মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০১:০১ পূর্বাহ্ন

পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব

-মূল : ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ)
-অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান*


(৫ম কিস্তি)

উপকারী জ্ঞানের পরিচয়

উপকারী জ্ঞান হল, আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাহর দলীল সম্পর্কে দখল রাখা, তার অর্থ বুঝা এবং কুরআন ও হাদীছের অর্থের ক্ষেত্রে ছাহাবী, তাবেঈ এবং তাবে-তাবেঈদের বর্ণনাগুলোকে ধরে রাখা। সাথে সাথে হালাল-হারামের মাসআলা, যুহ্দ, কোমলতা, সৎকাজ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের থেকে যা বর্ণিত হয়েছে সে সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা। তবে প্রথমে দুর্বল বর্ণনা থেকে বিশুদ্ধ বর্ণনাগুলোকে পৃথক করার জন্য পরিশ্রম করতে হবে অতঃপর সেগুলোর অর্থ ও তাৎপর্য বুঝার জন্য চেষ্টা করতে হবে। যে বুঝে এবং যে  উপকারী জ্ঞান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চায়, তার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।

যে ব্যক্তি এগুলো সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করবে, এক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাঁর কাছে সাহায্য চাইবে, তাহলে আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেন, হেদায়াত দিবেন, তাওফীক্ব দিবেন, সঠিক পথ দেখাবেন, বুঝ দিবেন এবং ইলহাম করবেন। আর তখনই ইলম তাকে বিশেষ ফল দিবে। আর তা হচ্ছে আল্লাহর ভয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِنَّمَا یَخۡشَی اللّٰہَ مِنۡ عِبَادِہِ  الۡعُلَمٰٓؤُا

‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই তাঁকে ভয় করে’ (সূরা আল-ফাত্বির : ২৮)।

আলেমদের বৈশিষ্ট

আল্লাহভীতি : ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) সহ অন্যরা বলেন,

كَفَى بِخَشْيَةِ اللهِ عِلْمًا وَ كَفَى بِالْاِغْتِرَارِ بِاللهِ جَهْلًا.

‘আল্লাহকে ভয় করার জন্য ইলমই যথেষ্ট, আর আল্লাহ সম্পর্কে ধোঁকা খাওয়ার জন্য মূর্খতাই যথেষ্ট’।[১] কোন কোন সালাফ বলেন,

لَيْسَ الْعِلْمُ بِكَثْرَةِ الرِّوَايَةِ وَلَكِنَّ الْعِلْمَ الْخَشْيَةُ

‘বেশি বেশি বর্ণনা করার নামই ইলম নয়, বরং ইলম হচ্ছে আল্লাহভীতি’।[২] কেউ কেউ বলেন,

مَنْ خَشِيَ اللهَ فَهُوَ عَالِمٌ وَ مَنْ عَصَاهُ فَهُوَ جَاهِلٌ

‘যে আল্লাহকে ভয় করল সেই আলেম, আর যে আল্লাহর অবাধ্যতা করল সে জাহেল’।[৩] এ বিষয়ে সালাফদের থেকে আরো বহু উক্তি বর্ণিত হয়েছে।

উপকারী জ্ঞানের ফলাফল

উপকারী জ্ঞান মূলত দু’টি বিষয়কে বুঝায়-

এক. আল্লাহর পরিচয়, উত্তম নাম, সুউচ্চ গুণাবলী এবং চমৎকার কার্যাবলী থেকে যা তার জন্য উপযোগী হয় তাকে বুঝায়। আর এটাই তার মহত্ব, বড়ত্ব, ভয়-ভীতি, ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, তাঁর উপর নির্ভরশীলতা, তাঁর ফায়ছালায় সন্তুষ্ট হওয়া এবং তাঁর পরীক্ষায় ধৈর্য ধরাকে আবশ্যক করে দেয়।

দুই. গোপন ও প্রকাশ্য কথা-কাজ এবং আক্বীদার মধ্য থেকে যেগুলো তিনি ভালোবাসেন এবং সন্তুষ্ট হন, আর যেগুলোকে অপসন্দ করেন এবং রাগান্বিত হন সেগুলো সম্পর্কে জানার্জন করা। আর এসব জানার পর একজন ব্যক্তির জন্য আবশ্যক হয়ে যায়, আল্লাহ তা‘আলা যা ভালোবাসেন এবং যাতে সন্তুষ্ট হন সে দিকে ধাবিত হওয়া এবং যা অপসন্দ করেন ও যে বিষয়ে রাগান্বিত হন তা থেকে দূরে থাকা। সুতরাং যে ইলম তার বহনকারীর জন্য ফলবান হয়, সেটাই উপকারী ইলম।

