শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৩২ পূর্বাহ্ন

মুসলিম উম্মাহর বিভ্রান্তির কারণ ও উত্তরণের উপায় 

-হাসিবুর রহমান বুখারী* 


(শেষ কিস্তি) 

(৫) দাওয়াত ও তাবলীগের গুরুত্ব-মাহাত্ম্য ও না করার ভয়াবহ পরিণতি

আল্লাহ তা‘আলা ভূমমণ্ডলে মানুষকে ইচ্ছা স্বাধীনতা দিয়েছেন আবার তাঁর দেয়া জীবন বিধানকে পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের উপর মানুষের দুনিয়াবী কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তি নির্ভরশীল করে দিয়েছেন। এজন্য তাকে সদাসর্বদা সচেতন ও সতর্ক থাকতে হয়। কেননা নিজের স্বাধীন ইচ্ছার প্রয়োগ করতে গিয়ে আল্লাহর বিধানকে অমান্য করে ন্যায় ও সত্যের পথ থেকে নিশ্চিতভাবে বিচ্যুত হয়ে যায়। ফলে আল্লাহকে ভুলে গিয়ে সে আপন প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়। বিপরীতমুখী আকর্ষণ তথা শয়তানী প্ররোচনার কালো আঁধারে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। এভাবে সে নিজের অজান্তেই দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত হয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, পৃথিবীতে মানুষের আগমনের পর থেকে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে এবং ঈমানের উপর টিকে থাকতে পেরেছে এমন মানুষের সংখ্যা অতি অল্প। অধিকাংশই হয়েছে পথভ্রষ্টদের দলভুক্ত। এই পথভোলা মানুষদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য আল্লাহ তা‘আলা যেমন যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূলকে প্রেরণ করেছেন, তেমনি আবার দায়িত্ব দিয়েছেন তাদেরকে যারা নবী-রাসূলদের অনুসরণ করার মাধ্যমে হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছেন। আদম (আলাইহিস সালাম) থেকে শুরু করে মুহাম্মাদ (ﷺ) পর্যন্ত সকল নাবী-রাসূল এই দায়িত্ব নিয়েই মানবসমাজকে আল্লাহর পথে প্রত্যাবর্তনের দাওয়াত নিয়ে দুনিয়ার বুকে আগমন করেছিলেন।

রাসূল (ﷺ)-এর আগমনের পূর্বে মক্কা তথা সমস্ত আরব ছিল- ‘দুষ্কর্ম, অপরাধ ও পাপে জর্জরিত’। অধিকাংশ আরববাসী- জুয়া, মদ্যপান, যিনা, ব্যভিচার, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি, হত্যা এবং প্রতিহিংসা পরায়ণতার মত জঘন্য, অমানবিক ও ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপে যুক্ত ছিল। এ সমস্ত অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য এবং সমাজে পরিবর্তনের বিপ্লব সৃষ্টি করার জন্য প্রয়োজন ছিল একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ও উন্নতমানের হাতিয়ারের। এরূপ ডুবন্ত ও কদর্য সমাজকে সংস্কার, সংশোধন এবং রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন ছিল বাহুবল, জনসমর্থন এবং একটি সক্রিয় সংগঠনের। তৎকালীন আরব সমাজের মত বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাও আমাদেরকে আইয়ামে জাহিলিয়্যাতের সেই বর্বর সমাজচিত্রের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই জাহিলিয়্যাতের মূলোৎপাটনের জন্যই আল্লাহ তা‘আলা মানবতার মুক্তির দূত হিসাবে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে প্রেরণ করেন। তিনি এসে মানব সমাজকে আল্লাহর নির্দেশিত পথের দিকে আহ্বান করেন এবং জাহিলিয়্যাতের ঘোর অমানিশা থেকে মানুষকে রক্ষা করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

ۛ کَمَاۤ  اَرۡسَلۡنَا فِیۡکُمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡکُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡکُمۡ  اٰیٰتِنَا وَ یُزَکِّیۡکُمۡ وَ یُعَلِّمُکُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ یُعَلِّمُکُمۡ مَّا لَمۡ تَکُوۡنُوۡا تَعۡلَمُوۡنَ

‘যেমন আমরা তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য একজন রাসূল প্রেরণ করেছি, যিনি তোমাদের নিকটে আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করে শুনান। আর যিনি তোমাদের পবিত্র করেন এবং তোমাদেরকে কিতাব ও সুন্নাহ শিক্ষা দেন। তোমাদেরকে এমন সব বিষয় শিক্ষা দেন, যা তোমরা জানতে না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৫১)।

সমাজকে পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে দাওয়াত দানের নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, وَ ادۡعُ  اِلٰی رَبِّکَ وَ لَا تَکُوۡنَنَّ  مِنَ  الۡمُشۡرِکِیۡنَ ‘আপনি আপনার পালনকর্তার দিকে (মানুষকে) আহ্বান করুন। আর আপনি অবশ্যই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না’ (সূরা আল-ক্বাছাছ: ৮৭)। তিনি আরো বলেন,

