মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ১২:৫৬ পূর্বাহ্ন

ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন  সংশয় নিরসন

-হাসিবুর রহমান বুখারী*


(৮ম কিস্তি)

(মার্চ’২২ সংখ্যার পর)

দাজ্জাল কোথায় অবস্থান করবে?

জনৈক বক্তা বলেছেন, ‘দাজ্জাল জেরুজালেমে অবস্থান করবে এবং সেখান থেকেই গোটা বিশ্বকে পরিচালনা করবে’। অথচ ছহীহ হাদীছের আলোচনা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। হাদীছের ভাষা অনুযায়ী দাজ্জাল ‘খুরাসান’ এবং ‘ইসফাহান’ থেকে আবির্ভূত হবে এবং তার অবতরণ হবে ‘খুজ’ এবং ‘কিরমান’ থেকে। আর এ সমস্ত অঞ্চলের সবগুলোই বর্তমানে ইরানে অবস্থিত। নির্দিষ্ট করে সে ‘কুছা’ গ্রামে অবতরণ করবে (যা পূর্বের সংখ্যায় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে)। অতঃপর ডানে-বামে দুর্যোগ সৃষ্টি করতে করতে মদীনার দিকে রওনা দেবে। মদীনার প্রত্যেকটি গেটে পাহারাদার নিযুক্ত থাকায় সে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে না। অতঃপর সে মদীনা থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে ‘জুরুফ’ নামক একটি জায়গায় আশ্রয় গ্রহণ করবে।[১] যেমন,

১. আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদিন নবী (ﷺ) আমাদের নিকট দাজ্জাল সম্পর্কে একটি দীর্ঘ হাদীছ বর্ণনা করলেন। তিনি তার সম্পর্কে আমাদেরকে যা কিছু বলেছিলেন, তাতে এও বলেছিলেন যে,

يَأْتِي الدَّجَّالُ وَهُوَ مُحَرَّمٌ عَلَيْهِ أَنْ يَدْخُلَ نِقَابَ الْمَدِيْنَةِ فَيَنْزِلُ بَعْضَ السِّبَاخِ الَّتِيْ تَلِي الْمَدِيْنَةَ.

‘দাজ্জাল আসবে কিন্তু মদীনার প্রবেশ পথে তার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ থাকবে। সুতরাং সে মদীনার নিকটবর্তী বালুকাময় একটি স্থানে অবতরণ করবে’।[২]

উপরিউক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এটি এমন একটি বালুকাময় অনুর্বর ভূমি যেখানে লবণাক্ততার কারণে কোন ফসল উৎপন্ন হয় না। আর মদীনার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোর এটিই বৈশিষ্ট্য। এ জায়গাটি মূলত মদীনা থেকে শামের দিকে অবস্থিত।[৩]

২. আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লহ (ﷺ) বলেছেন, অতঃপর হাম্মাদ ইবনু সালামাহ অবিকল বর্ণনা করেছেন। তবে এতে রয়েছে যে,

فَيَأْتِي سَبَخَةَ الْجُرُفِ فَيَضْرِبُ رِوَاقَهُ وَقَالَ فَيَخْرُجُ إِلَيْهِ كُلُّ مُنَافِقٍ وَمُنَافِقَةٍ

‘দাজ্জাল এসে ‘জুরুফ’-এর এক অনুর্বর ভূমিতে নামবে এবং এখানেই সে তার তাঁবু বা শিবির স্থাপন করবে। যার ফলে প্রত্যেক মুনাফিক্ব পুরুষ ও মহিলা তার কাছে চলে যাবে’।[৪]

