সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৩:৪৬ পূর্বাহ্ন

ফিতনা পরিচিতি ও আমাদের করণীয়

-আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ*


(শেষ কিস্তি)

ফিতনার সময় আমাদের করণীয়

আমরা বর্তমানে ফিতনার যুগেই অবস্থান করছি। কোথাও প্রকৃত শান্তি নেই। পাপীরা পাপের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে। অনিয়মই হয়ে যাচ্ছে নিয়ম। আল্লাহভীরুতা বাহ্যিক বেশ-ভূষাতে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ছোট থেকে বড় সকল পাপের কাজগুলো অহরহ হয়ে যাচ্ছে । সূদ, ঘুষ, হত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, গীবত, অপবাদ- সবই এখন আমাদের নিত্যদিনের কাজ। এখন আর আমরা পাপকে পাপ মনে করতেই রাজি নই (ওয়াল ইয়াযু বিল্লাহ)। মহান আল্লাহর নাফরমানি করা হয়ে উঠছে নিত্যদিনের স্বভাব। যার কারণে বিশ্বব্যাপী নেমে এসেছে বিপর্যয়। এই বিপর্যয় থেকে বাঁচতে আমাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দেখানো পথে। নিম্নে ফিতনার সময়ে আমাদের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা উপস্থাপন করা হল :

১). দু‘আ করা  

ফিতনার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হল- বেশি বেশি দু‘আ করা। বর্তমানে আমরা দু‘আ করাকে খুব তুচ্ছ বিষয় মনে করি। অথচ দু‘আই হল একজন মুমিনের বড় অস্ত্র। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, اَلدُّعَاءُ هُوَ الْعِبَادَةُ ‘দু‘আ হল ইবাদত’।[১] তাই একজন মুসলিম হিসাবে ছোট-বড় সকল ব্যাপারে মহান আল্লাহর কাছে দু‘আ করতে হবে। মুমিন হিসাবে ফিতনা থেকে বাঁচার জন্য এবং ফিতনায় পতিত হলে তা থেকে মুক্তির জন্য দু‘আ করতে হবে। ফিতনা যেন আল্লাহর একনিষ্ঠতা থেকে আমাদের মনোযোগ নষ্ট করতে না পারে সেজন্য দু‘আ করতে হবে। মোটকথা, সব কিছু ছেড়ে আমাদেরকে মহান রবের দিকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, اُدۡعُوۡنِیۡۤ اَسۡتَجِبۡ لَکُمۡ  ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব’ (সূরা আল-গাফির : ৬০)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ وَ نَعۡلَمُ مَا تُوَسۡوِسُ بِہٖ  نَفۡسُہٗ وَ نَحۡنُ  اَقۡرَبُ اِلَیۡہِ  مِنۡ  حَبۡلِ  الۡوَرِیۡدِ ‘আর আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার প্রবৃত্তি তাকে (নিত্য নতুন) যে সকল কুমন্ত্রণা দেয় তাও আমরা জানি। আর আমরা তার ধমনীর থেকেও নিকটবর্তী’ (সূরা ক্বফ : ১৬)।

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছালাতের শেষ বৈঠকে তাশাহহুদের পর চারটি বিষয় থেকে মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে বলতেন,

اَللَٰهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ جَهَنَّمَ وَمِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ وَمِنْ شَرِّ فِتْنَةِ الْمَسِيْحِ الدَّجَّالِ

‘হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট জাহান্নামের শাস্তি হতে, কবরের শাস্তি হতে, জীবন ও মৃত্যুর পরীক্ষা হতে এবং দাজ্জালের পরীক্ষা হতে আশ্রয় চাচ্ছি’।[২] ফিতনা থেকে মুক্ত থাকার জন্য প্রিয় নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে আরো একটি দু‘আ শিক্ষা দিয়েছেন,

اَللَٰهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْفِتَنِ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ

‘হে আল্লাহ! আমরা আপনার কাছে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল ফিতনা থেকে পরিত্রাণ চাচ্ছি’।[৩]

