ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি
-ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
(৫ম কিস্তি)
(পাঁচ) হিকমত অবলম্বন করা :
দাওয়াতী কাজ সফলভাবে সম্পাদনের জন্য প্রতিভা ও দূরদর্শিতা খুবই জরুরী। বর্তমান নব্য জাহিলিয়াতের যুগে ইসলামের পুনর্জাগরণের পথকে সুগম করতে হলে গভীর জ্ঞানের পাশাপাশি প্রয়োজন বিচক্ষণতা ও কৌশল। তাই আল্লাহ বলেন,
اُدۡعُ اِلٰی سَبِیۡلِ رَبِّکَ بِالۡحِکۡمَۃِ وَ الۡمَوۡعِظَۃِ الۡحَسَنَۃِ وَ جَادِلۡہُمۡ بِالَّتِیۡ ہِیَ اَحۡسَنُ اِنَّ رَبَّکَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِمَنۡ ضَلَّ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ وَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِالۡمُہۡتَدِیۡنَ
‘আপনি মানুষকে আপনার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করুন হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন সর্বোত্তম পন্থায়। কোন ব্যক্তি আল্লাহর পথ ছেড়ে বিপথগামী হয় সে সম্পর্কে আপনার প্রতিপালক অধিক অবহিত এবং কে হেদায়েতের পথে আছে, সে সম্পর্কে তিনি সম্যকভাবে অবহিত’ (সূরা আন-নাহল : ১২৫)।
(ছয়) দুঃখ-কষ্টে ও বিপদ-মুছীবতে ধৈর্যধারণ করা :
দাওয়াতের সাথী হল ধৈর্য। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা সূরা আছরের মধ্যে দাওয়াতের সাথে ধৈর্যকে উল্লেখ করেছেন (সূরা আল-‘আছর : ৩)। তাই এই মহৎ কাজের আঞ্জাম দেয়ার পথে দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-মুছীবত যা-ই আসুক, তাতে অসীম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে হবে। প্রত্যেক নবী-রাসূল উক্ত পথ পাড়ি দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,
وَ لَقَدۡ کُذِّبَتۡ رُسُلٌ مِّنۡ قَبۡلِکَ فَصَبَرُوۡا عَلٰی مَا کُذِّبُوۡا وَ اُوۡذُوۡا حَتّٰۤی اَتٰہُمۡ نَصۡرُنَا
‘আপনার পূর্বেও অনেক রাসূলকে মিথ্যাবাদী বলা হয়েছে। তাদের উপর মিথ্যাচার করা ও কষ্ট দেয়া সত্ত্বেও তাঁরা ধৈর্যধারণ করেছেন। অবশেষে আমার সাহায্য তাঁদের কাছে পৌঁছেছে’ (সূরা আল-আন‘আম : ৩৪)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, فَاصۡبِرۡ کَمَا صَبَرَ اُولُوا الۡعَزۡمِ مِنَ الرُّسُلِ وَ لَا تَسۡتَعۡجِلۡ لَّہُمۡ ‘অতএব আপনি ধৈর্যধারণ করুন, যেমন ধৈর্যধারণ করেছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ। আর আপনি তাদের জন্য তাড়াহুড়া করবেন না’ (সূরা আল-আহক্বাফ : ৩৫)। লুকমান তাঁর ছেলেকে অছিয়ত করে বলেন,
یٰبُنَیَّ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ وَ اۡمُرۡ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ انۡہَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ وَ اصۡبِرۡ عَلٰی مَاۤ اَصَابَکَ اِنَّ ذٰلِکَ مِنۡ عَزۡمِ الۡاُمُوۡرِ
‘হে বৎস! ছালাত কায়েম করবে, সৎকর্মের নির্দেশ দিবে আর অসৎকর্মে নিষেধ করবে এবং বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ করবে। এটা দৃঢ়সংকল্পের কাজ’ (সূরা লুক্বমান : ১৭)।
(সাত) নরম কথা, ভদ্র আচরণ ও সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে দাওয়াত পেশ করা :
দাওয়াতের জন্য উক্ত গুণগুলো একান্ত জরুরী। তাই দাঈ হবেন বিবেক সম্পন্ন ও বুদ্ধিদীপ্ত। আবেগী ও ঝোঁকপ্রবণ হবেন না। বিবেকশূন্য আবেগী ব্যক্তি গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন না, মাঝ পথে ছিটকে পড়েন। যেমন নড়বড়ে একটি গাড়ি পথ চলে, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না, মাঝ পথে বিকল হয়ে যায়। এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে,
