সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৬:৫১ অপরাহ্ন

সুন্নাতের আলো বিদ‘আতের অন্ধকার

মূল : ড. সাঈদ ইবনু আলী ইবনু ওয়াহাফ আল-ক্বাহত্বানী
অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন *


(১০ম কিস্তি) 

চতুর্থতঃ শা‘বানের ১৫তম রাতে অনুষ্ঠান পালন করা

মুহাম্মাদ ইবনু ওয়াযাহ আল-কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) স্বীয় সনদে আব্দুর রহমান ইবনু যায়েদ ইবনু আসলাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,

لم أدرك أحداً من مشيختنا، ولا فقهائنا يلتفتون إلى ليلة النصف من شعبان، ولم ندرك أحداً منهم يذكر حديث مكحول.

‘আমাদের শায়খ ও ফক্বীহগণের কাউকে শা‘বানের ১৫তম রাতের প্রতি গুরুত্বের সাথে দৃষ্টিপাত করতে দেখিনি এবং এ প্রসঙ্গে মাকহূল বর্ণিত হাদীছ উল্লেখ করতে দেখিনি (মাকহূল ব্যক্তির নাম)-এর হাদীছ’।[১] অর্থাৎ  অন্য কোন রাতের উপর তার বিশেষ কোন মর্যাদা আছে তা উল্লেখ করতে’।[২]

ইমাম আবূ বকর তরতুশী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমাকে আবূ মুহাম্মাদ আল-মাকদেসী (রাহিমাহুল্লাহ) অবহিত করেছেন যে, ‘আমাদের সময় বায়তুল মাক্বদিসে কখনও ছালাতুর রাগায়েব পড়া হয়নি, যা বর্তমানে রজব ও শা‘বান মাসে পড়া হয়। প্রথম এ বিদ‘আত (৪৪৮ হিজরীতে) চালু হয়। সে সময় নাবুলুস এর অধিবাসী এক ব্যক্তি বায়তুল মাক্বদিসে আগমন করল। সে ইবনে আবী হামরা’ নামে পরিচিত ছিল। তার কুরআন তেলাওয়াত ছিল খুবই সুন্দর, সে শা‘বানের ১৫তম রাতে বাইতুল মাক্বদিসে ছালাত শুরু করল। তার পিছনে অপর একজন এসে যোগ দিল, অতঃপর আরো তিন চারজন যোগ দিল। এভাবে ছালাত শেষে দেখা গেল বিরাট এক জামা‘আত হয়ে গেছে। পরবর্তী বছর আরো অনেকে এসে ছালাত আদায় করল। এর পরবর্তী বছর আরো বহু সংখ্যক লোক ছালাতে একত্রিত হল। এভাবে সমস্ত মসজিদ পূর্ণ হয়ে গেল। এক পর্যায়ে বায়তুল মাক্বদিসে শবেবরাতের ছালাত বা শা‘বানের ১৫তম রাতের ছালাতের ফযীলত প্রচলন হয়। পরবর্তীতে মানুষের ঘরে ঘরে তা ছড়িয়ে পড়ে। এই ধারাবাহিকতায় তা বর্তমান অবস্থায় পৌঁছায় এবং তা একটি ধর্মীয় রূপ ধারণ করে’।[৩] ইমাম ইবনু ওযায়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) স্বীয় সনদে বর্ণনা করেন,

أن ابن أبي ملكية قيل له إن زياداً النميري يقول إن ليلة النصف من شعبان أجرها كأجر ليلة القدر فقال ابن أبي ملكية: لو سمعته منه وبيدي عصاً لضربته بها، وكان زيادُ قاضياً.

