্তম ও সুন্দর আওয়াজের তিলাওয়াত কুরআনের সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করে’।[৪] উল্লেখ্য যে, কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ উত্তম ও সুন্দর করার উদ্দেশ্য ফাসিক কিংবা বিদ‘আতীদের স্বরে তিলাওয়াত করা নয়। বরং এর অর্থ হল ভীত-সন্ত্রস্ত এবং ভারাক্রান্ত মন নিয়ে উত্তম ও সুন্দর স্বরে তিলাওয়াত করা। যেমন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
إِنَّ مِنْ أَحْسَنِ النَّاسِ صَوْتًا بِالْقُرْآنِ الَّذِىْ إِذَا سَمِعْتُمُوْهُ يَقْرَأُ حَسِبْتُمُوْهُ يَخْشَى اللهَ
‘মানুষের মাঝে আওয়াজের দিক দিয়ে সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে সুন্দর ও উত্তম তিলাওয়াতকারী। যখন তোমরা তার তিলাওয়াত শুনবে, তখন তোমরা বুঝতে পারবে যে লোকটি কেবল আল্লাহকে ভয় করেই তিলাওয়াত করছে’।[৫]
মুছল্লীর এ কথা জানা যে, আল্লাহ তা‘আলা ছালাতে তার উত্তর দিচ্ছেন।
নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ قَسَمْتُ الصَّلَاةَ بَيْنِىْ وَبَيْنَ عَبْدِىْ نِصْفَيْنِ وَلِعَبْدِىْ مَا سَأَلَ فَإِذَا قَالَ الْعَبْدُ اَلۡحَمۡدُ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ قَالَ اللهُ تَعَالَى حَمِدَنِىْ عَبْدِىْ وَإِذَا قَالَ اَلرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ قَالَ اللهُ تَعَالَى أَثْنَى عَلَىَّ عَبْدِىْ وَإِذَا قَالَ مٰلِکِ یَوۡمِ الدِّیۡنِ قَالَ مَجَّدَنِىْ عَبْدِىْ فَإِذَا قَالَ اِیَّاکَ نَعۡبُدُ وَ اِیَّاکَ نَسۡتَعِیۡنُ قَالَ هَذَا بَيْنِىْ وَبَيْنَ عَبْدِىْ وَلِعَبْدِىْ مَا سَأَلَ فَإِذَا قَالَ اِہۡدِ نَا الصِّرَاطَ الۡمُسۡتَقِیۡمَ – صِرَاطَ الَّذِیۡنَ اَنۡعَمۡتَ عَلَیۡہِمۡ غَیۡرِ الۡمَغۡضُوۡبِ عَلَیۡہِمۡ وَ لَا الضَّآلِّیۡنَ قَالَ هَذَا لِعَبْدِىْ وَلِعَبْدِىْ مَا سَأَلَ
‘মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার এবং আমার বান্দার মাঝে আমি ছালাতকে অর্ধেক অর্ধেক করে ভাগ করে নিয়েছি এবং আমার বান্দার জন্য রয়েছে সে যা চায়। বান্দা যখন বলে, اَلۡحَمۡدُ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ (সমস্ত প্রশংসা বিশ^ জগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য), আল্লাহ তখন বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল। সে যখন বলে, اَلرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ (তিনি পরম করুণাময় এবং অসীম দয়ালু); আল্লাহ তা‘আলা বলেন, বান্দা আমার প্রশংসা করল, গুণগান করল। সে যখন বলে, مٰلِکِ یَوۡمِ الدِّیۡنِ (তিনি বিচার দিবসের মালিক); আল্লাহ তখন বলেন, আমার বান্দা আমার গুণ বর্ণনা করল। আল্লাহ আরও বলেন, বান্দা তার সমস্ত কাজ আমার উপর সমর্পণ করল। সে যখন বলে,
اِیَّاکَ نَعۡبُدُ وَ اِیَّاکَ نَسۡتَعِیۡنُ
