মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ১১:৫৪ অপরাহ্ন

ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম) -এর আগমন  সংশয় নিরসন

-হাসিবুর রহমান বুখারী*


(৬ষ্ঠ কিস্তি) 

দাজ্জাল কখন আবির্ভূত হবে?

আধুনিক যুগের কিছু নব্য আবিষ্কৃত বক্তা মাঝেমধ্যেই শয়তান গণকের (Astrologer) মত ইমাম মাহদী ও দাজ্জাল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে চলেছেন। কখনো বলছেন দাজ্জাল চলে এসেছে! কখনো বলছেন ইজরাইলের রাষ্ট্রপতিই দাজ্জাল! আবার কখনো বলছেন আমেরিকান ডলারই দাজ্জাল! বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। যেমন,

প্রথমতঃ দাজ্জাল কোন বস্তু বা পদার্থের নাম নয়। বরং সে মানব জাতির মধ্যে থেকেই হবে। যেমন মহানবী (ﷺ) দাজ্জালকে স্বপ্নে দেখে তার শারীরিক গঠনের বর্ণনা প্রদান করতে গিয়ে বলেছেন,

..فَذَهَبْتُ ألْتَفِتُ فَإِذَا رَجُلٌ أحْمَرُ جَسِيْمٌ جَعْدُ الرَّأْسِ أعْوَرُ عَيْنِهِ اليُمْنَى كَأنَّ عَيْنَهُ عِنَبَةٌ طَافِيَةٌ قُلْتُ مَنْ هَذَا؟ قَالُوْا هَذَا الدَّجَّالُ وأَقْرَبُ النَّاسِ بِهِ شَبَهًا ابْنُ قَطَنٍ. قَالَ الزُّهْرِيُّ رَجُلٌ مِن خُزَاعَةَ هَلَكَ فِي الجَاهِلِيَّةِ

‘অতঃপর আমি এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলাম, হঠাৎ দেখতে পেলাম, এক ব্যক্তি স্থুলকায় লাল বর্ণের, কোঁকড়ানো চুল, তার ডান চোখ ট্যারা, চোখটি যেন ফোলা আঙ্গুরের মত। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ লোকটি কে? লোকেরা বলল এ হল দাজ্জাল! মানুষের মধ্যে ইবনু কাত্বানের সঙ্গে তার বেশি সাদৃশ্য রয়েছে। ইমাম যুহরী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর বর্ণনায় বলেন, ইবনু কাত্বান খুযা‘আহ গোত্রের জনৈক ব্যক্তি, সে জাহিলিয়্যাতের যুগেই মারা গিয়েছে’।[১]

দ্বিতীয়তঃ পরকাল কেন্দ্রিক কোন বিষয়ে বা ভাবীকাল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা গর্হিত অপরাধ। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আল্লাহ তা‘আলা সম্বোধন করে বলেছেন,

قُلۡ  لَّاۤ  اَقُوۡلُ لَکُمۡ عِنۡدِیۡ خَزَآئِنُ اللّٰہِ وَ لَاۤ  اَعۡلَمُ الۡغَیۡبَ وَ لَاۤ  اَقُوۡلُ لَکُمۡ  اِنِّیۡ مَلَکٌ ۚ اِنۡ  اَتَّبِعُ  اِلَّا مَا یُوۡحٰۤی  اِلَیَّ