عَنْ عِيَاضِ بْنِ حِمَارٍ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَهْلُ الْجَنَّةِ ثَلَاثَةٌ ذُوْ سُلْطَانٍ مُقْسِطٌ مُتَصَدِّقٌ مُوَفِّقٌ وَرَجُلٌ رَحِيْمٌ رَفِيْقُ الْقَلْبِ لِكُلَّ ذِىْ قُرْبَى وَمُسْلِمٍ وَعَفِيْفٌ مُتَعَفِّفٌ ذُوْ عِيَالٍ. وَأَهْلُ النَّارِ خَمْسَةٌ الضَّعِيْفُ الَّذِىْ لَا زَبْرَ لَهُ الَّذِيْنَ هُمْ فِيْكُمْ تَبَعٌ لَا يَبْغُوْنَ أَهْلًا وَلَا مَالًا وَالْخَائِنُ الَّذِىْ لَا يَخْفَى لَهُ طَمَعٌ وَإِنْ دَقَّ إِلَّا خَانَهُ وَرَجُلٌ لَا يُصْبِحُ وَلَا يُمْسِىْ إِلَّا وَهُوَ يُخَادِعُكَ عَنْ أَهْلِكَ وَمَالِكَ وَذَكَرَ الْبُخْلَ أَوِ الْكَذِبَ وَالشِّنْظِيْرُ الْفَحَّاشُ
‘ইয়ায ইবনু হিমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তিন শ্রেণীর মানুষ জান্নাতী : (এক) ইনছাফকারী ও দানশীল শাসক, যাকে সৎ কাজের যোগ্যতা দেয়া হয়েছে (দুই) এমন ব্যক্তি যিনি দয়ালু এবং নিকটস্থ ও অন্যান্য মুসলিমদের প্রতি কোমল হৃদয় (তিন) যিনি সৎচরিত্রের অধিকারী এবং পারিবারিক অসচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বেঁচে থাকেন। পাঁচ প্রকার মানুষ জাহান্নামী : (এক) দুর্বল বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি, যে নিজের স্থূল বুদ্ধির কারণে নিজেকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে না। এই সমস্ত লোক তাদের অন্তর্ভুক্ত, যারা তোমাদের অধীনস্ত চাকর-বাকর। তারা স্ত্রী-পরিবার চায় না এবং সম্পদেরও ভ্রুক্ষেপ করে না (দুই) এমন আত্মসাৎকারী, যার লোভ থেকে গোপনীয় জিনিসও রক্ষা পায় না। অতি তুচ্ছ জিনিসও আত্মসাৎ করে (তিন) এমন ব্যক্তি যে তোমাকে তোমার পরিবার ও সম্পদের ব্যাপারে প্রতারণায় ফেলার জন্য সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত থাকে (চার) কৃপণতা ও মিথ্যাবাদিতা (পাঁচ) দুশ্চরিত্র ও অশ্লীলভাষী’।[১]
অপরিচিত মানুষের সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে কথা, লেখনি কিংবা চিঠির ভাষার মাধ্যমে। তাই কথা শুনলে, লেখনি পড়লে এবং চিঠির ভাষা উচ্চারণ করলেই তার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। একজন দাঈর জন্য ভাষা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সে জন্যই রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে লক্ষ্য করে আল্লাহ বলেন,
فَبِمَا رَحۡمَۃٍ مِّنَ اللّٰہِ لِنۡتَ لَہُمۡ وَ لَوۡ کُنۡتَ فَظًّا غَلِیۡظَ الۡقَلۡبِ لَانۡفَضُّوۡا مِنۡ حَوۡلِکَ فَاعۡفُ عَنۡہُمۡ وَ اسۡتَغۡفِرۡ لَہُمۡ وَ شَاوِرۡہُمۡ فِی الۡاَمۡرِ فَاِذَا عَزَمۡتَ فَتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰہِ اِنَّ اللّٰہَ یُحِبُّ الۡمُتَوَکِّلِیۡنَ
‘অতএব আল্লাহর অনুগ্রহ এই যে, আপনি তাদের প্রতি কোমল চিত্ত। আপনি যদি কর্কশভাষী, কঠোর হৃদয় বিশিষ্ট হতেন, তাহলে তারা আপনার সংসর্গ হতে দূরে সরে যেত। তাই আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং কাজের ব্যাপারে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। আর যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, তখন আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল করুন। নিশ্চয় আল্লাহ নির্ভরশীলদেরকে ভালবাসেন’ (সূরা আলে ইমরান : ১৫৯)।
মূলনীতি-৬ : যোগ্য ও সাহসী ব্যক্তির নেতৃত্ব প্রদান
যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া কোন সংগ্রাম সফল করা যায় না। তাই ইসলামী পুনর্জাগরণের জন্য প্রতিভাদীপ্ত, তাক্বওয়া সম্পন্ন, ন্যায়পরায়ণ, দূরদর্শী, আত্মবিশ্বাসী এবং সাহসী ব্যক্তির নেতৃত্ব একান্ত জরুরী। সে জন্য আল্লাহ তা‘আলা এবং রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্যের সাথে সাথে যোগ্য নেতৃত্বেরও আনুগত্য করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰہَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡکُمۡ فَاِنۡ تَنَازَعۡتُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ فَرُدُّوۡہُ اِلَی اللّٰہِ وَ الرَّسُوۡلِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ذٰلِکَ خَیۡرٌ وَّ اَحۡسَنُ تَاۡوِیۡلًا
