মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৬:৫৭ পূর্বাহ্ন

আল-কুরআনুল কারীম : শৈল্পিক সৌন্দর্য বিশ্লেষণ

-প্রফেসর এ কে এম শামসুল আলম*


কুরআন আল্লাহর কালাম। ইসলামী বিধি-বিধানের মৌলিক  উৎস। কুরআন পড়া, অনুধাবন করা এবং জীবনে বাস্তবায়ন করা সৌভাগ্যের বিষয়। কুরআন বাস্তব জ্ঞানের একটি পরিপূর্ণ কিতাব। এর মধ্যে অবাস্তব ও অপ্রাসঙ্গিক একটি কথাও নেই। এতে কোন সন্দেহ ও সংশয় নেই। এর প্রতিটি বর্ণ, শব্দ এবং ভাবার্থ সবই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে জিবরীল মারফত শেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী এবং রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর অবতীর্ণ। রাসূল (ﷺ)-এর নিকট থেকে সাহাবায়ে কেরাম অতঃপর বিশ্ববাসী এই মূল্যবান কিতাব অবগত হয়েছেন।

ইসলামের মৌলিক গ্রন্থ আল-কুরআনুল কারীম দ্বীনি তা‘লিমাতের মৌল উৎস। এ ছাড়া ইসলাম অবিকৃত থাকে না এবং মহান রবের নিকট তা গৃহীতও হয় না। মহান আল্লাহ বলেন, وَ مَنۡ یَّبۡتَغِ غَیۡرَ الۡاِسۡلَامِ دِیۡنًا فَلَنۡ یُّقۡبَلَ مِنۡہُ ۚ وَ ہُوَ فِی الۡاٰخِرَۃِ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ ‘কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনও কবূল করা হবে না এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ৮৫)।

কুরআনই সংবিধান এবং মানহাজ। মুসলিম উম্মাহর হিদায়াতের জন্য বিশেষ জ্যোতিস্বরূপ। এটি মুসলিম জাতির জীবনের শ্রেষ্ঠ পাথেয়।

ওলামায়ে কেরাম তাদের গবেষণায় এবং কুরআনের আলোকে কুরআনের কতিপয় নাম উল্লেখ করেছেন। ড. খামসায়ীর মতে কুরআনের নাম রয়েছে ৯৯টি এবং এই নামগুলো ৭২টি মূল শব্দ থেকে উৎসারিত। ফাইরোযাবাদী অভিধানে ৯০টি নাম রয়েছে। কোন কিছুর বহু সংখ্যক নাম ঐ জিনিসের গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলে। আল্লাহর ৯৯টি গুণবাচক নাম আল্লাহর মহত্ত্ব ও বড়ত্বের প্রতীক। রাসূলের বহু সংখ্যক নাম রাসূলের শানকে আরো মর্যাদার স্বর্ণ শিখরে ও শীর্ষে নিয়ে গেছে। কুরআনের বহু সংখ্যক নাম মূলত কুরআনেই উল্লিখিত হয়েছে। যেমন, আল-কিতাব, আল-ফুরকান, আয-যিকর, আন-নূর, আত-তানযীল।

রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি এক দফায় এটি অবতীর্ণ হয়নি, বরং ২৩ বছরের নবুওয়াতী জীবনে বহু দফায় অবতীর্ণ হয়েছে। মাহে রামাযানে কদরের রাতে পূর্ণ কুরআন নাযিল হয় লাওহে মাহফূয থেকে প্রথম আসমানে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অন্তরকে সুদৃঢ় করতে এবং বাতিলপন্থীদের অসাড় যুক্তিসমূহ নিশ্চিহ্ন করাই কুরআন নাযিলের অন্যতম লক্ষ্য। কুরআনে বর্ণিত অকাট্য দলীল প্রমাণাদির মুকাবেলায় বাতিলপন্থীদের ভিত্তিহীন যুক্তি হাস্যকর ছিল। তাই অল্প সময়ে কুরআনের দ্রুত প্রসার ঘটে।

