বিদায় হজ্জের ভাষণ : তাৎপর্য ও মূল্যায়ন
-মুহাম্মাদ আকবার হোসাইন*
(শেষ কিস্তি)
বিদায় হজ্জের ভাষণের মূল্যায়ন
আল্লাহ তা‘আলা শরী‘আত অবতীর্ণ করেন মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর। তিনি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে জাতিকে শরী‘আতের সার্বিক বিষয়াদি শিক্ষা দিয়েছেন। জীবনের সর্বশেষ বক্তব্যে শরী‘আতের মূলনীতি হিসাবে কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। বিদায় হজ্জের এই ভাষণের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় নিম্নে উল্লেখ করা হল :
পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসরণ যোগ্য
বিদায় হজ্জের ভাষণ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসরণযোগ্য। ক্বিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীর সকল মানুষ একে বিনা দ্বিধায় অনুসরণ করতে পারবে। যুগ ও কালের ব্যবধান পেরিয়ে এ ভাষণ বিশ্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করেছে। দীর্ঘ প্রায় ১৪০০ বছর পরও এবং বর্তমানে প্রযুক্তি বিদ্যার চরম উৎকর্ষের যুগেও তার ভাষণের পূর্ণ অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা মানুষ অনুভব করছে। শুধু বিদায় হজ্জের ভাষণই নয়, বরং নেতা হিসাবে মুহাম্মাদ (ﷺ)-ই একমাত্র অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রতিটি কথা ও কর্ম বিশ্ব মানবতার জন্য পথ প্রদর্শক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُلۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُحِبُّوۡنَ اللّٰہَ فَاتَّبِعُوۡنِیۡ یُحۡبِبۡکُمُ اللّٰہُ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ - قُلۡ اَطِیۡعُوا اللّٰہَ وَ الرَّسُوۡلَ ۚ فَاِنۡ تَوَلَّوۡا فَاِنَّ اللّٰہَ لَا یُحِبُّ الۡکٰفِرِیۡنَ.
‘(হে নবী!) আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসতে চাও, তাহলে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (হে নবী!) আপনি বলুন, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা কাফেরদেরকে ভালবাসেন না’ (সূরা আলে ইমরান : ৩১-৩২)। অন্যত্র তিনি বলেন, مَنۡ یُّطِعِ الرَّسُوۡلَ فَقَدۡ اَطَاعَ اللّٰہَ ۚ وَ مَنۡ تَوَلّٰی فَمَاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ عَلَیۡہِمۡ حَفِیۡظًا ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহ্র আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি বিমুখ হল, তবে আমরা তোমাকে তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক করে প্রেরণ করিনি’ (সূরা আন-নিসা : ৮০)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰہَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡکُمۡ ۚ فَاِنۡ تَنَازَعۡتُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ فَرُدُّوۡہُ اِلَی اللّٰہِ وَ الرَّسُوۡلِ.
‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্য থেকে বিজ্ঞদের। যদি তোমরা কোন বিষয়ে মত বিরোধ কর, তাহলে তা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ কর’ (সূরা আন-নিসা : ৫৯)। হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
كُلُّ أُمَّتِىْ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ إِلَّا مَنْ أَبَى قَالُوْا يَا رَسُولَ اللهِ ﷺ وَمَنْ يَأْبَى قَالَ مَنْ أَطَاعَنِىْ دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ عَصَانِىْ فَقَدْ أَبَى .
