মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৩:২৫ অপরাহ্ন

মাযহাবী গোঁড়ামি ও তার কুপ্রভাব

-মূল : শায়খ ইবরাহীম ইবনু আব্দুল্লাহ আল- মাযরূঈ
-অনুবাদ : রিদওয়ান ওবাইদ*


(শেষ কিস্তি

মাযহাবী গোঁড়ামি প্রত্যাখ্যানকারী আলেমগণ

আমরা সুনিশ্চিতভাবে অবগত হলাম যে, ছাহাবায়ে কিরামের সময়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তি কেন্দ্রিক এমন কোন মাযহাব ছিল না যেটি অনুসরণ করা হত। দ্বীনের বিষয়গুলোতে তাঁরা কেবল কিতাব-সুন্নাহর এবং তাদের ঐকমত্যের দিকেই প্রত্যাবর্তন করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় তাদের পরবর্তী অনুসারীগণ যেমন, ইমাম আবূ হানীফা, মালেক, শাফেঈ এবং আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুমুল্লাহ) একই পথে হেঁটেছেন।

শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘চার মুজতাহিদ ইমামের অনুমতি ছাড়াই কিছু সাধারণ মানুষ তাদের নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এই মাযহাবগুলোর প্রবর্তন করেছে এবং অদ্যাবধি মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টিকারী সেই মুকাল্লিদদের এই অপকর্মের সমর্থনে কোন মুজতাহিদকেই কিছু বলতে শুনিনি। বরং প্রথিতযশা আলিম এই অপকর্মের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তবে কিছু ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি অথবা ব্যক্তিগত ক্ষতির ভয়ে তারা নীরব থেকেছেন। সেকালে প্রতিটি বিবেকবান ব্যক্তি ভালো করে জানত যে, কোন মুজতাহিদ আলেম সরাসরি ‘তাক্বলীদ করা জায়েয নয়, এটি বিদ‘আত বলে ঘোষণা দিলে অধিকাংশ বিদ‘আতীরাই তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নিবে, তাঁকে লাঞ্ছিত করবে এবং তাঁর ধন-সম্পদ, দেহ ও সম্মানে আঘাত হানবে। তাদের হাত থেকে জীবন বাঁচানোর তাগীদে তাঁরা এমনটা করেছিলেন’।[১]

আল-ইয ইবনু আব্দুস সালাম (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ ৬৬০ হি.) বলেন, ‘আশ্চর্যের ব্যাপার হল, মুকাল্লিদ ফক্বীহগণ কোন বিষয়ে তাদের মাযহাবের ইমামের অসারতা সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্ত্বেও তাঁরই তাক্বলীদ করে থাকেন। আর যে ব্যক্তি নিজস্ব মতের পক্ষে কিতাব-সুন্নাহ এবং বিশুদ্ধ ক্বিয়াসের মাধ্যমে দলীল উপস্থাপন করেন তাকে বর্জন করে কিতাব-সুন্নাহর প্রকৃত চাহিদাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য বিভিন্ন অপকৌশল ও অলীক ব্যাখ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে থাকেন। তাদের সাথে আলোচনায় বসা অর্থহীন, উল্টো আরো পরস্পর বিভক্তি ও দৈরথের দ্বার উন্মুক্ত হয়। বিন্দুমাত্র উপকার সাধিত হয় না। সুবহানাল্লাহ! তাক্বলীদ যার দৃষ্টিকে অন্ধ করেছে সে ভীষণ ভয়ানক’।[২]

হাফেয যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ৭৪৮ হি.) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর ইমামদের তাক্বলীদ করা আবশ্যক করেননি। সুতরাং তারা তাদের (ইমামদের) কথা গ্রহণও করতে পারে কিংবা বর্জনও করতে পারে। যেমনটি ইমাম মালেক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, এই কবরবাসী (ﷺ) ব্যতীত সকলের বক্তব্যই গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যানযোগ্য’।[৩]

ইমাম আবূ ওমর ইবনু আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ৪৬৩ হি.) বলেন, ‘মুক্বাল্লিদ সমীপে প্রশ্ন ছুঁড়া হল, সালাফে ছালেহীনের বিরুদ্ধাচরণ করে তাক্বলীদের পক্ষে সাফাই গাও কেন? তাঁরা  তো তাক্বলীদ করেননি। তাদের কতককে পরিহার করে বাকিদের তাক্বলীদ করার দলীল কোথায় পেয়েছ? তাঁরা সকলেই তো আলেম’।[৪]

শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ৭২৮ হি.) বলেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা এই উম্মাহর উপর রাসূল (ﷺ) ছাড়া এককভাবে অন্য কারো অনুসরণ করা আবশ্যক করেননি। তাছাড়া প্রসিদ্ধ চার ইমামও তাদের প্রতিটি মতামতের তাক্বলীদ করা থেকে নিষেধ করেছেন। তাক্বলীদ কেবল তীব্র প্রয়োজনের ক্ষেত্রেই করা যাবে যখন সময় সংকীর্ণ হওয়ার দরুণ দলীল উপস্থাপন করা সম্ভব না হবে। আর এটাই সর্বাধিক ভারসাম্যপূর্ণ অভিমত ইনশা-আল্লাহ’।

