মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ১১:১৯ অপরাহ্ন

সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা

-ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর*


(৩য় কিস্তি)

হারাম জিনিসের ব্যবসার বিধান

মূলনীতি হল- যে সকল জিনিস ভক্ষণ করা হারাম সেগুলোর ব্যবসাও হারাম। হারাম জিনিসের ব্যবসা করা শরী‘আত পরিপন্থী। তাই কোন মুসলিমের এরূপ গর্হিত জিনিসের ব্যবসা করা নিষিদ্ধ। যাতে করে হারাম জিনিস সমাজে সম্প্রসারিত না হয়। হারাম জিনিস নির্মূল করার জন্যই ইসলামের এই ব্যবস্থপনা। যেমনটি হাদীছে বিবৃত হয়েছে।

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ لَمَّا نَزَلَتْ الْآيَاتُ مِنْ آخِرِ سُوْرَةِ الْبَقَرَةِ فِي الرِّبَا قَرَأَهَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى النَّاسِ ثُمَّ حَرَّمَ التِّجَارَةَ فِي الْخَمْرِ

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘সূদ সম্পর্কে সূরা আল-বাক্বারাহর শেষ আয়াতগুলো যখন অবতীর্ণ হল, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লোকদের নিকট তা পাঠ করে শোনালেন। তারপর মদের ব্যবসা নিষিদ্ধ করে দিলেন’।[১]

عَنْ عَائِشَةَ أَنَّهَا قَالَتْ لَمَّا أُنْزِلَتْ الْآيَاتُ الْأَوَاخِرُ مِنْ سُوْرَةِ الْبَقَرَةِ خَرَجَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَتَلَاهُنَّ فِي الْمَسْجِدِ فَحَرَّمَ التِّجَارَةَ فِي الْخَمْرِ

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘সূদ সম্পর্কে সূরা আল-বাক্বারাহর শেষ আয়াতগুলো যখন অবতীর্ণ হল, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘর থেকে বের হলেন এবং মসজিদে লোকদের নিকট তা পড়ে শোনালেন। এরপর মদের ব্যবসা নিষিদ্ধ করে দিলেন’।[২]

অপর এক বর্ণনা মতে বুঝা যায় যে, সূদের আয়াতই শেষ পর্যায়ে নাযিলকৃত আয়াতের মধ্যে অন্যতম। যেমন হাদীছে এসেছে,

عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ آخِرُ آيَةٍ نَزَلَتْ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ آيَةُ الرِّبَا

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর অবতীর্ণ হওয়া শেষ আয়াতটি হল সূদ সম্পর্কিত’।[৩]

উপরিউক্ত হাদীছগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে, সূদ হারাম হওয়ার সাথে সাথে মদের ব্যবসা নিষিদ্ধ করা হয়। যখন সূদ হারাম করা হল, তখনই মদের ব্যবসা নিষিদ্ধ করা হল। এতে বুঝা যায় সূদ যেমন হারাম, তেমনি মদও হারাম। হাদীছটি মুসলিমদেরকে প্রতিটি হারাম পণ্যের ব্যবসা নিষিদ্ধ হওয়ার দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাছাড়া অন্য হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, নেশা জাতীয় দ্রব্য খাওয়া ও ব্যবসা করা উভয়ই হারাম।

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّهُ سَمِعَ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ عَامَ الْفَتْحِ وَهُوَ بِمَكَّةَ إِنَّ اللهَ حَرَّمَ بَيْعَ الْخَمْرِ وَالْمَيْتَةَ وَالْخِنْزِيْرَ وَالْأَصْنَامَ

জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, তিনি মক্কা বিজয়ের বছর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মক্কায় বলতে শুনেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ মদ, মৃতপ্রাণী, শূকর ও মূর্তির ক্রয়-বিক্রয় হারাম করেছন’।[৪] অন্য বর্ণনায় রয়েছে- রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ নেশাদার দ্রব্য ও তার মূল্য, মৃতপ্রাণী ও তার মূল্য এবং শূকর ও তার মূল্য হারাম করেছেন’।[৫]

