আশূরায়ে মুহাররম
-ছাদীক মাহমূদ
প্রেক্ষাপট
‘আশূরা’ শব্দটি আরবী শব্দ ‘আশারা’ থেকে এসেছে, যার অর্থ হল ‘দশ’। হিজরী সনের প্রথম মাস মুহাররম। যেহেতু ইহা মুহাররম মাস, তাই এই দিনটির নামানুসারে একে বলা হয় ‘আশূরায়ে মুহাররম’ বা দশ-ই মুহাররম। ফেরাঊনের সাগরডুবি ও মূসা (আ.)-এর মুক্তি লাভের অলৌকিক ঘটনাটি ঘটেছিল ১০ই মুহাররম আশূরার দিন। এ দিনের স্মরণে আল্লাহ্র শুকরিয়া স্বরূপ মূসা ন ও বনী ইসরাঈলরা প্রতি বছর এ দিন ছিয়াম পালন করতেন। এই ছিয়ামই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। জাহেলী যুগেও এ ছিয়াম চালু ছিল। নবুঅতপূর্বকালে ও পরে রাসূলুল্লাহ ন আশূরার ছিয়াম রাখতেন। ২য় হিজরীতে রামাযানের ছিয়াম ফরয হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আশূরার ছিয়াম মুসলিমদের জন্য ‘ফরয’ ছিল। এরপর এটি নফল ছিয়ামে পরিণত হয়।[১] আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ يَوْمُ عَاشُوْرَاءَ تَصُوْمُهُ قُرَيْشٌ فِى الْجَاهِلِيَّةِ وَكَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُوْمُهُ فَلَمَّا قَدِمَ الْمَدِيْنَةَ صَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ فَلَمَّا فُرِضَ رَمَضَانُ تَرَكَ يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ فَمَنْ شَاءَ صَامَهُ وَمَنْ شَاءَ تَرَكَهُ
‘জাহেলী যুগে কুরায়েশরা আশূরার ছিয়াম পালন করত। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও তা পালন করতেন। মদীনায় হিজরতের পরেও তিনি পালন করেছেন এবং লোকদেরকে তা পালন করতে বলেছেন। কিন্তু (২য় হিজরী সনে) যখন রামাযান মাসের ছিয়াম ফরয হল, তখন তিনি বললেন, যে ব্যক্তির ইচ্ছা আশূরার ছিয়াম পালন কর এবং যে ব্যক্তির ইচ্ছা তা পরিত্যাগ কর’।[২] মসজিদে নববীতে খুৎবা দান কালে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
.هَذَا يَوْمُ عَاشُوْرَاءَ وَلَمْ يُكْتَبْ عَلَيْكُمْ صِيَامُهُ وَأَنَا صَائِمٌ فَمَنْ شَاءَ فَلْيَصُمْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيُفْطِرْ
‘আজ আশূরার দিন। এদিনের ছিয়াম তোমাদের উপরে আল্লাহ ফরয করেননি। তবে আমি ছিয়াম রেখেছি। এক্ষণে তোমাদের মধ্যে যে ইচ্ছা কর ছিয়াম পালন কর, যে ইচ্ছা কর পরিত্যাগ কর’।
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় হিজরত করে ইহুদীদেরকে আশূরার ছিয়াম রাখতে দেখে জিজ্ঞেস করলে তারা বলে,
هَذَا يَوْمٌ عَظِيْمٌ أَنْجَى اللهُ فِيْهِ مُوسَى وَقَوْمَهُ وَغَرَّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ فَصَامَهُ مُوسَى شُكْرًا فَنَحْنُ نَصُوْمُهُ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَنَحْنُ أَحَقُّ وَأَوْلَى بِمُوسَى مِنْكُمْ فَصَامَهُ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ
‘এটি একটি মহান দিন। এদিনে আল্লাহ তা‘আলা মূসা ন ও তাঁর কওমকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরাঊন ও তার লোকদের ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তার শুকরিয়া হিসাবে মূসা ন এ দিন ছিয়াম পালন করেন। অতএব আমরাও এ দিন ছিয়াম পালন করি। তখন রাসূলুল্লাহ ফ বললেন, তোমাদের চাইতে আমরাই মূসা (আ.)-এর (আদর্শের) অধিক হকদার ও অধিক দাবীদার। অতঃপর তিনি ছিয়াম রাখেন ও সকলকে রাখতে বলেন (যা পূর্ব থেকেই তাঁর রাখার অভ্যাস ছিল)’। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত,
حِيْنَ صَامَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّهُ يَوْمٌ تُعَظِّمُهُ الْيَهُوْدُ وَالنَّصَارَى فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ إِنْ شَاءَ اللهُ صُمْنَا الْيَوْمَ التَّاسِعَ قَالَ فَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ حَتَّى تُوُفِّيَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
