আধুনিক যুগে দাওয়াতী কাজের পদ্ধতি
-মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী*
(৩য় কিস্তি)
দাওয়াত দেওয়ার কৌশল সমূহ
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন নবী হিসাবে প্রেরিত হলেন, তখন তিনি নিজে আমল করেই সন্তুষ্ট হননি; বরং অন্যকে আমল করানো বা জানানোও তার উপর দায়িত্ব এসে গেল। কিন্তু সে সময় কোন অনুকূল পরিবেশ ছিল না। অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে অন্যকে জানানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। প্রথমতঃ গোপনে ও একজন একজনের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেন। দাওয়াতী কাজ নবী-রাসূলগণ নিজ থেকেই করতেন এমন নয়; বরং এ কাজের জন্যই তাদের প্রেরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ দাওয়াতী কাজ তাদের উপর ফরয ছিল। মহান আল্লাহ বলেন, وَ لَقَدۡ بَعَثۡنَا فِیۡ کُلِّ اُمَّۃٍ رَّسُوۡلًا اَنِ اعۡبُدُوا اللّٰہَ وَ اجۡتَنِبُواالطَّاغُوۡتَ ‘আমরা প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি এই ফরমান দিয়ে যে, তারা নির্দেশ দিবে তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত থেকে বিরত থাক’ (সূরা আন-নাহল : ৩৬)।
পবিত্র অহীর এ নির্দেশকে সামনে রেখেই পৃথিবীর সব নবী-রাসূলই দাওয়াতী কাজে আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় আমরাও বাদ পড়ব না। সেই নির্দেশ আমাদের উপরও একইভাবে প্রযোজ্য। তাই আধুনিক যুগে পূর্বের পদ্ধতি থেকে শিক্ষা নিয়ে সময় উপযোগী পদ্ধতি বা কৌশল কাজে লাগিয়ে মানুষের কাছে তাওহীদের দাওয়াত উপস্থাপন করতে হবে। তবে কোন একটি কৌশলের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। একটি পদ্ধতিতে সুফল না পেলে অন্য কৌশল অবলম্বন করতে হবে। স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, মানুষ যখন দাওয়াত গ্রহণ করার মানসিক সিদ্ধান্ত নেয় ঠিক তখনই দাওয়াত দেয়া উচিত। এজন্য প্রয়োজন সম্ভবপর মানুষের অবস্থা বুঝা। আমরা দেখেছি ‘ইসলামে কোন্ কাজটি উত্তম’ এমন প্রশ্নের জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উত্তর দিয়েছেন। প্রশ্ন হল-কেন? উত্তর হল- রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রশ্নকারীর মন বা অবস্থা বুঝে উত্তর দিয়েছেন। নিম্নে আধুনিক যুগে দাওয়াতী কাজের কিছু পদ্ধতি ও কৌশল পেশ করা হল :
ব্যক্তিগত দাওয়াত
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যক্তিগত দাওয়াত দিয়ে বেশ সফলতা পেয়েছিলেন। যেমন সর্বপ্রথম দাওয়াত দিলেন খাদীজা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে, আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে, ওয়ারাকা বিন নওফেলকে দাওয়াত দিলেন এবং সে দাওয়াত তারা গ্রহণও করেছিলেন।
প্রথম দিকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইসলামের প্রথম খলীফা আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)। তিনি ইসলামের ছায়াতলে আসার পর বসে না থেকে ইসলামের বাণী মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছানোর কাজ শুরু করেন। যা ব্যক্তিগত দাওয়াতী কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। এজন্য দেখা যায় যে, আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর দাওয়াতে ‘আশারা মুবাশ্শারা তথা জান্নাতের সনদপ্রাপ্ত ১০জন ছাহাবীর অধিকাংশই ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ওছমান ইবনু আফফান, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ, ত্বালহা ইবনু ওবাইদুল্লাহ, যুবাইর ইবনুল আওয়াম, আব্দুর রহমান বিন আওফ (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)। যদিও তারা সবাই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাতে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণ করেছেন কিন্তু দাওয়াত দিয়েছেন আবুবকর।[১] সুতরাং দাওয়াতের কৌশল হিসাবে ব্যক্তিগত দাওয়াতের প্রভাব অনেক সুদূরপ্রসারী।
সামষ্টিক দাওয়াত
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আক্বাবার শপথ সহ যে দাওয়াতী কাজ করেছিলেন তা ছিল সামষ্টিক দাওয়াতের অন্তর্ভুক্ত। প্রথমে ছিলেন মাত্র ৬ জন, অতঃপর ১২ জন পরে ছিলেন ৭৫ জন। একাকী দাওয়াতী কাজ করে গেলেও যখন وَ اَنۡذِرۡ عَشِیۡرَتَکَ الۡاَقۡرَبِیۡنَ ‘আপনি নিকটতম আত্মীয়দেরকে সতর্ক করুন’ (সূরা আশ-শু‘আরা : ২১৪) আয়াত নাযিল হল, তখন তিনি প্রকাশ্যে দাওয়াত দেবেন বলে মনস্থির করলেন। মক্কাবাসীকে জমা করলেন এবং তাদের সামনে প্রকাশ্যে ঐতিহাসিক দাওয়াত দিয়ে তিনি বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قُولُوا لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ تُفْلِحُوْا
‘হে মানব সকল! তোমরা বল, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মা‘বূদ নেই, তাহলে অবশ্যই তোমরা সফলকাম হবে’।[২] আমরা জানি সংঘবদ্ধভাবে যেকোন কাজ করলে তাতে বরকত হয়। আল্লাহ তা‘আলাও সংঘবদ্ধ দাওয়াতী কাজকে পসন্দ করেন। ঐক্যবদ্ধ মানুষের উপর আল্লাহর হাত রয়েছে মর্মে ছহীহ হাদীছ রয়েছে।[৩]
পারিবারিক দাওয়াত
পারিবারিক দাওয়াত সামষ্টিক দাওয়াতেরই একটি অংশ হলেও এটি একেবারেই স্বতন্ত্র বিভাগ। মহান আল্লাহ বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لِمَ تَقُوۡلُوۡنَ مَا لَا تَفۡعَلُوۡنَ- کَبُرَ مَقۡتًا عِنۡدَ اللّٰہِ اَنۡ تَقُوۡلُوۡا مَا لَا تَفۡعَلُوۡنَ
‘হে ঈমানদানগণ! তোমরা নিজেরা যা কর না তা বল কেন? আল্লাহর নিকট বড় অপরাধ হল- নিজে যা কর না তা অন্যকে বলা’ (সূরা আছ-ছফ্ফ : ২-৩)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا قُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ وَ اَہۡلِیۡکُمۡ نَارًا وَّ قُوۡدُہَا النَّاسُ وَ الۡحِجَارَۃُ عَلَیۡہَا مَلٰٓئِکَۃٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَّا یَعۡصُوۡنَ اللّٰہَ مَاۤ اَمَرَہُمۡ وَ یَفۡعَلُوۡنَ مَا یُؤۡمَرُوۡنَ
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজে ও পরিবারকে এমন আগুন থেকে রক্ষা কর যে আগুনের জ্বালানী হবে মানুষ এবং পাথর, যে আগুনের পাহারাদার হবে নির্মম হৃদয় ও কঠিন স্বভাবের অধিকারী ফেরেশতাগণ। তারা আল্লাহর কোন আদেশের অবাধ্য হয় না। বরং তিনি তাদেরকে যে কাজ করার নির্দেশ দেন, তারা তাই করেন’ (সূরা আত-তাহরীম : ৬)।
উক্ত দুই আয়াতে একজন দাঈর উপরে দু’টি দায়িত্ব বিশেষভাবে অর্পিত হয়েছে। সুতরাং সে প্রথমে পরিবারের উন্নয়নের জন্য কাজ করবে। নিজ পিতা-মাতা, স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বোন বা অধীনস্ত কর্মীদের মাঝে দাওয়াত দেবে। এটাকে পারিবারিক দাওয়াত বলে। আর পরিবারেই যদি ইসলাম না থাকে, তাহলে দাঈ স্বতঃস্ফূর্তভাবে দাওয়াতী কাজ করতে পারে না। তাই পারিবারিক দাওয়াতের গুরুত্ব অপরিসীম।