কুরআনে বর্ণিত শারঈ আহকাম শরী‘আত পন্থীদের সুবিধার্থে পর্যায়ক্রমে অবতীর্ণ হয়েছে। এছাড়া কুরআন যে রাসূলের পক্ষ থেকে রচিত নয় বরং সুস্পষ্টই মহান রবের বাণী পর্যায়ক্রমে নাযিল হওয়ায় তাও প্রতীয়মান হয়েছে। এটি বান্দার প্রতি আল্লাহর ইহসানও বটে।

কুরআনের বৈশিষ্ট্যসমূহ

কুরআনের মর্যাদা আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত এবং অন্যান্য আসমানী গ্রন্থ হতে এটি স্বতন্ত্র ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বৈশিষ্ট্যসমূহ হল-

১. হেদায়াতের পরিপূর্ণ মূলনীতি।
২. পরিপূর্ণ মানহাজে রব্বানী।
৩. মানুষের ইহ-পারকালীন কল্যাণ বাস্তবায়ন করা।
৪. সঠিক পথের সুস্পষ্ট ও বিশদ আসমানী কিতাব, যা মানব জাতির কল্যাণে পরিপূর্ণ।
৫. প্রত্যেক যুগের সব মানুষের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য দিকনির্দেশনা।
৬. নবী (ﷺ)-এর জন্য চিরন্তন মু‘জিযা।
৭. এটি তেলাওয়াত এবং এর উপর আমল করার জন্য সবচেয়ে সহজ কিতাব।
৮. এই কিতাবে পরস্পর বিরোধী কোন বক্তব্য নেই।
৯. এর প্রতিটি শব্দ বিন্যাস, বাক্যগঠন, বক্তব্যের নিপূন শৈলি, তেলাওয়াত শ্রুতিমধুর, সহজভঙ্গী, সাবলীল বিষয়বস্তু। সর্বোপরি মানবজাতির মুক্তির নিমিত্তে মানবিক ও প্রাণবন্ত সংবিধান।

কুরআন কোন জাতি-গোষ্ঠী, সময়কাল বা ভৌগোলিক অঞ্চলের জন্য নির্দিষ্ট নয় বরং আগ্রহী যে কোন পাঠকের মনে পরিত্রাণের জন্য কুরআন একটি অনুপম আসমানী কিতাব। সংক্ষেপে কুরআন অতি প্রাসঙ্গিক বিস্ময়কর একটি আসমানী কিতাব। মানুষের ব্যক্তি জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র, নর-নারী, শিশু, তরুণ, বৃদ্ধ, গোত্র-গোষ্ঠী, দেশ-অঞ্চল, শুস্ক, পানি, আকাশ-বাতাস, মেঘমালা, আলো-আধার, ঝড়-তুফান সবই এই কিতাবে অতি চমৎকার ভঙ্গিতে বিবৃত হয়েছে।

মানুষের সৃষ্টি রহস্য, কলব-নফস ও রূহ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে এতে। এমনকি মানুষের বিবেক বুদ্ধি নিয়েও সুস্পষ্ট সম্বোধন রয়েছে। বিবেক ও বুদ্ধি উভয়কেই অতি সুন্দর ও সাবলীল ভঙ্গিতে সম্বোধন করে এত আকর্ষণীয় নির্দেশনা রয়েছে যে, কেউ উন্নত আদর্শ রপ্ত করতে চাইলে মডেল হিসাবে রাসূলের আদর্শ তুলে ধরা হয়েছে। মানব জাতির প্রতি সম্বোধন, বিবেক জাগানিয়া সম্বোধন রয়েছে যেন ‘কলব’ ও ‘আকল’ এক সাথেই সুপথে একনিষ্ঠ হয়ে কাজ করতে সক্ষম হয়। যে কেউ শরী‘আতের বিধান শুনলে বা কুরআন শ্রবণ কালে অমনোযোগী হলে তার হেদায়াত নসীব নাও হতে পারে। তাই মহান রব এরশাদ ফরমান, اِلَّا مَنۡ اَتَی اللّٰہَ بِقَلۡبٍ سَلِیۡمٍ  অন্যত্র বলা হয়েছে, اَوۡ اَلۡقَی السَّمۡعَ وَ ہُوَ شَہِیۡدٌ। এসব উদ্ধৃতির মূল কথা হল, নিবিষ্টচিত্তে গভীর মনোযোগের সাথে কুরআন শ্রবণ এবং অনুধাবন অপরিহার্য।