‘ইবনু আবী মুলাইকাহ (রাহিমাহুল্লাহ)-কে বলা হল, যিয়াদ আন-সুমাইরী মনে করেন, শা‘বানের ১৫তম রাতের ফযীলত লাইলাতুল ক্বদরের ফযীলতের ন্যায়। তখন ইবনু আবী মুলাইকাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যদি তার থেকে আমি শুনতাম আর আমার হাতে লাঠি থাকত তাহলে আমি তার দ্বারা তাকে প্রহার করতাম। তখন যিয়াদ বিচারক ছিলেন’।[৪]

ইমাম আবূ শামাহ শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘শা‘বানের ১৫তম রাতের ছালাতকে ‘আলফিয়্যাহ’ বলা হয়। কারণ এ রাতে ১০০ রাক‘আত নফল ছালাতে ১০০০ (এক হাজার) বার সূরা ইখলাছ তেলাওয়াত করা হয়। প্রত্যেক রাক‘আতে সূরা ফাতিহা ১বার ও সূরা ইখলাছ ১০বার তেলাওয়াত করা হয়। এটা খুব লম্বা ও কষ্টকর ছালাত; যার সমর্থনে কোন ছহীহ হাদীছ কিংবা আছার (ছাহাবীদের উক্তি) পাওয়া যায় না, তবে দুর্বল ও জাল হাদীছ পাওয়া যায়। তাই এটা সাধারণ মানুষের জন্য বড় ফিতনার কারণ। এ রাতে বিভিন্ন মসজিদে আলোকসজ্জা করা হয়, গুরুত্বের সাথে সেখানে সারারাত জাগ্রত থেকে ছালাত আদায় করা হয়। পাশাপাশি অনেক পাপের কাজও সংঘটিত হয়। যেমন নারী-পুরুষের অবাধ মিলামিশা ও এ রাতের প্রশংসায় গান-বাজনার আসর বসা ইত্যাদি। অনেক সাধারণ মানুষের বন্ধমূল ধারণা হল- এগুলো ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। আর শয়তান তাদের এ সকল কর্মকা-কে আরো চাকচিক্যময় করে দিয়েছেন এবং এটাকে মুসলিমদের নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন’।[৫] হাফেয ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ) একটি মূল্যবান কথার পর বলেন,

وليلة النصف من شعبان كان التابعون من أهل الشام: كخالد بن معدان, ومكحول, ولقمان ابن عامر, وغيرهم يعظمونها ويجتهدون فيها العبادة, وعنهم أخذ الناس فضلها وتعظيمها, وقد قيل: إنه بلغهم في ذلك آثارٌ إسرائيلية, فلما اشتهر ذلك عنهم في البلدان اختلف تعظيمها، فمنهم من قبله منهم ووافقهم على تعظيمها، منهم طائفة من عبّاد أهل البصرة، وغيرهم، وأنكر ذلك أكثر العلماء من أهل الحجاز، منهم: عطاء، وابن أبي مليكه، ونقله عبد الرحمن بن زيد بن أسلم عن فقهاء أهل المدينة، وهو قول أصحاب مالك وغيرهم، وقالوا: ذلك كله بدعة، واختلف علماء أهل الشام في صفة إحيائها على قولين:

‘শা‘বানের ১৫তম রাতকে শাম দেশের তাবেঈগণ যথা- খালেদ ইবনে মি‘দান(রাহিমাহুল্লাহ), মাকহূল(রাহিমাহুল্লাহ), লুক্বমান বিন আমের (রাহিমাহুল্লাহ) এবং অন্যরা খুব সম্মানের দৃষ্টিতে দেখেন এবং এ রাতে ইবাদত করতেন। তাদের দেখেই লোকেরা এ রাতের সম্মান করতে থাকে। অবশ্য বলা হয় যে, এ মতটি তাদের নিকট ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে পৌঁছেছে। অতঃপর যখন এ মতাদর্শ বিভিন্ন দেশে প্রসিদ্ধ লাভ করে তখন এ রাতের মর্যাদার ব্যাপারে মতানৈক্য শুরু হয়। কেউ কেউ তাদের সাথে একমত হয়ে এ রাতে ইবাদত করতে থাকেন। এরা হচ্ছেন, বছরা ও অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসী। হেজাজের অনেক ওলামা এটাকে অস্বীকার ও অপসন্দ করেছেন। তাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছেন, ‘আত্বা ইবনু আবী রাবাহ্ (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইবনু আবী মুলাইকাহ (রাহিমাহুল্লাহ) প্রমুখ। আব্দুর রহমান ইবনু যায়েদ ইবনু আসলাম (রাহিমাহুল্লাহ) মদীনার ফক্বীহগণ থেকে বর্ণনা করেন, ইমাম মালেক (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সাথীগণসহ অন্যান্য আলেমেরও একই অভিমত। আর তা হচ্ছে এসবই বিদ‘আত। এ রাতে অর্থাৎ শা‘বানের ১৫তম রাতে) জাগ্রত থেকে ইবাদত করার ফযীলত নিয়ে সিরিয়ার আলেমগণের দু’টি অভিমত রয়েছে। যথা:

প্রথম অভিমত: এ রাতে জাগ্রত থেকে দলবদ্ধভাবে মসজিদে ইবাদত করার মুস্তাহাব। খালেদ ইবনে মি‘দান(রাহিমাহুল্লাহ), লুক্বমান বিন আমের (রাহিমাহুল্লাহ) সহ অন্যান্য আলেম এ রাতে উত্তম কাপড় পরিধান করতেন, আগরবাতি জ¦ালিয়ে মসজিদে সুগন্ধিময় করতেন, চোখে সুরমা লাগাতেন এবং সারা রাত ছালাত ও অন্যান্য ইবাদতে দ-ায়মান থাকতেন। ইসহাক্ব ইবনু রাহওয়াই (রাহিমাহুল্লাহ) তাদের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন। তিনি আরো বলেন, এ রাতে মসজিদে ইবাদতের জন্য দ-ায়মান হওয়া বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত নয়। হরব আল-কিরমানী এ মাসআলাটি তার থেকে বর্ণনা করেছেন।

দ্বিতীয় অভিমত: এ রাতে মসজিদে একত্রিত হয়ে ছালাত আদায়, কাহিনী বর্ণনা করা ও দু‘আ করা অপসন্দনীয়। অবশ্য একা একা ছালাত আদায় করাতে কোন দোষ নেই। এটা সিরিয়ার তৎকালীন প্রসিদ্ধ ইমাম, ফক্বীহ ও আলেম ইমাম আওযাঈ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর অভিমত। ইনশাআল্লাহ এটাই তুলনামূলক বিশুদ্ধ...। অতঃপর তিনি (ইবনে রজব) বলেন,

ولا يعرف للإمام أحمد كلامٌ في ليلة نصف شعبان، ويخرَّج في استحباب قيامها عنه روايتان، من الروايتين عنه في قيام ليلة العيد؛ فإنه في رواية لم يستحب قيامها جماعة؛ لأنه لم يُنقل عن النبي صلّى الله عليه وسلّم وأصحابه، واستحبها في رواية؛ لفعل عبد الرحمن بن زيد بن الأسود لذلك، وهو من التابعين، فكذلك قيام ليلة النصف من شعبان، لم يثبت فيها شيء عن النبي صلّى الله عليه وسلّم، ولا عن أصحابه، وثبت فيها عن طائفة من التابعين من أعيان فقهاء أهل الشام .

‘নিছফে (মধ্য) শা‘বানের অর্থাৎ শা‘বানের ১৫তম রাতের ব্যাপারে ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কোন মতামত পাওয়া যায় না, তবে নিছফে শা‘বানের ক্বিয়াম করা মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারে তার দু’টি মত বের করা যেতে পারে, ঈদের রাতে ক্বিয়াম করার ব্যাপারে তার দু’টি মত থেকে। ঈদের রাতে দলবদ্ধভাবে ক্বিয়াম করার ব্যাপারে তার একটি মত হল- তা মুস্তাহাব নয়। কেননা সে সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) ও ছাহাবীদের থেকে কিছু বর্ণিত হয়নি। দ্বিতীয় মত হল- তা মুস্তাহাব। কেননা তাবেঈ আব্দুর রহমান ইবনু যায়দ ইবনু আসওয়াদ ঈদের রাত জেগে ইবাদত করতেন। অনুরূপভাবে নিছফে শা‘বানের ব্যাপারে রাসূল (ﷺ) ও ছাহাবী (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) থেকে কিছু সাব্যস্ত নেই। তবে শামের কিছু তাবেঈ ফক্বীহ থেকে সে রাত জেগে ইবাদত করা সাব্যস্ত আছে’।[৬] আব্দুল্লাহ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