২). ঈমানের উপর অটল থাকা

ফিতনার সময় শয়তান নানাভাবে মুমিনকে কুমন্ত্রণা দেয়। মূলত মহান আল্লাহ ফিতনার মাধ্যমে মুমিনদের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। অতীতে যেভাবে তিনি ফেরআঊনের মাধ্যমে বানী ইসরাঈলের ঈমানী পরীক্ষা নিয়েছিলেন। আবার অত্যাচারী কুরাইশবাসীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ছাহাবীদের ঈমানী পরীক্ষা নিয়েছিলেন। কাজেই যারা প্রকৃত মুমিন তারা ফিতনার সময় ঈমান থেকে দূরে সরে যায় না। বরং ফিতনা যত বড়ই হৌক তারা ঈমানের উপর অটল থাকতে প্রাণপণ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। পক্ষান্তরে মুনাফিক্বরা ফিতনাগ্রস্ত হয়ে মুমিনদের থেকে পৃথক হয়ে কাফেরদের সাথে সাদৃশ্যতা স্থাপন করে। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফিতনা থেকে বাঁচতে এবং ঈমানের উপর অন্তরকে টিকিয়ে রাখতে একটি দু‘আ শিখিয়ে দিয়েছেন।

শাহর ইবনু হাওশাব (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উম্মু সালামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে আমি বললাম, হে উম্মুল মুমিনীন! রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনার কাছে অবস্থানকালে অধিকাংশ সময় কোন্ দু‘আটি পাঠ করতেন? তিনি বললেন, তিনি অধিকাংশ সময় পাঠ করতেন, يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوْبِ ثَبِّتْ قَلْبِىْ عَلَىْ دِيْنِكَ ‘হে অন্তরের পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের উপর স্থির রাখুন’। উম্মু সালামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি অধিকাংশ সময় এই দু‘আটি কেন পাঠ করেন? তখন তিনি বললেন, হে উম্মু সালামাহ! এরূপ কোন মানুষ নেই যার মন আল্লাহ তা‘আলার দুই আঙ্গুলের মধ্যবর্তীতে অবস্থিত নয়। যাকে ইচ্ছা তিনি (দ্বীনের উপর) স্থির রাখেন এবং যাকে ইচ্ছা (দ্বীন হতে) বিপথগামী করে দেন। অতঃপর মু‘আয (রাহিমাহুল্লাহ) এ আয়াত তেলাওয়াত করেন, رَبَّنَا لَا تُزِغۡ قُلُوۡبَنَا بَعۡدَ  اِذۡ ہَدَیۡتَنَا  ‘হে আমাদের রব! আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করার পর আপনি আমাদের অন্তরসমূহকে বাঁকা করে দিবেন না’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ৮)।[৪]

৩). ইবাদতের প্রতি গভীরভাবে মনোযোগী হওয়া

ফিতনার সময় ব্যক্তির মানসিক অবস্থা বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকে। নানা ধরনের চিন্তা-ভাবনা তার উপর চেপে বসে। অযৌক্তিক চিন্তা করেই ব্যক্তি তার গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত করে দেয়। মানসিক এই অস্থিরতা থেকে মুক্তির সর্বোত্তম মাধ্যম হল মহান আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিয়োগ করা। যেমন- যথাযথ সময়ে ছালাত আদায় করা। এক ওয়াক্ত ছালাত আদায় করে পরবর্তী ওয়াক্তের জন্য অপেক্ষা করা। সুন্নাত ও নফল ছালাতের প্রতি গুরুত্বারোপ করা। ফরয ছিয়ামের পাশাপাশি অধিকহারে নফল ছিয়াম পালনে সচেষ্ট হওয়া। বেশি বেশি আল-কুরআন তেলাওয়াত করা ও কর্মজীবনে তা বাস্তবায়নের দৃঢ় মনস্থ করা। দান-ছাদাক্বাহ করা। বেশি বেশি যিকর, তওবা ও ইস্তিগফার করা। এছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের দিকে আকৃষ্ট হওয়া একান্ত উচিত। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

