জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলাম শিক্ষার আবশ্যকতা
-ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*
প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় ত্রুটি বিশ্লেষণ
এ কথা সত্য যে, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা অর্জন করে অনেক মেধাবীরা দেশ-বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছে। আবার বেশ কিছু ত্রুটির কারণে জাতি শিক্ষার সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যেগুলো আমাদের মেধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে দিচ্ছে না। ফলে শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার গতি এখনো খুবই ধীর। সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের পর এমন একটি শাসকগোষ্ঠী বিজয়ী শক্তির আসনে অধিষ্ঠিত হলো তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল দুনিয়াবী জীবনের সফলতা। তাদের ভোগ-বিলাসিতা ও অগ্রগতির মূলকথা ছিল শুধুই বৈষয়িক উন্নতি। ক্ষমতা দখলের পর তারা মুসলিমদের চেতনা বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারই অংশ হিসাবে এ উপমহাদেশের সভ্যতা, ভাষা, সংস্কৃতি ও শিক্ষা ব্যবস্থার ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায়। উর্দূ ও ফরাসী ভাষার পরিবর্তে ইংরেজীকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় পরিণত করা হয়। শিক্ষার বিষয় বস্তুকেও ইংরেজরা তাদের সভ্যতা ও আদর্শের ছাঁচে ঢালাই করে নেয়। ১৮৩৬ সালে লর্ড মেকলে কর্তৃক প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় সুপারিশমালার ভূমিকায় বলেন,
‘We must at present do our best to form a class, who may be interpreters between us and millions, whom we govern, a class of persons, Indian in blood and colour but English in taste, in opinion, in morals and intellect’.
‘বর্তমানে আমাদের সর্বাধিক চেষ্টা করতে হবে, যাতে এমন একটি গোষ্ঠী সৃষ্টি করা যায়, যারা আমাদের ও আমাদের লক্ষ লক্ষ প্রজার মধ্যে দূত হিসাবে কাজ করতে পারে। এরা রক্তে ও বর্ণে হবে ভারতীয়, তবে স্বাদ, বুদ্ধি, মতামত এবং নীতিতে হবে ইংরেজ’।[১] মূলত এ শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্যই ছিল রাজ্য শাসন বিস্তার ও নিজেদের চিন্তা-চেতনার উপযোগী লোক তৈরি। ফলে আমাদের দেশ থেকেই তৈরি হছে ব্রিটিশ শাসন, সভ্যতা ও সংস্কৃতির অনুগত মানুষ। সেদিন বাংলাদেশ ছিল উপমহাদেশের ক্ষুদ্র একটি ছোট্ট দেশ। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করেই সেই বিদেশী শক্তির দাসত্বের মন-মানসিকতার ও গোলামী চেতনা থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি আজও। নিম্নে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় মৌলিক যে ত্রুটিগুলো পরিলক্ষিত হয় উল্লেখ করা হল :
- আল্লাহবিমুখ শিক্ষা ব্যবস্থা
- আল-কুরআন ও হাদীছবিমুখ শিক্ষা ব্যবস্থা
- ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা
- নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ব্যর্থতা
- দুনিয়ামুখী শিক্ষা ব্যবস্থা
- সহশিক্ষা
- নৈতিকতা বিধ্বংসী শিক্ষা ব্যবস্থা
- ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা
- মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বৈষম্য
- প্রশ্ন ফাঁস ও অসদুপায় অবলম্বনে পূর্ণ স্বাধীনতা
- ভর্তি বাণিজ্য
- জীবন-পদ্ধতি সম্পকে নির্দেশনা বর্জিত শিক্ষা
- প্রকৃত মেধার অবমূল্যায়ন
- দুর্নীতির প্রসার
- কর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থা
- জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টিতে ব্যর্থতা
- অপরাধনীতির লেজুর বিশিষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থা
- নেতৃত্ব ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে ব্যর্থতা।
প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাব
মানুষের জ্ঞানগত পরিধি যতই বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার সমস্যা ততই জটিল হতে জটিলতার হয়ে যাচ্ছে। মানুষ বস্তুগত অগ্রগতি যত বেশি লাভ করছে, নিত্য-নতুন কামনা-বাসনা, নতুন নতুন সমস্যা ও জটিলতা এবং নানারূপ নৈরাশ্য ও বঞ্চনার হাহাকার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। দুঃখজনক হলেও বাস্তব যে, বর্তমানে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সভ্য সমাজেই প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অপরাধের হার বেড়েই চলেছে। কেননা উন্নতির সোপান হিসাবে বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবার ব্যবস্থা নেই। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাবগুলো নিম্নে তুলে ধরা হল:
মূল্যবোধের অবক্ষয়
শিক্ষায় মূল উদ্দেশ্য মূল্যবোধ সৃষ্টি করা হলেও প্রচলিত শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে কেউ তা অর্জন করতে পারছে না। পৃথিবীর অগ্রযাত্রার সাথে সাথে মানুষের প্রতি মানুষের মূল্যবোধ হ্রাস পাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের মায়া-মমতা, মহব্বত ইত্যাদি। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে ক্রমশই বাড়ছে সমাজে মূল্যবোধ অবক্ষয়। অথচ যে সমাজে মূল্যবোধ যত বেশি নিরাপদ হবে, সে সমাজে তত বেশি শান্তি ও সুখ নিশ্চিত হবে। এমন অবস্থা হবে যে, কেউ কারো প্রতি অন্যায় হস্তক্ষেপ করবে না। কেউ কারো জান-মাল ও ইযযতের কোন ক্ষতি করবে না। বরং প্রত্যেকে হবে প্রত্যেকের জন্য রক্ষাকবচ। কারো অসাক্ষাতেও কেউ কারো অমঙ্গল চিন্তা করবে না। বরং তার কল্যাণের জন্য দু‘আ করবে। যা ফিরিশতাগণ লিখে নিবেন ও ক্বিয়ামতের দিন তাকে উত্তম পুরস্কার দিবেন।[২]