কুরআন প্রত্যাখ্যান বিষয়ে একটি ভুল ধারণা অনেকেরই আছে। যারা মনোযোগ দিয়ে শোনে না, কুরআনের সুস্পষ্ট আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘন করে, কুরআনে বর্ণিত হালাল-হারাম উপেক্ষা করে, কুরআনের নির্দেশ ও নিষেধাদি জনগণের মাঝে প্রচার-প্রসারে উদাসীন থাকে, দ্বীনের মৌলিক ও শাখাগত নীতিসমূহ অবহেলা করে, যাদের কুরআন অনুধাবন করার যোগ্যতা আছে কিন্তু বৈষয়িক বিষয়ে অতি ব্যস্ত থাকার অযুহাতে অনুধাবন যথাযথভাবে বুঝার চেষ্টা করেন না এবং কুরআনে বর্ণিত রোগ নিরাময় পন্থাকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে।

কুরআন তেলাওয়াত

কুরআন তেলাওয়াত একটি অন্যতম ইবাদত। কুরআন মানব জাতির জন্য সেরা হেদায়াত। সারা পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কিতাব, যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কুরআনই মুসলিম মিল্লাতের সংবিধান। মানুষের জীবনের সমূহ উপলক্ষের প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ আসমানী কতাব। জন্ম, দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, বিয়ে-শাদি, উত্তরাধিকার আইন, ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঋণ সব কিছুর সাবলীল বিধান। নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াতে পাঠক শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পায়।

‘কুরআনের মতন’ (Text)

কোন ভূমিকা ছাড়াই অভিনব কিতাব কোথাও বিষয়বস্তুর শিরোনাম নেই। এটা গদ্য বা পদ্য রীতির কোনাটই ধারণ করে না।

১১৪টি সূরা, তিরিশটি জুয। কিছু মাক্কী কিছু মাদানী সূরা ও আয়াত কোন কোনটি মাক্কী ও মাদানী উভয়ই।

কুরআন কারীমের কতিপয় বিশেষণ

রূহ- সূরা আশ-শূরা, আয়াত : ৫২

হাদী- সূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত : ৯

কিতাবুল হক্ক- সূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত : ১০৫

নূর- সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত : ১৫

শেফা- সূরা আল-ফুসসিলাত, আয়াত : ৪৪

আল-কুরআন থেকে অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে

ইলমু নুযূলিল কুরআন, ইলমুত তাফসীর, ইলমুল বালাগাহ, ইলমুল ইসতিখরাজ আহকামিল কুরআন, ইলমুত তা’ভীল, ইলমুল মুহকাম-মুতাশাবিহ, ইলমুল উসূল, ইলমুত তরজমা, ইলমুত তিলাওয়াহ ও তাজবীদ, ইলমুর রসম ও খাত্ত্ব।

কুরআন ছাড়া জীবন অর্থহীন। আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ)-কে তিনি বলতে শুনেছেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ ফরমিয়েছেন, ফেতনার যুগ শুরু হবে। আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, বাঁচার পথ কী? তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কিতাব’। এতে তোমাদের পূর্বের যুগের মানুষের তথ্যাদি রয়েছে। পরবর্তী যুগের মানুষের খবরাদি রয়েছে। তোমাদের সময়ে করণীয় বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং কুরআনের নির্দেশনাই চূড়ান্ত। কোনরূপ ঠাট্টা-মশকরা বা রূপকথা নেই এতে। অহংকারবশত কুরআন পরিত্যাগকারীদেরকে আল্লাহ চুরমার করবেন। কুরআন ছাড়া অন্য কিছুতে যারা হেদায়াত তালাশ করবে আল্লাহ তাদেরকে পথহারা করবেন। কুরআনই আল্লাহর সুদৃঢ় মজবুত রশি। এটিই বিজ্ঞানময় উপদেশবাণী। এইটিই সিরাতে মুস্তাক্বীম।[১]

কুরআন অনুসরণে কেউ বক্রতাগ্রস্ত হয় না। নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াতকারী কখনও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে না। কুরআন চর্চায় লিপ্ত আলেমগণ কখনও এর প্রতি আকর্ষণ হারান না। বার বার কুরআন তিলাওয়াতেও কুরআনের চমক ম্লান হয় না। এই সেই কুরআন যা শুনে জিন্নরা বলেছিল, আমরা বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি। আল্লাহর বাণী,