وأما ما اختاره الأوزاعي رحمه الله من استحباب قيامها للأفراد، واختيار الحافظ ابن رجب لهذا القول فهو غريب وضعيف؛ لأن كل شيء لم يثبت بالأدلة الشرعية كونه مشروعاً لم يجزْ للمسلم أن يحدثه في دين الله، سواء فعله مفرداً أو جماعة، وسواء أسره أو أعلنه، لعموم قول النبي صلّى الله عليه وسلّم.

‘আল্লামা আওযাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক এ রাতে ব্যক্তিগত ইবাদতকে মুস্তাহাব বলাটা ও হাফেয ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ)-এর তা পসন্দ করাটি অত্যন্ত দুর্বল মত। কেননা এ প্রসঙ্গে শরী‘আতের কোন অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। আর প্রমাণ ব্যতীত কোন আমল শরী‘আতসিদ্ধ নয়। কেননা তা আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আত। চাই তা ব্যক্তিগত ইবাদত হোক কিংবা সম্মিলিত ইবাদত হোক। প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য হোক। কেননা নবী করীম (ﷺ)-এর ব্যাপক কথার অন্তর্ভুক্ত। مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهْوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি আমাদের পক্ষ থেকে স্বীকৃত নয় এমন কোন আমল করল, তা প্রত্যাখ্যাত’।[৭] আরো অনেক হাদীছে বিদ‘আত সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে’।[৮] উল্লিখিত ইমাম ইবনে ওয়াযাহ(রাহিমাহুল্লাহ), ইমাম তরতুশী(রাহিমাহুল্লাহ), আব্দুর রহমান ইবনু ইসমাঈল ওরফে আবূ শামাহ (রাহিমাহুল্লাহ) হাফেয ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ) এবং ইমাম আব্দুল আযীয বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) প্রমুখের মতামত দ্বারা স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, শবেবরাতের ইবাদত, ছালাত কিংবা অন্য কোন আমল যা শরী‘আতসিদ্ধ নয় তা বিদ‘আত। কুরআন ও হাদীছে এর কোন ভিত্তি নেই এবং নবী করীম (ﷺ)-এর কোন ছাহাবায়ে কেরাম এ আমল করেননি।

পঞ্চমত: (التّبرُّك) আত-তাবাররুক

التّبرُّك هو طلب البركة، والتبرك بالشيء: طلب البركة بواسطته ‘আত-তাবাররুক’ অর্থ : বরকত চাওয়া বা কল্যাণ কামনা করা। কোন জিনিসের দ্বারা বরকত চাওয়া অর্থ ঐ জিনিসের মাধ্যমে কল্যাণ কামনা করা’।[৯] নিঃসন্দেহে যাবতীয় কল্যাণ ও বরকত আল্লাহ তা‘আলার হাতে। আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় ইচ্ছা অনুযায়ী কিছু সৃষ্টির মধ্যে অনুগ্রহ ও বরকত রেখে দিয়েছেন। বরকতের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, স্থায়ীত্ব ও আবশ্যকীয়তা, আবার বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত অর্থেও আসে। (التّبرُّك) ‘আত-তাবাররুক’ শব্দটি দু‘আ অর্থে আসে। যেমন বলা হয়ে থাকে, برَّك عليه ‘তার জন্য বরকতের দু‘আ করেছে। বলা হয়, بارك الله الشيءَ وبارك فيه أو بارك عليه ‘আল্লাহ তা‘আলা ঐ জিনিসে বরকত দান করেছেন, তার মধ্যে বরকত রয়েছে অথবা তার জন্য বরকতের দু‘আ করা হয়েছে। আর (تبارك) ‘তাবারাকা’ (বরকতময় হওয়া) শব্দটি শুধু আল্লাহ তা‘আলার জন্য নির্দিষ্ট। এটা বলা যাবে না যে, অমুক ব্যক্তি বরকতময়। কেননা বরকত শব্দের অর্থ বড় ও মহান। অতএব এ গুণ আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো জন্য হতে পারে না। (اليُمْنُ) ‘শব্দের অর্থ- বরকত। সুতরাং ‘বারাকা ও ইউমনু শব্দদ্বয় সমর্থবোধক। কুরআনুল কারীমে বরকত শব্দটি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। নি¤েœ তা উল্লেখ করা হল-

