ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও তার সমাধান
-ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় ইসলামী পুনর্জাগরণের পথে হিমাদ্রিসম অসংখ্য বাধা দৃশ্যমান। তবে মুসলিম সমাজের কর্ণধারগণ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে এই বাধা অতিক্রম করা সম্ভব। কারণ ইতিপূর্বেও হাজারো বাধা ছিন্ন করেই পুনর্জাগরণের পথ উন্মুক্ত হয়েছে। সে জন্য উক্ত বাধাগুলো মুকাবেলা করতে হবে সুনির্দিষ্ট পন্থায়। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন হল- মৌলিক বাধাগুলো চিহ্নিত করণ এবং এর প্রতিকারে কার্যকরী নীতি নির্ধারণ।
পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হল, ইসলাম সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ ধারণা না থাকা। তাছাড়া ইসলাম বিরোধী চক্রের অপপ্রচার এবং পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের রচিত আধুনিক মতবাদ ইসলামের পুনর্জীবনী ধারাকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। বিশেষ করে মানব রচিত থিওরিগুলো ইসলামের যাত্রাকে অক্টোপাসের মত আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রেখেছে। বিরোধী গ্রুপগুলো জাহেলী সংস্কৃতি প্রতিস্থাপন করে ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির মূলোৎপাটনে সর্বদা সিদ্ধহস্ত।[১] অন্যদিকে ইসলামের নামে সামাজিক কুসংস্কার, উছূলী বিতর্ক ও দলীয় বিভক্তি মুসলিম উম্মাহকে আরো ক্ষত-বিক্ষত করেছে।[২]
বর্তমান পরিস্থিতিতে উক্ত বাধাগুলো অতিক্রম করা কঠিন হলেও মুসলিম উম্মাহ ও বিশ্বমানবতার স্বার্থে এই পথ পাড়ি দিতে হবে। এ জন্য শারঈ জ্ঞানে পরিপক্ক ও আধুনিক বিশ্ব সভ্যতা সম্পর্কে অভিজ্ঞ একশ্রেণীর সাহসী ব্যক্তির প্রয়োজন, যারা বাধাগুলো চিহ্নিত করবেন এবং এর ক্ষতির দিকগুলো মানুষের সামনে পেশ করবেন। সেই সাথে ইসলামী বিধানের স্থায়ী কল্যাণের দিক প্রকাশ করবেন। নিম্নে ইসলামী পুনর্জাগরণের বাধা ও উত্তরণের উপায় সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরা হল।
(১) ইসলাম সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক ধারণার অভাব :
ইসলামের প্রথম বাণী হল, পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন (সূরা আল-আলাক্ব : ১)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আপনি জানুন যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই’ (সূরা মুহাম্মাদ : ১৯)। কারণ জ্ঞান অর্জন ছাড়া প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করা যায় না। আল্লাহ প্রদত্ত শরী‘আত চিরন্তন ও অপরিবর্তনশীল, আপোসহীন ও অপ্রতিরোধ্য। তার নিজস্ব স্বকীয়তা ও সাতন্ত্র্য রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর আমি এ কিতাবকে আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যা হক্বের সাথে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহেরও সত্যতা প্রমাণকারী এবং ঐ কিতাবসমূহের সংরক্ষকও। অতএব আপনি তাদের পারস্পরিক বিষয়ে আল্লাহর নাযিলকৃত এই কিতাব অনুযায়ী মীমাংসা করুন। এটা পরিত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী কাজ করবেন না। তোমাদের প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য আমি নির্দিষ্ট শরী‘আত এবং নির্দিষ্ট পন্থা নির্ধারণ করেছি’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৪৮)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘এরপর আমি আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি দ্বীনের বিশেষ শরী‘আতের উপর। সুতরাং আপনি তার অনুসরণ করুন, মূর্খদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না’ (সূরা আল-জাছিয়াহ : ১৮)।
