সালাফী মানহাজের মূলনীতিসমূহ
-আব্দুল গাফফার মাদানী*
(২য় কিস্তি)
৫. বিদ‘আতকে সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা
আল্লাহ তা‘আলার বাণী
ثُمَّ قَفَّیۡنَا عَلٰۤی اٰثَارِہِمۡ بِرُسُلِنَا وَ قَفَّیۡنَا بِعِیۡسَی ابۡنِ مَرۡیَمَ وَ اٰتَیۡنٰہُ الۡاِنۡجِیۡلَ ۬ۙ وَ جَعَلۡنَا فِیۡ قُلُوۡبِ الَّذِیۡنَ اتَّبَعُوۡہُ رَاۡفَۃً وَّ رَحۡمَۃً ؕ وَ رَہۡبَانِیَّۃَۨ ابۡتَدَعُوۡہَا مَا کَتَبۡنٰہَا عَلَیۡہِمۡ اِلَّا ابۡتِغَآءَ رِضۡوَانِ اللّٰہِ فَمَا رَعَوۡہَا حَقَّ رِعَایَتِہَا ۚ فَاٰتَیۡنَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مِنۡہُمۡ اَجۡرَہُمۡ ۚ وَ کَثِیۡرٌ مِّنۡہُمۡ فٰسِقُوۡنَ.
‘তারপর তাদের পিছনে আমি আমার রাসূলদেরকে অনুগামী করেছিলাম এবং মারইয়াম পুত্র ঈসাকেও অনুগামী করেছিলাম। আর তাকে ইনজীল কিতাব দিয়েছিলাম এবং যারা তার অনুসরণ করেছিল তাদের অন্তরসমূহে করুণা ও দয়া-মায়া দিয়েছিলাম। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তারাই বৈরাগ্যবাদের প্রবর্তন করেছিল। এটা আমি তাদের ওপর লিপিবদ্ধ করে দেইনি। তারপর তাও তারা যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করেনি। আর তাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে আমি তাদের প্রতিদান দিয়েছিলাম এবং তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল ফাসিক’ (সূরা আল-হাদীদ : ২৭)।
رَهبانية-এর অর্থ হল, বৈরাগ্যবাদ বা সন্ন্যাসবাদ অথবা সংসার ত্যাগ করা। অর্থাৎ দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে কোন জঙ্গলে বা মরুভূমিতে গিয়ে নির্জনে আল্লাহর উপাসনা-আরাধনা করা। এর পট-ভূমিকা হল, ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর পর এমন রাজাদের আগমন ঘটে, যারা তাওরাত ও ইঞ্জীলের মধ্যে বহু পরিবর্তন সাধন করে। যে কাজকে একটি দল মেনে নিতে পারেনি। উক্ত দল রাজাদের ভয়ে পাহাড়ের চূড়া ও গুহায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। এখান থেকেই বৈরাগ্যবাদ বা সন্ন্যাসবাদের সূচনা হয়। যার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল পরিস্থিতির চাপে পড়ে। কিন্তু তাদের পরে আগত অনেক মানুষ তাদের বড়দের অন্ধ অনুকরণে দেশ ত্যাগ করাকে ইবাদতের একটি তরীকা বানিয়ে নেয় এবং নিজেকে গির্জা ও উপাসনালয়ে আবদ্ধ করে নেয়। আর এর জন্য দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করাকে অত্যাবশ্যক গণ্য করে। এটাকেই আল্লাহ ابتداع (মনগড়া বা নব আবিষ্কৃত বিদ‘আত) বলে আখ্যায়িত করেছেন।
মহান আল্লাহ পরিষ্কার করে বলে দিলেন যে, দ্বীনে নিজের পক্ষ হতে বিদ‘আত রচনা করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায় না। আর সেটা (এই বিদ‘আত) দেখতে যতই সুন্দর হোক না কেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি একমাত্র তাঁর আনুগত্যেই অর্জন হতে পারে। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِيْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ فَهُوَ رَدٌّ ‘কেউ আমাদের এ শরী‘আতে নেই এমন কিছুর অনুপ্রবেশ ঘটালে তা প্রত্যাখ্যাত’।[১]
অত্র হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, শরী‘আর দৃষ্টিতে দ্বীনের নামে ছাওয়াবের উদ্দেশ্যে কিছু করাকে বিদ‘আত বলা হয়, যা দ্বীনের মধ্যে নতুন আবিষ্কার। অতএব দুনিয়াবী আবিষ্কার যেমন বাস, ট্রেন, উড়োজাহাজ, পানি জাহাজ প্রভৃতিতে চড়া বিদ‘আত নয়। কারণ এগুলোতে চড়ার মাধ্যমে কেউ ছাওয়াবের আশা করে না। দুঃখের বিষয় হলেও অতি সত্যকথা যে, আমরা ইবাদত করতে এত ব্যস্ত যে, ঐ ইবাদতটি নবীর তরীকা মুতাবিক হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করারও সময় নেই। এজন্যই অজান্তে দেদারসে এমন কিছু আমল ছাওয়াব পাওয়ার নিমিত্তে করে যাচ্ছি