অতএব ইলম যখন উপকারী হবে এবং আল্লাহর জন্য অন্তরে গেঁথে যাবে, তখন অন্তর আল্লাহকে ভয় করবে এবং শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত হবে। ভয়-ভীতি, সম্মান, ভালোবাসা ও বড়ত্বের কারণে তাঁর কাছে নীচু হয়ে যাবে। আর অন্তর যখন আল্লাহকে ভয় করে এবং তার জন্য বিনয়ী হয়, তখন সে দুনিয়ার সামান্য হালাল বস্তু নিয়েই তৃপ্তি হয়ে যায় এবং তা নিয়েই পরিতৃপ্ত থাকে। আর এটাই তখন অল্পে তুষ্টি এবং দুনিয়াবিমুখতাকে আবশ্যক করে দেয়। আর ধন-সম্পদ, মান-সম্মান এবং জীবন ধারণের অতিরিক্ত জিনিস থেকে যেগুলো ধ্বংসশীল কিংবা চিরদিন থাকে না, মূলত তা আখিরাতে আল্লাহর নিকট বান্দার গচ্ছিত নে‘মতের অংশকে কমিয়ে দেয়। যদিও সে আল্লাহর কাছে সম্মানতি হয়। যেমনটি ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) এবং অন্যান্য সালাফদের থেকে বর্ণিত হয়েছে।

স্বাচ্ছন্দ্যের সময় আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের প্রতি উৎসাহ প্রদান, যাতে করে কষ্টের সময় বান্দা তাঁকে পেতে পারে

আল্লাহভীতি আরো আবশ্যক করে দেয় যে, বান্দা ও তার প্রভুর মধ্যে বিশেষ একটা পরিচিতি থাকবে। তাই বান্দা তাঁর কাছে চাইলে তিনি তাকে দিবেন, তাঁকে ডাকলে তিনি সেই ডাকে সাড়া দিবেন। যেমন একটি হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,


وَلَا يَزَالُ عَبْدِيْ يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ

‘আর আমার বান্দা নফলের সাহায্যে আমার নিকটবর্তী হতে থাকে, এমনকি আমি তাকে ভালোবাসতে থাকি’। অতঃপর তিনি আরো বলেন,

فَلَئِنْ سَأَلَنِيْ لَأُعْطِيَنَّهُ وَلَئِنْ اسْتَعَاذَنِيْ لَأُعِيْذَنَّهُ

‘সে যদি আমার কাছে কিছু চায় আমি অবশ্যই তাকে তা দেই। সে যদি আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে আমি অবশ্যই তাকে আশ্রয় দান করি’।[৪]

অন্য বর্ণনায় আছে, وَلَئِنْ دَعَانِيْ لَأُجِيْبَنَّهُ ‘সে আমাকে ডাকলে আমি অবশ্যই তার ডাকে সাড়া দেই’।[৫] ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে উপদেশ দিতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন,

اِحْفَظِ اللهَ يَحْفَظْكَ اِحْفَظِ اللهَ تَجِدْهُ أَمَامَكَ تَعَرَّفْ إِلَى اللهِ فِيْ الرَّخَاءِ يَعْرِفْكَ فِيْ الشِّدَّةِ

‘তুমি আল্লাহকে সংরক্ষণ করবে, তাহলে আল্লাহ তোমাকে সংরক্ষণ করবেন। তুমি আল্লাহকে স্মরণ করবে তাহলে তাঁকে তুমি তোমার সম্মুখে পাবে। সচ্ছল অবস্থায় তুমি আল্লাহকে স্মরণ করবে, তাহলে কঠিন অবস্থায় তিনি তোমাকে স্মরণ করবেন’।[৬]

অন্তরের মাধ্যমে বান্দা এবং তার প্রভুর মধ্যে বিশেষ এক ধরনের পরিচিতি হবে। আর তা এভাবে যে, বান্দা তাঁকে নিকটে পাবে, নির্জনে তাঁর ঘনিষ্ঠ হবে, তাঁর স্মরণ, দু‘আ ও মুনাজাতে স্বাদ অনুভব করবে। আর এগুলো কেবল সে ব্যক্তিই পাবে, যে গোপনে ও প্রকাশ্যে উভয়াবস্থায় আল্লাহর আনুগত্য করে। যেমন বুহাইব ইবন ওয়ারদকে বলা হল, অবাধ্য ব্যক্তি কি আনুগত্যের স্বাদ পাবে? তিনি বললেন, না, এমনকি যে অবাধ্যতার চিন্তা করে সেও পাবে না।[৭]