মুসলিম হিসাবে তার জীবন বিধান সম্পর্কে সম্মক জ্ঞান রাখা আবশ্যক। তাই প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির উপর দ্বীনী ইলম অর্জন করা ফরয।[৩] আক্বীদা ও আমল সম্পর্কে এতটুকু ইলম অর্জন করা, যাতে দ্বীনের হুকুম-আহকাম, তাওহীদ-শিরক, সুন্নাত-বিদ‘আত, হালাল-হারাম সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। আসলে ইসলাম সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা না থাকাই ইসলামী পুনর্জারণের সবচেয়ে বড় বাধা। তবে ইলম অর্জনের পাশাপাশি শরী‘আত বুঝার মূলনীতি সম্পর্কে যথার্থ ধারণা থাকলে ইসলাম বুঝা সহজ হয়ে যায়।
(ক) তাওহীদের জ্ঞান অর্জন করা :
প্রত্যেক ব্যক্তির তাওহীদ সম্পর্কে সঠিক ও স্বচ্ছ ধারণা থাকা আবশ্যক। কারণ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আল্লাহকে চেনা প্রধান শর্ত। আল্লাহর একত্ব বা তাওহীদ তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত। সূরা ফাতেহার শুরুতেই উক্ত তিনটি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে (সূরা আল-ফাতিহা : ১-৫)। (ক) তাওহীদে রুবূবিয়াহ। এর অর্থ আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রুযীদাতা, আইনদাতা হিসাবে বিশ্বাস করা। (খ) তাওহীদে উলূহিয়াহ। এর অর্থ যাবতীয় ইবাদত, চাওয়া, দু‘আ, ভয় সবকিছুই আল্লাহর জন্য খাছ করা। অর্থাৎ জীবনের সর্বক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহরই দাসত্ব করা। সকল কাজকর্মে আল্লাহর এককত্ব প্রমাণ করা। যাবতীয় প্রার্থনা, ইবাদত, মানত, দু‘আ সবই এক আল্লাহর শানে পেশ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُوْنِ ‘আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি এই জন্য যে, তারা একমাত্র আমারই ইবাদত করবে (সূরা আয-যারিয়াত : ৫৬)। (গ) তাওহীদে আসমা ওয়া ছিফাত। এর অর্থ- আল্লাহর নামসমূহ ও তাঁর গুণাবলী এককভাবে তাঁর সাথেই সম্পৃক্ত বলে বিশ্বাস করা। এগুলো অন্য কারো সাথে তুলনীয় নয়। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, ঐভাবেই বিশ্বাস করতে হবে। কোন রূপক বা বিকৃত অর্থ করা যাবে না, কোন কল্পিত ব্যাখ্যাও চলবে না। আল্লাহ বলেন, لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা (সূরা আশ-শূরা : ১১)। সুতরাং তাঁর আকারের সাথে কোন কিছুর তুলনা করা যাবে না। যেমন আল্লাহ নিজেই বলেছেন, فَلَا تَضْرِبُوْا لِلهِ الْأَمْثَالَ (সুতরাং তোমরা আল্লাহর কোন সাদৃশ্য বর্ণনা করো না (সূরা আন-নাহল : ৭৪)।
(খ) শরী‘আতের আহকামের গুরুত্ব উপলব্ধি করা :
ইসলাম মানব জাতির জন্য সমস্ত বিধি-বিধান বা আহকাম নির্ধারণ করেছে, সেগুলোর গুরুত্ব ও মর্যাদা যথাযথভাবে উপলব্ধি করা অপরিহার্য। অন্যথা আহকাম পালনের প্রতি উৎসাহ বা ভীতি তৈরি হবে না। ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত, দান, ছাদাক্বা ইত্যাদি পালন করাও সহজ হবে না। কোন্ কাজের কী হুকুম, ফযীলত ও গুরুত্ব তা জানার জন্য ইলম অর্জন করা যেমন যরূরী, তেমনি উপলব্ধি করাও যরূরী। তাছাড়া পরিবারের সদস্যদেরকে দ্বীনী পরিবেশের উপর গড়ে তুলার জন্যও শারঈ জ্ঞান অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন। তাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির উপর ফরয’।[৪] এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কর্তব্য হল পবিত্র কুরআন শিক্ষা করা।
عَنِ الْحَسَنٌ مُرْسَلًا قَالَ سُئِلَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ عَنْ رَجُلَيْنِ كَانَا فِى بَنِيْ إِسْرَائِيلَ أَحَدُهُمَا كَانَ عَالِمًا يُصَلِّي الْمَكْتُوْبَةَ ثُمَّ يَجْلِسُ فَيُعَلِّمُ النَّاسَ الْخَيْرَ وَالْآخِرُ يَصُومُ النَّهَارَ وَيَقُومُ اللَّيْلَ أَيُّهُمَا أَفْضَلُ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ فَضْلُ هَذَا الْعَالِمِ الَّذِيْ يُصَلِّي الْمَكْتُوْبَةَ ثُمَّ يَجْلِسُ فَيُعَلِّمُ النَّاسَ الْخَيْرَ عَلَى الْعَابِدِ الَّذِي يَصُومُ النَّهَارَ وَيَقُوْمُ اللَّيْلَ كَفَضْلِي عَلَى أَدْنَاكُمْ
হাসান বছরী (রাহিমাহুল্লাহ) হতে মুরসাল সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দু’জন লোক সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল, যারা ছিলেন বনী ইসরাঈলদের মধ্যের লোক। তাদের একজন ছিলেন আলেম, যিনি শুধু ফরয ছালাত আদায় করতেন, অতঃপর বসে লোকদেরকে ইলম শিক্ষা দিতেন। অপর ব্যক্তি সারাদিন ছিয়াম রেখে কাটাতেন এবং সারা রাত ছালাতে রত থাকতেন এদের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, যে সারা দিন ছিয়াম রাখে আর সারা রাত ছালাতে কাটায়, তার অপেক্ষা সেই আলেমের মর্যাদা বেশী, যিনি শুধু ফরয ছালাত আদায় করেন, অতঃপর বসে লোকদেরকে ইলম শিক্ষা দেন। যেমন আমার ফযীলত তোমাদের একজন সাধারণ লোকের উপর।[৫] অন্য বর্ণনায় এসেছে,
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا أَنَّهَا قَالَتْ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ يَقُوْلُ إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ أَوْحَى إِلَيَّ أَنَّهُ مَنْ سَلَكَ مَسْلَكًا فِىْ طَلَبِ الْعِلْمِ سَهَّلْتُ لَهُ طَرِيْقَ الْجَنَّةِ وَمَنْ سَلَبْتُ كَرِيْمَتَيْهِ أَثَبْتُهُ عَلَيْهِمَا الْجَنَّةَ. وَفَضْلٌ فِىْ عِلْمٍ خَيْرٌ مِنْ فَضْلٍ فِىْ عِبَادَةٍ وَمِلَاكُ الدِّيْنِ الْوَرَعُ
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা আমার নিকট অহী পাঠিয়েছেন, যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের উদ্দেশ্যে কোন পথ অবলম্বন করবে তার জন্য আমি জান্নাতের পথ সহজ করে দিব এবং যে ব্যক্তির দুই চক্ষু আমি নিয়ে গেছি, তাকে তার পরিবর্তে আমি জান্নাত দান করব। ইবাদত অধিক হওয়া অপেক্ষা ইলম অধিক হওয়া উত্তম। দ্বীনের (তথা ইলম ও আমলের) আসল হচ্ছে সন্দেহের জিনিস হতে বেঁচে থাকা।[৬]
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ إِنَّ مِمَّا يَلْحَقُ الْمُؤْمِنَ مِنْ عَمَلِهِ وَحَسَنَاتِهِ بَعْدَ مَوْتِهِ عِلْمًا عَلَّمَهُ وَنَشَرَهُ وَوَلَدًا صَالِحًا تَرَكَهُ وَمُصْحَفًا وَرَّثَهُ أَوْ مَسْجِدًا بَنَاهُ أَوْ بَيْتًا لاِبْنِ السَّبِيلِ بَنَاهُ أَوْ نَهْرًا أَجْرَاهُ أَوْ صَدَقَةً أَخْرَجَهَا مِنْ مَالِهِ فِىْ صِحَّتِهِ وَحَيَاتِهِ يَلْحَقُهُ مِنْ بَعْدِ مَوْتِهِ