যেগুলো জাহান্নামে যাওয়ার অন্যতম কারণ। যেমন, মীলাদ, শবেবরাত, চল্লিশা, খতমে জালালী, খতমে ইউনুস, কুরআন খানি, ফাতিহা খানি, শবীনা খতম, দরুদে তাজ, দরুদে লাক্ষী, দু‘আয়ে গাঞ্জুল আরশ, কুম কুম ইয়া হাবীবা ওযীফা, উরস, কবরে চাদর দেয়া, কবর পাকা করা, কবরের উপর লেখা, তাতে ফ্যানের ব্যবস্থা রাখা, সেখানে আগর বাতি-মোমবাতি জ্বালানো, সেখানে নযরানা পেশ করা, মুখে নিয়তের গদ উচ্চারণ করা (নাওয়াইতু আন উসল্লিয়া ----- বলে), ফরয ছালাতান্তে, জানাযা ছালাতান্তে সস্মিলিতভাবে হাত তুলে দু‘আ করা প্রভৃতি। এগুলো এমন আমাল যার মধ্যে নবী (ﷺ)-এর তরীকা বিদ্যমান না থাকায় নিঃসন্দেহে বিদ‘আত- যার পরিণাম জাহান্নাম ছাড়া আর কিছু নয়। অনেকে বলে থাকেন, বুঝলাম এগুলো বিদ‘আত কিন্তু বিদ‘আত তো দুই প্রকার।
১. বিদ‘আতে হাসানাহ (উত্তম বিদ‘আত) ২. বিদ‘আতে সায়্যিআহ (মন্দ বিদ‘আত)।
অতএব এগুলো বিদ‘আত হলেও মন্দ বিদ‘আত নয় বরং উত্তম বিদ‘আত। প্রকৃতপক্ষে বিদ‘আতকে উক্ত দুই ভাগে ভাগ করাও একটি বিদ‘আত। কারণ নবী (ﷺ) হতে বিদ‘আতের এই বিভাজন আদৌ প্রমাণিত নেই। বরং তিনি সমস্ত বিদ‘আতকে ভ্রষ্টতা বলেছেন।[২] ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, সমস্ত বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা যদিও মানুষ তাকে উত্তম মনে করে।[৩]
মনে রাখতে হবে যে, দুনিয়াবী বিষয়ে সকল বিষয়ই বৈধ বা হালাল, শুধু কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যে যে সকল বস্তুকে হারাম করা হয়েছে সেগুলো ব্যতীত। আর ইবাদতের ক্ষেত্রে সকল প্রকার ইবাদত হারাম বা অবৈধ শুধু কুরআন ও সুন্নাহয় যেগুলোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেগুলো ব্যতীত। আমল ছহীহ ও সুন্নাতী পদ্ধতিতে হবার জন্য ছয়টি বিষয়ের উপর খেয়াল রাখতে হবে। সেগুলো হল-
(ক) কারণ : যেমন চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণের কারণে ছালাত আছে কিন্তু আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর জন্ম বা মৃত্যুর কারণে কোন ইবাদত নেই, তাই জন্ম বা মৃত্যুর কারণে কোন ইবাদত করা বিদ‘আত।
(খ) প্রকার : যত প্রকার মহিলাকে বিবাহ করা হারাম তত প্রকার ব্যতীত অন্য সকল প্রকার নারীকে বিবাহ বৈধ, কিংবা যত প্রকারের জানোয়ার আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কুরবানী করেছেন সেগুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকা, যেমন আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ঘোড়া কুরবানী করেননি বা মোরগ-মুরগী কুরবানী করেননি, তাই তা না করা।
(গ) পরিমাণ : যতটুকু করেছেন তার চেয়ে কম বা বেশি না করা। যেমন যোহরের চার রাক‘আতে স্থলে ৩ বা ৫ রাক‘আত করা যাবে না।
(ঘ) সময় : যে সময়ে করেছেন সে সময়ে করা। যেমন সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা, যোহরের ছালাতে আছরের সময় আর আছরের ছালাত যোহরে আদায় না করা।
(ঙ) স্থান : যে স্থানে করেছেন, যেমন হজ্জের মীক্বাত, মীনায় অবস্থান, আরাফায় অবস্থান, ফরয ছালাত মসজিদে আদায় ইত্যাদি।
(চ) পদ্ধতি : যেভাবে করেছেন সেভাবেই করতে হবে, পদ্ধতি পরিবর্তন না করা।
আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ইবনু মালেক হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, إِنَّ اللهَ حَجَرَ التَّوْبَةَ عَنْ كُلِّ صَاحِبِ بِدْعَةٍ ‘আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বিদ‘আতী থেকে তওবা আড়াল করে রাখেন’।[৪]
ইহইয়া ইবনে ইয়ামান (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি সুফিয়ান (রাহিমাহুল্লাহ)-কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেন, ‘শয়তানের নিকট গুনাহর চেয়ে বিদ‘আত অধিক প্রিয়। গুনাহের তওবা কবুল হয় পক্ষান্তরে বিদ‘আতের তওবা কবুল হয় না’।[৫]
