আল-কুরআনে মানুষ: মর্যাদা ও স্বরূপ বিশ্লেষণ
- ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ*
(শেষ কিস্তি)
বার. নিবোর্ধ প্রতারক
কিছু লোক আছে যারা প্রতারণা ও ভণ্ডামীতে লিপ্ত। নিজেদেরকে যদিও তারা চালাক মনে করে কিন্তু তাদের মাথায় ভুষি ছাড়া আর কিছুই নেই। তারা মানুষকে ঠকানোর চেষ্টা করে কিন্তু মূলত তারা নিজেরাই নিজেদের ঠকাচ্ছে। কুরআনের ভাষায়:
وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّقُوۡلُ اٰمَنَّا بِاللّٰہِ وَ بِالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَ مَا ہُمۡ بِمُؤۡمِنِیۡنَ- یُخٰدِعُوۡنَ اللّٰہَ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ۚ وَ مَا یَخۡدَعُوۡنَ اِلَّاۤ اَنۡفُسَہُمۡ وَ مَا یَشۡعُرُوۡنَ
‘আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে, যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান এনেছি; কিন্তু তারা মুমিন নয়। আল্লাহ এবং মুমিনদেরকে তারা প্রতারিত করতে চায়। অথচ তারা যে নিজেদেরকে ভিন্ন কাউকে প্রতারিত করে না, এটা তারা বুঝতে পারে না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ৮-৯)।
তের. তর্ক প্রিয়
মানুষ স্বভাবতই তর্ক প্রিয়। মানব উম্মেষকাল থেকে মুহাম্মাদ (ﷺ) পর্যন্ত তর্কের অস্তিত্ব বিদ্যমান। আল্লাহ রব্বুল আলামীন মানব সৃষ্টির সূচনালগ্নে একদল ফিরিশতার সাথে বিতাড়িত শয়তানের সাথে এবং বিভিন্ন উম্মত ও তার কাওমের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিতর্কের বর্ণনা পবিত্র কুরআনুল কারীমে বিধৃত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, وَ کَانَ الۡاِنۡسَانُ اَکۡثَرَ شَیۡءٍ جَدَلًا ‘মানুষ অধিকাংশ ব্যাপারে তর্ক প্রিয়’ (সূরা আল-কাহফ: ৫৪)।
চৌদ্দ. ঝগড়াটে
কিছু লোক আছে যারা ঝগড়া করতে পসন্দ করে। সত্য হোক কিংবা মিথ্যা, জেনে হোক কিংবা না জেনে ঝগড়া বা গণ্ডগোল তারা করবেই। কুরআনে এসেছে,
ہٰۤاَنۡتُمۡ ہٰۤؤُلَآءِ حَاجَجۡتُمۡ فِیۡمَا لَکُمۡ بِہٖ عِلۡمٌ فَلِمَ تُحَآجُّوۡنَ فِیۡمَا لَیۡسَ لَکُمۡ بِہٖ عِلۡمٌ ؕ وَ اللّٰہُ یَعۡلَمُ وَ اَنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ
‘হ্যাঁ, তোমরা তো সেসব লোক, যে বিষয়ে তোমাদের সামান্য জ্ঞান আছে সে বিষয়ে তোমরাই তো তর্ক করেছ, তবে যে বিষয়ে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই সে বিষয়ে কেন তর্ক করছ? আল্লাহ জ্ঞাত আছেন এবং তোমরা জ্ঞাত নও’ (সূরা আল-ইমরান: ৬৬)। এমর্মে অন্যত্রে ইরশাদ হয়েছে, وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یُّجَادِلُ فِی اللّٰہِ بِغَیۡرِ عِلۡمٍ وَّ لَا ہُدًی وَّ لَا کِتٰبٍ مُّنِیۡرٍ ‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ সম্বন্ধে বিতন্ডা করে, তাদের না আছে জ্ঞান, না আছে পথ নির্দেশ, না আছে কোন দীপ্তিমান কিতাব’ (সূরা আল-হজ্জ: ৮)।