উপরিউক্ত হাদীছে বর্ণিত ‘জুরুফ’ নামক জায়গা সম্পর্কে হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘জুরুফ’ হল, মদীনা থেকে মোটামুটি তিন মাইল দূরে শামের দিকে যেতে রাস্তার ধারে অবস্থিত একটি জায়গার নাম।[৫] অর্থাৎ দাজ্জাল যেখানে অবস্থান করবে বা শিবির স্থাপন করবে সে জায়গাটি মদীনা থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে অবস্থিত। অথচ মদীনা থেকে জেরুজালেমের দূরত্ব প্রায় ১.২০০ কিলোমিটার। তাহলে বক্তা কোন্ গবেষণার ভিত্তিতে বলেছেন যে, দাজ্জাল জেরুজালেম থেকে বিশ্ব পরিচালনা করবে? তবে এ কথা সত্য যে, দাজ্জাল সমগ্র বিশ্ব ভ্রমণ করবে, অবশেষে সে যখন জেরুজালেমে পৌঁছবে, তখন তাকে ঈসা (আলাইহিস সালাম) সেখানেই হত্যা করবেন।

দাজ্জাল ও জেরুজালেমের সম্পর্ক

দাজ্জাল জেরুজালেম থেকে সমগ্র বিশ্ব পরিচালনা করবে। বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং প্রযুক্তি বিদ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এটি মূলত ইয়াহুদীদের ব্লুপ্রিন্ট (ইষঁবঢ়ৎরহঃ) বা ধর্মবিশ্বাস। ইয়াহুদীরা মনে করে যে, শেষ জামানায় প্রতিক্ষিত দাজ্জাল এসে তাদেরকে মুক্ত করবে এবং সমস্ত দুঃখ-কষ্ট মোচন করে বিশ্বের শাসন ক্ষমতা তাদের হাতে তুলে দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি। যা তাদের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে প্রমাণিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ইসলামী আক্বীদার সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই।

ইয়াহুদীদের ধর্মগ্রন্থের আলোকে দাজ্জাল হল মুক্তকারী, ত্রাণকর্তা, নিষ্কৃতি দানকারী, উদ্ধারকারী ও রক্ষাকারী। সে আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী পৃথিবীর নিয়মনীতি পরিবর্তন করে নতুন নিয়ম চালু করবে। তার ভয়ে নেকড়ে বাঘ ও মেষশাবক এক সঙ্গে বসবাস করবে, চিতাবাঘ ও ছাগলছানা এক সঙ্গে পশুশালায় বিশ্রাম করবে, সিংহশাবক ও গরুর বাছুরকে এক সঙ্গে খাবার দেয়া হবে, একটি ছোট্ট বালক তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াবে, গরু এবং ভাল্লুক একত্রে চরে বেড়াবে এবং তাদের বাচ্চাগুলো একসঙ্গে পশুশালায় বিশ্রাম করবে, বলদ গরুর মত সিংহও খড় বা ঘাস খেতে শুরু করবে, দুগ্ধপায়ী শিশুরা বিষধর সাপের সঙ্গে খেলা করবে, কোলের শিশুরা ডোরা-কাটা বিষধর সাপের গর্তে হাত ঢুকাবে। সেই সময় কেউ কাউকে কষ্ট দেবে না এবং কোনরূপ বিশৃঙ্খলা করবে না। প্রতিটি উপত্যকায় শান্তি বিরাজ করবে। কেননা পৃথিবী তার প্রতিপালকের জ্ঞানে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে, যেমন বন্যার পানি সমুদ্রকে পরিপূর্ণ করে তোলে।[৬]