৬. কাবীরা গোনাহগার গোনাহকে হালাল মনে না করলে কাফের হবে না এবং ইসলামের গণ্ডি থেকেও বের হবে না
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّ اللّٰہَ لَا یَغۡفِرُ اَنۡ یُّشۡرَکَ بِہٖ وَ یَغۡفِرُ مَا دُوۡنَ ذٰلِکَ لِمَنۡ یَّشَآءُ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তার সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্যান্য অপরাধে যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করেন’ (সূরা আন-নিসা : ৪৮)।
এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, তিনি তাঁর সাথে শিরক করাকে ক্ষমা করবেন না। এর বাইরে যত গোনাহ আছে সবই তিনি যার জন্য ইচ্ছে ক্ষমা করে দিবেন। আর যে তার সাথে কাউকে শরীক করে সে অবশ্যই এক বড় মিথ্যা অপবাদ রটনা করল। অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা শিরককারীদের মধ্যে যারা তওবা করবে তাদেরকে ক্ষমা করার কথা ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা আল্লাহর সাথে অন্য কোন ইলাহকে ডাকে না, ... তবে যদি তারা তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে’ (সূরা আল-ফুরকান : ৭০)। সুতরাং তওবাহ করলে শিরকও মাফ হয়ে যায়, তবে সেটা মৃত্যুর আগে দুনিয়াতেই হতে হবে।
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, আমরা কাবীরা গোনাহকারীর জন্য ইস্তেগফার করা থেকে বিরত থাকতাম। শেষ পর্যন্ত যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে এ আয়াত শুনলাম এবং আরো শুনলাম যে, তিনি বলছেন, আমি আমার দু‘আকে গচ্ছিত রেখেছি আমার উম্মতের কাবীরা গোনাহগারদের সুপারিশ করার জন্য। ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, এরপর আমাদের অন্তরে যা ছিল, তা অনেকটা কেটে গেল ফলে আমরা ইস্তেগফার করতে থাকলাম ও আশা করতে থাকলাম।[৬] মহান আল্লাহ বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الۡقِصَاصُ فِی الۡقَتۡلٰی ؕ اَلۡحُرُّ بِالۡحُرِّ وَ الۡعَبۡدُ بِالۡعَبۡدِ وَ الۡاُنۡثٰی بِالۡاُنۡثٰی ؕ فَمَنۡ عُفِیَ لَہٗ مِنۡ اَخِیۡہِ شَیۡءٌ فَاتِّبَاعٌۢ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ اَدَآءٌ اِلَیۡہِ بِاِحۡسَانٍ ؕ ذٰلِکَ تَخۡفِیۡفٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ رَحۡمَۃٌ ؕ فَمَنِ اعۡتَدٰی بَعۡدَ ذٰلِکَ فَلَہٗ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ.
‘হে ঈমানদারগণ! নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের উপর কিছাছের বিধান লিখে দেয়া হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, ক্রীতদাসের বদলে ক্রিতদাস, নারীর বদলে নারী। তবে তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে কোন ক্ষমা প্রদর্শন করা হলে যথাযথ বিধির অনুসরণ করা ও সততার সাথে তার রক্ত-বিনিময় আদায় করা কর্তব্য। এটা তোমাদের রব-এর পক্ষ থেকে শিথিলতা ও অনুগ্রহ। সুতরাং এর পরও যে সীমালংঘন করে তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (সূরা আন-নিসা : ১৭৮)।
عَنْ أَنَسٍ ু قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ قَالَ اللهُ تَعَالَى يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ مَا دَعَوْتَنِيْ وَرَجَوْتَنِيْ غَفَرْتُ لَكَ عَلٰى مَا كَانَ فِيْكَ وَلَا أُبَالِيْ يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ لَوْ بَلَغَتْ ذُنُوْبُكَ عَنَانَ السَّمَاءِ ثُمَّ اسْتَغْفَرْتَنِيْ غَفَرْتُ لَكَ وَلَا أُبَالِيْ يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ لَوْ لَقِيْتَنِيْ بِقُرَابِ الْأَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لَقِيْتَنِيْ لَا تُشْرِكُ بِيْ شَيْئًا لَأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً.
আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে আদম সন্তান! যতদিন তুমি আমাকে ডাকবে এবং আমার নিকট ক্ষমার আশা রাখবে আমি তোমাকে ক্ষমা করব, তোমার অবস্থা যাই হোক না কেন আমি কারো পরওয়া করি না। আদম সন্তান! তোমার গুনাহ যদি আকাশ পর্যন্তও পৌঁছে অতঃপর তুমি আমার নিকট ক্ষমা চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব। আমি ক্ষমা করার ব্যাপারে কারও পরওয়া করি না। আদম সন্তান! তুমি যদি পৃথিবী পরিমাণ গুনাহ নিয়ে আমার দরবারে উপস্থিত হও এবং আমার সাথে কোন শরীক না করে আমার সামনে আস, আমি পৃথিবী পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে উপস্থিত হব।[৭]
عَنْ أَنَسٍ ঃ أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ قَالَ شَفَاعَتِيْ لِأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّتِيْ.
আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নিশ্চয় নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, আমার উম্মতের কাবীরা গোনাহকারীরাই বিশেষভাবে আমার শাফা‘আত লাভ করবে অন্য উম্মতের কাবীরা গোনাহকারীরা শাফা‘আত লাভ করতে পারবে না।[৮]
কাবীরা গোনাহগারদের ক্ষমার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শাফা‘আত হল খাছ, এটা অন্য কোন উম্মতের জন্য হবে না। আল্লামা ত্বীবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এর অর্থ হল কাবীরা গোনাহের কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মুক্তির জন্য আমার শাফা‘আত একমাত্র বিশেষায়িত।
কাযী ‘ইয়ায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মাযহাব বা মত হল, কুরআনুল কারীমের স্পষ্ট আয়াত দ্বারা গোনাহগারদের জন্য শাফা‘আত প্রমাণিত’। যেমন আল্লাহর বাণী, یَوۡمَئِذٍ لَّا تَنۡفَعُ الشَّفَاعَۃُ اِلَّا مَنۡ اَذِنَ لَہُ الرَّحۡمٰنُ وَ رَضِیَ لَہٗ قَوۡلًا ‘সেদিন সুপারিশ কারো কাজে আসবে না, কিন্তু দয়াময় (আল্লাহ) যাকে অনুমতি দিবেন এবং যার কথার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন’ (সূরা ত্ব-হা : ১০৯)।
এছাড়া মুতাওয়াতির হাদীছ দ্বারা ক্বিয়ামতের শাফা‘আত প্রমাণিত। এটা সালাফে ছালিহীন এবং তৎপরবর্তী আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের সর্ববাদীসম্মত মত। কিন্তু খারিজী সম্প্রদায় এবং কতিপয় মু‘তাযিলা কাবীরা গোনাহকারীদের জন্য শাফা‘আত বৈধ হওয়া এবং গ্রহণ হওয়াকে অস্বীকার করে থাকে, ফলে তাদের চিরস্থায়ী জাহান্নামী বলে মনে করে এবং দলীল স্বরূপ তারা কুরআনের কয়েকটি আয়াত উপস্থাপন করে। যেমন,
فَمَا تَنۡفَعُہُمۡ شَفَاعَۃُ الشّٰفِعِیۡنَ.
‘অতএব সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন কাজে আসবে না’ (সূরা আল-মুদ্দাছছির : ৪৮)।
مَا لِلظّٰلِمِیۡنَ مِنۡ حَمِیۡمٍ وَّ لَا شَفِیۡعٍ یُّطَاعُ.
‘সেদিন যালিমদের কোন অন্তরঙ্গ বন্ধু থাকবে না এবং এমন কোন সুপারিশকারীও থাকবে না যার কথা গ্রহণ হয়’ (সূরা আল-মুমিন : ১৮)।
মু‘তাযিলা ও খারিজীদের ধারণা ও প্রদত্ত দু’টি দলীলের জওয়াবে আমরা বলব যে, উক্ত আয়াতদ্ব কাফিরদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, আর যুলুম দ্বারা উদ্দেশ্য হল শিরক।
তারা শাফা‘আতের তা’বীল বা ব্যাখ্যায় বলে থাকে যে, শাফা‘আত হবে জান্নাতীদের মর্যাদা বাড়ানোর জন্য (কাবীরা গোনাহগারদের মুক্তির জন্য নয়) তাদের এ ব্যাখ্যা বাতিল বা অগ্রহণযোগ্য। কাবীরা গোনাহগার জাহান্নামীদের জন্য শাফা‘আত গ্রহণের মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তির ভূরিভূরি হাদীছ কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে। বক্ষমাণ হাদীছটি এর প্রামাণ্য দলীল।
عَنْ عَبْدِ اللهِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ ... وَلَا يَدْخُلُ النَّارَ مَنْ كَانَ فِىْ قَلْبِهِ مِثْقَالُ خَرْدَلَةٍ مِنْ إِيْمَانٍ.