মানুষের মূল্যবোধকে অক্ষুণ্ন ও উন্নত করার জন্য এযাবৎ মনুষ্যকল্পিত যত পথ-পন্থা এবং শিক্ষানীতি ও পদ্ধতি বের হয়েছে এবং কথিত ধর্মসমূহে যেসব নীতি ও বিধান প্রণীত হয়েছে, সে সবের ঊর্ধ্বে আল্লাহ প্রেরিত বিধানই সর্বোত্তম ও চূড়ান্ত। মানুষের জন্য ইসলামই হলো আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম (সূরা আলি ‘ইমরান : ১৯)। এর বাইরে অন্যত্র কোন বিধান তালাশ করলে তা আল্লাহর নিকট কবুল হবে না এবং চূড়ান্ত বিচারে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে (সূরা আলি ‘ইমরান : ৮৫)।
মনুষ্যত্বের বিনাশ
প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে মানব সত্তার চরম উৎকর্ষ সাধিত হলেও প্রকৃত মনুষ্যত্বের উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। মনুষ্যত্ব বিকাশের ব্যাপারে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা আজ ব্যর্থ। অথচ আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ও মনুষ্যত্বের বিকাশে পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে বিভিন্ন গোত্রের নিকট মহানায়কদের পাঠিয়েছেন, যারা অহীর মাধ্যমে মানব জাতির শান্তি নিশ্চিত করতে আমৃত্যু কাজ করেছেন। বিভিন্ন নবী ও রাসূলকে বিভিন্ন গোত্রের জন্য বা নির্দিষ্ট এলাকার জন্য প্রেরণ করলেও রাসূল (ﷺ)-কে শেষ নবী হিসাবে সমগ্র বিশ্ব মানবতার জন্য প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমি আপনাকে সমগ্র মানব জাতির জন্যই সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী বানিয়ে পাঠিয়েছি’ (সূরা সাবা : ২৮)। তিনি আরো বলেন, ‘হে লোক সকল! তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে এ নবী তোমাদের কাছে সত্য সহকারে এসেছেন, কাজেই তোমরা ঈমান পোষণ কর। এটা তোমাদের পক্ষে কল্যাণকর’ (সূরা আন-নিসা : ১৭০)। আরো বর্ণিত হয়েছে, ‘তিনি আল্লাহ যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়ত ও সত্য জীবন ব্যবস্থা সহ পঠিয়েছেন, যেন তিনি এ দ্বীনকে সমস্ত বাতিল ব্যবস্থাসমূহের উপর বিজয়ী করেন’ (সূরা আল-ফাত্হ : ২৮)।
মূলত মনুষ্যত্বের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুষ নামের প্রকৃত স্বার্থকতা। আর মনুষ্যত্বের বিকল্প সাধনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হচ্ছে শিক্ষা। তাই একটি জাতির উথান- পতনের অনেকটাই নির্ভর করে সেই জাতির শিক্ষাব্যবস্থার উপর। শিক্ষা ব্যবস্থা যদি পূর্ণভাবে জাতির মধ্যে মানবতার উৎকর্ষ সাধন করতে পারে তাবেই সম্ভব একটি আদর্শ জাতি তথা আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা কিন্তু আজ অন্যায় অনাচার, অনৈতিকতার সয়লাবে ভেসে যাওয়া এই সমাজের চিত্র এ কথা আমাদের সামনে স্পষ্ট করে দেয় যে, প্রচলিত বস্তুগত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে মানব সত্তার দু’টি দিকের একটি অর্থাৎ জৈবিক সত্তাকে উন্নত করতে পারলেও মানব সত্তার মূল যে নৈতিক সত্তার চরম উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে মনুষ্যত্বের উন্নয়ন, এই কাজটি করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
নৈতিকতার অধঃপতন
নৈতিকতার অধঃপতন বর্তমানে সমাজের সবক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হয়। বিচ্যুতি নেই এমন স্থান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষকতা, ছাত্র ও অভিভাবক প্রভৃতি সকল স্তরেই নৈতিকতার অধঃপতন আজ শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করেছে। একসময় পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি নৈতিকতা, আদর্শ, আচার-আচরণ শেখানো হত। এখন প্রায়ই দেখা যায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীর যৌন হয়রানির ঘটনা। শিক্ষক যখন এ রকম কুকর্মে লিপ্ত থাকেন, সেই শিক্ষকের কাছ থেকে নৈতিকতা শেখার কোন সুযোগ নেই। আবার অভিভাবক যখন তাঁদের ছেলেমেয়েকে অনৈতিক পন্থায় পরীক্ষায় পাস বা সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার জন্য সমর্থন করেন, তখন ছেলেমেয়েদের মধ্যে নৈতিকতার কোন বিকাশ হবে না, এটাই স্বাভাবিক। যখন এ রকম পরিস্থিতি ক্রমশ বাড়তে থাকে, তখন শিক্ষাঙ্গনে একটা অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরীক্ষায় ফেল করলে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিল, শিক্ষকের পদত্যাগ দাবি করা, শ্রেণিকক্ষে তালা দেয়া, ব্যবহারিক পরীক্ষা/থিসিস নম্বরের সুযোগ ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি, প্রাইভেট টিউশন নিতে বাধ্য করা, কী নেই এদেশে। এভাবেই প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরাই নৈতিকতাকে প্রতিনিয়ত দুমড়েমুচড়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে আর কলুষিত করছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। শিক্ষার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিকিৎসাক্ষেত্রেও এ রকম অবনতি স্পষ্টত লক্ষ্য করা যায়। নৈতিকতার চরম ব্যত্যয় দেখা যায় খাবারে ভেজাল ও কেমিক্যাল ব্যবহারে। গুঁড়া মসলায় মেশানো হয় অস্বাস্থ্যকর ইটের গুঁড়াসহ নানা রঙের কেমিক্যাল। রান্না করা খাবারেও বিপত্তি। পচা-বাসি খাবার মিশিয়ে দেয়া, পোড়া তেলের ব্যবহার, নোংরা পরিবেশে রান্না ও সংরক্ষণ করা সহ সবকিছুতেই নীতিবর্জিত কাজ আজ অহরহ সর্বত্র দৃশ্যমান। নিয়োগ-বাণিজ্যের মাধ্যমে অদক্ষ লোকবল নিয়োগ, পদোন্নতি, পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেমে নেই। পুরোদমে চলে সরকারের ও অন্যের অর্থ কীভাবে লোপাট করে নিজের করা যায় সেই ধান্দা। মানুষ এতটাই দিশেহারা হয়ে গেছে যে ঠিক-বেঠিকের মধ্যে কোন তফাত খুঁজে পায় না।
সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনেও অনৈতিকতা ও আদর্শহীনতার ছোঁয়া ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যের সফলতা কারো সহ্য হয় না। সুযোগ পেলেই কাউকে বিপদে ফেলতে এতটুকু কেউ দ্বিধা করে না। কারও বিপদে কেউ সাহায্যের হাতে এগিয়ে আসে না; বরং দাঁড়িয়ে তামাশা দেখি, সেলফি নিই, ভিডিও করি। যারা সাহায্য করতে আসেন, তাদের মধ্যে কিছু মানুষ আবার এটাকে ব্যবসা হিসাবে দেখেন। ফেসবুক/ইউটিউবে লাইভ করেন, অনুসারী বাড়ানোর জন্য। অন্যের নামে কুৎসা রটানো, অপদস্থ করা, রাস্তাঘাট ও গণপরিবহনে নারীদের কটুক্তি করা, তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মারামারি, খুন কোনটিই বাদ পড়ছে না। রাস্তাঘাট, বন্দর, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, শিক্ষা, চিকিৎসা সহ এমন একটা খাত খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে নৈতিকতার বিপর্যয় চরমভাবে ঘটেনি। এসব দুর্নীতি, অপকর্ম, অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারা জড়িত, তাদের অধিকাংশই প্রচলিত শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত সব পণ্ডিত মহল। আর যারা এই সকল অপকর্ম রোধ করা যাদের দায়িত্ব, সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেই কতটা নৈতিক অবস্থানে আছে, বর্তমানে তা সহজেই অনুমেয়। যারা প্রায় সকলেই প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত মহাজন।
উক্ত পরিস্থিতিতে বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে নৈতিকতার বদলে অনৈতিক শিক্ষা দেয়া, ইতিহাসকে বার বার বদলে দেয়া, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ বিনষ্ট করার মাধ্যমে এ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভুল পথেই বেশি নেয়া হচ্ছে যার ভয়াবহ চিত্র আজ সমাজে দৃশ্যমান। সুতরাং শুধু নৈতিক অধঃপতন-ই নয় শিক্ষার মানও কমে যাচ্ছে। অথচ নৈতিক শিক্ষা ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলির অন্তর্গত।[৩] মূলত আচরণে (আমলে বা কর্মে) ইতিবাচক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধনই শিক্ষার উদ্দেশ্য। নৈতিক শিক্ষার সঙ্গে যেসব বিষয় সরাসরি সম্পর্কিত সেগুলো হলো সুশাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, দুর্নীতি দমন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি, শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি। আচরণে অভীষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধনের জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তথ্য প্রদান বা জ্ঞান দান করাকে শিক্ষা বলে। নৈতিক শিক্ষা সম্বন্ধে আল-কুরআনের ভাষ্য হলো, ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) দু‘আ করলেন,
رَبَّنَا وَ ابۡعَثۡ فِیۡہِمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡہُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتِکَ وَ یُعَلِّمُہُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ یُزَکِّیۡہِمۡ ؕ اِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ
‘হে আমাদের প্রভু! আপনি তাদের মাঝে পাঠান এমন রাসূল, যিনি আপনার আয়াত উপস্থাপন করবেন, কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী স্নেহশীল ও কৌশলী’ (সূরা আল-বাকারাহ : ১২৯)। মানুষ দোষে-গুণে সৃষ্টি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَاَلۡہَمَہَا فُجُوۡرَہَا وَ تَقۡوٰىہَا - قَدۡ اَفۡلَحَ مَنۡ زَکّٰىہَا- وَ قَدۡ خَابَ مَنۡ دَسّٰىہَا
‘অতঃপর তাতে ঢেলে দিলেন অপরাধপ্রবণতা ও তাক্বওয়া। অবশ্যই সফল হলো সে যে তা পবিত্র করল; আর বিপদগ্রস্ত হলো সে যে তা ছেড়ে দিল’ (সূরা আশ-শামছ: ৮-১০)। নৈতিক শিক্ষা সম্বন্ধে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
أَلَا وَإِنَّ فِى الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ أَلَا وَهِىَ الْقَلْبُ
‘জেনে রাখো! শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরা আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীর তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীর তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখো! সে গোশতের টুকরাটি হলো কলব’।[৪]
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন
প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে আকাশ সংস্কৃতিতে ছেঁয়ে গেছে গোটা বিশ্ব। প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে না পারায় মানুষ তাদের নিজস্ব আচার-আচরণ, রীতি-নীতি ভুলে পাশ্চাত্য সভ্যতার মধ্যে প্রবেশ করছে। সুশিক্ষার অভাবে মানুষ শিক্ষা অর্জন করে কিছু শিখতে পারছে না। যা দেখছে সেটাই গ্রহণ করছে। ভাল-মন্দের পার্থক্য তাদের বিচার-বিবেচনার বাইরে। ভিনজাতির সভ্যতা-সংস্কৃতি গ্রহণ না করার ব্যাপারে ইসলামের শিক্ষা সুস্পষ্ট। বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূল (ﷺ) বলেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাদৃশ্যতা অবলম্বন করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে’।[৫]
