বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০৫:৪৭ পূর্বাহ্ন

কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা

-মূল : ড. সাঈদ ইবনু আলী ইবনু ওয়াহাফ আল-ক্বাহত্বানী
-অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন*


(২য় কিস্তি)

যারা ‘ইলম ব্যতীত আল্লাহর ব্যাপারে কথা বলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের নিন্দা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلۡ  اِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّیَ الۡفَوَاحِشَ مَا ظَہَرَ  مِنۡہَا وَ  مَا بَطَنَ وَ الۡاِثۡمَ وَ الۡبَغۡیَ بِغَیۡرِ الۡحَقِّ وَ اَنۡ تُشۡرِکُوۡا بِاللّٰہِ مَا لَمۡ یُنَزِّلۡ بِہٖ سُلۡطٰنًا وَّ اَنۡ تَقُوۡلُوۡا عَلَی  اللّٰہِ  مَا لَا  تَعۡلَمُوۡنَ

‘(হে নবী!) আপনি বলুন, ‘আমার প্রতিপালক অবশ্যই প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা, পাপ, অন্যায়, বিরোধিতা, আল্লাহর অংশীদার স্থির করা যে ব্যাপারে তিনি কোন প্রমাণ নাযিল করেননি এবং আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদের অজ্ঞতাপ্রসূত কথাবার্তা নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ৩৩)। উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ব্যাপারে ‘ইলমবিহীন কথা বলাকে শিরক করার সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ کُلُوۡا مِمَّا فِی الۡاَرۡضِ حَلٰلًا طَیِّبًا ۫ۖ وَّ لَا تَتَّبِعُوۡا خُطُوٰتِ الشَّیۡطٰنِ ؕ اِنَّہٗ لَکُمۡ عَدُوٌّ مُّبِیۡنٌ-  اِنَّمَا یَاۡمُرُکُمۡ بِالسُّوۡٓءِ وَ الۡفَحۡشَآءِ وَ اَنۡ تَقُوۡلُوۡا عَلَی اللّٰہِ مَا لَا تَعۡلَمُوۡنَ

‘হে মানবজাতি! ভূমণ্ডলে বিদ্যমান বস্তুগুলো হতে হালাল উত্তম জিনিসগুলো খাও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না, বস্তুতঃ সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সে তোমাদেরকে শুধু অসৎ এবং অশ্লীল কর্মের নির্দেশ দেয়, আর তোমাদেরকে নির্দেশ দেয় আল্লাহর সম্বন্ধে এমন কথা বলার যা তোমরা জান না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৬৮-১৬৯)।

উক্ত আয়াতটিও এ কথাকে শক্তিশালী করে যে, ‘ইলম ব্যতীত আল্লাহর ব্যাপারে কথা বলাটা শয়তানের কর্ম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ لَا تَقۡفُ مَا لَیۡسَ لَکَ بِہٖ عِلۡمٌ ؕ اِنَّ السَّمۡعَ وَ الۡبَصَرَ وَ الۡفُؤَادَ  کُلُّ  اُولٰٓئِکَ کَانَ  عَنۡہُ  مَسۡـُٔوۡلًا

‘আর সে বিষয়ের পিছনে ছুটো না, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই। কান, চোখ আর অন্তর- এগুলো বিষয়ে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৩৬)।

আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে ‘ইলমবিহীন কথা বলে, তাকে নবী করীম (ﷺ) অজ্ঞ, পথভ্রষ্ট এবং অপরকে পথভ্রষ্টকারীদের অন্তর্ভুক্ত বলে ঘোষণা করেছেন। এ বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি,

إِنَّ اللهَ لَا يَنْزِعُ الْعِلْمَ مِنَ النَّاسِ انْتِزَاعًا وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعُلَمَاءَ فَيَرْفَعُ الْعِلْمَ مَعَهُمْ وَيُبْقِى فِى النَّاسِ رُءُوْسًا[১] جُهَّالًا يُفْتُوْنَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ فَيَضِلُّوْنَ وَيُضِلُّوْنَ

‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা মানুষের হৃদয় হতে ‘ইলম (জ্ঞান) ছিনিয়ে নিবেন না। বরং আলিমগণকে তাদের ‘ইলমসহ ক্রমশ তুলে নেয়ার মাধ্যমে তা ছিনিয়ে নিবেন। তখন কেবল মূর্খ  নেতারা (আলেমগণ) অবশিষ্ট থাকবে। তারা না জেনে ফাতাওয়া প্রদান করবে। ফলে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে’।[২]

মোদ্দাকথা হল, কারো মতামতের উপর নির্ভর করা জায়েয নয়। বরং আল-কুরআন ও সুন্নাহর দিকে অথবা দু’টির কোন একটির দিকে ফিরে যেতে হবে। যদি আল-কুরআন ও সুন্নাহর কোন দলীল পাওয়া না যায়, তাহলে ইজমা‘র দিকে ফিরে যেতে হবে। যদি এই তিনটির কোন একটিতেও পাওয়া না যায়, তাহলে ছাহাবায়ে কেরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর কথার দিকে ফিরে যেতে হবে। যদি তাঁদের কারো একজনের কথা পাওয়া যায় এবং অন্য কোন ছাহাবী তার বিরোধিতা না করে এবং আল-কুরআন ও সুন্নাহর কোন দলীলও এর বিপরীতে পাওয়া না যায় অথবা এ কথাটি ছাহাবীগণের যুগে প্রসিদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে ছাহাবী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কথা গৃহীত হবে। কেননা ছাহাবী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কথা জমহূর আলিমের নিকট দলীল হিসাবে সাব্যস্ত। তবুও যদি দলীল পেশ করার জন্য ছাহাবী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কোন কথা পাওয়া না যায় এবং ক্বিয়াসের প্রয়োজন অনুভব করে, তাহলে কোন কৃত্রিমতা ব্যতীত সে দিকে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু ক্বিয়াসকে তার যথাস্থানে ব্যবহার করতে হবে এবং ক্বিয়াস বৈধ হওয়ার সাধারণ যে কারণ রয়েছে, যা ক্বিয়াসের অন্তর্ভুক্ত তা সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা করা যাবে না। বরং যদি ক্বিয়াস বৈধ হওয়ার সাধারণ কারণটি সুস্পষ্ট না হয় তাহলে সে যেন মূলের (আল-কুরআন ও সুন্নাহর) উপর অটল থাকে।[৩]

হাদীছ যেমন আল-কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার প্রতি প্রমাণ বহন করে, তেমনি (দ্বীনের ব্যাপারে) মানুষের মতামত গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার সতর্কবাণীও উচ্চারণ করে। যেমন সাহল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বাণী, اِتَّهِمُوْا رَأْيَكُمْ عَلَى دِيْنِكُمْ   ‘তোমরা তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে নিজেদের মতামতের উপর নির্ভর করা থেকে বিরত থাকো’। হাফেয ইবনু হাজার আল-‘আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, أَيْ لَا تَعْمَلُوْا فِيْ أَمْر الدِّيْنِ بِالرَّأْيِ الْمُجَرَّد الَّذِيْ لَا يَسْتَنِد إِلَى أَصْل مِنْ الدِّيْنِ ‘উল্লিখিত আছারের অর্থ হল, তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে শুধু কারো মতের উপর নির্ভর করে আমল করবে না। যে মতটি দ্বীনের উছূল তথা মৌলিক বিষয়ের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখে না’।[৪] এ ব্যাপারে ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর উক্তি কতইনা চমৎকার,

كُلُّ الْعُلُوْمِ سِوَى الْقُرْآنِ مُشْغِلَةٌ * إِلَّا الْحَدِيْثَ وَإِلَّا (عِلْمَ) الْفِقْهِ فِيْ الدِّيْنِ

اَلْعِلْمُ مَا كَانَ فِيْهِ قَالَ حَدَّثَنَا * وَمَا سِوَى ذَاكَ وَسْوَاسُ الشَّيَاطِيْنِ

‘কুরআন, সুন্নাহ ও ইলমুল ফিক্বহ ছাড়া যত জ্ঞান আছে সবই হল পেশা। ‘ইলম তো হল তাই যাতে রয়েছে হাদ্দাছানা (তিনি আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন) এ ছাড়া যা কিছু আছে সবই হল শয়তানের ওয়াসওয়াসা (কুমন্ত্রণা)’।[৫]