অতএব যে সকল জিনিস ভক্ষণ করা হারাম সেগুলোর ব্যবসাও হারাম। হাদীছদ্বয়ে মদ বা সকল নেশা জাতীয় দ্রব্য, মৃতপ্রাণী, শূকর ও মূর্তির ব্যবসা করা হারাম হয়েছে। কেনাবেচার সাথে এর লভ্যাংশ ভোগ করাও হারাম করা হয়েছে। মোটকথা এ সব ক্রয়-বিক্রয় করা, পালন করা, বিক্রয়ের মূল্য ভোগ করা এমনকি লভ্যাংশ ভোগ করা সবই অবৈধ। এগুলোর সাথে কোন মুসলিম ব্যক্তি জড়িত হতে পারবে না। যারা স্বীয় দোকানে বিভিন্ন প্রকারের মূর্তি খেলনার নামে বিক্রি করছেন তারা এই হাদীছের আলোকে কী জবাব দিবেন? পূজার জন্য হোক আর খেলনার জন্য হোক সেগুলো তো মূর্তিই! অন্যদিকে যে সকল মুদী দোকানদার বিড়ি, সিগারেট, গুল, আলাপাতা, জর্দা ইত্যাদি বিক্রয় করেন তারাও বা কী জবাব দিবেন? অথচ এরূপ হীন কর্ম পরিহার করা উচিত। এ ক্ষেত্রে আরো একটি হাদীছ উল্লেখ করা দরকার-

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ  رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِى الْخَمْرِ عَشَرَةً عَاصِرَهَا وَمُعْتَصِرَهَا وَشَارِبَهَا وَحَامِلَهَا وَالْمَحْمُوْلَةَ إِلَيْهِ وَسَاقِيَهَا وَبَائِعَهَا وَآكِلَ ثَمَنِهَا وَالْمُشْتَرِىَ لَهَا وَالْمُشْتَرَاةَ لَهُ

আনাস ইবনু মালেক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মদের সাথে সম্পর্ক রাখে এমন দশ শ্রেণীর লোকের প্রতি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অভিশাপ করেছেন। ১. যে মদ তৈরি করে। ২. যে মদ তৈরির নির্দেশ দেয়। ৩. যে মদ পান করে। ৪. যে মদ বহন করে। ৫. যার জন্য মদ বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়। ৬. যে মদ পান করায়। ৭. যে মদ বিক্রি করে। ৮. যে মদের লভ্যাংশ ভোগ করে। ৯. যে মদ ক্রয় করে এবং ১০. যার জন্য মদ ক্রয় করা হয়।[৬]

উল্লেখিত হাদীছে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে যে, মদের সাথে সম্পৃক্ত সকল ব্যক্তিই অভিশপ্ত। তথা হারাম জিনিসের ক্রয়-বিক্রয় থেকে শুরু করে এর সবকিছুই ইসলামের দৃষ্টিতে গর্হিত কাজ। হারাম জিনিসের ব্যবসায়ের সাথে সম্পৃক্ত সকল ব্যক্তির জন্য অত্র হাদীছটি মাইল ফলক। যা থেকে সকল মুসলিমের সর্তক হওয়া একান্ত যরূরী।

হাদীছের আলোকে সূদ

ইতোমধ্যে সূদের প্রাচীন ইতিহাসের অনেক কিছুই আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। এক্ষণে এ ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার হওয়া দরকার। মানবমুক্তির অগ্রদূত নবীকুল শিরোমনী রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিভিন্ন পর্যায়ে সূদের যে বিররণ পেশ করেছেন, তা পর্যালোচনা করলে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। নি¤েœ কখন কোন্ লেনদেনে সূদ হয় তা তুলে ধরা হল-