যুব সমাজের অধঃপতন
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করার পরও অত্যন্ত সাধারণ অনেক বিষয়েও কোন রকম জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হয় না। সকল বিষয়ে মুখস্থ বিদ্যার দিকে মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু টেকনিক্যাল ও লজিক্যাল বিদ্যা গুরুত্ব পাচ্ছে না। কারণ পাঠ্যসূচীকে এমনভাবে গঠন করা হয়েছে যে, গৎবাঁধা মুখস্থ না করলে কোনভাবেই ভাল ফলাফল করা সম্ভব না। আবার গত কয়েক বছর ধরে পাবলিক পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি এক প্রকার open secret-এ রূপ নিয়েছে। পরীক্ষার সময় টার্গেট নির্ধারণ করে দেয়া হয়, যাতে কেউ পরীক্ষায় ফেল না করে। আর সমাপনী পরীক্ষায় নাকি এমনও নির্দেশ দেয়া থাকে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার খাতায় লিখতে পারুক বা না পারুক বা সেভাবেই হোক লিখিয়ে শতভাগ পাস নিশ্চিত করতে হবে। এমন অবস্থা সে পরীক্ষার খাতায় পাস মার্ক না ওঠলে সেখানে খাতা মূল্যায়নকারীরাই লিখে পাস মার্ক দিতে হবে। এবিষয়টি দেশে চলমান P.S.C, J.S.C, S.S.C ও H.S.C পরীক্ষায় পাসের হার বাড়িয়ে দিলেও প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার মান বেড়েছে এ কথা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। কেননা সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায় যে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা অংশগ্রহণকারী সর্বোচ্চ গ্রেড জিপিএ ৫ প্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ৮০% ছাত্র-ছাত্রীই ন্যূনতম পাস মার্ক পায়নি। এ চিত্র কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, বরং মেডিক্যাল, বুয়েট থেকে শুরু করে সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই অতিরঞ্জিত গ্রেড নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পাওয়া দূরে থাকুক পাস পর্যন্ত করতে পারে না তখন তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। শুধু শিক্ষার হার বাড়লেও কমছে শিক্ষার মান।[৬]
প্রকৃত মেধার অবমূল্যায়ন
প্রকৃত শিক্ষা অর্জন না করায় অর্থাৎ বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে পাস করা হচ্ছে। যেমন নকল করে, পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁস, রাজনৈতিক ক্ষমতা, শিক্ষকদের দুর্বলতা, প্রশাসনিক দুর্নীতির ইত্যাদির কারণে আজ প্রকৃত মেধাবী মুখ বাছাই করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে এবং আসলে প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন করা হচ্ছে না যার ফলে দেশ ও জাতির উন্নতির পথে চরম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
একটি দেশের উন্নতির জন্য দরকার মেধাবী জনশক্তি। পৃথিবীর সব উন্নত দেশগুলোই মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নতির স্বর্ণশিখরে পৌঁছেছে। মেধাবীদের ব্যবহারের জন্য তারা অবকাঠামো তৈরি করেছে বিশ্বমানের। যেকোনভাবেই মেধার পাচার রোধ করা তাদের পরিকল্পনার শীর্ষে থাকে। আর এ কাজটি তারা করে মেধাবীদের মূল্যায়নের মাধ্যমে। বাংলাদেশের উন্নয়ন করতে হলে তাই দরকার মেধাবী জনশক্তি ও তার সঠিক মূল্যায়ন।
ইসলামী জ্ঞানের ক্রমশ হ্রাস
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় নীতি-নৈতিকতা ঈমান-আকীদা আমল ইত্যাদি বিবর্জিত শিক্ষা ব্যবস্থা। যদিও ধর্ম শিক্ষা নামে মাত্র দেয়া হয় তাও সঠিক নয় ভ্রান্ত দিনে দিনে ইসলামী শিক্ষার ক্রমশ হ্রাসই হচ্ছে। যার ফলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি হচ্ছে। মনুষ্যত্ববোধ কমে যাচ্ছে। নীতি-নৈতিকতা বলতে সমাজে কিছু থাকছে না।
জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলাম শিক্ষার অপরিহার্যতা
ইসলাম হল পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। ইসলাম মানুষকে সত্যের সন্ধান দেয়, মহান স্রষ্টা আল্লাহ তার আলোকে চিনতে সাহায্য করে। সঠিক ও সাফল্যের পথে চলতে সহায়তা করে। আল্লাহর প্রিয় বান্দা, সমাজের বাঞ্ছিত ও দক্ষ ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য যা যা দরকার তার সব কিছুর ব্যবস্থাই ইসলামে বিদ্যমান। মোট কথা মানব জীবনের ও মানব চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন সুবিধার ও ন্যায়-নীতি ভিত্তিক শান্তি শৃঙ্খলাপূর্ণ প্রগতিশীল সমাজ গঠন ও সংরক্ষণে ইসলামের বিকল্প নেই। কেননা আল্লাহ তা‘আলা প্রথম যে অহী সূরা আল-আলাক্বের ১-৫ পর্যন্ত আয়াত নাযিল করেছেন, তা জ্ঞান অর্জন বা শিক্ষা অর্জন সম্পর্কিত। জ্ঞান ছাড়া দ্বীনের উপর অবিচল ভাবে টিকে থাকা যায় না। আল্লাহ যার কল্যাণ কামনা করেন, তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন। এ সম্পর্কে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ ‘আল্লাহ যার কল্যাণ কামনা করেন, তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করে থাকেন’।[৭]
শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো যোগ্য নাগরিক তৈরি করা। শিক্ষার সংজ্ঞা সম্পর্কে বিভিন্ন জাতির নিকট বিভিন্ন অর্থ রয়েছে। কোন দেশে এর অর্থ হলো অন্যায় ও বিদ্রোহ করা কিংবা বিদ্রোহ দমনে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করা অথবা সে এমন একজন ভাল লোক যে অন্যায় ও বাড়াবাড়ি পসন্দ করে না, কোন সময় সে এমন আবিদ হয় যে পার্থিব জগৎ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং দ্বন্ধ-সংঘর্ষ এড়িয়ে চলে, কোন সময় সে দেশ প্রেমিক হয় ও নিজস্ব বর্ণ রক্ষার জন্য উন্মাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এতদসত্ত্বেও স্থান-কাল-পাত্রভেদে এরা সবাই দেশের যোগ্য নাগরিক। ইসলাম নিজেকে এহেন সংকীর্ণতার মধ্যে নিক্ষেপ করেনি। ইসলাম শিক্ষার মাধ্যমে যোগ্য নাগরিক নয় বরং ‘যোগ্য মানুষ’ গড়ার ব্যাপক লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। মানুষ শব্দটি ব্যাপক মনুষ্যত্ব অর্থবোধক। এই অর্থে মানুষ শুধু নির্দিষ্ট কোন ভূখণ্ডের নাগরিকই নয়, এর ঊর্ধ্বে উঠে সে হচ্ছে কেবল মানুষ। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, اِنَّ اَکۡرَمَکُمۡ عِنۡدَ اللّٰہِ اَتۡقٰکُمۡ ‘তোমাদের মধ্যে যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু, সে আমার নিকট ততবেশি সন্মানিত’ (সূরা আল-হুজুরাত : ১৩)।
ইসলামের এই শিক্ষা মানুষের জ্ঞান, আত্মা, বৈষয়িক ও নৈতিক সবদিকে ব্যাপৃত। ইসলাম মানুষকে শরীর, জ্ঞান ও আত্মার সমন্বিত রূপ মনে করে। এগুলোসহ তাদের বৈষয়িক ও নৈতিক যাবতীয় কাজের সর্বাত্মক উন্নয়ন ও বিকাশ সাধন করাই হচ্ছে ইসলামী শিক্ষার লক্ষ্য। ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মা বিশেষ এক নে‘মত এবং শরীরের কেন্দ্রবিন্দু ও আল্লাহ তা‘আলার সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির বাহন। ইসলামে আত্মার প্রশিক্ষণ বলতে বুঝায় সমস্ত কাজ, চিন্তা ও সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার সাথে আত্মার একটা সম্পর্ক ও সংযোগ সংঘটিত হওয়া। আল্লাহ মানুষকে যথাসাধ্য আল্লাহভীরু হওয়ার নির্দেশ দিয়ে ঘোষণা করেন, فَاتَّقُوا اللّٰہَ مَا اسۡتَطَعۡتُمۡ‘তোমরা আল্লাহভীরু হওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা কর’ (সূরা আত-তাগাবুন : ১৬)। অন্যত্র মহান আল্লাহর ঘোষণা, یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰہَ حَقَّ تُقٰتِہٖ وَ لَا تَمُوۡتُنَّ اِلَّا وَ اَنۡتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করার মত ভয় কর এবং পুরোপুরি মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ কর না’ (সূরা আলে-ইমরান : ১০২)।
একজন খাঁটি মুসলিম হিসাবে জীবনযাপন করতে হলে, ইসলামের শিক্ষা অনুসরণ করে বিশ্বভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, সাম্য, উদার মানবতাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে চলতে হয়। ইসলামের শিক্ষানুযায়ী চলতে হলে ইসলাম বিষয়ক জ্ঞানার্জন এবং ইসলাম শিক্ষা বিষয়ক অধ্যয়ন করা প্রত্যেক মুসলিমের একান্ত আবশ্যক। সর্বপ্রথম নবী আদম (আলাইহিস সালাম) থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (আলাইহিস সালাম) পর্যন্ত মানুষের হেদায়াতের জন্য যত নবী-রাসূল এসেছেন, তারা সবাই ইসলামের সুন্দর ও শাশ্বত শিক্ষা প্রচার করেছেন। ইসলামের মৌলিক ও প্রাথমিক বিষয়গুলো জানা এবং সে অনুযায়ী চলা ফেরা আইনসিদ্ধ বিষয়। এজন্যই তো বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করা ফরযে কিফায়া। মানব জীবনে ইসলাম শিক্ষার গুরত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। যেমন,
ইসলামী শিক্ষা অর্জন করা ফরযে আইন তথা আবশ্যক
ইসলামের আক্বীদা-বিশ্বাস এবং ইবাদত করতে ন্যূনতম যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু ইসলাম শিক্ষা অর্জন করা ফরযে আইন তথা আবশ্যক। সুতরাং মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলাম কর্তৃক নির্দেশিত পথ ও পদ্ধতির আলোকেই তৈরি করতে হবে। এ ব্যাপারে ইসলামের দিক-নির্দেশনা সুস্পষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ مَا کَانَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ لِیَنۡفِرُوۡا کَآفَّۃً ؕ فَلَوۡ لَا نَفَرَ مِنۡ کُلِّ فِرۡقَۃٍ مِّنۡہُمۡ طَآئِفَۃٌ لِّیَتَفَقَّہُوۡا فِی الدِّیۡنِ وَ لِیُنۡذِرُوۡا قَوۡمَہُمۡ اِذَا رَجَعُوۡۤا اِلَیۡہِمۡ لَعَلَّہُمۡ یَحۡذَرُوۡنَ
‘আর মুমিনদের এটাও সমীচীন নয় যে, (জিহাদের জন্য) সবাই একত্রে বের হয়ে পড়ে; সুতরাং এমন কেন করা হয় না যে, তাদের প্রত্যেকটি বড় দল হতে এক একটি ছোট দল বহির্গত হয়, যাতে তারা ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে পারে, আর যাতে তারা নিজ কওমকে (নাফারমানী হতে) ভয় প্রদর্শন করে যখন তারা ওদের নিকট প্রত্যাবর্তন করে, যেন তারা সতর্ক হয়’ (সূরাহ আত-তাওবাহ : ১২২)। হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (ﷺ) বলেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيْضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ‘প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর জ্ঞান অর্জন করা ফরয’।[৮]
দ্বীনের ইলম অর্জনের হুকুম সম্পর্কে শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) (১৩৪৭-১৪২১ হি.)-কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘শরঈ জ্ঞান অর্জন করা ফরযে কিফায়া, যা যথেষ্ট পরিমাণ ব্যক্তি আদায় করলে অন্যদের বেলায় সুন্নাত হয়ে যায়। আবার কোন কোন সময় সকল মানুষের উপর জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক তথা ফরযে আইন হয়ে যায়। যেমন, কোন মানুষ যদি আল্লাহ তা‘আলার কোন ইবাদত করতে চায়, তাহলে তার উপর জেনে নেয়া আবশ্যক হয়ে যায় যে, কীভাবে সে আল্লাহ তা‘আলার জন্য এই ইবাদতটি করবে এবং এর মত আরও (আল্লাহর উদ্দেশ্যে) অন্যান্য ইবাদত করার পদ্ধতি সম্পর্কে জানা আবশ্যক তথা ফরযে আইন’।[৯]