(আমরা কেবলই তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি); তখন আল্লাহ বলেন, এটা আমার এবং আমার বান্দার মধ্যকার ব্যাপার। (এখন) আমার বান্দার জন্য রয়েছে সে যা চায়। যখন সে বলে,
اِہۡدِ نَا الصِّرَاطَ الۡمُسۡتَقِیۡمَ – صِرَاطَ الَّذِیۡنَ اَنۡعَمۡتَ عَلَیۡہِمۡ غَیۡرِ الۡمَغۡضُوۡبِ عَلَیۡہِمۡ وَ لَا الضَّآلِّیۡنَ
(আমাদের সরল-সঠিক পথে পরিচালনা করুন, ঐ সকল লোকদের পথে যাদেরকে আপনি নে‘মত দান করেছেন, তাদের পথে নয়, যাদের প্রতি আপনার গযব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে); তখন আল্লাহ বলেন, এসবই আমার বান্দার জন্য এবং আমার বান্দার জন্য রয়েছে সে যা চায়’।[৬] এটা একটি মর্যাদাময় ও অতি গুরুত্বপূর্ণ হাদীছ। প্রত্যেক মুছল্লী যদি ছালাতে হাদীছটির মর্মার্থকে অন্তরে উপস্থিত রেখে দণ্ডায়মান হয়, তাহলে অবশ্যই তার অন্তরে পরিপূর্ণ খুশূ‘-খুযূ’ অর্জিত হবে। আর কেনই বা তা হবে না? যখন সে ইহা অনুভব করছে এবং বুঝতে পারছে যে, স্বয়ং তার প্রতিপালক (আল্লাহ তা‘আলা) তার সাথে কথা বলছেন, তার কথার প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন, অতঃপর সে যা চাচ্ছে তাই পাচ্ছে। সুতরাং একজন মুছল্লির জন্য আবশ্যকীয় করণীয় হল যে, সে এই কথোপকথনকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করবে এবং এর যথাযথ মূল্যায়ন করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
إِنَّ أَحَدَكُمْ إِذَا قَامَ يُصَلِّيْ فإنَّمَا يُنَاجِيْ رَبَّهُ فَلْيَنْظُرْ كَيْفَ يُنَاجِيْهِ
‘নিশ্চয় তোমাদের কোন ব্যক্তি যখন ছালাতের জন্য দণ্ডায়মান হয়, তখন সে যেন তার প্রতিপালকের সাথেই কথা বলছে। সুতরাং সে যেন লক্ষ্য রাখে, কিভাবে সে তার প্রতিপালকের সাথে কথা বলছে?’[৭]
সুতরাকে সামনে রেখে ছালাত আদায় করা এবং তার কাছাকাছি দাঁড়ানো।
ছালাতে খুশূ‘-খুযূ’ তথা বিনম্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়ক বিষয়াবলীর মাঝে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সুতরা স্থাপনের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা এবং সুতরার নিকটবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করা। কেননা এটা মুছল্লীর দৃষ্টির নিয়ন্ত্রক, শয়তানের প্ররোচনা হতে রক্ষাকারী এবং সামনে দিয়ে মানুষের অতিক্রম করার কারণে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটানো থেকে নিরাপদ। সুতরা না থাকলে এগুলো মুছল্লির ছালাতে গোলযোগ সৃষ্টি করে বিঘ্ন ঘটায় এবং মুছল্লির ছালাতের প্রতিদানকে কমিয়ে দেয়। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
إِذَا صَلَّى أَحَدُكُمْ فَلْيُصَلِّ إِلَى سُتْرَةٍ وَلْيَدْنُ مِنْهَا
‘তোমাদের কেউ যখন ছালাতের জন্য দণ্ডায়মান হয়, তখন সে যেন সুতরার দিকে ছালাত আদায় করে এবং সুতরার নিকটবর্তী স্থানে দাঁড়ায়’।[৮] সুতরার নিকটবর্তী স্থানে দাঁড়ানোর ফলে অনেক বড় উপকার রয়েছে। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