‘যখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আশূরার ছিয়াম পালন করলেন ও অন্যকে পালন করার নির্দেশ দিলেন, তখন ছাহাবীগণ বললেন, এটা তো এমন এক দিবস যাকে ইহুদী ও খ্রিস্টানরা সম্মান করে থাকে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আগামী বছর এলে আমরা ইনশাআল্লাহ ৯ম তারিখে ছিয়াম পালন করব’। ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ‘পরবর্তী বছর আসার পূর্বেই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তেকাল করেন’।
ফযীলত
আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘রামাযান মাসের পর সর্বোত্তম ছিয়াম হল আল্লাহর মাস মুহাররমের ছিয়াম। আর ফরয ছালাতের পর সর্বোত্তম ছালাত হল রাতের ছালাত’।
.عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَال صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللهِ الْمُحَرَّمُ وَأَفْضَلُ الصَّلّاةِ بَعْدَ الْفَرِيْضَةِ صَلَاةُ اللَّيْلِ
আবু ক্বাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আশূরার ছিয়াম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হল, তিনি বললেন, ‘তা বিগত এক বছরের গোনাহের কাফফারা’।
জ্ঞাতব্য : আশূরায়ে মুহাররমে এক বা দু’দিন স্রেফ নফল ছিয়াম ব্যতীত আর কিছুই করার নেই। ১০ই মুহাররম তারিখে পৃথিবীতে আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ন্যায় ৬১ হিজরী সনে হুসাইন ভ-এর মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু সেজন্য ছিয়াম পালন, অনুষ্ঠান করা, শোক দিবস পালন ইত্যাদির বিধান ইসলামী শরী‘আতে নেই। অতএব আশূরার ছিয়াম পালনের নিয়ত হবে ‘নাজাতে মূসার শুকরিয়া’ হিসাবে, ‘শাহাদাতে হুসায়েন’-এর শোক হিসাবে নয়। এরূপ নিয়ত করলে নেকীর বদলে গোনাহ হবে। কারণ কারবালার ঘটনার ৫০ বছর পূর্বেই ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে এবং অহি-র আগমন বন্ধ হয়ে গেছে।
আশূরায়ে মুহাররমে ইসলাম বিরোধী কার্যাবলী
আশূরায়ে মুহাররম আমাদের দেশসহ অনেক মুসলিম দেশে শোকের মাস হিসাবে পালিত হয়। শী‘আ, সুন্নী সকলে মিলে অবলীলাক্রমে শিরক ও বিদ‘আতে লিপ্ত হয়। কোটি কোটি টাকার অপচয় হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে। সরকারী ছুটি ঘোষিত হয় ও সরকারীভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি পালিত হয়। রক্তের নামে লাল রং ছিটানো হয়। রাস্তা-ঘাট রং-বেরং সাজে সাজানো হয়। লাঠি-তীর-বল্লম নিয়ে যুদ্ধের মহড়া দেয়া হয়। হুসাইন ভ-এর নামে কেক ও পাউরুটি বানিয়ে ‘বরকতের পিঠা’ বলে বেশী দামে বিক্রি করা হয়। সুসজ্জিত অশ্বারোহী দলের মিছিল বের করে কারবালা যুদ্ধের মহড়া দেয়া হয়। কালো পোষাক পরিধান বা কালো ব্যাজ ধারণ করা হয় ইত্যাদি। এমনকি অনেকে শোকের মাস ভেবে এই মাসে বিবাহ-শাদী করাও অন্যায় মনে করে থাকে। ঐ দিন অনেকে পানি পান করা এমনকি শিশুর দুধ পান করানোকেও অন্যায় ভাবে। হুসাইন ভ-এর নামে ভুয়া কবর তৈরি করে রাস্তায় তা‘যিয়া বা শোক মিছিল বের করা হয়। ঐ ভুয়া কবরে হুসাইনের রূহ হাযির হয় ধারণা করে তাকে সালাম করা হয়। তার সামনে মাথা ঝুঁকানো হয়। সেখানে সিজদা করা হয়, মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য প্রার্থনা করা হয়। এগুলো পরিষ্কার শিরক। কারণ আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সিজদা করা হারাম। তা‘যিয়ার নামে ভুয়া কবর যিয়ারত করাও মূর্তিপূজার শামিল।