قُلۡ ہٰذِہٖ سَبِیۡلِیۡۤ  اَدۡعُوۡۤا  اِلَی اللّٰہِ ۟ؔ عَلٰی بَصِیۡرَۃٍ  اَنَا  وَ مَنِ اتَّبَعَنِیۡ ؕ وَ سُبۡحٰنَ اللّٰہِ  وَ مَاۤ   اَنَا مِنَ  الۡمُشۡرِکِیۡنَ

‘(হে নবী!) আপনি বলুন, এটিই আমার পথ। আমি এবং আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর পথে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে (সুস্পষ্ট দলীল সহকারে)। আল্লাহ মহা পবিত্র। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (সূরা ইউসুফ: ১০৮)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

یٰۤاَیُّہَا النَّبِیُّ  اِنَّاۤ  اَرۡسَلۡنٰکَ شَاہِدًا وَّ مُبَشِّرًا وَّ  نَذِیۡرًا-وَّ دَاعِیًا اِلَی اللّٰہِ  بِاِذۡنِہٖ وَ سِرَاجًا مُّنِیۡرًا

‘হে নবী! আমরা আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর পথে দাওয়াত দানকারী হিসাবে ও উজ্জ্বল প্রদীপ রূপে’ (সূরা আল-আহযাব: ৪৫-৪৬)। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের মধ্যে নবী (ﷺ)-কে সম্বোধন করে বলেন, یٰۤاَیُّہَا الرَّسُوۡلُ بَلِّغۡ  مَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ  مِنۡ رَّبِّکَ ؕ وَ  اِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلۡ فَمَا بَلَّغۡتَ رِسَالَتَہٗ ‘হে রাসূল! আপনার প্রতি আপনার প্রভুর পক্ষ হতে যা নাযিল হয়েছে (অর্থাৎ কুরআন), তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিন। যদি না দেন, তাহলে আপনি তাঁর রিসালাত পৌঁছে দিলেন না’ (সূরা আল-মায়িদাহ: ৬৭)।

আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশিত এই মহান দায়িত্ব মহানবী (ﷺ)-এর অবর্তমানে তাঁর উম্মতের উপর অর্পিত হয়েছে। সে কারণে এ মহান দায়িত্বে অবহেলা করা চলবে না, বরং তা পালন করতে হবে যথাযথভাবে। রাসূল (ﷺ) বলেন,

مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَّمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَّمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيْمَانِ

‘তোমাদের কেউ অন্যায় কাজ দেখলে সে যেন তা হাত দ্বারা প্রতিহত করে। যদি এটা তার দ্বারা সম্ভব না হয়, তাহলে মুখ দ্বারা বাধা দিবে, তাও সম্ভব না হলে অন্তর দ্বারা (তাকে ঘৃণা করবে)। আর এটাই হল দুর্বলতম ঈমান’।[১]

আল্লাহর পথে দাওয়াতী কাজের গুরুত্ব-মাহাত্ম্য ও মর্যাদা বহিঃপ্রকাশ করে মহান আল্লাহ বলেন,

وَ مَنۡ اَحۡسَنُ  قَوۡلًا  مِّمَّنۡ دَعَاۤ  اِلَی اللّٰہِ  وَ عَمِلَ  صَالِحًا وَّ قَالَ  اِنَّنِیۡ مِنَ الۡمُسۡلِمِیۡنَ- وَ لَا تَسۡتَوِی الۡحَسَنَۃُ  وَ لَا السَّیِّئَۃُ ؕ اِدۡفَعۡ  بِالَّتِیۡ  ہِیَ  اَحۡسَنُ فَاِذَا الَّذِیۡ بَیۡنَکَ وَ بَیۡنَہٗ  عَدَاوَۃٌ کَاَنَّہٗ  وَلِیٌّ حَمِیۡمٌ

‘ঐ ব্যক্তির কথার চেয়ে কার কথা উত্তম হতে পারে! যে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে যে, নিশ্চয় আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত। সৎকর্ম ও অসৎকর্ম কখনো সমান নয়। প্রত্যুত্তর নম্রভাবে দাও, দেখবে তোমার শত্রুও অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে পরিণত হয়েছে’ (সূরা হা-মীম সাজদা: ৩৩-৩৪)। উপরিউক্ত আয়াতে দাওয়াতের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। এর ফলে পারস্পরিক শত্রুতা দূরীভূত হয় এবং বন্ধুত্ব ফিরে আসে। একে অপরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। অন্যত্র তিনি বলেন,

ثُمَّ کَانَ مِنَ الَّذِیۡنَ  اٰمَنُوۡا وَ تَوَاصَوۡا بِالصَّبۡرِ  وَ تَوَاصَوۡا بِالۡمَرۡحَمَۃِ- اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ الۡمَیۡمَنَۃِ

‘অতঃপর (আল্লাহর নৈকট্য তারাও লাভ করতে পারে) যারা ঈমান আনে এবং পরস্পরে ধৈর্যের উপদেশ দেয় এবং পরস্পরে দয়ার উপদেশ দেয়। তারাই হল ডানপন্থী, তারাই সফলকাম’ (সূরা আল-বালাদ: ১৭)। রাসূল (ﷺ) বলেন,