بَادِرُوْا بِالْأَعْمَالِ فِتَنًا كَقِطَعِ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّجُلُ مُؤْمِنًا وَيُمْسِيْ كَافِرًا وَيُمْسِيْ مُؤْمِنًا وَيُصْبِحُ كَافِرًا يَبِيْعُ دِيْنَهُ بِعَرَضٍ مِّنَ الدُّنْيَا

‘তোমরা নেক আমলের দিকে দ্রুত অগ্রসর হও, ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত্রির অংশ সদৃশ ফিতনায় পতিত হওয়ার পূর্বেই। যখন কোন ব্যক্তি ভোরে উঠবে ঈমানদার হয়ে আর সন্ধ্যা করবে কুফরী অবস্থায় এবং সন্ধ্যা করবে মুমিন অবস্থায় আর ভোরে উঠবে কাফের হয়ে। সে দুনিয়ার সামান্য সম্পদের বিনিময়ে নিজের দ্বীনকে বিক্রয় করে দিবে’।[৫] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন, اَلْعِبَادَةُ فِي الْهَرْجِ كَهِجْرَةٍ إِلَيَّ ‘ফিতনার সময় এতে লিপ্ত না হয়ে ইবাদতে মশগুল থাকার ছওয়াব আমার দিকে হিজরত করে আসার সমতুল্য’।[৬] ইসলামের পথে হিজরতকারী ছাহাবীদের সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে আমরা অবগত। এর দ্বারা ফিতনার সময় ইবাদতের প্রতি মনোনিবেশের গুরুত্ব ও তাৎপর্য স্পষ্ট হয়। মহান আল্লাহ আমাদের ফিতনার সময় ধৈর্য্য ধরে বেশি বেশি তাঁর ইবাদত করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!

৪). মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ও সংবাদ প্রচারণা থেকে সাবধান থাকা

মিথ্যা সংবাদ প্রচারই অনেক সময় নানা সমস্যা, ফিতনা ও বিপর্যয়ের কারণ হয়ে থাকে। মিথ্যাচারকারীরা এমন সংবাদ প্রচার করে যার সাথে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক নেই। বিশেষ করে যখন অধিকাংশ প্রচার মাধ্যম ইসলামের শত্রুদের হাতে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সকল সংবাদ যাচাই-বাছাই করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, یٰۤاَیُّہَا  الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنۡ جَآءَکُمۡ فَاسِقٌۢ بِنَبَاٍ فَتَبَیَّنُوۡۤا ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কাছে যদি কোন ফাসিক ব্যক্তি কোন খবর নিয়ে আসে তোমরা তা যাচাই করে দেখ’ (সূরা আল-হুজুরাত : ৬)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَ  اِذَا جَآءَہُمۡ  اَمۡرٌ مِّنَ الۡاَمۡنِ اَوِ  الۡخَوۡفِ اَذَاعُوۡا بِہٖ  وَ لَوۡ رَدُّوۡہُ  اِلَی الرَّسُوۡلِ وَ اِلٰۤی اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡہُمۡ لَعَلِمَہُ الَّذِیۡنَ یَسۡتَنۡۢبِطُوۡنَہٗ مِنۡہُمۡ

‘তাদের কাছে যখন নিরাপদ বা ভীতি সংক্রান্ত কোন সংবাদ আসে তখন তারা ওটা প্রচার করতে থাকে। তারা যদি ওটা রাসূলের এবং জ্ঞানীদের কাছে আসত তাহলে তাদের আলেমগণ অবশ্যই প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করতে পারতেন’ (সূরা আন-নিসা : ৮৩)। কাজেই ফিতনার সময় বিভ্রান্তিকর এবং মিথ্যা তথ্য প্রচার করা থেকে সতর্ক ও সাবধানতা অবলম্বন আবশ্যক।