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, মুমিনের মৃত্যুর পরও তার আমল ও নেক কাজসমূহের মধ্যে যার ছওয়াব তার নিকট পৌঁছতে থাকবে, তা হচ্ছে- (১) ইলম, যা সে শিক্ষা করেছে, অতঃপর তা বিস্তার করেছে, (২) নেক সন্তান, যাকে সে রেখে গিয়েছে, অথবা (৩) কুরআন, যা মীরাছরূপে বা দান করে গিয়েছে, অথবা (৪) মসজিদ, যা সে নির্মাণ করে গিয়েছে, অথবা (৫) মুসাফিরখানা, যা সে মুসাফিরদের জন্য তৈরি করে গিয়েছে, অথবা (৬) খাল, (কূপ, পুকুর প্রভৃতি) যা সে খনন করে গিয়েছে, অথবা (৭) দান, যা সে সুস্থ ও জীবিত অবস্থায় তার মাল হতে করে গিয়েছে (এগুলোর ছওয়াব)। তার মৃত্যুর পরও তার নিকট পৌঁছতে থাকবে।[৭]
মূলত জ্ঞানের মর্যাদাই বেশী। কারণ যেকোন কাজ জেনে করলে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়। ঈমান ও তাক্বওয়া বৃদ্ধি পায়। উৎসাহ ও ভীতির সাথে কাজ করার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
(গ) ইবাদতে তাওক্বীফী ও ইবাদতে মু‘আমালা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখা :
মুসলিম ব্যক্তি যা কিছু সম্পাদন করে সবই ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। শুধু ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাতই ইবাদত নয়; বরং ধর্মীয় ও বৈষয়িক উভয় জীবনের সকল কার্যক্রম ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। মুসলিম জীবন দু’টি স্তম্ভের উপর ভিত্তিশীল। আক্বীদা ও আমল অর্থাৎ বিশ্বাস ও কর্ম। এগুলো বাস্তব জীবনে আমল করতে গেলে দু’টি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি ‘ইবাদতে তাওক্বীফী’ বা অপরিবর্তনশীল ইবাদত। অন্যটি ‘ইবাদতে মু‘আমালা’ বা বৈষয়িক জীবনে পালনীয় ঐচ্ছিক ইবাদত।
এখানে অপরিবর্তনশীল ইবাদত বলতে আক্বীদা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় এবং ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত প্রভৃতি সবধরনের মানুষের উপর এগুলো ফরয। যেভাবে কুরআন-হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, ঠিক সেভাবেই বাস্তবায়ন করা। এখানে কোনরূপ স্বাধীনতা নেই। এগুলো পরিবর্তনশীলও নয়, ইচ্ছাধীনও নয়; মানুষের ইচ্ছার উপরেও ছেড়ে দেয়া হয়নি। যেমন আক্বীদার বিষয়গুলো ধনী-গরীব, আমীর-ফকীর, সুস্থ-অসুস্থ সকল প্রকার ব্যক্তির উপর সমানভাবে ফরয। কুরআন ও ছহীহ হাদীছে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন ছাড়াই তাকে গ্রহণ করা। কারণ এটা অদৃশ্যের সাথে জড়িত।
অনুরূপ ছালাত আদায়ের ক্ষেত্রে হাদীছে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, সেভাবেই তার সময়, আরকান, আহকাম পালন করতে হবে। এখানে মনগড়া কোনকিছু করার সুযোগ নেই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, صَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُوْنِىْ أُصَلِّىْ তোমরা সেভাবেই ছালাত আদায় কর, যেভাবে আমাকে ছালাত আদায় করতে দেখছ।[৮] মুহাম্মাদ (ﷺ) ব্যতীত পৃথিবীর আর অন্য কারো তরীকায় ছালাত আদায় করা যাবে না। ফরয, সুন্নাত, বিতর, তাহাজ্জুদ, তারাবীহ, ঈদায়েন, জানাযা সবই তাঁরই তরীকায় আদায় করতে হবে। হজ্জের ক্ষেত্রেও একই বিধান। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, خُذُوْا عَنِّىْ مَنَاسِكَكُمْ তোমরা হজ্জের নিয়ম-কানুন আমার নিকট থেকে গ্রহণ কর।