পনের. বিপর্যয় সৃষ্টিকারী
কতক মানুষের স্বভাব হলো সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি করার মাধ্যমে শান্তি বিঘ্নিত করা। তারা না জেনে ও না বুঝে অনেক সময় এ ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টির পায়তারা করে। যখন তাদেরকে এ থেকে বিরত থাকতে বলা হয় তখন তারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
وَ اِذَا قِیۡلَ لَہُمۡ لَا تُفۡسِدُوۡا فِی الۡاَرۡضِ ۙ قَالُوۡۤا اِنَّمَا نَحۡنُ مُصۡلِحُوۡنَ- اَلَاۤ اِنَّہُمۡ ہُمُ الۡمُفۡسِدُوۡنَ وَ لٰکِنۡ لَّا یَشۡعُرُوۡنَ
‘তাদেরকে যখন বলা হয়, প্রথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করো না। তারা বলে, আমরাই তো শান্তি স্থাপনকারী। সাবধান! এরাই অশান্তি সৃষ্টিকারী। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১১-১২)।
ষোল. ওজর আপত্তিকারী
মানব জীবনের যাবতীয় কার্যাবলী সাধারণত দু’টি অবস্থায় সংঘটিত হয়। একটি সহজ অবস্থা অপরটি হলো কঠিন অবস্থা বা দুঃখ দুর্দশাগ্রস্ত হওয়া। মানুষ সর্বদা সহজতর অবস্থা কামনা করে থাকে। কিন্তু যখনই কোন কাঠিন্য ও দুঃখ-দুর্দশা তাকে স্পর্শ করে তখন সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং মিথ্যা ওজর-আপত্তি পেশ করে তা থেকে বিরত থাকর চেষ্টা করে। আল-কুরআনে নিম্নোক্তভাবে বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে,
لَوۡ کَانَ عَرَضًا قَرِیۡبًا وَّ سَفَرًا قَاصِدًا لَّاتَّبَعُوۡکَ وَ لٰکِنۡۢ بَعُدَتۡ عَلَیۡہِمُ الشُّقَّۃُ ؕ وَ سَیَحۡلِفُوۡنَ بِاللّٰہِ لَوِ اسۡتَطَعۡنَا لَخَرَجۡنَا مَعَکُمۡ ۚ یُہۡلِکُوۡنَ اَنۡفُسَہُمۡ ۚ وَ اللّٰہُ یَعۡلَمُ اِنَّہُمۡ لَکٰذِبُوۡنَ
‘আশু সম্পদ লাভের সম্ভাবনা থাকলে ও সফর সহজ হলে তারা নিশ্চয় তোমার অনুসরণ করত, কিন্তু তাদের নিকট যাত্রাপথ সুদীর্ঘ মনে হল। তারা অচিরেই আল্লাহর নামে শপথ করে বলবে, পারলে আমরা নিশ্চয় তোমাদের সাথে বের হতাম। তারা নিজেদেরকে ধ্বংস করে। আল্লাহ জানেন তারা অবশ্যই মিথ্যাবাদী’ (সূরা আত-তাওবাহ: ৪২)।
সতের. ভীতু বেহায়া
ভয়-ভীতি মানুষের প্রাকৃতিক স্বভাব বটে। কিন্তু এ ভীতির সঙ্গে অনেক সময় নির্লজ্জ ও ভীতু বেহায়া স্বভাবে পরিণত করে। বস্তুত মিথ্যা আশ্রয় নেয়ার জন্য এটি মানুষের অন্যতম কূটকৌশল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ لَوۡ تَرٰۤی اِذۡ وُقِفُوۡا عَلَی النَّارِ فَقَالُوۡا یٰلَیۡتَنَا نُرَدُّ وَ لَا نُکَذِّبَ بِاٰیٰتِ رَبِّنَا وَ نَکُوۡنَ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ- بَلۡ بَدَا لَہُمۡ مَّا کَانُوۡا یُخۡفُوۡنَ مِنۡ قَبۡلُ ؕ وَ لَوۡ رُدُّوۡا لَعَادُوۡا لِمَا نُہُوۡا عَنۡہُ وَ اِنَّہُمۡ لَکٰذِبُوۡنَ
