ইখলাছই পরকালের জীবনতরী
-আব্দুল গাফফার মাদানী*
(৪র্থ কিস্তি)
৮. সাধারণ মুবাহ কর্মকে মহৎ কর্মে রূপান্তর
বান্দার যাবতীয় কর্ম বিশুদ্ধ ও সৎ নিয়তের সাথে সংগঠিত হলে তা আল্লাহর নিকট অনেক মূল্যবান হয়ে যায়। হাদীছে এসেছে,
وَفِيْ بُضْعِ أَحَدِكُمْ صَدَقَةٌ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ أَيَأتِيْ أَحَدُنَا شَهْوَتَهُ وَيَكُوْنُ لَهُ فِيْهَا أَجْرٌ؟ قَالَ أَرَأَيْتُمْ لَوْ وَضَعَهَا فِيْ حَرَامٍ أَكَانَ عَلَيْهِ فِيْهَا وِزْرٌ؟ فَكَذَلِكَ إِذَا وَضَعَهَا فِي الْحَلَالِ كَانَ لَهُ أَجْرٌ
‘তোমাদের স্ত্রী মিলনেও রয়েছে ছাদাক্বার ছওয়াব। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ধ! আমাদের কেউ তার প্রবৃত্তি কামনা পূর্ণ করবে আর তাতেও তার ছওয়াব হবে? রাসূল (ﷺ) বললেন, তোমরা কি মনে কর, যদি সে তার প্রবৃত্তি কামনা হারাম কাজে ব্যবহার করত, তাহলে কি সে ক্ষেত্রে পাপ হত না? অনুরূপভাবে যখন সে তার প্রবৃত্তি কামনা হালাল পথে ব্যবহার করবে, তখন তার ছওয়াব হবে’।[১] তিনি আরো বলেন,
إِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللهِ إِلَّا أُجِرْتَ عَلَيْهَا حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِيْ فَمِ امْرَأَتِكَ
‘তুমি আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে যাই ব্যয় কর না কেন, তোমাকে তার প্রতিদান নিশ্চিতরূপে প্রদান করা হবে। এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যা তুলে দাও, তারও (প্রতিদান পাবে)’।[২]
ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৩১-৬৭৬ হি.) বলেন, ‘যখন মুবাহ আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা হয়, তখন সে আমল মহৎ কর্মে পরিণত হয় এবং তার প্রতিদান দেয়া হয়। নিজ স্ত্রী উপভোগ করার ক্ষেত্রে যখন উদ্দেশ্য থাকবে স্ত্রীর হক্ব আদায় করা, তার সাথে সদাচরণ করা অথবা সৎ সন্তানের আকাক্সক্ষা, নিজেকে ও স্ত্রীকে হারাম দৃষ্টি, চিন্তা বা কাজ থেকে হেফাযত করা, তখন তা ইবাদতে পরিণত হয়’।[৩]
অর্থাৎ যে কোন মুবাহ কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করলেই তিনি সে কাজে ছওয়াব দান করেন। যেমন সঠিক সময় খাওয়া, পান করা ও ঘুমানো, যাতে করে সঠিক সময়ে আল্লাহর ইবাদত করতে সমস্যা না হয়। এ সম্পর্কে যায়েদ আল-ইয়ামী বলেন,
إِنِّىْ لَأُحِبُّ أَنْ تَكُوْنَ لِىْ نِيَّةٌ فِىْ كُلِّ شَيْئٍ حَتَّى فِى الطَّعَامِ وَالشَّرَابِ
‘আমি প্রত্যেক মুবাহ কাজে নিয়ত করা অতি পসন্দ করি। এমনকি খানা-পিনার সময়েও’। এই কারণে সালাফগণ প্রত্যেক মুবাহ কাজে সৎ নিয়ত করতেন, যাতে তাদের কোন আমল ছওয়াব মুক্ত না হয়। কেননা বান্দার নিয়ত সৎ ও স্বচ্ছ হলে আল্লাহ তাকে প্রতিদান দেন, যদিও একটি লুকমার বিনিময়ে হয়। যেমনভাবে ইখলাছ মুবাহ আমলকে মহৎ আমলে উন্নীত করে। পক্ষান্তরে রিয়া (লোক দেখানো) আমল মহৎ আমলকে জঘন্য গুনাহে রূপান্তরিত করে ফেলে। মহান আল্লাহ বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تُبۡطِلُوۡا صَدَقٰتِکُمۡ بِالۡمَنِّ وَ الۡاَذٰی ۙ کَالَّذِیۡ یُنۡفِقُ مَالَہٗ رِئَآءَ النَّاسِ وَ لَا یُؤۡمِنُ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ
‘হে বিশ্বাসীগণ! কষ্ট ও খোঁটা দিয়ে তোমরা তোমাদের দানকে ঐ ব্যক্তির ন্যায় নিষ্ফল করিও না, যে নিজের ধন লোক দেখানোর জন্য ব্যয় করে থাকে এবং আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান রাখে না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৬৪)।
৯. সৎ নিয়তে আমলের সমপরিমাণ নেকী অর্জন
কখনো সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অর্থসংকট বা অসুস্থতার কারণে সে সৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। আবার কখনো কল্যাণ কাজ করার প্রচেষ্টা করেও গন্তব্যে পৌঁছা যায় না। কিন্ত আল্লাহ তা‘আলা ব্যক্তির অন্তরের ইখলাছের ফলে ঐ কর্মে তাকে পুরোপুরি প্রতিদান দিয়ে থাকেন। রাসূল (ﷺ) বলেন,
إِنَّ أَقْوَامًا بِالْمَدِيْنَةِ خَلْفَنَا مَا سَلَكْنَا شِعْبًا وَلَا وَادِيًا إِلَّا وَهُمْ مَعَنَا فِيْهِ حَبَسَهُمُ العُذْرُ
‘কিছু ব্যক্তি মদীনায় আমাদের পিছনে রয়েছে। তাদের সঙ্গ ব্যতীত আমরা কোন ঘাঁটি বা উপত্যকায় চলিনি। ওযর-ই তাদের আটকে রেখেছে’[৪] এবং إِلَّا شَرِكُوْكُمْ فِي الْأَجْرِ ‘তবে তারা তোমাদের সাথে ছওয়াবে শামিল হয়েছে’।[৫] তিনি আরো বলেন,
مَنْ أَتَى فِرَاشَهُ وَهُوَ يَنْوِي أَنْ يَّقُوْمَ يُصَلِّي مِنَ اللَّيْلِ فَغَلَبَتْهُ عَيْنَاهُ حَتَّى أَصْبَحَ كُتِبَ لَهُ مَا نَوَى وَكَانَ نَوْمُهُ صَدَقَةً عَلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ عَزَّ وَجَلَّ
‘যে ব্যক্তি তাহাজ্জুদের ছালাত পড়ার নিয়ত করে ঘুমাতে যায় কিন্তু তার চক্ষুদ্বয় ঘুমে বিভোর থাকে; এমনকি সে সকাল করে ফেলে, তার জন্য তাই লেখা হবে যা সে নিয়ত করে। আর তার এই ঘুম-ই হবে আল্লাহর পক্ষ হতে ছাদাক্বাহ’।[৬] তিনি আরো বলেন,
مَنْ سَأَلَ اللهَ الشَّهَادَةَ بِصِدْقٍ بَلَّغَهُ اللهُ مَنَازِلَ الشُّهَدَاءِ وَإِنْ مَاتَ عَلَى فِرَاشِهِ
‘যে সততার সাথে শহীদ হওয়ার কামনা করে আল্লাহ তাকে শহীদী মর্যাদা দান করেন, যদিও সে আপন বিছানায় মৃত্যুবরণ করে’।[৭] অন্য হাদীছে এসেছে
وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالًا وَلَمْ يُؤْتِهِ عِلْمًا فَهُوَ يَخْبِطُ فِيْ مَالِهِ يُنْفِقُهُ فِيْ غَيْرِ حَقِّهِ وَرَجُلٌ لَمْ يُؤْتِهِ اللهُ عِلْمًا وَلَا مَالًا فَهُوَ يَقُوْلُ لَوْ كَانَ لِي مِثْلُ هَذَا عَمِلْتُ فِيْهِ مِثْلَ الَّذِيْ يَعْمَلُ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ فَهُمَا فِي الْوِزْرِ سَوَاءٌ
‘আল্লাহ এক ব্যক্তিকে সম্পদ দান করেছেন কিন্তু জ্ঞান দান করেননি। সে তার মালে ভ্রষ্টনীতি গ্রহণ করে তা অন্যায় পথে ব্যয় করে। আর এক ব্যক্তি যাকে আল্লাহ জ্ঞান ও সম্পদ কোনটাই দান করেননি। সে বলে, ঐ ব্যক্তির মত আমারও সম্পদ থাকলে আমি তার মত তা (ভ্রষ্ট) কাজে লাগাতাম। রাসূল (ﷺ) বলেন, এই দুই ব্যক্তি সমান অপরাধী’।[৮]
ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৬১-৭২৮ হি.) বলেন, ‘শুধু নিয়তের কারণে ছওয়াব দান করা হয় এবং নিয়তবিহীন আমলে কোন ছওয়াব দেয়া হয় না। অতএব কুরআন, ছহীহ সুন্নাহ্ ও ইমামগণের ঐকমত্যে, কেউ যদি ইখলাছবিহীন আমল করে, তাহলে তা গ্রহণ করা হয় না। রাসূল (ﷺ) বলেন, مَنْ هَمَّ بِحَسَنَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كُتِبَتْ لَهُ حَسَنَةً ‘যে ব্যক্তি কোন সৎ কাজের নিয়ত করল কিন্তু সে তা পালন করল না, তবুও তার জন্য একটি ছওয়াব লেখা হয়’।[৯]
মুখলিছ ব্যক্তির কাজটি যদি যথাস্থানে না-ও পৌঁছে, তবুও মহান আল্লাহ তাকে তার ইখলাছের বিশুদ্ধতার বিনিময়ে পূর্ণ ছওয়াব দান করেন। এ প্রসঙ্গে রাসূল (ﷺ) বলেন,
قَالَ رَجُلٌ لَأَتَصَدَّقَنَّ اللَّيْلَةَ بِصَدَقَةٍ فَخَرَجَ بِصَدَقَتِهِ فَوَضَعَهَا فِيْ يَدِ زَانِيَةٍ فَأَصْبَحُوْا يَتَحَدَّثُوْنَ تُصُدِّقَ اللَّيْلَةَ عَلَى زَانِيَةٍ قَالَ اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ عَلَى زَانِيَةٍ لَأَتَصَدَّقَنَّ بِصَدَقَةٍ فَخَرَجَ بِصَدَقَتِهِ فَوَضَعَهَا فِيْ يَدِ غَنِيٍّ فَأَصْبَحُوْا يَتَحَدَّثُوْنَ تُصُدِّقَ عَلَى غَنِيٍّ قَالَ اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ عَلَى غَنِيٍّ لَأَتَصَدَّقَنَّ بِصَدَقَةٍ فَخَرَجَ بِصَدَقَتِهِ فَوَضَعَهَا فِيْ يَدِ سَارِقٍ فَأَصْبَحُوْا يَتَحَدَّثُوْنَ تُصُدِّقَ عَلَى سَارِقٍ فَقَالَ اللهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ عَلَى زَانِيَةٍ وَعَلَى غَنِيٍّ وَعَلَى سَارِقٍ فَأُتِيَ فَقِيْلَ لَهُ أَمَّا صَدَقَتُكَ فَقَدْ قُبِلَتْ أَمَّا الزَّانِيَةُ فَلَعَلَّهَا تَسْتَعِفُّ بِهَا عَنْ زِنَاهَا وَلَعَلَّ الْغَنِيَّ يَعْتَبِرُ فَيُنْفِقُ مِمَّا أَعْطَاهُ اللهُ وَلَعَلَّ السَّارِقَ يَسْتَعِفُّ بِهَا عَنْ سَرِقَتِهِ
‘এক ব্যক্তি বলল, আমি কিছু ছাদাক্বাহ করব। ছাদাক্বাহ নিয়ে বের হয়ে সে এক ব্যভিচারিণীর হাতে দিয়ে দিল। সকালে লোকেরা বলাবলি করতে লাগল, ব্যভিচারিণীকে ছাদাক্বাহ দেয়া হয়েছে। এতে সে বলল, হে আল্লাহ! সকল প্রশংসা আপনারই, আমি অবশ্যই ছাদাক্বাহ করব। ছাদাক্বাহ নিয়ে আবার বের হয়ে তা এক ধনীর হাতে দিল। সকালে লোকেরা বলাবলি করতে লাগল, রাতে এক ধনীকে ছাদাক্বাহ দেয়া হয়েছে। লোকটি বলল, হে আল্লাহ! সকল প্রশংসা আপনারই, আমি অবশ্যই ছাদাক্বাহ করব। পুনরায় ছাদাক্বাহ নিয়ে আবার বের হয়ে তা এক চোরের হাতে দিল। সকালে লোকেরা বলাবলি করতে লাগল, রাতে এক চোরকে ছাদাক্বাহ দেয়া হয়েছে। লোকটি বলল, হে আল্লাহ! সকল প্রশংসা আপনারই, আমার প্রদত্ত্ব ছাদাক্বাহ চোর, ব্যভিচারিণী ও ধনী ব্যক্তির হাতে গিয়ে পড়েছে। পরে স্বপ্নযোগে তাকে বলা হল, তোমার ছাদাক্বাহ কবুল করা হয়েছে। তোমার ছাদাক্বাহর কারণে ব্যভিচারিণী সম্ভবতঃ তার ব্যভিচার হতে পবিত্র থাকবে। ধনী ব্যক্তি সম্ভবতঃ শিক্ষা গ্রহণ করবে এবং আল্লাহর দেয়া সম্পদ হতে ছাদাক্বাহ করবে। আর চোর সম্ভবতঃ চুরি করা থেকে বিরত থাকবে’।[১০]
১০. বিপদ থেকে মুক্তিলাভ
নিয়তের সততা থাকার কারণে আল্লাহ দুনিয়ার বালা-মুছিবত থেকে রক্ষা করেন এবং দুঃখ-কষ্ট দূর করেন। মহান আল্লাহ বলেন, وَ لَقَدۡ ضَلَّ قَبۡلَہُمۡ اَکۡثَرُ الۡاَوَّلِیۡنَ ‘তাদের আগেও পূর্ববর্তীদের অধিকাংশ বিপথগামী হয়েছিল’ (ছাফ্ফাত ৭১)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,
ہُوَ الَّذِیۡ یُسَیِّرُکُمۡ فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ ؕ حَتّٰۤی اِذَا کُنۡتُمۡ فِی الۡفُلۡکِ ۚ وَ جَرَیۡنَ بِہِمۡ بِرِیۡحٍ طَیِّبَۃٍ وَّ فَرِحُوۡا بِہَا جَآءَتۡہَا رِیۡحٌ عَاصِفٌ وَّ جَآءَہُمُ الۡمَوۡجُ مِنۡ کُلِّ مَکَانٍ وَّ ظَنُّوۡۤا اَنَّہُمۡ اُحِیۡطَ بِہِمۡ ۙ دَعَوُا اللّٰہَ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ الدِّیۡنَ ۬ۚ لَئِنۡ اَنۡجَیۡتَنَا مِنۡ ہٰذِہٖ لَنَکُوۡنَنَّ مِنَ الشّٰکِرِیۡنَ- فَلَمَّاۤ اَنۡجٰہُمۡ اِذَا ہُمۡ یَبۡغُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ بِغَیۡرِ الۡحَقِّ ؕ یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اِنَّمَا بَغۡیُکُمۡ عَلٰۤی اَنۡفُسِکُمۡ ۙ مَّتَاعَ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۫ ثُمَّ اِلَیۡنَا مَرۡجِعُکُمۡ فَنُنَبِّئُکُمۡ بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ
‘তিনি তোমাদেরকে জল-স্থলে ভ্রমণ করান এবং তোমরা যখন নৌকারোহী হও ও সেগুলো আরোহী নিয়ে অনুকূল বাতাসে বয়ে যায়, তারা তাতে আনন্দিত হয়। অতঃপর এগুলো ব্যহ্যত ও সর্বদিক হতে তরঙ্গায়িত হয় এবং তারা তার দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছে মনে করে, তখন তারা আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে আল্লাহকে ডেকে বলে, তুমি আমাদেরকে এ বিপদ হতে পরিত্রাণ দিলে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞদের অর্ন্তভুক্ত হব। অতঃপর তিনি যখনই তাদেরকে বিপদ-মুক্ত করেন, তখনই তারা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে যুলুম করতে থাকে। হে মানুষ! তোমাদের যুলুম বস্তুতঃ তোমাদের নিজেদের প্রতিই হয়ে থাকে। পার্থিব জীবনে সুখ ভোগ করে নাও, পরে আমার নিকটেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন হবে। তখন আমি তোমাদেরকে তোমাদের কৃতকর্ম জানিয়ে দেব’ (সূরা ইউনুস: ২২-২৩)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,
وَ اِذَا غَشِیَہُمۡ مَّوۡجٌ کَالظُّلَلِ دَعَوُا اللّٰہَ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ الدِّیۡنَ ۬ۚ فَلَمَّا نَجّٰہُمۡ اِلَی الۡبَرِّ فَمِنۡہُمۡ مُّقۡتَصِدٌ ؕ وَ مَا یَجۡحَدُ بِاٰیٰتِنَاۤ اِلَّا کُلُّ خَتَّارٍ کَفُوۡرٍ