قُلۡ  اُوۡحِیَ  اِلَیَّ  اَنَّہُ  اسۡتَمَعَ  نَفَرٌ مِّنَ الۡجِنِّ فَقَالُوۡۤا  اِنَّا سَمِعۡنَا قُرۡاٰنًا عَجَبًا -یَّہۡدِیۡۤ  اِلَی الرُّشۡدِ فَاٰمَنَّا بِہٖ ؕ وَ لَنۡ نُّشۡرِکَ بِرَبِّنَاۤ   اَحَدًا

বলুন, আমার প্রতি অহী প্রেরিত হয়েছে যে, জিন্নদের একটি দল মনোযোগ সহকারে কুরআন শ্রবণ করেছে এবং বলেছে আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শ্রবণ করেছি, যা সঠিক পথ নির্দেশ করে; তাই আমরা এতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনও আমাদের রবের কোন শরীক স্থাপন করব না’ (সূরা আল-জিন্ন : ১-২)।

কুরআন কারীমের সংজ্ঞা

উলামায়ে কেরাম বিভিন্নভাবে কুরআনের সংজ্ঞা চিত্রায়িত করেছেন। কয়েকটি অভিমত তুলে ধরা হল :

১. ‘ইসমু আলাম’। এখান থেকে কোন শব্দ উৎসারিত হয়নি। (গায়রে মুশতাক)

২. এ শব্দটি ইকরা ক্রিয়াপদের মুশতাক। ব্যাপক অর্থে পড়, শেখ, অনুধাবন কর, বুঝ, মুখস্থ রাখ, বহন কর, ইবাদতে মশগূল থাক। এ মতের বিশেষজ্ঞদের নিকট কুরআন ‘কারাআ’ ক্রিয়াপদের উৎস থেকে উৎসারিত। আল্লাহর বাণী,

اِنَّ عَلَیۡنَا جَمۡعَہٗ وَ قُرۡاٰنَہٗ - فَاِذَا قَرَاۡنٰہُ  فَاتَّبِعۡ  قُرۡاٰنَہٗ

‘কুরআন সংরক্ষণ ও পাঠ করাবার দায়িত্ব আমারই। সুতরাং যখন আমি তা পাঠ করি তুমি সেই পাঠের অনুসরণ কর। অতঃপর এর বিশদ ব্যাখ্যার দায়িত্ব আমারই’ (সূরা আল-ক্বিয়ামাহ : ১৭-১৯)।

কেউ কেউ  قرء এবং  قرن মূল শব্দ থেকেও কুরআন শব্দ গঠিত বলে অভিমত পেশ করেছেন। আল্লাহু আ‘লামু।

পারিভাষিক অর্থ : এটি আল্লাহর কালাম জিবরীল মারফত ২৩ বছরে শ্রেষ্ট নবী ও রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নিকট অবতীর্ণ সর্বশেষ আসমানী কিতাব। এই কিতাব পাঠে ইবাদত হয়। এর শব্দ ও অর্থ মু‘জিয অর্থাৎ এমন রচনা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়, সকলেই অক্ষম ও অপারগ। কুরআন রাসূলের যুগ থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত সবযুগেই অসংখ্য বর্ণনাকারী দ্বারা বর্ণিত এবং মাছহাফে লিপিবদ্ধ। কুরআন নাযিলের বিষয়টি তিনটি পর্যায়ে সংঘটিত হয়েছে।

১. লওহে মাহফূযে সংরক্ষণ
২. লায়লাতুল কদরে পরিপূর্ণ কুরআন আসমানে অবতীর্ণ হয়েছে।
৩. অতঃপর ২৩ বছরে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নিকট জিবরীল মারফত নাযিল হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নবুওয়াতকে সত্যায়ন করার নিমিত্তে মহান আল্লাহ কুরআন নাযিল করে রাসূলকে মহিমান্বিত ও মর্যাদাবান করেছেন। লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরাম রাসূলের কাছে থেকে কুরআন শুনে অন্তরে ধারণ করেছেন। সাহাবীদের নিকট থেকে তাবেঈগণ কুরআন অন্তরে ধারণ করেছেন। রিদ্দার যুদ্ধে অগণিত হাফেয শহীদ হলে প্রথম খলীফা আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কুরআন সংকলন ও সংরক্ষণের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন এবং তার জীবদ্দশায় তা সফলভাবে সম্পন্ন হয়। পরবর্তীকালে খলীফা ওসমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এর বেশ কটি কপি করে বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রেরণ করেন। ইস্তাম্বুলের জাতীয় যাদুঘরে এমন একটি কপি ১৯৯৩ সালে আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। ফালিল্লাহিল হামদ।

