বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৪ অপরাহ্ন

ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ  

ড. মেসবাহুল ইসলাম বিন মাহতাবুদ্দীন*  


(শেষ কিস্তি)  

৫. ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুব সমাজের গুরুত্ব

যুব সমাজ আল্লাহ প্রদত্ত এক অমূল্য সম্পদ। এ যুব সমাজকে দিয়েই আল্লাহ তা‘আলা ইসলামের সুমহান বাণী মানব জাতির দ্বারে দ্বারে পৌঁছিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যৌবনকালকে গণীমতের মাল তথা মূল্যবান সম্পদ হিসাবে উল্লেখ করে তা মূল্যায়ন করতে তাকীদ দিয়েছেন। কেননা এ সময় সম্পর্কে পরকালে জবাবদিহিতা করতে হবে। আল্লাহ বলেন,

عَنْ عَمْرِو بْنِ مَيْمُوْنٍ الْأَوْدِيِّ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ لِرَجُلٍ وَهُوَ يَعِظُهُ اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ.

আমর ইবন মায়মূন আল-আওদী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) জনৈক ব্যক্তিকে উপদেশ স্বরূপ বলেন, পাঁচটি বস্তুর পূর্বে পাঁচটি বস্তুকে গণীমত মনে করো। যথা: (১) তোমার বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনকে (২) পীড়িত হওয়ার পূর্বে সুস্বাস্থ্যকে (৩) দারিদ্র্যতার পূর্বে সচ্ছলতাকে (৪) ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে এবং (৫) মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে।[১]

আল্লাহ প্রদত্ত যৌবনের এই মহা মূল্যবান সময়টাকে আল্লাহর অহির বিধান প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় ব্যয় না করে হেলায়-দোলায় নষ্ট করলে কিংবা মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত তন্ত্র-মন্ত্র, ইযম-তরীকা ও শিরক-বিদ‘আত এবং মনগড়া ইবাদত প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় ব্যয় করলে তার কড়ায় গণ্ডায় হিসাব দিতে হবে কিয়ামতের কঠিন দিবসে। হাদীছে এসেছে,

عَنِ ابْنِ مَسْعُوْدٍ عَنِ النَّبِىِّ ﷺ قَالَ لَا تَزُوْلُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمْرِهِ فِيْمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيْمَا أَبْلَاهُ وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيْمَ أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيْمَا عَلِمَ .

ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আদম সন্তানকে স্ব স্ব স্থান থেকে এক কদমও নড়াতে দেয়া হবে না। যথা (১) সে তার জীবনকাল কিভাবে অতিবাহিত করেছে (২) যৌবনকাল কোথায় ব্যয় করেছে (৩) ধন-সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে (৪) কোন পথে তা ব্যয় করেছে (৫) সে দ্বীনের কতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে এবং অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী সে আমল করেছে কিনা’।[২]

যৌবনের এই সোনালী সময়ে মানুষের দেহ সাধারণত থাকে সুস্থ, সবল, শক্ত ও উদ্দীপনায় পূর্ণ। এ সময় তার হাতে থাকে উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত সময়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অধিকাংশ মানুষই তা সুষ্ঠুভাবে ব্যয় করে না। এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ النَّبِىُّ ﷺ نِعْمَتَانِ مَغْبُوْنٌ فِيْهِمَا كَثِيْرٌ مِنَ النَّاسِ الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ .

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, ‘দু’টি নে‘মতের ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষ ধোঁকার মধ্যে রয়েছে। তাহল সুস্থতা ও সুস্বাস্থ্য’।[৩] ইবনুল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

مَنِ اسْتَعْمَلَ فَرَاغَهُ وَصِحَّتَهُ فِيْ طَاعَةِ اللهِ فَهُوَ الْمَغْبُوْطُ وَمَنِ اسْتَعْمَلَهُمَا فِيْ مَعْصِيَةِ اللهِ فَهُوَ الْمَغْبُوْنُ.

‘যে ব্যক্তি তার সচ্ছলতা ও সুস্বাস্থ্যকে আল্লাহর আনুগত্যের কাজে লাগায়, সে ব্যক্তি হল ঈর্ষণীয়। আর যে ব্যক্তি ঐ দু’টি বস্তুকে আল্লাহর অবাধ্যতায় কাজে লাগায়, সে ব্যক্তি হল ধোঁকায় পতিত’।[৪] 

যৌবন যেমন সুস্থতা ও পূর্ণতার স্বরূপ, তেমনি পরিপূর্ণ জীবন ও প্রাণের স্বরূপ। হক্বের ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে বাতিলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনকাল। তাইতো ইসলাম শিশু, পঙ্গু, অসুস্থ, বৃদ্ধ ও নারীদের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম ফরয করেনি। কবি বলেছেন, ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় তার’। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই যৌবনের জয়গান গেয়েছেন। প্রসিদ্ধ সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে আছে এই যৌবনের স্তবগান এবং উৎসাহ ও উদ্দীপনাময় বক্তব্যের সমাহার। বর্তমান ঘুণেধরা এই সমাজের অশ্লীলতা, নগ্নতা, বেহায়পনা, নির্লজ্জতা ও যেনা-ব্যভিচার যুবসমাজই পারে দূর করতে। এক্ষেত্রে যুবকদের ছহীহ পদ্ধতিতে বিবাহ করা একান্ত যরূরী। অন্যথা ছিয়াম পালন করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখবে। যেমন ‘আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, মহানবী (ﷺ) যুবকদের লক্ষ্য করে বলেন,

يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فَاِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وأَحْسَنُ لِلْفَرْجِ وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ.