‘যখন তরঙ্গ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে মেঘাচ্ছন্নের মত, তখন তারা আল্লাহকে ডাকে তাঁর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে। কিন্তু যখন তিনি তাদেরকে উদ্ধার করে স্থলে পৌঁছান, তখন তাদের কেউ কেউ সরল পথে থাকে; কেবল বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিই আমার নির্দেশনাবলী অস্বীকার করে’ (সূরা লুক্বমান: ৩২)। এ সম্পর্কে একটি হাদীছের নিম্নে সার-সংক্ষেপ তুলে ধরা হল- ‘বিপদের সময় তিনজন ব্যক্তি গুহায় আশ্রয় নিলে তাদের সে গুহাটির প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর তারা পর্যায়ক্রমে তাদের জীবনের সৎ আমলের কথা স্মরণ করে বলে, হে আল্লাহ! সে আমলটি যদি তোমার মনতুষ্টির জন্য করে থাকি, তাহলে তুমি আমাদেরকে এই বিপদ থেকে রক্ষা কর। এক পর্যায়ে আল্লাহ তাদেরকে সেই মহা বিপদ থেকে রক্ষা করেন এবং তারা সেখান থেকে মুক্তি পায়’।[১১]
সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) -এর বরাতে মক্কা বিজয়ের ঘটনায় বর্ণিত হয়েছে যে, ‘ইকরিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) একদা সমুদ্রে আরোহণকালে একপর্যায়ে তাদের নৌকাটি বিপদের কবলে পড়লে তিনি বলেন, হে আল্লাহ! তুমি যদি আমাদের এই বিপদ থেকে নিরাপত্তা দান কর, তাহলে আমি মুহাম্মাদের ধর্মের প্রতি ঈমান আনব। এরপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন’।[১২]
১১. শয়তানের প্রতারণা থেকে সুরক্ষা
শয়তান সর্বদা মানুষকে ধোঁকায় ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে এবং খারাপ আমলগুলো তার জন্য জাঁকজমকপূর্ণ করে তুলে। কিন্তু আল্লাহ তাঁর মুখলিছ বান্দাদেরকে তার চক্রান্ত থেকে হেফাযত করেন। আল্লাহ বলেন,
قَالَ رَبِّ بِمَاۤ اَغۡوَیۡتَنِیۡ لَاُزَیِّنَنَّ لَہُمۡ فِی الۡاَرۡضِ وَ لَاُغۡوِیَنَّہُمۡ اَجۡمَعِیۡنَ- اِلَّا عِبَادَکَ مِنۡہُمُ الۡمُخۡلَصِیۡنَ
‘সে (শয়তান) বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি যে আমাকে বিপথগামী করলেন তার জন্য আমি পৃথিবীতে মানুষের নিকট পাপকর্মকে অবশ্যই শোভনীয় করে তুলব এবং আমি তাদের সকলকেই বিপথগামী করব, তবে তাদের মধ্যে আপনার নির্বাচিত সৎকর্মশীল বান্দাগণ ব্যতীত’ (সূরা আল-হিজর: ৩৯-৪০)। অন্যত্র তিনি বলেন,
قَالَ فَبِعِزَّتِکَ لَاُغۡوِیَنَّہُمۡ اَجۡمَعِیۡنَ- اِلَّا عِبَادَکَ مِنۡہُمُ الۡمُخۡلَصِیۡنَ
‘সে বলল, আপনার ক্ষমতার শপথ! আমি তাদের সকলকেই পথভ্রষ্ট করব, তবে তাদের মধ্যে আপনার নির্বাচিত সৎকর্মশীল বান্দাগণ ব্যতীত’ (সূরা ছোয়াদ: ৮২-৮৩)। আবূ সুলায়মান আদ-দারানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,إِذَا أَخْلَصَ الْعَبْدُ انْقَطَعَتْ عَنْهُ كَثْرَةُ الْوَسَاوِسِ وَالرِّيَاءِ ‘বান্দা যখন একনিষ্ঠভাবে আমল করে তখন তার থেকে কুমন্ত্রণা ও রিয়া দূরীভূত হয়ে যায়’।[১৩] মা‘রূফ কেঁদে কেঁদে বলতেন, يَا نَفْسُ كَمْ تَبْكِيْنَ؟ أَخْلِصِيْ تَخْلُصِيْ ‘হে অন্তর! কতই না ক্রন্দন করছ, তুমি ইখলাছপূর্ণ আমল কর, তাহলে তুমি শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পাবে’।[১৪]
ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৬১-৭২৮ হি.) বলেন, ‘যখন কেউ তার রবের জন্য ইখলাছপূর্ণ আমল করে, তখন তার রব তাকে পসন্দ করেন। অতঃপর তার অন্তর পুনরুজ্জীবিত করেন। সে তার রবের প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং তার থেকে সব ধরনের অন্যায় অশ্লীলতা ফিরিয়ে দেন। এই অন্তরটি ঐ অন্তরের বিপরীত, যে অন্তরে আল্লাহর ইখলাছ নেই। সেই অন্তর শুধু (দুনিয়ার) সন্ধানে এবং সাধারণ ভালোবাসায় লিপ্ত থাকে। কখনো হারামের দিকে ধাবিত হয়। সে শুধু তার মনের পূজা করে, যার ফলে সে মানুষের নিকট শত্রু এবং সমালোচনার পাত্র হয়ে পড়ে’।[১৫]
১২. কল্যাণ, ভদ্রতা এবং শান্তি অর্জন
শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৬১-৭২৮ হি.) বলেন, ‘কথিত আছে যে, কিছু লোক শুনেছে, যে ব্যক্তি ৪০ দিন আল্লাহর জন্য ইখলাছের সাথে আমল করবে সে ব্যক্তির বিচক্ষণতা অন্তর থেকে বের হয়ে মুখে প্রকাশ পাবে। এক ব্যক্তি মনে মনে ৪০ দিন ইখলাছ করার পরে ‘হিকমাহ’ না পেয়ে হাকীমের নিকট অভিযোগ করে। হাকীম তাকে বলেন, তুমি তো আল্লাহর জন্য ইখলাছ করনি বরং তুমি ‘হিকমাহ’ পাওয়ার আশায় করেছ’।[১৬]
১৩. ফেৎনা থেকে মুক্তি লাভ
ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) ফেৎনা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
وَ لَقَدۡ ہَمَّتۡ بِہٖ ۚ وَ ہَمَّ بِہَا لَوۡ لَاۤ اَنۡ رَّاٰ بُرۡہَانَ رَبِّہٖ ؕ کَذٰلِکَ لِنَصۡرِفَ عَنۡہُ السُّوۡٓءَ وَ الۡفَحۡشَآءَ ؕ اِنَّہٗ مِنۡ عِبَادِنَا الۡمُخۡلَصِیۡنَ
‘সেই রমণী তো তার প্রতি আসক্ত হয়েছিল এবং সেও তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ত যদি না সে তার প্রতিপালকের নিদর্শন প্রত্যক্ষ করত। আমরা তাকে মন্দকর্ম ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখার জন্য এভাবে নিদর্শন দেখিয়েছিলাম। সে তো ছিল আমার বিশুদ্ধচিত্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত’ (ইউসুফ ২৪)। উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) -কে অশ্লীলতা এবং বেহায়াপনা থেকে রক্ষা করেছেন তার ইখলাছের বিনিময়ে। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালবাসে এবং তাঁর জন্যই একনিষ্ঠতা প্রকাশ করে সে ব্যক্তির অন্তরটা তার প্রেমিক আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত থাকে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠতা প্রকাশ করে না সে ব্যক্তির অন্তর অন্যের ইবাদত করে’।[১৭]