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা শাসক তাদের। যদি তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়, তবে সে বিষয়টিকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও- যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাক। এটাই কল্যাণকর ও শ্রেষ্ঠ পরিসমাপ্তি’ (সূরা আন-নিসা : ৫৯)। অনুরূপ হাদীছেও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য যোগ্য নেতার আনুগত্য করার তাকীদ দেয়া হয়েছে।
عَنِ الْعِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ رضى الله عنه قَالَ صَلَّى بِنَا رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ذَاتَ يَوْمٍ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيْغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُوْنُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوْبُ فَقَالَ قَائِلٌ يَا رَسُوْلَ اللهِ كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَمَاذَا تَعْهَدُ إِلَيْنَا فَقَالَ أُوصِيْكُمْ بِتَقْوَى اللهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِىْ فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيْرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِىْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّيْنَ الرَّاشِدِيْنَ تَمَسَّكُوْا بِهَا وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ
ইরবায ইবনু সারিয়াহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদিন আমাদের নিয়ে ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসলেন। তারপর আমাদেরকে এমন মর্মস্পর্শী ভাষণ দিলেন, যাতে চক্ষুসমূহ অশ্রুসজল হয়ে গেল এবং হৃদয়সমূহ ভীত-বিহ্বল হয়ে গেল। এমন সময় একজন লোক বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! মনে হচ্ছে এটা বিদায়ী উপদেশ। অতএব আপনি আমাদেরকে আরও বেশী উপদেশ দিন। তখন রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘আমি তোমাদেরকে আল্লাহ ভীতির অছিয়ত করছি এবং তোমাদের আমীরের আদেশ শুনতে ও মান্য করতে উপদেশ দিচ্ছি, যদিও তিনি একজন হাবশী গোলাম হন। কেননা আমার পরে তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে, তারা সত্বর বহু মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাতকে এবং সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে। তাকে কঠিনভাবে ধরবে এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরবে। সাবধান! দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি সমূহ হতে দূরে থাকবে। কেননা (দ্বীনের ব্যাপারে) যেকোন নতুন সৃষ্টি হল বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা’।[২]
ইসলামী পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে ক্রসেড বিজেতা ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী এক জ্বলন্ত উদাহরণ। তিনি ছিলেন সর্বোত্তম সাংগঠনিক যোগ্যতা ও অতুলনীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নেতৃত্বের অধিকারী। তিনি কেবল সিপাহসালার ও বিজেতাই ছিলেন না; বরং জনপ্রিয় নেতা ও সকলের কাছেই গ্রহণযোগ্য সিপাহীও ছিলেন। কয়েক শতাব্দী পর বিক্ষিপ্ত ও বিস্তৃত ইসলামী রাজ্যকে তিনি জিহাদের পতাকাতলে সমবেত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে মুসলিম বিশ্ব একটি সুসংগঠিত সংগ্রাম পরিচালনা করে, যার লক্ষ্যই ছিল মুসলিম উম্মাহর হেফাযত করা। ঐতিহাসিক লেনপুল যথার্থই বলেছেন,
“All the strength of Christendom concentrated in the third Crusade had not shaken Salasdin`s power. His soldiers many have murmured at their long months of hard and perilous service year after year, but they never refused to come to his summons and lay down their lives in his cause….” [৩]