‘(হে নবী!) আপনি বলুন, ‘আমি তোমাদেরকে এ কথা বলি না যে, আমার নিকট আল্লাহর ধনভাণ্ডার রয়েছে এবং আমি গায়েব বা অদৃশ্য সম্বন্ধেও অবগত নই এবং আমি তোমাদেরকে এ কথাও বলি না যে, আমি ফিরিশতা। আমার প্রতি যা অহীরূপে প্রেরণ করা হয় আমি শুধু তারই অনুসরণ করি!' (সূরা আল-আন‘আম : ৫০; সূরা হূদ : ৩১)। এ মুহূর্তে বক্তা এবং শ্রোতা উভয়কেই গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত যে, স্রষ্টার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) যদি অদৃশ্যের সংবাদ না জানেন! তাহলে আমরা কারা? আমরা কিভাবে বলতে পারি যে, ইমাম মাহদী ২০১৯ অথবা ২০২৬ সালে আবির্ভূত হবেন! আমরা কিভাবে বলতে পারি যে, দাজ্জাল অমুক তারিখে প্রকাশিত হবে! অথচ আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (ﷺ) এ সম্পর্কে কোন স্পষ্ট মন্তব্য করেননি। তাহলে কি আমরা আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (ﷺ) থেকেও বেশি জ্ঞানী! মা‘আযাল্লাহ! আল্লাহ এদের হেদায়াত দান করুন। এই ধরনের বক্তাগণ সজ্ঞানে অথবা অজ্ঞানে কত বড় ধ্বংসাত্মক গুনাহের মধ্যে যে অধঃপতিত হচ্ছে তা কল্পনাতীত। শরী‘আতের পরিভাষায় এদেরকেই জ্যোতিষী, গণক বা ভবিষ্যদ্বক্তা বলা হয়। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, ইমাম খাত্ত্বাবী ও শায়খ ‘উছাইমীন (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, الكاهِنُ هو الذي يخبِرُ عن المغَيَّباتِ في المستقبَلِ ‘মূলত গণক বলা হয় ঐ ব্যক্তিকে, যে ভবিষ্যতের গায়িবী বিষয় সম্পর্কে সংবাদ দেয় অর্থাৎ যে ভবিষ্যদ্বাণী করে। আবার কারো মতে যে ব্যক্তি ভবিষ্যতের গোপন খবর বলে দেয়ার দাবী করে তাকেই গণক বলা হয়’।[২]

অতএব যে ব্যক্তি গণক বা ভবিষ্যদ্বক্তার কথা বিশ্বাস করল সে আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত ও মুহাম্মাদ (ﷺ) কর্তৃক আনিত দ্বীনকে অস্বীকার করল। কেননা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কেউ-ই অদৃশ্যের খবর জানে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلۡ لَّا یَعۡلَمُ مَنۡ فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ الۡغَیۡبَ  اِلَّا اللّٰہُ ‘(হে নবী!) আপনি বলুন, নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের কেউ-ই অদৃশ্য বিষয়ক জ্ঞান রাখে না’ (সূরা আন-নামল : ৬৫)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَ عِنۡدَہٗ مَفَاتِحُ الۡغَیۡبِ لَا  یَعۡلَمُہَاۤ  اِلَّا ہُوَ ‘আর অদৃশ্যের চাবিকাঠি তো তাঁরই নিকট রয়েছে। তিনি ছাড়া কেউ তা জানে না’ (সূরা আল-আন‘আম : ৫৯)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اَعِنۡدَہٗ  عِلۡمُ  الۡغَیۡبِ فَہُوَ یَرٰی ‘তার নিকটে কি অদৃশ্যের জ্ঞান রয়েছে যে, সে সবকিছু দেখবে?’ (সূরা আন-নাজম : ৩৫)। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, وَ اللّٰہُ یَعۡلَمُ  وَ اَنۡتُمۡ  لَا تَعۡلَمُوۡنَ ‘আর আল্লাহ অবগত আছেন আর তোমরা অবগত নও’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২১৬)।

নবী করীম (ﷺ) বলেন, مَنْ أَتَى كَاهِنًا  فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُوْلُ فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ ‘যে ব্যক্তি কোন গণকের নিকট আসল এবং তার কথা বিশ্বাস করল সে মুহম্মাদ (ﷺ)-এর উপর অবতীর্ণ কিতাবকে অস্বীকার করল’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর যা অবতীর্ণ করা হয়েছে সে তা থেকে দায়মুক্ত (অর্থাৎ সে ইসলামের গণ্ডির বাইরে)’।[৩] অন্যত্র তিনি বলেন,

مَنْ أَتَى عَرَّافًا فَسَأَلَهُ عَنْ شَىْءٍ لَمْ تُقْبَلْ لَهُ صَلَاةٌ أَرْبَعِيْنَ لَيْلَةً . وَفِيْ رِوَايَةٍ (أَرْبَعِيْنَ يَوْمًا)