‘তুমি যদি দেখতে পেতে যখন তাদেরকে অগ্নির পাশে দাঁড় করানো হবে এবং তারা বলবে, হায়! যদি আমাদের প্রত্যাবর্তন ঘটত তবে আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনকে অস্বীকার করতাম না এবং আমরা মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। না, পূর্বে তারা যা গোপন করত তা যখন তাদের নিকট প্রকাশ পেয়েছে এবং তারা প্রত্যাবর্তিত হলেও যা করবে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল পুনরায় তারা তাই করত। আর নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী’ (সূরা আল-আন‘আম: ২৭-২৮)।
আঠার. স্বেচ্ছাচারী
অহংকারবশে মানুষ অনেক সময় স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে। এরা নিজেদেরকে কোন নির্দিষ্ট পথের পথিক কিংবা কোন দল বা জামা‘আতের অন্তর্ভুক্তও মনে করে না। এ মর্মে কুরআনে এসেছে, اَوَ کُلَّمَا عٰہَدُوۡا عَہۡدًا نَّبَذَہٗ فَرِیۡقٌ مِّنۡہُمۡ ؕ بَلۡ اَکۡثَرُہُمۡ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ ‘তবে কি যখনই তারা অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে, তখনই তাদের কোন একদল তা ভঙ্গ করেছে? বরং তাদের অধিকাংশই বিশ্বাস করে না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১০০)।
উনিশ: গোঁয়ার ও স্থবির প্রকৃতির
সমাজে এমন এক শ্রেণীর মানুষ রয়েছে যারা অত্যন্ত গোঁয়ার এবং স্থবির প্রকৃতির। তারা নিজেরা যা বুঝে অন্যেরা তার ধারে পৌঁছাতেও সক্ষম নয় বলে ধারণা পোষণ করে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ ধরনের গোর্য়াতুমির জন্যই একশ্রেণীর মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়া থেকে বঞ্চিত ছিল। মনে হয় যেন তাদের পা গুলো পাথর দিয়ে তৈরি। তারা এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কোন চেষ্টা করেনি। মহান আল্লাহ তাদের স্বরূপ সম্পর্কে বলেন,
وَ اِذَا قِیۡلَ لَہُمُ اتَّبِعُوۡا مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ قَالُوۡا بَلۡ نَتَّبِعُ مَاۤ اَلۡفَیۡنَا عَلَیۡہِ اٰبَآءَنَا ؕ اَوَ لَوۡ کَانَ اٰبَآؤُہُمۡ لَا یَعۡقِلُوۡنَ شَیۡئًا وَّ لَا یَہۡتَدُوۡنَ
‘আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা তোমরা অনুসরণ কর, তারা বলে, না বরং আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে যাতে পেয়েছি তার অনুসরণ করব। এমনকি তাদের পিতৃপুরুষগণ যদিও কিছু বুঝত না এবং তারা সৎপথে পরিচালিত ছিল না, তথাপিও?’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৭০)।
বিশ. পার্থিব জীবনের মোহে মোহগ্রস্ত
এমন কিছু লোক আছে যারা পার্থিব জীবনকেই বেশী গুরুত্ব দেয়। যেখানেই থাকুক না কেন জৈবিক চাহিদাটাই তাদের কাছে বড়। তারা একে এত বেশী গুরুত্ব দেয়, প্রয়োজনে লাঞ্চনার জীবন যাপন করতে রাজি তথাপিও দুনিয়ার সহায়-সম্পদ ও লোভ-লালসায় মত্ত থাকা থেকে বিরত থাকতে পারে না। ইরশাদ হয়েছে,