ইয়াহুদীদের নিকটে দাজ্জালের বৈশিষ্ট্য

মূলত কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মধ্যে ঈসা (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে যে সব ভবিষ্যদ্বাণী বর্ণিত হয়েছে, ইয়াহুদীরা সেগুলোকে দাজ্জালের জন্য প্রমাণ করতে অতিব্যস্ত। এক্ষেত্রে তারা কিন্তু খ্রিষ্টানদেরকেও ধোঁকা দিচ্ছে। তারা বলে, ‘আমরা প্রতিশ্রুত মাসীহ-এর অপেক্ষা করছি অথচ মুসলিমরা মাসীহ-এর বিরোধিতা করে। প্রকৃতপক্ষে বাস্তবতা তার এর সম্পূর্ণ বিপরীত। মুসলিম ও খ্রিষ্টান উভয়েই মসীহ অর্থাৎ ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ। পক্ষান্তরে ইয়াহুদীরা যার অপেক্ষা করছে, সে হল দাজ্জাল, ঈসা (আলাইহিস সালাম) যাকে হত্যা করবেন। কাজেই বর্তমান পরিস্থিতিতে খ্রিষ্টানদের উচিত ছিল মুসলিমদেরকে সমর্থন করা, ইয়াহুদীদের নয়। কেননা ইয়াহুদীরা তাদের পুরনো শত্রু। উল্লেখ্য, কুরআন ও ছহীহ হাদীছে শুধু ঈসা (আলাইহিস সালাম)-কেই ‘মাসীহ’ উপাধিতে সম্বোধন করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

اِذۡ قَالَتِ الۡمَلٰٓئِکَۃُ یٰمَرۡیَمُ اِنَّ اللّٰہَ یُبَشِّرُکِ بِکَلِمَۃٍ مِّنۡہُ ٭ۖ اسۡمُہُ الۡمَسِیۡحُ عِیۡسَی ابۡنُ مَرۡیَمَ وَجِیۡہًا فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ  وَ مِنَ الۡمُقَرَّبِیۡنَ.

‘স্মরণ করুন, যখন ফেরেশতাগণ বললেন, হে মারইয়াম! নিশ্চয় আল্লাহ নিজের পক্ষ থেকে আপনাকে একটি কালিমাহ (দ্বারা সৃষ্ট সন্তানের) সুসংবাদ দিচ্ছেন, যার নাম হবে মাসীহ, মারইয়াম পুত্র ঈসা। তিনি হবেন ইহকালে ও পরকালে সম্মানিত এবং সান্নিধ্যপ্রাপ্তগণের অন্যতম’ (সূরা আলে ইমরান : ৪৫)।

সুধী পাঠক! ঈসা (আলাইহিস সালাম)-কে কেন ‘মাসীহ’ উপনামে সম্বোধন করা হয়েছে এ সম্পর্কে বেশ কয়েকটি মতামত পরিলক্ষিত হয়। যেমন,

১. শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মাসীহ’-এর অর্থ হল, হাত বুলিয়ে দেয়া, মুছে দেয়া, নিরাময় করা, দূরীভূত করা ইত্যাদি। কেননা ঈসা (আলাইহিস সালাম) জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীদের উপর হাত বুলিয়ে দিলে তারা আল্লাহর নির্দেশে আরোগ্য লাভ করত। যেমন তিনি বলেন,

اَنِّیۡۤ  اَخۡلُقُ لَکُمۡ مِّنَ الطِّیۡنِ کَہَیۡـَٔۃِ الطَّیۡرِ فَاَنۡفُخُ فِیۡہِ فَیَکُوۡنُ طَیۡرًۢا بِاِذۡنِ اللّٰہِ ۚ وَ اُبۡرِیُٔ الۡاَکۡمَہَ وَ الۡاَبۡرَصَ وَ اُحۡیِ الۡمَوۡتٰی بِاِذۡنِ اللّٰہِ.

‘অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য মাটি দ্বারা একটি পাখী সদৃশ আকৃতি গঠন করব, অতঃপর আমি তাতে ফুঁ দেব, ফলে আল্লাহর অনুমতিক্রমে সেটা পাখি হয়ে যাবে। আমি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তকে নিরাময় করব এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে মৃতকে জীবন্ত করব’ (সূরা আলে ইমরান : ৪৯)।[৭]

ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক নবীকে তাঁর যুগের অবস্থা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী মু‘জিযা বা অলৌকিক বিষয়সমূহ দান করেছিলেন। যাতে তাঁর সত্যতা ও মহত্ত্ব প্রকাশিত হয়। মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর যুগে যাদু-বিদ্যার বড়ই চর্চা ছিল। তাই তাঁকে এমন মু‘জিযা দান করেছিলেন যে, তাঁর সামনে যাদুকররা নিজেদের যাদুর ভেলকি দেখাতে অক্ষম প্রমাণিত হয়েছিল এবং এ থেকে তাদের নিকট মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর সত্যতা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছিল, ফলে তারা ঈমান এনেছিল। ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর জামানায় চিকিৎসা বিদ্যার বেশ চর্চা ছিল। তাই তাঁকে মৃতকে জীবিত করার এবং জন্মান্ধ ও ধবল-কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ করে তোলার মু‘জিযা দান করেছিলেন। আর এ কাজ কোন ডাক্তারই তার ডাক্তারী বিদ্যার দ্বারা করতে সক্ষম নয়, তাতে সে যত বড়ই বিশেষজ্ঞ হোক না কেন। আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর জামানায় কবিতা, সাহিত্য এবং বাকপটুতার খুবই চর্চা ছিল। তাই তাঁকে এমন মু‘জিযাপূর্ণ কুরআন দান করলেন যা ছন্দে-মাধুর্যে এবং সাহিত্যে পরিপূর্ণ। যার নজীর পেশ করতে বিশ্বের বড় বড় সাহিত্যিক ও কাবীরা অপারগ সাব্যস্ত হয়েছে। চ্যালেঞ্জ দেয়া সত্ত্বেও আজও পর্যন্ত অপারগ সাব্যস্ত হয়েছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত অপরাগই থাকবে। ইনশাআল্লাহ’।[৮]

২. মাসীহ (مَسِيْحٌ) শব্দটি مَسَحَ ধাতু থেকে গঠিত। যার অর্থ হল, বেশি বেশি সফর করা, আরবীতে ভূপৃষ্ঠের উপর খুব বেশি ভ্রমণকারীকে مَسَحَ الأَرْضَ বলা হয়। এই বিশ্লেষণ অনেকটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা ঈসা (আলাইহিস সালাম) নবীদের মধ্যে সর্বাধিক ভ্রমণকারী’।[৯]

৩. প্রখ্যাত ভাষাবিদ ইবনু মানযূর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ইবরাহীম নাখঈ, আবুল হাইছাম ও আযহারী মনে করেন যে, ‘মাসীহ’ মানে সত্যবাদী। তাঁর সত্যবাদিতার জন্যই তাঁকে এই উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। ঈসা (আলাইহিস সালাম) আল্লাহ, মানুষ এবং নিজের ব্যাপারে সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা, সহৃদয়তা, ক্ষমাশীলতা এবং সত্যবাদিতায় সত্যবাদী ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)-এর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ ছিলেন।[১০]

৪. হাফিয আবূ নাঈম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘কোন কোন ভাষাবিদ মনে করেন যে, উৎকৃষ্ট ও উৎকর্ষ মুখম-ল বিশিষ্ট হওয়ার কারণে তাঁকে ‘মাসীহ’ উপনামে সম্বোধন করা হয়েছে। যেহেতু আরবী ভাষায় ‘মাসীহ’ মানে সুন্দর, সুদর্শন ও সুন্দর চেহারা বিশিষ্টও হয়। যেমন আরবীতে বলা হয়ে থাকে (على وجهه مسحة من جمال وحسن) তার মুখম-লে সৌন্দর্য, শোভা ও শ্রেষ্ঠত্বের ছোঁয়া রয়েছে।[১১]

৫. এটি এমন একটি উপনাম, যা আল্লাহ তা‘আলা বহু পূর্বেই তাঁর জন্য নির্ধারণ করেছেন। তাওরাতে তাঁকে মাশীহ (مشيح) নামে ডাকা হয়েছিল। একটু পরিবর্তন করে ‘মাসীহ’ করা হয়েছে।[১২] এছাড়াও আরো অনেক বিশ্লেষণ গোচরীভূত হয়। তবে এর মধ্যে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ও সামঞ্জস্যপূর্ণ মতামত হল প্রথমটি। আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।