আর বান্দা যখন এমনটা অনুভব করবে, তখন সে প্রকৃতপক্ষে তার প্রভুকে চিনবে এবং তার ও আল্লাহর মধ্যে একধরনের বিশেষ পরিচিতি হয়ে যাবে। সুতরাং বান্দা তার কাছে চাইলে তিনি তাকে দিবেন, তাঁকে ডাকলে তিনি সেই ডাকে সাড়া দিবেন। যেমন শা‘ওয়ানাকে[৮] দু‘আ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি ফুযাইল ইবন ই‘আযকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তোমার এবং তোমার প্রভুর মধ্যে এমন কী সম্পর্ক আছে যে, তুমি ডাকলে তিনি সাড়া দিবেন? অতঃপর তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন’।[৯]

বান্দা সর্বদা দুঃখ-কষ্টে পতিত হবে, দুনিয়া, কবর এমনকি বিচারের মাঠেও। অতএব যখন তার এবং তার প্রভুর মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক থাকবে, তখন সকল স্থানে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট হবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে দেয়া উপদেশের মধ্যে এই ইঙ্গিতই রয়েছে। যেমন তিনি বলেন,

تَعَرَّفْ إِلَى اللهِ فِيْ الرَّخَاءِ يَعْرِفْكَ فِيْ الشِّدَّةِ

‘সচ্ছল অবস্থায় তুমি আল্লাহকে স্মরণ করবে তাহলে কঠিন অবস্থায় তিনিও তোমাকে স্মরণ করবেন’।[১০]

মা‘রূফ (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করা হল, মৃত্যু, কবর, হাশরের মাঠ, জান্নাত-জাহান্নাম এগুলোর মধ্যে কোনটি আপনাকে বেশি নাড়া দেয়? তিনি বললেন, এ সবকিছুর কর্তৃত্ব একজনের হাতে, যখন তার মধ্যে এবং তোমার মধ্যে সুন্দর একটি সম্পর্ক থাকবে, তখন সকল বিষয়ে তিনিই তোমার জন্য যথেষ্ট হবেন।[১১]

সুতরাং উপকারী জ্ঞান হল, যা বান্দা এবং তার প্রভুর মধ্যে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং তাকে সঠিক পথ দেখায়। তখন সে তার রবকে চিনতে পারে, তাঁকে এক বলে স্বীকার করে, তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়, তাঁর কাছে আসতে লজ্জাবোধ করে এবং এমনভাবে সে তাঁর ইবাদত করে যেন তাঁকে দেখতে পাচ্ছে।

ইলম থেকে সর্বপ্রথম বিনয় উঠিয়ে নেয়া হবে

এজন্যই একদল ছাহাবী বলেন,

إِنَّ أَوَّلَ عِلْمٍ يُرْفَعُ مِنَ النَّاسِ الْخُشُوْعُ

‘ইলমের যে বস্তুটি সর্বপ্রথম মানুষের থেকে তুলে নেয়া হবে তাহল বিনয়’।[১২] ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,

إِنَّ أَقْوَامًا يَقْرَءُوْنَ الْقُرْآنَ لَا يُجَاوِزُ تَرَاقِيَهُمْ وَلَكِنْ إِذَا وَقَعَ فِى الْقَلْبِ فَرَسَخَ فِيْهِ نَفَعَ

‘নিশ্চয় কিছু লোক এমনভাবে কুরআন পাঠ করে যে, কুরআন তাদের কন্ঠনালি অতিক্রম করে না, কিন্তু যখন তা অন্তরে গিয়ে সুদৃঢ় হবে, তখনই কেবল তা উপকারে আসবে’।[১৩] হাসান (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

اَلْعِلْمُ عِلْمَانِ فَعِلْمٌ عَلَى اللِّسَانِ فَذَلِكَ حُجَّةُ اللهِ عَلَى ابْنِ آدَمَ وَ عِلْمٌ فِيْ الْقَلْبِ فَذَاكَ الْعِلْمُ النَّافِعُ 

‘ইলম দু’প্রকার। যথা : ১. জবানের ইলম, যা আদম সন্তানের উপর আল্লাহ তা‘আলার হুজ্জাত। ২. অন্তরের ইলম, এটাই হল উপকারী ইলম’।[১৪]