مَنْ سَنَّ فِي الإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَهُ أَجْرُهَا وَأَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا مِنْ غَيْرِ أَنْ يُّنْقَصَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيْئٌ وَمَنْ سَنَّ فِيْ الإِسْلَامِ سُنَّةً سَيِّئَةً كَانَ عَلَيْهِ وِزْرُهَا وَوِزْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا مِنْ بَعْدِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يُّنْقَصَ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَيْئٌ

যে ব্যক্তি (দাওয়াতের মাধ্যমে) ইসলামের একটি উত্তম সুন্নাত চালু করবে সে তার নেকী পাবে এবং ঐ সুন্নাতের প্রতি মানুষ আমল করে যত নেকী পাবে, তাদের সমপরিমাণ নেকী তার আমলনামায় লেখা হবে। তবে তাদের কারো নেকী কম করা হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইসলামে কোন মন্দ আমল চালু করবে, সেজন্য তার পাপ রয়েছে। আর ঐ মন্দ আমল করে যত লোক যে পরিমাণ পাপ অর্জন করবে সবার সমপরিমাণ পাপ তার আমলনামায় লেখা হবে। তবে তাদের কারো পাপ এতটুকুও কম করা হবে না’।[২] অন্যত্র রাসূল (ﷺ) বলেন,

مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الْأَجْرِ مِثْلُ أُجُوْرِ مَنْ تَبِعَهُ لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلَالَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا

‘যে ব্যক্তি হিদায়াতের দিকে আহ্বান করবে তার জন্য তার অনুসারী ব্যক্তিদের সমপরিমাণ নেকী রয়েছে। কিন্তু তাদের নেকী থেকে বিন্দু পরিমাণও হ্রাস করা হবে না। অপরদিকে যে ব্যক্তি ভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান করবে তার জন্য তার অনুসারী ব্যক্তিদের সমপরিমাণ পাপ রয়েছে। কিন্তু তাদের পাপ থেকে বিন্দু পরিমাণও হ্রাস করা হবে না’।[৩] অন্য বর্ণনায় এসেছে,

عَنْ أَبِىْ مَسْعُوْدٍ الأَنْصَارِىِّ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِىِّ ﷺ فَقَالَ إِنِّىْ أُبْدِعَ بِى فَاحْمِلْنِىْ فَقَالَ مَا عِنْدِىْ فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَنَا أَدُلُّهُ عَلَى مَنْ يَحْمِلُهُ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ

আবূ মাসঊদ আল-আনছারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, জনৈক ব্যক্তি নবী করীম (ﷺ)-এর নিকটে এসে বলল, আমার সওয়ারী ধ্বংস হয়ে গেছে। আমাকে একটি সওয়ারী দান করুন। তিনি বললেন, সওয়ারী আমার কাছে নেই। এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি তাকে এমন লোকের কথা বলে দিতে পারি, যে তাকে সওয়ারীর পশু দিতে পারবে। রাসূল (ﷺ) বললেন, ‘যে ব্যক্তি কল্যাণের দিকে পথ দেখায় তার জন্য কল্যাণকর কাজ সম্পাদনকারীর সমপরিমাণ পুরস্কার রয়েছে’।[৪]

পরিতাপের বিষয় আমাদের সমাজও আজ জাহিলী যুগের ন্যায় অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত। মানব রচিত কোন তন্ত্র-মন্ত্র দিয়ে তমসাচ্ছন্ন এই সমাজকে রক্ষা করা আদৌ সম্ভব নয়। একমাত্র বিশ্ব সংস্কারক মুহাম্মাদ (ﷺ) প্রদর্শিত পন্থায় দাওয়াত দানের মাধ্যমেই এই সমাজের উত্তরণের পথ উন্মোচিত হতে পারে। তাই রাসূল (ﷺ) নির্দেশিত পদ্ধতিতে মানবতাকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আহ্বান করতে হবে। রাসূল (ﷺ) বলেন,

بَلِّغُوْا عَنِّىْ وَلَوْ آيَةً، وَحَدِّثُوْا عَنْ بَنِى إِسْرَائِيلَ وَلَا حَرَجَ، وَمَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ

‘আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত জানা থাকলেও তোমরা তা পৌঁছিয়ে দাও। আর বানী ইসরাঈলের কাহিনী বর্ণনা কর তাতে কোন দোষ নেই। তবে যে ব্যক্তি আমার উপর ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যারোপ করল, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে নির্ধারিত করে নিলো’।[৫]

অতএব একজন প্রকৃত মুমিনের জীবনাদ্দেশ্য হবে দাওয়াতী কাজের জন্য নিজেকে তৈরি করে ব্যক্তি জীবনে তার অনুসারী হয়ে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে দাওয়াতী কাজের মাধ্যমে আল্লাহর বিধানকে পৌঁছে দেয়া ও তাকে বিজয়ী করার চেষ্টা করা। পক্ষান্তরে এই দায়িত্ব পালনে কেউ অনিহা দেখালে অথবা অস্বীকার করলে দুনিয়া ও আখিরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। হাদীছে এসেছে,