সালাফগণ (রাহিমাহুমুল্লাহ) দলীলবিহীন মতামতকে নিন্দা করেছেন। ইবনুল আশাজ্জ (রাহিমাহুল্লাহ) ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন, নিশ্চয় তিনি বলেন,

إِيَّاكُمْ وَأَصْحَابُ الرَّأيِ فَإِنَّهُمْ أَعْدَاءُ السُّنَنِ أَعْيَتْهُمُ الْأَحَادِيْثَ أَنْ يَّحْفَظُوْهَا فَقَالُوْا بِالرَّأيِ فَضَلُّوْا وَأَضَلُّوْا

‘তোমরা রায়পন্থীদের থেকে বেঁচে থাকো। কেননা তারা হলেন সুন্নাহর (হাদীছের) শত্রু। তারা অনেক হাদীছ সংরক্ষণ করা থেকে ব্যর্থ। অতঃপর তারা রায়ের ভিত্তিতে কথা বলে। ফলে তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয় এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করে’।[৬] ওরওয়াহ ইবনুয যুবাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,السُّنَنُ السُّنَنُ فَإِنَّ السُّنَنَ قَوَامُ الدِّيْنِ (أَزْهَدُ النَّاسِ فِي الْعَالَمِ أَهْلُهُ) ‘সুন্নাহসমূহ, সুন্নাহসমূহ। কেননা সুন্নাহসমূহ হচ্ছে দ্বীনের পরিচালক। {দুনিয়াতে মানুষদের মধ্যে তার (সুন্নাহপন্থী) আলেমগণই বেশি দুনিয়াবিমুখ}’।[৭]

ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, لَا تَكَادُ تَرَى أَحَدًا نَظَرَ فِيْ هَذَا الرَّأْيِ إِلَّا وَفِيْ قَلْبِهِ دَغَلٌ ‘তুমি যাকেই দেখবে যে মানুষের রায়ের দিকে দৃষ্টি দেয়, তার অন্তরেই ত্রুটি রয়েছে’।[৮] আওযাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, إِذَا أَرَادَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ أَنْ يَحْرِمَ عَبْدَهُ بَرَكَةَ الْعِلْمِ أَلْقَى عَلَى لِسَانِهِ الْأَغَالِيْطَ ‘আল্লাহ তা‘আলা যখন তাঁর কোন বান্দাকে ‘ইলমের বরকত থেকে বঞ্চিত করতে চান তখন তার যবানে (জিহবায়) ভুল-ত্রুটি চাপিয়ে দেন’।[৯] হাফেয ইবনু আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) কারো রায় (মতামত) গ্রহণ করার নিন্দা করতে গিয়ে অনেকগুলো আছার উল্লেখ করার পর কিছু কথা বলেছেন। যার সারসংক্ষেপ হল, অধিকাংশ আহলে ‘ইলম বলেছেন,

إِنَّ الرَّأْيَ الْمَذْمُوْمَ الْمَعِيْبَ الْمَهْجُوْرَ الَّذِيْ لَا يَحِلُّ النَّظَرُ فِيْهِ وَلَا الْاِشْتِغَالُ بِهِ هُوَ الرَّأْيُ الْمُبْتَدَعُ وَشِبْهُهُ مِنْ أَنْوَاعِ (ضُرُوْبِ) الْبِدَعِ

‘নিশ্চয় নিন্দনীয় ক্বিয়াস যাকে জমহূর বিদ্বান দোষারোপ করেছেন। যার দিকে দৃষ্টি দেয়া বৈধ নয় এবং যাকে নিয়ে ব্যস্ত হওয়াও বৈধ নয়। সেটা হল বিদ‘আতী ক্বিয়াস (মতামত) এবং তাঁর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বিদ‘আতের অন্য প্রকারসমূহ’।[১০] জমহূর আহলে ইলম আরো বলেছেন,

اَلرَّأْيُ الْمَذْمُوْمِ فِيْ هَذِهِ الْآثَارِ الْمَذْكُوْرِ هُوَ الْقَوْلُ فِيْ أَحْكَامِ شَرَائِعِ الدِّيْنِ بِالِاسْتِحْسَانِ وَالظُّنُوْنِ وَالِاشْتِغَالُ بِحِفْظِ الْمُعْضِلَاتِ وَالْأُغْلُوْطَاتِ وَرَدُّ الْفُرُوْعِ وَالنَّوَازِلِ بَعْضِهَا عَلَى بَعْضٍ قِيَاسًا دُوْنَ رَدِّهَا عَلَى أُصُوْلِهَا مِنَ الْكِتَابِ أَوْ مِنَ السُّنَّةِ