‘আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,.... যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান থাকবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না।[৯]
ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ এই বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছে যে, তাওহীদপন্থী কাবীরা গোনাহকারীর ব্যাপারে শাফা‘আত করা হবে এবং সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে না। পক্ষান্তরে খাওয়ারেজ ও মু‘তাযিলারা এটা অস্বীকার করে’।[১০]
৭. ঈমান বিষয়ে নাজাতপ্রাপ্ত দলের অবস্থান
ঈমান বিষয়ে নাজাতপ্রাপ্ত দলের অবস্থান হল- অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কাজে বাস্তবায়ন, যা ভালো আমলের মাধ্যমে বৃদ্ধি পাবে এবং গোনাহের কাজে হ্রাস পাবে। কুরআন-হাদীছ এবং সালাফদের মতামতের ভিত্তিতে যা অকাট্যভাবে প্রমাণিত।
ঈমান ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ঈমান ব্যতীত মানুষ তার কোন সৎ আমলের প্রতিদান পরকালে লাভ করতে পারবে না। আবার ঈমানহীন মানুষ জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হবে চিরকাল। তাই ঈমানকে ইসলামের মূল খুঁটি বললেও অত্যুক্তি হবে না।
ঈমানের শারঈ অর্থ
পারিভাষিক অর্থে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের নিকট ঈমান হল মূল ও শাখাসহ হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়ন সমন্বিত নাম। প্রথম দু’টি মূল ও শেষেরটি হল শাখা, যেটা না থাকলে পূর্ণ মুমিন হওয়া যায় না।[১১] ঈমানের শারঈ অর্থে পাঁচটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষ যখনই সে পাঁচটি বিষয় তার জীবনে বাস্তবায়ন করবে তখনই সে একজন ঈমানদার ব্যক্তি হিসাবে গণ্য হবে, নচেৎ নয়।
(ক) অন্তরের কথা অর্থাৎ অন্তরে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস পোষণ করা। মহান আল্লাহ বলেন,
وَ الَّذِیۡ جَآءَ بِالصِّدۡقِ وَ صَدَّقَ بِہٖۤ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُتَّقُوۡنَ . لَہُمۡ مَّا یَشَآءُوۡنَ عِنۡدَ رَبِّہِمۡ ؕ ذٰلِکَ جَزٰٓؤُا الۡمُحۡسِنِیۡنَ.
‘যারা সত্যসহ উপস্থিত হয়েছে এবং সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে তারাই তো মুত্তাক্বী, তারা যা চাইবে সব কিছুই আছে তাদের প্রতিপালকের নিকট। এটাই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান’ (সূরা আয-যুমার : ৩৩-৩৪)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
وَ کَذٰلِکَ نُرِیۡۤ اِبۡرٰہِیۡمَ مَلَکُوۡتَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ لِیَکُوۡنَ مِنَ الۡمُوۡقِنِیۡنَ.