‘আমার সকল উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে। কিন্তু অস্বীকারকারী ব্যতীত। তারা বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ)! কে অস্বীকারকারী? তিনি বললেন, যে আমার অনুসরণ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্যতা করবে তারাই অস্বীকারকারী’।[১] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, فَمَنْ أَطَاعَ مُحَمَّدًا ﷺ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَى مُحَمَّدًا ﷺ فَقَدْ عَصَى اللهَ وَمُحَمَّدٌ ﷺ فَرْقٌ بَيْنَ النَّاسِ ‘যে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর অনুসরণ করল, সে আল্লাহ্র আনুগত্য করল। আর যে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর অবাধ্যতা করল, তারা আল্লাহ্র অবাধ্যতা করল। মুহাম্মাদ (ﷺ) হলেন মানুষের মাঝে পার্থক্যের মাপকাঠি’।[২]
তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদর্শের অনুসরণই ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তির মাধ্যম। যদি তাকে উপেক্ষা করে পূর্বের কোন নবীরও আনুগত্য করা হয়, তবুও সে পথভ্রষ্ট জাহান্নামী। সাধারণ কোন ইমাম, পীর, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক তো অনেক দূরের ব্যাপার। জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) একদা তাওরাতের একটি কপি নিয়ে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! এটি তাওরাতের কপি। একথা শুনে তিনি চুপ থাকলেন। তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) পড়তে শুরু করলেন। ফলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেল। তখন আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন, তোমার ধ্বংস হোক! তুমি কি রাসূল (ﷺ)-এর চোহরার দিকে দেখছ না? তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মুখের দিকে তাকালেন এবং বললেন, আমি আল্লাহ তা‘আলা ও তার রাসূল (ﷺ)-এর ক্রোধ হতে পরিত্রাণ চাচ্ছি। আমরা আল্লাহকে রব হিসাবে ইসলামকে দ্বীন হিসাবে এবং মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে নবী হিসাবে পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, যার হাতে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর প্রাণ রয়েছে, তার কসম করে বলছি, যদি আজ মূসা (আলাইহিস সালাম) তোমাদের মাঝে আবির্ভূত হন আর তোমরা তার অনুসরণ কর এবং আমাকে পরিত্যাগ কর, তবুও তোমরা সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে। আজ মূসা (আলাইহিস সালাম) যদি বেঁচে থাকতেন আর আমার নবুঅত পেতেন, তবে তিনিও আমার অনুসরণ করতেন।[৩]
ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা
মহানবী (ﷺ)-এর আবির্ভাবের পূর্বে বিশেষ করে আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। খুঁটিনাটি বিষয়কে কেন্দ্র করে ভাইয়ে-ভাইয়ে, গোত্রে-গোত্রে মারামারি, রক্তপাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ, হিংসা-হানাহানি লেগেই থাকত। একে অন্যের নিকটে মানবীয় সম্মানবোধের কোন বালাই ছিল না। মুহাম্মাদ (ﷺ) নবুঅত লাভের পর উক্ত অবস্থার পরির্বতন করে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিদায় হজ্জের ভাষণে মুসলিম সমাজকে এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃ সমাজ হিসাবে ঘোষণা দেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ ‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই’।[৪]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ اِخۡوَۃٌ فَاَصۡلِحُوۡا بَیۡنَ اَخَوَیۡکُمۡ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ ‘নিশ্চয় মুমিনগণ পরস্পর ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে, সম্ভবত তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হবে’ (সূরা আল-হুজুরাত : ১০)।
মহানবী (ﷺ) বিদায় হজ্জে আরাফার ময়দানে সমবেত লক্ষাধিক জনতার সামনে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত স্বরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। আজও আল্লাহর হুকুম পালনার্থে প্রতি বছর সারা বিশ্ব থেকে ২০ লক্ষাধিক মুসলিম ঐতিহাসিক আরাফার ময়দানে সমবেত হয়। যে আরাফার ময়দান বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের মাইল ফলক। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিদায় হজ্জের বক্তব্য বর্তমান সময়ের মুসলিমরা মূল্যায়ন না করার ফলে তারা এক কাতারে আসতে শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে এবং হচ্ছে। কারণ অহীর বিধান পরিত্যাগ করে মস্তিষ্ক প্রসূত চিন্তা-চেতনা ও বিভিন্ন ধরণের মতবাদের অনুসারী হওয়ায় মুসলিমগণ সর্বত্র নির্যাতিত এবং অপমানজনকভাবে বন্দি জীবন-যাপন করছে। তাই বিশ্ববাসীর কাছে বিশেষ করে মুসলিম উম্মার কাছে নি¤েœাক্ত আল্লাহ্র বাণী পেশ করতে চাই। আল্লাহ বলেন,
وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰہِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا ۪ وَ اذۡکُرُوۡا نِعۡمَتَ اللّٰہِ عَلَیۡکُمۡ اِذۡ کُنۡتُمۡ اَعۡدَآءً فَاَلَّفَ بَیۡنَ قُلُوۡبِکُمۡ فَاَصۡبَحۡتُمۡ بِنِعۡمَتِہٖۤ اِخۡوَانًا ۚ وَ کُنۡتُمۡ عَلٰی شَفَا حُفۡرَۃٍ مِّنَ النَّارِ فَاَنۡقَذَکُمۡ مِّنۡہَا.