‘তৃতীয় ক্রুসেড যুদ্ধে সমগ্র খ্রীস্টানজগতের মিলিত শক্তি মুসলিমদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু ছালাহুদ্দীনের শক্তিতে তারা এতটুকু চিড় ধরাতে পারেনি। ছালাহুদ্দীনের সৈন্যরা মাসের পর মাস কঠিন পরিশ্রম এবং বছরের পর বছর বিপদসঙ্কুল খেদমতে নিয়োজিত থাকার কারণে ক্লান্তি ও অবসাদে ভেঙে পড়েছিল বটে, কিন্তু তাদের মুখে অভিযোগের লেশমাত্র ছিল না। তলব মাত্র হাজির হতে এবং একটি নেক কাজে নিজেদের জীবন কুরবানী দিতে তাদের কেউ পিছপা হয়নি।’ একটু পরে তিনি বলেন,
“Kurds, Turkmans, Arabs and Egyptians, they were all moslems and his servants when he called. In spite of their differences of race, their national jealousies and tribal pride, he had kept them togeher as one host-not without difficulty and twice or thrice, a critical waver.” [৪]
‘কুর্দ, তুর্কমেন, আরব, মিশরীয় সমস্ত মুসলমানই ছিল সুলতানের খাদেম। তলব মাত্রই তারা খাদেমের মতই সুলতানের খেদমতে এসে হাজির হত। কে কোন্ বংশের কিংবা কে কোন্ জাতিগোষ্ঠীর, সেদিকে তাদের লক্ষ্য ছিল না। বর্ণ, বংশ, গোত্রগত বৈপরীত্য সত্ত্বেও সুলতান তাদেরকে এমন একটি অখ- ও ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করেছিলেন যে, গোটা বাহিনী যেন এক আত্মায় বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন। মনে হত সবাই যেন একই জাতিগোষ্ঠীর সদস্য’।
ইসলামী পুনর্জাগরণে নেতৃত্বের আনুগত্য যে কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা উক্ত আলোচনায় পরিস্ফুটিত হয়েছে। মুসলিম উম্মাহ যদি আবার এরূপ নেতৃত্বের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, তবে অবশ্যই ইসলামের পুনর্জাগরণ ঘটবে।
নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা :
যথাযথভাবে নেতার আনুগত্য করা কোন আদর্শের বিজয়ের জন্য পূর্বশর্ত। নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের সামান্য ঘাটতি থাকলে আদর্শের সেই সংগ্রাম কখনও সফল হবে না। এ জন্য ইসলামী শরী‘আতে আমীরের আনুগত্য অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ।
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ أَطَاعَنِيْ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَانِيْ فَقَدْ عَصَى اللهَ وَمَنْ يُطِعْ الْأَمِيْرَ فَقَدْ أَطَاعَنِيْ وَمَنْ يَعْصِ الْأَمِيْرَ فَقَدْ عَصَانِيْ وَإِنَّمَا الْإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ وَيُتَّقَى بِهِ فَإِنْ أَمَرَ بِتَقْوَى اللهِ وَعَدَلَ فَإِنَّ لَهُ بِذَلِكَ أَجْرًا وَإِنْ قَالَ بِغَيْرِهِ فَإِنَّ عَلَيْهِ مِنْهُ
আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে যেন আল্লাহর আনুগত্য করল। যে ব্যক্তি আমার নাফরমানী করল, বস্তুত সে আল্লাহর নাফরমানী করল। যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য করল, সে আমারই আনুগত্য করল। যে আমীরের অবাধ্য হল, সে যেন আমারই অবাধ্য হল। প্রকৃতপক্ষে শাসক হলেন ঢাল স্বরূপ, তাঁর পশ্চাতে থেকে যুদ্ধ করা হয় এবং তাঁর দ্বারা নিরাপদে থাকা যায়। সুতরাং যে নেতা আল্লাহ্র প্রতি ভয়-ভীতি রেখে তাঁর বিধান প্রতিষ্ঠা করে, তিনি তার বিনিময়ে ছওয়াব ও প্রতিদান পাবেন। কিন্তু যদি তিনি তার বিপরীত কোন কাজ করেন, তাহলে তার গুনাহ তার উপরই বর্তাবে’।[৫]
عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ فِيْمَا أَحَبَّ وَكَرِهَ مَا لَمْ يُؤْمَرْ بِمَعْصِيَةٍ فَإِذَا أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, (নেতার নির্দেশ) শ্রবণ করা এবং আনুগত্য করা ‘প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। সেই নির্দেশ তার পসন্দ হোক কিংবা অপসন্দ হোক, যতক্ষণ না তাকে নাফরমানীর নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু যদি তার প্রতি নাফরমানীর নির্দেশ দেয়া হয়, তবে তা শ্রবণ করা ও আনুগত্য করার দায়িত্ব তার নেই’।[৬]
মূলনীতি-৭ : নির্ভেজাল তাওহীদের ঝাণ্ডাবাহী প্লাটফরমে সমবেত হওয়া