‘হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা উহা চক্ষুকে অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানকে রক্ষা করে। আর যে সামর্থ্য রাখে না, সে যেন ণিয়াম রাখে। কেননা উহা তার প্রবৃত্তিকে দমন করার উপযুক্ত মাধ্যম’।[৫]

হাসান (রাহিমাহুল্লাহ) বলতেন, قَدِّموا إلينا أحداثكم، فإنهم أفرغ قلوبًا، وأحفظ لما سمعوا، فمن أراد الله أن يتمه له أتمه ‘তোমারা তোমাদের যুবকদেরকে আমাদের নিকট পাঠাও। কেননা তাদের অন্তর মুক্ত, তারা যা শুনে তাই স্মরণ রাখতে পারে। আল্লাহ যাকে চান তাকে পূর্ণতা দান করেন’।[৬] ইবনু হাজার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘কুরআন সংকলনের জন্য বিশেষ ভাবে চারটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে যুবক হওয়া। কেননা জ্ঞান অন্বেষণে তারা চঞ্চল হয়, মুখস্থ শক্তি বেশি থাকে, মেধা থাকে স্বচ্ছ’।[৭]

৬. ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুব সমাজের অবদান বিশ্লেষণ

আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে যত নীব-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তারা সকলই যুবক অবস্থায় নবুওয়াত লাভ করেছেন, যৌবন বয়স এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, যুগে যুগে সব নবী-রাসূলই যৌবনকালেই পেয়েছে নবুওয়ত ও রিসালাতের দায়িত্ব। আল্লাহ তা‘আলা নবী-রাসূলদের বেশির ভাগকেই যুবক বয়সেই নবুওয়ত ও রিসালাতের দায়িত্ব দিয়েছেন। মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম, ইউসুফ, ইয়াহিয়া, ইসহাক, ঈসা, মূসা ও সর্বশেষ নবী ও রাসূল  মুহাম্মাদ (ﷺ) সহ অনেককেই যুবক বয়সে নবুওয়ত ও রিসালাতের দায়িত্ব পেয়েছেন মর্মে কুরআন ও হাদীছে প্রমাণ পাওয়া যায়। হাদীছে আছে, 

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ مَا بَعَثَ اللهُ نَبِيًّا إِلا وَهُوَ شَابٌّ رواه الطبراني في الأوسط وفيه قابوس بن أبي ظبيان وثقه يحيى بن معين في رواية وضعفه في أخرى وقال ابن عدي : أرجو أنه لا بأس به وضعفه أحمد.

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা যুবক অবস্থায় সকল নবীকে প্রেরণ করেছেন এবং যুবক অবস্থায় ‘আলিমকে ‘ইলম দান করেছেন’। ত্বাবারানী তার ‘আল-মু‘জামুল আওসাত’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, ক্বাবুস ইবন আবু যুবইয়ান নামক একজন রাবী রয়েছে, যাকে ইহইয়া ইবন মাঈন শক্তিশালী বলেছেন, অপর সূত্রে তিনি তাকে যঈফ বলেছেন। ইবনু ‘আদী বলেন আমি মনে করি তাতে কোন সমস্যা নেই, ইমাম আহমাদ (রহ.) তাকে যঈফ বলেছেন।[৮] আল্লাহ তা‘আলা সকল নবীকে যুবক অবস্থায় নবুওয়ত প্রদানের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবকদের অবদানের বিষয়টি পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে।

১- যুবক মূসা (আলাইহিস সালাম)

মূসা (আলাইহিস সালাম) যুবক অবস্থায় নবী ছিলেন। মানব জীবনের দু’টি স্তরের একটি হচ্ছে  শক্তি আর একটি হচ্ছে দুর্বলতা। যুবকের স্তরের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শক্তি। আর শারীরিক শক্তি মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর মধ্যে ছিল, যা মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর ঘটনায় বুঝা যায়। যখন তিনি দু’টি মেয়ের পশুগুলোকে পানি পান করালেন, আল্লাহ বলেন, তাদের একজন বলল, হে পিতা! আপনি একে মজুর নিযুক্ত করুন, কারণ আপনার মজুর হিসাবে উত্তম হবে সেই ব্যক্তি যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত।[৯] যিনি এত ভারী বালতি টানতে সক্ষম তিনি যুবক ছিলেন।[১০]  

২- যুবক ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)

মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) যৌবনে ছোট্ট এক ঘটনার মাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন পুরো ব্যাবিলনে। মূর্তি ভেঙে পুরো পৌত্তলিক সমাজব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তাওহীদের ঘোষণা দিয়েছিলেন। আওয়াজ উঠল, কে করেছে এই কাজ, কার এত বড় সাহস? আল-কুরআনের বর্ণনায়- ‘তাদের কেউ কেউ বলল, আমরা শুনেছি এক যুবক এই মূর্তিগুলোর সমালোচনা করে। তাকে বলা হয় ইবরাহীম’।[১১]

