হজ্জ ও ওমরার সঠিক পদ্ধতি
-ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ভূমিকা
হজ্জ ইসলামের রুকন সমূহের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুকন। এটি মাত্র কয়েক দিনের কর্মসূচী হলেও এর বিধি-বিধান অনেক। বিধানগুলো সঠিকভাবে পালন করলে এর একমাত্র প্রতিদান হবে জান্নাত। এছাড়া আরাফার মাঠসহ দু‘আ কবুলের স্থানগুলোতে দু‘আ করে দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনকে ধন্য করার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে এই ইবাদতে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ টাকার জোরে হজ্জ করতে যায় সমাজে মর্যাদাবান ব্যক্তি হিসাবে যাহের করার জন্য। অথচ রাসূল (ﷺ) বিদায় হজ্জে বলেছিলেন, اَللَّهُمَّ حَجَّةٌ لَا رِيَاءَ فِيْهَا وَلَا سُمْعَةَ ‘হে আল্লাহ! এই হজ্জ লোক দেখানোর জন্যও নয় এবং জনশ্রুতির জন্যও নয়’।[১] তাই বিশুদ্ধভাবে হজ্জ পালনের জন্য তেমন কোন প্রস্তুতি গ্রহণ করতে দেখা যায় না, বরং চরম অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। তাই বারবার হজ্জ করলেও তাদের জীবনে কোন পরিবর্তন আসে না। সূদ-ঘুষ, দুর্নীতি-আত্মসাৎ, জুয়া-লটারি, অশ্লীলতাসহ নানা পাপে লিপ্ত থাকে। এগুলো হজ্জ কবুল না হওয়ার লক্ষণ। রাসূল (ﷺ) বলেন, وَسَتَلْقَوْنَ رَبَّكُمْ فَيَسْأَلُكُمْ عَنْ أَعْمَالِكُمْ أَلَا فَلَا تَرْجِعُوْا بَعْدِىْ ضُلَّالًا ‘অতি সত্বর তোমরা তোমাদের রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তোমাদের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। তাই সাবধান! তোমরা আজকের দিনের পর পুনরায় অপকর্মে লিপ্ত হয়ো না’।[২] অতএব অযথা অর্থ ব্যয় করে লাভ নেই। তাই মাকবূল হজ্জের জন্য মনোযোগ দিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে সঠিক পদ্ধতিতে হজ্জ ও ওমরা পালন করতে হবে।
হজ্জ ও ওমরার প্রস্তুতি
হজ্জের জন্য আর্থিক প্রস্তুতি সাথে সাথে শারীরিক প্রস্তুতি নেয়াও যরূরী। কারণ শারিরীক সক্ষমতা না থাকলে হজ্জের বিধানগুলো সঠিকভাবে আদায় করা সম্ভব নয়। এতে সন্দেহ নেই যে, হজ্জ ও ওমরা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ইবাদত। তাই কয়েকটি বিষয়ে প্রস্তুতি নেয়া আবশ্যক, যেন পরিশ্রম বৃথা না যায় :
(১) আক্বীদা সংশোধন
মুসলিম জীবন আক্বীদার উপর প্রতিষ্ঠিত। যার আক্বীদা সঠিক নয়, তার জীবন একেবারেই ব্যর্থ। কারণ বিশুদ্ধ আক্বীদা মুমিন জীবনের মূল চাবিকাঠি ও মুসলিম উম্মাহ্র সুদৃঢ় ভিত্তি। তাই মুসলিম ব্যক্তির প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হল, নিজের আক্বীদাকে পরিশুদ্ধ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَنْ يَّكْفُرْ بِالْإِيْمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ وَهُوَ فِى الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ ‘যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সাথে কুফরী করবে, তার আমল নষ্ট হয়ে