বুধবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৫, ১০:৩৯ পূর্বাহ্ন
সূদের ইহকালীন ও পরকালীন ক্ষতিসমূহ
- মাসঊদুর রহমান*


ভূমিকা

সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য। যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করার পাশাপাশি উত্তম রিযিক দান করেছেন, শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর ওপর। যিনি জীবিকা নির্বাহের সকল উপায়-উপকরণ শিক্ষা দিয়েছেন। উপার্জনের ক্ষেত্রে নিকৃষ্ট অবলম্বন হল হারাম উপার্জন, যার অন্যতম মাধ্যম হল ‘সূদ’। এটা এমন জঘন্য বিষয় যে, পৃথিবীর ইতিহাসে সকল যুগে সকল ধর্মেই এটা নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি পৃথিবীর সকল দেশের সভ্যসমাজ এটাকে নিকৃষ্ট-খারাপ ও  অপরাধ বলে আখ্যায়িত করে। এটা একটি সামাজিক ব্যাধি; যার মাধ্যমে বৃত্তশীলরা দরিদ্রদের অর্থ চুষে খায়। ফলশ্রুতিতে ধনীরা হয় আরো বিত্তশালী, নিম্ন শ্রেণীর মানুষেরা হয় পথের ভিখারী। তৈরি হয় সামাজিক বিশৃঙ্খলা মারামারি-হানাহানি, নষ্ট হয় ভাতৃত্ববোধ ও সামাজিক ঐক্য। নিম্নে সূদের ইহকালীন ও পরকালীন ক্ষতিকর দিকসমূহ তুলে ধরা হল:

‘সূদ’-এর পরিচয়

‘সূদ’-এর আরবী শব্দ ‘রিবা’ ( الربا), যার অর্থ  বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি, আধিক্য, অতিরিক্ত ইত্যাদি। পরিভাষায় এমন অতিরিক্ত অর্থ বা পন্য গ্রহণ, যার বিপরীতে কোন বিনিময় থাকে না; তাকে রিবা বা সূদ বলে। প্রচলিত অর্থে সূদ হচ্ছে, নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধার/ঋণ দিয়ে চুক্তির শর্ত মোতাবেক আসলের ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ অতিরিক্ত গ্রহণ করা। ইসলামের সূদের চমৎকার ও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। যেমন, ফুযাল্লাহ ইবনু উবাইদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, كُلُّ قَرْضٍ جَرَّ مَنْفَعَةً فَهُوَ وَجْهٌ مِنْ وُجُوهِ الرِّبَا ‘যে ঋণ কোন  মুনাফা  টানে তা সূদের  প্রকারসমূহের একটি’।[১] এমনকি রাসূল (ﷺ) বলেন, উমামা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেন,

مَنْ شَفَعَ لِأَخِيْهِ بِشَفَاعَةٍ فَأَهْدَى لَهُ هَدِيَّةً عَلَيْهَا فَقَبِلَهَا فَقَدْ أَتَى بَابًا عَظِيْمًا مِنْ أَبْوَابِ الرِّبَا.

‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ব্যপারে কোন সুপারিশ করল, অতঃপর সুপারিশের বিনিময়ে তাকে কোন উপহার প্রদান করা হলো আর সে তা গ্রহণ করল- সে সূদের অনেকগুলো শাখার মধ্য থেকে একটি বড় শাখায় উপনীত হলো’।[২]

‘সূদ’-এর প্রকার

সূদ বা রিবা প্রধানত দুই প্রকার। যথা: রিবা আন-নাসিয়াহ এবং রিবা আল-ফাদল। নিম্নে এ দু’ প্রকার আলোচনা করা হলো:

প্রথমতঃ রিবা আন-নাসিয়াহ

রিবা আন-নাসিয়াহ অর্থ মেয়াদি ঋনের সূদ। পরিভাষায়, নির্দিষ্ট মেয়াদের বিপরীতে শরী‘আতসম্মত কোন বিনিময় ছাড়া চুক্তির শর্ত অনুযায়ী যে অতিরিক্ত অর্থ বা মাল আদায় করা হয় তাকে ‘রিবা আন-নাসিয়াহ’ অর্থ মেয়াদি ঋনের সূদ  বলে। ‘রিবা আল-নাসিয়া’ হল মূলত বর্তমান সমাজে বহুল প্রচলিত সূদ। পুরো ব্যাংকিং সিস্টেম টিকে আছে এই সূদী ব্যবস্থার উপর। সাধারণ মানুষেরা এ সূদেই ঋণ দিয়ে থাকে। ব্যাংক স্বল্প হারের সূদে ঋণ নিয়ে অপেক্ষাকৃত অধিক হারের সূদে ঋণ প্রদান করে। এই দুই সূদের হারের পার্থক্য হল ব্যাংকের লাভ বা মুনাফা। তাই অর্থনীতির ভাষায় বলা হয়, ব্যাংক পরের ধনের পোদ্দারি করে। এই সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটি হারাম সূদের উপর দাঁড়িয়ে আছে। 

অর্থ বা পণ্যের ক্ষেত্রে রিবা আর নাসিয়াহ

উদাহরণস্বরূপ: কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে ১০০০ টাকা ঋণ দিল বা ১০ কেজি চাউল ধার দিল এই শর্তে যে, একমাস পরে সে এক হাজার টাকার সাথে আরো দুইশত টাকা বা ১০ কেজি চাউলের সাথে আরো দুই কেজি চাউল বেশি দেবে। এই  ২০০ টাকা বা ২ কেজি চাউল অতিরিক্ত গ্রহণ করাটাই হলো রিবা আন-নাসিয়াহ।

বাকিতে কেনাবেচার ক্ষেত্রে রিবা আন-নাসিয়াহ

উদাহরণস্বরূপ: কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির নিকট থেকে কোন কাপড় বা কোন পণ্য ১০০০ টাকায় ক্রয় করল এই শর্তে যে, সে একমাস পরে তার মূল্য পরিশোধ করবে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে ক্রেতা তার মূল্য পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের সম্মতিক্রমে এক হাজার টাকার সাথে আরো ১০০ টাকা বৃদ্ধি করল। এখানে এই অতিরিক্ত ১০০ টাকা গ্রহণ করাটাই হলো রিবা আন-নাসিয়াহ।

দ্বিতীয়তঃ রিবা আল-ফাদল

রিবা আল-ফাদল অর্থ, অতিরিক্ত, বাড়তি বা বেশি নেয়া ইত্যাদি। পরিভাষায়, পন্য বা অর্থের বিনিময়ে অতিরিক্ত পন্য বা অর্থ গ্রহণ করাই রিবা আল-ফাদল (সূদ)।

সমজাতীয় মুদ্রা বা পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে রিবা আল-ফদল

মুদ্রার বিনিময়ে মুদ্রা এবং পন্যের বিনিময়ে পন্য লেনদেনের ক্ষেত্রে যদি একই জাতীয় ও একই শ্রেণীভুক্ত হয়, তাহলে লেনদেন নগদে ও পরিমাণে সমান সমান হতে হবে। যেমন, এক টাকার বিনিময়ে এক টাকা বিক্রি বা এক ডলারের বিনিময়ে এক ডলার বিক্রি করা এবং এক কেজি খেজুর বা ধান-গমের বিনিময়ে এক কেজি খেজুর বিক্রি করা। কেননা  হাদীছে এসেছে, আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

أُتِىَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ بِتَمْرٍ فَقَالَ ্রمَا هَذَا التَّمْرُ مِنْ تَمْرِنَاগ্ধ. فَقَالَ الرَّجُلُ يَا رَسُوْلَ اللهِ بِعْنَا تَمْرَنَا صَاعَيْنِ بِصَاعٍ مِنْ هَذَا. فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ ্রهَذَا الرِّبَا فَرُدُّوْهُ ثُمَّ بِيْعُوْا تَمْرَنَا وَاشْتَرُوْا لَنَا مِنْ هَذَاগ্ধ.

‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে কিছু খেজুর আনা হল। তিনি বললেন, আমাদের খেজুরের মধ্যে এ ধরণের খেজুর কিভাবে এলো? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! এক ছা‘য়ের বিনিময়ে আমাদের দু’ছা‘ খেজুর বিক্রি করেছি। অর্থাৎ  আমাদের নিম্ন মানের দু’ছা‘ খেজুর দিয়ে তাদের উন্নত মানের এক ছা‘ খেজুর এনেছি। রাসূল (ﷺ) বললেন, এ তো সূদ। তোমরা তা ফেরত দাও। তারপর আমাদের খেজুর বিক্রি  করো এবং উত্তম জাতের খেজুর আমাদের জন্য ক্রয় করো’।[৩] উল্লেখ্য, সমজাতীয় মুদ্রা বা সমজাতীয় পন্য বিক্রি-বিনিময়  বৈধ হওয়ার জন্য অন্যতম শর্ত হল, উভয়টি নগদে নগদে এবং সমান সমান  হতে হবে।

জাহেলী যুগে ‘সূদ’-এর ধরণ

যায়েদ ইবনু আসলাম (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত,  তিনি বলেন,

كَانَ الرِّبَا فِي الْجَاهِلِيَّةِ أَنْ يَكُوْنَ لِلرَّجُلِ عَلَى الرَّجُلِ الْحَقُّ إِلَى أَجَلٍ فَإِذَا حَلَّ الْأَجَلُ قَالَ أَتَقْضِيْ أَمْ تُرْبِي فَإِنْ قَضَى أَخَذَ وَإِلَّا زَادَهُ فِيْ حَقِّهِ وَأَخَّرَ عَنْهُ فِي الْأَجَلِ.

‘জাহেলী যুগে সূদের ধরণ এমন ছিল যে, এক ব্যক্তির আরেক ব্যক্তির নিকট নির্ধারিত মেয়াদে কোন হক বা ঋণ পাওনা থাকত। মেয়াদ পূর্ণ হলে সে বলত, তুমি কি ঋণ পরিশোধ করবে, না সময় বৃদ্ধি করে নেবে? যদি ঋণ পরিশোধ করত, তাহলে ঋণদাতা তা গ্রহণ করত। অন্যথা সে তার পাওনায় অর্থ বৃদ্ধি (সূদ) করে দিত এবং পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দিত’।[৪]

দুঃখজনক হলে সত্য যে, জাহেলী যুগে সূদদাতা যে যুল্ম করত এবং সূদ গ্রহণের যে স্তর ছিল বর্তমানে সূদদাতার যুল্ম ও সূদের ধরণ তার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি প্রচার-প্রসারও মহামারির মত ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।

‘সূদ’-এর হুকুম বা বিধান

রিবা বা সূদের ধরণ-প্রকৃতি ও পদ্ধতি যা-ই হোক না কেন ইসলামে সকল ধরনের সূদ হারাম। জাহেলী যুগে সমাজে  প্রচলিত সূদ যেমন হারাম তেমনি সময়ের ব্যবধানে বর্তমানে  নতুন নতুন পদ্ধতিতে সংঘটিত সকল ধরনের রিবা বা সূদও হারাম। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اَحَلَّ اللّٰہُ الۡبَیۡعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا ‘মহান আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সূদকে হারাম করেছেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৭৫)। অন্যত্র তিনি বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَاۡکُلُوا الرِّبٰۤوا اَضۡعَافًا مُّضٰعَفَۃً  ۪ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ لَعَلَّکُمۡ  تُفۡلِحُوۡنَ.

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা দ্বিগুণের উপর দ্বিগুণ সূদ ভক্ষণ কর না এবং আল্লাহকে ভয় কর যেন তোমরা সুফলপ্রাপ্ত হও’ (সূরা আলে ইমরান: ১৩০)।

‘সূদ’-এর দুনিয়াবি ক্ষতি

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, یَمۡحَقُ اللّٰہُ الرِّبٰوا وَ یُرۡبِی الصَّدَقٰتِ ؕ وَ اللّٰہُ  لَا یُحِبُّ کُلَّ  کَفَّارٍ اَثِیۡمٍ ‘আল্লাহ সূদকে ক্ষয় করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন, বস্তুত আল্লাহ অতি কৃতঘ্ন পাপাচারীদেরকে ভালোবাসেন না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৭৬)। এ আয়াতে সূদের দুনিয়াবী ক্ষতি প্রস্ফুটিত হয়। তদুপরি নিম্নে আরো কিছু দুনিয়াবী ক্ষতি উল্লেখ করা হলো:

১.   সূদ গ্রহণ বা প্রদানের মাধ্যমে আজ হোক কাল হোক অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটবেই।

২.  সমস্ত আমল-ইবাদত নষ্ট হয়ে যাবে।

৩. সূদদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।

৪.  সূদ প্রদানের মাধ্যমে ও মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষগুলো অর্থনৈতিকভাবে আরো দুর্বল হয়ে পড়ে।

৫.  খুদে ব্যবসায়ীরা তাদের পুঁজি-পাটি হারিয়ে পথের ভিখারী হয়ে যায়।

‘সূদ’-এর পরকালীন শাস্তি

১- জিনে আছর করা রোগীর মত অবস্থা হবে: ক্বিয়ামতের দিন সূদ গ্রহীতার অবস্থা হবে জিনে আছর করা রোগীর ন্যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَلَّذِیۡنَ یَاۡکُلُوۡنَ الرِّبٰوا لَا یَقُوۡمُوۡنَ اِلَّا کَمَا یَقُوۡمُ الَّذِیۡ یَتَخَبَّطُہُ الشَّیۡطٰنُ مِنَ الۡمَسِّ ؕ ذٰلِکَ بِاَنَّہُمۡ قَالُوۡۤا اِنَّمَا الۡبَیۡعُ مِثۡلُ الرِّبٰوا.

‘যারা সূদ ভক্ষণ করে তারা শয়তানের স্পর্শে মোহাভিভূত ব্যক্তির অনুরূপ ক্বিয়ামত দিবসে দণ্ডায়মান হবে; এর কারণ এই যে, তারা বলে, ব্যবসা সূদের অনুরূপ বৈ তো নয়’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৭৫)।

২- সূদ গ্রহীতা যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করল

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰہَ وَ ذَرُوۡا مَا بَقِیَ مِنَ الرِّبٰۤوا اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ- فَاِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلُوۡا فَاۡذَنُوۡا بِحَرۡبٍ مِّنَ اللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ ۚ وَ  اِنۡ تُبۡتُمۡ  فَلَکُمۡ رُءُوۡسُ اَمۡوَالِکُمۡ ۚ لَا تَظۡلِمُوۡنَ وَ لَا تُظۡلَمُوۡنَ.

‘হে বিশ্বাসস্থাপনকারীগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং যদি তোমরা মুমিন হও, তাহলে সূদের মধ্যে যা অবশিষ্ট রয়েছে তা বর্জন কর। কিন্তু যদি না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও। আর যদি তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর তাহলে তোমাদের মূলধন পেয়ে যাবে, তোমরা অত্যাচার করবে না এবং তোমরাও অত্যাচারিত হবে না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৭৮-২৭৯)।

৩- সূদ গ্রহীতা পরকালে রক্তের নদীতে হাবুডুবু খাবে

সামুরা ইবনু জুনদুব প হতে বর্ণিত, একটি লম্ব হাদীছের অংশবিশেষ। যেখানে নবী (ﷺ) বলেন,

رَأَيْتُ اللَّيْلَةَ رَجُلَيْنِ أَتَيَانِيْ فَأَخْرَجَانِيْ إِلَى أَرْضٍ مُقَدَّسَةٍ فَانْطَلَقْنَا حَتَّى أَتَيْنَا عَلَى نَهَرٍ مِنْ دَمٍ فِيْهِ رَجُلٌ قَائِمٌ وَعَلَى وَسَطِ النَّهَرِ رَجُلٌ بَيْنَ يَدَيْهِ حِجَارَةٌ فَأَقْبَلَ الرَّجُلُ الَّذِيْ فِي النَّهَرِ فَإِذَا أَرَادَ الرَّجُلُ أَنْ يَخْرُجَ رَمَى الرَّجُلُ بِحَجَرٍ فِيْ فِيْهِ فَرَدَّهُ حَيْثُ كَانَ فَجَعَلَ كُلَّمَا جَاءَ لِيَخْرُجَ رَمَى فِيْ فِيْهِ بِحَجَرٍ فَيَرْجِعُ كَمَا كَانَ فَقُلْتُ مَا هَذَا فَقَالَ الَّذِيْ رَأَيْتَهُ فِي النَّهَرِ آكِلُ الرِّبَا.