‘উল্লেখিত আছারে নিন্দনীয় ক্বিয়াস বলতে বুঝানো হয়েছে, শরী‘আতের আহকাম বর্ণনার ক্ষেত্রে সুন্দর মনে করে, ধারণাবশত এবং নিজের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে কথা বলা এবং কুটিল প্রশ্ন ও জটিল বিষয় আয়ত্ত্ব করতে ব্যস্ত হওয়া। আর সমস্যা সমাধানের মূল উছূল কুরআন ও সুন্নাহর দিকে না ফিরিয়ে শাখাগত বিষয় ও নতুন সমস্যা সম্বলিত একটিকে অপরটির দিকে ফিরিয়ে দেয়া’।[১১] অতঃপর তিনি (ইবনু আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ)) বলেন,

وَمَنْ تَدَبَّرَ الْآثَارَ الْمَرْوِيَّةَ فِيْ ذَمِّ الرَّأْيِ الْمَرْفُوْعَةِ وَآثَارِ الصَّحَابَةِ وَالتَّابِعِيْنَ فِيْ ذَلِكَ عَلِمَ أَنَّهُ مَا ذَكَرْنَا

‘নিন্দনীয় ক্বিয়াসের (মতামতের) ব্যাপারে মারফূ‘ সূত্রে বর্ণিত আছারসমূহ এবং এক্ষেত্রে ছাহাবী ও তাবেঈগণের বাণীগুলো নিয়ে যে ব্যক্তি ভালভাবে চিন্তা করবে সে জানতে পারবে যে, তাহল ঐ সমস্ত বিষয় যা আমরা উল্লেখ করেছি’।[১২] অতএব ইবনু আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) এ কথাটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। অতঃপর তিনি বলেন,

لَيْسَ أَحَدٌ مِنْ عُلَمَاءِ الْأُمَّةِ يُثْبِتُ حَدِيْثًا عَنْ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ ثُمَّ يَرُدُّهُ دُوْنَ ادِّعَاءِ نَسْخِ ذَلِكَ بِأَثَرٍ مِثْلِهِ أَوْ بِإِجْمَاعٍ أَوْ بِعَمَلٍ يَجِبُ عَلَى أَصْلِهِ الْاِنْقِيَادُ إِلَيْهِ أَوْ طَعْنٍ فِيْ سَنَدِهِ وَلَوْ فَعَلَ ذَلِكَ أَحَدٌ سَقَطَتْ عَدَالَتُهُ فَضْلًا عَنْ أَنْ يُتَّخَذَ إِمَامًا وَلَزِمَهُ اسْمُ الْفِسْقِ وَلَقَدْ عَافَاهُمُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ مِنْ ذَلِكَ

‘উম্মতের আলিমগণের মধ্যে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোন হাদীছকে সাব্যস্ত করার পর কোন আছার বা ইজমার মাধ্যমে মানসূখ হওয়ার দাবী করা ব্যতীত যার দিকে ফিরে যাওয়া ওয়াজিব। অথবা সনদে কোন ত্রুটি থাকার দাবী করা ব্যতীত হাদীছটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। যদি কেউ এরূপ কর্ম করে, তাহলে তাকে ইমাম হিসাবে গ্রহণ করা তো দূরের কথা, তাঁর গ্রহণযোগ্যতাই নষ্ট হয়ে যায় এবং সে ফাসিকের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা উম্মতের আলিমদেরকে এর থেকে হেফাযত করেছেন।[১৩] সুতরাং প্রত্যেক বান্দার উপর কর্তব্য হল, আল-কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা, অতঃপর ইজমা‘ তারপর ছাহাবীদের বাণীসমূহকে আঁকড়ে ধরা। আল্লাহ তা‘আলাই হলেন তাওফীক্বদাতা এবং সঠিক সরল পথে পরিচালণাকারী।[১৪]

তৃতীয়তঃ আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনে মানুষের প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ের বর্ণনা করেছেন