শায়খ মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘পক্ষান্তরে ক্বিয়ামতের নিকটতম সময়ে প্রকাশ লাভকারী দাজ্জালকেও যে মাসীহ বলা হয়, এর কারণ সম্পর্কে আলেমগণ বলেছেন, ‘দাজ্জালকে মাসীহ এ জন্যই বলা হয় যে, সে مَمسوح العَين অর্থাৎ কানা হবে, তার এক চক্ষু সম্পূর্ণরূপে লেপা ও মাংস দ্বারা আবৃত থাকবে। যেমন রাসূল (ﷺ) বলেছেন,

اَلدَّجَّالُ مَمْسُوْحُ الْعَيْنِ مَكْتُوْبٌ بَيْنَ عَيْنَيْهِ كَافِرٌ ‏‏ ثُمَّ تَهَجَّاهَا ك ف ر ‏ يَقْرَؤُهُ كُلُّ مُسْلِمٍ.

‘দাজ্জালের এক চক্ষু লেপা বা প্ল্যাস্টার করা হবে। তার উভয় চোখের মধ্যস্থলে কাফির লেখা থাকবে। অতঃপর তিনি এক একটি অক্ষর পৃথক-পৃথকভাবে উচ্চারণ করে বললেন ك, ف ,ر কাফ, ফা, র। আর মুসলিম মাত্রই প্রত্যেকে এ লেখা পাঠ করতে পারবেন’।[১৩]

শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘দাজ্জালও যেহেতু সারা দুনিয়া ভ্রমণ করবে এবং মক্কা ও মদীনা ব্যতীত সব স্থানেই প্রবেশ করবে, সে জন্য তাকে মাসীহ অর্থাৎ অধিক ভ্রমণকারী বলা হয়’।[১৪]

ইয়াহুদীরা দাজ্জালকে ‘মাসীহ’ এই জন্যই বলে যে, তাদেরকে যে বিপ্লব সৃষ্টিকারী মাসীহের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে এবং যার জন্য তারা এখনো পর্যন্ত ভ্রান্তিময় অপেক্ষায় রয়েছে, দাজ্জাল এই মাসীহর নাম নিয়েই আসবে। অর্থাৎ সে নিজেকে তাদের সেই অপেক্ষিত মাসীহ বলেই প্রকাশ করবে। কিন্তু সে তার এই দাবী সহ অন্যান্য দাবীতে এত বড় প্রতারক ও ধোঁকাবাজ হবে যে, পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের মধ্যে তার কোন নজির মিলবে না। আর এই জন্য তাকে ‘দাজ্জাল’ অর্থাৎ ভীষণ মিথ্যূক ও ধোঁকাবাজ, বিভ্রান্তিকারী ও প্রতারক বলা হয়। মূলত দাজ্জাল বলতে বুঝায় ছদ্মবেশী মিথ্যাবাদীকে, যে নিরন্তর মিথ্যা বলে মানুষকে ধোঁকা দেয়।[১৫] নিম্নে দাজ্জাল সম্পর্কে ইয়াহুদীদের কিছু হাস্যকর আক্বীদাহ তুলে ধরা হল :

১. প্রভুর গোলাম : দাজ্জাল সম্পর্কে প্রভু বলবেন, ‘দেখ! এ হল আমার সেই গোলাম যাকে আমি সমর্থন করি, আমার সেই মনোনীত ব্যক্তি যার প্রতি আমার আত্মা সন্তুষ্ট, আমি তার উপর আমার রূহ বা আত্মা রেখেছি এবং সেই-ই জাতির কাছে প্রকৃত সত্য প্রকাশ করবে’।[১৬]

২. সে প্রতিপালকের জন্য রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করবে এবং তাঁর নামে একটি গৃহ নির্মাণ করবে।[১৭]  