[৯] ছিয়ামের ক্ষেত্রে মৌলিক বিধান দিলেন যে, مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلهِ حَاجَةٌ فِى أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ ‘যে ব্যক্তি ছিয়াম অবস্থায় মিথ্যাচার ও মন্দ কাজ করা পরিত্যাগ করেনি, তার পানাহার পরিত্যাগে আল্লাহর কিছুই যায়-আসে না।[১০] সাধারণ সব ধরনের আমল সম্পর্কে মূলনীতি দিয়েছেন, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ ‘কেউ যদি এমন কোন আমল করে, যার প্রতি আমাদের নির্দেশ নেই- সেই আমল প্রত্যাখ্যাত।[১১] উক্ত বিষয়গুলো সবই তাওক্বীফী বা অপরিবর্তনশীল।
মু‘আমালার বিষয়টি ইচ্ছাধীন। কারণ বৈষয়িক জীবনে কেউ চাকরী করতে পারে, কেউ ব্যবসা করতে পারে, কেউ ডাক্তারি করতে পারে, আবার কেউ কৃষি কাজ করতে পারে। কেউ কোন একটিকে গ্রহণ করতে পারে, আবার চাইলে সবগুলোর সাথেও জড়িত থাকতে পারে। এগুলো তার জন্য ইচ্ছাধীন। তবে এগুলো পালনের জন্য শরী‘আত বান্দাকে সুনির্দিষ্ট মূলনীতি দিয়েছে, যার অনুসরণ করা আবশ্যক। যেমন-
ব্যবসার ক্ষেত্রে অনুসরণীয় মূলনীতি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّىْ ‘যে ব্যক্তি প্রতারণা করল, সে আমার দলভুক্ত নয়’।[১২] (ক) ব্যবসায়ী পণ্য হালাল হওয়া। হারাম কোন পণ্য দ্বারা ব্যবসা করা নিষিদ্ধ।[১৩] (খ) কোন রকমের প্রতারণার আশ্রয় না নেয়া। ইসলামে প্রতারণার কোন সুযোগ নেই। (গ) সূদ ও ঘুষ মুক্ত হওয়া।[১৪]
রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ইসলামী মূলনীতির পরিসর অনেক বড়। কারণ এখানে বিধানসভা, বিচার বিভাগ, প্রশাসন বিভাগের মত বৃহত্তর বিষয় রয়েছে। মূলত এই তিনটিই রাষ্ট্রের মূল কাঠামো। আইনসভা বা সংসদ মহান আল্লাহ প্রদত্ত সংবিধান পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করবে। কারণ তাওহীদে রুবূবিয়ার শর্তানুসারে আইনদাতা একমাত্র আল্লাহ। তাই সংসদ কখনো আল্লাহর বিধান বিরোধী কোন আইন প্রণয়ন করতে পারবে না। আল্লাহ বলেন,
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوْا لَهُمْ مِنَ الدِّيْنِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللهُ وَلَوْلَا كَلِمَةُ الْفَصْلِ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ وَإِنَّ الظَّالِمِيْنَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ
‘তাদের কি এমন কিছু শরীক আছে, যারা তাদের জন্য আইন প্রণয়ন করে, যে বিষয়ে আল্লাহ অনুমতি দেননি? (ক্বিয়ামতের) ফায়ছালার ঘোষণা না থাকলে তাদের বিষয়ে ফায়ছালা হয়েই যেত। নিশ্চয় সীমালংঘনকারীদের জন্য কঠোর শাস্তি বিদ্যমান’ (সূরা আশ-শূরা : ২১)। অনুরূপ আইনসভার কোন সদস্য অনৈতিক কাজে লিপ্ত হবেন না এবং অবৈধ ক্ষমতার দাপট দেখাবেন না। কারণ তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমোদিত প্রতিনিধি বা খলীফা মাত্র। তারা আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করবেন বলে যাবতীয় কাজের আঞ্জাম দিবেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই এক একজন দায়িত্বশীল। আর ক্বিয়ামতের দিন তোমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে’।[১৫]