‘যে ব্যক্তি কোন গণকের নিকট গেল এবং তাকে কোন ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল, সেক্ষেত্রে চল্লিশ দিন ও রাত পর্যন্ত তার ছালাত কবুল হবে না’।[৪] সুতরাং বক্তা এবং শ্রোতা উভয়কেই আত্মসংযমী ও পরিমিত হওয়া আবশ্যক। ভিত্তিহীন ভবিষ্যদ্বাণী সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা উচিত। অন্যথা বক্তা এবং তাদের অন্ধভক্ত শ্রোতাদের ছালাতগুলোও অনর্থক বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে।

শায়খ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘দাজ্জাল কখন আবির্ভূত হবে? এর উত্তরে এক কথায় বলা যায় শেষ যামানায়। কিন্তু শেষ যামানার কোন্ সময়ে? তা সুনিশ্চিতভাবে বলা অসম্ভব। কারো পক্ষেই ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয় যে, অমুক সালে দাজ্জাল আবির্ভূত হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজেও এ ব্যাপারে পরিষ্কার কোন তথ্য বা দিনক্ষণ বলে যাননি। তবে তিনি দাজ্জালের আগমনের অনেকগুলো পূর্বশর্ত বা নিদর্শন বলে গেছেন, যেগুলো সাধারণত ক্বিয়ামতের আলামত বা নিদর্শন নামেই পরিচিত। আর ক্বিয়ামতের দশটি বড় আলামতের একটি অন্যতম বড় আলামত হল দাজ্জালের আগমন। যেমন হুযায়ফাহ ইবনু আসীদ আল-গিফারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদিন আমরা (বিবিধ বিষয়ে) আলোচনা করছিলাম। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিকট আবির্ভূত হলেন এবং প্রশ্ন করলেন, তোমরা কী বিষয়ে আলোচনা করছ? উত্তরে তাঁরা বললেন, আমরা ক্বিয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করছি। এ কথা শুনে তিনি বললেন, ততক্ষণ পর্যন্ত ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না তোমরা দশটি বিশেষ আলামত দেখবে। অতঃপর তিনি বর্ণনা করলেন যে, (১) ধুম্র (২) দাজ্জাল (৩) দাব্বাতুল আরয বা ভূমির প্রাণী (৪) পশ্চিমাকাশ হতে সূর্যোদয় হওয়া (৫) মারইয়াম পুত্র ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর অবতরণ (৬) ইয়াজূজ-মাজূজ এবং তিনবার ভূখণ্ড ধ্বসে যাওয়া। যথা : (৭) পূর্ব দিকের ভূখণ্ড ধ্বস (৮) পশ্চিম দিকের ভূখণ্ড ধ্বস (৯) আরব উপদ্বীপে ভূখণ্ড ধ্বস। (১০) এ আলামতসমূহ প্রকাশিত হওয়ার পর এডেনের ভূগর্ভ থেকে এক অগ্নুৎপাতের প্রকাশ ঘটবে, যা তাদেরকে ইয়ামান থেকে হাশরের মাঠ পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যাবে’।[৫]

অনুরূপভাবে ক্বিয়ামতের অনেকগুলো ছোট ছোট আলামত রয়েছে, যার অনেকগুলোই প্রকাশিত বা বাস্তবায়িত হয়ে গিয়েছে, অল্প কিছু এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। এ ধরনের ছোট আলামতসমূহের মধ্যে সর্বশেষটি হচ্ছে ইমাম মাহদীর আগমন। আর বড় আলামতগুলোর মধ্যে প্রকাশের দিক থেকে প্রথম হল দাজ্জালের আগমন। ইমাম মাহদীর আগমনের কিছুকাল পরেই দাজ্জালের আগমন ঘটবে এবং তারও কিছুকাল পরে তাকে হত্যা করার জন্য ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন ঘটবে। অন্তত কিছুটা সময় হলেও তারা তিনজন একইসাথে পৃথিবীতে অবস্থান করবে। সুতরাং বলা যায় যে, ইমাম মাহদী না আসা পর্যন্ত দাজ্জাল আসবে না। আর দাজ্জাল না আসা পর্যন্ত ঈসা (আলাইহিস সালাম) আসবেন না। এখন প্রশ্ন হতে পারে যে, ইমাম মাহদী কখন আসবেন? আলহামদুল্লিাহ, সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধের প্রথম তিনটি পর্বে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