‘তোমরা আল্লাহ্র অনুগ্রহ স্মরণ কর। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে। অতঃপর (ইসলাম গ্রহণের পর) আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের হৃদয়ে সম্প্রীতির সঞ্চার করে দিয়েছেন। ফলে আল্লাহ্র অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছ। তোমরা তো অগ্নিকু-ের কিনারে অবস্থান করছিলে, আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)।
(১) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিদায় হজ্জের মাধ্যমে জাহেলী যুগের মানুষ হত্যা প্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করেন এবং হত্যা করলে অপরাধীর বিধানও আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেন। ইসলাম এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
مَنۡ قَتَلَ نَفۡسًۢا بِغَیۡرِ نَفۡسٍ اَوۡ فَسَادٍ فِی الۡاَرۡضِ فَکَاَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِیۡعًا
‘যে কেউ জীবনের বদলে জীবন অথবা জনপদে অনর্থ সৃষ্টি করা ব্যতীত কাউকে হত্যা করে, সে যেন সকল মানুষকে হত্যা করে। আর যে ব্যক্তি কারও জীবন রক্ষা করে, সে যেন সকল মানুষের জীবন রক্ষা করে’ (সূরা আল-মায়েদাহ : ৩২)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَالۡفِتۡنَۃُ اَکۡبَرُ مِنَ الۡقَتۡلِ ‘ফিৎনা (সন্ত্রাস) হত্যা অপেক্ষাও মহাপাপ’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২১৭)।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,مَنْ قَتَلَ نَفْسًا مُعَاهَدًا لَمْ يَرَحْ رَائِحَةَ الْجَنَّةِ وَإِنَّ رِيحَهَا يُوجَدُ مِنْ مَسِيْرَةِ أَرْبَعِيْنَ عَامًا ‘যে ব্যক্তি মুসলিম জনপদে চুক্তিবদ্ধ কোন ব্যক্তিকে হত্যা করবে, সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। যদিও চল্লিশ বছরের পথের দূরত্ব হতেও তার সুগন্ধি পাওয়া যায়’।[৫] তিনি বলেন, لَزَوَالُ الدُّنْيَا أَهْوَنُ عَلٰى اللهِ مِنْ قَتْلِ رَجُلٍ مُسْلِمٍ ‘আল্লাহ্র নিকট সারা দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার চেয়েও গুরুতর হচ্ছে কোন মুসলিমকে হত্যা করা’।[৬] অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, مَنْ حَمَلَ عَلَيْنَا السِّلَاحَ فَلَيْسَ مِنَّا ‘যে ব্যক্তি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র উত্তোলন করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[৭]
উক্ত বিধান থাকলেও অনেকে তা মূল্যায়ন করেনি। ফলে পৃথিবীতে হত্যাকা- বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতি দ্বন্দ্ব তো আছেই। তাছাড়া বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যেই হত্যাকা- ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আক্বীদাভ্রষ্ট ও শরী‘আত সম্পর্কে অজ্ঞ একশ্রেণীর মানুষ জিহাদ ও ক্বিতালের অপব্যাখ্যা করে ইসলামের নামে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের আমদানি করছে। অথচ ইসলামের সাথে জঙ্গীবাদের দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। বরং যাবতীয় চরমপন্থাকে ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রমাণিত হবে যে, ইসলাম কখনো হত্যা ও সন্ত্রাসকে উসকে দেয়নি বা উৎসাহিত করেনি। বরং ইসলামে এসব নিষিদ্ধ, হারাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ঐতিহাসিক ভাষণ আজ মানুষ ভুলে গেছে।