একতাই বল। কথাটি যেমন প্রসিদ্ধ, তেমনি কার্যকরী। কোন আদর্শের পুনর্জাগরণের জন্য ঐক্যবদ্ধ শক্তি শ্রেষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। আর আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে সর্বদা একশ্রেণীর মানুষকে মহা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখবেন। তাই সকলকে সেই নির্ভেজাল তাওহীদের প্লাটফরমে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তাহলে কাক্সিক্ষত সাফল্য পাওয়া যাবে। মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বপ্রথম ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনেরই প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰہِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا وَ اذۡکُرُوۡا نِعۡمَتَ اللّٰہِ عَلَیۡکُمۡ اِذۡ کُنۡتُمۡ اَعۡدَآءً فَاَلَّفَ بَیۡنَ قُلُوۡبِکُمۡ فَاَصۡبَحۡتُمۡ بِنِعۡمَتِہٖۤ اِخۡوَانًا وَ کُنۡتُمۡ عَلٰی شَفَا حُفۡرَۃٍ مِّنَ النَّارِ فَاَنۡقَذَکُمۡ مِّنۡہَا کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰہُ لَکُمۡ اٰیٰتِہٖ لَعَلَّکُمۡ تَہۡتَدُوۡنَ
‘তোমরা একযোগে আল্লাহ্র রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং দলে দলে বিভক্ত হয়ো না। আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর যে অনুগ্রহ রয়েছে, তা তোমরা স্মরণ কর। যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, তখন তিনিই তোমাদের অন্তকরণে প্রীতি স্থাপন করেছিলেন। তারপর তোমরা তাঁর অনুগ্রহে ভ্রাতৃত্বে আবদ্ধ হলে। তোমরা যখন অগ্নিকু-ের নিকটে ছিলে, তখন অনন্তর তিনিই তোমাদেরকে তা হতে উদ্ধার করেছেন। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় নিদর্শনাবলী ব্যক্ত করেন, যাতে তোমরা সুস্পষ্ট পথ পাও’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)।
রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় গিয়ে সর্বপ্রথম আওস ও খাজরায গোত্রের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে বিদ্যমান যুদ্ধ বন্ধ করেন এবং পরস্পরকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেন। ইহুদীদের চক্রান্তে হঠাৎ একদিন তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উভয় গোত্রের মাঝে পুনরায় যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলিত এবং ভ্রাতৃত্ব বিনষ্টের উপক্রম হয়। তখনই উক্ত আয়াত নাযিল হয়।[৭]
তাই ঐতিহাসিক গীবন বলেন, “It was one of most memorable revolution which have impressed a new and lasting charter on the nations of the globe.” [৮] ‘এই বিপ্লব এমন অবিস্মরণীয়, যা পৃথিবীর সমস্ত জাতির উপর একটি নতুন এবং চিরস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করেছে, ইসলামের মহান সংহতি স্থাপনে এবং সর্বজাতির সমন্বয়ে জাতি প্রতিষ্ঠা করে অক্ষয় কীর্তি রেখে গেছে’। পি কে হিট্টি বলেন, “Within a brief span of moratal life Muhammad called forth out of uncompromising material a nation never united before in a country that was hitherto but a geographical expression.”[৯] ‘মরণশীল জীবনের অতি অল্প পরিসরে মুহাম্মাদ বিশৃঙ্খল ও প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে এমন একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি ও সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র গঠন করেন, যা ইতিপূর্বে শুধু ভৌগলিক সীমারেখায় নিবন্ধ ছিল’।
জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে সাফল্য আসবেই। বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কাজ করে সফলতার দ্বার উন্মোচন করা অত্যন্ত কঠিন। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জাতিতে জাতিতে যে বিভেদ ছিল তার শিকড় উপড়ে ফেলেছিলেন। অন্য একটি হাদীছে এসেছে,