মোদ্দাকথা হল শেষ যামানায় ক্বিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে মিথ্যুক দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। দাজ্জালের আগমন ক্বিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার সবচেয়ে বড় আলামত। আদম (আলাইহিস সালাম) থেকে শুরু করে ক্বিয়ামত পর্যন্ত মানব জাতির জন্য দাজ্জালের চেয়ে অধিক বড় বিপদ আর নেই। তাই সমস্ত নবী-ই স্বীয় উম্মতকে দাজ্জালের ফিতনা সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করেছেন। আমাদের নবী (ﷺ)ও দাজ্জালের ফিতনা থেকে সতর্ক করেছেন এবং তার অনিষ্ট থেকে বাঁচার উপায়ও বলে দিয়েছেন।[৬]

ছহীহ হাদীছের আলোকে দাজ্জাল আবির্ভাবের পূর্বশর্ত সমূহ

১. যখন আরববাসীরা সংখ্যায় নগণ্য হয়ে যাবে

জাবির ইবনু আব্দিল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, উম্মু শারীক (রাযিয়াল্লাহু আনহা) আমাকে বর্ণনা করে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, লোকেরা দাজ্জালের আতঙ্কে পলায়ন করবে, অবশেষে তারা পাহাড় পর্বতে গিয়ে আশ্রয় নিবে। উম্মু শারীক (রাযিয়াল্লাহু আনহা) প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! সে সময় আরবের মানুষেরা কোথায় থাকবে? উত্তরে তিনি বললেন, সে সময় তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য হবে’।[৭]

২. মহাযুদ্ধে কুস্তুন্তুনিয়া বা কনস্টান্টিনোপলের উপর মুসলিম বাহিনীর বিজয় লাভ

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছেন যে, শেষ যামানায় মুসলিম সেনাবাহিনী ও রোমান সেনাবাহিনীর মধ্যে অস্ত্রহীন মালহামাহ বা মহাযুদ্ধ সংঘটিত হবে। সেই যুদ্ধে মুসলিম সেনাবাহিনী কুস্তুন্তুনিয়ার উপর জয়লাভ করবে কোন প্রকারের রক্তক্ষয় ছাড়াই। শুধু আল্লাহু আকবর ও লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ধ্বনি শুনেই শত্রুদের প্রাচীর ভেঙে পড়বে। যেমন, মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘বায়তুল মাক্বদিসের পার্থিব উন্নতি মদীনাহ ধ্বংস হওয়ার কারণ হবে। আর মদীনার বিপর্যয় বিভিন্ন ফিতনা ও মহাযুদ্ধের সূচনা করবে এবং মহাযুদ্ধ কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পূর্ব সংকেত হবে। আর কনস্টান্টিনোপলের বিজয় হবে দাজ্জালের আবির্ভাবের পূর্ব সংকেত’।[৮]

জাবির ইবনু সামুরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি নাফি‘ ইবনু উতবাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে চারটি কথা আয়ত্ত করেছিলাম এবং তা আমার হাত দ্বারাই গণনা করলাম। তিনি বললেন, তোমরা ‘আরব উপদ্বীপে যুদ্ধ অভিযান চালাবে এবং আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে তাতে বিজয়ী করবেন। অতঃপর পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, তাতেও আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে জয়যুক্ত করবেন। তারপর রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, এটাতেও আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে বিজিত করবেন। অবশেষে তোমরা দাজ্জালের বিরুদ্ধে লড়াই করবে, তাতেও আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে বিজয়ী করবেন। বর্ণনাকারী নাফি‘ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, হে জাবির! আমাদের মনে হয় রোম বিজিতের পর দাজ্জালের আগমন ঘটবে’।[৯]

