সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১১:১৬ অপরাহ্ন

জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলাম শিক্ষার আবশ্যকতা

-ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*



[সারসংক্ষেপ : শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। যে জাতি যতবেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। শিক্ষার মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা একটি আদর্শিক শিক্ষা। আবহমান কাল থেকে মানব জাতির ইতিহাসে ধর্মই সভ্যতার প্রধান জীবনী শক্তিরূপে কাজ করে আসছে। ধর্ম বিশ্বাসই মানুষকে সততা ও পুণ্যের পথে পরিচালিত করেছে। আল্লাহর উপর ভক্তি মানুষের অহমিকা ও দাম্ভিকতাকে খর্ব করে তাকে সংযমী ও বিনয়ী করে তোলে। যে কৌতুহল, বিস্ময়বোধ, অজানাকে জানার আগ্রহ মানুষকে উদ্দীপিত করেছে এবং সকল প্রকার বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মূলে কাজ করেছে তা হলো ধর্ম। মানুষের দেহ, মন ও আত্মার পূর্ণাঙ্গ ও সুষম উন্নয়নই শিক্ষার উদ্দেশ্য। মৌলিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ মানব সভ্যতার ভিত্তি। শিক্ষার মধ্য দিয়েই তার বিকাশ হওয়া প্রয়োজন এবং এ দিকেই মানুষের সকল কর্মপ্রচেষ্টা নিবদ্ধ থাকা উচিত। বর্তমান প্রজন্ম যে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে এটি হয়তোবা বাস্তবসম্মত কিন্তু এটি কতটুকু ধর্মীয় শিক্ষার পরিচয় বহন করে তা স্বভাবতই সকলের জিজ্ঞাস্য।

জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলাম শিক্ষা যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়ায় এবং এর প্রতি গুরুত্ব না থাকায় ক্রমশঃই এদেশের মানুষ নীতি-নৈতিকতা ও মানসিক মূল্যবোধ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অপরাধ প্রবণতাকে তুচ্ছজ্ঞান করছে। দুর্নীতি, অবৈধ উপার্জন, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার, পরকীয়া, যেনা-ব্যভিচার, প্রতারণা প্রভৃতিতে মানুষ আকণ্ঠ নিমজ্জিত হচ্ছে। যা সর্বত্র মহামারীর রূপ ধারণ করেছে। মূলত আদর্শিক শিক্ষার অভাবই এজন্য দায়ী। জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে প্রত্যেক স্তরে ইসলাম শিক্ষা পূর্ণাঙ্গরূপে কার্যকর হলে ইসলামের মৌলিক ও মানবিক মূল্যবোধ এবং নীতি-নৈতিকতা সম্বন্ধে মানুষের সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি হবে। নীতিভ্রষ্ট ও নীতিহ্রাস থেকে জাতি মুক্তি পাবে। কেননা মানবতার সকল সমস্যা নিরসনে ইসলাম শিক্ষা ঐতিহাসিক ও বাস্তবসম্মতভাবে স্বীকৃত। অতএব বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলাম শিক্ষার আবশ্যকতা ও রূপরেখা যথাযথভাবে আলোচিত হলে ভবিষ্যত প্রজন্ম সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠবে। যা সকলেরই কাম্য]                 

ভূমিকা

শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। মানুষ জন্মের পর থেকে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যা শেখে তাই শিক্ষা। সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে। তবে শিক্ষা হল সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যহত অনুশীলন। দেশবাসীকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সচেতন করে তোলা শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এছাড়া শিক্ষা ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে নৈতিক, মানবিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাকল্পে শিক্ষার্থীদের মেধা-মননে, কর্মে ও ব্যবহারিক জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করার এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমও বটে। অথচ বাংলাদেশের শিক্ষা কার্যক্রমে ইসলামী শিক্ষা পূর্ণভাবে কার্যকর হলে মানুষেরা ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধ সম্বন্ধে জানতে পারব। যেটি জানা মুসলিম হিসাবে প্রত্যেকের জন্য অপরিহার্য। কেননা ইসলামী শিক্ষাই একমাত্র সকল সমস্যা নিরসন করতে পারে।

বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা তিনটি স্তরে বিভক্ত। ক. সাধারণ শিক্ষা খ. মাদরাসা শিক্ষা ও গ. কাওমী শিক্ষা। প্রত্যেকটি স্তর আবার কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত। শিক্ষার সুষ্ঠু বিকাশ ও সুষম পাঠদানের জন্য উক্ত শ্রেণী বিন্যাসের যৌক্তিকতা রয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত দেশীয় ও পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা ও পদ্ধতির সম্মিলিত ফল। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার ধাপসমূহের প্রথম ধাপ হল প্রাথমিক শিক্ষা। এটি প্রত্যেক শিশুর মৌলিক অধিকার। তাই দেশের সকল মানুষকে ন্যূনতম মৌলিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার অন্যতম উপায় হচ্ছে সকলকে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা। এই প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা একটি শিশুর উচ্চতর স্তরের ভিত্তি স্বরূপ এবং তাকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলে। তাই দেশে ১৯৮০ সালে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা এবং ১৯৯৩ সালে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করা হয়। এ স্তরের শিক্ষাকে সহজলভ্য করার জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, শিক্ষার জন্য খাদ্য এবং উপ-বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে।[১] বর্তমানে বাংলাদেশে মাধ্যমিক শিক্ষা হিসাবে যে স্তরটিকে চিহ্নিত করা হয় তার সূচনা ঘটে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে।[২]

এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সেকেন্ডারী এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট ও হায়ার সেকেন্ডারী এডুকেশন প্রজেক্টের সহায়তায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এ শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও নবায়নের কাজ সম্পন্ন করে।[৩] অন্যদিকে ১৯৭৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের জন্য একটি ব্যাপকভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করে। আল-কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সূচনা ঘটে উপমহাদেশে মুসলিম শাসনামলে। বাংলাদেশে মূলত দুই প্রকার মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে। (ক) আলিয়া ও (খ) কাওমী। ১৯৭৫ সাল থেকে বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষাধারার আধুনিকায়ন কর্মসূচী শুরু হয়। ১৯৮৫ সাল থেকে আলিয়া মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঁচ বছর মেয়াদী ইবতেদায়ী স্তর এবং পাঁচ বছর মেয়াদী দাখিল স্তর চালু করা হয়। দাখিল অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত একই শিক্ষা এবং নবম ও দশম শ্রেণীতে সাধারণ, বিজ্ঞান, মুজাব্বিদ ও হিফযুল কুরআন নামে চারটি শাখা প্রবর্তণ করা হয়। এছাড়া রয়েছে ফাজিল ও কামিল স্তরে  উচ্চ শিক্ষা অর্জনের ব্যবস্থা করা হয়। যেখানে ফাজিল স্তরে সাধরণ ও মুজাব্বিদ বিভাগে চালু করা হয় এবং কামিল স্তরে হাদীছ, ফিকহ, তাফসীর, আদব ও মুজাব্বিদ বিভাগ পাঠদান করার ব্যবস্থা করা হয়।[৪]

আর কাওমী শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামী শিক্ষা অর্জনের বিস্তৃত পরিমণ্ডল রয়েছে। সেখানে মূলত ইসলাম শিক্ষা প্রদান করা হয়। সেখানে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করা হয় না। কাওমী মাদরাসা থেকে বের হওয়া কোন ছাত্র দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতে পারে না এবং কোন সরকারী চাকুরীতে যুক্ত হতে পারে না।[৫] এজন্য কিন্তু তাদের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পশ্চাৎমুখিতা, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবের কারণে কাওমী শিক্ষা ব্যবস্থায় আধুনিকতার ছুঁয়া লাগেনি। কতিপয় ধনাঢ্যশীল ব্যক্তিদের দান, ছাদাক্বাহ, যাকাত, ফেতরা, উশর ইত্যাদির মাধ্যমেই মূলত কাওমী শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো বিদ্যমান।[৬] বর্তমানে বাংলাদেশের ঢাকা কেন্দ্রিক কাওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বিফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া কাওমী মাদরাসাসমূহের সিলেবাসের সাথে প্রাইমারী স্তরের একটি পূর্ণাঙ্গ পাঠ্যক্রম ও সিলেবাস সংযোজন করেছে। যার মধ্যে আরবী, বাংলা, ইংরেজী, গণিতসহ মৌলিক ও প্রয়োজনীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু কাওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধিভুক্ত অধিকাংশ মাদরাসাতেই উক্ত শিক্ষাক্রম ও সিলেবাস অনুসরণ করা হয় না। অধিকাংশ কাওমী মাদরাসাতেই প্রাইমারী স্তরে নিজেদের ইচ্ছা ও সুবিধা অনুযায়ী কোর্স করা হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও কিছু আধুনিক বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে। যাতে করে বর্তমান যুগের চাহিদা পূরণ করতে পারে।[৭]

জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলাম শিক্ষার গুরুত্ব

পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচীতে ইসলাম শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত ইসলামী শিক্ষা বলতে বুঝায়- যে শিক্ষার প্রতিটি বিভাগই কুরআন ও হাদীছভিত্তিক, অর্থাৎ যার কোন একটি দিকও ইসলামী আক্বীদাবিরোধী নয় এমন শিক্ষার নামই হল ইসলামী শিক্ষা।[৮] ইসলামের জ্ঞান লাভ করা একজন মানুষের মুসলিম হওয়ার জন্য সর্বপ্রথম শর্ত।[৯] হাদীছে আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘দ্বীনী ইলম শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয’।[১০] অনেকেই মনে করে থাকেন যে, ইসলামী জ্ঞান অর্জন করা মানেই হল বিজ্ঞান শিক্ষা না করা, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা না করা।[১১] আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, কুরআন-হাদীছ পড়াই হচ্ছে ইসলামী শিক্ষা। এর বাইরে আর সব শিক্ষাই ইসলাম বিরোধী শিক্ষা।[১২] উক্ত ধারণা সম্পূর্ণই অজ্ঞাত প্রসূত এবং কুরআন-হাদীছ না জানার ফল।[১৩] কারণ আল-কুরআনই বিজ্ঞান চর্চার জন্য নিরন্তর নির্দেশ প্রদান করে। শুধু তাই নয়, যারা সৃষ্টি সম্পর্কে গবেষণা করে কুরআনে তাদেরকেই জ্ঞানী সম্প্রদায় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।[১৪] তাছাড়া জ্ঞানী সম্প্রদায়ই আল্লাহকে বেশি চিনতে পারে এবং তারাই তাঁকে সর্বাধিক বেশী ভয় করে।[১৫]

ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হল- মানুষের মাঝে এক আল্লাহ্র গোলামী করার প্রবণতা সৃষ্টি করা, আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও পরকালের মুক্তিলাভের প্রেরণা সৃষ্টি করা, আল্লাহ প্রদত্ত সত্যের সাক্ষ্য হিসাবে নিজেদেরকে পেশ করার যোগ্যতা অর্জন করা এবং খেলাফত পরিচালনা ও মানবতার সেবা করার দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করা। ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক ধারণা প্রদান করে আল্লাহ বলেন, ‘এটি হচ্ছে গোটা সৃষ্টি জগতের জন্য উপদেশ’।[১৬]

ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার কোন স্তর ইসলামর দিক-নির্দেশনা বহির্ভূত নয়। ইসলামের সঙ্গে সংস্কৃতি (Culture), মনোবিদ্যা (Psychology), নৃতত্ত্ব (Anthropology), প্রত্নতত্ত্ব বিজ্ঞান (Archeology), দর্শন (Philosophy), ইতিহাস (History), ভূগোল (Geography), সমাজবিজ্ঞান (Sociology) সহ পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান শাখার সুদৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে।[১৭] সংস্কৃতি হল সেই সমষ্টি, যা সমাজের সদস্য হিসাবে মানুষের অর্জিত জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নৈতিকতা, আইন, রীতিনীতি এবং অন্য যে কোন দক্ষতা ও অভ্যাসের জটিল সমষ্টির বিদ্যা।[১৮] মনোবিজ্ঞান হল মানব মনস্তত্ত্বের বিদ্যা।[১৯] দর্শন হল বস্তু ও ভাববাদী তত্ত্বের বিদ্যা। বস্তুর ব্যাপারেও ইসলামের স্পষ্ট নির্দেশ আছে। মন বা আত্মার মাধ্যমেই তো মানুষ মূলত জ্ঞান চর্চা, উন্নতি অথবা স্রষ্টাকে চেনার সাধনা করে থাকে; সে জন্য মনোবিদ্যা ও দর্শন- দু’টি বিষয় ইসলামের খুবই সম্পর্কিত।[২০]

আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে সমগ্র মানবজাতিকে একই গোত্রভুক্ত করতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা করেননি। বিভিন্ন দেশ, ভাষা, সংষ্কৃতি,ভূগোলের মধ্যে তিনি মানুষকে ছড়িয়ে দিয়েছেন’।[২১] এটি নৃতত্ত্ব, পরিবেশবিদ্যা, ভূগোল বিষয়ের অন্তর্গত।[২২] আল-কুরআনে বলা হয়েছে, ‘অবিশ্বাসীরা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে’[২৩], ‘অবিশ্বাসীদের পরিণতি কি হয়েছিল’, সভ্যতার ধ্বংসযজ্ঞ দেখে তারা অনুধাবন করে না’? এ সমস্ত প্রশ্নের জবাবের মধ্যে ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব ও সভ্যতার জ্ঞান বিশেষভাবে নির্দিষ্ট রয়েছে।[২৪] আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আল্লাহ মানুষকে মাটি দিয়ে তৈরি করেছেন’[২৫], ‘মহাশূন্যে সব কিছুই ঘুর্ণায়মান’[২৬], মানুষকে আল্লাহ পুঞ্জিভূত রক্তপিণ্ড[২৭] হতে সৃষ্টি করেছেন। এ বিষয়গুলো জীববিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ও জেনেটিক সাইন্সের অন্তর্গত।[২৮]

মহাজ্ঞানী আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু সমস্ত জ্ঞানের স্রষ্টা; তাই বিশ্বজ্ঞানের সকল বিষয়কেই আল্লাহ মানুষের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন। আল্লাহ যেহেতু সমস্ত জ্ঞানে জ্ঞানী, সেই জন্য ইসলামী জ্ঞানতত্ত্ব সমস্ত জ্ঞানের নিয়ন্ত্রণকারী। সততা ও আল্লাহ্র উপর পূর্ণ বিশ্বাস থেকে মানব কল্যাণের জন্য নবী করীম (ﷺ) নির্দেশিত পথে মানুষ সমগ্র জ্ঞানের সুস্থ ও নৈতিকচর্চা করে যাবে-এটিই মানুষের নিকট মহান আল্লাহ নির্দেশ।[২৯] অতএব বাংলাদেশের পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচীতে আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি আরবী ও ইসলাম শিক্ষাকে এমনভাবে সন্নিবেশিত করতে হবে, যেন একজন ছাত্র জ্ঞানের ব্যাপক পরিপেক্ষিত লাভ করতে পারে এবং বিশিষ্টকরণের স্তরে প্রবেশ করার আগে জীবন ও সমস্যাবলীর প্রতি সুসংহত সৃষ্টিকোণ অর্জন করতে পারে।[৩০] তাছাড়া ইসলাম জ্ঞানকে সমন্বিত ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত সামগ্রিকতা বলেই বিবেচনা করে। কারণ আল-কুরআনই হচ্ছে সব জ্ঞানের প্রধান উৎস। এ গ্রন্থটিই যে কোন বিভাগীয় জ্ঞানান্বেষণকারীর মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ন্ত্রণ করছে। এ বাস্তবতা আমাদেরকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বিত জ্ঞানের ধারণার দিকে পরিচালিত করছে। জ্ঞান ক্ষুদ্র ও অসংলগ্ন ক্ষুদ্্রাংশে বিভক্ত থাকবে না। কিন্তু তা হবে সমন্বিত। একটি মাত্র এককে সম্পৃক্ত। এভাবেই বিলুপ্ত হবে জ্ঞানকে ক্ষুদ্রাংশে বিভাক্ত করা এবং বিভাগীয়রূপে ভাগ করে নেয়ার পদ্ধতি। হয়তো এটাই হবে উচ্চতর পর্যায়ে বিশিষ্টকরণ সূচীত করার পথে শামিল। এছাড়া নিম্নস্তরসমূহে শিক্ষা সমন্বিত থাকা উচিত। এ পদ্ধতির শিক্ষাই শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গীর সম্প্রসারণ হবে এবং তাদের মাঝে বুদ্ধিবৃত্তিক সহনশীলতার গুণ উদ্ভাসিত হবে।[৩১]

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায় যে, জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলাম শিক্ষার গুরুত্ব বর্ণনাতীত। ফলে একজন শিক্ষার্থী জ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বদর্পে বিচরণ করতে সক্ষম হবে। গড়ে উঠবে দেশের আনুগত্যশীল সুনাগরিক হিসাবে। উন্মোচিত হচ্ছে সত্য, ন্যায় আর ইসলামী আদর্শের দিগি¦জয়ী আহ্বান।

মুসলিম সমাজে ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষানীতির বিরূপ প্রভাব

ব্রিটিশরা মুসলিমেরদের তাদের মানসপুত্রে পরণত করার জন্য শিক্ষানীতিকে বেছে নিয়েছিল। মুসলিমদেরকে যদি কুরআন ও হাদীস থেকে বিমুখ করা যায়, তাহলে তাদের উপর সহজেই প্রভুত্ব কায়েম করা সম্ভব হবে। এজন্য তারা যেসকল পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল সংক্ষিপ্তাকারে তার স্বরূপ ছিল নিম্নরূপ:

  • ইসলামী আইন-কানুন ও ইসলামী আদর্শকে কুৎসিৎ থেকে কুৎসিতরূপে সমাজের সম্মুখে তুলে ধরা, যেন  মুসলিমদের মনে ইসলাম সম্পর্কে যে পবিত্র ধারণা ছিল তা নষ্ট হয় এবং ইসলামের প্রতি যেন প্রত্যেকেরই একটা ঘৃণাভাব সৃষ্টি হয়।
  • ইসলামকে একটা আনুষ্ঠানিক ধর্ম হিসেবে প্রচার করা।
  • আল-কুরআন শুধু বানান করে পড়লেই অনেক সওয়াব হবে, তা অর্থ বুঝে পড়ার দরকার নেই- এ কথা বুঝানো। আমরা প্রত্যেকেই বুঝি যে, পড়ার অর্থ হলো বুঝে পড়া । কিন্তু একমাত্র আল-কুরআন যা বুঝে পড়ার বেলাতেই আমাদের ভুল ধারণা যে, তা বুঝে পড়ার পরিবর্তে শুধু বানান করে পড়লেই কুরআন তিলাওয়াতের হক আদায় হয়ে যায়।
  • তারা মুসলিম ছাত্রদের আরো শিখায় যে, (ক) ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থাই উত্তম, (খ) তাদের অর্থব্যবস্থাই উন্নততর, (গ) তাদের সমাজব্যবস্থাই আদর্শস্থানীয়, (ঘ) তাদের গণতন্ত্রই যুক্তিগ্রাহ্য ও গ্রহণযােগ্য এবং (ঙ) ফরাসী বিপ্লবই মানবাধিকারের প্রতি প্রথম স্বীকৃতি দেয়।[৩২]

অথচ এই প্রত্যেকটি পাশ্চাত্যরীতিই ঘৃণিত যেমন তাদের সমাজব্যবস্থায় মূলত পারিবারিক অশান্তির বীজ রোপিত যেখানে সমাজ ভাঙ্গার করুণসুর রণিত। তাদের অর্থব্যবস্থা যার ভিত্তি মূলত সুদের উপর প্রতিষ্ঠিত, যা দরিদ্রকে আরো দরিদ্র ও ধনীকে আরো ধনী করে সমাজে সম্পদের। অসমবণ্টন নিশ্চিত করে। পাশ্চাত্যের সমাজব্যবস্থা মূলত: অশ্লীলতার স্রোতে ভাসমান। তাদের গণতন্ত্র সমাজে আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির প্রসার করে।[৩৩]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)


* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আল-ইসলামিয়্যাহ, খড়খড়ি, রাজশাহী।