عَنْ حُذَيْفَةَ بْنِ الْيَمَانِ عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ ‏وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوْفِ وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ أَوْ لَيُوْشِكَنَّ اللهُ أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عِقَابًا مِنْهُ ثُمَّ تَدْعُوْنَهُ فَلَا يُسْتَجَابُ لَكُمْ‏.‏

হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেন, ‘সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! নিশ্চয় তোমরা সৎকাজের জন্য আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করবে। তা না হলে আল্লাহ তা‘আলা শীঘ্রই তোমাদের উপর তার শাস্তি অবতীর্ণ করবেন। তোমরা তখন তার নিকট দু‘আ করলেও তিনি তোমাদের সেই দু‘আ গ্রহণ করবেন না’।[৬]

আল্লাহর পথে দাওয়াত দানে উদাসীনতা ও অলসতাকারীর জন্য পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে। নু‘মান ইবনু বাশীর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন,

مَثَلُ الْمُدْهِنِ فِيْ حُدُوْدِ اللهِ وَالْوَاقِعُ فِيْهَا مَثَلُ قَوْمٍ اِسْتَهَمُوْا سَفِيْنَةً فَصَارَ بَعْضُهُمْ فِيْ اَسْفَلِهَا وَصَارَ بَعْضُهُمْ فِيْ أَعْلَاهَا فَكَانَ الَّذِيْ فِيْ أَسْفَلِهَا يَمُرُّ بِالْمَاءِ عَلَى الَّذِيْنَ فِيْ أَعْلَهَا فَتَأَذَّوْا بِهِ فَأَخَذَ فَأْسًا فَجَعَلَ يَنْقُرُ أَسْفَلَ السَّفِيْنَةِ فَأَتَوْهُ فَقَالُوْا مَا لَكَ قاَلَ تَأَذَّيْتُمْ بِيْ وَلَا بُدَّلِيْ مِنَ الْمَاءِ فَاِنْ أَخَذُوْا عَلَى يَدَيْهِ أَنْجُوْهُ وَنَجُّوْا أَنْفُسَهُمْ وَإِنْ تَرَكُوْهُ أَهْلَكُوْهُ وَأَهْلَكُوْا أَنْفُسَهُمْ

‘আল্লাহর বিধান পালনে অলসতাকারী ও অমান্যকারীর দৃষ্টান্ত ঐ লোকদের ন্যায় যারা লটারীর মাধ্যমে কেউ জাহাজের উপরে, কেউ জাহাজের নিচে স্থান পেল। তাদের মধ্যে যারা নিচে রয়েছে, তারা পানি আনার জন্য উপরে গেলে উপরের লোকদের কষ্ট হত। কাজেই নিচের এক ব্যক্তি (পানি সংগ্রহের জন্য) একটি কুঠার নিয়ে নৌকার তলা ছিদ্র করতে আরম্ভ করল। তখন উপরের লোকজন এসে বলল, তোমার কী হয়েছে? (তুমি নৌকা ছিদ্র করছ কেন?) সে বলল, উপরে পানি আনতে গেলে তোমাদের কষ্ট হচ্ছে, আর পানি আমার একান্ত প্রয়োজন। এক্ষণে যদি তারা ঐ ব্যক্তিকে নৌকা ছিদ্র করতে বাধা দেয় তবে তারা তাকে এবং নিজেদেরকে রক্ষা করল। আর যদি তাকে নৌকা ছিদ্র করার কাজে ছেড়ে দেয় তবে তারা তাকে এবং নিজেদেরকে ধ্বংস করল’।[৭] আবূ বাকর আছ-ছিদ্দীক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি,

يَقُوْلُ إِنَّ النَّاسَ إِذَا رَأَوْا مِنْكُمْ فَلَمْ يُغَيِّرُوهُ يُوْشكُ أَنْ يَّعُمَّهُمُ اللهُ بِعِقَابَهِ وَفِيْ رِوَايَةٍ أَبِيْ دَاوُدَ مَا مِنْ قَوْمٍ يَعْمَلُ فِيْهِمْ بِالْمَعَاصِيْ ثُمَّ يَقْدِرُوْنَ عَلَى أَنْ يُّغَيِّرُوْا ثُمَّ لاَ يُغَيِّرُوْنَ إِلاَّ أَنْ يَّعُمَّهُمْ اللهُ بِعِقَابٍ

‘নিশ্চয় মানুষ যখন কোন গর্হিত কর্ম দেখে তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা না করে, অচিরেই আল্লাহ তাদের সকলকে শাস্তি দিবেন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, যখন কোন সম্প্রদায়ের মাঝে পাপ হতে থাকে এবং প্রতিরোধ করতে সক্ষম ব্যক্তিরা প্রতিরোধ না করে, তখন আল্লাহ সকলকেই শাস্তি দেন’।[৮] জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি,

مَا مِنْ رَجُلٍ يَكُوْنُ فِيْ قَوْمٍ يَعْمَلُ فِيْهِمْ بِالْمَعَاصِي يَقْدِرُوْنَ عَلَى أَنْ يُغَيِّرُوْا عَلَيْهِ وَلَا يُغَيِّرُوْنَ إِلَّا أَصَابَهُمُ اللهُ مِنْهُ بِعِقَابٍ قَبْلَ أَنْ يَمُوْتُوْا