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। নবী (ﷺ) বলেছেন, তোমরা কি ঐ শহরের কথা শুনেছ, যার একদিকে স্থলভাগ এবং একদিকে জলভাগ? (অর্থাৎ কুস্তুন্তুনিয়ার)। উত্তরে ছাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! শুনেছি। অতঃপর তিনি বললেন, ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত ইসহাক্ব (আলাইহিস সালাম)-এর সন্তানদের সত্তর হাজার লোক এ শহরের লোকদের সঙ্গে যুদ্ধ না করবে। তাঁরা শহরের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছবে এবং কোন অস্ত্র দ্বারা যুদ্ধ করবেন না এবং কোন তীরও চালাবেন না, বরং তাঁরা একবার ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ‘ওয়াল্লা-হু আকবার’ বলবেন, সাথে সাথে এর এক প্রান্ত ধ্বসে পড়বে। অতঃপর দ্বিতীয়বার তাঁরা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ‘ওয়াল্লা-হু আকবার’ বলবেন, এতে শহরের অপর প্রান্ত ধ্বসে যাবে। এরপর তাঁরা তৃতীয়বার ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ও ‘ওয়াল্লা-হু আকবার’ বলবেন। তখন তাদের শহরের দ্বার খুলে দেয়া হবে। তাঁরা যখন তাতে প্রবেশ করে গনীমতের মাল ভাগাভাগিতে ব্যতিব্যস্ত থাকবে, তখন কেউ উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠবে, দাজ্জালের আগমন ঘটেছে। এ কথা শুনামাত্রই তাঁরা ধন-সম্পদ ফেলে দেশে ফিরে যাবে।[১০]

উপরিউক্ত হাদীছগুলো থেকে একথা দিবালোকের ন্যায় প্রতীয়মাণ হয় যে, (ক) যারা বলছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা দাজ্জালের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য মুসলিমদের প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত এবং এ সম্পর্কে গবেষণাগার ও অস্ত্রাগার নির্মাণ করা উচিত। যেখান থেকে মুসলিমরা সামরিক প্রশিক্ষণ নেবে, অত্যাধুনিক হাতিয়ার চালানো শিখবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের জন্য উপরিউক্ত হাদীছ শিক্ষণীয় ও পঠনীয়। মুসলিমদের হাতিয়ার আগ্নেয়াস্ত্র বা পারমাণবিক বোমা নয়, বরং তাঁদের অপ্রতিরোধ্য ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হাতিয়ারের নাম হল, ‘সুদৃঢ় ঈমান’। ঈমানের দীপ্তি শিখা ও লেলিহান অগ্নিশিখার মাধ্যমেই শত্রুদের দূর্গ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। সুতরাং গবেষণাগার ও অস্ত্রাগার নির্মাণ না করে নিজেদের ঈমান সুদৃঢ়করণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশি বেশি দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করতে হবে। তাদের ঈমান মজবুতকরণে উৎসাহিত করতে হবে এবং মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য আহ্বান করতে হবে। (খ) সেই সময় মুসলিমরা শক্তিশালী ও মর্যাদাবান হবে। মূলত মুসলিমদের ঐ শক্তি ও মর্যাদা বিনষ্ট করার জন্যই দাজ্জালের আগমন ঘটবে।