৩- যুবক ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)

ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) যুবক  ছিলেন। আল্লাহ তা‘আল বলেন, ‘তিনি যে স্ত্রীলোকের গৃহে ছিলেন তাঁকে তার প্রতি আকৃষ্ট করতে চাইলো এবং দরজাগুলো বন্ধ করে দিল ও বলল, চলে এসো তিনি বললেন, ‘আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি, তিনি আমার প্রভু! তিনি আমাকে সম্মানজনক ভাবে থাকতে দিয়েছেন যালিমরা কখনও সফলকাম হয় না’।[১২] ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘অশ্লীল কর্মে লিপ্ত হওয়ার আহ্বানের অনেক কিছুই যখন ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)-এর মধ্যে একত্রিত হয়েছিল, তখন তিনি যুবক ছিলেন। কেননা তাতে লিপ্ত হওয়ার জন্য যা লাগে, কেবল তা যুবকের মধ্যেই থাকে’।[১৩]

এছাড়া আরো যে সকল যুবকের পরিচয় পাওয়া যায়, তার কতিপয় দৃষ্টান্ত পেশ করা হল:

১- যুবতি মারিয়াম (আলাইহিস সালাম)

মারিয়াম (আলাইহিস সালাম)-এর নামে একটি সূরার নামকরণ করা হয়েছে ‘মারিয়াম’। তিনি ছিলেন একজন যুবতী। আল-কুরআনে এসেছে- ‘আর স্মরণ করো এই কিতাবে উল্লিখিত মারিয়ামের কথা, যখন সে তার পরিবার থেকে আলাদা হয়ে নিরালায় পূর্বদিকে এক স্থানে আশ্রয় নিলো’।[১৪]

২- মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর আহ্বানে যুবকদের সাড়া

মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন সে সময়ের যুবকরা। যেই যুবকরা ফেরাঊনের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে কিছু সাহসী মানুষ মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। তারাও ছিলেন যুবক। যাদের বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ‘কিন্তু মূসার প্রতি তার কওমের ক্ষুদ্র একটি দল ছাড়া কেউ ঈমান আনল না, এ ভয়ে যে, ফেরাউন ও তাদের পরিষদ তাদেরকে ফেতনায় ফেলবে’।[১৫]

৩- মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর সঙ্গীও ছিল যুবক

আল্লাহর আদেশে মূসা (আলাইহিস সালাম) খিযির (আলাইহিস সালাম)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সঙ্গী হিসাবে নিয়েছিলেন ইউশা ইবন নূন (আলাইহিস সালাম)-কে। তিনি ছিলেন যুবক। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর স্মরণ কর, যখন মূসা তাঁর সহচর যুবকটিকে বলল, আমি চলতে থাকব যতক্ষণ না দুই সমুদ্রের মিলনস্থলে উপনীত হবো কিংবা দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেব’। [১৬]

৪- যুবক ইয়াহইয়া (আলাইহিস সালাম)

ইয়াহইয়া (আলাইহিস সালাম) আল্লাহ তা‘আলা আরও একজন কিশোরের বিষয়ে বলেন, ‘হে ইয়াহইয়া! তুমি কিতাবটিকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো’ আমরা তাকে শৈশবেই প্রজ্ঞা দান করেছি। আর আমাদের পক্ষ থেকে তাকে স্নেহ-মমতা ও পবিত্রতা দান করেছি এবং সে মুত্তাকী ছিল’।[১৭]

এ ছাড়াও দাঊদ (আলাইহিস সালাম) ও তালূতের ঘটনা উল্লেখ করার মত। ইসলামের দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে তরুণ ও যুবকরা অগ্রাধিকারী। ইসলামের একেবারে প্রথম দিকে যারা ইসলাম প্রহণ করেছিলেন তাদের বেশির ভাগই ছিলেন কিশোর ও যুবক। প্রসিদ্ধ ছাহাবীগণ ১০ থেকে ৩৭ বছর বয়সের আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। যদিও বয়সের ব্যাপারটা ঐতিহাসিকদের মতে কমবেশি হতে পারে।