তথ্যসূত্র :
[১]. আব্দুল মালেক, মরিয়ম বেগম, ফখরুল ইসলাম, শেখ শাহবাজ রিয়াদ, শিক্ষাবিজ্ঞান ও বাংলাদেশে শিক্ষা (ঢাকা : বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, ১ম প্রকাশ ২০০৭), পৃ. ১৭৯-১৮০।
[২]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯০।
[৩]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৩।
[৪]. প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৭।
[৫]. Muhammad Boni Amin, Madrasah Education in Bangladesh (IFD Note Series, November 2013), P. 3-4.
[৬]. Sanchita Bhattacharya, The Perspective of Madrasa Education in Bangladesh, P. 227.
[৭]. ড. মুহাম্মদ শফিকুল্লাহ ও শেখ মোঃ তৈয়বুর রহমান, বাংলাদেশে কাওমী মাদ্রাসা : একটি সমীক্ষা (গবেষণা প্রকল্প, কলা অনুষদ, ফেব্রুয়ারি, ২০১৫), পৃ. ৭৫।
[৮]. খন্দকার আবুল খায়ের, ইসলামী জীবন দর্শন, প্রকাশ : নভেম্বর ২০০৯, ঢাকা, পৃ. ১৮।
[৯]. ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম ভূঁইয়া, “ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে কাক্সিক্ষত শিক্ষানীতি”, সেমিনার প্রবন্ধ সংকলন ২০২২ (ঢাকা : বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, জানুয়ারী ২০১৩), পৃ. ৯৮।
[১০]. طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ-দ্র. : মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ আল-খত্বীব আত-ত্বিবরীজী, মিশকাতুল মাসাবীহ, তাহক্বীক্ব : মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, ১ম খণ্ড (বৈরূত : মাকতাবুল ইসলামী, ৩য় সংস্করণ, ১৪০৫ হি./১৯৮৫ খ্রি.), পৃ. ৪৭, হাদীস নং-২১৮।
[১১]. সেমিনার প্রবন্ধ সংকলন ২০২২, পৃ. ৯৮।
[১২]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৮।
[১৩]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৯।
[১৪]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৯।
[১৫]. إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ -দ্র. : সূরা আল-ফাতির : ২৮; মুহাম্মাদ আবুল হুসাইন, ছাত্রজীবনে ইসলামী দাবী (ঢাকা, প্রকাশ মে ২০১১), পৃ. ৬৭-৬৮; সেমিনার প্রবন্ধ সংকলন ২০২২, পৃ. ৯৯।
[১৬]. إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ لِلْعَالَمِينَ-দ্র. : সূরাহ আত-তাকভীর : ২৭।
[১৭]. সেমিনার প্রবন্ধ সংকলন ২০২২, পৃ. ১০১।
[১৮]. E.B. Tylor বলেন, Culture is that complex whole which includes knowledge, belief, art, oral, law, custom and an other capabilities and habits acquired by man as a member of society- দ্র. : এ.এইচ.এম. মোস্তাফিজুর রহমান ও মোঃ ইকবাল হুসাইন, সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি (ঢাকা : লেখাপড়া প্রকাশনী, ২য় সংস্করণ, মে ২০১১), পৃ. ১১৩-১১৪।
[১৯]. সেমিনার প্রবন্ধ সংকলন ২০২২, পৃ. ১০১।
[২০]. প্রাগুক্ত।
[২১]. يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ-দ্র. : সূরাহ আল-হুজুরাত : ১৩।
[২২]. সেমিনার প্রবন্ধ সংকলন ২০২২, পৃ. ১০১।
[২৩]. সূরাহ আলি ইমরান : ১৩৭।
[২৪]. সেমিনার প্রবন্ধ সংকলন ২০২২, পৃ. ১০২।
[২৫]. ইমাম আবুল হুসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল-কুশাইরী আন-নায়সাপুরী, সহীহ মুসলিম, ৪র্থ খণ্ড ( বৈরূত : দারু ইহইয়াইত তুরাছিল ‘আরাবী, তা.বি.), পৃ. ২২৯৪, হাদীস নং-২২৯৪; মিশকাতুল মাসাবীহ, ৩য় খণ্ড. পৃ. ২৩৯, হা/৫৭০১।
[২৬]. সূরাহ ইয়াসিন : ৪০।
[২৭]. সূরাহ আল-আলাক্ব : ২০।
[২৮]. সেমিনার প্রবন্ধ সংকলন ২০২২, পৃ. ১০২।
[২৯]. ডক্টর রহমান হাবিব, ইসলাম ও জ্ঞানতত্ত্ব (ঢাকা : প্রকাশক বিহীন, ২০১১), পৃ. ১৩-১৪; সেমিনার প্রবন্ধ সংকলন ২০২২, পৃ. ১০১।
[৩০]. সেমিনার প্রবন্ধ সংকলন ২০২২, পৃ. ১০৮।
[৩১]. অধ্যাপক খুরশীদ আহমদ, অনুবাদ : অধ্যাপক এ. কে. এম. নাজির আহমদ, ইসলামী শিক্ষার মূলনীতি (ঢাকা : মার্চ ২০০৮), পৃ. ১৬-১৭; সেমিনার প্রবন্ধ সংকলন ২০২২, পৃ. ১০৮।
[৩২]. ইসলামী জীবন দর্শন, পৃ. ১৮-১৯।
[৩৩]. সেমিনার প্রবন্ধ সংকলন ২০২২, পৃ. ৮৪-৮৫।




প্রসঙ্গসমূহ »: শিক্ষা-সংস্কৃতি
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও তার সমাধান (৩য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
কুরবানীর মাসায়েল - ইবাদুল্লাহ বিন আব্বাস
জীবন ব্যবস্থা হিসাবে আল-কুরআনের মূল্যায়ন - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মসজিদ: ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইসলামে দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
সুন্নাতের রূপরেখা (৩য় কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ঈদে মীলাদুন্নবী : একটি পর্যালোচনা - আল-ইখলাছ ডেস্ক
আল-কুরআনের আলোকে দাওয়াতের মাধ্যম - আব্দুল গাফফার মাদানী

ফেসবুক পেজ