বিশুদ্ধ মতানুসারে কুরআনের আয়াত সংখ্যা ৬২৩৬। কুরআনুল কারীমের আয়াত সমূহ দু’ভাগে বিভক্ত। আল্লাহর বাণী,

ہُوَ الَّذِیۡۤ اَنۡزَلَ عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ مِنۡہُ اٰیٰتٌ مُّحۡکَمٰتٌ ہُنَّ اُمُّ  الۡکِتٰبِ وَ اُخَرُ مُتَشٰبِہٰتٌ ؕ فَاَمَّا الَّذِیۡنَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ زَیۡغٌ فَیَتَّبِعُوۡنَ مَا تَشَابَہَ مِنۡہُ ابۡتِغَآءَ الۡفِتۡنَۃِ وَ ابۡتِغَآءَ تَاۡوِیۡلِہٖ ۚ؃ وَ مَا یَعۡلَمُ  تَاۡوِیۡلَہٗۤ  اِلَّا اللّٰہُ  ۘؔ وَ الرّٰسِخُوۡنَ فِی الۡعِلۡمِ یَقُوۡلُوۡنَ اٰمَنَّا بِہٖ ۙ کُلٌّ  مِّنۡ عِنۡدِ رَبِّنَا ۚ وَ مَا یَذَّکَّرُ  اِلَّاۤ اُولُوا الۡاَلۡبَابِ

‘তিনিই তোমার প্রতি এ কিতাব অবতীর্ণ করেছেন যার কতক আয়াত ‘মুহকাম’, এগুলো কিতাবের মূল আর অন্যগুলো ‘মুতাশাবিহ’; যাদের অন্তরে সত্য লঙ্ঘন প্রবণতা রয়েছে শুধু তারাই ফিৎনা এবং ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে মুতশাবিহাতের অনুসরণ করে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর তারা বলে, আমরা এটি বিশ্বাস করি সমস্তই আমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে আগত এবং বোধশক্তি সম্পন্নরা ব্যতীত অপর কেউ শিক্ষাগ্রহণ করে না’ (সূরা আলে ইমরান : ৭)।

খৃষ্টানরা ঈসা (আলাইহিস সালাম)-কে রূহুল্লাহ ভুল অর্থ খোঁজে এটি যে তাদের বিপক্ষে যায় তা তারা অনুধাবন করতে অক্ষম। রূহুল্লাহ মুতাশাবিহ শব্দ, এর প্রকৃত অর্থ আল্লাহই ভাল জানেন। সূরা যুখরুফে ঈসা (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে,

اِنۡ ہُوَ اِلَّا عَبۡدٌ اَنۡعَمۡنَا عَلَیۡہِ وَ جَعَلۡنٰہُ  مَثَلًا   لِّبَنِیۡۤ   اِسۡرَآءِیۡلَ

‘সে তো ছিল আমারই এক বান্দা যাকে আমি অনুগ্রহ করেছিলাম এবং করেছিলাম বনী ইসরাঈলের জন্য দৃষ্টান্ত’ (সূরা আয-যুখরুফ : ৫৯)।

আল্লামা উছায়মীন ঢ় বলেন, মুহকাম আয়াতসমূহ বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না। যেমন আসমান-যমীন, চাঁদ-সুরুজ, ঠা-া-গরম, আলো-আধার, সাগর-মহাসাগর, পাহাড়-পর্বত, বৃক্ষলতা, জীবজগৎ, চতুষ্পদ জন্তু ইত্যাদি। এসব বুঝতে কারো সংশয় হয় না। মুতাশাবিহ জ্ঞানে প্রাজ্ঞরাও বুঝতে সংশয়ে পড়েন। সুন্নাহ ছাড়া মুতাশাবিহ আয়াতগুলো স্পষ্ট বুঝা যায় না। ‘আকীমুস সালাত’ মুতাশাবিহ আয়াতের উদাহরণ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শেখানো পদ্ধতি ছাড়া আকীমুস সালাত বোঝা যাবে না। বিশ্ববাসীর পরীক্ষার জন্যই এ দু’ধরনের আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে।