‘যে সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন এক ব্যক্তি পাপে লিপ্ত হয়, আর সে সম্প্রদায়ের লোকেরা ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাকে পরিবর্তন না করে, তখন তাদের মৃত্যুর পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলার আযাব তাদের উপর পতিত হবে’।[৯]

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যারা দাওয়াত প্রদানে অলসতা করে, কিন্তু নিজেরা সর্বদা ইবাদত করে, তারাও পাপীদের সাথে ধ্বংস প্রাপ্ত হবে। কেননা দাওয়াত দান আল্লাহর নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যা ত্যাগ করা গর্হিত অপরাধ। কাজেই দাওয়াতী কাজ না করে শুধু ইবাদতে মশগুল থাকলে সে ইবাদত গ্রহণযোগ্য হবে না।

(৬) বিচ্ছিন্নতার বিষন্নতা ও ঐক্যের পুরুস্কার

ঐক্যের গুরুত্ব-মাহাত্ম্য সামনে রেখেই ইসলাম গৃহত্যাগ বা বৈরাগ্যবাদকে হারাম ঘোষণা করেছে। ঐক্য ও সংহতি মুসলিম জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ঐক্যবদ্ধভাবে জীবনযাপন করা মুমিনের অপরিহার্য কর্তব্য। ইসলামে ঐক্যের গুরুত্ব অপরিসীম। সংঘবদ্ধভাবে জীবন পরিচালনা করা ইসলামের নির্দেশনা। এ সর্ম্পকে মহান আল্লাহ বলেন, وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰہِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে (ইসলাম) আঁকড়ে ধর (ঐক্যবদ্ধ হও) এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (সূরা আলে ইমরান: ১০৩)। ঐক্য সর্ম্পকে আল্লাহ তা'আলা অন্যত্র বলেন,

وَ لَا تَکُوۡنُوۡا کَالَّذِیۡنَ تَفَرَّقُوۡا وَ اخۡتَلَفُوۡا مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَہُمُ الۡبَیِّنٰتُ ؕ وَ اُولٰٓئِکَ لَہُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ

‘তোমরা সেসব লোকদের মত হয়ো না, যাদের কাছে স্পষ্ট ও প্রকাশ্য নিদর্শন আসার পরও তারা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং নানা ধরনের মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি’ (সূরা আলে ইমরান: ১০৫)।

ঐক্য সম্পর্কে পবিত্র কুরআনুল কারীমের এত নির্দেশনা থাকার পরও বর্তমানে মুসলিম সমাজের ঐক্যের অভাবই বেশি পরিলক্ষিত হয়। মুসলিম জাতি এক প্রাণ, এক দেহ, এই চেতনাবোধ দিনে দিনে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। ইসলামে মুসলিমদের পারস্পরিক সর্ম্পক ভ্রাতৃত্বের। এ সর্ম্পকের ভিত্তি ইসলামের একটি স্তম্ভের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যে কেউ তার স্বীকৃতি দিবে সেই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবে। এই ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা এবং রাসূল (ﷺ) জোর তাকীদ দিয়েছেন। উমার ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন,

عَلَيْكُمْ بِالْجَمَاعَةِ وَإِيَّاكُمْ وَالْفُرْقَةَ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ مَعَ الْوَاحِدِ وَهُوَ مِنَ الِاِثْنَيْنِ أَبْعَدُ مَنْ أَرَادَ بُحْبُوْحَةَ الْجَنَّةِ فَلْيَلْزَمِ الْجَمَاعَةَ مَنْ سَرَّتْهُ حَسَنَتُهُ وَسَاءَتْهُ سَيِّئَتُهُ فَذَلِكَ الْمُؤْمِنُ.‏

‘তোমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বসবাস কর। বিচ্ছিন্নতা হতে সাবধান থেকো। কেননা শয়তান বিচ্ছিন্নজনের সাথে থাকে এবং সে দু’জন হতে অনেক দূরে অবস্থান করে। যে ব্যক্তি জান্নাতের সর্বোত্তম অংশে বসবাস করে আনন্দিত হতে চায়, সে যেন ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরে। যার সৎ আমল তাকে আনন্দিত করে এবং বদ আমল কষ্ট দেয় সেই হলো প্রকৃত ঈমানদার’।[১০]

পৃথিবীতে যারা যতবেশী ঐক্যবদ্ধ, সুসংগঠিত তারা ততবেশী শক্তিশালী ও মর্যাদাবান। পক্ষান্তরে যারা বিচ্ছিন্ন, দলত্যাগী তারা দুর্বল ও উপেক্ষিত। ইসলাম কখনো বিচ্ছিন্নতাকে সমর্থন করে না। পারিবারিক চৌহদ্দি থেকে শুরু করে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও মুসলিমদের পারস্পরিক ঐক্য, সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্বমূলক সুদৃঢ় বন্ধন দেখতে চায়। সেই লক্ষ্যে সব মুসলিমকে এক কাতারে এনে ঘোষণা করেছে, ‘মু'মিনরা পরস্পর ভাই ভাই’ (সূরা আল-হুজুরাত: ১০)। নু‘মান ইবনু বাশীর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন,