৩. সে হবে একজন জাতীয় বীর যে ইসরাঈলদের শত্রুদের উপর বিজয়ী হবে। ‘সেই দিন ইয়াহুদীরা মুক্তি পাবে এবং জেরুজালেমে শান্তির সাথে বসবাস করবে’।[১৮] ‘সেদিন থেকে ইসরাঈলদের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং বিচার ব্যবস্থা কার্যকারী হবে। সমস্ত শত্রুদের হাত থেকে ইয়াহুদীদেরকে মুক্ত করা হবে এবং প্রভুর জন্য একটি গৃহ নির্মাণ করা হবে’।[১৯] ‘সমস্ত বাদশাহ তাকে সিজদাহ করবে এবং সমস্ত জনগণ তার সেবা-যতœ করবে’।[২০]

৪. তার রাজত্ব চিরস্থায়ী হবে। দাজ্জাল সম্পর্কে প্রভু বলেছেন, ‘এবং আমি তার রাজত্বের সিংহাসনকে চিরকালের জন্য অবিনশ্বর করে দিয়েছি’।[২১]

৫. অলৌকিক ও বিস্ময়কর ক্ষমতার অধিকারী : ‘এবং তার উপর প্রভুর আত্মা অবতরণ করবে, প্রজ্ঞা ও বোধের আত্মা, পরামর্শ এবং শক্তির আত্মা, জ্ঞান ও আল্লাহভীতির আত্মা’।[২২]

৬. নৈতিক বিচারমূলক কাজের অনুশীলন করবে : ‘সে দুর্বলদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে এবং ভূমিহীনদের জন্য চিরস্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করবে’।[২৩]

৭. সে অ-ইয়াহুদীদের জন্য একটি উজ্জ্বল জ্যোতির ন্যায় : প্রভু বলেছেন, ‘আমি তোমাকে সততার দিকে আহ্বান করেছি এবং আমি তোমার হাত ধরে তোমাকে গঠন করেছি এবং তোমাকে মানব জাতির জন্য একটি চুক্তি ও পথপ্রদর্শক বানিয়েছি, যাতে তুমি অন্ধদের চক্ষু খুলে দিতে পারো এবং বন্দীদেরকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে পারো এবং যারা অন্ধকার কারাগারে বসে আছে তাদের উন্মুক্ত করতে পারো’।[২৪]

৮. তার সাফল্য আধ্যাত্মিক এবং অহিংস কার্যকলাপের ফল হবে : সে দুর্বলদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে, ভূমিহীনদের জন্য চিরস্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করবে, সে তার মুখের দ- দ্বারা ভূপৃষ্ঠকে আঘাত করবে এবং সে তার ওষ্ঠ দ্বারা দুষ্টদের হত্যা করবে’।[২৫]

৯. একজন লাঞ্ছিত ব্যক্তিত্ব যে তার কাঁধে সমাজের বোঝা বহন করবে : ‘সে আমাদের দুঃখ-কষ্ট, বেদনা ও যন্ত্রণা বহন করবে। তাকে পীড়িত করার জন্য এবং ঈশ্বরের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত এবং অপমানিত করার জন্য আমরাই যথেষ্ট। আমাদের পাপের কারণে তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে এবং আমাদের গুনাহের কারণে তাকে পরাভূত করা হয়েছে। আমাদের শান্তির জন্য তার উপর শাস্তি নেমে এসেছে এবং তার ক্ষত দ্বারা আমরা আরোগ্য লাভ করেছি’।[২৬]

১০. সে দাঊদ (আলাইহিস সালাম)-এর বংশোদ্ভূত হবে : ‘এবং জেসির শাখা থেকে একটি উপশাখা বাহির হবে এবং তার মূল থেকে একটি শাখা গজাবে’।[২৭]

পক্ষান্তরে দাজ্জাল সম্পর্কে ইয়াহুদীদের আক্বীদার সঙ্গে খ্রিষ্টানদের আক্বীদা পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।[২৮]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* মুর্শিদাবাদ, ভারত।