আল-কুরআনে বর্ণিত ঘটনার আলোকে যুবকের অবদান

যুব সমাজের আত্মত্যাগ ছাড়া পৃথিবীতে কোন সত্য উদ্ঘাটন বা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বনী ইসরাঈলের গো-কুরবানীর কাহিনী সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বনী ইসরাঈলের এক যুবক তার চাচার সম্পত্তির লোভে এবং চাচাতো বোনকে বিয়ে করার আশায় রাতের অন্ধকারে চাচাকে হত্যা করে মৃতদেহ অন্যের বাড়ির সামনে রেখে আসে। পরদিন সকালে যে বাড়ির সামনে লাশ পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে চাচাকে হত্যার অভিযোগ উত্থাপন করে। এ নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায় তারা উভয় পক্ষ বিষয়টি মীমাংসার জন্য মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর স্মরণাপন্ন হয়। তখন মূসা (আলাইহিস সালাম) আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে জানান যে, তোমরা একটা গাভী কুরবানী করে তার এক টুকরো গোশত ঐ মৃত লাশের গায়ে স্পর্শ কর, তাহলে সে জীবিত হয়ে তার মৃত্যু-কাহিনী বর্ণনা করবে। তারা তখন মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর সাথে বহু বাদানুবাদ করল যেমন, গাভীটি কেমন হবে, তার রং কী, তার বয়স কেমন ইত্যাদি। আল্লাহর পক্ষ থেকে তখন গাভীর যতগুলো গুণাগুণ বর্ণনা করা হল তার প্রথমটি হল- ‘গাভীটি বয়সে বৃদ্ধও হবে না আবার বাছুরও হবে না। এর মধ্যবর্তী যৌবন বয়সের হতে হবে’।[১৮] অবশেষে তারা তাই করল। মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়ে তার হত্যার রহস্য প্রকাশ করে দিল। দু’টি গোত্র সাক্ষাৎ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের হাত থেকে রক্ষা পেল। এখানে লক্ষণীয় যে, একটি সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে কিছু মানুষকে নিষ্কৃতি প্রদানের অসীলা হিসাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি মধ্যম বয়সী প্রাণীকে নির্বাচন করা হল।

দ্বীন প্রতিষ্ঠায় যুব সমাজের আত্মত্যাগের গুরুত্ব আরো বেশি পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে ‘আসহাবুল উখদূদ’-এর কাহিনীতে। ঘটনাটি সংক্ষেপে এরূপ- পূর্ব যামানায় এক রাজা একটি ছেলেকে যাদুবিদ্যা শেখানোর জন্য তার বৃদ্ধ যাদুকরের কাছে পাঠায়। ছেলেটি যাদুবিদ্যা শিক্ষার পাশাপাশি এক খ্রিস্টান পাদ্রীর নিকটে সবক নিত। একদিন তার যাতায়াতের পথে বিরাট এক বন্য জন্তু এসে মানুষের চলাচলের পথ রুদ্ধ করে রাখল। ছেলেটি তখন ভাবল আজ আমি পরখ করে দেখব, পাদ্রী শ্রেষ্ঠ না যাদুকর শ্রেষ্ঠ? সে তখন একটি পাথর হাতে নিয়ে বলল, ‘হে আল্লাহ! পাদ্রীর কর্ম যাদুকরের কর্ম হতে আপনার কাছে যদি অধিক পসন্দনীয় হয়, তবে এ জন্তুটিকে মেরে ফেলুন’। এই বলে সে পাথরটি নিক্ষেপ করল এবং ঐ পাথরের আঘাতে জন্তুটি মরে গেল। বিষয়টি সর্বত্র জানাজানি হয়ে গেল। তখন অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগীসহ বিভিন্ন রোগীরা ছেলেটির কাছে আসতো। তারা আল্লাহর উপর ঈমান আনলে সে তাদের রোগ মুক্তির জন্য আল্লাহর নিকটে দু‘আ করত তাদের রোগ ভাল হয়ে যেত। এক পর্যায় রাজার পরিষদের এক সদস্য অন্ধ ছেলেটির নিকটে গিয়ে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনল, আল্লাহর রহমতে সে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেল। পরের দিন সে রাজ দরবারে গেলে রাজা তাকে জিজ্ঞেস করল, কে তোমাকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিল? সে উত্তর দিল, আমার রব। রাজা বলল, আমি ছাড়া তোমার রব কে? সে বলল, আল্লাহ তোমার ও আমার রব। তখন রাজা তাকে গ্রেফতার করে অমানুসিক নির্যাতন করতে লাগল। অবশেষে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ছেলেটির কথা বলে দেয়। রাজা তখন ছেলেটিকে গ্রেফতার করে তাকেও নির্মমভাবে নির্যাতন শুরু করে। এক পর্যায় ছেলেটি বাধ্য হয়ে পাদ্রীর কথা রাজাকে বলে। রাজা তখন পাদ্রীকে গ্রেফতার করে আনে তার দ্বীন ত্যাগ করতে বলে। কিন্তু সে প্রস্তাবে পাদ্রী অস্বীকৃতি জানালে তাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত করাত দিয়ে চিরে অত্যন্ত নির্মমভাবে নিহত করা হয়। এরপর তার পরিষদের লোকটিকে বলা হয়, তুমি তোমার দ্বীন ত্যাগ কর। সেও অস্বীকৃতি জানালে তাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত করাত দিয়ে চিরে হত্যা করা হয়।