৫). ফিতনার সময় ঐক্যবদ্ধ থাকা

ফিতনার সময় মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ থাকা আবশ্যক। হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ফিতনার সময় করণীয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِيْنَ وَإِمَامَهُم ‘তুমি মুসলিমদের জামা‘আত ও তাদের ইমামের আঁকড়ে ধরবে’। হাদীছে এসেছে, হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকেরা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট কল্যাণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করত। আর আমি ক্ষতিকর বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম এই ভয়ে, যেন আমি তাতে লিপ্ত না হই। হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদা আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমরা এক সময় মূর্খতা ও মন্দের মধ্যে নিমজ্জিত ছিলাম। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এই কল্যাণ দান করেন। তবে কি এই কল্যাণের পর পুনরায় অকল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আসবে। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, সেই অকল্যাণের পরে কি আবার কল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আসবে, তবে তা হবে ধোঁয়াযুক্ত। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সেই ধোঁয়া কী প্রকৃতির? তিনি বললেন, লোকেরা আমার সুন্নাত বর্জন করে অন্য তরীকা গ্রহণ করবে এবং আমার পথ ছেড়ে লোকদেরকে অন্য পথে পরিচালিত করবে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, সেই কল্যাণের পরও কি অকল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, জাহান্নামের দ্বারে দাঁড়িয়ে কতিপয় আহ্বানকারী লোকদেরকে সেদিকে আহ্বান করবে। আর যারা তাদের আহ্বানে সাড়া দিবে তারা তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাদেরকে তাদের পরিচয় জানিয়ে দিন। তিনি বললেন, তারা আমাদের মতই মানুষ হবে এবং আমাদের ভাষায় কথা বলবে। আমি বললাম, আমি সে অবস্থায় উপনীত হলে, তখন আমাকে কী নির্দেশ দেন? তিনি বললেন, তখন তুমি মুসলিমদের জামা‘আত ও মুসলিমদের ইমামকে আঁকড়ে ধরবে। আমি বললাম, সে সময় যদি কোন মুসলিম জামা‘আত ও মুসলিম ইমাম না থাকে? তিনি বললেন,  فَاعْتَزِلْ تِلْكَ الْفِرَقَ كُلَّهَا وَلَوْ أَنْ تَعَضَّ بِأَصْلِ شَجَرَةٍ حَتَّى يُدْرِكَكَ الْمَوْتُ وَأَنْتَ عَلَى ذَلِكَ ‘তখন তুমি সেই সমস্ত বিচ্ছিন্ন দলকে পরিত্যাগ করবে, যদিও তোমাকে গাছের শিকড়ের আশ্রয় নিতে হয় এবং তুমি এই নির্জন অবস্থায় থাকবে যতক্ষণ তোমার মৃত্যু উপস্থিত না হয়’।[৭]

৬). ফিতনার সময় ধীরস্থীরতা অবলম্বন করা

সদা সর্বদা তাড়াহুড়া করা নিষিদ্ধ। এমনকি তা আনন্দ বা খুশীর সময়েও। কাজেই তাড়াহুড়া করা যদি এরকম মুহূর্তে দোষণীয় হয়ে থাকে তাহলে বিপদের সময় কেমন হবে একটু অনুধাবন করলেই স্পষ্ট বুঝা যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, اَلتُّؤَدَةُ فِيْ كُلِّ شَيْء إِلَّا فِيْ عَمَلِ الْآخِرَةِ ‘প্রত্যেক কাজই ধীরে-সুস্থে সম্পাদন করার মধ্যে কল্যাণ রয়েছে, তবে আখেরাতের আমল এর ব্যতিক্রম।[৮] অর্থাৎ আখিরাতের কাজে প্রতিযোগিতার সাথে অগ্রসর হতে হবে। আর অন্যান্য কাজে ধীরে সুস্থে সতর্কতার সাথে আগাতে হবে।