যাবে। সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে হবে’ (সূরা আল-মায়েদাহ : ৫)। মুসলিমদের অধিকাংশই ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণ করে থাকে। কেউ কুফরী আক্বীদা লালন করছে, কেউ শিরকী, কেউ বিদ‘আতী, কেউ জাহেলী। এভাবে মনের অজান্তেই তারা ঈমান ও আমল ধ্বংস করে দিচ্ছে। আক্বীদার ব্যাপারে তারা খুবই উদাসীন। মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তারা মসজিদেও যায়, মাযারেও যায়, মক্কাতেও যায়, মন্দিরেও যায়। এভাবে শিরক, কুফর ও ত্বাগূত মিশ্রিত আক্বীদা নিয়ে জীবন যাপন করছে। সমাজে এদের সংখ্যাই বেশী। আল্লাহর ভাষায় এরা মুশরিক। আল্লাহ বলেন, وَ مَا یُؤۡمِنُ اَکۡثَرُہُمۡ بِاللّٰہِ اِلَّا وَ ہُمۡ مُّشۡرِکُوۡنَ ‘আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা সত্ত্বেও তাদের অধিকাংশই মুশরিক’ (সূরা ইউসুফ : ১০৬)। তাই শিরক, কুফর, ত্বাগূত ও জাহেলিয়াত থেকে ঈমানকে হেফাযত করতে হবে, যেন ঈমানের সাথে এগুলো মিশ্রিত না হয়।
ঈমানী চেতনা যদি শিরকমুক্ত হয়, তবে আমলগুলো আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে। কারণ এই আক্বীদার উপরই যাবতীয় আমল নির্ভরশীল। রাসূল (ﷺ) বলেন, إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ ‘সমস্ত আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল’।[৩] রাসূল (ﷺ) বলেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلاَّ مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا وَابْتُغِىَ بِهِ وَجْهُهُ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা কোন আমল কবুল করবেন না, যদি তাঁর জন্য তা খালেছ হৃদয়ে ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্য না করা হয়’।[৪] এজন্য বলা হয়, اَلْعَقِيْدَةُ الصَّحِيْحَةُ هِىَ أَصْلُ دِيْنِ الْإِسْلاَمِ وَأَسَاسُ الْمِلَّةِ ‘বিশুদ্ধ আক্বীদা দ্বীন ইসলামের শিকড় এবং মুসলিম মিল্লাতের সুদৃঢ় ভিত্তি’।[৫] তাই আক্বীদা যদি শিরক মিশ্রিত হয়, তাহলে কোন আমলই কবুল হবে না। হাদীছে এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর হুঁশিয়ারী এসেছে,
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ قَالَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ مَنْ عَمِلَ عَمَلاً أَشْرَكَ فِيْهِ مَعِىْ غَيْرِىْ تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, বরকতময় মহান আল্লাহ বলেন, আমি শিরককারীদের শিরক থেকে মুক্ত। যে ব্যক্তি কোন আমল করে আর তাতে আমাকে ছাড়া অন্যকে শরীক করে, আমি তাকে এবং তার শরীককে বর্জন করি।[৬] নিম্নে কতিপয় শিরক পেশ করা হল-