অতঃপর একই ভাবে ছেলেটিও দ্বীন পরিত্যাগে অস্বীকৃতি জানালে তাকে কিছু সৈন্যের সাথে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় তুলে সেখান থেকে ফেলে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে পাহাড় কেঁপে উঠে, এতে তার সঙ্গীরা পাহাড়ের চূড়া হতে নিচে পড়ে মারা যায় এবং ছেলেটি প্রাণে রক্ষা পায়। অতঃপর তাকে নৌকায় করে সাগরের মাঝখানে নিয়ে পানিতে ফেলে দেয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও যারা তাকে নিয়ে গেল ঝড়ের কারণে তাদের সলীল সমাধি হল, কিন্তু আল্লাহর রহমতে ছেলেটির কিছুই হল না। রাজার হতবিহ্বল অবস্থা দেখে ছেলেটি রাজাকে বলল, তুমি আমার নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ না করলে আমাকে হত্যা করতে পারবে না। সে তখন রাজাকে বলল, একটি ময়দানে রাজ্যের সকল জনগণকে সমবেত কর। তাই করা হল। অতঃপর ছেলেটি বলল, এবার আমাকে শূলের উপর উঠাও এবং আমার তীরদানী হতে একটি তীর নিয়ে ধনুকের মাঝখানে রেখে ‘ছেলেটির রবের নামে তীর মারছি’ বলে তীর নিক্ষেপ কর। তাই করা হল এবং ছেলেটি মারা গেল। এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত সকল জনতা বলে উঠল, ‘আমরা ছেলেটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম’। যে আশঙ্কায় ভীত হয়ে রাজা পাদ্রীকে, পরিষদ সদস্যকে এবং এই ছেলেকে হত্যা করল; শেষ পর্যন্ত তাই বাস্তবায়িত হল। রাজা তখন ক্ষিপ্ত হয়ে সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী এই মানুষগুলোকে ধরে ধরে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারল।[১৯]

সংক্ষেপে বর্ণিত এ ঘটনা থেকে সহজেই অনুমেয় যে, ছেলেটি একমাত্র দ্বীন প্রচারের খাতিরে স্বেচ্ছায় নিজের হত্যার কৌশল শত্রুর নিকটে ব্যক্ত করল। ফলে মাত্র একজন যুবকের আত্মত্যাগের বিনিময়ে হাজার হাজার মানুষ পরকালীন মুক্তির দিশা খুঁজে পেল।

আছহাবে কাহাফ এর অধিবাসী যারা ছিলেন তারা যুবক

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, نَحۡنُ نَقُصُّ عَلَیۡکَ نَبَاَہُمۡ  بِالۡحَقِّ ؕ اِنَّہُمۡ فِتۡیَۃٌ  اٰمَنُوۡا بِرَبِّہِمۡ وَ زِدۡنٰہُمۡ ہُدًی ‘আমি তোমার নিকট তাদের সঠিক ঘটনা বণনা করছি,তারা ছিল কয়েকজন যুবক, রবের প্রতি তারা ঈমান এনেছিল, আমি তাদের সঠিক পথ দেখিয়েছিলাম’ (সূরা আল-কাহফ: ১৩)।

ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা আয়াতে ‘ফিতইয়া’ উল্লেখ করেছেন, তারা হচ্ছে যুবক। তারা হক্ব নিয়ে এসেছিল, তারা অধিক সঠিক পথের অধিকারী ছিল ঐ বৃদ্ধদের চেয়ে যারা বাতিল দ্বীনে ডুবে ছিল এবং তার ওপর অটল ছিল। একারণে আল্লাহ রাসূলের দিকে সাড়াদান কারীদের অধিকাংশই যুবক ছিল। কুরাইশ বৃদ্ধরা তাদের দ্বীনে অটল ছিল। তাদের মাঝে অল্পসংখক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এভাবে আল্লাহ আছহাবে কাহফ সম্পর্কে খবর দিয়েছেন যে, তারা ছিল যুব সমাজ’। [২০] যারা কাহফে আশ্রয় নিয়েছিল তারা ছিল যুবক, তোমার কওমের মুশরিকরদের কেউ তাদের সম্পর্কে জানতে চায়। তারা এমন কতিপয় যুবক যারা তাদের প্রভুর প্রতি ঈমান এনেছিল।[২১]

যুব সাহাবী

১. সামুরা ইবন জুনদুব ও রাফি‘ ইবন খাদীজ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)

উহুদ যুদ্ধের দিন অনেকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য যাত্রাপথ যাওয়ার সময় মুনাফিক সরদার ‘আব্দুল্লাহ ইবন উবাই এর ষড়যন্ত্রে ফিরে আসে। কিন্তু যুব ছাহাবী যাদের যুদ্ধে যাওয়ার সময় এখনও পরিপক্ক হয়নি। অথচ তারা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য রাসূলের কাছে বায়না ধরেন এবং যাওয়ার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বণ করতে থাকেন। উহুদ যুদ্ধের দিন বানী হারেসার দু’ভাই সামুরা ইবন যুনদুব ও রাফে ইবন খাদীজ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) রাসূল (ﷺ)-এর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেন। তখন তারা ১৫ বছরের নব যুবক ছিলেন। রাসূল (ﷺ) তাদের যুদ্ধের অনুমতি না দিয়ে বাধা দিলেন। তখন রাসূল (ﷺ)-কে বলা হল, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! নিশ্চয় রাফি‘ তিরন্দাজ, তিনি রাফি‘-কে অনুমতি দিলেন। রাফি‘কে অনুমতি দিলে তাকে বলা হল। হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সামুরা তো (বিভিন্ন কুস্তিতে) রাফি‘কে পরাজিত করে। তখন তিনি তাকেও অনুমতি দিলেন রাসূল (ﷺ) উসামা ইবন যায়দ, আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার ইবনুল খাত্তাব, যায়দ ইবন ছাবিত, বারা ইবন আযিব, আমর ইবন হাযম, উসাইদ ইবন হুযাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-কে অনুমতি দিলেন না। তবে তিনি তাদেরকে ১৫ বছর বয়সে খন্দকের দিন অনুমতি দিয়েছেন। [২২]