تَرَى الْمُؤْمِنِيْنَ فِيْ تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ كَمَثَلِ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى عُضْوًا تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ جَسَدِهِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى‏‏.‏

‘পারস্পরিক দয়া, ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শনে তুমি মুমিনরা একটি দেহের মতই। যখন শরীরের একটি অঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয়, তখন শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রাত জাগে এবং জ্বরে অংশ নেয়’।[১১]

বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতার পরিণতি কী এবং একতার সুফল কী তা ইসলাম স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছে। জাহিলী যুগে আরবের ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থার মত রাজনৈতিক অবস্থাও ছিল খুবই দুর্বল। রাজনৈতিক দুরবস্থার মূলে ছিল বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতা। তারা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত ছিল। একদলের সঙ্গে অন্য দলের সংঘাত-সংঘর্ষ লেগেই থাকত। আধিপত্য ধরে রাখতে কখনো একদল অন্য দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হত বটে, কিন্তু সমগ্র আরব এক হয়ে নিজেদের রাষ্ট্র সংরক্ষণ কিংবা জাতীয়তা রক্ষার মিশনে কখনো এক হতো না। কিছুসংখ্যক শহরে বসবাস করলেও অধিকাংশ আরব ছিল যাযাবর। আরবদের এহেন দুর্বলতার সুযোগে সেখানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল তখনকার সময়ের দু’টি পরাশক্তি রোম ও পারস্য। কখনো কখনো সে সুযোগ গ্রহণ করত দক্ষিণের রাজ্যগুলোও। আরবরা ছিল দাবার ঘুঁটির মত। কিন্তু ইসলাম এসে তাদের ঐক্যবদ্ধ করে সুগঠিত করে। এক আল্লাহ তা‘আলার উপর বিশ্বাসী হওয়ার তাকীদ দেয়। তাদের কাছে পাঠানো রাসূলকে অনুসরণের নির্দেশ করে। কুরআনুল কারীমের ছায়াতলে আসতে বলে। ধীরে ধীরে তারা সে ডাকে সাড়া দেয়। আলোকিত হয় ইসলামের আলোয়। ফলস্বরূপ পরবর্তীতে তাঁরা দেখেছিলেন শুধুই বিজয়ের ইতিহাস। তাই ইসলাম মুমিনদের দ্বীন-ধর্ম আঁকড়ে ধরে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছে এবং অতীতের দুরবস্থার কথাও স্মরণে রাখার তাকীদ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰہِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا ۪ وَ اذۡکُرُوۡا نِعۡمَتَ اللّٰہِ عَلَیۡکُمۡ  اِذۡ  کُنۡتُمۡ اَعۡدَآءً فَاَلَّفَ بَیۡنَ قُلُوۡبِکُمۡ فَاَصۡبَحۡتُمۡ بِنِعۡمَتِہٖۤ اِخۡوَانًا ۚ وَ کُنۡتُمۡ عَلٰی شَفَا حُفۡرَۃٍ مِّنَ النَّارِ فَاَنۡقَذَکُمۡ مِّنۡہَا ؕ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰہُ لَکُمۡ اٰیٰتِہٖ  لَعَلَّکُمۡ  تَہۡتَدُوۡنَ

‘তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু (দ্বীন বা কুরআন)-কে শক্ত করে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ কর, তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করলেন। ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুণ্ডের (জাহান্নামের) প্রান্তে ছিলে, অতঃপর তিনি (আল্লাহ) তা হতে তোমাদেরকে উদ্ধার করেছেন। এরূপে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর নিদর্শন স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন, যাতে তোমরা সৎপথ পেতে পার’ (সূরা আলে ইমরান: ১০৩)।

ইসলামের এই নির্দেশ মুমিনরা (ছাহাবায়ে কিরাম) এতটাই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন, যার নজীর পৃথিবীতে বিরল। মদীনার আনছার সম্প্রদায় মক্কার মুহাজির সম্প্রদায়ের প্রতি যে ভ্রাতৃত্ব আর সৌহার্দ প্রদর্শন করেছিলেন তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত প্রশংসিত উপাখ্যান হয়ে থাকবে। নিজেদের নিত্যব্যবহার্য আসবাবপত্র, আহার-পানীয়, ঘরবাড়ি, ক্ষেতখামার, পোশাক-আশাকসহ সবকিছু মুহাজিরদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের ভাষায় বলেন, وَ الَّذِیۡنَ مَعَہٗۤ اَشِدَّآءُ عَلَی الۡکُفَّارِ رُحَمَآءُ  بَیۡنَہُمۡ ‘আর তার (মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর) সহচরগণ কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন’ (সূরা আল-ফাত্হ: ২৯)।