কুরআনুল কারীম হল সর্বযুগের সর্বস্থানের সকল সমস্যার প্রত্যাবর্তন স্থল এবং মানুষের দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের একমাত্র আশ্রয়স্থল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ نَزَّلۡنَا عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ تِبۡیَانًا  لِّکُلِّ شَیۡءٍ  وَّ  ہُدًی  وَّ  رَحۡمَۃً   وَّ  بُشۡرٰی  لِلۡمُسۡلِمِیۡنَ ‘আমরা আপনার প্রতি এ কিতাব অবতীর্ণ করেছি যা প্রত্যেকটি বিষয়ের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা, সত্য পথের নির্দেশ, রহমত আর আত্মসমর্পণকারীদের জন্য সুসংবাদ স্বরূপ’ (সূরা আন-নাহল : ৮৯)।

ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেছেন, قَدْ بَيَّنَ لَنَا فَيْ هَذَا القُرْآن كُلّ عِلم وَكُلّ شَيْء ‘আল্লাহ তা‘আলা এই কুরআনে আমাদের জন্য সকল ‘ইলম (জ্ঞান) এবং যাবতীয় বিষয়ের বর্ণনা দিয়েছেন’।[১৫]

চতুর্থতঃ কুরআনুল কারীমকে অবতীর্ণ করা হয়েছে আমল করার জন্য

যে ব্যক্তি জীবনের সর্বাবস্থায় কুরআনের উপর আমল করবে সেই হবে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলকাম, বুদ্ধিমান এবং সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
کِتٰبٌ  اَنۡزَلۡنٰہُ  اِلَیۡکَ مُبٰرَکٌ  لِّیَدَّبَّرُوۡۤا اٰیٰتِہٖ وَ  لِیَتَذَکَّرَ  اُولُوا الۡاَلۡبَابِ ‘এটি একটি কল্যাণময় কিতাব, আমরা আপনার কাছে অবতীর্ণ করেছি যাতে তারা এর আয়াতগুলোর প্রতি চিন্তা-ভাবনা করে, আর জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে থাকে’ (সূরা ছোয়াদ : ২৯)। আর যে ব্যক্তি কুরআনের উপর আমল করবে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর জন্য সফলতা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ কথার উপর প্রমাণ বহণকারী দলীল হল নাফে‘ ইবনু আব্দুল হারেছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিম্নোক্ত হাদীছ,

لَقِىَ عُمَرَ بِعُسْفَانَ وَكَانَ عُمَرُ يَسْتَعْمِلُهُ عَلَى مَكَّةَ فَقَالَ مَنِ اسْتَعْمَلْتَ عَلَى أَهْلِ الْوَادِى فَقَالَ ابْنَ أَبْزَى. قَالَ وَمَنِ ابْنُ أَبْزَى قَالَ مَوْلًى مِنْ مَوَالِيْنَا. قَالَ فَاسْتَخْلَفْتَ عَلَيْهِمْ مَوْلًى قَالَ إِنَّهُ قَارِئٌ لِكِتَابِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ وَإِنَّهُ عَالِمٌ بِالْفَرَائِضِ. قَالَ عُمَرُ أَمَا إِنَّ نَبِيَّكُمْ ﷺ قَدْ قَالَ إِنَّ اللهَ يَرْفَعُ بِهَذَا الْكِتَابِ أَقْوَامًا وَيَضَعُ بِهِ آخَرِيْنَ

‘তিনি [নাফি‘ ইবনু হারেছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)] ওসফান নামক স্থানে ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলেন। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাকে মক্কায় (রাজস্ব আদায়কারী) নিয়োগ করেছিলেন। অতঃপর তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি প্রান্তরবাসীদের জন্য কাকে কাজে নিয়োগ করেছ? সে বলল, ইবনু আবযাকে। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, ইবনু আবযা কে? সে (নাফি‘) বলল, আমাদের আযাদকৃত ক্রীতদাসের একজন। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, তুমি একজন কৃতদাসকে তাদের জন্য খলীফা নিয়োগ করেছ? নাফি‘ বললেন, সে (ক্রীতদাসটি) মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর কিতাবের একজন ভাল ক্বারী। আর সে ফারায়েয শাস্ত্রেও (অভিজ্ঞ) আলিম। তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, জেনে রাখ তোমাদের নবী (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা এ কিতাব দ্বারা অনেক জাতিকে মর্যাদায় উন্নীত করেন আর অন্যদের অবনত করেন।[১৬]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* নারায়ণপুর, নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর।