২. ‘আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)

‘আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ৬ বছর বয়স থেকে রাসূল (ﷺ)-এর তত্ত্বাবধায়নে লালিত-পালিত হন। তাঁর হাতেই আদব-আখলাকের সবক গ্রহণ করেন। অহী অবতরনের সময় তার বয়স ১২ বছর। তিনি অগ্রগামী ঈমান গ্রহণকারীদের অন্যতম। নবুওয়ত প্রাপ্তির সময় থেকে তিনি রাসূল (ﷺ)-এর সঙ্গে থেকে মক্কার গিরি পথে কুরাইশদের চক্ষুর আড়ালে ছালাত আদায় করেন। হিজরতের দিন তিনি নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে রাসূল (ﷺ)-এর বিছানায় শহীদ হওয়ার মানসিকতা নিয়ে শুয়েছিলেন। তখন তিনি মাত্র ২৩ বছরের যুবক ছিলেন। [২৩]  খয়বারের দিন রাসূল (ﷺ) বলেন, এমন এক ব্যক্তিকে যুদ্ধের ঝাণ্ডা দেয়া হবে আল্লাহ ও রাসূল (ﷺ) যাকে ভালবাসেন। ঝাণ্ডা দেয়া হয়েছিল ‘আলী (ﷺ)-কে। আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে বিজয়দান করেন। [২৪]

৩. ‘আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)

‘আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হিজরতের দশ বছর পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন, তিনি তার পিতার সাথে হিজরত করেন। তিনি পিতার ন্যায় শক্তিশালী, বুদ্ধিমান ও জ্ঞান অন্বেষণে অধিক আগ্রহী ছিলেন। তিনি বদর ও উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণের চেষ্ট করলে রাসূল (ﷺ) তাকে বাধা দেন কিন্তু খন্দকের যুদ্ধে তাকে অনুমতি দেয়া হয়। এরপর থেকে তিনি আর কোন যুদ্ধে অনুপস্থিত থাকেননি। তিনি প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন এবং সর্বাধিক হাদীছ বর্ণনাকারীদের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় ছিলেন। [২৫]

৪. যুবাইর ইবনুল ‘আওয়াম (রাযিয়াল্লাহু আনহু)

তিনি ছিলেন রাসূল (ﷺ)-এর হাওয়ারী। আল্লাহর রাস্তায় তলোয়ার উত্তোলনকারী ছাহাবীদের মধ্যে ১ম ছিলেন। তিনি দক্ষ অশ্বারোহী ছিলেন। কোন্ যুদ্ধে তিনি পিছু থাকেননি। দ্বীনের উপর অটল থাকার কারণে তার চাচার পক্ষ থেকে সকল শাস্তিকে মাথা পেতে মেনে নিয়েছেন এবং ধৈর্যধারণ করে বলেছেন। ‘আমি কখনও কুফুরী ধর্মে প্রত্যাবর্তন করব না। তিনি হাবশায় হিজরতকারীদের অন্যতম ছিলেন এবং বদরের যুদ্ধে তিনি তার চাচা নাওফিল ইবন খুওয়াইলিদ ইবন আসাদকে হত্যা করেন। উহুদ ও বনু কুরাইযার দিনে রাসূল (ﷺ) তাকে বলেন, আমার পিতা-মাতা তোমার জন্য উৎসর্গ হোক। খন্দকের দিনে রাসূল (ﷺ) বলেন, আমার নিকট শত্রুদের খবর কে এনে দিবে? যুবাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, ‘আমি। তিনি ঘোড়ায় চড়ে গেলেন এবং তাদের সংবাদ নিয়ে আসলেন। এভাবে পরপর তিনদিন তিনি তাদের সংবাদ নিয়ে আসলেন তখন রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘প্রত্যেক নবীর হাওয়ারী ছিল আর আমার হাওয়ারী হচ্ছে যুবাইর (আলাইহিস সালাম)’। [২৬]

৫. আসমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)