আল্লাহর পরিচয় ও আল্লাহভীতি অর্জন করা অপরিহার্য
আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস বা আল্লাহ তা‘আলাকে চেনা হল ইসলাম শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য। সুতরাং আল্লাহকে চিনতে হলে এবং সঠিকভাবে তাঁর প্রতি বিশ্বাস করতে আল্লাহর নাম ও ছিফাত অর্থাৎ আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করা একান্ত আবশ্যক। আত্মপরিচয় এবং সৃষ্টি জগৎকে পর্যালোচনার মাধ্যমে আল্লাহকে জানা যায়, আর এ জানার মাধ্যমেই প্রত্যয় জন্মে। আর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কেউ অবগত হতে পারলে তার পক্ষে কোন অন্যায় ও অপকর্ম করা অসম্ভব। আর তাঁর পরিচয় সম্পর্কে অবগত ব্যক্তিরাই মূলত তাকে বেশি ভয় করে থাকে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল তাকে ভয় করে’ (সূরা আল-ফাতির : ২৮)।
জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ
আল্লাহ তা‘আলা মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি প্রথম অহীতেই জ্ঞানার্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। এ থেকে আমরা জ্ঞান অর্জন তথা ইসলাম শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি। অজ্ঞতা থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে ইলম[১০] অর্জনের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন। মানুষ ইলম অর্জন করবে, সে অনুযায়ী আমল করবে এবং নিজেদের মাঝে ইলম প্রচার করবে এটাই আল্লাহর দাবী (সূরা আত-তওবাহ : ১২২)। ইলম আল্লাহ প্রদত্ত এক অফুরন্ত নি‘আমত। যা জ্ঞানী ও মূর্খদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلۡ ہَلۡ یَسۡتَوِی الَّذِیۡنَ یَعۡلَمُوۡنَ وَ الَّذِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ‘(হে মুহাম্মাদ!) আপনি বলুন! যারা জানে এবং যারা জানে না তার কি সমান?’ (সূরাহ আয-যুমার : ৯)। অন্যত্র তিনি বলেন, قُلۡ ہَلۡ یَسۡتَوِی الۡاَعۡمٰی وَ الۡبَصِیۡرُ ۬ۙ اَمۡ ہَلۡ تَسۡتَوِی الظُّلُمٰتُ وَ النُّوۡرُ ‘(হে মুহাম্মাদ!) আপনি বলুন! অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান হতে পারে? আলো ও অন্ধকার কি এক হতে পারে?’ (সূরা আর-রা‘দ : ১৬)। ইলম এমন একটি মূল্যবান সম্পদ, যে ব্যক্তি তা অর্জন করবে আল্লাহ তাকে নবীদের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী বানাবেন। অজ্ঞতা থেকে মুক্ত থাকার ব্যাপারে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (ﷺ) উৎসাহিত করেছেন।
তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করার উদ্দেশ্যে কোন পথ অবলম্বন করে আল্লাহ তা‘আলা তা দ্বারা তাকে জান্নাতের কোন একটি পথে পৌঁছে দেন এবং ফিরিশতাগণ ইলম অন্বেষণকরীর উপর খুশি হয়ে নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেন। এছাড়া আলিমদের জন্য আসমান ও যমীনের সকল অধিবাসী আল্লাহর নিকট দু‘আ ও প্রার্থনা করে। এমনকি পানির মধ্যে বসবাসকারী মাছও (তাদের জন্য দুা‘আ করে)’।[১১]
দ্বীন ইসলামকে সমুন্নত রাখা
দ্বীনের প্রচার, প্রতিষ্ঠা, সমুন্নত ও অক্ষুন্ন রাখার জন্য ইসলাম শিক্ষা অপরিহার্য। ইসলাম শিক্ষা ছাড়া দ্বীনের প্রচার, প্রতিষ্ঠা ও উজ্জীবন সম্ভব নয়। পূর্বে নবীর পরে অন্য নবী আসতেন। সুতরাং দ্বীন প্রচারে উম্মতের তেমন দায়িত্ব ছিল না। কিন্তু মুহাম্মাদ (ﷺ) সর্বশেষ নবী। তার পরে কোন নবী আসবেন না। সুতরাং দ্বীন প্রচার, প্রতিষ্ঠা ও উজ্জীবনের দায়িত্ব তার উম্মতের। আর এ দায়িত্ব পালন করার জন্য ইসলাম শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
إِنَّ الْعُلَمَاءَ هُمْ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ إِنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوْا دِيْنَارًا وَلَا دِرْهَمًا إِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ
‘আলিমরাই নবীগণের উত্তরাধিকারী। নবীগণ দীনার বা দিরহামের উত্তরধিকারী করেন না। বরং তারা ইলমের উত্তরাধিকারী করেন। ফলে যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করল সে বৃহদাংশ গ্রহণ করল’।[১২]
ভালো-মন্দ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্য
সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করার জন্য ইসলামী জ্ঞানের একান্ত আবশ্যক। জ্ঞান ছাড়া এ পার্থক্য করা অসম্ভব। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আনয়নের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দায়িত্ব দিয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আলিফ-লাম-রা; এই কিতাব এটা আমরা আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি যাতে আপনি মানব জাতিকে তাদের প্রতিপালকের নির্দেশক্রমে বের করে আনতে পারেন অন্ধকার হতে আলোর দিকে, তাঁর পথে, যিনি পরাক্রমশালী, প্রশংসিত’ (সূরা ইবরাহীম : ১)।
সম্মান-মর্যাদার মাপকাঠি
শিক্ষাই সম্মান ও মর্যাদার মাপকাঠি। আল্লাহ তা‘আলা আদম (আলাইহিস সালাম)-কে ফিরিশতাদের উপরেও মর্যাদা দিয়েছিলেন এবং তার মানদণ্ড ছিল শিক্ষা। ফিরিশতাগণ আদম (আলাইহিস সালাম)-এর জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব দেখে তার প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘এবং তিনি আদমকে সমস্ত নাম শিক্ষা দিলেন, অনন্তর তৎসমুদয় ফিরিশতাদের সামনে উপস্থাপিত করলেন; তৎপর বললেন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও, তবে আমাকে এসব বস্তুর নামসমূহ জানাও। তারা বলেছিল আপনি পরম পবিত্র; আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তদ্ব্যতীত আমাদের কোনই জ্ঞান নেই; নিশ্চয় আপনি মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়। তিনি বলেছেন হে আদম, তুমি তাদেরকে ঐ সকলের নামসমূহ জানিয়ে দাও; অতঃপর যখন সে তাদেরকে ঐগুলোর নামসমূহ জানিয়ে দিল, তখন তিনি বলেছিলেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, নিশ্চয় আমি ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের অদৃশ্য বিষয় অবগত আছি এবং তোমরা যা প্রকাশ কর ও যা গোপন কর আমি তাও পরিজ্ঞাত আছি’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৩১-৩৩)। এজন্যই তো তিনি বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘জ্ঞানীরা আর মূর্খরা কি সমান হতে পারে’ (সূরা আয-যুমার : ৯)। হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে এবং অন্যদেরকে শিক্ষা দেয়’।[১৩]
হালাল উপার্জন
হালাল উপার্জনে সহায়তা এবং আত্মকর্মসংস্থানে সক্ষম করে তোলার উদ্দেশ্যে ইসলাম শিক্ষা প্রয়োজন। ইসলামে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে উপার্জনের জন্য উৎসাহ দিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং যাবতীয় বৈধ ও অবৈধ পন্থাও বাতলে দিয়েছেন। অতএব হালাল উপার্জন বলতে বুঝায় উপার্জনের ক্ষেত্রে বৈধ ও শরী‘আত সম্মত পন্থা অবলম্বন। হালাল উপায়ে জীবিকা উপার্জনের ফলে সমাজ ব্যবস্থায় ধনী দরিদ্রের মাঝে সুষম ভারসাম্য ফিরে আসে; কৃষক দিন মজুর, ক্রেতা-বিক্রেতা, শ্রমিক-মালিক এবং অধস্তনদের সাথে ঊর্ধ্বতনদের সুদৃঢ় ও সংগতিপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। ফলে সকল শ্রেণীর নাগরিকই তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পায় এবং সমাজ সংসারে নেমে আসে শান্তির সুবাতাস। মূলত ইসলাম যে পেশাকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে সেসব পন্থায় উপার্জন ব্যতীত অন্যান্য পন্থায় উপার্জন করা বৈধ বলে বিবেচিত। ইসলাম প্রদত্ত সীমারেখা ও মূলনীতি ঠিক রেখে বৈধ যে কোন পণ্যের ব্যবসা করার মাধ্যমে উপার্জনকে ইসলামী শরী‘আত হালাল হিসাবে আখ্যা দিয়েছে। এছাড়া যদি কেউ বৈধ উপায়ে যোগ্যতানুযায়ী চাকুরী করে এবং ঘুষ সহ যাবতীয় অবৈধ লেন-দেন ও অসৎ মানসিকতা থেকে দূরে থাকে তবে সেটাও জীবিকার্জনের হালাল পন্থা হিসাবে সাব্যস্ত হবে। এছাড়া হালাল উপায়ে উপার্জন করা ও তার ব্যবস্থা করাও অন্যতম একটি মৌলিক ইবাদত। শুধু তাই নয়, ইসলাম এটিকে অত্যাবশ্যক (ফরয) কাজ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন ও মানবতার বিকাশ
মানুষের মেধা, মননশীলতা শিক্ষার মাধ্যমে বিকশিত হয়। এর মাধমে আত্মার উন্নতি হয়। মানুষের মধ্যে দয়া-মায়া, হে-মমতা ইত্যাদি মানবীয় গুনাবলি উৎকর্ষিত ও বিকশিত হয়। আচার-আচরণ পরিশীলিত ও পরিমার্জিত হয়। এতে চারিত্রিক উৎকর্ষ বৃদ্ধি পায়, মানবিক গুনাবলির বিকাশ ঘটে। মানবতা সমুন্নত হয়।
জ্ঞান ইসলামীকরণে পদক্ষেপসমূহ
জ্ঞান ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে ডক্টর ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর চিন্তাধারা অনেক যৌক্তিক ও শক্তিশালী। তিনি বলতে চেয়েছেন যে, আধুনিক জ্ঞানের ইসলামীকরণ একটি মহান পদক্ষেপ। যদি সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীর প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের অংশ হিসাবে মুসলিম বিশ্বে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বাধ্যতামূলক কোর্স হিসাবে চালু করা হয়। জ্ঞানের ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে তিনি যে কয়েকটি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন নিম্নে তা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো:
- আধুনিক জ্ঞান আয়ত্তে এনে এর শাখাগুলোকে শ্রেণী, নীতি, পদ্ধতি, সমস্যা ও বিষয়বস্তু অনুযায়ী বিন্যস্ত করতে হবে।
- জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় জরিপ চালিয়ে অর্থাৎ এর উৎপত্তি ও ঐতিহাসিক বিকাশ, বিকাশের পদ্ধতি, দৃষ্টিপাতের ব্যাপকতা এবং এর পক্ষে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের অবদানের উপর আলোকপাত করতে হবে।
- জ্ঞানের সংশ্লিষ্ট বিষয়টির সাথে ইসলামের বিস্তৃত সামঞ্জস্য অন্বেষণের আগেই ঐ বিষয় সম্পর্কে ইসলামী জ্ঞান কী বলতে চায় তা উদঘাটন করা আবশ্যক অর্থাৎ পণ্ডিত্ব অর্জন করতে হবে।
- ইসলামী জ্ঞানের বিশ্লেষণকল্পে ইসলামী চিন্তাবিদদেরকে বর্তমান সমস্যার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তুত করে ক্রমবিন্যাস করতে হবে।
- এখন জ্ঞানের প্রতিটি বিষয়ের সাথে ইসলামী জ্ঞানের সুনির্দিষ্ট প্রাসঙ্গিকতা উভয়ের অভিন্ন অবদানের আলোকে নির্ণয় করতে হবে।
- এ পর্যায়ে আধুনিক জ্ঞানকে ইসলামের দৃষ্টিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা আবশ্যক।
- ইসলামী জ্ঞানের উৎস পর্যালোচনা করতে হবে আল-কুরআন ও আল-হাদীসের সুস্পষ্ট দৃষ্টান্তের আলোকে, বিশ্বব্যাপী উম্মাহর বর্তমান চাহিদা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যাবতীয় আধুনিক জ্ঞানের ভিত্তিতে।
- উম্মাহর প্রধান সমস্যাবলী কারণ ও লক্ষণসহ জরিপ করতে হবে।
- যেহেতু সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের দায়িত্ব ইসলামী দর্শনের উপর ন্যাস্ত, সেহেতু আজকের বিশ্বের সমস্যা সমাধানে মানব জাতির সমস্যা জরিপ করতে হবে।