আলেমের প্রকারভেদ

সালাফগণ বলতেন, ‘আলেম তিন প্রকার। যথা : ১). আল্লাহ সম্পর্কে আলেম, ২). আল্লাহর বিষয়াদি সম্পর্কে আলেম এবং ৩). আল্লাহ সম্পর্কে আলেম কিন্তু আল্লাহর বিষয়াদি সম্পর্কে আলেম নয়, আবার আল্লাহর বিষয়াদি সম্পর্কে আলেম, আল্লাহ সম্পর্কে আলেম নয়’।[১৫] এর মধ্যে প্রথমজনই হল, পরিপূর্ণ আলেম যে আল্লাহকে ভয় পায় এবং তার বিধি-বিধানসমূহ সম্পর্কে অবগত।

মোট কথা হল- ইলমের মাধ্যমে বান্দা তার রব সম্পর্কে অবহিত হতে পারে এবং তাঁকে চিনতে পারে। আর যখন সে তার প্রভুকে চিনতে পারবে তখন সে তাঁকে নিকটে পাবে। আর যখন সে তাঁকে নিকটে পাবে, তখন আল্লাহ তাকে তাঁর কাছে টেনে নিবেন এবং তার ডাকে সাড়া দিবেন। যেমন একটি ইসরাঈলী বর্ণনায় রয়েছে,

ابْنَ آدَمَ اطْلُبْنِيْ تَجِدْنِيْ فَإِنْ وَجَدْتَّنِيْ وَجَدْتُّ كُلَّّ شَيْءٍ وَ إِنْ فُتَّكَ فَاتَكَ كُلُّّ شَيْءٍ وَ أَنَا أَحَبُّ إِلَيْكَ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ

‘হে আদম সন্তান! তুমি আমাকে খোঁজ, তাহলে আমাকে পাবে। আর আমাকে পেলে তুমি সবকিছুই পাবে, আমাকে হারালে তুমি সবকিছুই হারাবে এবং সবকিছু থেকে আমিই তোমার নিকট সবচেয়ে প্রিয়’।[১৬] ইউনুস (আলাইহিস সালাম) প্রতি রাতে নিচের চরণগুলো পুনরাবৃত্তি করতেন,

لِأَنْفُسِكُمْ مِثْلَ مَا وَجَدْتُّ أَنَا  اطْلُبُوْا

قَدْ وَجَدْتُّ لِيْ سَكَناً لَيْسَ هُوَ فِيْ هَوَاهُ عَنَّا

إِنْ بَعُدتُ قَرَّبَنِي أَوْ قَرُبْتُ مِنْهُ دَنَا .

‘তোমরাও তোমাদের জন্য খোঁজ, যেমনটি আমি পেয়েছি নিজে।
আমি আমার জন্য এমন আবাসস্থল পেয়েছি, কোন কষ্ট নেই যার ভিতরে।
যদি দূরে চলে যায় কভু তিনি কাছে টেনে নেন মোরে অথবা আমি নিজেই চলে যায় তাঁর তরে’।

ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) মা‘রূফ (রাহিমাহুল্লাহ) সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘প্রকৃত ইলম তার সাথেই ছিল। আর তাহল আল্লাহভীতি’।[১৭]

মৌলিক ইলমের পরিচয়

প্রকৃত ইলম হল- আল্লাহ সম্পর্কে জানা, যা আল্লাহর ভয়, তাঁর ভালোবাসা, তাঁর নিকটবর্তী হওয়া, তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়া এবং তাঁর ব্যাপারে আগ্রহী হওয়াকে আবশ্যক করে দেয়।

অতঃপর আল্লাহর বিধি-বিধান সম্পর্কে ইলম অর্জন করতে হবে এবং  কথা, কাজ, অবস্থা বা ‘আক্বীদার মধ্যে বান্দার থেকে তিনি যা ভালোবাসেন এবং পসন্দ করেন সেই সম্পর্কে জানতে হবে। সুতরাং যে এই দু’প্রকার জ্ঞানের বাস্তবায়ন করবে, তার জ্ঞানটা উপকারী জ্ঞান। আর এর মাধ্যমে সে উপকারী ইলম, ভীত অন্তর এবং তুষ্ট হৃদয়ের অধিকারী হতে পারবে। সাথে তার দু‘আ কবুল করা হবে। আর এই উপকারী ইলম যার হাতছাড়া হয়ে যাবে, সে সেই চারটি ক্ষতির মধ্যে পড়বে, যা থেকে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আশ্রয় চেয়েছিলেন।