আবূ বাকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) নবী (ﷺ)-কে নিয়ে হিজরতে যাওয়ার সময় তিনি তার সঙ্গে যা মাল ছিল তাই নিয়ে যান। তার পরিমাণ প্রায় ৬০০০/= দিরহাম। তিনি তার পরিবারের জন্য কিছুই রেখে যাননি। যখন আসমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর দাদা আবূ কুহাফা তার বাড়ীতে এসে বলেন যে, আবূ বাকর বাড়ীর সব কিছু কি নিয়ে চলে গেছে! তখন আসমা বলেন, ‘হে দাদা! তিনি আমাদের জন্য সব কিছুই রেখে গিয়েছেন’। এছাড়া ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় বহু যুব ছাহাবীদের অবদান ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তাঁরা শুরু থেকে নবী (ﷺ)-এর খিদমত থেকে নিয়ে সর্বক্ষেত্রে রাসূল (ﷺ)-এর সহচর্য লাভ করে ইসলামকে সারা বিশ্বের বুকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে বহু বিপদগামী যুবক তার অন্ধকার পথ থেকে ফিরে এসে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে।[২৭] এমনিভাবে মূসা ইবন নুসাইর, তারিক ইবন যিয়াদ, মুহাম্মাদ ইবন কাসিম, ইবরাহীম ইবন নাখঈ ও ‘উমার ইবন ‘আব্দিল ‘আযীয (রাহিমাহুমুল্লাহ) সহ বহু যুবক ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যে অবদান তুলে ধরেছেন, তা জাতির সামনে ইতিহাসে জ্বল জ্বল করছে।

এমনিভাবে যুগে যুগে যুব সমাজের আত্মত্যাগের মাধ্যমে সমাজ থেকে অন্যায় ও অসত্যের দম্ভ চূর্ণ হয়ে তদস্থলে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। বর্তমান বিশ্ব পরিমণ্ডলে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে সর্বত্র নব্য ফেরাউন ও নমরুদ মুসলিম বিশ্বকে গ্রাস করতে অক্টোপাসের মত ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে চলেছে। মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে নানা রকম মিথ্যা তোহমত দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য জাতির কাছে তাদেরকে হেয় বা ঘৃণ্য জাতি হিসাবে চিত্রিত করা হচ্ছে। ইরাক, আফগান, কাশ্মীর, সোমালিয়াসহ বিশ্বের যেখানেই মুসলিমরা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় এবং শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে, সেখানেই তাদেরকে ইহুদী-খ্রিস্টানদের মদদপুষ্ট প্রচার মাধ্যমগুলো জঙ্গী হিসাবে চিত্রিত করছে। অথচ তাদের মুখে কখনও ইসরাঈলকে জঙ্গী বলতে শোনা যায় না, শ্রীলংকার তামিল বিদ্রোহী, ভারতের উলফাসহ অন্যান্য চরমপন্থী গ্রুপগুলোকে, নেপালের মাওবাদী বিদ্রোহী বাহিনীসহ অন্য ধর্মাবলম্বী চরমপন্থী কোন গ্রুপকে জঙ্গী বলতে শোনা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে এসব মোড়লদের বিরুদ্ধে ঐ সকল চরমপন্থী দলগুলোকে অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সহযোগিতা করারও অভিযোগ ওঠে, যা বহুলাংশে সত্য। ইহুদী-খ্রিস্টানদের এহেন ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে বিশেষ করে মুসলিম যুবকদের সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। যাতে কোন অবস্থাতেই কোন মুসলিম যুবক তাদের হাতের পুতুলে পরিণত না হয়।

সাম্প্রতিক কালে ধর্মের নামে অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত কিছু যুবক সস্তায় জান্নাত লাভের আশায় ইহূদী-নাছারাদের চক্রান্তের শিকার হয়ে নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করছে। বিশেষ করে কোমলমতি যুবসমাজকে জিহাদের নামে সরাসরি জঙ্গী কার্যক্রমের মত ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হচ্ছে। কুরআন-হাদীছের খণ্ড খণ্ড আয়াত ও হাদীছ পড়িয়ে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দিয়ে সরলমনা এসব ছেলেদের শরীরে বোমা বেঁধে ইসলামের দুশমন খতমের নামে যত্রতত্র হামলা চালানো হচ্ছে। আর তাতে প্রাণ হারাচ্ছে শত শত নিরীহ নিরপরাধ প্রাণ। পরিণামে ছেলেটি ইহকাল-পরকাল দু’টিই হারাচ্ছে, সাথে সাথে বিশ্বের দরবারে চির সত্য ধর্ম ইসলাম সন্ত্রাসীদের ধর্ম হিসাবে আখ্যায়িত হচ্ছে। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি হত্যার বিনিময়ে হত্যা অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ব্যতীত কোন নিরপরাধ ব্যক্তি হত্যা করল, সে যেন সমগ্র মানব জাতিকে হত্যা করল’।[২৮] অতএব সাবধান হে যুবসমাজ! কোন চক্রান্তকারীর চক্রান্তের শিকার হয়ে আমরা যেন বিপথগামী না হয়ে পড়ি। সাথে সাথে মহান আল্লাহ আমাদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা যেন যথাযথভাবে পালন করে যেতে পারি সেদিকে সদা সচেষ্ট থাকতে হবে।


* প্রভাষক, দেওগাঁ রহমানিয়া ফাযিল ডিগ্রী মাদরাসা, ঘোড়াঘাট, দিনাজপুর।

[১]. মুসতাদরাক আলাছ ছহীহাইন, হা/৭৮৪৬ ; মিশকাত, হা/৫১৭৪ ; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘, হা/১০৭৭।

[২]. তিরমিযী, হা/২৪১৭ ; মিশকাত, হা/৫১৯৭, সনদ ছহীহ।

[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪১২ ; তিরমিযী, হা/২৩০৪ ; ইবনু মাজাহ, হা/৪১৭০ ; মুসতাদরাক আলাছ ছহীহাইন, হা/৭৮৪৫ ; মিশকাত, হা/৫১৫৫।