ইমাম ছালেহ আল-ফুলানী (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ১২১৮ হি.) বলেন, ‘পরবর্তী যুগের মাযহাবী ফক্বীহগণ তাদের নিজস্ব কিছু মত-অভিমত ইমামদের নামে চালিয়ে দিয়েছেন। অথচ এসবের সাথে ইমামগণের কোন সম্পর্ক নেই’।[৫]

ইমাম শাত্বেবী (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ৭৯০ হি.) বলেন, ‘দলীল থেকে মুখ ফিরিয়ে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিবর্গের উপর নির্ভর করার কারণেই মানুষ পথহারা হয়ে গেছে। ঠিক এ কারণেই কতিপয় মানুষ ছাহাবায়ে কিরাম ও তাবেঈগণের পথ থেকে ছিটকে পড়েছে এবং অজ্ঞতাবশত প্রবৃত্তি পূজা করার কারণে সঠিক পথ হতে বিভ্রান্ত হয়ে গেছে’।[৬]

মুহাম্মাদ সুলতান আল-মা‘ছূমী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এই উম্মাহর কারো উপর হানাফী, মালেকী, শাফেঈ অথবা হাম্বলী হওয়া আবশ্যক নয়। বরং অজানা বিষয়ে কোন আলেমকে জিজ্ঞাসা করা প্রত্যেক ব্যক্তির উপর আবশ্যক’।[৭] শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,

من تمسك بكل ما ثبت في السنة، ولو خالف بعض أقوال الأئمة؛
لا يكون مباينًا لمذهبهم، ولا خارجًا عن طريقتهم؛ بل هو متبع لهم جميعًا، ...ومن ترك السنة الثابتة لمجرد مخالفتها لقولهم؛ بل هو بذلك عاصٍ لهم، ومخالف لأقوالهم 

‘যে ব্যক্তি ইমামদের মতামত পাত্তা না দিয়ে সুন্নাহ থেকে সুসাব্যস্ত মতকে আঁকড়ে ধরে, সে ব্যক্তি তাঁদের মাযহাব বিরোধী নয় এবং তাঁদের মতাদর্শ পরিপন্থীও নয়। বরং সে-ই তাদের প্রকৃত অনুসারী। আর যে ব্যক্তি ইমামদের বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে তাঁদের মাযহাব অসমর্থিত কোন প্রতিষ্ঠিত সুন্নাহকে বর্জন করে, প্রকৃত অর্থে সে ব্যক্তিই তাদের অবাধ্য এবং তাদের বক্তব্যের বিরুদ্ধাচারণকারী’।[৮]

আমরা কি চরমপন্থী?

আমরা প্রথম থেকেই বিভক্তি ও মতভেদ অপসন্দ করি। এর পাশাপাশি বিভাজন, বিবাদ, দলাদলী ও স্বপক্ষপ্রীতি-কেও চরমভাবে ঘৃণা করি। আমরা চাই, গোটা মুসলিম উম্মাহ একই মতার্দশের উপর প্রতিষ্ঠিত হোক। যে মতাদর্শের উপর ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ), তাঁর ছাহাবীগণ এবং উম্মাহর প্রথম যুগের অনুসারীগণ। যেমনটি ইমাম মালেক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, لن يصلح آخر هذه الأمة إلا ما أصلح أولها ‘এ উম্মাহর প্রথমাংশ যা গ্রহণ করে সংশোধিত হয়েছে, তা গ্রহণ করা ব্যতীত এই উম্মাহর শেষাংশ সংশোধন হতে পারবে না’।

আমরা সর্বদা কিতাব-সুন্নাহর আদলে প্রতিষ্ঠিত সালাফে ছালেহীনের মানহাজের দিকে আহ্বান করি। যে মানহাজ আল্লাহর দ্বীনের উপর আরোপিত সকল কদুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে, দ্বীনের মধ্যে নব আবিষ্কৃত সকল বিদ‘আতকে ছুড়ে ফেলে এবং দ্বীন পরিপন্থী সবকিছুই বর্জন করে।

দ্বীনের যাবতীয় বিধি-বিধান এবং নির্দেশাবলীর ক্ষেত্রে সালাফে ছালেহীনের মানহাজ কতটুকু ইলম নির্ভর? যখন আমরা এই মানহাজের উপর দিনাতিপাত করতে আরম্ভ করলাম তখন আম-জনতা ও বিশেষ ব্যক্তির মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বহু শিরক, বিদ‘আত ও কুসংস্কার উপস্থিতি টের পেলাম। সাথে সাথে সুন্নাহ বিস্মৃত হতে চলেছে এবং আজকাল সঠিক দ্বীন পাওয়াও বড় দুস্কর হয়ে পড়েছে।  আমরা এমন কিছু দুর্বল ও মিথ্যা হাদীছ পেলাম, যেগুলো ইমাম, বক্তা এবং মুদাররিসদের মুখে শুনতে পাচ্ছি। আমরা মাযহাবী ফিক্বহে প্রচুর পরিমাণে কিতাব-সুন্নাহর বিপরীত পেলাম। তাই আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম যে, আল্লাহর দিকে দাওয়াতের স্বার্থে এ ধরণের সকল কুকর্ম আম-জনতার সম্মুখে প্রকাশ করে দিব।