[১]. বুলদানুল খিলাফাতিশ শারক্বিয়্যাহ, পৃ. ৯৪-৯৫; মু‘জামুল বুলদান, ১ম খ-, পৃ. ২৩৩; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১২৯১৬৪।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৮২, ৭১৩২; ছহীহ মুসলিম হা/২৯৩৮।
[৩]. ফাৎহুল বারী, ১৩তম খ-, পৃ. ১০২।
[৪]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৪৩।
[৫]. ফাৎহুল বারী, ১৩তম খ-, পৃ. ৯৩।
[৬]. সাফারু আশ‘ইয়া, ১১তম খ-, পৃ. ৮-৯।
[৭]. লিসানুল আরব, ২য় খ-, পৃ. ৫৯৪-৫৯৮; ইবনু বায অফিসিয়াল ওয়েবসাইট : যঃঃঢ়ং://নরহনধু.ড়ৎম.ংধ/ভধঃধিং/১৩১১৩/%উ৮%.
[৮]. তাফসীর ইবনু কাছীর, ৩য় খ-, পৃ. ৪৯।
[৯]. লিসানুল আরব, ২য় খ-, পৃ. ৫৯৪-৫৯৮।
[১০]. লিসানুল আরব, ২য় খ-, পৃ. ৫৯৪-৫৯৮।
[১১]. লিসানুল আরব, ২য় খ-, পৃ. ৫৯৪-৫৯৮।
[১২]. লিসানুল আরব, ২য় খ-, পৃ. ৫৯৪-৫৯৮।
[১৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৩৩, ২৯৩৪; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৮৮০৬।
[১৪]. ইবনে বায অফিসিয়াল ওয়েবসাইট : যঃঃঢ়ং://নরহনধু.ড়ৎম. ংধ/ভধঃধিং/১৩১১৩/%উ৮%; লিসানুল আরাব, ২য় খ-, পৃ. ৫৯৪-৫৯৮।
[১৫]. তাফরীরে কুরতুবী ও ফাৎহুল ক্বাদীর, ০৩:৪৯।
[১৬]. আশ‘ইয়া, ১ম খ-, পৃ. ২৪।
[১৭]. ছামুয়ীলুছ ছানী, ৭ম খ-, পৃ. ১৩।
[১৮]. ইরমিয়া, ১৬তম খ-, পৃ. ৩৩।
[১৯]. ছামুয়ীলুছ ছানী, ৭ম খ-, পৃ. ১১।
[২০]. আল-মাযামীর, ১১তম খ-,. পৃ. ৭২ ।
[২১]. ছামুয়ীলুছ ছানী, ৭ম খ-, পৃ. ১৩।
[২২]. আশ‘ইয়া, ২য় খ-, পৃ. ১১।
[২৩]. আশ‘ইয়া, ৪র্থ খ-, পৃ. ১১।
[২৪]. আশ‘ইয়া, ৪২/৬-৭ পৃ.।
[২৫]. আশ‘ইয়া, ৪র্থ খ-, পৃ. ১১।
[২৬]. আশ‘ইয়া, ৫৩/৪-৫ পৃ.।
[২৭]. আশ‘ইয়া, ১ম খ-, পৃ. ১১।
[২৮]. লুক্বা, ৪/১৮-২১ পৃ.; মাতা, ৩/২, ১১/৫ ও ২৫/৩১-৩২।




প্রসঙ্গসমূহ »: বিবিধ
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (৯ম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
পরবর্তীদের তুলনায় সালাফদের ইলমী শ্রেষ্ঠত্ব (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : আযহার বিন আব্দুল মান্নান
তাক্বওয়াই মুক্তির সোপান (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - আব্দুর রশীদ
সর্বশ্রেষ্ঠ আমল - হাফেয আবূ তাহের বিন মজিবুর রহমান
স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের আলোকে ছিয়াম সাধনা - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১৮তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (ত্রয়োদশ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ভ্রান্ত ফের্কাসমূহের ঈমান বনাম আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ঈমান : একটি পর্যালোচনা - ড. আব্দুল্লাহিল কাফী বিন লুৎফর রহমান মাদানী
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৩য় কিস্তি) - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
বিদ‘আত পরিচিতি (৭ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (৩য় কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন

ফেসবুক পেজ