[৪]. আহমাদ ইবনু হাজার আল-‘আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী শারহু ছহীহিল বুখারী (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফ, ১৩৭৯ হি.), পৃ. ২৩০।

[৫]. ইবনু মাজাহ, ৯ম খণ্ড, পৃ. ১৭০, হা, ৪১৭০।

[৬]. যঃঃঢ়ং://ধৎ.রংষধসধিু.হবঃ/ধৎঃরপষব/১৮৫৩৭/

[৭]. ফাৎহুল বারী, ৯ম খণ্ড, পৃ. ১৩। 

[৮]. ‘উলামা ওয়া ত্বলাবাতিল ইলম, মাযমূ‘ আয যাওয়য়িদ, ১ম খণ্ড (প্রকাশনা স্থান বিহীন : মাওকি‘ল ইসলাম, তা.বি.), পৃ. ৩৩৪ ।

[৯]. সূরা আল-ক্বাছাছ: ২৬।

[১০]. মুহাম্মাদ হাসান আশ শায়খ আলী আল কুতুবী, আশ-শাইবু ওয়াস শাবাবু ফিল আদাবিল আরবী (ভারত: মাকতাবাহ আল-কুতুবিল আম্মাহ, সংস্করণ, ১৯৭২ খ্রি.), পৃ. ৩৩।

[১১]. সুরা আল-আম্বিয়া : ৬০।

[১২]. সূরা ইউসুফ: ২৩।

[১৩]. আশ শাইবু ওয়াস শাবাবু ফিল আদাবিল ‘আরবী, পৃ. ৩৩ ।

[১৪]. সূরা মারিয়াম: ১৬।

[১৫]. সূরা ইউনুছ: ৮৩।

[১৬]. সূরা আল-কাহ্ফ: ৬০।

[১৭]. সূরা মারিয়াম: ১২-১৩।

[১৮]. আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ.১৪৩।

[১৯]. আবুল ফিদা ইসমা‘ঈল ইবনু উমার ইবনু কাছীর আল-কুরাশী আদ-দিমাশকী, মুহাক্কিক সামী ইবন মুহাম্মাদ সালামহ, তাফসীরুল কুরআনীল ‘আযীম, ৮ম খণ্ড ( দারুত ত্বাইয়্যেবাহ, ১৯৯৯ খ্রি.), পৃ.৩৬৬-৩৬৮।

[২০]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৫ম খণ্ড, পৃ.১৩৯।

[২১]. মুহাম্মাদ ইবন জারীর ইবন কাছীর ইবন ইয়াযীদ ইবন গালিব আল-আমালী, মুহাক্কীক : আহমাদ মুহাম্মাদ শাকির, জামি‘উল বায়ান ফী তাবীলিল কুরআন, ১৭ খণ্ড ( মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ২০০০ খ্রি.), পৃ.৬১৫।

[২২]. ইবরাহীম ইবন ইসমা‘ঈল আল-আবইয়ারী, আল-মাওসূ‘আতুল কুরআনিয়্যাহ, ১ম খণ্ড (মুওসসাসাতু সিজিল্লিল ‘আরাব, সংস্করণ ১৪০৫ হি.), পৃ. ১৬৪।

[২৩]. যঃঃঢ়ং://ধৎ.রংষধসধিু.হবঃ/ধৎঃরপষব/১৮৫৩৭/

[২৪]. সহীহুল বুখারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪৭, হা, ২৯৪২।

[২৫]. যঃঃঢ়ং://ধৎ.রংষধসধিু.হবঃ/ধৎঃরপষব/১৮৫৩৭/

[২৬].যঃঃঢ়ং://িি.িরংষধসবিন.হবঃ/ধৎ/ভধঃধি/৩৬২৬৩/...

[২৭]. যঃঃঢ়ং://ধৎ.রংষধসধিু.হবঃ/ধৎঃরপষব/১৮৫৩৭/

[২৮]. সূরা আল-মায়িদাহ : ৩২।




প্রসঙ্গসমূহ »: যুবসমাজ
ইসলামে বিবাহের গুরুত্ব (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আবূ সাঈদ
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৫ম কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
মুসলিম উম্মাহর বিভ্রান্তির কারণ ও উত্তররেণর উপায় - হাসিবুর রহমান বুখারী
অহংকার করা ও তার পরিণাম (শেষ কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
আল্লাহর ভালোবাসা - ড. মুস্তফা মনজুর
ফাযায়েলে কুরআন (৭ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
আধুনিক যুগে দাওয়াতী কাজের পদ্ধতি (২য় কিস্তি) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
ফাযায়েলে কুরআন - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব (৪র্থ কিস্তি) - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
ইসলামে রোগ ও আরোগ্য (৪র্থ কিস্তি) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
ভ্রান্ত ফের্কাসমূহের ঈমান বনাম আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ঈমান : একটি পর্যালোচনা (শেষ কিস্তি) - ড. আব্দুল্লাহিল কাফী বিন লুৎফর রহমান মাদানী

ফেসবুক পেজ