‘এমনিভাবেই আমিই ইবরাহীমকে আসমান ও যমীনের রাজত্ব অবলোকন করিয়েছি, যাতে সে বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়’ (সূরা আল-আন‘আম : ৭৫)। তিনি আরো বলেন, اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِاللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ ثُمَّ لَمۡ یَرۡتَابُوۡا ‘তারাই প্রকৃত মুমিন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পরে আর কোন সন্দেহ পোষণ করে না’ (সূরা আল-হুজুরাত : ১৫)।
মুমিন ব্যক্তির বিশ্বাসে কোন সন্দেহের লেশমাত্র থাকে না। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ﷺ) বলেন, যে ব্যক্তি ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলবে আর তার অন্তরে একটি যব পরিমাণও ঈমান বিদ্যমান থাকবে, তাকে জাহান্নাম হতে বের করা হবে এবং যে ব্যক্তি ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলবে আর তার অন্তরে একটি গম পরিমাণও পুণ্য বিদ্যমান থাকবে, তাকে জাহান্নাম হতে বের করা হবে। আর যে ব্যক্তি ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলবে আর তার অন্তরে একটি অণু পরিমাণও নেকী থাকবে, তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে’।[১২]
হাদীছের অর্থ এই নয় যে, ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ পড়ে বসে থাকবে। বরং অন্তরে বিশ্বাস, মুখে উচ্চারণ এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আমল দ্বারাই একজন মুমিন হওয়া যাবে, নচেৎ নয়। যা কুরআন ও ছহীহ সুন্নার দ্বারা বুঝা যায়।
(খ) মুখে উচ্চারণ অর্থাৎ ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ ওয়া আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহর’ মুখে স্বীকৃতি প্রদান করা, উচ্চারণ করে পড়া এবং আমলের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা। মহান আল্লাহ বলেন,
قُوۡلُوۡۤا اٰمَنَّا بِاللّٰہِ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡنَا وَ مَاۤ اُنۡزِلَ اِلٰۤی اِبۡرٰہٖمَ وَ اِسۡمٰعِیۡلَ وَ اِسۡحٰقَ وَ یَعۡقُوۡبَ وَ الۡاَسۡبَاطِ وَ مَاۤ اُوۡتِیَ مُوۡسٰی وَ عِیۡسٰی وَ مَاۤ اُوۡتِیَ النَّبِیُّوۡنَ مِنۡ رَّبِّہِمۡ ۚ لَا نُفَرِّقُ بَیۡنَ اَحَدٍ مِّنۡہُمۡ ۫ۖ وَ نَحۡنُ لَہٗ مُسۡلِمُوۡنَ.
‘তোমরা বল, আমরা ঈমান রাখি আল্লাহর প্রতি এবং যা আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়াকূব এবং তাদের বংশধরের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল এবং মূসা ও ঈসা-কে যা প্রদান করা হয়েছিল এবং অন্যান্য নবীকে তাদের প্রভু হতে যা দেয়া হয়েছিল। আমরা তাদের কারো মধ্যে পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৩৬)।
মহান আল্লাহ বলেন, وَ اِذَا یُتۡلٰی عَلَیۡہِمۡ قَالُوۡۤا اٰمَنَّا بِہٖۤ اِنَّہُ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّنَاۤ ‘যখন তাদের নিকট এটা আবৃত্তি করা হয় তখন তারা বলে, আমরা এতে ঈমান আনি। এটা আমাদের প্রতিপালক হতে আগত সত্য’ (সূরা আল-ক্বাছাছ : ৫৩)। তিনি আরো বলেন, وَ قُلۡ اٰمَنۡتُ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ مِنۡ کِتٰبٍ ‘বলুন, আল্লাহ যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন আমি তাতে বিশ্বাস করি’ (সূরা আশ-শূরা : ১৫)। অন্যত্র তিনি বলেন, اِلَّا مَنۡ شَہِدَ بِالۡحَقِّ وَ ہُمۡ یَعۡلَمُوۡنَ ‘তবে যারা সত্য উপলব্ধি করে সত্যের সাক্ষ্য দেয় তারা ব্যতীত’ (সূরা আয-যুখরুফ : ৮৬)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, اِنَّ الَّذِیۡنَ قَالُوۡا رَبُّنَا اللّٰہُ ثُمَّ اسۡتَقَامُوۡا فَلَا خَوۡفٌ عَلَیۡہِمۡ وَلَا ہُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ ‘যারা বলে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ এবং এই বিশ্বাসে অবিচল থাকে, তাদের জন্য কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না’ (সূরা আল-আহক্বাফ : ১৩)।
ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন, আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য নির্দেশিত হয়েছি, যতক্ষণ না তারা এ মর্মে সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য মা‘বূদ নেই ও মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল। আর ছালাত প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত আদায় করে। তারা যদি এগুলো করে, তবে আমার পক্ষ হতে তাদের জান ও মালের ব্যাপারে নিরাপত্তা লাভ করল। অবশ্য ইসলামের বিধান অনুযায়ী যদি কোন হক্ব থাকে, তাহলে স্বতন্ত্র কথা। আর তাদের হিসাবের ভার আল্লাহর উপর অর্পিত।[১৩]
উপরে বর্ণিত কুরআনের আয়াত এবং হাদীছ থেকে সুস্পষ্ট হল যে, ঈমান অর্থ অন্তরে বিশ্বাস, মুখে উচ্চারণ ও তদনুযায়ী আমল করা। এই তিনটির সমন্বয়েই খাঁটি মুমিন হওয়া যাবে, নচেৎ নয়।
(গ) অন্তরের আমল অর্থাৎ নিয়ত করা। কারণ সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। সকল ইবাদতের ক্ষেত্রে ইখলাছ থাকা। কারণ ইবাদত শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করতে হবে। ভালোবাসা, আনুগত্য, আশা-ভরসা ইত্যাদি সবই আল্লাহর জন্য হতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,وَ لَا تَطۡرُدِ الَّذِیۡنَ یَدۡعُوۡنَ رَبَّہُمۡ بِالۡغَدٰوۃِ وَ الۡعَشِیِّ یُرِیۡدُوۡنَ وَجۡہَہٗ ‘আর যেসব লোক সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে ডাকে এবং এর মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদেরকে তুমি দূরে ঠেলে দিও না’ (সূরা আল-আন‘আম : ৫২)। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,
اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الَّذِیۡنَ اِذَا ذُکِرَ اللّٰہُ وَجِلَتۡ قُلُوۡبُہُمۡ وَ اِذَا تُلِیَتۡ عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتُہٗ زَادَتۡہُمۡ اِیۡمَانًا وَّ عَلٰی رَبِّہِمۡ یَتَوَکَّلُوۡنَ.