(২) অনুরূপ অর্থনীতির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। আজ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিদায় হজ্জের ভাষণকে মূল্যায়ন না করে ইসলামী অর্থনীতিকে আড়াল করে সূদ ভিত্তিক অর্থনীতি সম্প্রসারণে মুসলিম নারী-পুরুষ ব্যবহৃত হচ্ছে। ভয়ংকর অভিশাপ সূদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। ব্যাঙ্গের ছাতার ন্যায় অসংখ্য এন.জি.ও পরিচালনা করা হচ্ছে। পরিচালিত হচ্ছে অসংখ্য ব্যাংক, বীমা ও সংস্থা। যার পরিণতি হল নিঃস্বতা ও দারিদ্রতা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, الرِّبَا وَإِنْ كَثُرَ فَإِنَّ عَاقِبَتَهُ تَصِيْرُ إِلَى قُلٍّ ‘সূদের দ্বারা সম্পদ যতই বৃদ্ধি পাক না কেন, তার শেষ পরিণতি হল নিঃস্বতা’।[৮] আবূ হরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, الرِّبَا سَبْعُوْنَ حُوْبًا أَيْسَرُهَا أَنْ يَنْكِحَ الرَّجُلُ أُمَّهُ ‘সূদের পাপের সত্তরটি স্তর রয়েছে, যার নি¤œতম স্তর হল মায়ের সাথে যেনা করার পাপ’।[৯]
আব্দুল্লাহ ইবনু হানযালা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, دِرْهَمُ رِباً يَأْكُلُهُ الرَّجُلُ وَهُوَ يَعْلَمُ أَشَدُّ مِنْ سِتَّةٍ وَثَلاَثِيْنَ زَنْيَةً ‘কোন ব্যক্তি যদি এক দিরহাম রৌপমুদ্রা সূদ জ্ঞাতসারে গ্রহণ করে, তাতে তার পাপ ছত্রিশবার ব্যভিচার করার চেয়েও অনেক বেশি হয়’।[১০]
(৩) ইসলাম নারীদের যে মর্যাদা দিয়েছে, পৃথিবীর অন্য কোন ধর্ম তা দেয়নি। বিশেষ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিদায় হজ্জের ভাষণে নারীর মর্যাদাকে আরো স্থায়ী ও সুদৃঢ় করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ নামধারী মুসলিম তাকে মূল্যায়ন না করে সমঅধিকার ও ক্ষমতায়নের লোভে নারী সমাজকে নষ্ট করার যাবতীয় পথ খুলে দিয়েছে। অথচ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, الْمَرْأَةُ عَوْرَةٌ فَإِذَا خَرَجَتِ اسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ ‘নারী হচ্ছে ঢেকে রাখার বস্তু। যখন সে রাস্তায় বের হয় শয়তান তাকে নগ্নতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে’।[১১] এজন্যই দেখা যায় যে, নারীরা যখন বাড়ীতে থাকে তখন এক রকম। আর যখন রাস্তায় বের হয় তখন অন্য রকম। নারীরা শ্লোগান দিচ্ছে ‘আমরা নারী, সবই পারি’।
আশ্চর্য জনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে বাংলাদেশে বেকার সমস্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। অনেক সার্কুলারে দেখা যায়, পুরুষের থেকে নারীদের অগ্রাধিকার বেশী। অনেক ক্ষেত্রে ৬০% মহিলার কথা সরাসারি উল্লেখ থাকে। যেখানে যুবকরা বেকার সেখানে তরুণী, যুবতী নারীদেরকে নিরাপত্তা কর্র্মী হিসাবে পুলিশ বাহিনীতে, সেনাবাহিনীতে, নৌবাহিনীতে, আনসার বাহিনীতে ও বিমান বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। নারীদের নিরাপত্তার জন্য যেখানে বাহিনী দরকার, সেখানে নারীদেরকেই দেয়া হচ্ছে নিরাপত্তার দায়িত্ব। এ এক অবাক সভ্যতা! অহীর বিধানে বিবাহ বন্ধনে উৎসাহিত করা হয়েছে। আর মানুষ যখনই অহীর বিধান বাদ দিয়ে মানুষ রচিত বিধানের বয়স সীমা বেধে দিয়েছে, তখনই মানুষ যেনা-ব্যভিচারের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
পর্ণোগ্রাফি তৈরি অশ্লীলতা ও বিকারগ্রস্ত মানসিকতার পরিচায়ক। তরুণ ও যুব চরিত্র হরণ করাই এর মূল উদ্দেশ্য। ইসলাম যেকোন প্রকার অশ্লীলতার নিকটবর্তী হতেও নিষেধ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَا تَقۡرَبُوا الۡفَوَاحِشَ مَا ظَہَرَ مِنۡہَا وَ مَا بَطَنَ ‘তোমরা কোন ধরনের প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য অশ্লীল কাজের নিকটবর্তী হয়ো না’ (সূরা আন-আন‘আম : ১৫১)।
ইলেকট্রিক মিডিয়ায় সুপারস্টার ও সুন্দরী প্রতিযোগিতা, ইউটিউবে আপলোড করা বিভিন্ন নগ্ন ভিডিও, নগ্ন বিলবোর্ড ও পোস্টার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় উলঙ্গ বিজ্ঞাপন, সমকামিতা, ইভটিজিং, নারী ধর্ষণ ইত্যাদি নারী জাতির মর্যাদাকে একেবারে পদদলিত করেছে। তাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিদায় হজ্জের ভাষণকে মূল্যায়ন করা অত্যাবশ্যক।
(৪) তাওহীদ বলতে ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহকে একক গণ্য করা বুঝায়।[১২] আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে তাওহীদের উপর সৃষ্টি করেছেন। তাই প্রত্যেক নবী-রাসূল তার জাতিকে প্রথমে তাওহীদের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিদায় হজ্জের ভাষণে তাওহীদকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ আজ তাওহীদকে বর্জন করে শিরকে নিমজ্জিত। অথচ মানুষকে দুনিয়াতে পাঠানোর আগে আত্মার জগতে তাদের কাছ থেকে আল্লাহ তাওহীদের প্রতিশ্রুতিও নিয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন,
وَ اِذۡ اَخَذَ رَبُّکَ مِنۡۢ بَنِیۡۤ اٰدَمَ مِنۡ ظُہُوۡرِہِمۡ ذُرِّیَّتَہُمۡ وَ اَشۡہَدَہُمۡ عَلٰۤی اَنۡفُسِہِمۡ ۚ اَلَسۡتُ بِرَبِّکُمۡ ؕ قَالُوۡا بَلٰی ۚۛ شَہِدۡنَا ۚۛ اَنۡ تَقُوۡلُوۡا یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ اِنَّا کُنَّا عَنۡ ہٰذَا غٰفِلِیۡنَ.
‘আর স্মরণ কর, যখন তোমার পালনকর্তা বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করলেন তাদের সন্তানদেরকে এবং নিজের উপর তাদের প্রতিভাত করলেন যে, আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই? তারা বলল, অবশ্যই। আমরা অঙ্গীকার করছি। ক্বিয়ামতের দিন তারা যেন বলতে না পারে যে, আমাদের এ বিষয়ে জানা ছিল না’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৭২)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَقَدۡ بَعَثۡنَا فِیۡ کُلِّ اُمَّۃٍ رَّسُوۡلًا اَنِ اعۡبُدُوا اللّٰہَ وَ اجۡتَنِبُواالطَّاغُوۡتَ ‘আমরা সকল উম্মতের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি তাদেরকে এই নির্দেশ প্রদান করার জন্য যে, তোমরা আল্লাহ্র একত্ববাদকে গ্রহণ কর এবং ত্বাগূত থেকে বিরত থাক’ (সূরা আন-নাহল : ৩৬)। অন্যত্র বলেন, وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ مِنۡ رَّسُوۡلٍ اِلَّا نُوۡحِیۡۤ اِلَیۡہِ اَنَّہٗ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّاۤ اَنَا فَاعۡبُدُوۡنِ ‘(হে নবী!) আপনার পূর্বে আমরা যে রাসূলই প্রেরণ করেছি তাদেরকে এ আদেশই প্রেরণ করেছি যে, আমি ব্যতিরেকে কোন সত্য ইলাহ নেই। অতএব তোমরা কেবল আমারই ইবাদত কর’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ২৫)।