কথা বলা
প্রচারের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হল কথা বলা বা খুৎবাহ অথবা বক্তৃতা দেয়া। আরাবী একজন শায়খ তার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি বাস্তব ঘটনা বলছিলেন, জর্ডানে সফরে গিয়ে পুরো দিন দাওয়াতী কাজ করে যখন ঘুমাতে যাব, ঠিক তখন ব্যবস্থাপকরা এসে আমাকে জানালেন ফজরের পর একটি মসজিদে আলোচনা আছে। প্রথমে অসম্ভব বলে অপারগতা প্রকাশ করলাম কিন্তু পূর্ব নির্ধারিত প্রোগ্রামসূচী থাকায় বাধ্য হয়ে যেতেই হল। সেখানে গিয়ে কোন একটি বিষয়ে কথা বলে ফিরে আসলাম। প্রায় ২ বছর পর ইরাক থেকে একটি পরিবার ফোন করে আমাকে জানাল, আপনার সেদিন ২৭ মিনিটের বক্তৃতায় আমাদের পরিবারের ৪জন শী‘আ থেকে মুসলিম হয়েছি। আমি স্মরণ করার চেষ্টা করলাম, কী বিষয়ে কথা বলেছি বা কতক্ষণ, কোথায় কথা বলেছি। অনেক পরে স্মরণ হয়েছে। বুঝলাম মন থেকে কথা বললে সেটা অনেকের হেদায়াতের কারণ হতে পারে। তাইতো রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা আমার পক্ষ থেকে প্রচার কর যদি একটি আয়াতও হয়’।[৪]
দাওয়াতী কৌশলের অন্যতম একটি হল তথ্যসহ কথা বলা। আহুত ব্যক্তি তথ্যের কারণেও অনেক সময় আকৃষ্ট হতে পারে। আজগুবি কথা বলা বা না জেনে কথা বলাও নিন্দনীয়, যা আল্লাহর কাছেও অপসন্দীয়। যেমন মহান আল্লাহ ছাহাবীদের উদ্দেশ্যে আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর ইফকের কাহিনী সম্পর্কে বলেন, اِذۡ تَلَقَّوۡنَہٗ بِاَلۡسِنَتِکُمۡ وَ تَقُوۡلُوۡنَ بِاَفۡوَاہِکُمۡ مَّا لَیۡسَ لَکُمۡ بِہٖ عِلۡمٌ ‘যখন তোমরা একে মুখে মুখে ছড়াচ্ছিলে এবং মুখে এমন বিষয় উচ্চারণ করছিলে, যার কোন জ্ঞান তোমাদের ছিল না’ (সূরা আন-নূর : ১৫)। বর্তমান সমাজে রেফারেন্স বা তথ্য ছাড়াই বেশী বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। এমন কিছু বক্তব্য উপস্থাপন করা হয় যে সম্পর্কে তার উল্লেখযোগ্য কোন জ্ঞান নেই। অথচ মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তার পিছনে পড়ো না’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৩৬)।
কাহিনী ও উপমা
মানুষকে ইসলামের কথা বলতে গিয়ে মাদ‘ঊ তথা দাওয়াত গ্রহণকারীর বুঝার স্বার্থে সত্য কাহিনী বা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। এতে সাধারণ মানুষ দাঈর কথা শুনতে আগ্রহী হবে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে স্থানভেদে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে অনেক উদাহরণ পেশ করেছেন। মহান আল্লাহ যেকোন কিছুর উদাহরণ দিতে লজ্জাবোধও করেন না, সে কথাও উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন,
یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسۡتَمِعُوۡا لَہٗ اِنَّ الَّذِیۡنَ تَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ لَنۡ یَّخۡلُقُوۡا ذُبَابًا وَّ لَوِ اجۡتَمَعُوۡا لَہٗ