(১) চিরস্থায়ী কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত হওয়া।

(২) কল্যাণ অধিকহারে হওয়া ও ধারাবাহিকতা অটুট থাকা।

(৩) (تبارك) বা বরকতময় শব্দটি শুধু আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো দিকে নিসবত করা যাবে না। ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) উল্লেখ করেছেন,

أن تباركه سبحانه وتعالى: دوام جوده، وكثرة خيره، ومجده وعلوِّه، وعظمته وتقدسه، ومجيء الخيرات كلها من عنده، وتبريكه على من شاء من خلقه، وهذا هو المعهود من ألفاظ القرآن أنها تكون دالة على جملة معان.

‘আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বরকতময়, তাঁর দান স্থায়ী, তাঁর দেয়া কল্যাণ অফুরন্ত, তাঁর মর্যাদা সুউচ্চ, তিনি অতি মহান, পুত-পবিত্র এবং যাবতীয় কল্যাণ একমাত্র তাঁর পক্ষ থেকেই আসে। তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা কল্যাণ দান করেন। এটাই হচ্ছে (تبارك) ‘তাবারাকা’ এর প্রকৃত অর্থ যা কুরআনে রয়েছে’।[১০]

বিভিন্ন শ্রেণীর বরকতময় বিষয়

(১) কুরআনুল কারীম বরকতময়: এতে দুনিয়া ও আখেরাতের অনেক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আর এ বরকত বা কল্যাণ লাভ করা যায় বিশুদ্ধভাবে তেলাওয়াত ও কুরআনের বিধান অনুযায়ী আমল করার মাধ্যমে। যা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হতে হবে।

(২) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বরকতময়: আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মধ্যে অনেক কল্যাণ বা বরকত রেখেছেন। এ বরকত দু’প্রকার। যথা:

(ক) পরোক্ষ বরকত বা কল্যাণ: আর এটা অর্জিত হয় ইহকালে ও পরকালে তাঁর রিসালাতের বরকতের মধ্য দিয়ে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে পৃথিবীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন। তিনি মানব জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে এসেছেন। মানুষের জন্য পবিত্র জিনিস হালাল করেছেন এবং অপবিত্র জিনিস হারাম করেছেন। তাঁকে দিয়ে নবুওয়তের সমাপ্তি টানা হয়েছে এবং তাঁর আনীত দ্বীন হচ্ছে, সহজ, সরল মহানুভব এবং উদার।

(খ) প্রত্যক্ষ বরকত বা কল্যাণ: উহা দু’প্রকার। যথা:

প্রথম প্রকার: তাঁর কর্মের মধ্যে বরকত, তা হল আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে উজ্জ্বল সুস্পষ্ট মু‘জিযা দিয়ে সত্যায়িত করেছেন।

দ্বিতীয় প্রকার: তিনি সত্তাগতভাবে ও রেখে যাওয়া অনুভবযোগ্য বস্তুর দিক দিয়ে বরকতময়, যে বরকত আল্লাহ তাঁর সত্তাতে দিয়েছেন। এজন্য ছাহাবায়ে কেরাম তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর থেকে বরকত লাভ করেছেন ও তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দেহে ব্যবহৃত অবশিষ্ট বস্তুর মাধ্যমে বরকত লাভ করেছেন’।[১১]