এছাড়া মিথ্যা শোক প্রদর্শন করে বুক চাপড়ানো হয়, বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। ‘হায় হোসেন’ ‘হায় হোসেন’ বলে মাতম করা হয়। এগুলো কোনকিছুই ইসলামী রীতি নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُوْدَ وَشَقَّ الْجُيُوْبَ وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ ‘ঐ ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে ব্যক্তি শোকে নিজ মুখে মারে, কাপড় ছিঁড়ে ও জাহেলী যুগের ন্যায় মাতম করে’। অন্য হাদীছে এসেছে যে, أَنَا بَرِىءٌ مِمَّنْ حَلَقَ وَسَلَقَ وَخَرَقَ ‘আমি ঐ ব্যক্তি হতে দায়িত্বমুক্ত, যে ব্যক্তি শোকে মাথা মুণ্ডন করে, উচ্চৈঃস্বরে কাঁদে ও কাপড় ছিঁড়ে’।
অপরদিকে উগ্র শী‘আরা কোন কোন ‘ইমাম বাড়া’তে আয়েশা (রা.)-এর নামে বেঁধে রাখা একটি বকরীকে লাঠিপেটা করে ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে বদলা নেয় ও উল্লাসে ফেটে পড়ে। তাদের ধারণা মতে আয়েশা র-এর পরামর্শক্রমেই আবুবকর ভ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অসুখের সময় জামা‘আতে ইমামতি করেছিলেন ও পরে খলীফা নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাই আলী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খলীফা হতে পারেননি (নাঊযুবিল্লাহ)। ওমর, ওছমান, মু‘আবিয়া, মুগীরা বিন শো‘বা (রা.) প্রমুখ জলীলুল ক্বদর ছাহাবীকে এ সময় বিভিন্নভাবে গালি দেয়া হয়। অথচ ছাহাবায়ে কেরামকে গালি দেয়া সবচেয়ে বড় গোনাহের কাজ। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
لَا تَسُبُّوْا أَصْحَابِىْ فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلَا نَصِيْفَهُ
‘তোমরা আমার ছাহাবীগণকে গালি দিয়ো না। কেননা (তাঁরা এমন উচ্চ মর্যাদার অধিকারী যে) তোমাদের কেউ যদি ওহোদ পাহাড় পরিমাণ সোনাও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তবুও তাঁদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ অর্থাৎ সিকি ছা‘ বা তার অর্ধেক পরিমাণ (যব খরচ)-এর সমান ছওয়াব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না’।
এ ছাড়াও রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একথা বুঝাতে চেষ্টা করে যে, আশূরায়ে মুহাররমের মূল বিষয় হল শাহাদাতে হুসাইন ভ বা কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা। চেষ্টা করা হয় এটাকে ‘হক্ব ও বাতিলের’ লড়াই হিসাবে প্রমাণ করতে। চেষ্টা করা হয় হুসাইনকে মা‘ছূম ও ইয়াযীদকে মাল‘ঊন প্রমাণ করতে। অথচ প্রকৃত সত্য এসব থেকে অনেক দূরে।
* পি-এইচ.ডি. গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
১. ছহীহ মুসলিম, হা/১১২৮; মিশকাত, হা/২০৬৯ ‘ছিয়াম’ অধ্যায়, ‘নফল ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ-৬।
২. ছহীহ বুখারী, হা/২০০২ ‘ছওম’ অধ্যায়।
৩. ছহীহ বুখারী, হা/২০০৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১১২৯ ‘ছিয়াম’ অধ্যায়।
৪. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৩০।
৫. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৩৪।
৬. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬৩।
৭. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬২; তিরমিযী, হা/২৮০৯।
৮. ছহীহ বুখারী, হা/১২৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৩; মিশকাত, হা/১৭২৫ ‘জানাযা’ অধ্যায়।
৯. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৪; মিশকাত, হা/১৭২৬।
১০. ছহীহ বুখারী, হা/৩৬৭৩; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৪০; মিশকাত, হা/৫৯৯৮ ‘ছাহাবীগণের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ।