ইসলামে দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল
-আবূ মুশফিক ফাহিম*
সারসাংক্ষেপ
দারিদ্র্য সমগ্র বিশ্বের অন্যতম একটি বহুমাত্রিক সমস্যা। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ও মানুষ আজ দারিদ্র্য সমস্যায় জর্জরিত। বিশ্বের শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ বর্তমান দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। উন্নয়নশীল দেশসমূহে বিশেষ করে মুসলিম দেশসমূহে দারিদ্র্য উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান এই Pandemic Situation (Covid 19) এর পর বিশ্বের দারিদ্র্য সীমার হার কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা সকলের কাছে এখন ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দারিদ্র্য এমন অর্থনৈতিক অবস্থা, যখন একজন মানুষ জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান অর্জনে এবং স্বল্প আয়ের কারণে জীবনধারণের অপরিহার্য দ্রব্যাদি ক্রয় করার সক্ষমতা হারায়। এটি একটি অর্থনৈতিক প্রপঞ্চ। দারিদ্র্য বলতে বুঝায়, যার সামান্য সম্পদ ও অল্প আয় রয়েছে, যার দ্বারা সে ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজন মিটাতে ব্যর্থ। দারিদ্র্য নিরসনের জন্য যাকাত এক বিপ্লবী ও বহুমুখী প্রক্রিয়া। যাকাতের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার দারিদ্র্য বিমোচন, যা আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার মূল গ্যারান্টি। চলমান দারিদ্র্যাবস্থার জন্য কতিপয় কারণও দায়ী। যুগে যুগে অনেক জ্ঞান-তাপস ও এ বিষয়ের সুপণ্ডিত ব্যক্তিগণ যাকাতের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্পর্কে প্রভূত গবেষণা করেছেন। বর্তমানে দারিদ্র্য বিমোচন এখনও একটি চ্যালেঞ্জ। দারিদ্র্যের মোকাবেলা করার জন্য দরকার যথাযথ পরিকল্পনা, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও একাগ্রতা এবং সর্বোপরি দক্ষ ও সমন্বিত বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ ও কর্মপ্রেরণা। অতএব বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার মাধ্যমে ইসলামে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বাস্তবভিত্তিক কৗশল ও পদ্ধতি বিশ্লেষণ করে ন্যায়সঙ্গত কৌশল চিহ্নিত করাই এ প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়।
ভূমিকা
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান বাধা হল দারিদ্র্যতা। ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যতা বর্তমান বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় দারিদ্র্য বিমোচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হিসাবে বহু পূর্বেই স্থান পেয়েছে। ফলে দারিদ্র্যের প্রকটতা কিছুটা হ্রাস পেলেও ক্রমবর্ধমান হারে এর ব্যাপকতা ও গভীরতার বৃদ্ধি মারাত্মক উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠাকারী নামে পরিচিত আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘জাতিসংঘ’ দারিদ্রতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু এত কিছুর পরেও দারিদ্রতা কমানো যায়নি, বরং ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। মাত্র কয়টা টাকার জন্য নারী তার সতীত্ব পর্যন্ত বিকিয়ে দিচ্ছে। ‘মা’ তার সন্তানকে ক্ষুধার জ্বালায় বিক্রি করছে। ডাষ্টবিনের ময়লা পচা-বাসি খাবার খাওয়ার জন্য কুকুর-মানুষ এক সাথে লড়াই করছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতিদিন দারিদ্রতার কারণে মানুষ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে। পৃথিবীর লাখ লাখ বনী আদম তপ্ত মরুভূমিতে খাদ্যহীন, আশ্রয়হীনভাবে উদ্ধাস্তু অবস্থায় মানবেতর জীবন-যাপন করছে। আফগানিস্তান, ফিলিস্তীন, কাশ্মীর, ইরাক, ভারত, সুদান, কঙ্গো ও মায়ানমায়ারের আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গারা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এমন ভয়ানক পরিস্থিতিতে মানব কল্যাণে ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এবং দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ইসলামে যে ইতিবাচক-নেতিবাচক পদক্ষেপ ও কৌশল, প্রতিকারের প্রক্রিয়া রয়েছে তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পর্যালোচনা ও গবেষণা হওয়া একান্ত অবশ্যক।
দারিদ্র্য বিমোচনের ধারণাগত প্রত্যয় বিশ্লেষণ
দারিদ্র্য অন্যতম সামাজিক সমস্যা। এটি শুধু নিজেই সমস্যা নয় বরং অন্যান্য সমস্যার উৎসও বটে। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পথে দারিদ্র্য অন্যতম প্রতিবন্ধক। এর প্রভাব দেশ তথা সমাজের সকল দিকে পরিলক্ষিত হয়। মূলত দারিদ্র্য এমন একটি অবস্থা যখন মানুষ তার বেঁচে থাকার মত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় বা মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে দারিদ্র্য হচ্ছে এমন এক অবস্থা যা মানব জীবনের অব্যাহত প্রয়োজনীয় পণ্য বা মাধ্যম উভয়েরই অপর্যাপ্ততা থাকে।[১] আভিধানিক অর্থে ‘দারিদ্র্য’ বলতে অভাব-অনটনকে বুঝায়। এটি এক প্রকার নেতিবাচক অর্থনৈতিক অবস্থা। শব্দটি বাংলা। দারিদ্র্য এর আরবী প্রতিশব্দ হচ্ছে الفقر। এর আরবী বিপরীত শব্দ الغنى। যার অর্থ মুখাপেক্ষী। ‘তাজুল আরূস’ প্রণেতা বলেন, فَقُرَ শব্দটি كَرُمَ এর ওজনে এসেছে। এখান থেকেই فقير, যার অর্থ ফকীর দলের সদস্য বা দরিদ্রদের সদস্য’।[২] ‘তাহযীবুল লুগাত’ প্রণেতা বলেন, প্রয়োজনীয়তা বা অভাবগ্রস্ত হওয়া।[৩] আর الفقير যার অর্থ ভগ্ন মেরুদণ্ড। যখন মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহারিত হবে, তখন এর অর্থ হবে স্বল্প পরিমাণ খাবারের অধীকারী’।[৪] ইমাম আবূ হানীফা (৮০-১৫০ হি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
إِنَّ الْفَقِيْرَ أَحْسَنُ حَالًا مِنَ الْمِسْكِيْنِ قَالُوْا لِأَنَّ الْفَقِيْرَ هُوَ الَّذِيْ لَهُ بَعْضُ مَا يَكْفِيْهِ وَيُقِيْمُهُ وَالْمِسْكِيْنُ الَّذِيْ لَا شَيْءَ لَهُ
‘ফক্বীরের অবস্থা মিসকীনের চেয়ে ভাল। কেননা ফক্বীর যে কারো নিকটে হাত পেয়ে তার সমস্যা সমাধান করে। আর মিসকীন যার কিছুই নেই’।[৫]
মুহাম্মাদ ইবনু জারীর আত-ত্বাবারী (২২৪-৩১০ হি./৮৩৯-৯২৩ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, الفقير المحتاج المتعفف عن المسالة و المسكين المحتاج السائل ‘ফক্বীর বা দারিদ্র্য হচ্ছে সে যে অভাবগ্রস্থ ও ভিক্ষা বৃত্তি থেকে মুক্ত। আর মিসকীন ভিক্ষাকারী অভাবগ্রস্ত’।[৬]
হাসান আল-বাছরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, الفقير الجالس في بيته والمسكين الذى يسعي ‘ফক্বীর হচ্ছে সে যে তার বাড়ীতেই অবস্থান করে অন্যের দ্বারে দ্বারে যায় না। আর মিসকীন যে অন্যের দ্বারে দ রে যায়’।[৭]
ক্বাতাদা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, الفقير من به زمانه و مسكين الصحيح الجسم ‘ফক্বীর সে যে দুরারোগে আক্রান্ত আর মিসকীন যে সুস্থ দেহের অধিকারী’।[৮]
Dr. Ali Akbar বলেন, "Poverty is such an oppressive socio-economic condition where people cannot meet the bare subsistence if living; to depend on other for livelihood and to possess low status in the society". ‘দারিদ্র্য এমন এক পীড়াদায়ক আর্থ-সামাজিক অবস্থা, যাতে মানুষ জীবনধারণের উপায় মিটাতে পারে না; অন্যের উপর নির্ভর করে ও সমাজে নিম্ন মর্যাদা ধারণ করে’।[৯]
দারিদ্র্যের বিস্তারিত পরিচয় বর্ণনায় ‘দৈনিক আজকের কাগজে’র প্রদত্ত সংজ্ঞা হলো, ‘যার দক্ষতা আছে কাজ নেই, কর্মের সক্ষমতা আছে ব্যবসার পুঁজি নেই, দুর্যোগে পতিত হলে উত্তরণের বিকল্প নেই, মুখ আছে আহার নেই, শক্তি আছে বলার সুযোগ নেই, উন্নয়ন স্কীম আছে কিন্তু তার অংশগ্রহণ নেই, দেশে সম্পদ আছে তাতে তার মালিকানা নেই, জায়গা আছে মাথা গোঁজার ঠাই নেই, ভিটি আছে ঘর নেই। শরীর আছে কাপড় নেই, ঈদ আছে তার আনন্দ নেই, হাসপাতাল আছে চিকিৎসার সুযোগ নেই, শক্তি-মেধা-দক্ষতা আছে খাটানোর জায়গা নেই, ক্ষুধা আছে খাবার নেই, স্কুল আছে শিক্ষার সুযোগ নেই, ব্যাংক আছে কিন্তু তার জন্য ঋণ নেই অর্থাৎ যিনি ক্ষমতা ও সম্পদহীন তিনিই দরিদ্র’।[১০]
ইসলামী জীবন দর্শনে দারিদ্র্যকে দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা : (ক) আধ্যাত্মিক দারিদ্র্য এবং (খ) বস্তুগত দারিদ্র্য।[১১] এছাড়া ইসলামে দারিদ্র্যকে দু’টি স্তরে বিন্যাস করা যায়। একটি হলো কঠিন দারিদ্র্য, যার মধ্যে ফক্বীর ও মিসকীন পড়ে। অন্যটি হলো সাধারণ দারিদ্র্য, যার নিছাব পরিমাণ সম্পদ নেই।[১২]
দারিদ্র্যের প্রত্যয়গত ধারণা দু’টি স্তরে বিভক্ত। ১. দারিদ্র্যের পাশ্চাত্যের বস্তুতান্ত্রিক ধারণা এবং ২. দারিদ্র্যের ইসলামী ধারণা।
প্রথমতঃ দারিদ্র্যের পাশ্চাতের বস্তুতান্ত্রিক ধারণা
এটা আবার তিনটি ধারায় বিভক্ত। যেমন,
ক. দারিদ্র্যের বস্তুতান্ত্রিক ধারণা হলো জীবনের মৌলিক চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণে অক্ষমতা। যেমনটি মিখাইল রোজ বলেছেন।[১৩] সমাজতত্ত্ববিদ বুথ দারিদ্র্যকে অভাব ও বঞ্চনার মধ্যে দেখেতে চেয়েছেন। অর্থনীতিবিদ টাউনসেন্ড এবং রেইন দারিদ্র্যকে সামাজিক স্তরবিন্যাস এবং বৈষম্যের ভিতর খুঁজেছেন। আর স্তরবিন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শ্রেণী, মর্যাদা, ক্ষমতা, পেশা, আয়, শিল্প, সামাজিক গতিশীলতা অথবা এগুলো সব মিলিয়ে যা হয় তাই।[১৪] অর্থনীতিবিদ ওঝা, ডান্ডেকার, পাথ ও আহলুওয়ালিয়া দারিদ্র্যকে পুষ্টির ঘাটতি অথবা অপুষ্টির আঙ্গিকে দেখেছেন।[১৫] সুতরাং এভাবে দারিদ্র্য হলো একাধারে একটি বস্তুনির্ভর বাস্তবতা এবং তার চেয়েও বেশি, তা হলো একটি সামাজিক অনুভব যা সামাজিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা দ্বারা কালপরিক্রমায় একেক মাত্রায় ও রূপে নির্ধারিত হয়ে থাকে। সমাজে বৈষম্যের মাত্রা দ্বারা বহুলাংশেই দারিদ্র্যের চেহারা ও অনুভব নির্ধারিত হয়।[১৬]
খ. পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী ধারণা ও বৈষম্য : পুঁজিবাদী অর্থনীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো- জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গী, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রদর্শন, অবাধ ব্যক্ত স্বাধীনতা, উন্মুক্ত বা অবাধ অর্থনীতি, ব্যক্তির নিরংকুশ মালিকানা, লাগামহীন চিন্তার স্বাধীনতা ও পুরোপুরি সাম্রাজ্যবাদী।[১৭] জে জনউনমকির মতে, দারিদ্র্য হল এমন এক অবস্থা, যাতে প্রয়োজনসমূহ সম্পূর্ণভাবে পূরণ হয় না। ডেলটুসিং বলেছেন, মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় সম্পদের অপ্রতুলতাই হল দারিদ্র্য। থিওডরসনের মতে, দারিদ্র্য হল প্রাকৃতিক, সামাজিক ও মানসিক উপোষ। দারিদ্র্য কোন একজন বা একদল লোকের জীবনযাত্রার নিম্নমান যা যথেষ্ট সময় পর্যন্ত স্বাস্থ্য, আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার প্রতি অবমাননামূলক।[১৮] রবার্ট চেম্বার্স দারিদ্র্যকে জীবন ধারণের জন্য আয় এবং ব্যয়ের চৌহদ্দি থেকে আকস্মিক সংকটে পড়ার অবস্থা বা সম্ভাবনা, পরাধীনতা, নিরাপত্তাহীনতা, ক্ষমতাহীনতা এবং একাকীত্বের অবস্থা পর্যন্ত বিস্তৃতি দিয়েছেন।[১৯]
গ. পাশ্চাত্যের বস্তুতান্ত্রিক ব্যস্ততা : পুঁজিবাদে বস্তুগত সম্পদ আহরণে তৎপর পাশ্চাত্যের মডেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকা জোর গলায় দাবি করে, তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিবার, বন্ধু ও বিশ্বাস। কিন্তু বাস্তবে তাদের জীবনের অধিকাংশ সময়ই ব্যয় হয় বস্তুগত নানা সংগ্রহ ও ভোগ্য পণ্যের চাহিদা পূরণের জন্য। কোন না কোন ভাবে আমেরিকানরা বাজারের দাস হয়ে পড়ছে। শুধু আমেরিকা নয়, বিশ্ব জুড়েই ক্রমশ বেশি বেশি মানুষ এই ভাগ্য বরণের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।[২০] অথচ পাশ্চাত্যের বস্তুগত কল্যাণ সাধনায় ত্বরাপ্রিয় ব্যস্ত পরলোকে বিশ্বাসহীন মানুষ নিজের অজান্তেই নিজের অকল্যাণ করে বসে।
দ্বিতীয়তঃ দারিদ্র্যের ইসলামী ধারণা
দারিদ্র্যের ইসলামী ধারণা হলো, আল্লাহ তা‘আলাই প্রতিটি প্রাণীর জীবিকার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি মানুষ ও জিন জাতিকে আহার্য সহ যাবতীয় প্রয়োজনাদীর ব্যবস্থা করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوۃُ فَانۡتَشِرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَ ابۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِ اللّٰہِ وَ اذۡکُرُوا اللّٰہَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ
‘ছালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলকাল হও’ (সূরা আল-জুমু‘আহ : ১০)। তিনি আরো বলেন,
اَلَمۡ تَرَوۡا اَنَّ اللّٰہَ سَخَّرَ لَکُمۡ مَّا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ وَ اَسۡبَغَ عَلَیۡکُمۡ نِعَمَہٗ ظَاہِرَۃً وَّ بَاطِنَۃً
‘তোমরা কি দেখ না, আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করেছেন?’ (সূরা লুকমান : ২০)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
ہُوَ الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ ذَلُوۡلًا فَامۡشُوۡا فِیۡ مَنَاکِبِہَا وَ کُلُوۡا مِنۡ رِّزۡقِہٖ ؕ وَ اِلَیۡہِ النُّشُوۡرُ
‘তিনিই তো তোমাদের জন্য ভূমিকে সুগম করে দিয়েছেন; অতএব তোমরা তার দিক-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তাঁর প্রদত্ত জীবনোপকরণ হতে আহার্য গ্রহণ কর; পুনরুত্থান তো তাঁরই নিকট’ (সূরা আল-মুলক : ১৫)।
মূলত পৃথিবীতে রিযিক অন্বেষণ, শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন ও অপরের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করে আখিরাতে সফলকাম হওয়ার জন্য এবং আল্লাহর ‘ইবাদত করার উদ্দেশ্যেই মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে দারিদ্র্য এটি এমন ধরনের জীবন-যাপন, যা কোন সুস্থ গ্রাসাচ্ছদনের পর্যায়ে পড়ে না। এটা ব্যক্তির এমন এক অবস্থা যেখানে শুধু অব্যাহতভাবে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখা নয় বরং সুস্থ ও উৎপাদনমুখী অস্তিত্বের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য, পোশাক এবং আশ্রয়ের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের উপযোগী সম্পদের অভাব রয়েছে।[২১] এজন্য ইমাম গাজালী (রাহিমাহুল্লাহ) মানুষের প্রয়োজনকে জরুরিয়াত বা অত্যাবশ্যকীয়, হাজিয়াত বা প্রয়োজনীয় এবং তাহসিনিয়াত বা সৌন্দর্যবর্ধক মর্মে তিনটি স্তরে বিভক্ত করেছেন।[২২]
জাহিলী আরবের সমাজ ব্যবস্থায় ধনি-দরিদ্রদের মাঝে বিরাট ব্যবধান ছিল। দরিদ্র মানুষদের কোন অধিকার ছিল না। অতঃপর ইসলাম আগমন করে জাহিলী যুগের দরিদ্র অধিকার আদায়ে কিছু দৃঢ় প্রত্যয় ও পদক্ষেপের কথা স্পষ্টরূপে ঘোষণা করে। যেমন, ‘উশর[২৩], খারাজ বা ভূমিকর।[২৪], জিযিয়া[২৫], গনীমত[২৬], ফাই[২৭] এবং সাদাকাহ[২৮]। সুতরাং ইসলামে দারিদ্র্য বিমোচনে গৃহীত প্রত্যয় ও পদক্ষেপে উপরে বর্ণিত পদক্ষেপগুলো আজও যথাযথ বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব হলে দারিদ্র্য বিমোচনে দ্রুত সুফল বয়ে আনবে।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আল-ইসলামিয়্যাহ, খড়খড়ি, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র:
[১]. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম, “দারিদ্র্য বিমোচন : ইসলামী প্রেক্ষিত”, দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলাম (ঢাকা : ইসলামিক ইকোনমিকস রিসার্চ ব্যুরো, ১ম প্রকাশ ২০০৯ খ্রি.), পৃ. ২৪।
[২]. মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু ‘আব্দির রাজ্জাক আল-হাসীনী আয-যুবাইদী, তাজুল আরূস মিন জাওয়াহিরিল কামূস, ১৩শ খণ্ড (প্রকাশস্থান বিহীন : দারুল হিদায়াহ, তা.বি.), পৃ. ৩৩৬।
[৩]. আবূ মানসূর মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ আল-আজহারী, তাহজীবুল লুগাত, ৯ম খণ্ড (বৈরূত : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল ‘আরাবী, ১ম সংস্করণ ২০০১ খ্রি.), পৃ. ১০২।
[৪]. ইবরাহীম মোস্তফা, আহমাদ যিয়াত, হামিদ ‘আব্দুল কাদির ও মুহাম্মাদ আন-নাজ্জার, আল-মু‘জামুল ওয়াসীত, ২য় খণ্ড (প্রকাশস্থান বিহীন : দারুদ দাওয়াহ, তা.বি.), পৃ. ৬৯৭।
[৫]. মুহাম্মাদ ইবনু ‘আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু ‘আব্দিল্লাহ আশ-শাওকানী, ফাতহুল কাদীর, ২য় খণ্ড (দামিস্ক : দারু ইবনি কাসীর, ১ম সংস্করণ ১৪১৪ হি.), পৃ. ৪২৫।
[৬]. মুহাম্মাদ ইবনু জারীর ইবনু ইয়াযীদ ইবনু কাসীর ইবনু গালিব আল-আমালী আবূ যা‘ফর আত-তাবারী, জামি‘উল বায়ান ফী তা‘বীলিল কুরআন, ১৪ খণ্ড (মুয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ১ম প্রকাশ ১৪২০ হি./২০০০খ্রি.), পৃ: ৩০৫-৩০৬ ।
[৭]. প্রাগুক্ত।
[৮]. আবুল ফিদা ইসমা‘ঈল ইবনু ‘উমার ইবনু কাসীর আল-কুরাইশী আদ-দিমাশকী, তাফসীরুল কুরআনীল ‘আযীম, ৪র্থ খণ্ড (দারুত তাইয়েবা, ২য় সংস্করণ ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.), পৃ. ১৬৫-১৬৬।
[৯]. মোঃ শহীদুল্লাহ, সামাজিক সমস্যা বিশ্লেষণ (ঢাকা : গ্রন্থ কুটির, পুনর্মুদ্রণ জানুয়ারী, ২০১৮/’১৯), পৃ. ৯১।
[১০]. দৈনিক আজকের কাগজ, ২৩ জুলাই, ১৯৯৩।
[১১]. ইমাম গাযালী, হুজ্জাতুল ইসলাম, কিমিয়ায়ে সাআদাত, অনুবাদক: মাওলানা নূরুর রহমান, ১ম খণ্ড (ঢাকা : এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ১৯৯৫, পৃ. ৮৬-৯৩, ১৫৬-১৫৭।
[১২]. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম, “দারিদ্র্য বিমোচন : ইসলামী প্রেক্ষিত”, দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলাম, পৃ. ২৪-২৫।
[১৩]. Michael Roye, The relief of Poverty, Macmillan, London.