মুতাশাবিহ আয়াতের একটি উদাহরণ হল :

ثُمَّ لَمۡ تَکُنۡ فِتۡنَتُہُمۡ  اِلَّاۤ  اَنۡ قَالُوۡا وَ اللّٰہِ  رَبِّنَا مَا کُنَّا مُشۡرِکِیۡنَ

‘অতঃপর তাদের এ ছাড়া অন্য কিছু বলার অযুহাত থাকবে না। আমাদের প্রতিপালক আল্লাহর শপথ! আমরা তো  মুশরিক ছিলাম না’ (সূরা আল-আন‘আম : ২৩)।

الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ عَصَوُا الرَّسُوۡلَ لَوۡ تُسَوّٰی بِہِمُ الۡاَرۡضُ ؕ وَ لَا یَکۡتُمُوۡنَ اللّٰہَ  حَدِیۡثًا

‘যারা কুফুরী করেছে এবং রাসূলের অবাধ্য হয়েছে তারা সেদিন কামনা করবে যদি তারা মাটির সাথে মিশে যেত। আর তারা আল্লাহ হতে কোন কথায়ই গোপন করতে পারবে না’ (সূরা আন-নিসা : ৪২)।

উপরের আয়াত দু’টিতে এক শ্রেণীর মানুষ পরস্পর  বিরোধী বক্তব্য আছে বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু বিশেষ জ্ঞানী রাসেখুন আলেমগণ কোন সাংঘর্ষিক ভাব লক্ষ্য করেন না এবং তারা বলেন যে, সবই আল্লাহ তা‘আলার সুসামঞ্জস্যশীল বাণী। হৃদয়ে বক্রতা ও সত্য লংঘনের প্রবণতা আছে এমন ব্যক্তিরাই এতে অমিল ও অসামাঞ্জস্যতা খুঁজে পায়।

কিয়ামত দিবস হবে পার্থিব দিবসের হিসাবে পঞ্চাশ হাজার বছরের দিবস, যেদিনের বিভীষিকাময় পরিবেশে আগে পরে কোন্ কাফেরের মুখে কী কথা উচ্চারিত হবে এতে ‘তানাকোদ’ বা পরস্পর বিরোধী হবে কেন? [নূরুন ‘আলাদ দারব থেকে শায়খ উছায়মীনের বক্তব্যগুলো উদ্বৃত]

১১৪টি সূরার মধ্য হতে মাত্র ২৯টি সূলার সূচনায় হুরুফে মুকাত্তিয়াত রয়েছে। যা সর্বমোট ২৭ বর্ণ। তবে বার বার আসা শব্দ বাদ দিলে মাত্র ১৪ টি বর্ণ থাকে। মনে রাখার সুবিধার্থে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন নিচের বাক্যটি মনে রাখুন :

نص حكيم قاطع له سر

ن ص ح ك ي م ق ا ط ع ل ه س ر

*অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং সাবেক চেয়ারম্যান, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস।

তথ্যসূত্র :
[১]. তিরমিযী, হা/২৯০৬; মিশকাত, হা/২১৩৮। হাদীছটির সনদ দুর্বল, সিলসিলা যঈফাহ, হা/২৩৯৩




প্রসঙ্গসমূহ »: কুরআনুল কারীম
চোগলখোরী করা ও তার পরিণাম - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৬ষ্ঠ কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
ইসলামী তাবলীগ বনাম ইলিয়াসী তাবলীগ (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
বিদ‘আত পরিচিতি (৮ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
মসজিদ: ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
বিদ‘আত পরিচিতি (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
বিদ‘আত পরিচিতি (৩১তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
বিদ‘আত পরিচিতি (১২তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মাযহাবী গোঁড়ামি ও তার কুপ্রভাব (৪র্থ কিস্তি) - অনুবাদ : রিদওয়ান ওবাইদ
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১০ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম

ফেসবুক পেজ