৩. উদ্ভিদ উৎপাদনের হার ও বৃষ্টি বর্ষণের হার হ্রাস পাবে

আবূ উমামাহ আল-বাহিলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘... দাজ্জালের আবির্ভাবের তিন বছর পূর্বে চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে। তখন মানুষ চরমভাবে অন্নকষ্ট ভোগ করবে। প্রথম বছর আল্লাহ তা‘আলা নভোমণ্ডলকে এক-তৃতীয়াংশ বৃষ্টি আটকে রাখার নির্দেশ দিবেন এবং ভূমণ্ডলকে নির্দেশ দিলে তা এক-তৃতীয়াংশ ফসল কম উৎপাদন করবে। এরপর তিনি দ্বিতীয় বছর নভোমণ্ডলকে একই নির্দেশ দিলে, তা দু’-তৃতীয়াংশ কম বৃষ্টি বর্ষণ করবে এবং ভূম-লকে নির্দেশ দিলে তাও দুই-তৃতীয়াংশ কম ফসল উৎপন্ন করবে। এরপর আল্লাহ তা‘আলা আকাশকে তৃতীয় বছরে একই নির্দেশ দিলে তা সম্পূর্ণভাবে বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দিবে। ফলে এক ফোঁটা বৃষ্টিও বর্ষিত হবে না। আর তিনি পৃথিবীকে নির্দেশ দিলে তা শস্য উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখবে। ফলে ভূপৃষ্ঠে কোন ঘাস জন্মাবে না, কোন সবজি অবশিষ্ট থাকবে না, বরং তা ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে আল্লাহ যা চাইবেন। জিজ্ঞেস করা হল, এ সময় লোকেরা কী আহার করে জীবন ধারণ করবে? উত্তরে তিনি বলেন, যারা তাহলীল অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, তাকবীর অর্থাৎ আল্লাহু আকবার, তাসবীহ অর্থাৎ সুবহানাল্লাহ এবং তাহমীদ অর্থাৎ আলহামদুলিল্লাহ বলতে থাকবে এগুলো তাদের খাদ্যনালিতে আহার হিসাবে প্রবাহিত করা হবে’।[১১]

৪. তামীম-আদ-দারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত হাদীছে দাজ্জাল আগমনের তিনটি আলামত পাওয়া যায়

ফাতিমাহ বিনতু ক্বায়স (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত। নবী (ﷺ) ও তামীম-আদ-দারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছালাত আদায়ন্তে হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় মিম্বারে বসে গেলেন। অতঃপর তিনি বললেন, ...অতঃপর দাজ্জাল বলল, তোমরা আমাকে বাইসানের (শাম দেশের একটি এলাকা) খেজুর বাগানের সংবাদ বল। আমরা বললাম, এর কোন্ বিষয়টি সম্পর্কে তুই জানতে চাচ্ছিস? সে বলল, বাইসানের খেজুর বাগানে ফল আসে কি-না? আমরা তাকে বললাম, হ্যাঁ, ফল ধরে। সে বলল, অচিরেই এগুলোতে কোন ফল ধরবে না। তারপর সে বলল, আচ্ছা! তিবরিয়্যাহ (শাম দেশে অবস্থিত) নামক সমুদ্রের ব্যাপারে আমাকে অবগত কর। আমরা বললাম, এর কোন্ বিষয় সম্পর্কে তুই আমাদের থেকে জানতে চাচ্ছিস? সে বলল, এর মধ্যে পানি আছে কি? তারা বলল, হ্যাঁ, সেখানে বহু পানি আছে। অতঃপর সে বলল, সেদিন বেশি দূরে নয়, যখন এ সাগরে পানি থাকবে না। সে আবার বলল, ‘যুগার’ (বাইতুল মাক্বদিছ)-এর ঝর্ণার ব্যাপারে তোমরা আমাকে অবহিত কর। তারা বলল, তুই এর কী সম্পর্কে আমাদের নিকট জানতে চাচ্ছিস? সে বলল, এর ঝর্ণাতে পানি আছে কি? আর এ জনপদের লোকেরা তাদের ক্ষেতে এ ঝর্ণার পানি দেয় কি? আমরা বললাম, হ্যাঁ, এতে অনেক পানি আছে এবং এ জনপদের লোকেরা এ পানির মাধ্যমেই তাদের ক্ষেত আবাদ করে। সে আবার বলল, তোমরা আমাকে উম্মীদের নবীর ব্যাপারে খবর দাও। সে এখন কী করছে? তারা বলল, তিনি মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় চলে এসেছেন। সে জিজ্ঞেস করল, আরবের লোকেরা তার সাথে যুদ্ধ করেছে কি? আমরা বললাম, হ্যাঁ, করেছে। সে বলল, সে তাদের সঙ্গে কিরূপ আচরণ করেছে। আমরা তাকে খবর দিলাম যে, তিনি আরবের পার্শ্ববর্তী এলাকায় জয়ী হয়েছেন এবং তারা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। সে বলল, এ কি হয়েই গেছে? আমরা বললাম, হ্যাঁ। সে বলল, বশ্যতা স্বীকার করে নেয়াই জনগণের জন্য কল্যাণকর ছিল’।[১২]