‘নিশ্চয় মুমিনরা এরূপ যে, যখন (তাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তরসমূহ ভীত হয়ে পড়ে। আর যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন সেই আয়াতসমূহ তাদের ঈমানকে আরও বৃদ্ধি করে দেয়। আর তারা তাদের প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে’ (সূরা আল-আনফাল : ২)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡتُوۡنَ مَاۤ اٰتَوۡا وَّ قُلُوۡبُہُمۡ وَجِلَۃٌ اَنَّہُمۡ اِلٰی رَبِّہِمۡ رٰجِعُوۡنَ ‘এবং যারা তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে- এই বিশ্বাসে তাদের যা দান করার তা দান করে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে’ (সূরা আল-মুমিনূন : ৬০)।
উল্লিখিত আয়াতসমূহ থেকে এবং অন্যান্য আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর উপর ভরসা, ভয়-ভীতি, আশা-আকাক্সক্ষা, বিনয়-ন¤্রতা, আল্লাহর দিকে রুজূ‘ হওয়া ইত্যাদি অন্তরের আমল।
(ঘ) জিহ্বা বা মুখের মাধ্যমে আমল। কুরআন তেলাওয়াত, যিকর-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল, তাকবীর, দু‘আ-ইস্তেগফার ইত্যাদি মুখের ইবাদত। মহান আল্লাহ বলেন,
اِنَّ الَّذِیۡنَ یَتۡلُوۡنَ کِتٰبَ اللّٰہِ وَ اَقَامُوا الصَّلٰوۃَ وَ اَنۡفَقُوۡا مِمَّا رَزَقۡنٰہُمۡ سِرًّا وَّ عَلَانِیَۃً یَّرۡجُوۡنَ تِجَارَۃً لَّنۡ تَبُوۡرَ.
‘যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, ছালাত কায়েম করে, আমরা তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করতে পারে তাদের এমন ব্যবসায়ের যার ক্ষয় নেই’ (সূরা আল-ফাতির : ২৯)। তিনি আরো বলেন, وَ اتۡلُ مَاۤ اُوۡحِیَ اِلَیۡکَ مِنۡ کِتَابِ رَبِّکَ ۚؕ لَا مُبَدِّلَ لِکَلِمٰتِہٖ ۚ۟ وَ لَنۡ تَجِدَ مِنۡ دُوۡنِہٖ مُلۡتَحَدًا ‘আপনি আপনার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট আপনার প্রতিপালকের কিতাব আবৃত্তি করুন; তাঁর বাক্য পরিবর্তন করার কেউই নেই’ (সূরা আল-কাহ্ফ : ২৭)। অন্যত্র তিনি বলেন,
یٰۤاَیُّہَاالَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اذۡکُرُوا اللّٰہَ ذِکۡرًا کَثِیۡرًا . وَّ سَبِّحُوۡہُ بُکۡرَۃً وَّ اَصِیۡلًا.
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা কর’ (সূরা আল-আহযাব : ৪১-৪২)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, وَ اسۡتَغۡفِرُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ‘তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর আল্লাহর নিকট। নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, দয়ালু’ (সূরা আল-মুয্যাম্মিল : ২০)।
এসব দলীল এবং অন্যান্য আরো দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুখের মাধ্যমে উচ্চারণ করে বা পড়ে যেসব আমল করা হয় তা সবই মৌখিক ইবাদতের মধ্যে শামিল হবে।
(ঙ) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা আমল করা। রুকূ-সিজদা আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা, মসজিদের দিকে ছালাতের জন্য রওয়ানা হওয়া, হজ্জ আদায় করা, ছিয়াম পালন করা, আল্লাহর দ্বীন সমুন্নত করার জন্য আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা ইত্যাদি যত প্রকার আমল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা করা হয় সবই এর মধ্যে শামিল হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বিনীতভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে (ছালাতে) দ-ায়মান হও’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৩৮)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا ارۡکَعُوۡا وَ اسۡجُدُوۡا وَ اعۡبُدُوۡا رَبَّکُمۡ وَ افۡعَلُوا الۡخَیۡرَ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ . وَ جَاہِدُوۡا فِی اللّٰہِ حَقَّ جِہَادِہٖ .