তাঁরা ভোগে নয়, ত্যাগে বিশ্বাসী ছিলেন। নিজের ওপর অন্য মুমিনকে প্রাধান্য দিতেন। মুসলিমদের ভ্রাতৃত্ব, ভালোবাসা আর সহমর্মিতার ইতিহাস বিস্ময়কর। সেই ভ্রাতৃত্ব, ভালোবাসা আর ঐক্যের ফলকে দাঁড়িয়েই মুসলিমরা এক দিন বিশ্ব জয় করছিলেন। শত্রুর মোকাবিলায় যারা ছিলেন সীসাঢালা প্রাচীর সদৃশ। ফলাফলও ছিল ঈর্ষণীয়। মদীনার ছোট্ট রাষ্ট্রটিকে তাঁরা বিস্তৃত করেছিলেন অর্ধ পৃথিবী ব্যাপী। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ইয়াহুদী ও মুনাফিক্ব চক্রের কূটচালে তৃতীয় খলীফা উছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সময়ে মুসলিমদের ঐক্যে ফাটল ধরে। চতুর্থ খলীফা আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর আমলে এসে ঐক্যের গোড়ায় বড় আঘাত লাগে। সে আঘাতে বিক্ষিপ্ত হতে থাকে মুসলিমরা। উদ্ভব হয় নতুন নতুন দল-উপদলের। শী‘আ, খারেজী, রাফেযীর মত নানা ভ্রান্ত ফির্ক্বার। শক্তি হারাতে থাকে ইসলাম। ঐক্য আর সম্প্রীতির বাণী ভুলে মুসলিমরা হতে থাকে বিচ্ছিন্ন। সেই ধারা আজও বহমান।

তাই মুসলিমদের ওপর জেঁকে বসেছে শত্রুরা। পৃথিবীর নানা প্রান্তে নির্যাতন করে চলছে যুগের পর যুগ, দশকের পর দশক ধরে। তবু মুসলিমরা কেউ কারও সঙ্গে এক হতে রাজি নয়। ক্ষমতা, অর্থ আর সম্মানের মোহে বিভোর হয়ে আছে। যত দ্রুত এই অবস্থার অবসান ঘটবে, ততই মঙ্গল হবে এই উম্মাহর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اَطِیۡعُوا اللّٰہَ  وَ رَسُوۡلَہٗ  وَ لَا  تَنَازَعُوۡا فَتَفۡشَلُوۡا  وَ تَذۡہَبَ رِیۡحُکُمۡ وَ اصۡبِرُوۡا ؕ اِنَّ  اللّٰہَ  مَعَ  الصّٰبِرِیۡنَ

‘আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর ও নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ করো না, করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি ও প্রতিপত্তি বিলুপ্ত হবে। আর তোমরা ধৈর্য ধারণ কর, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে থাকেন’ (সূরা আল-আনফাল: ৪৬)।

আল্লাহ তা‘আলার বিস্ময়কর নিদর্শন হল জাহিলরা যখন আল্লাহর কিতাবের উপর একতাবদ্ধ থাকা ও রাসূল (ﷺ)-এর উপর অর্পিত শরী‘আতকে আঁকড়ে ধরা বর্জন করল তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা, বিক্ষিপ্ততা ও হানাহানি সৃষ্টি করে তাদেরকে পরীক্ষায় ফেললেন। আর তারা নিজেদের বাতিলকে নিয়ে উল্লাসে মেতে উঠল। এটাই তাদের শাস্তি। কেননা মানুষ বাতিল নিয়ে আনন্দিত হলে তা আর পরিত্যাগ করে না। অপরদিকে যখন বাতিলের প্রতি আনন্দবোধ থাকে না, সন্দেহ জাগে তখন এক্ষেত্রে তাওবাহ করা ও ফিরে আসার সম্ভবনা থাকে। কিন্তু যখন বাতিলকে নিয়ে শান্তি পায় ও আনন্দিত হয় তখন ব্যক্তির মাঝে পরিবর্তন ঘটে না। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে বাতিলপন্থীদের শাস্তি। কেননা যে হক্ব পরিত্যাগ করে, সে বাতিলের পরীক্ষায় পড়ে। আর যে একতাবদ্ধ থাকা বর্জন করে, সে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত, হানাহানি ও সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার পরীক্ষায় পড়ে। তাই দ্বীন ও দুনিয়াবী বিষয়ে ভিন্নমতের ঐসব মানুষের মাঝে কেবল শত্রুতা, গোঁড়ামি ও বিদ্বেষ পাওয়া যায়। কখনো কখনো নিজেরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়। আর যারা কুরআন ও সুন্নাহকে একত্রে আঁকড়ে ধরে, তাদের মাঝে হৃদ্যতা ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয় এবং পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে দেখা যায়। তারা যেন একটি দেহের মত। তাই কুরআন ও সুন্নাহ আঁকড়ে ধরা ব্যতীত কোন নিরাপত্তা নেই। আর কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ ছাড়া কোন ঐক্যও নেই। এ ছাড়া যা কিছু আছে সবই বিভেদ ও শাস্তি। যারা নিজেদের কথা অনুযায়ী মুসলিমদেরকে একতাবদ্ধ দেখতে চায়, তাদেরকে বলা হবে, তোমরা যদি মুসলিমদের ঐক্য কামনা করেই থাক, তাহলে আক্বীদার ক্ষেত্রে এক হও। রাসূল (ﷺ) যা নিয়ে এসেছেন সে একত্বে ও আক্বীদার উপর সবাই এক হয়ে যাও। আর এটা আমাদের কারামাত, এটা আমাদের ছূফীমত ও এটা আমাদের শী‘আমত এসব বলে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করো না।