(ক) একই বস্তু (ভালো-মন্দ) বিনিময়ে কম-বেশি করা সূদ

এক জাতীয় (ভালো-মন্দ) বস্তু পরস্পরের মধ্যে লেনদেনে কম-বেশি করা সূদের অন্তর্ভুক্ত। কম দিয়ে বেশি নেয়া বা বেশি দিয়ে কম নেয়া উভয়ই অপরাধ। যেমনটি হাদীছে বিধৃত হয়েছে-

عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ جَاءَ بِلَالٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِتَمْرٍ بَرْنِيٍّ فَقَالَ لَهُ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ أَيْنَ هَذَا؟ قَالَ كَانَ عِنْدَنَا تَمْرٌ رَدِيْءٌ فَبِعْتُ مِنْهُ صَاعَيْنِ بِصَاعٍ لِنُطْعِمَ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ أَوَّهْ عَيْنُ الرِّبَا عَيْنُ الرِّبَا لَا تَفْعَلْ وَلَكِنْ إِذَا أَرَدْتَ أَنْ تَشْتَرِيَ التَّمْرَ فَبِعِ التَّمْرَ بِبَيْعٍ آخَرَ ثُمَّ اشْتَرِ بِهِ

আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদা বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট কিছু উন্নতমানের (বরমী/বারনী) খেজুর নিয়ে আসল। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেন, তুমি কোথা থেকে এ খেজুর আনলে? বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আমাদের খেজুর নিকৃষ্টমানের ছিল। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে তা দু’ ছা‘ এর বিনিময়ে এক ছা‘ কিনেছি। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘ওহ! এতো নির্ভেজাল সূদ, এতো নির্ভেজাল সূদ। কখনো এরূপ কর না। তোমরা যদি উত্তম খেজুর পেতে চাও, তাহলে নিজের খেজুর বাজারে বিক্রি করবে, তারপর উন্নতমানের খেজুর কিনে নিবে’।[৭]

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اسْتَعْمَلَ رَجُلًا عَلَى خَيْبَرَ فَجَاءَهُ بِتَمْرٍ جَنِيْبٍ فَقَالَ أَكُلُّ تَمْرِ خَيْبَرَ هَكَذَا؟ قَالَ لَا وَاللهِ يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ  إِنَّا لَنَأْخُذُ الصَّاعَ مِنْ هَذَا بِالصَّاعَيْنِ وَالصَّاعَيْنِ بِالثَّلَاثِ فَقَالَ لَا تَفْعَلْ بِعِ الْجَمْعَ بِالدَّرَاهِمِ ثُمَّ ابْتَعْ بِالدَّرَاهِمِ جَنِيْبًا. وَقَالَ فِي الْمِيْزَانِ مِثْلَ ذَلِكَ

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক ব্যক্তিকে ‘খায়বার’ এলাকায় চাকরি দিলেন। ঐ ব্যক্তি সেখান থেকে খুব ভাল মানের কিছু খেজুর নিয়ে আসল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, খায়বারের সব খেজুরই কি এরূপ উত্তম হয়? ঐ ব্যক্তি বলল, না, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আল্লাহর শপথ! আমরা এরূপ এক ছা‘ খেজুর দুই ছা‘ খারাপ খেজুরের বিনিময়ে গ্রহণ করে থাকি। অথবা ভাল দুই ছা‘ খারাপ তিন ছা‘-এর বিনিময়ে গ্রহণ করে থাকি। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, এরূপ বিনিময় কর না; বরং খারাপ খেজুর মুদ্রার বিনিময়ে বিক্রি কর। অতঃপর ঐ মুদ্রা দ্বারা ভাল খেজুর ক্রয় কর। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এটাও বললেন, ‘বাটখারায় ওযন করা বস্তুর একই বিধান’।[৮]

عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كَانَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَرْزُقُنَا تَمْرًا مِنْ تَمْرِ الْجَمْعِ فَنَسْتَبْدِلُ بِهِ تَمْرًا هُوَ أَطْيَبُ مِنْهُ وَنَزِيْدُ فِى السِّعْرِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَصْلُحُ صَاعُ تَمْرٍ بِصَاعَيْنِ وَلَا دِرْهَمٌ بِدِرْهَمَيْنِ وَالدِّرْهَمُ بِالدِّرْهَمِ وَالدِّيْنَارُ بِالدِّيْنَارِ لَا فَضْلَ بَيْنَهُمَا إِلَّا وَزْنًا

আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে আহারের জন্য নি¤œ মানের খেজুর দিতেন। আমরা এই খেজুর পরিমাণে বেশি দিয়ে উত্তম (অপেক্ষাকৃত উন্নত মানের) খেজুর বদলে নিতাম। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘এক ছা‘ খেজুরের পরিবর্তে দু’ ছা‘ খেজুর এবং এক দিরহামের পরিবর্তে দু’ দিরহাম গ্রহণ করা বৈধ নয়, বরং এক দিরহামের পরিবর্তে এক দিরহাম এবং এক দীনারের পরিবর্তে এক দীনার সমান ও ওযনে অতিরিক্ত না করে নেয়া যাবে’।[৯]

বর্ণিত হাদীছগুলোতে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, একই জাতীয় ভালো-মন্দ দ্রব্য বিনিময় করার সময় কম-বেশি করা যাবে না। এরূপ বিনিময় সূদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তা হারাম। এ ক্ষেত্রে যদি একজনের দ্রব্য ভালো হয়, আর অপর জনের দ্রব্য অপেক্ষাকৃত মন্দ হয়। তবুও কম দিয়ে বেশি নেয়া বা বেশি দিয়ে কম নেয়া নিষিদ্ধ। বরং মন্দ দ্রবটি বিক্রি করে তার মূল্য দিয়ে ভালো দ্রব্যটি খরিদ করতে হবে। অন্যথা তারা সূদী কারবারে জড়িয়ে পড়বে।

(খ) সমমানের একই দ্রব্য বিনিময়ে কম-বেশি করা সূদ

সমমানের একই জাতীয় দ্রব্য বিনিময় করতে চাইলে নগদে এবং সমান সামন বিনিময় করতে হবে। এক্ষেত্রে কম-বেশি লেনদেন করলেও সূদ হিসাবে গণ্য হবে। 

عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِيِّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الذَّهَبُ بِالذَّهَبِ وَالْفِضَّةُ بِالْفِضَّةِ وَالْبُرُّ بِالْبُرِّ وَالشَّعِيْرُ بِالشَّعِيْرِ وَالتَّمْرُ بِالتَّمْرِ وَالْمِلْحُ بِالْمِلْحِ مَثَلًا بِمَثَلٍ يَدًا بِيَدٍ فَمَنْ زَادَ أَوِ اسْتَزَادَ فَقَدْ أَرْبَى الْآخِذُ وَالْمُعْطِيْ فِيْهِ سَوَاءٌ

আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিন বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ, রূপার বিনিময়ে রূপা, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর, লবণের বিনিময়ে লবণ লেনদেন করা হলে একই জাতীয় সমপরিমাণে নগদে আদান-প্রদান করতে হবে। আর যে ব্যক্তি একই জাতীয় পণ্যের বিনিময়ে বেশি দেয় ও বেশি গ্রহণ করে, সে সূদ লেনদেনকারী বলে গণ্য হবে। অতএব এ ব্যাপারে গ্রহীতা ও দাতা উভয়েই সমান অপরাধী।[১০] অন্য বর্ণনায় রয়েছে, فَمَنْ زَادَ أَوِ اسْتَزَادَ فَهُوَ رِبًا ‘যে অতিরিক্ত দিবে বা অতিরিক্ত গ্রহণ করবে, তাই সূদ হবে’।[১১]

عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِيِّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا تَبِيْعُوا الذَّهَبَ بِالذَّهَبِ إِلَّا مِثْلًا بِمِثْلٍ وَلَا تُشِفُّوْا بَعْضَهَا عَلَى بَعْضٍ وَلَا تَبِيْعُوا الْوَرِقَ بِالْوَرِقِ إِلَّا مِثْلًا بِمِثْلٍ وَلَا تُشِفُّوْا بَعْضَهَا عَلَى بَعْضٍ وَلَا تَبِيْعُوْا مِنْهَا غَائِبًا بِنَاجِزٍ

আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ সমান সমান ব্যতীত বিক্রি করো না এবং এক অংশের উপর অপর অংশ বেশি কর না। রূপার বিনিময়ে রূপা সমান সমান ব্যতীত বিক্রি কর না এবং এক অংশের উপর অপর অংশ বেশি কর না। আর এ বস্তুদ্বয়ে নগদের সাথে বাকির বিনিময়ে ক্রয়-বিক্রয় কর না। অর্থাৎ একপক্ষের দ্রব্য নগদ আর অন্যপক্ষের দ্রব্য বাকী লেনদেন চলবে না।[১২]

عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِىِّ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا تَبِيْعُوا الذَّهَبَ بِالذَّهَبِ وَلَا الْوَرِقَ بِالْوَرِقِ إِلَّا وَزْنًا بِوَزْنٍ مِثْلًا بِمِثْلٍ سَوَاءً بِسَوَاءٍ

আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ, রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য ওযন ও পরিমাণ সমান সমান হওয়া ব্যতিরেকে বিক্রি কর না’।[১৩]

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ছাহাবী ও তাঁর মুখপাত্র উবাদাহ ইবনু ছামিত আনসারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) মু‘আবিয়াহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে রোম (বায়জান্টাইন) যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি লোকদের লক্ষ্য করলেন যে, তারা সোনার টুকরা স্বর্ণ মুদ্রার সাথে এবং রূপার টুকরা রৌপ্য মুদ্রার সাথে ক্রয়-বিক্রয় (বিনিময়) করছে। তিনি বলেন, হে লোক সকল! তোমরা (এরূপ বিনিময়ে) সূদ খাচ্ছ। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, তোমরা সোনার বিনিময়ে সোনা বিক্রয় কর না, তবে পরিমাণে সমান সমান হলে, বাড়তি না হলে এবং লেনদেন বাকীতে না হলে করতে পার। তখন মু‘আবিয়াহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে বলেন, হে আবুল ওয়ালীদ! আমি তো এরূপ লেনদেনে সূদের কিছু দেখছি না, যদি না লেনদেন বাকীতে হয়। উবাদাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি তোমার নিকট রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীছ বর্ণনা করছি। আর তুমি আমার নিকট তোমার অভিমত ব্যক্ত করছ। আল্লাহ যদি আমাকে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দেন তাহলে আমি এমন এলাকায় বসবাস করব না, যেখানে আমার উপর তোমার কর্তৃত্ব চলে। অতএব তিনি (যুদ্ধ থেকে) প্রত্যাবর্তন করে মদীনায় পৌঁছলে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে বলেন, হে আবুল ওয়ালীদ! আপনি কেন ফিরে এসেছেন? তখন তিনি তার নিকট সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করেন এবং সেখানে তার বসবাস না করার কথাও ব্যক্ত করেন। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, হে আবুল ওয়ালীদ! আপনি আপনার এলাকায় ফিরে যান। কেননা যে এলাকায় আপনি ও আপনার মত মানুষ থাকবে না সেখানে আল্লাহ গযব নাযিল করবেন। তিনি মু‘আবিয়াহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে লিখে পাঠান, উবাদাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর উপর তোমার কোন কর্তৃত্ব চলবে না এবং তিনি যা বলেন জনসাধারণকে তদনুযায়ী পরিচালনা কর। কারণ এটাই আদেশ।[১৪]