إِذَا صَلَّى أَحَدُكُمْ إِلَى سُتْرَةٍ فَلْيَدْنُ مِنْهَا لَا يَقْطَعُ الشَّيْطَانُ عَلَيْهِ صَلَاتَهُ
‘তোমাদের কেউ যখন সুতরার দিকে ছালাতের জন্য দণ্ডায়মান হয় তখন সে যেন সুতরার নিকটবর্তী স্থানে দাঁড়ায়, যাতে করে শয়তান তার ছালাতকে নষ্ট করতে না পারে’।[৯]
অতএব সুতরা স্থাপনের সুন্নাতী পদ্ধতি হল, সুতরা এবং মুছল্লির মাঝে তিন হাত পরিমাণ দুরত্ব রাখা। সিজদা ও সুতরার মাঝে একটি ছাগল অতিক্রম করার জায়গা পরিমাণ স্থান দূরত্ব রাখা। যেমনটি ছহীহ হাদীছ সমূহে বর্ণিত হয়েছে।[১০]
নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন মুছল্লীকে এ মর্মে উপদেশ দেন যে, সে যেন তার দাঁড়ানোর স্থান এবং সুতরার মাঝে দিয়ে কাউকে অতিক্রম করার অনুমতি না দেয়। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
إِذَا كَانَ أَحَدُكُمْ يُصَلِّىْ فَلَا يَدَعْ أَحَدًا يَمُرُّ بَيْنَ يَدَيْهِ وَ لِيَدْرَأْهُ مَا اسْتَطَاعَ فَإِنْ أَبَى فَلْيُقَاتِلْهُ فَإِنَّ مَعَهُ الْقَرِيْنَ
‘যখন তোমাদের কেউ ছালাত আদায় করে, তখন সে যেন কাউকে তার সামনে দিয়ে অতিক্রম করতে না দেয়। সে যেন তার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করে তাকে প্রতিহত করে। এরপরও যদি অতিক্রমকারী ব্যক্তি অস্বীকার পূর্বক অতিক্রম করে, তাহলে সে যেন তার মুকাবিলা করে। কেননা তার সাথে শয়তান রয়েছে’।[১১] ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
وَالْحِكْمَةُ فِي السُّتْرَةِ كَفُّ الْبَصَرِ عَمَا وَرَاءَهُ وَمَنْعُ مَنْ يَجْتَازُ بِقُرْبِهِ وَتَمْنَعُ الشَّيْطَان الْمُرُوْر وَالتَّعَرُّضِ لِإِفْسَادِ صَلَاتِهِ
‘মুছল্লির সামনে সুতরা স্থাপনের হিকমাত হল, মুছল্লী তার দৃষ্টিকে সুতরার বাইরের দিকে তাকানো হতে বিরত রাখা এবং মুছল্লির সামনে (ও সুতরার মধ্যবর্তী স্থান) দিয়ে অতিক্রমকারীকে বাধা প্রদান করা। শয়তানকে মুছল্লির সামনে দিয়ে অতিক্রম করতে বাধা প্রদান করা এবং শয়তানকে ছালাত (এর মনোযোগ) নষ্ট করার সুযোগ না দেয়া’।[১২]
ডান হাতকে বাম হাতের উপর রেখে তা বুকের উপর বাঁধা।
নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ছালাতে দণ্ডায়মান হতেন, তখন ডান হাতকে বাম হাতের উপর রাখতেন।[১৩] অতঃপর তিনি উভয় হাতকে বুকের উপর রাখতেন।[১৪] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
إِنَّا مَعْشَرَ الْأَنْبِيَاءِ أُمِرْنَا أَنْ نَضَعَ أَيْمَانَنَا عَلَى شَمَائِلِنَا فِي الصَّلَاةِ
‘নিশ্চয় আমরা নবীগণের দল, আমাদের আদেশ করা হয়েছে আমরা যেন ছালাতে অমাদের ডান হাতকে বাম হাতের উপর রাখি’।[১৫]
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ)-কে ছালাতে দণ্ডায়মান অবস্থায় এক হাত অপর হাতের উপর রাখার উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,