[১৪]. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম, “দারিদ্র্য বিমোচন : ইসলামী প্রেক্ষিত”, দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলাম, পৃ. ১৮।
[১৫]. P.D. Ojha, Configuration of Indian Poverty, 1970, RDI Bulletin, 24 (1), P-1-12; S. Montek Ahluwalia, Rural Poverty and Agricultural Performance in India", Journal of Development Studies, 1978.
[১৬]. মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ”ক্ষুদ্রঋণের জন্য খাই-খালাসী আইন প্রয়োজন”, দৈনিক ইত্তেফাক, ৫৮তম বর্ষ, ৩২২তম সংখ্যা, ২২ নভেম্বর, ২০১০, পৃ. ১০।
[১৭]. শাহ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, ইসলামী অর্থনীতি নির্বাচিত প্রবন্ধ (রাজশাহী : দি রাজশাহী স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, ২য় সংস্করণ, জানুয়ারী ২০০০ খ্রি.), পৃ. ২৪৬।
[১৮]. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম, “দারিদ্র্য বিমোচন : ইসলামী প্রেক্ষিত”, দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলাম, পৃ. ২১।
[১৯]. Roberr Chambers, 1988 : `Poverty in India, concepts Research and Reality', Discussion paper 241, IDS, Sussex.
[২০]. মিতবাক, ”দিন বদলায়”, দৈনিক ইত্তেফাক, ৫৮তম বর্ষ, ৩২৩তম, সংখ্যা, ২৩ নভেম্বর, ২০১০, পৃ. ১০।
[২১]. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম, “দারিদ্র্য বিমোচন : ইসলামী প্রেক্ষিত”, দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলাম, পৃ. ২২।
[২২]. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫।
[২৩]. আবুল হাসান নূরুদ্দীন মোল্লা আলী ক্বারী, মিরকাতুল মাফাতীহ শারহু মিশকাতিল মাসাবীহ, ৪র্থ খণ্ড (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১ম সংস্করণ ১৪০২ হি./২০০২ খ্রি.), পৃ. ১২৮০; মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াজীদ আবূ ‘আব্দিল্লাহ আল-কাজভীনী, সুনানু ইবনি মাজাহ, ১ম খণ্ড (বৈরূত : দারুল ফিকর, তা.বি.), পৃ. ৫৮১, হাদীস নং-১৮১৮; অধ্যাপক মোঃ রুহুল আমীন, ইসলামের দৃষ্টিতে উশর : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত (ঢাকা : ইসলামিক ইকনমিক্স রিসার্চ ব্যুরো, ১৯৯৯), পৃ. ১৩-১৪।
[২৪]. হাফিয মুহাম্মদ ইবরাহিম তাহির কিলানি, মাওলানা তানভির আহমদ ও হাফিয আবদুল্লাহ নাসির মাদানি, সীরাত বিশ্বকোষ, অনুবাদ : আবদুল কাইয়ুম শেখ, ৫ম খণ্ড (ঢাকা : মাকতাবাতুল আযহার, ১ম প্রকাশ, ২০১৯ খ্রি.), পৃ. ১৪২; ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, বাংলাদেশে উশর বা ফসলের যাকাত : গুরুত্ব ও প্রয়োগ (ঝিনাইদহ : আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, ২য় সংস্করণ ২০০৯ খ্রি.), পৃ. ৮০-৮১।
[২৫]. আহমাদ ইবনু ‘আব্দিল হালীম ইবনু তাইমিয়্যাহ, আস-সিয়াসাহ আশ-শার‘ঈয়্যাহ ফী ইসলাহির রা‘য়ী ওয়ার রা‘ইয়্যাতি (বৈরুত : দারুল মা‘আরিফাহ, তা.বি.), পৃ. ৬২।
[২৬]. সীরাত বিশ্বকোষ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৪০-১৪১; কাযী আবূ ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফাহ, তা.কি.), পৃ. ২২।
[২৭]. সূরাহ আল-হাশর : ৬; সীরাত বিশ্বকোষ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৪১-১৪২।
[২৮]. সূরাহ আল-বাকারাহ : ১৯৫; সূরাহ আয-যারিয়াত : ১৯; সূরাহ আর-বাকারাহ : ২৬৭।
প্রসঙ্গসমূহ »:
সমাজ-সংস্কার