- সর্বোচ্চ বিচক্ষণতার সাথে সৃজনশীল বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ করতে হবে।
- ইসলামী কাঠামোর আওতায় বিভিন্ন বিষয়ের পুনর্বিন্যাস এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক রচনা, যা জ্ঞানের ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত ধাপ হিসাবে পরিগণিত।
- ইসলামী জ্ঞানের প্রসারের লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তকগুলো বিভিন্ন দেশের স্ব স্ব ভাষায় মুদ্রিত করে সংশ্লিষ্ট সরকার গুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে পাঠ্যপুস্তক হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানাতে হবে।[১৪]
উপসংহার
একটি জাতির সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতির মৌলিক উপাদান হল শিক্ষা। যে জাতি যতবেশি শিক্ষিত, সে জাতি ততবেশি উন্নত ও সুসংহত। শিক্ষা, শিক্ষার উপকরণ, কৌশল ও পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা শিক্ষা কার্যক্রমের মূল হাতিয়ার। শিক্ষার স্বরূপ ও প্রকৃতি এবং প্রয়োজনীয়তার উপর বিস্তারিত আলোচনা, পর্যালোচনা ও তাত্ত্বিকতার উপর নির্ভর করে শিক্ষার উপযোগিতা ও চাহিদা। জাতীয় উন্নতি, নৈতিকতা, নীতিবোধ, সত্য ও ন্যায়ের দিক-নির্দেশনার মূর্তপ্রতীক হল এই শিক্ষা। ব্যক্তির চালচলন, গবেষণা, জীবন দর্শন, চৈতন্য ও সমাজবোধ পরিস্ফুটিত হয় তার অর্জিত ও পরিশিলীত মননের উপর। তাই শিক্ষা হতে হবে একদিকে যেমন নৈতিকতা, নীতবোধ ও আদর্শের অনুসারী, অন্যদিকে সুস্থ প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান নির্ভর। অতএব ধর্মচর্চা এবং প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান নির্ভরতা উভয়ের উপযুক্ত সমন্বয়ের ভিত্তিতে গঠিত শিক্ষানীতিই মূলত জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির মূল নেয়ামক। শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বাহ্যিক সৌন্দর্যের চাকচিক্যের ঢামাডোলে কোন লাভ হবে না। বরং ক্ষতিই হবে তুলনামূলকভাবে বেশি। অতএব এ কথা চিরন্তন সত্য যে, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে উন্নত জাতিরাষ্ট্র হিসাবে দাঁড়াতে চাইলে মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে যোগ্য মানবসম্পদ তৈরির কোন বিকল্প নেই। অনুরূপ যোগ্যতা সম্পন্ন জনগোষ্ঠী চাইলে প্রয়োজন কোয়ালিটি এডুকেশন। শুধু সংখ্যার ভার দিয়ে কাক্সিক্ষত মানে পৌঁছানো কখনোই সম্ভব নয়।
* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আল-ইসলামিয়্যাহ, খড়খড়ি, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র:
[১]. ড. মুযাফফর বিন মুহসিন, ভ্রান্তির বেড়াজালে ইক্বামতে দ্বীন (রাজশাহী : বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, ২য় সংস্করণ, ২০১৪ খ্রি.), পৃ. ৮৫।
[২]. সহীহ মুসলিম, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২০৯৪, হাদীস নং-২৭৩৩; মিশকাতুল মাসাবীহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ২, হাদীস নং-২২২৮।
[৩]. সূরাহ আল-বাকারাহ : ৩২; সূরাহ আল-আলাক্ব : ১-৫; সূরাহ আর-রহমান : ১-৪।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২; মিশকাত, হা/২৭৬২।
[৫]. সুলাইমান ইবনুল আশ‘আছ আবূ দাঊদ আস-সিজিস্তানী, সুনানু আবী দাঊদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৪১, হাদীস নং-৪০৩১।
[৬]. https://alaponblog.com/post/1516/.
[৭]. আবূ ‘আব্দিল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াযীদ আল-ক্বাযভীনী, সুনানু ইবনি মাজাহ, ১ম খণ্ড (বৈরূত : দারুল ফিকর, তাবি), পৃ. ৮০, হাদীস নং-২২০।
[৮]. সুনানু ইবনি মাজাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৮১, হাদীছ নং-২২৪।
[৯]. মাজম্ঊূ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল লিইবনি ‘উছাইমীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৭৪।
[১০]. ‘ইলম’ আরবী শব্দ العلم মাসদার থেকে উৎকলিত। অর্থ إدراك الشيء ‘কোন কিছু উপলব্ধি করা’। -‘আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু ‘আলী আল-জুরজানী, আত-তা‘রীফাত (বৈরূত : দারুল কিতাবিল ‘আরাবী, ১ম সংস্করণ ১৪০৫ হি.), পৃ. ১৯৯; আল-মু‘জামুল ওয়াসীত, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬২৪।
[১১]. সুনানু আবী দাঊদ, পৃ. ৬৫৫, হাদীছ নং-৩৬৪১; মাজদুদ্দীন আবুস সা‘আদাত আল-মুবারক ইবনুল আসীর, জামি‘উল উসূল ফী আহাদীছির রাসূল, ৮ম খণ্ড (বৈরূত : মাকতাবাতুল হালওয়ানী, ১ম সংস্করণ ১৩৯২ হি./১৯৭২ খ্রি.), পৃ. ৪, হাদীছ নং-৫৮২৫।
[১২]. মুহাম্মাদ ইবনু ঈসা আবূ ঈসা আত-তিরমিযী, আল-জামি‘উস ছহীহ সুনানুত তিরমিযী, ৫ম খণ্ড (বৈরূত : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল ‘আরাবী, তা.বি.), পৃ.৪৮, হাদীস নং-২৬৮২; ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্দির রহমান আবূ মুহাম্মাদ আদ-দারিমী, সুনানুদ দারিমী, ১ম খণ্ড (বৈরূত : দারুল কিতাবিল ‘আরাবী, ১ম সংস্করণ ১৪০৭ হি.), পৃ. ১১০, হাদীছ নং-৩৪২; আবূ বাকার আহমাদ ইবনুল হুসাইন আল-বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান, ২য় খণ্ড (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ ১৪১০ হি.), পৃ. ২৬২, হাদীছ নং-১৬৯৬।
[১৩]. সুনানু আবী দাঊদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৬০, হাদীস নং-১৪৫২।
[১৪]. সেমিনার প্রবন্ধ সংকলন ২০২২, পৃ. ১০২-১০৩।
প্রসঙ্গসমূহ »:
শিক্ষাব্যবস্থা