উপরিউক্ত হাদীছগুলোতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, সমমানের দ্রব্য নগদে সমান সমান বিনিময় করা বৈধ। কিন্তু সমমানের একই জাতীয় দ্রব্য বিনিময়ে কম-বেশি করলে তখন সূদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। যে বেশি দিবে অথবা বেশি নিবে উভয়েই সমান অপরাধী হিসাবে গণ্য। যদিও রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমমানের ছয়টি জিনিসের নাম উল্লেখ করেছেন। যেমন-সোনা, রূপা, গম, খেজুর, যব ও লবণ। তিনি তৎকালীন সময়ের উল্লেখযোগ্য ছয়টি দ্রব্যের নাম উল্লেখ করেছেন। তবে সমমানের সকল দ্রব্য এর মধ্যে শামিল।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৫৪০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৮০; ইবনু মাজাহ, হা/৩৩৮২; দারেমী, হা/২৫৬৯।   
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/১৫৮০; ছহীহ মুসলিম, হা/৪১৩১; আবূ দাঊদ, হা/৩৪৯০; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৭৩৬।  
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৫৪৪; বায়হাক্বী সুনানুল কুবরা, হা/১০৭৭৭।  
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/২২৩৬, ৪২৯৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৮১; আবূ দাঊদ, হা/৩৪৮৬; তিরমিযী, হা/১২৯৭; নাসাঈ, হা/৪৬৬৯; ইবনু মাজাহ, হা/২১৬৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৪৫১২; ইরওয়াউল গালীল, হা/১২৯০; মিশকাত, হ/২৭৬৬।  
[৫]. আবূ দাঊদ, হা/৩৪৮৫; দারাকুৎনী, হা/২৮৫৩; ছহীহ আত-তারগীব, হা/২৩৫৮; আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/১১৬; মুসনাদু আবী আওয়ানাহ, হা/৫৩৬৩, সনদ ছহীহ।  
[৬]. তিরমিযী, হা/১২৯৫; ইবনু মাজাহ, হা/৩৩৮১; ছহীহ আত-তারগীব, হা/২৩৫৭; আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/১৩৫৫; গায়াতুল মারাম, হা/৬০; মিশকাত, হা/২৭৭৬, সনদ ছহীহ।  
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/২৩১২; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৪; নাসাঈ, হা/৪৫৫৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৬১৩; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫০২২; মিশকাত, হা/২৮১৪।  
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/২২০২; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৩; নাসাঈ, হা/৪৫৫৩; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫০২১; মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/২৩১১; মিশকাত, হা/২৮১৩।  
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/২০৮০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৮৪; নাসাঈ, হা/৪৫৫৫; ইবনু মাজাহ, হা/২২৫৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১০৬০৯; মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/১৩১৫; দারেমী, হা/২৫৭৭।  
[১০]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৮৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৯৪৭; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫০১৫; মিশকাত, হা/২৮০৯।  
[১১]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৮৪, ১৫৮৮; ছহীহুল জামে, হা/৩৪৪৭; বুলুগুল মারাম, হা/৮৩৪।  
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/২১৭৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৮৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৫১২; বায়হাক্বী, হা/১০৭৮১; মিশকাত, হা/২৮১০।  
[১৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৮৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১০৭৭।  
[১৪]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৮৭; ইবনু মাজাহ, হা/১৮; তিরমিযী, হা/১২৪০; আবূ দাউদ, হা/৩৩৪৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২১৭৫; দারেমী, হা/২৫৭৯।  




হাদীছ বর্ণনায় আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর অবদান - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২০তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (২য় কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (২য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
বিদায় হজ্জের ভাষণ : তাৎপর্য ও মূল্যায়ন (শেষ কিস্তি) - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৫ম কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎকারী - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
বিদ‘আত পরিচিতি (১৪তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
বিদ‘আত পরিচিতি (১৯তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
বিদ‘আত পরিচিতি (২৬তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান

ফেসবুক পেজ