আল্লাহ্র নবীর জীবদ্দশাতে ছাহাবায়ে কেরাম তাঁর থেকে বরকত লাভ করেছেন, তাঁর উপর ক্বিয়াস বা অনুমান করে অন্য কারো থেকে এমন বরকত লাভ করা যাবে না। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ তা‘আলা সকল নবী (আলাইহিস সালাম)-এর মাঝে অফুরন্ত বরকত রেখেছেন। অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের মাঝে এবং সৎ বান্দাদের মাঝেও বরকত রেখেছেন। কিন্তু তাদের ব্যাপারে কোন প্রমাণ না থাকায় তাদের থেকে বরকত লাভ করা বৈধ নয়। অনুরূপভাবে এমন কিছু স্থান আছে যা বরকতময়। যেমন তিনটি মসজিদ- (১) মসজিদুল হারাম, (২) মসজিদুন নববী ও (৩) মসজিদুল আক্বছা। অতঃপর দুনিয়ার সকল মসজিদ। এমনিভাবে তিনি কিছু সময়কেও বরকতময় করেছেন। যেমন- রামাযান মাস, লায়লাতুল ক্বদর, যিলহজ্জের প্রথম ১০দিন, সম্মানিত মাসসমূহ (মহররম, রজব, যিলক্বদ ও যিলহজ্জ); সোমবার, বৃহস্পতিবার, জুমু‘আহবার, প্রতি রাতে দুই তৃতীয়াংশে আল্লাহ তা‘আলা (দুনিয়ার) প্রথম আসমানে নেমে আসার মুহূর্ত ইত্যাদি। এ সময়গুলো বরকতময়। কিন্তু মুসলিমগণ এ থেকে বরকত লাভ করে না। অথচ এ সময়গুলোতে শরী‘আত সমর্থিত সৎ আমল দ্বারা বরকত লাভ করা যায়’।[১২]

(৩) আবার কিছু জিনিস রয়েছে বরকতময়: যেমন যমযমের পানি, বৃষ্টির পানি ইত্যাদি। এগুলোর বরকত হল, মানুষ, গবাদি পশু পান করবে এবং তদ্বারা যমীনে ফসল ও গাছ-পালা উৎপন্ন হবে। অনুরূপ যাইতুনের গাছ, খেজুর, দুধ, ঘোড়া, ছাগল, উট ইত্যাদিও বরকতময়’।[১৩]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)


* নারায়ণপুর, নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর।

[১]. যা ইবনু আছেম ‘আস- সুন্নাহ’ কিতাবে বর্ণনা করেছেন, হা/৫১২; ইবনু হিব্বান, ১২/৪৮১ পৃ., হা/৫৬৬৫; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, ২০/১০৯ পৃ., হা/২১৫; আবূ ন‘আইম, হিলয়াতুল আউলিয়া, ৫/১৯১ পৃ.; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, ৫/২৭২ পৃ., হা/৬৬২৮; মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে দুনিয়াবাসীর প্রতি ফিরেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করেন। আল্লামা আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর ‘সিলসিলা ছহীহাহ’ গ্রন্থে বলেন, ‘হাদীছ ছহীহ’, ছাহাবীদের একটি জামা‘আত থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে যা একটি অন্যটিকে শক্তিশালী করে। তারা হলেন, মু‘আয ইবনু জাবাল, আবূ ছা‘লাবা আল-খুশানী, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর, আবূ মূসা আল-আশ‘আরী, আবূ হুরায়রা, আবূ বকর ছিদ্দীক, আওফ ইবনু মালেক, আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)। এরপর তিনি (আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)) এই আটটি সনদ বর্ণনা করেন ও তার রাবীদের নিয়ে দীর্ঘ ৪ পৃষ্ঠা আলোচনা করেন। আমি বলব, (সাঈদ ইবনু আলী) নিছফে শা‘বানের ব্যাপারে বর্ণিত এই হাদীছটি যদি ছহীহ হয়, যেমনটি আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) উল্লেখ করেছেন, তথাপি তাতে এমন কিছু উল্লেখ নেই যা প্রমাণ করে যে, সেই রাতে ক্বিয়াম করতে হবে ও দিনে ছিয়াম পালন করতে হবে। তবে মুসলিম সে সমস্ত ইবাদত করতে পারবে যা তার নিয়মিত অভ্যাস অনুসারে করে থাকে। কেননা সকল প্রকার ইবাদত আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত।