هُوَ ذِلٌّ بَيْنَ يَدَيِ الْعَزِيْزِ الْخُشُوْعِ فِي الصَّلَاةِ
‘এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল ছালাতে মহান আল্লাহর সামনে নিজেকে নত-অপদস্ত ও অপমানিত করা’।[১৬]
ইবনু হাজার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আলেমগণ বলেন, এ অবস্থার তাৎপর্য হল,
أَنَّهَا صِفَةُ السَّائِلِ الذَّلِيْلِ وَهُوَ أَمْنَعُ مِنَ الْعَبَثِ وَأَقْرَبُ إِلَى الْخُشُوْعِ
‘নিশ্চয় এটা একজন বিনয়ী চাওয়া ব্যক্তির গুণাগুণ। এটা যাবতীয় অনর্থক কাজ করা থেকে বাধা প্রদান করে এবং ছালাতে বিনয়ী-একাগ্রতা আনয়নে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করে’।[১৭]
সিজদার স্থানের দিকে দৃষ্টি রাখা।
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে যেমনটি বর্ণিত রয়েছে,
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا صَلَّى طَأْطَأَ رَأْسَهُ وَ رَمَى بِبَصْرِهِ نَحْوَ الْأَرْضِ
‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ছালাতে দণ্ডায়মান হতেন তখন তিনি তার মাথা নত অবস্থায় ঝুঁকাতেন এবং তার দৃষ্টি যমীনের দিকে নিক্ষেপ করতেন’।[১৮] অপর এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,
وَ لَماَّ دَخَلَ رَسُوْلُ اللهِ الْكَعْبَةَ مَا خَلَّفَ بَصَرُهُ مَوْضِعَ سُجُوْدِهِ حَتَّى خَرَجَ عَنْهَا
‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন কা‘বা ঘরে প্রবেশ করেন, তখন সেখানে থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত তিনি তার দৃষ্টি সিজদার স্থান থেকে অন্য কোন দিকে ফেরাননি’।[১৯]
আর মুছল্লী যখন তাশাহ্হুদের জন্য (বৈঠকে) বসবে, তখন সে যে আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করছে সেই আঙ্গুলের দিকে তাকাবে, এমতবস্থায় সে তার (শাহাদাত) আঙ্গুল বারবার নাড়া-চাড়া করবে। যেমনটি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিত হয়েছে,
يُشِيْرُ بِإِصْبَعِهِ الَّتِىْ تَلِى الْإِبْهَامَ إِلَى الْقِبْلَةِ وَيَرْمِيْ بِبَصْرِهِ إِلَيْهَا
‘যখন তিনি তাশাহ্হুদের জন্য বসতেন তখন তিনি তার বৃদ্ধাঙ্গুলের সাথে মিলিত আঙ্গুল (শাহাদাত আঙ্গুল) দ্বারা কিবলার দিকে ইশারা করতেন এবং ইশারাকৃত আঙ্গুলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন’।[২০] অপর এক বর্ণনায় আছে, وَأَشَارَ بِالسَّبَّابَةِ وَلَمْ يُجَاوِزْ بَصَرُهُ إِشَارَتَهُ ‘তিনি শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করতেন, এমতাবস্থায় তার দৃষ্টি ইশারাকৃত আঙ্গুল অতিক্রম করত না’।[২১]
মাসআলা
এখানে কতিপয় মুছল্লির মনে একটি প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রশ্নটি হল, ছালাতে দু’চোখ বন্ধ রাখার হুকুম কী? বিশেষ করে যখন কোন মুছল্লী চোখ বন্ধ রাখায় অধিক পরিমাণে খুশূ‘-একাগ্রতা অনুভব করে, তখন এর হুকুম কী হবে? চোখ বন্ধ করে রাখা যাবে কি-না?