وَ لَتَجِدَنَّہُمۡ اَحۡرَصَ النَّاسِ عَلٰی حَیٰوۃٍ ۚۛ وَ مِنَ الَّذِیۡنَ اَشۡرَکُوۡا ۚۛ یَوَدُّ اَحَدُہُمۡ لَوۡ یُعَمَّرُ اَلۡفَ سَنَۃٍ ۚ وَ مَا ہُوَ بِمُزَحۡزِحِہٖ مِنَ الۡعَذَابِ اَنۡ یُّعَمَّرَ ؕ وَ اللّٰہُ بَصِیۡرٌۢ بِمَا یَعۡمَلُوۡنَ
‘তুমি নিশ্চয় তাদেরকে জীবনের প্রতি সহজ সমস্ত মানুষ, এমনকি মুশরিক অপেক্ষা অধিক লোভী দেখতে পাবে। তাদের প্রত্যেক আকাক্সক্ষা করে যদি সহস্র বছর আয়ু দেয়া হত; কিন্তু দীর্ঘায়ু তাকে শান্তি হতে দূরে রাখতে পারবে না। তারা যা করে আল্লাহ তার দ্রষ্টা’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ৯৬) । অন্যত্র আরো বর্ণিত হয়েছে, اِنَّ ہٰۤؤُلَآءِ یُحِبُّوۡنَ الۡعَاجِلَۃَ وَ یَذَرُوۡنَ وَرَآءَہُمۡ یَوۡمًا ثَقِیۡلًا ‘নিশ্চয় তারা ভালোবাসে পার্থিব জীবনকে এবং তারা পরবর্তী কঠিন দিবসকে উপেক্ষা করে চলে’ (সূরা আল-ইনসান/আদ-দাহর: ২৭)।
একুশ: কৃপণ
যারা প্রয়োজনের মুহূর্তে খরচ করে না, তারা কৃপণ। যদি কেউ খরচ করার পর ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন সে বিজয়ের হাসি হেসে বলে, যাক! আমি খরচ না করে ভালোই করেছি। আমার টাকাগুলো রয়ে গেল। আর যদি জিহাদে কোন কল্যাণ লাভ হয় তখন আক্ষেপ করে বলে, হায়! যদি আমিও খরচ করতাম তবে লাভ হত। ইরশাদ হয়েছে,
وَ اِنَّ مِنۡکُمۡ لَمَنۡ لَّیُبَطِّئَنَّ ۚ فَاِنۡ اَصَابَتۡکُمۡ مُّصِیۡبَۃٌ قَالَ قَدۡ اَنۡعَمَ اللّٰہُ عَلَیَّ اِذۡ لَمۡ اَکُنۡ مَّعَہُمۡ شَہِیۡدًا- وَ لَئِنۡ اَصَابَکُمۡ فَضۡلٌ مِّنَ اللّٰہِ لَیَقُوۡلَنَّ کَاَنۡ لَّمۡ تَکُنۡۢ بَیۡنَکُمۡ وَ بَیۡنَہٗ مَوَدَّۃٌ یّٰلَیۡتَنِیۡ کُنۡتُ مَعَہُمۡ فَاَفُوۡزَ فَوۡزًا عَظِیۡمًا
‘তোমাদের মধ্যে এমন কতক লোক আছে, যে গড়িমসি করবেই। তোমাদের কোন মুসীবত হলে সে বলবে, তাদের সঙ্গে না থাকায় আল্লাহ আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ হলে, যেন তোমদের ও তার মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই এমনভাবে বলবেই, হায়! যদি তাদের সাথে থাকতাম তবে আমিও বিরাট সাফল্য লাভ করতাম’ (সূরা আন-নিসা: ৭২-৭৩)।
বাইশ. ভেতর ও বাইরের বৈপরীত্য
কিছু লোক আছে যাদের বাইরের ও ভেতরের কোন মিল নেই। মনে হয় সে একজন নয় দু’জন মানুষ। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন,
وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یُّعۡجِبُکَ قَوۡلُہٗ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ یُشۡہِدُ اللّٰہَ عَلٰی مَا فِیۡ قَلۡبِہٖ ۙ وَ ہُوَ اَلَدُّ الۡخِصَامِ- وَ اِذَا تَوَلّٰی سَعٰی فِی الۡاَرۡضِ لِیُفۡسِدَ فِیۡہَا وَ یُہۡلِکَ الۡحَرۡثَ وَ النَّسۡلَ ؕ وَ اللّٰہُ لَا یُحِبُّ الۡفَسَادَ
‘আর মানুষের মধ্যে এমন ব্যক্তি আছে, পার্থিব জীবন সম্পর্কে যার কথাবার্তা তোমাকে চমৎকার করে এবং তার অন্তরে যা আছে সে সম্বন্ধে সে আল্লাহকে সাক্ষী রাখে। প্রকৃতপক্ষে সে ভীষণ কলহপ্রিয়। যখন সে প্রস্থান করে তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টির এবং শষ্যক্ষেত্র ও জীবজন্তু নিপাতের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ অশান্তি পসন্দ করেন না’ (সূরা আল বাক্বারাহ: ২০৪-২০৫)।