عَنِ الْحَارِثِ الْأَشْعَرِىِّ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم آمُرُكُمْ بِخَمْسٍ بِالْجَمَاعَةِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَالْهِجْرَةِ وَالْجِهَادِ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ وَإِنَّهُ مَنْ خَرَجَ مِنَ الْجَمَاعَةِ قِيْدَ شِبْر ِفَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الْإِسْلاَمِ مِنْ عُنُقِهِ إِلاَّ أَنْ يُرَاجِعَ وَمَنْ دَعَا بِدَعْوَىِ الْجَاهِلِيَّةِ فَهُوَ مِنْ جُثَى جَهَنَّمَ وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أَنَّهُ مُسْلِمٌ
হারিছ আল-আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছি (১) জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন করা (২) আমীরের নির্দেশ শ্রবণ করা (৩) তাঁর আনুগত্য করা (৪) প্রয়োজনে হিজরত করা ও (৫) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। যে ব্যক্তি জামা‘আত হতে এক বিঘত পরিমাণ বের হয়ে গেল তার গর্দান হতে ইসলামের গ-ি ছিন্ন হল-যতক্ষণ না সে ফিরে আসে। যে ব্যক্তি মানুষকে জাহেলিয়াতের দাওয়াত দ্বারা আহ্বান জানাল, সে ব্যক্তি জাহান্নামীদের দলভুক্ত হল। যদিও সে ছিয়াম পালন করে, ছালাত আদায় করে এবং ধারণা করে যে, সে একজন মুসলিম’।[১০] অন্য একটি হাদীছে এসেছে,
عَنْ عُمَرَ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَكْرِمُوْا أَصْحَابِىْ فَإِنَّهُمْ خِيَارُكُمْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ثُمَّ يَظْهَرُ الْكِذْبُ حَتَّى إَنَّ الرَّجُلَ لَيَحْلِفُ وَلاَ يُسْتَحْلِفُ وَيَشْهَدُ وَلاَ يُسْتَشْهَدُ أَلاَ مَنْ سَرَّهُ بُحْبُوْحَةُ الْجَنَّةِ فَلْيَلْزَمِ الْجَمَاعَةَ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ مَعَ الْفَذِّ وَهُوْ مِنَ الْإِثْنَيْنِ أَبعَدُ وَلاَيَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ ثَالِثُهُمْ وَمَنْ سَرَّتْهُ حَسَنَتُهُ وَسَاءَتْهُ سَيِّئَتُهُ فَهُوَ مُؤْمِنٌ
ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘আমার ছাহাবীগণকে সম্মান কর। কেননা তারা তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম লোক। অতঃপর তৎপরবর্তীদেরকে (তাবেঈ), অতঃপর তার পরবর্তী লোকদেরকে (তাবে‘ তাবেঈ)। এরপর মিথ্যার আবির্ভাব ঘটবে। এমনকি কোন ব্যক্তি (স্বেচ্ছায়) কসম করবে, অথচ তার নিকট কসম চাওয়া হবে না। সে সাক্ষ্য দিবে, অথচ তার নিকট হতে সাক্ষ্য চাওয়া হবে না। সাবধান! যে ব্যক্তি জান্নাতের মধ্যস্থলের আকাক্সক্ষী, সে যেন জামা‘আতকে ধরে রাখে। কেননা শয়তান সে ব্যক্তির সাথে থাকে, যে জামা‘আত হতে পৃথক থাকে। সাবধান! তোমাদের কেউ যেন কোন বেগানা নারীর সাথে নির্জনে অবস্থান না করে। কেননা শয়তান তৃতীয় ব্যক্তি হিসাবে তাদের মাঝে উপস্থিত থাকে। আর যার নেক কাজে মনের মধ্যে আনন্দ জাগে এবং খারাপ কাজ তাকে চিন্তিত করে ফেলে, সেই প্রকৃত ঈমানদার’।[১১]
মূলনীতি-৮ : সর্বত্র জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে আপোসহীন ভূমিকা পালন করা
ইসলাম ও জাহিলিয়াতের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। কারণ জাহিলিয়াতের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। তাই প্রাচীন ও নব্য জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রাম পরিচালনা করাই মুমিন জীবনের একটি অন্যতম অধ্যায়। ইসলামী জাগরণকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য জাহিলী সভ্যতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে বলেন, اَفَحُکۡمَ الۡجَاہِلِیَّۃِ یَبۡغُوۡنَ وَ مَنۡ اَحۡسَنُ مِنَ اللّٰہِ حُکۡمًا لِّقَوۡمٍ یُّوۡقِنُوۡنَ ‘তবে কি তারা জাহিলিয়াতের বিধান কামনা করে। আর দৃঢ় বিশ্বাসীদের কাছে মীমাংসার ক্ষেত্রে আল্লাহ্র চেয়ে কে অধিক উত্তম হতে পারে’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৫০)? জাহিলী আদর্শের বিরুদ্ধে হাদীছে অত্যন্ত কঠোর বাণী উচ্চারিত হয়েছে। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য অনুকরণ করবে, সে ঐ জাতিরই অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে’।[১২] অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رضى الله عنهما أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ أَبْغَضُ النَّاسِ إِلَى اللهِ ثَلاَثَةٌ مُلْحِدٌ فِى الْحَرَمِ وَمُبْتَغٍ فِى الْإِسْلاَمِ سُنَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ وَمُطَّلِبُ دَمِ امْرِئٍ بِغَيْرِ حَقٍّ لِيُهَرِيْقَ دَمَهُ
ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি তিনজন : (ক) যে ব্যক্তি হারামের মধ্যে অন্যায় কাজ করে। (খ) যে ব্যক্তি মুসলিম সমাজে জাহিলী রীতি চালু করে এবং (গ) যে ব্যক্তি অন্যায়ভবে কারো রক্তপাত দাবী করে।[১৩] রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্য হাদীছে বলেন,
وَمَنِ ادَّعَى دَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَإِنَّهُ مِنْ جُثَا جَهَنَّمَ فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَإِنْ صَلَّى وَصَامَ قَالَ وَإِنْ صَلَّى وَصَامَ فَادْعُوا بِدَعْوَى اللهِ الَّذِىْ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِيْنَ الْمُؤْمِنِيْنَ عِبَادَ اللهِ
‘যে ব্যক্তি মানুষকে জাহিলিয়াতের দাওয়াত দ্বারা আহ্বান জানাল, সে ব্যক্তি জাহান্নামীদের দলভুক্ত হল। জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! যদি সে ছালাত আদায় করে এবং ছিয়াম পালন করে? তিনি বললেন, যদিও সে ছালাত আদায় করে এবং ছিয়াম পালন করে। অতএব তোমরা আল্লাহ্র দিকে দাওয়াত দাও, যিনি তাঁর বান্দা হিসাবে তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম মুমিন’।[১৪] অন্য একটি হাদীছে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُوْدَ وَشَقَّ الْجُيُوْبَ وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ ‘ঐ ব্যক্তি আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়, যে (মৃত শোকে) গালে মারে, কাপড় ছিঁড়ে এবং জাহিলিয়াতের দিকে মানুষকে আহ্বান করে’।[১৫]
জাহেলী যুগে প্রচলিত কোন কর্ম রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাধারণত করতে চাইতেন না। বরং বিরোধিতা করতেন। কারণ জাহিলিয়াত হল ভ্রষ্টতা আর ইসলাম হল হিদায়াত। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জের ভাষণে পরিষ্কার করে বলে গেছেন,
إِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ حَرَامٌ عَلَيْكُمْ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِىْ شَهْرِكُمْ هَذَا فِىْ بَلَدِكُمْ هَذَا أَلاَ كُلُّ شَىْءٍ مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ تَحْتَ قَدَمَىَّ مَوْضُوْعٌ وَدِمَاءُ الْجَاهِلِيَّةِ مَوْضُوْعَةٌ وَإِنَّ أَوَّلَ دَمٍ أَضَعُ مِنْ دِمَائِنَا دَمُ ابْنِ رَبِيْعَةَ بْنِ الْحَارِثِ كَانَ مُسْتَرْضِعًا فِىْ بَنِى سَعْدٍ فَقَتَلَتْهُ هُذَيْلٌ وَرِبَا الْجَاهِلِيَّةِ مَوْضُوْعٌ وَأَوَّلُ رِبًا أَضَعُ رِبَانَا رِبَا عَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَإِنَّهُ مَوْضُوْعٌ كُلُّهُ فَاتَّقُوا اللهِ فِى النِّسَاءِ فَإِنَّكُمْ أَخَذْتُمُوْهُنَّ بِأَمَانِ اللهِ وَاسْتَحْلَلْتُمْ فُرُوْجَهُنَّ بِكَلِمَةِ اللهِ وَلَكُمْ عَلَيْهِنَّ أَنْ لاَ يُوْطِئْنَ فُرُشَكُمْ أَحَدًا تَكْرَهُوْنَهُ فَإِنْ فَعَلْنَ ذَلِكَ فَاضْرِبُوْهُنَّ ضَرْبًا غَيْرَ مُبَرِّحٍ وَلَهُنَّ عَلَيْكُمْ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوْفِ وَقَدْ تَرَكْتُ فِيْكُمْ مَا لَنْ تَضِلُّوْا بَعْدَهُ إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ كِتَابَ اللهِ