উত্তর : ছালাতে চোখ বন্ধ করে রাখা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক বর্ণিত সুন্নাতের পরিপন্থী। যার আলোচনা কিছুক্ষণ আগেই করা হয়েছে। এর কারণ হল, ছালাতে চোখ বন্ধ রাখার দ্বারা সিজদার স্থানের দিকে তাকানো এবং তাশাহ্হুদে আঙ্গুলের দিকে তাকানোর সুন্নাত ছুটে যায়। তবে এই আলোচনার আরও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বিদ্যমান। তাই আমরা আলোচনাটি আলোচকদের জন্য উন্মুক্ত রেখে দিলাম।
আবু আব্দুল্লাহ ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বিষয়টি নিয়ে আলোচনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন এবং বিষয়টিকে স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেন, ছালাতে দু’চোখ বন্ধ রাখা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাতী পদ্ধতী নয়। কেননা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাশাহ্হুদের দু‘আ পড়াবস্থায় তার দৃষ্টিকে আঙ্গুলের দিকে নিক্ষেপ করতেন। আর তার দৃষ্টি আঙ্গুলের ইশারার বাইরে যেত না।
আর এটাও প্রমাণ বহন করে যে, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন সূর্য গ্রহণের ছালাতে জান্নাত দেখেন, তখন তিনি (আঙ্গুরের) থোকা নেয়ার জন্য হাত লম্বা করে বাড়িয়ে দেন। অনুরূপভাবে তাঁর জাহান্নামকে দেখা, বিড়ালকে কষ্টদানকারীণিকে দেখা এবং মাথাবাঁকা লাঠিওয়ালাকে দেখা।
অনুরূপভাবে ছালাতরত অবস্থায় জনৈক ব্যক্তির সালামের উত্তর ইশারার মাধ্যমে দেয়া সম্পর্কে বর্ণিত হাদীছ। কেননা তিনি কেবল তাকেই ইশারা করেন যাকে তিনি দেখেন। অনুরূপভাবে ছালাতে শয়তান তাঁর সামনে আসলে শয়তানকে গলা টিপে ধরা। আর এটা তখনই তিনি করেছিলেন, যখন তিনি শয়তানকে চোখে দেখেছিলেন। উপরিউক্ত হাদীছ সমূহ এবং এতদ্বসংশ্লিষ্ট অন্যান্য হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ছালাতে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু’চোখ বন্ধ করে রাখতেন না।
ছালাতে দু’চোখ বন্ধ রাখা অপসন্দনীয় (মাকরূহ) হওয়া নিয়ে ফক্বীহগণ ইখতিলাফ করেছেন। ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) ও তার সাথীদের মতে, ছালাতে দু’চোখ বন্ধ রাখা মাকরূহ। তারা বলেন, এটা ইহুদীদের কাজ। পক্ষান্তরে একদল এর বৈধতা দিয়েছে এবং একে মাকরূহ বলেনি। সঠিক কথা হল, ছালাতে চোখ খোলা রাখলে যদি ছালাতের খুশূ‘-একাগ্রতার বিঘ্নতা না ঘটে, তাহলে চোখ খোলা রাখাই উত্তম। আর যদি ক্বিবলার দিকে কারুকার্য, চাকচিক্য ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করা থাকে কিংবা এমন কিছু থাকে যা ছালাতে খুশূ‘-একাগ্রতা অবলম্বনে বিঘ্নতা ঘটায়, তাহলে ছালাতে চোখ বন্ধ রাখা আদৌ মাকরূহ হবে না। আর এ অবস্থার উপর বিবেচনা করে ছালাতে চোখ বন্ধ রাখাকে মাকরূহ না বলে মুস্তাহাব বলাটাই অধিক যুক্তিযুক্ত এবং শরী‘আতের মূলনীতি ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কাছাকাছি। আল্লাহ তা‘আলা অধিক অবগত।[২২]
সুতরাং এ কথা স্পষ্ট যে, সুন্নাত হচ্ছে চোখ বন্ধ না রাখা। তবে যদি খুবই প্রয়োজন হয় অর্থাৎ, খুশূ‘-একাগ্রতায় বিঘ্নতা সৃষ্টি করে এমন কিছুকে প্রতিহত করার জন্য চোখ বন্ধ করতে হয় তাহলে সমস্যা নেই।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
*অধ্যয়নরত, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব।