‘আজ রাত্রে আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, দু’ব্যক্তি আমার নিকট আগমন করে আমাকে এক পবিত্র ভূমিতে নিয়ে গেল। আমরা চলতে চলতে এক রক্তের নদীর কাছে পৌঁছলাম। নদীর মধ্যস্থলে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে এবং আরেক ব্যক্তি নদীর তীরে, তার সামনে পাথর পড়ে রয়েছে। নদীর মাঝখানে লোকটি যখন বের হয়ে আসতে চায় তখন তীরের লোকটি তার মুখে পাথর খণ্ড নিক্ষেপ করে তাকে স্বস্থানে ফিরিয়ে দিচ্ছে। এভাবে যতবার সে বেরিয়ে আসতে চায় ততবারই তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করছে আর সে স্বস্থানে ফিরে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ কে? সে বলল, যাকে আপনি (রক্তের) নদীতে দেখেছেন, সে হল সূদখোর’।[৫]

৪- সূদের সাথে সম্পৃক্ত সবার উপর রাসূল (ﷺ)-এর বদদু‘আ

জাবির (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ آكِلَ الرِّبَا وَمُوْكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَاهِدَيْهِ وَقَالَ هُمْ سَوَاءٌ.

‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সূদগ্রহীতা, সূদদাতা, সূদের লেখক ও সূদের সাক্ষীদ্বয় সকলের ওপর অভিসম্পাত করেছেন এবং বলেছেন, তারা সকলেই সমান অপরাধী’।[৬] এ হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, যেসব প্রতিষ্ঠানে সূদী কারবারি চলে সেসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি বা কাজ করাটা তাদেরকে সহযোগিতা করারই  নামান্তর।

৫- সূদ গ্রহীতা যেন তার মায়ের সাথে ব্যভিচার করল

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, الرِّبَا سَبْعُوْنَ حُوْبًا أَيْسَرُهَا أَنْ يَنْكِحَ الرَّجُلُ أُمَّهُ ‘সূদের গুনাহের সত্তরটি স্তর রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্র স্তর হলো আপন মাকে বিবাহ তথা যেনা করা’।[৭]

৬- এক টাকা সূদ গ্রহণ করলে ৩৬ বার যেনা-ব্যভিচার  করার সমপরিমাণ গুনাহ হয়

‘গাসীলুল মালাইকা’ নামে খ্যাত হানজালাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, دِرْهَمُ رِباً يَأْكُلُهُ الرَّجُلُ وَهُوَ يَعْلَمُ أَشَدُّ مِنْ سِتَّةٍ وَثَلَاثِيْنَ زَنْيَةً ‘যে ব্যক্তি জেনে বুঝে এক টাকা সূদ গ্রহণ করল সে যেন ৩৬ বারের চেয়ে ও অধিক ব্যভিচার করল’।[৮]

সূদ থেকে বাঁচার উপায়

১. করযে হাসানা

করযে হাসানা হতে পারে দারিদ্র্য বিমোচনের ব্যাপকভিত্তিক শক্তিশালী মডেল এবং সূদী ঋণের উত্তম বিকল্প। করযে হাসানা হচ্ছে- সময়মতো ঋণ পরিশোধ করা হবে, কিন্তু দাতা কোন অতিরিক্ত অর্থ নিতে পারবে না। আর করযে হাসানা দাতার জন্য তো অগণিত ছাওয়াবের ওয়াদা আছেই। তাছাড়া করযে হাসানা বা সূদমুক্ত ঋণ প্রদানের মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র লোকদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। যারা অত্যন্ত অসহায়ত্বের শিকার তাদেরকে করযে হাসানা প্রদান করে ছোটখাটো কোন ব্যবসা ধরিয়ে দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনা যায়। যেমন পোশাক তৈরি, এমব্রয়ডারি, খাদ্য তৈরি, মোটরসাইকেল মেকানিক, ছাগল পালন, হাঁস-মুরগির খামার, কাঠের সরঞ্জাম তৈরি ইত্যাদি’।

২. সূদমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রচলন

সূদমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় হতে পারে সমাজ থেকে সূদ উৎখাতের অন্যতম মাধ্যম। কেননা সমাজে ছোট থেকে বড় যে সকল ব্যবসায়ীর অধিকাংশই ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকে। সুতরাং ব্যাংকিং ব্যবস্থা যদি সূদমুক্ত হয়, তাহলে সমাজ থেকে সূদকে চিরতরে বিদায় করা একেবারে সহজ হয়ে যাবে। এমনিভাবে আস্তে আস্তে সমাজের মানুষ সূদমুক্ত জীবন যাপন করতে পারবে ইনশাআল্লাহ।

৩. সুখে-দুঃখে সর্ববস্থায় আল্লাহকে ভয় করা

দুঃখ-কষ্টকে আল্লাহর পরীক্ষা মনে করে সূদের পাপের ক্ষেত্রে যদি কেউ আল্লাহকে  ভয় করে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই তাকে যেকোন ভাবে রিযিকের পথ খুলে দেবেন। যা সে কখনো কল্পনাও করেনি। তাই তো মহান আল্লাহ্ বলেন,

وَ  مَنۡ یَّتَّقِ اللّٰہَ  یَجۡعَلۡ لَّہٗ  مَخۡرَجًا- وَّ یَرۡزُقۡہُ  مِنۡ حَیۡثُ لَا یَحۡتَسِبُ

‘যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার নিস্কৃতির ব্যবস্থা করে দিবেন। আর তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে দান করবেন রিয্ক’ (সূরা আত-ত্বালাক্ব: ৩)।

৪. সর্বোপরি মহান আল্লাহর উপর ভরসা করা ও ধৈর্যধারণ করা। কেননা বিপদে-আপদে যদি আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করি এবং ধৈর্যধারণ করি, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করবেন। তাই তো মহান আল্লাহ বলেন, اِنَّ اللّٰہَ مَعَ الصّٰبِرِیۡنَ ‘নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলগণের সাথে আছেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৫৩)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَ مَنۡ  یَّتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰہِ  فَہُوَ حَسۡبُہٗ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট’ (সূরা আত-ত্বালাক্ব: ৩)।

উপসংহার

পরিশেষে বলতে চাই- অতীব পরিতাপের বিষয় যে, সূদ ও ঘুষ উভয়টি মারাত্মক গুনাহ। যদিও ঘুষকে যতটা খারাপ মনে করা হয়, সূদকে ততটা খারাপ মনে করা হয় না। অথচ  ঘুষের চেয়ে সূদের পাপ আরও বেশি মারাত্মক, যা থেকে আমাদের বেঁচে থাকা আবশ্যক। তাই আল্লাহর কাছে দু‘আ করি মহান আল্লাহ তা‘আলা যেন আমাদের সকলকেই এই সূদ নামক মারাত্মক গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!



* শিক্ষক, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাউসা হেদাতিপাড়া, বাঘা, রাজশাহী।

[১]. বাইহাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/১১২৫২।

[২]. আবূ দাঊদ, হা/৩৫৪১; সনদ হাসান, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩৪৬৫।

[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৪।

[৪]. মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/২৪৮০; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/১০২৪৭।

[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/২০৮৫।

[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৮; মিশকাত, হা/২৮০৭।

[৭]. ইবনে মাজাহ, হা/২২৭৪; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘, হা/৩৫৪১।

[৮]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২২০০৭; মিশকাত, হা/২৮২৫; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১০৩৩।




প্রসঙ্গসমূহ »: পাপ হালাল-হারাম
দু‘আ ও যিকর : আল্লাহর অনুগ্রহ ও প্রশান্তি লাভের মাধ্যম (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামী উত্তরাধিকার আইন: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ধারা - ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১৪তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম (৫ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
রামাযানে ছিয়াম রাখার বিধান ও না রাখার পরিণাম - আল-ইখলাছ ডেস্ক
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (শেষ কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
অল্পে তুষ্ট (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইসলামে দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
মুসলিম বিভক্তির কারণ ও প্রতিকার (২য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায় (৫ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
তারুণ্যের উপর সন্ত্রাসবাদের হিংস্র ছোবল : প্রতিকারের উপায় (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান

ফেসবুক পেজ