(১) কবরে সিজদা করা (২) মৃত পীর বা অলীর দরগায় গিয়ে তার কাছে সাহায্য চাওয়া (৩) কবরে গরু, ছাগল-মোরগ, টাকা-পয়সা মানত করা (৪) খানকায় পোষা কুমির, কচ্ছপ, মাছ, কবুতর ইত্যাদিকে বিশেষ সম্মান দেয়া (৫) মূর্তি, ভাস্কর্য, শহীদ বেদী, প্রতিকৃতিতে ফুল দেওয়া ও শ্রদ্ধা নিবেদন করা (৬) পীরকে অসীলা করে দু‘আ করা ও মুক্তি চাওয়া (৭) মাযারে বার্ষিক ওরস করা (৮) কবরস্থানে মসজিদ নির্মাণ করা (৯) কবরবাসীর নিকটে কিছু কামনা করা (১০) মাযারে দান না করলে মৃত পীরের বদ দু‘আ লাগবে বলে বিশ্বাস করা (১১) পীরের দরগায় দান করলে পরীক্ষায় রেজাল্ট ভাল হবে এবং মামলা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এমন বিশ্বাস করা (১২) মৃত পীর কবরে জীবিত আছেন ও ভক্তদের উপকার-ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখেন মর্মে আক্বীদা পোষণ করা (১৩) কবরে সৌধ নির্মাণ করা, তার সৌন্দর্য বর্ধন করা ও মোমবাতি, আগরবাতি জ্বালিয়ে রাখা (১৪) কোন দিবস বা প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীকে মঙ্গলময় মনে করা এবং পালন করা (১৫) গণকের কাছে যাওয়া ও তার শিরকী মন্ত্রে বিশ্বাস করা। এগুলো সবই শিরকে আকবার বা বড় শিরক, যার পরিণাম হল- জীবনের সমস্ত সৎআমল বিনষ্ট হওয়া, ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়া। এছাড়া শরীরে তা‘বীয, তামার আংটি, চেইন, মাযার কর্তৃক বিতরণ করা ফিতা বাঁধা। এগুলো শরীরে বাঁধা থাকলে ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত কোন ইবাদতই কবুল হবে না। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়–ন ‘ভ্রান্ত আক্বীদা বনাম সঠিক আক্বীদা’ শীর্ষক বই।
(২) হালাল সম্পদ সংগ্রহ
‘হালাল রূযী ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত’ কথাটি সমাজে প্রচলিত থাকলেও মানুষের মাঝে এর কোন প্রভাব নেই। রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র বস্তু ছাড়া কবুল করেন না’। কারো খাদ্য, পানীয় ও পোশাক হারাম হলে তার ইবাদত গ্রহণযোগ্য হবে না।[৭] তাই প্রত্যেককে লক্ষ্য করা উচিত তার খাদ্য, পানীয়, পোশাক, আসবাবপত্র হালাল, না হারাম। কারণ হারাম মিশ্রিত কোন ইবাদত আল্লাহ কবুল করেন না। দুর্নীতি, আত্মসাৎ, প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ এবং সূদ-ঘুষ, জুয়া-লটারী ও অবৈধ পন্থায় প্রাপ্ত অর্থ ভক্ষণ করে ইবাদত করলে উক্ত ইবাদত আল্লাহর কাছে পৌঁছবে না। আর অপবিত্র দেহ পবিত্র জান্নাতে প্রবেশ করতেও পারবে না।[৮] তাই হজ্জ-ওমরার প্রস্তুতির সময় পবিত্র হালাল অর্থ সংগ্রহ করতে হবে।
(৩) হজ্জ কাফেলা, হজ্জ প্রশিক্ষণ ও মু‘আল্লিম সম্পর্কে দু’টি কথা
হজ্জ সফরের জন্য তাক্বওয়াশীল আলেমের সাথী হওয়া খুবই যরূরী। রাসূল (ﷺ) হজ্জের ঘোষণা দিলে হজ্জে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাহাবীগণ মদীনায় একত্রিত হয়েছিলেন।[৯] কারণ মু‘আল্লিম সালাফী মানহাজের না হলে সঠিক পদ্ধতিতে হজ্জ করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাই বিশুদ্ধভাবে হজ্জ সম্পাদন করার জন্য নির্ভরযোগ্য কাফেলা নির্বাচন করতে হবে। সেই সাথে হজ্জে যাওয়ার অন্তত এক মাস পূর্বে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া হাদীছে ভাল মানুষের সাহচর্য লাভ করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। আবূ মূসা আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেন,