৭). মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব রাখা

ফিতনার সময় একজন মুমিনের জন্য করণীয় হল মুমিনদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা এবং কাফিরদের সাথে সকল প্রকার শারঈ পদ্ধতি অনুযায়ী সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করা, তাদেরকে ঘৃণা করা এবং তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা। এমনকি শিরকের অবসান না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ আমাদেরকে কাফেরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন,وَ قَاتِلُوۡہُمۡ حَتّٰی لَا تَکُوۡنَ فِتۡنَۃٌ وَّ یَکُوۡنَ الدِّیۡنُ کُلُّہٗ  لِلّٰہِ ‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর ফিতনার (শিরক) অবসান না হওয়া পর্যন্ত এবং দ্বীন পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট না হওয়া পর্যন্ত’ (সূরা আল-আনফাল : ৩৯)।

উল্লেখ যে, বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া ফিতনা দ্বারা পরিপূর্ণ। এর মাধ্যমে মুহূর্তেই একজন ব্যক্তি যেকোন অহরহ ফিতনায় পতিত হচ্ছে। কাজেই একজন মুসলিম হিসাবে সোশ্যাল মিডিয়ার সদ্ব্যবহার সম্পর্কে জানা এবং তদনুযায়ী এগুলো ব্যবহার করা একান্ত উচিত। কেননা মহান আল্লাহর নিকট আমাদের সবকিছুর জবাব দিতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,اِنَّ السَّمۡعَ وَ الۡبَصَرَ وَ الۡفُؤَادَ  کُلُّ  اُولٰٓئِکَ کَانَ  عَنۡہُ  مَسۡـُٔوۡلًا  ‘নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তর- এগুলোর সকল বিষয়ে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৩৬)।

পরিশেষে, হে প্রিয় মুমিন ভাই! এখন আর আমাদের অন্যের দোষ অনুসন্ধান করার সময় নেই। এখন উচিত নিজেদেরকে সংশোধন করা। পাপ থেকে বিরত থাকা। চোখ, হাত ও অন্তরের যিনা, ধর্ষণ, হত্যা, অশ্লীলতা ও উলঙ্গপনা, অন্যকে কষ্ট দেয়া, অন্যের হক্ব নষ্ট করা, সূদ ও ঘুষের ন্যায় মারাত্মক পাপ থেকে নিজেকে যথাসাধ্য বাঁচানোর চেষ্টা করা। ফিতনা থেকে বাঁচতে আমাদেরকে অবশ্যই এ ধরনের অপরাধের ব্যাপারে সর্বদা নিজে ও পরিবার-পরিজনসহ পরিচিত মহলকে সতর্ক থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমরা মহান আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে সকল ধরনের ফিতনা থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক্ব দান করেন। আমাদেরকে ঈমানের সাথে মৃত্যবরণ করার তাওফীক্ব দান করেন- আমীন!!

* অধ্যয়নরত, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।

তথ্যসূত্র :
[১]. আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৭১৪; আবূ দাঊদ, হা/১৪৭৯; তিরমিযী, হা/২৯৬৯; ইবনু মাজাহ, হা/৩৮২৮; সনদ ছহীহ।
[২]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৮৮; মিশকাত, হা/৯৪১।
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮৬৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬৬৭।
[৪]. তিরমিযী, হা/৩৫২২; সনদ ছহীহ।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৮; তিরমিযী, হা/২১৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮০১৭; মিশকাত, হা/৫৩৮৩।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৪৮; মিশকাত, হা/৫৩৯১।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৬০৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৪৭।
[৮]. আবূ দাঊদ, হা/৪৮১০।




কালো কলপ ব্যবহারের শারঈ বিধান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
সালাফী মানহাজের মূলনীতিসমূহ (৩য় কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
বিদ‘আত পরিচিতি (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (শেষ কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
বিদ‘আত পরিচিতি (১৫তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামে বিবাহের গুরুত্ব (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আবূ সাঈদ
হজ্জ ও ওমরাহ সম্পর্কে প্রচলিত বিদ‘আতসমূহ - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
অল্পে তুষ্ট - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৫ম কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
ফাযায়েলে কুরআন (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
আশূরায়ে মুহাররম : করণীয় ও বর্জনীয় - ইউনুস বিন আহসান
ইসলামী তাবলীগ বনাম ইলিয়াসী তাবলীগ (২য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন

ফেসবুক পেজ