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিদায় হজ্জের ভাষণে তাওহীদকে দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ধরা এবং আল্লাহ্র সাথে কাউকে শরীক না করার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّہٗ مَنۡ یُّشۡرِکۡ بِاللّٰہِ فَقَدۡ حَرَّمَ اللّٰہُ عَلَیۡہِ الۡجَنَّۃَ وَ مَاۡوٰىہُ النَّارُ ؕ وَ مَا لِلظّٰلِمِیۡنَ مِنۡ اَنۡصَارٍ ‘নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সাথে অংশীদার স্থাপন করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম। অত্যাচারীদের কোন সাহায্যকারী নেই’ (সূরা আল-মায়েদা : ৭২)।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, مَنْ لَقِىَ اللهَ لَا يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ لَقِيَهُ يُشْرِكُ بِهِ دَخَلَ النَّارِ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সাথে কাউকে শরীক না করে মৃত্যুবরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি তার সাথে কাউকে শরীক করে মৃত্যুরণ করবে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’।[১৩]
উক্ত হুঁশিয়ারী থাকা সত্ত্বেও আমরা বর্তমানে জেনে, না জেনে, সংস্কৃতির নামে, আধুনিকতার নামে, প্রগতির নামে, জাতি ও মানুষ পূজার নামে, কবর পূজার নামে, দিবস পূজার নামে, মালা পুজার নামে, সম্মান প্রদর্শনের নামে, নীরবতার নামে অসংখ্য শিরকে লিপ্ত। তাই আমাদেরকে শিরকের ভয়াভয়তা থেকে সর্তক থাকতে হবে এবং তাওহীদের সফলতার প্রতি সজাগ হয়ে বিদায় হজ্জের ভাষণকে সমাজের সর্বস্তরে বাস্তবায়নের সার্বিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
উপসংহার
বিশ্ববাসী যতদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিদায় হজ্জের ভাষণকে যথাযথ মূল্যায়ন না করবে, ততদিন বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। হে আল্লাহ! বিদায় হজ্জের ভাষণের সেই চূড়ান্ত দিক-নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!
* সহকারী অধ্যাপক, আরবী বিভাগ, হামিদপুর আলহেরা কলেজ, যশোর।
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৭২৮০; মিশকাত, হা/১৪৩।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৭২৮১; মিশকাত, হা/১৪৪।
[৩]. দারেমী, হা/৪৪৩; মিশকাত, হা/১৯৪, সনদ হাসান।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/২৪৪২; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪; মিশকাত, হা/৪৯৮৫।
[৫]. ছহীহ বুখারী হা/৬৯১৪।
[৬]. তিরমিযী হা/১৩৯৫; নাসাঈ হা/৩৯৮৭; মিশকাত হা/৩৪৬২; ছহীহুল জামে‘ হা/৫০৭৭, সনদ ছহীহ।
[৭]. ছহীহ বুখারী হা/৬৮৭৪; ছহীহ মুসলিম হা/৯৮; মিশকাত হা/৩৫২০।
[৮]. মুসনাদে আহমাদ হা/৩৭৫৪; হাকেম হা/২২৬২; মিশকাত হা/২৮২৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৫৪২, সনদ ছহীহ।
[৯]. ইবনু মাজাহ হা/২২৭৪; মিশকাত হা/২৮২৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৫৪১, সনদ ছহীহ।
[১০]. মুসনাদে আহমাদ হা/২২০০৭; দারাকুৎনী হা/২৮৮০; মিশকাত হা/২৮২৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১০৩৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৩৭৫, সনদ ছহীহ।
[১১]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৩১০৯, সনদ ছহীহ ।
[১২]. ছালেহ ইবনু ফাওযান ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু ফাওযান, ইয়া‘নাতুল মুসতাফীদ বি শারহী কিতাবিত তাওহীদ (প্রকাশনা : মুয়াস্সাসাতুর রিসা‘লাহ, তৃতীয় সংস্করণ ১৪২৩ হি./২০০২ খ্রি.), ১ম খ-, পৃ. ২৪।
[১৩]. ছহীহ মুসলিম হা/৯৩।
প্রসঙ্গসমূহ »:
হজ্জ ও ওমরাহ