[২]. ইমাম ইবনু ওয়াযাহ, কিতাবু ফীহি মা জাআ ফিল বিদ‘ঈ, পৃ. ১০০, হা/১১৯।

[৩]. তারতুশী (মৃ. ৪৭৪ হি.), কিতাবুল হাওয়াদিছ ওয়াল বিদ‘ঈ, পৃ. ২৬৬, হা/২৩৮ (‘মাকতাবা শামেলা, ১/১৩২ পৃ., পরিচ্ছেদ-১১)।

[৪]. ইমাম ইবনু ওযায়াহ, কিতাবু ফীহি মা জাআ ফিল বিদ‘ঈ, পৃ. ১০১, হা/১২০; তরতুশী, কিতাবুল হাওয়াদেছ ওয়াল বিদ‘ঈ, ইবনু ওয়াযাহ হতে; পৃ ২৬৩, হা/২৩৫।

[৫]. আব্দুর রহমান ইবনু ইসমাঈল ওরফে আবু শামাহ, কিতাবুল বায়েস আলা ইনকারিল বিদ‘ঈ ওয়াল হাওয়াদেছ, পৃঃ ১২৪।

[৬]. ইবনু রজব, লাতায়েফুল মা‘আরিফ, পৃ. ২৬৩।

[৭]. ছহীহ মুসলিম, ৩/৩৪৪ পৃ., হা/১৭১৮, হাদীছ পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে, পৃ. ৩৩।

[৮]. ইবনু বায, আত-তাহযীরু মিনাল বিদ‘আ’ পৃ. ২৬।

[৯]. ইবনু আছীর, আন-নিহায়াহ ফী গারীবিল হাদীছ, ‘বা সহ রা’ অধ্যায়, মূল অক্ষর ‘বারাকা’ ১/১২০ পৃ.; ড. নাছীর আল-জাদী‘, আত-তাবাররুক, আনওয়াহু ওয়া আহকামুহু, পৃ. ৩০।

[১০]. জালাউল ইফহাম, পৃ. ১৮০; সা‘দী, তাইসীরুল কারীমির রাহমান ফী তাফসীরিহ কালামিল মান্নান, ৩/৩৯ পৃ.।

[১১]. ড. নাছির আল-জাদী‘, আত-তাবাররুক: আনওয়াহু ওয়া আহকামুহু, পৃ. ২১-৬৯।

[১২]. আত-তাবাররুক: আনওয়াহু ওয়া আহকামুহু, পৃ. ৭০-১৮২।

[১৩]. আত-তাবাররুক: আনওয়াহু ওয়া আহকামুহু, পৃ. ১৮৩-১৯৭।




ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব ও মূল্যায়ন - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
কুরবানীর মাসায়েল - আল-ইখলাছ ডেস্ক
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন
বিদ‘আত পরিচিতি (৩১তম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম) -এর আগমন সংশয় নিরসন (৬ষ্ঠ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২২তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের আলোকে ছিয়াম সাধনা - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
শরী‘আত অনুসরণের মূলনীতি - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
হেদায়াত লাভের অনন্য মাস রামাযান - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা (শেষ কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
হজ্জ মুসলিম উম্মাহর বিশ্ব সম্মেলন - প্রফেসর ড. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম

ফেসবুক পেজ