مَثَلُ الْجَلِيسِ الصَّالِحِ وَالسَّوْءِ كَحَامِلِ الْمِسْكِ وَنَافِخِ الْكِيرِ فَحَامِلُ الْمِسْكِ إِمَّا أَنْ يُحْذِيَكَ وَإِمَّا أَنْ تَبْتَاعَ مِنْهُ وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ مِنْهُ رِيحًا طَيِّبَةً وَنَافِخُ الْكِيرِ إِمَّا أَنْ يُحْرِقَ ثِيَابَكَ وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ رِيحًا خَبِيثَةً
‘সৎ সঙ্গী এবং অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ হচ্ছে- আতর বিক্রেতা এবং কামারের মত। আতর বিক্রেতা হয় তোমাকে আতর প্রদান করবে, না হয় তুমি তার কাছ থেকে আতর কিনে নিবে, আর না হয় তুমি অন্তত তার কাছ থেকে সুঘ্রাণ পাবে। পক্ষান্তরে কামার হয় তোমার কাপড় পুড়িয়ে দিবে, আর না হয় তুমি তার কাছ থেকে দুর্গন্ধ পাবে’।[১০]
(৪) হজ্জ ও ওমরার আহকাম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা
হজ্জ ও ওমরা পালন করতে হবে একমাত্র রাসূল (ﷺ)-এর দেখানো পদ্ধতি অনুযায়ী। অন্য কোন ব্যক্তি, ইমাম, মাযহাব ও ত্বরীক্বার পদ্ধতিতে করলে কবুল হবে না। রাসূল (ﷺ) বলেন, خُذُوْا عَنِّىْ مَنَاسِكَكُمْ ‘তোমরা তোমাদের হজ্জের পদ্ধতি আমার নিকট থেকে গ্রহণ কর’।[১১] তাই রাসূল (ﷺ) কোন্ পদ্ধতিতে হজ্জ ও ওমরাহ করেছেন, তা সঠিকভাবে জানা আবশ্যক। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অধিকাংশ মানুষ হজ্জ করছে বিদ‘আতী তরীক্বায়। তারা অর্থ ব্যয় করছে, শারীরিক পরিশ্রম করছে কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না।
হজ্জ ও ওমরার অর্থ
মহান আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে রাসূল (ﷺ)-এর প্রদত্ত পদ্ধতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট কার্যক্রম সম্পাদন করাকে ‘হজ্জ’ বলে। আর বায়তুল্লাহ, ছাফা-মারওয়া ত্বাওয়াফ এবং মাথার চুল চেঁছে ফেলা কিংবা খাটো করার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করাকে ‘ওমরাহ’ বলে’।[১২]
হজ্জ ও ওমরার গুরুত্ব ও ফযীলত :
হজ্জ এমন একটি ইবাদত, যার দ্বারা মাত্র কয়েক দিন পরিশ্রম করে জান্নাত লাভ করা যায়। যেমন হজ্জ যাবতীয় পাপ থেকে মুক্ত করে নিষ্পাপ শিশুর মত করে দেয়, তেমনি জান্নাতও নিশ্চত করে। নিম্নের হাদীছগুলো তারই প্রমাণ বহন করে।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِىَّ ﷺ يَقُوْلُ مَنْ حَجَّ لِلهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ
আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ্জ করল এবং স্ত্রী সহবাস, যাবতীয় অশ্লীল কর্ম ও গালমন্দ থেকে বিরত থাকল, সে ঐদিনের মত হয়ে প্রত্যাবর্তন করল, যেদিন তার মা তাকে জন্ম দিয়েছিল’।[১৩] রাসূল (ﷺ) আমর ইবনুল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,
أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ الْإِسْلاَمَ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ وَأَنَّ الْهِجْرَةَ تَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهَا وَأَنَّ الْحَجَّ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ
‘হে আমর! তুমি কি জানো না যে, ইসলাম তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ নষ্ট করে দেয়? হিজরত তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ধ্বংস করে দেয়? এবং হজ্জ তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ মোচন করে দেয়?’।[১৪] অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا وَالْحَجُّ الْمَبْرُوْرُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ
আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘এক ওমরাহ থেকে আরেক ওমরার মধ্যবর্তী সময়ের ছগীরা গোনাহসমূহের কাফফারা স্বরূপ। আর মাবরূর (কবুল) হজ্জের বিনিময় জান্নাত ছাড়া কিছুই নয়’।[১৫]
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ تَابِعُوْا بَيْنَ الْحَجِّ وَالْعُمْرَةِ فَإِنَّهُمَا يَنْفِيَانِ الْفَقْرَ وَالذُّنُوْبَ كَمَا يَنْفِى الْكِيْرُ خَبَثَ الْحَدِيْدِ وَالذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَلَيْسَ لِلْحَجَّةِ الْمَبْرُوْرَةِ ثَوَابٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘তোমরা হজ্জ ও ওমরার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখ। কারণ এ দু’টি দরিদ্রতা এবং গোনাহ উভয়ই দূর করে দেয়, যেমন হাপর লোহা ও সোনা-রূপার ময়লা দূর করে। আর মাবরূর (কবুল) হজ্জের প্রতিদান জান্নাত বৈ কিছুই নয়’।[১৬]
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ سُئِلَ أَىُّ الْعَمَلِ أَفْضَلُ؟ فَقَالَ إِيْمَانٌ بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ. قِيْلَ ثُمَّ مَاذَا؟ قَالَ اَلْجِهَادُ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ قِيْلَ ثُمَّ مَاذَا؟ قَالَ حَجٌّ مَبْرُوْرٌ
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সর্বোত্তম কাজ কোন্টি? জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনা’। তাঁকে বলা হয়েছিল, এরপর কী? তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদ করা’। তাঁকে আবার বলা হয়েছিল, এরপর কী? তিনি বলেছিলেন, ‘মাবরূর হজ্জ’।[১৭] অন্য হাদীছে ওমরার গুরুত্ব আরও ফুটে উঠেছে,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ إِنَّ عُمْرَةً فِىْ رَمَضَان تَعْدِلُ حَجَّةً
‘নিশ্চয় রামাযান মাসে একটি ওমরাহ একটি হজ্জের সমতুল্য’।[১৮] অন্য হাদীছে বলেন, فَإِنَّ عُمْرَةً فِىْ رَمَضَانَ تَقْضِىْ حَجَّةً مَعِىْ ‘রামাযান মাসে একটি ওমরাহ করা আমার সাথে একটি হজ্জ করার সমান’।[১৯]
হারামাইনের ফযীলত :
عَنْ جَابِرٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ صَلَاةٌ فِىْ مَسْجِدِىْ أَفْضَلُ مِنْ أَلْفِ صَلَاةٍ فِيْمَا سِوَاهُ إِلَّا الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ وَصَلَاةٌ فِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ أَفْضَلُ مِنْ مِائَةِ أَلْفِ صَلَاةٍ فِيْمَا سِوَاهُ
জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘আমার মসজিদে ছালাত আদায় করা মসজিদুল হারাম ব্যতীত অন্যান্য মসজিদের চেয়ে এক হাযার ছালাতের চেয়েও উত্তম। আর মসজিদে হারামে ছালাত আদায় করার ছওয়াব অন্যান্য মসজিদের চেয়ে ১ লক্ষ গুণ বেশী’।[২০] উল্লেখ্য যে, মসজিদে আক্বছায় এক ছালাত আদায় করা ৫০ হাযার ছালাতের সমান এবং মসজিদে নববীতে এক ছালাত ৫০ হাযার ছালাতের সমান মর্মে বর্ণিত হাদীছ যঈফ।[২১]
ত্বাওয়াফের ফযীলত :
পৃথিবীর সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সম্মানিত ঘর কা‘বাকে প্রদক্ষিণ করাকে ‘ত্বাওয়াফ’ বলে। উক্ত ঘর ত্বাওয়াফ করা অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلۡیَطَّوَّفُوۡا بِالۡبَیۡتِ الۡعَتِیۡقِ ‘তোমরা প্রাচীনগৃহ (কা‘বাকে) ত্বাওয়াফ কর’ (হজ্জ ২৯)। ত্বাওয়াফের ফযীলত সম্পর্কে অনেকগুলো হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যেমন-
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ يَقُوْلُ مَنْ طَافَ بِالْبَيْتِ وَصَلَّى رَكْعَتَيْنِ كَانَ كَعِتْقِ رَقَبَةٍ
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি কা‘বা ঘর ত্বাওয়াফ করল এবং দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করল, সে একজন গোলাম আযাদ করল।[২২] রাসূল (ﷺ) অন্য হাদীছে বলেন, ‘যে ব্যক্তি একজন মুসলিম গোলাম আযাদ করল, সে যেন তার প্রত্যেকটি অঙ্গকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করল’।[২৩] অন্য হাদীছে তিনি বলেন,
لَا يَضَعُ قَدَمًا وَلَا يَرْفَعُ أُخْرَى إِلاَّ حطَّ اللهُ عَنْهُ بهَا خَطِيْئَةً وَكَتَبَ لَهُ بِهَا حَسَنَةً وَرَفَعَ لَهُ بِهَا دَرَجَةً
‘ত্বাওয়াফকারী যতবার পা উঠাবে এবং পা ফেলবে, ততবার আল্লাহ তার একটি করে গোনাহ ক্ষমা করবেন, একটি করে নেকী নির্ধারণ করবেন এবং একটি করে মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিবেন’।[২৪] অন্য হাদীছে এসেছে, مَنْ طَافَ بِهَذَا الْبَيْتِ أُسْبُوْعًا فَأَحْصَاهُ كَانَ كَعِتْقِ رَقَبَةٍ ‘যে ব্যক্তি সাতবার এই ঘরের ত্বাওয়াফ করবে, তার একটি দাসমুক্তির নেকী হবে’।[২৫] অন্য বর্ণনায় এসেছে, مَنْ طَافَ سَبْعًا فَهُوَ كَعِدْلِ رَقَبَةٍ ‘যে ব্যক্তি সাতটি ত্বাওয়াফ করল, সে যেন একটি দাস মুক্ত করল’।[২৬] অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ جُبَيْرِ بْنِ مُطْعِمٍ أَنَّ النَّبِىَّ ﷺ قَالَ يَا بَنِىْ عَبْدِ مَنَافٍ لاَ تَمْنَعُوْا أَحَدًا طَافَ بِهَذَا الْبَيْتِ وَصَلَّى أَيَّةَ سَاعَةٍ شَاءَ مِنْ لَيْلٍ أَوْ نَهَارٍ
যুবায়ের ইবনু মুত্বঈম (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, হে বনী আবদে মানাফ! যে ব্যক্তি এই ঘর ত্বাওয়াফ করতে এবং রাতে-দিনে যে কোন সময় ছালাত আদায় করতে চায়, তাকে তোমরা বাধা দিও না।[২৭]