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (ﷺ) (৬৯১-৭৫১ হি.) বলেন, ‘গুনাহের মূলনীতি ৩টি। যথা : (১) অন্তরের ধ্যান আল্লাহ ছাড়া অন্যের সাথে থাকা, (২) ক্রোধের বশবর্তী হয়ে কোন কাজ করা ও (৩) কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করা। এগুলোর আসল রূপ হল শিরক, যুলুম ও অশ্লীলতা। এ তিনটির একটি অপরটির দিকে আহ্বান করে। যেমন শিরক আহ্বান করে যুলুম ও অশ্লীলতার দিকে। এর বিপক্ষে ইখলাছ ও তাওহীদ তা প্রতিহত করে’।[১৮] মহান আল্লাহ বলেন, کَذٰلِکَ لِنَصۡرِفَ عَنۡہُ السُّوۡٓءَ وَ الۡفَحۡشَآءَ ؕ اِنَّہٗ مِنۡ عِبَادِنَا الۡمُخۡلَصِیۡنَ ‘আমরা তাকে মন্দ কর্ম ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখার জন্য এভাবে নিদর্শন দেখিয়েছিলাম। সে তো ছিল আমাদের বিশুদ্ধচিত্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত’ (সূরা ইউসুফ: ২৪)।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* শিক্ষক, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাঘা, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০০৬।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬।
[৩]. আবূ যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনু শারফ আন-নববী, আল-মিনহাজ শারহু ছহীহ মুসলিম (বৈরূত : দারু ইহইয়াউত তুরাছিল আরাবী, ২য় সংস্করণ, ১৩৯২ হি.), ১১শ খণ্ড, পৃ. ১১২।
[৪]. ছহীহ বুখারী হা/২৮৩৯ ।
[৫]. ছহীহ মুসলিম হা/১৯১১।
[৬]. নাসাঈ হা/১৭৮৭; ছহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২১, সনদ হাসান ছহীহ।
[৭]. ছহীহ মুসলিম হা/১৯০৯।
[৮]. ইবনু মাজাহ হা/৪২২৮, সনদ ছহীহ।
[৯]. ছহীহ মুসলিম হা/৩৫৪।
[১০]. ছহীহ বুখারী হা/১৪২১।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/২২৭২; ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৪৩।
[১২]. নাসাঈ, হা/৪৬৭, সনদ ছহীহ।
[১৩]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯২।
[১৪]. সিয়ারু ‘আলামিন নুবালা, ৯ম খণ্ড, পৃ. ৩৪১।
[১৫]. আল্লামা ইমাম ইবনু তায়মিয়া, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ১৪শ খণ্ড, পৃ. ৩৩২; ইমাম ইবনু তায়মিয়া, আল-হাসানাতু ওয়াস সায়ইয়াহ (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি), পৃ. ৯৩।
[১৬]. আল্লামা ইমাম ইবনু তায়মিয়া, আল-ফাতাওয়াউল কুবরা (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ১ম সংস্করণ, ১৪০৮ হি./১৯৮৭ খ্রি.), ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৭৯।
[১৭]. ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়াহ, ইগাছাতুল লুহফান ফী হুকমি ত্বালাকিল গাযবান (বৈরূত : আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, ২য় সংস্করণ, ১৪০৮ হি./১৯৮৮ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৭।
[১৮]. আল-ফাওয়াইদ, পৃ. ৮১; ইগাছাতুল লুহফান ফী হুকমি ত্বালাকিল গাযবান, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪১।
প্রসঙ্গসমূহ »:
আত্মশুদ্ধি