[১]. আবূ দাঊদ, হা/৪০০১; আলবানী (রহ.) হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন; ইরওয়াউল গালীল, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬০।
[২]. মুসনাদে আহমাদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৯৪; শায়খ আলবানী, সিফাতু ছালাতিন নবী (ছা.), পৃ. ১০৫; সনদ ছহীহ।
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭৩৩।
[৪]. হাকিম, হা/২১২৫, ১/৫৭৫; ছহীহুল জামে‘, হা/৩৫৮১।
[৫]. ইবনু মাজাহ, হা/১৩৩৯; ছহীহুল জামে‘, হা/২২০২।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩৯৫, ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘প্রতি রাক‘আতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব হওয়া বিষয়ে আলোচনা সংক্রান্ত’ পরিচ্ছেদ; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৮২৩; মিশকাত, হা/৮২৩।
[৭]. হাকিম, হা/৮৬১, ১/২৩৬; ছহীহুল জামি‘, হা/১৫৩৮।
[৮]. আবূ দাঊদ, হা/৬৯৫, ১/৪৪৬; ছহীহুল জামি’, হা/৬৫১।
[৯]. আবূ দাঊদ, হা/৬৯৫, ১/৪৪৬; ছহীহুল জামে‘, হা/৬৫০।
[১০]. ছহীহ বুখারী, ফাৎহুল বারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৭৪, ৫৭৯।
[১১]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬০; ছহীহুল জামে‘, হা/৭৫৫।
[১২]. শারহু ছহীহি মুসলিম, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২১৬।
[১৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪০১।
[১৪]. আবূ দাঊদ, হা/৭৫৯; ইরওয়াউল গালীল, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭১।
[১৫]. ত্বাবারানী, মু‘জামুল কাবীর, হা/১১৪৮৫; আল্লামা হায়ছামী (রহ.) বলেন, ইমাম ত্বাবারানী (রহ.) হাদীছটিকে ‘আওসাত্বে’ উল্লেখ করেছেন এবং এর বর্ণনাকারীগণ বিশুদ্ধ; আল মু‘জাম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৫৫।
[১৬]. ইবনু রজব, আল-খুশূ‘ ফিছ ছালাহ, পৃ. ২১।
[১৭]. ছহীহ বুখারী, ফাৎহুল বারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৪।
[১৮]. মুসতাদরাক হাকিম, ১/৪৭৯; তিনি বলেন, হাদীছটি ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (রহ.)-এর শর্তানুসারে ছহীহ; আলবানী (রহ.) হাদীছটি ছহীহ হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন, নাছিরুদ্দীন আলবানী, সিফাতু ছালাতিন নাবী (ছা.), পৃ. ৮৯।
[১৯]. মুসতাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ১/৪৭৯; তিনি বলেন হাদীছটি ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (রহ.)-এর শর্তানুসারে ছহীহ; ইমাম যাহাবী (রহ.) হাদীছটি ছহীহ হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন; নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) তাদের উভয়ের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন, ইরওয়াউল গালীল, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭৩।
[২০]. ইবনু খুযায়মাহ, ১/৩৫৫; মুহাক্কিক্ব বলেন, হাদীছটির সনদ ছহীহ, নাসিরুদ্দীন আলবানী, সিফাতু ছালাতিন-নাবী (ছা.), পৃ. ১৩৯।
[২১]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬১৪৫; আবূ দাঊদ, হা/৯৯০।
[২২]. যাদুল মা‘আদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৯৩, প্রকাশনী: দারুর রিসালাহ।