আমরা তো চরমপন্থী নই! কারণ নিন্দিত গোঁড়ামি হচ্ছে, দলীল স্পষ্ট হওয়ার পরেও পক্ষপাতিত্ব ও প্রবৃত্তিপূজাবশত সত্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানো। কিন্তু দলীল-প্রমাণ ব্যতীত আলেমদের বক্তব্য গ্রহণ করা তো আমাদের বৈশিষ্ট্য নয় অথবা তাদের বক্তব্যের অসারতা ও অলীকতা জানার পরেও সেগুলো আমরা গ্রহণ করি না। বরং আমরা আলেমদের সেই বক্তব্যগুলোই গ্রহণ করি যেগুলো শক্তিশালী দলীল সমর্থিত। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘তোমরা এই হাদীছের উপর নির্ভর করবে এবং হাদীছের আলোকে প্রাপ্ত মতকেই গ্রহণ করবে’।[৯]

তাক্বলীদ ও অনুসরণের ক্ষেত্রে একজন মুসলিমের নীতিমালা কেমন হবে?

১. দলীলশূন্য বক্তব্য পরিহার করবে।

২. নির্দিষ্ট ব্যক্তির পক্ষপাতিত্ব পরিহার করবে।

৩. হক্ব যেখানেই পাবে তা গ্রহণ করবে।

৪. গোটা মুসলিম উম্মাহ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। (ক) মুজতাহিদ, (খ) দলীল বুঝে অভিমত গ্রহণ করে থাকেন এবং (গ) জাহেল মুক্বাল্লিদ যারা কিতাব-সুন্নাহ থেকে ফাতাওয়ার জন্য যে কোন মানুষকে প্রশ্ন করেন এবং তাদের অভিমত গ্রহণ করেন।

৫. নির্দিষ্ট কোন ফিক্বহী মাযহাব লালন না করা এবং মানার ক্ষেত্রে সকল মুজতাহিদকে সমান গুরুত্ব প্রদান করা।

৬. কোন মাসআলা প্রদানে কারো ভুল প্রমাণিত হওয়ার পরেও সেই ভুলকারীর তাক্বলীদ করা শরী‘আতে বৈধ নয়।

৭. ছাহাবায়ে কিরাম, তাবেঈন, প্রসিদ্ধ চার মুজতাহিদ ইমামসহ সকল সালাফে ছালেহীনকে ভালোবাসা প্রতিটি মুসলিমের উপর আবশ্যক।

৮. এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, প্রতিটি যুগেই বিজ্ঞ মুজতাহিদ ইমাম রয়েছেন।

৯. গোটা মুসলিম জাতির ঐক্যের পথ একটাই। সেটি হল, দ্বীনের প্রতিটি বিষয়ে সালাফে ছালেহীনের মানহাজ অনুসরণ করা।

যাবতীয় প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য যিনি জগৎসমূহের পালনকর্তা।  

* পাঁচরুখী, আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ।

তথ্যসূত্র :
[১]. মুহাম্মাদ শাওকানী, আল-কওলুল মুফীদ ফী আদিল্লাতিল ইজতিহাদ ওয়াত তাক্বলীদ (কুয়েত : দারুল ক্বালাম, তা.বি.), পৃ. ৪৬।
[২]. ক্বাওয়া‘ইদুল আহকাম ফিল আন, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৩৪-১৩৬।
[৩]. মীযানিলু ই‘তিদাল-এর মুকাদ্দামা দ্র.।
[৪]. জামিঊ বায়ানিল ইলম, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪৩।
[৫]. ইকাযুল হুমাম, পৃ. ৯৯।
[৬]. ইমাম শাত্বেবী, আল-ই‘তিছাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৭।
[৭]. হালিল মুসলিমু মুলযামুন বি ইত্তিবায়ে মাযহাবিন, পৃ. ১৬।
[৮]. ছিফাতুছ ছালাহ, পৃ. ৩৪।
[৯]. জামিঊ বায়ানিল ইলম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৩।




প্রসঙ্গসমূহ »: বিবিধ
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৭ম কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
আশূরায়ে মুহাররম : করণীয় ও বর্জনীয় - ইউনুস বিন আহসান
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (২য় কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (শেষ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ফাযায়েলে কুরআন (৫ম কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
মসজিদ: ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মাযহাবী গোঁড়ামি ও তার কুপ্রভাব (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : রিদওয়ান ওবাইদ
সালাফী মানহাজের মূলনীতিসমূহ (৩য় কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
হজ্জ ও ওমরাহ সম্পর্কে প্রচলিত বিদ‘আতসমূহ - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও তার সমাধান (৫ম কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামে পর্দার বিধান (২য় কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ইসলামে কথা বলার নীতি : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ

ফেসবুক পেজ