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা রুকূ‘ কর, সিজদা কর, তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর ও সৎকর্ম কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। আর আল্লাহর পথে জিহাদ কর, যেভাবে জিহাদ করা উচিত’ (সূরা আল-হজ্জ : ৭৭-৭৮)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,
وَ عِبَادُ الرَّحۡمٰنِ الَّذِیۡنَ یَمۡشُوۡنَ عَلَی الۡاَرۡضِ ہَوۡنًا وَّ اِذَا خَاطَبَہُمُ الۡجٰہِلُوۡنَ قَالُوۡا سَلٰمًا . وَ الَّذِیۡنَ یَبِیۡتُوۡنَ لِرَبِّہِمۡ سُجَّدًا وَّ قِیَامًا .
‘আর রহমানের বান্দা তারাই যারা (আল্লাহর) যমীনে বিনীতভাবে চলাফেরা করে এবং যখন অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে সম্বোধন করে তখন তারা বলে সালাম (শান্তি)। আর তারা রাত্রি অতিবাহিত করে তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদারত অবস্থায় ও দ-ায়মান হয়ে’ (সূরা আল-ফুরক্বান : ৬৩-৬৪)। এ সম্পর্কে কুরআন ও ছহীহ হাদীছে আরো অনেক দলীল বর্ণিত হয়েছে।[১৪]
ইমাম মুহাম্মাদ হুসাইন আল-আজুর্রী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ঈমান হচ্ছে অন্তরের বিশ্বাস, মুখের স্বীকৃতি এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা আমল করা। সুতরাং যার মধ্যে এ তিনটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে সে প্রকৃত ঈমানদার। এরপর তিনি বলেন, জেনে রেখ! আল্লাহ তোমাদের ও আমাদের উপর রহম করুন! মুসলিমদের আলেমগণ যে কথার উপর অটল আছেন সেটা হল, ঈমানের (অর্থ হচ্ছে) অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আমল করা সকল সৃষ্টির উপর ওয়াজিব। অতঃপর তিনি বলেন, জেনে রেখ! অন্তরের বিশ্বাস ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ হবে না, যতক্ষণ না তার সাথে মুখের স্বীকৃতি পাওয়া যাবে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত অন্তরের বিশ্বাস ও মুখের স্বীকৃতি পরিপূর্ণ হবে না যতক্ষণ না অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা আমল করবে। সুতরাং যার মধ্যে এ তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান সেই প্রকৃত ঈমানদার। আর এর উপরেই কুরআন ও হাদীছের দলীল এবং মুসলিম আলেমদের কথা প্রমাণিত রয়েছে’।[১৫]
মোদ্দাকথা আল্লাহর প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব সমূহের প্রতি, নবী-রাসূলদের প্রতি, পরকালের প্রতি, তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান আনতে হবে। আর সালাফী মানহাজের এটি একটি অন্যতম মৌলিক নীতিমালা।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* শিক্ষক, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাঘা, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮।
[২]. ইবনু মাজাহ, হা/৪২; ইবনু খুযাইমাহ, হা/১৭৮৫।
[৩]. আলবানী, ছালাতুত তারাবীহ, পৃ. ৮১।
[৪]. ত্বাবারানী আওসাত্ব, হা/৪২০২; বায়হাক্বী, হা/৯৪৫৬, সনদ ছহীহ।
[৫]. মুসনাদে ইবনুল জা‘আদ, হা/১৮০৯।
[৬]. মুসনাদে আবি ইয়া‘লা, হা/৫৮১৩।
[৭]. তিরমিযী, হা/৩৫৪০, সনদ ছহীহ।
[৮]. আবু দাঊদ, হা/৪৭৩৯; তিরমিযী, হা/২৪৩৫।
[৯]. আবূ দাঊদ, হা/৪০৯১।
[১০]. মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১ম খ-, পৃ. ১০৮।
[১১]. ইবনু মান্দাহ, কিতাবুল ঈমান, ১ম খ-, পৃ. ৩৩১।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৪।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/২৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২২।
[১৪]. মা‘আরিজুল কুবূল, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭৩৫-৭৪০।
[১৫]. আশ-শারী‘আহ, পৃ. ১১৯।
প্রসঙ্গসমূহ »:
সালাফে ছালেহীন