তার ইলম তার জন্য বিপদ হয়ে যাবে এবং তার বিরুদ্ধে দলীল হয়ে দাঁড়াবে, যার মাধ্যমে সে একটুও উপকৃত হতে পারবে না। কেননা তার অন্তর তার রবের ভয়ে প্রকম্পিত নয় এবং দুনিয়া নিয়ে তার প্রবৃত্তিও পরিতৃপ্ত নয়; বরং দুনিয়ার ব্যাপারে তার লোভ-লালসা, চাওয়া-পাওয়া বৃদ্ধিই পেতে থাকে। তার প্রভুর আদেশের অনুসরণ এবং তার অপসন্দনীয় বিষয় থেকে বিরত না থাকার কারণে তার দু‘আ কবুল করা হয় না। তবে এগুলো তখনই তার উপকারে আসবে যখন তার জ্ঞানটা এমন হবে, যার দ্বারা উপকার লাভ করা সম্ভব, আর তাহল কুরআন ও সুন্নাহ থেকে আহরিত ইলম। আর তা যদি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে আহরিত না হয়, তাহলে তা মূলত অনুপকারী ইলম, যার দ্বারা উপকার লাভ করা সম্ভব নয়, বরং উপকারের চেয়ে তার ক্ষতিই বেশি।

 (ইনশাআল্লাহ চলবে)


* অধ্যয়নরত, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মদীনা মুনাওয়ারাহ, সঊদী আরব।