‘তোমাদের একজনের জান-মাল অন্যদের উপর হারাম, যেভাবে এই দিনে, এই মাসে, এই শহরে হারাম। সাবধান! জাহেলী যুগের সকল অপকর্ম আমি আমার দু’পায়ের নীচে রেখে দিলাম। জাহেলী যুগের রক্তের দাবীসমূহও রহিত হল। আর আমাদের রক্তের যে দাবী আমি প্রথমে রহিত করলাম, তা হল ইবনু রাবী‘আ ইবনু হারছের রক্তের দাবী। সে বনী সা‘দ গোত্রে দুধপান অবস্থায় ছিল, এমন অবস্থায় হুযাইল গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করে। অনুরূপ জাহেলী যুগের সূদকে আমার দু’পায়ের নীচে রেখে দিলাম। প্রথমে রাখলাম (আমার চাচা) আব্বাস ইবনু আবদুল মুত্তালিবের সূদ। এর সবই পায়ের নীচে রাখলাম। ‘তোমরা নারীদের ব্যাপারে আল্লাহ্কে ভয় করবে। কারণ তোমরা তাদেরকে গ্রহণ করেছ আল্লাহ্র যামানতে এবং আল্লাহর নির্দেশে তাদের লজ্জাস্থানকে হালাল করেছ। তাদের উপর তোমাদের হক্ব হল, তারা যেন তোমদের স্থানে অন্যকে যেতে না দেয়, যা তোমরা অপসন্দ কর। যদি তারা তা করে, তবে তাদেরকে সাধারণভাবে মারধর করবে। আর তোমাদের উপর তাদের হক্ব হল, তোমরা ন্যায়সঙ্গতভাবে তাদের অন্ন ও বস্ত্রের ব্যবস্থা করবে। আমি তোমাদের মধ্যে এমন এক জিনিস রেখে যাচ্ছি, যদি তোমরা তা ধরে থাক, তবে তোমরা আমার পর কখনও বিপথগামী হবে না। তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব’।[১৬]
তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ মুসলিম, পৃ. ৮৫৮, হা/২৮৬৫; মিশকাতুল মাছাবীহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৩৮৬, হা/৪৯৬০।
[২]. সুনানু আবী দাঊদ, পৃ. ৮৩২, হা/৪৬০৭, ‘সুন্নাহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬।
[৩]. মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারালো?, পৃ. ১৭১।
[৪]. তদেব, পৃ. ১৭১-১৭২।
[৫]. ছহীহুল বুখারী, পৃ. ৩৫২, হা/২৯৫৭; মিশকাতুল মাছাবীহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১০৮৫, হা/৩৬৬১।
[৬]. ছহীহুল বুখারী, পৃ. ৮৭২, হা/৭১৪৪; ছহীহ মুসলিম, পৃ. ৫৫৭, হা/১৮৩৯; মিশকাতুল মাছাবীহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১০৮৬, হা/৩৬৬৪।
[৭]. আব্দুল মালিক ইবনু হিশাম ইবনু আইয়ূব আল-হুমাইরী আল-মু‘আফিরী আবু মুহাম্মাদ, আস-সীরাহ আন-নাবুবিয়াহ লি ইবনি হিশাম, ৩য় খণ্ড (বৈরুত : দারুল জাইল, ১৪১১ হি.), পৃ. ৯৪; ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতূম (বৈরুত : দারুল মুআইয়িদ, ১৯৯৬ খৃ./১৪১৬ হি.), পৃ. ১০৬।
[৮]. বিশ্ব শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা), পৃ. ২৯১।
[৯]. PHILIP. K. HITTI, History of the Arabs (from the earliest times to the present) (London : The Macmillan Press Ltd, Tenth edition 1970, 16th reprint 1994), p. 121-122.
[১০]. মুসনাদুল ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২০২, হা/১৭৮৩৩; সুনানুত তিরমিযী, পৃ. ৬৪০, হা/২৮৬৩; সনদ ছহীহ, মিশকাতুল মাছাবীহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১০৯১-১০৯২, হা/৩৬৯৪, ‘ইমারত’ অধ্যায়।
[১১]. মুসনাদুল ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল, ১ম খ-, পৃ. ৬৬, হা/১৭৭, সনদ ছহীহ, মিশকাতুল মাছাবীহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৬৯৫, হা/৬০১২।
[১২]. সুনানু আবী দাউদ, পৃ. ৭২১, হা/৪০৩১; মিশকাতুল মাছাবীহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১২৪৬, হা/৪৩৪৭।
[১৩]. ছহীহুল বুখারী, পৃ. ৮৪০, হা/৬৮৮২, ‘দিয়াত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৯; মিশকাতুল মাছহীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫১, হা/১৪২।
[১৪]. সুনানুত তিরমিযী, পৃ. ৬৪০, হা/২৮৬৩; মুসনাদুল ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২০২, হা/১৭৮৩৩; সনদ ছহীহ।
[১৫]. ছহীহুল বুখারী, পৃ. ১৬৩, হা/১২৯৭।
[১৬]. ছহীহ মুসলিম, পৃ. ৩৫৫, হা/১২১৮, ‘হজ্জ’ অধ্যায়, ‘নবী (ছা.)-এর হজ্জ’ অনুচ্ছেদ-১৯; মিশকাতুল মাছাবীহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭৮৩, হা/২৫৫৫।
প্রসঙ্গসমূহ »:
শারঈ মূলনীতি