উপরিউক্ত হাদীছ থেকে একথা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, দাজ্জাল অদৃশ্যের খবর জানে না। পৃথিবীর বুকে কী ঘটছে সে সম্পর্কে দাজ্জাল মোটেও অবগত নয়। তাহলে যে সমস্ত বক্তাগণ বলছেন যে, দাজ্জালের কাছে পৃথিবীর সবকিছুরই খবর আছে, ইতিমধ্যেই সে দুনিয়ার অনেক কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে দিয়েছে, এ কথার ভিত্তি বা প্রমাণ কী? এই মন্তব্য কি উপরিউক্ত হাদীছের বিরোধী নয়?

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* মুর্শিদাবাদ, ভারত।

তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৭১২৮, ৩৪৪১, ৫৯০২, ৬৯৯৯, ৭০২৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৯, ১৭১।
[২]. মাজমূঊল ফাতাওয়া লিইবনি তাইমিয়্যাহ, ৩৫তম খণ্ড, পৃ. ১৩৭; মা‘আলিমুস সুনান, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২২৮ ও ৩য় খণ্ড, পৃ. ১০৪; আল-ক্বাউলুল মুফীদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৫২।
[৩]. আবু দাঊদ, হা/৩৯০৪; তিরমিযী, হা/১৩৫; নাসাঈ, হা/৯০১৭; ইবনু মাজাহ, হা/৬৩৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১০১৬৭; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩০৪৪, ৩০৪৮।
[৪]. ছহীহ মুসলিম, হা/২২৩০; ছহীহুল জামে‘, হা/৫৯৪০।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯০১ ‘কিতাবুল ফিতান’; আবূ দাঊদ, হা/৪৩১১; তিরমিযী, হা/২১৮৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৮৭।
[৬]. ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৪২৯৭০।
[৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৪৫; তিরমিযী, হা/৩৯৩০; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৭৬২০।
[৮]. আবূ দাঊদ, হা/৪২৯৪; সনদ হাসান, ছহীহুল জামে‘, হা/৪০৯৬; মিশকাত, হা/৫৪২৪; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, হা/৩৭২০৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২০২৩; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/১৬৬৩৮; মুসতাদরাক হাকিম, হা/৮২৯৭।
[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯০০; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫৪১; ছহীহুল জামে‘, হা/২৯৬৯; মিশকাত, হা/৫৪১৯; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৬৬৭২; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/১৮০১; আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৩৬৯১।
[১০]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯২০; ছহীহুল জামে‘, হা/৩৬৩৮; মুসতাদরাক হাকিম, হা/৮৪৬৯; মিশকাত, হা/৫৪২৩।
[১১]. ছহীহুল জামে‘, হা/৭৮৭৫, সনদ ছহীহ।
[১২]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৪২; আবূ দাঊদ, হা/৪৩২৫, ৪৩২৬; তিরমিযী, হা/২২৫৩; ইবনু মাজাহ, হা/৪০৭৪।




সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (২য় কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
হেদায়াত লাভের অনন্য মাস রামাযান - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
কালো কলপ ব্যবহারের শারঈ বিধান - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
আল-কুরআন এক জীবন্ত মু‘জিযা - আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইউনুস
শরী‘আত অনুসরণের মূলনীতি (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
বাউল মতবাদ (শেষ কিস্তি) - গোলাম রহমান
বিদ‘আত পরিচিতি (৯ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রেম ও ভালোবাসা - আব্দুল গাফফার মাদানী
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
মাদক : সুশীল সমাজ ধ্বংসের অন্যতম হাতিয়ার - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর

ফেসবুক পেজ