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
তথ্যসূত্র :
[১]. ইবনু মাজাহ হা/২৮৯০, সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৬১৭।
[২]. ছহীহ বুখারী হা/৫৫৫০, ‘কুরবানী’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫; ছহীহ মুসলিম হা/১৬৭৮; মিশকাত হা/২৬৫৯।
[৩]. ছহীহ বুখারী হা/১, ১/২ পৃঃ; ছহীহ মুসলিম হা/৫০৩৬, ২/১৪০-১৪১ পৃঃ; মিশকাত হা/১।
[৪]. নাসাঈ হা/৩১৪০, সনদ ছহীহ।
[৫]. শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায, আল-আক্বীদাতুছ ছহীহাহ ওয়ামা ইউযাদ্দুহা (রিয়ায : দারুল ক্বাসেম, ১৪১৫ হিঃ), পৃঃ ৩ ভূমিকা দ্রঃ।
[৬]. ছহীহ মুসলিম হা/৭৬৬৬, ২/৪১১ পৃঃ, (ইফাবা হা/৭২০৫), ‘যুহদ ও রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬।
[৭]. মুসলিম হা/২৩৯৩, ১/৩২৬ পৃঃ, ‘যাকাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২০; মিশকাত হা/২৭৬০, পৃঃ ২৪১।
[৮]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৫৯৬১; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৬০৯; মিশকাত হা/২৭৮৭।
[৯]. ছহীহ মুসলিম হা/১২১৮; মিশকাত হা/২৫৫৫।
[১০]. ছহীহ বুখারী হা/৫৫৩৪; মুসলিম হা/৬৬৯২।
[১১]. বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা হা/৯৭৯৬, সনদ ছহীহ, ইরওয়াউল গালীল হা/১১০৫; ছহীহ মুসলিম হা/১২৯৭।
[১২]. আশ-শারহুল মুমতে‘ আলা যাদিল মুস্তানকি‘ ৭/৫ পৃঃ।
[১৩]. ছহীহ বুখারী হা/১৫২১, ১/২০৬ পৃঃ; ছহীহ মুসলিম হা/১৩৫০ (ইফাবা হা/৩১৫৭); মিশকাত হা/২৫০৭।
[১৪]. ছহীহ মুসলিম হা/১২১, ১/৭৬ পৃঃ; মিশকাত হা/২৮।
[১৫]. ছহীহ বুখারী হা/১৭৭৩; ছহীহ মুসলিম হা/১৩৪৯; মিশকাত হা/২৫০৮।
[১৬]. তিরমিযী হা/৮১০, ১/১৬৭ পৃঃ; ছহীহ ইবনে খুযায়মা হা/২৫১২; নাসাঈ হা/২৬৩১, সনদ ছহীহ।
[১৭]. ছহীহ বুখারী হা/২৬ এবং হা/১৫১৯, ১/২০৬ পৃঃ; ছহীহ মুসলিম হা/৮৩; মিশকাত হা/২৫০৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৩৯২, ৫/১৭৬ পৃঃ।
[১৮]. ছহীহ বুখারী হা/১৭৮২, ১/২৩৯ পৃঃ, ‘ওমরাহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪; ছহীহ মুসলিম হা/১২৫৬, ১/৪০৯ পৃঃ; মিশকাত হা/২৫০৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৩৯৫, ৫/১৭৬ পৃঃ।
[১৯]. ছহীহ বুখারী হা/১৮৬৩, ১/২৫১ পৃঃ, ‘শিকার’ অধ্যায়, ‘মহিলাদের হজ্জ’ অনুচ্ছেদ-২৬; ছহীহ মুসলিম হা/১২৫৬, ১/৪০৯ পৃঃ।
[২০]. ইবনু মাজাহ হা/১৪০৬, পৃঃ ১০২, সনদ ছহীহ; ছহীহ বুখারী হা/১১৯০, ১/১৫৯ পৃঃ (ইফাবা হা/১১১৭, ২/৩২৭ পৃঃ); মিশকাত হা/৬৯২, পৃঃ ৬৭।
[২১]. ইবনু মাজাহ হা/১৪১৩, পৃঃ ১০২; মিশকাত হা/৭৫২, পৃঃ ৭২।
[২২]. ইবনু মাজাহ হা/২৯৫৬, সনদ ছহীহ।
[২৩]. ছহীহ বুখারী হা/৬৭১৫; মিশকাত হা/৩৩৮২।
[২৪]. আলবানী, তাহক্বীক্ব ছহীহ ইবনে হিব্বান হা/৩৬৮৯; তারগীব হা/১১৪৩; তিরমিযী হা/৯৫৯, সনদ ছহীহ লিগায়রিহী।
[২৫]. তিরমিযী হা/৯৫৯, সনদ হাসান; শারহুস সুন্নাহ হা/১৯১৬।
[২৬]. নাসাঈ হা/২৯১৯, সনদ ছহীহ।
[২৭]. তিরমিযী হা/৮৬৮, সনদ ছহীহ; আবুদাঊদ হা/১৮৯৪।
প্রসঙ্গসমূহ »:
হজ্জ ও ওমরাহ