‘হে লোক সকল! একটি উপমা বর্ণনা করা হল, অতএব তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন। তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর, তারা কখনও একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না যদিও তারা সকলে একত্রিত হয়’ (সূরা আল-হাজ্জ : ৭৩)। আল্লাহ নিঃসন্দেহে মশা বা তদুর্ধ্ব বস্তু দ্বারা উপমা পেশ করতে লজ্জাবোধ করেন না। বস্তুত যারা মুমিন তারা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে, তাদের পালনকর্তার উপস্থাপিত এ উপমা সম্পূর্ণ নির্ভুল ও সঠিক (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৬)। আর এসব দৃষ্টান্ত আল্লাহ মানুষের জন্য পেশ করে থাকেন। কিন্তু জ্ঞানী লোকেরা ছাড়া কেউ তা বুঝে না (সূরা আল-আনকাবুত : ৪৩; সূরা আল-হাশর : ২১)।
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও অনেক স্থানে উদাহরণ পেশ করেছেন, যা হাদীছে উল্লেখ রয়েছে। যেমন সৎসঙ্গ ও অসৎসঙ্গের উদাহরণ পেশ করেছেন একজন আতর বিক্রেতা ও কামারের সাথে। নেকীর উদাহরণ দিয়েছেন উহুদ পাহাড়ের সাথে ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর মযবুত ঈমানদার জান্নাতপাগল ছাহাবীদের দ্বীন বুঝানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপমা ও কাহিনী বলেছেন। যেমন পাহাড়ে আটকে পড়া ৩ যুবকের কাহিনী, ১০০জন মানুষকে হত্যা করার পরও সে কিভাবে ক্ষমা পেল তার কাহিনী, একজন মানুষ মদ পান করার কারণে সে সব পাপকেই তুচ্ছ করল কিভাবে সেসব কাহিনী ছাহাবীদের শুনিয়েছেন। তাই দাঈরাও যদি এ ধরণের যৌক্তিক উদাহরণ এবং শিক্ষণীয় ঘটনা সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থাপন করে তাতে তাদের দ্বীন গ্রহণ করতে আরো সহজ হয়।
খুৎবাহ বা বক্তৃতা
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, নিশ্চয় কোন কোন ভাষণ-বক্তৃতা জাদুর মত।[৫] কথা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার অন্যতম মাধ্যম হল জুমু‘আর খুৎবাহ, সাধারণ সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, জালসা-মাহফিল ইত্যাদি। সাধারণত রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কোন কিছু বলার থাকলে তা জুমু‘আর খুৎবায় বলতেন আবার মাঝে মাঝে হঠাৎ ছাহাবীদের একত্রিত করে সাধারণ বক্তৃতা দিতেন। বিদায় হজ্জের সময় হজ্জের মূল ভাষণ ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে সাধারণ বক্তৃতার মাধ্যমে ছাহাবীদের হজ্জ সহ ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান নিয়ে কথা বলেছেন। তাই জুমু‘আর খুৎবার মাধ্যমে মানুষকে আহ্বান করার একটি অন্যতম সুযোগ।
লেখনি
দাওয়াতের আরো অন্যতম মাধ্যম হল লেখনি। মাদ‘ঊ বা দাওয়াত গ্রহণকারীরা বিভিন্নজন বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তাদের স্বাদ ও চাহিদাও ভিন্ন ভিন্ন। সমাজে অনেকে আছে যারা পড়তে ভালবাসে। তাই এ সকল পাঠকের চাহিদা পূরণের জন্য লেখা উচিত। সাপ্তাহিক, মাসিক বা পাক্ষিক পত্রিকায় বিষয়ভিত্তিক লিখে তাদের কাছে পৌঁছলে ফল পাওয়া যেতে পারে। ইসলামের পরিপূর্ণ ছায়া যখন করায়ত্ব হল তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের নিকট লেখনির মাধ্যমে চিঠি-পত্রের সাহায্যে দাওয়াত প্রেরণ করেছিলেন।[৬] ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নাস্তিক বা ইসলামবিরোধী ব্যক্তির লেখনির জবাবও দেয়া যায় এই কলমের মাধ্যমে।
অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা
কুরআনে বিভিন্ন স্থানে নবী-রাসূলদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে। অর্থাৎ যাদের আহ্বান করব তাদের জন্যই দু‘আ করা। অনুরূপ একটি বিষয় তাদের অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করা। যাকাতের ৮টি খাতের একটি হল ‘অমুসলিম অথচ ইসলামের প্রতি যাদের মন আকৃষ্ট হয়েছে’। নিম্নের হাদীছটি আমাদের অনেক কিছুই শিক্ষা দেয়।
عَنْ أَنَسٍ رضى الله عنه قَالَ مَا سُئِلَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى الْإِسلَامِ شَيْئًا إِلَّا أَعْطَاهُ قَالَ فَجَاءَهُ رَجُلٌ فَأَعْطَاهُ غَنَمًا بَيْنَ جَبَلَيْنِ فَرَجَعَ إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ أَسْلِمُوْا فَإِنَّ مُحَمَّدًا يُعْطِي عَطَاءً لَا يَخْشَى الْفَاقَةَ فَقَالَ أَنَسٌ إِنْ كَانَ الرَّجُلُ لَيُسْلِمُ مَا يُرِيْدُ إِلَّا الدُّنْيَا فَمَا يُسْلِمُ حَتَّى يَكُوْنَ الْإِسْلَامُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا عَلَيْهَا
আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট ইসলাম গ্রহণ করার পর কেউ কিছু চাইলে তিনি অবশ্যই তা দিয়ে দিতেন। জনৈক লোক রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আসলে তিনি তাকে এত বেশী ছাগল দিলেন, যাতে দু’উপত্যকার মাঝামাঝি স্থান পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। এরপর সে লোক তার গোত্রের নিকট গিয়ে তাদের বলল, হে আমার জাতি! তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর। কারণ মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অভাবের আশংকা না করে দান করতেই থাকেন। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, যদিও লোকটি শুধু ইহলোকের উদ্দেশ্যেই ইসলাম গ্রহণ করেছে তবুও ইসলাম গ্রহণ করতে না করতেই ইসলাম তার কাছে পৃথিবী এবং পৃথিবীর সকল প্রাচুর্যের চাইতে অধিকতর প্রিয় হয়ে যায়।[৭]
জিহাদ
ইসলামের প্রচার ও প্রসারের মূলত ৩টি মাধ্যম ছিল। মৌখিক প্রচার, আচরণ এবং তরবারী বা জিহাদ। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর জীবনে মাত্র ১৯ থেকে সর্বোচ্চ ৩০টি জিহাদ করেছেন।[৮] আর এতে কত ছাহাবীই হবে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন? বিভিন্ন ছাহাবীর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী পড়লে জানা যায় তারা কেউই জিহাদের কারণে ইসলাম গ্রহণ করেননি; বরং বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের কারণে ইসলামের ছায়াতলে এসেছেন। অর্থাৎ দাওয়াত প্রসারের মাধ্যমগুলোর একটি হল জিহাদ। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম যদি বলা হয়, তাহলে সেটা ঠিক নয়।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
* এম.ফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র :
[১]. ইমাম বায়হাক্বী, দালাইল নবুওয়াহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৬৫।
[২]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬০২৩, সনদ ছহীহ।
[৩]. নাসাঈ, হা/৪০৩৭, সনদ ছহীহ।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৬১।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৬৭।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৫৫৩।
[৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৩১২।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৯৪৯।