তথ্যসূত্র :
[১]. ইমাম আহমাদ, আয-যুহ্দ, পৃ. ১৩০; মুছন্নাফে ইবনু আবী শায়বা, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১০৪; ইমাম ত্ববারানী, ‘আল-মু‘জামুল কাবীর’, ৯ম খণ্ড, পৃ. ১৮৯; ইবনু আব্দুল বার্র, জামেঊ বায়ানিল ‘ইলম ও ফাযলিহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮১১, সনদ মুনক্বাতে‘। কেননা বর্ণনাকারীদের মধ্যে আল-ক্বাসেম বিন আব্দুর রহমান তার দাদা আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণনা করেন, কিন্তু আল-ক্বাসেম আব্দুল্লাহ বিন মাসউদের সাক্ষাৎ পাননি। তিনি কেবল তার থেকে ইরসাল করেন। একইভাবে বর্ণনাকারী আল-মাসউদী আল-ক্বাসেম থেকে বর্ণনা করতে গিয়ে অন্যটির সাথে সম্পৃক্ত করেছেন।
[২]. ইমাম আহমাদ, আয-যুহ্দ, পৃ. ১৩১; আবূ নু‘আইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩১; ইবনু আব্দিল বার্র, জামিঊ বায়ানিল ‘ইলম ও ফাযলিহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৫৮; আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর উক্তি থেকে, বর্ণনাকারীগণ ছিক্বাহ তবে সনদ মুনক্বাতে‘; কেননা আউন ইব্ন আব্দুল্লাহ ইব্ন মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর সাক্ষাৎ পায়নি।
[৩]. প্রথমাংশটুকু ইব্ন আব্বাসের উক্তি হিসাবে ইমাম দারেমী বর্ণনা করেন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৬, সনদ যঈফ। ‘আত্বা (রাহিমাহুল্লাহ)-এর উক্তি থেকে  ইবনু আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর ‘জামিঊ বায়ানিল ‘ইলম ওয়া ফাযলিহ’-এ বর্ণনা করেছেন, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮২২, এই সনদেও সমস্যা আছে।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৫০২, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে।
[৫]. মুসনাদে বায্যার, ১৫তম খণ্ড, পৃ. ২৭০; হুবহু ইমাম বুখারীর সনদে, তারপর তিনি বলেন, এই হাদীছ আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে অন্য সনদে বর্ণিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবে ওমর ইবন ইসহাক্ব ইবন ইয়াসার তার চাচা ‘আত্বা ইবন ইয়াসারের সূত্রে মাইমূনা থেকে বর্ণনা করেছেন।
[৬]. উল্লিখিত শব্দে ইমাম আহমাদ, হা/২৭৬৩; আহমাদ শাকের সনদকে ছহীহ বলেছেন, তাহক্বীকুল মুসনাদ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২৮৭; শায়খ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) ছহীহ বলেছেন, ছহীহুল জামে‘, হা/২৯৬১; ইমাম তিরমিযী, অন্য শব্দে বর্ণনা করেছেন, হা/২৫১৬ এবং তিনি বলেন, হাদীছটি হাসান ছহীহ।
[৭]. ইবনুল আরাবী, আল-মু‘জাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৬৬; আবূ নু‘আইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪৪; ইমাম বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, ৯ম খণ্ড, পৃ. ৩৮৫; খত্বীব বাগদাদী, তারীখে বাগদাদ, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৮৩।
[৮]. আবেদা একজন মহীষী রমণী ছিলেন, তিনি আবাল্লাহতে (ইরাক্বের একটি শহর, তার মধ্যে এবং বছরার মধ্যে চার ফারসাখ দূুরত্ব), তার মধুর কন্ঠস্বর ও সুরেলা আওয়াজ ছিল, তিনি মানুষকে উপদেশ দিতেন, তার উপদেশে যাহেদ, আবেদ, নৈকট্যশীল এবং মুজতাহেদারা উপস্থিত থাকতেন। তিনিও মুজতাহেদা ও ক্রন্দনকারিণী ছিলেন। দ্র. সুল্লামী ‘তাবাক্বাতুস সুফিয়্যা, পৃ. ৩৯৩।
[৯]. আবূ নু‘আইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া, ৮ম খণ্ড, পৃ. ১১৩।
[১০]. মুসতাদরাকু ‘আলাছ ছহীহাইন, হা/৬৩০৩।
[১১]. ‘জামেঊল ‘উলূম ওয়াল হিকাম’, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৬৩।
[১২]. তিরমিযী, হা/২৬৫৩; দারেমী, হা/২৯৬, ওবাদা ইবনু ছামেত (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর উক্তি থেকে। ইমাম তিরমিযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাদীছটি হাসান গরীব। ‘ছহীহুত তিরমিযী’ গ্রন্থে আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) ছহীহ বলেছেন; মুসতাদরাকে হাকেম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৭৯-এ বর্ণনা করে বলেছেন, বাছরীদের হাদীছ থেকে এই সনদটি ছহীহ্, ইমাম যাহাবী ‘তালখীছ’-এ তার সাথে একমত পোষণ করেছেন।
[১৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮২২।
[১৪]. দারেমী, হা/৩৭৯; মুছান্নাফে ইবনু আবী শায়বা, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৮২; ইবনুল মুবারক, আয-যুহ্দ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪০৭, সনদ যঈফ। কেননা হাসান বাছরী থেকে হিশাম ইবন হাস্সানের বর্ণনার ক্ষেত্রে সমস্যা আছে, তাহযীবুত তাহযীব, ১১তম খণ্ড, পৃ. ৩৬।
[১৫]. দারেমী, হা/৩৭৫; আবূ নু‘আইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৭৯; ইবনু আব্দুল বার্র, জামিঊ বায়ানিল ‘ইলম ও ফাযলিহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮২২; ইমাম বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, ৩য় খণ্ড, পৃ ৩২৩, ইবনু আব্দুল বার্রের নিকট তা আবূ হাইয়ান আত-তামীমীর কথা।
[১৬]. শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যা, জামিঊল মাসাইল, ১ম খণ্ড,পৃ. ১৫৯; ইবনুল ক্বাইয়িম, ‘আদ্-দাঊ ওয়াদ দাওয়াঊ, পৃ. ৪৬২; মাদারীজুস সালিকীন, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৩২; তাফসীর ইবনু কাছীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪২।
[১৭]. খত্বীব বাগদাদী, তারীখে বাগদাদ, ১৫তম খণ্ড, পৃ. ২৬৩; ইবনু আবী ই‘আলা, ত্ববাক্বাতুল হানাবালাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৮২, مَعَهُ رَأْسُ الْعِلْمِ শব্দে বর্ণনা করেছেন।




ফাযায়েলে কুরআন (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
হজ্জ মুসলিম উম্মাহর বিশ্ব সম্মেলন - প্রফেসর ড. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
সালাফী মানহাজের মূলনীতিসমূহ (শেষ কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১৮তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৩য় কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (১০ম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
মাযহাবী গোঁড়ামি ও তার কুপ্রভাব (শেষ কিস্তি) - অনুবাদ : রিদওয়ান ওবাইদ
ইসলামে কথা বলার নীতি : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৭ম কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৫ম কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী

ফেসবুক পেজ