তেইশ. স্বল্প বুদ্ধি সম্পন্ন
কিছু লোক এমন স্বল্প বুদ্ধির হয়ে থাকে, তাদের সামনে কী বলা হলো না হলো সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। কুরআনের ভাষায়, وَ مِنۡہُمۡ مَّنۡ یَّسۡتَمِعُ اِلَیۡکَ ۚ حَتّٰۤی اِذَا خَرَجُوۡا مِنۡ عِنۡدِکَ قَالُوۡا لِلَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡعِلۡمَ مَاذَا قَالَ اٰنِفًا ‘তাদের মধ্যে কতক লোক আপনার কথার দিকে কান পাতে ঠিকই কিন্তু বাইরে বের হওয়া মাত্র যারা শিক্ষিত তাদেরকে বলে: এই মাত্র তিনি কী বললেন?’ (সূরা মুহাম্মাদ: ১৬)।
চবিবশ: মুমূর্ষু অবস্থায় তাওবাকারী
তাওবা (توبة) অর্থ অনুশোচনা, অনুতাপ, প্রত্যাবর্তন, ক্ষমা।[১] মানুষ সাধারণত অপরাধ প্রবণ। কোন না কোনভাবে সে অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। মহান আল্লাহ তা থেকে পরিত্রাণের জন্য তাওবার ব্যবস্থা রেখেছেন। আর এটি অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পরপরই তাৎক্ষণিকভাবে করতে হয়। অথচ কতিপয় লোক ইচ্ছে মাফিক গোটা জিন্দেগী অন্যায় পথে যাপন করে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তাওবা করে। কিন্তু তাদের এ তাওবা গ্রহণযোগ্য নয়। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে,
اِنَّمَا التَّوۡبَۃُ عَلَی اللّٰہِ لِلَّذِیۡنَ یَعۡمَلُوۡنَ السُّوۡٓءَ بِجَہَالَۃٍ ثُمَّ یَتُوۡبُوۡنَ مِنۡ قَرِیۡبٍ فَاُولٰٓئِکَ یَتُوۡبُ اللّٰہُ عَلَیۡہِمۡ ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ عَلِیۡمًا حَکِیۡمًا- وَ لَیۡسَتِ التَّوۡبَۃُ لِلَّذِیۡنَ یَعۡمَلُوۡنَ السَّیِّاٰتِ ۚ حَتّٰۤی اِذَا حَضَرَ اَحَدَہُمُ الۡمَوۡتُ قَالَ اِنِّیۡ تُبۡتُ الۡـٰٔنَ وَ لَا الَّذِیۡنَ یَمُوۡتُوۡنَ وَ ہُمۡ کُفَّارٌ ؕ اُولٰٓئِکَ اَعۡتَدۡنَا لَہُمۡ عَذَابًا اَلِیۡمًا
‘আল্লাহ অবশ্যই সেসব লোকদের তাওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে এবং সত্বর তওবা করে। এরাই তারা, যাদের তওবা আল্লাহ কবুল করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। তওবা তাদের জন্য নয় যারা আজীবন মন্দ কাজ করে। অবশেষে তাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হলে সে বলে, আমি এখন তওবা করছি এবং তাদের জন্য নয় যাদের মৃত্যু হয় কাফির অবস্থায়। এরাই তারা যাদের জন্য মর্মান্তুদ শাস্তির ব্যবস্থা করেছি’ (সূরা আল-নিসা: ১৭-১৮)।
পঁচিশ. তাড়াহুড়া প্রিয়
মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই ত্বরাপ্রবণ। কোন কর্মের ত্বরিত ফলভোগে বিশ্বাসী। ফলে সর্বদা তাড়াহুড়া করে কোন কিছু অর্জনকেই বেশী প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তবে এটি সমুচিত নয়। আল-কুরআনে এ চরিত্রের বর্ণনায় এসেছে, خُلِقَ الۡاِنۡسَانُ مِنۡ عَجَلٍ ؕ سَاُورِیۡکُمۡ اٰیٰتِیۡ فَلَا تَسۡتَعۡجِلُوۡنِ ‘মানুষ সৃষ্টিগতভাবে ত্বরাপ্রবণ, শীঘ্রই আমি তোমাদেরকে আমার নির্দেশাবলী দেখাব; সুতরাং তোমরা আমাকে ত্বরা করতে বলো না’ (সূরা আল-আম্বিয়া: ৩৭)। অন্যত্র মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, وَ کَانَ الۡاِنۡسَانُ عَجُوۡلًا ‘মানুষতো অতি মাত্রায় ত্বরাপ্রিয়’ (সূরা বনী ইসরাইল: ১১)।
পরিশেষে বলা যায় যে, মানুষ এমন এক প্রাণী যাকে মহান আল্লাহ নিজের পসন্দ মোতাবেক সৃষ্টি করেছেন, বানিয়েছেন দুনিয়ায় তার খলিফা বা প্রতিনিধি। তার প্রকৃতির মধ্যে রয়েছে আল্লাহকে চেনার, তার স্বরূপ উপলব্ধির যোগ্যতা। মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন, তার মধ্যে রয়েছে বিশ্বস্ততা এবং নিজের প্রতি ও সারা বিশ্বের প্রতি দায়িত্বানুভুতি। প্রকৃতি, আকাশ ও পৃথিবীর উপর আধিপত্য বিস্তারের যোগ্যতা দান করে মানুষকে করা হয়েছে ধন্য ও মহিমান্বিত। মানুষের মধ্যে রয়েছে ভাল ও মন্দের প্রতি ঝোক প্রবাণতা। মহত্ব ও মর্যাদাার সহজাত গুণাবলী। মানুষের যোগ্যতা ও সামর্থ্য সীমাহীন জ্ঞান অর্জন ও অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগ ও উভয় ক্ষেত্রেই। মহান আল্লাহর অসংখ্য নে‘মতপ্রাপ্ত এ প্রাণীর আল্লাহ এবং আল্লাহ কেন্দ্রিক চিন্তাাধারা ছাড়া অন্য কোন কিছুর লালন সমূচিত নয়। পবিত্র কুরআনে তাদের সৃষ্টির রহস্য, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কর্মপন্থা ও প্রদত্ত নে‘আমতরাজির বর্ণনাসহ স্ব-নামে (ইনসান) একটি সূরার অবতারণা হয়েছে, যার নির্দেশনার অনুসরণ ও অনুকরণে মানুষ পেতে পারে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি। এ মর্মে মহান আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছে, اِنَّ ہٰذِہٖ تَذۡکِرَۃٌ ۚ فَمَنۡ شَآءَ اتَّخَذَ اِلٰی رَبِّہٖ سَبِیۡلًا ‘ইহা এক উপদেশ, অতএব, যার ইচ্ছা সে তার প্রতিপালকের দিকে পথ অবলম্বন করুক’ (সূরা আল-ইনসান: ২৯)।
আলোচ্য প্রবন্ধে মানুষের স্বরূপ উদঘাটনে যেসব আয়াতের উল্লেখ করা হয়েছে মূলত তার অধিকাংশই একটি বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের জীবন্ত ও বাস্তব এমন কিছু চিত্র অংকিত হয়েছে যা বিষয়বস্তুর দিক থেকে অলৌকিক ও চিরন্তর। কেননা এ চিত্রগুলো স্থান ও কালের আবর্তনে শতাব্দীর পর শতাব্দী চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছে এবং তা সর্বদাই জীবন্ত, প্রাণবন্ত ও মূর্তমান।
* সহকারী অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা), সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা।
[১] ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩৪।
প্রসঙ্গসমূহ »:
কুরআনুল কারীম