প্রথমেই আক্বীদার উপর এক হও, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তথা আল্লাহ ছাড়া কোন প্রকৃত মা‘বুদ নেই এ কালেমা আঁকড়ে ধরো। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলার নাযিলকৃত বিধানের ক্ষেত্রে এক হও। আর আল্লাহ তা‘আলার কিতাব ও রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাতের দিকে ফিরে এসো। আর যাবতীয় নিয়ম, রীতি ও গোত্রীয় অভ্যাস ইত্যাদি প্রত্যাখ্যান করো এবং কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে এসো যেহেতু তোমরা মুসলিমদের একতাবদ্ধতা ও ঐক্য কামনা করছো। তাই একই আক্বীদা ও উদ্দেশ্য ছাড়া মুসলিমরা কখনোই এক হতে পারবে না।

উপসংহার

আল্লাহ তা‘আলার স্থায়ী নিয়ম হল- আল্লাহর বাণী: مَا یَفۡعَلُ اللّٰہُ بِعَذَابِکُمۡ  اِنۡ شَکَرۡتُمۡ وَ اٰمَنۡتُمۡ ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ شَاکِرًا عَلِیۡمًا ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর ও ঈমান আনয়ন কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে শাস্তি দিয়ে কী করবেন? বস্তুত আল্লাহ গুণগ্রাহী, সর্বজ্ঞ’ (সূরা আন-নিসা: ১৪৭)। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা বিনা কারণে কাউকে শাস্তি দিয়ে ধ্বংস করেন না। মানুষ ঈমান থেকে ফিরে গেলে কিংবা অকৃতজ্ঞ হলে আল্লাহ তা‘আলা শাস্তি দিয়ে থাকেন।

সুধী পাঠক! ‘মুসলিম উম্মাহর বিভ্রান্তির কারণ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা দেখতে পেলাম যে, মুসলিমদের এই অধঃপতন ও দুরাবস্থা খামোখা হয়নি। বরং এর নেপথ্যে শরী‘আত সম্মত কারণ আছে। সেগুলো হল- (১) শিরকে নিমজ্জিত হওয়া। (২ ও ৩) কুরআন ও রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত থেকে বিমুখতা। (৪) দুনিয়ার মোহ-মায়ায় মোহান্ধ। (৫) দাওয়াত ও তাবলীগ থেকে বিরত থাকা। (৬) মুসলিম উম্মাহর বিচ্ছিন্নতা। সুতরাং এই বিভ্রান্তি ও ধ্বংসাত্মক পরিণতি থেকে বাঁচতে হলে শিরকমুক্ত জীবন-যাপনের অভ্যস্ত হতে হবে, কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরতে হবে এবং এর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। দুনিয়ার মোহ-মায়া ত্যাগ করে পরকাল সম্পর্কে সজাগ হতে হবে। দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এবং যে কোন মূল্যে মুসলিম সমাজে ঐক্য ফিরিয়ে আনতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে উপরিউক্ত ছয়টি কর্মের বিনিময়ে দুনিয়ার সমস্ত বিপদাপদ থেকে নিরাপদ থাকার তাওফীক্ব দান করুন-আল্লাহুম্মা আমীন!!


* মুর্শিদাবাদ, ভারত।

তথ্যসূত্র:
[১]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪৯; ইবনু মাজাহ, হা/৪০১৩।
[২]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০১৭।
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৭৪; মিশকাত, হা/১৫৮।
[৪]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৯৩; মিশকাত, হা/২০৯।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৬১; তিরমিযী, হা/২৬৬৯।
[৬]. তিরমিযী, হা/২১৬৯; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৮৬৮।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৮৬, ২৪৯৩।
[৮]. তিরমিযী, হা/২১৬৮; আবূ দাঊদ, হা/৪৩৩৮; ইবনু মাজাহ, হা/৪০০৫; ছহীহুত তারগীব, হা/২৩১৭।
[৯]. আবূ দাঊদ, হা/৪৩৩৯; ছহীহুত তারগীব, হা/২৩১৬।
[১০]. তিরমিযী, হা/২১৬৫; ইবনু মাজাহ, ২৩৬৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৪।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০১১; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৮৬।




প্রসঙ্গসমূহ »: মুসলিম জাহান
হজ্জ ও ওমরাহ সম্পর্কে প্রচলিত বিদ‘আতসমূহ - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (শেষ কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
সালাম প্রদানের গুরুত্ব ও মর্যাদা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আরিফ হুসাইন
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায় (৭ম কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৫ম কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ফাযায়েলে কুরআন (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
শিক্ষাদানে নববী পদ্ধতি ও কৌশল - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
সুন্নাতের রূপরেখা (শেষ কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (৮ম কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর

ফেসবুক পেজ