তথ্যসূত্র :
[১]. رُءُوْسًا (রুউসান) শব্দটি رَأْسٌ (রা’সুন)-এর বহুবচন। আর এতে মূর্খদেরকে নেতা হিসাবে গ্রহণ করা থেকে হুঁশিয়ারী রয়েছে। ইমাম নববী, শরহে মুসলিম, ১৬তম খণ্ড, পৃ. ৪৬৫।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩০৭ ‘কুরআন ও সুন্নাহকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে থাকা’ অধ্যায়, ‘মনগড়া মত ও ভিত্তিহীন ক্বিয়াস নিন্দনীয়’ অনুচ্ছেদ; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৭৩ ‘ইলম’ অধ্যায়, ‘শেষ যামানায় ‘ইলম উঠে যাওয়া, অজ্ঞতা ও ফিৎনা প্রকাশ পাওয়া’ অনুচ্ছেদ।
[৩]. ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২০তম খণ্ড, পৃ. ১৪ ও  ১৯তম খণ্ড, পৃ. ১৭৬; ইমাম ইবনু ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩০; ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ২৮৮।
[৪]. ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ২৮৮।
[৫]. মুহাম্মাদ ‘আফীফ (সঙ্কলন) দেওয়ানুশ শাফেঈ, পৃ. ৮৮; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ১০তম খণ্ড, পৃ. ২৫৪।
[৬]. আল-লালকায়ী, উছূলু ই‘তিক্বাদী আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩৮, আছার নং-২০১; ইবনু আব্দিল বার্র, জামি‘উ বায়ানিল ‘ইলমি ওয়া ফাযলিহি (সঊদী আরব : দারু ইবনিল জাওযী, ১ম সংস্করণ, ১৪১৪ হি./১৯৯৪ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ১০৪২; হা/২০০১, ২০০৩, ২০০৪, ২০০৫।
[৭]. জামি‘উ বায়ানিল ‘ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ২য় খণ্ড, পৃ. ১০৫১, হা/২০২৯, ২০৩০।
[৮]. প্রাগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ. ১০৫৪, হা/২০৩৫।
[৯]. প্রাগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ. ১০৭৩, হা/২০৮৩।
[১০]. প্রাগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ. ১০৫২, হা/২০৩৩।
[১১]. প্রাগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ. ১০৫৪, হা/২০৩৫।
[১২]. প্রাগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ. ১০৬২, হা/২০৫৪।
[১৩]. প্রাগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ. ১০৮০, হা/২১০৫।
[১৪]. সাঈদ ইবনু আলী ইবনু ওয়াহাফ আল-ক্বাহতানী, ফিক্বহুদ দাও‘আহ ফী ছহীহি ইমাম বুখারী (আর-রিয়াসাতুল আম্মাহ লি ইদারাতিল বুহূছিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা ওয়াদ দা‘ওয়াতি ওয়াল ইরশাদ, ১ম সংস্করণ, ১৪২১ হি.), ১ম খণ্ড, ১০৬২।
[১৫]. আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম (দারু ত্বাইয়েবা, ২য় সংস্করণ, ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.), ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৫৯৪।
[১৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮১৭; ইবনু মাজাহ, হা/২১৮; মিশকাত, হা/২১১৫।




প্রসঙ্গসমূহ »: বিবিধ
বিদ‘আত পরিচিতি (২৮তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন : সংশয় নিরসন (৩য় কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
বিদ‘আত পরিচিতি (১৭তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও তার সমাধান (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
সালাম প্রদানের গুরুত্ব ও মর্যাদা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আরিফ হুসাইন
হজ্জের শিক্ষা ও হজ্জ পরবর্তী করণীয় - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
সমকামীতার ভয়াবহতা ও তার অপকার - হাসিবুর রহমান বুখারী
সুন্নাতের রূপরেখা (শেষ কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
ফাযায়েলে কুরআন (৫ম কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
ইসলামী উত্তরাধিকার আইন: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ধারা - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
তওবার গুরুত্ব ও ফযীলত (শেষ কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর

ফেসবুক পেজ