বিচার বিভাগ থাকবে সম্পূর্ণ স্বাধীন। এ বিভাগের সাথে যারা জড়িত থাকবেন তারা ইসলামের বিধান অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। এটা ঈমানী দায়িত্ব। আল্লাহ এই ক্ষেত্রে মূলনীতি দিয়েছেন যে, ‘আল্লাহ তা‘আলা যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন, সে অনুযায়ী যারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না তারা কাফের’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৪৪)। পরের দুই আয়াতে যালেম ও ফাসেক বলা হয়েছে’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৪৫ ও ৪৭)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিচারককে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। বুরায়দা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘বিচারক তিন প্রকার। এক শ্রেণীর বিচারক জান্নাতী, আর দুই শ্রেণীর বিচারক জাহান্নামী। (১) যে বিচারক সত্য উপলব্ধি করে এবং তদানুযায়ী বিচার করে, সে জান্নাতী (২) যে বিচারক সত্য উপলব্ধি করতে পারে, কিন্তু তদনুযায়ী বিচার করে না, সে জাহান্নামী। (৩) আর এক শ্রেণীর বিচারক সত্য উপলব্ধি করতে পারে না। অজ্ঞতার ভিত্তিতে বিচার করে, সেও জাহান্নামী’।[১৬] এই সতর্কতা জেনে রাখা আবশ্যক।
অনুরূপভাবে প্রশাসন বিভাগের দু’টি ধারা সিভিল প্রশাসন ও প্রশাসন পরিচালিত হবে আল্লাহর কাছে দায়বদ্ধ থেকে। সিভিল প্রশাসনের ব্যক্তিবর্গ মানবতার সেবক হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ব্যাপারে রক্ষণশীল ভূমিকা পালন করবেন। সচিব থেকে শুরু করে ডিসি, টিওনো সবাই সুন্দরভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা পালন করবেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় একদনি পাহারা দেয়া, সমস্ত দুনিয়া ও তার উপরের যাবতীয় সম্পদ হতে উত্তম’।[১৭] তেমনিভাবে প্রশাসন বিভাগের সর্বস্তরের ব্যক্তি দেশের আইনশৃংখলা রক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন এবং আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করবেন। মানুষের উপর প্রভুত্ব কায়েম করবেন না। এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, [১৮] لَاطَاعَةَ لِمَخْلُوْقٍ فِىْ مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ (সৃষ্টিকর্তার অবাধ্যতা করে সৃষ্টির কোন আনুগত্য নেই।) মানুষের উপর কোন রকম যুলুম বা অত্যাচার করবেন না। এক্ষেত্রে আল্লাহভীতি যরূরী ভূমিকা পালন করবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে ইয়ামানে পাঠানোর সময় বলেছিনে, ‘তুমি মযলূমের বদ দু‘আ থেকে সাবধান থাকবে। তার দু‘আ ও আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা নেই’।[১৯]
মুসলিম ব্যক্তি হিসাবে ইসলাম সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ জ্ঞান রাখা যে আবশ্যক, তা উক্ত আলোচনায় ফুটে উঠেছে। অন্যথা অজান্তেই শিরক, কুফর ও অন্যায়ের সাথে জড়িয়ে পড়বে।
তথ্যসূত্র :
[১]. মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম, পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি (ঢাকা : খায়রুন প্রকাশনী, নভেম্বর-২০০২ খৃ.), পৃ. ১৪।
[২]. সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী, অনুবাদ : আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী, ইসলামী রেনেসাঁর অগ্রপথিক, ১ম খণ্ড (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, মে ১৯৮৭ খৃ.), পৃ. ৩।
[৩]. ইবনু মাজাহ, হা/২২৪।
[৪]. ইবনে মাজাহ, পৃ. ৫৬, হা/২২৪।
[৫]. দারিমী, হা/৩৪৯; মিশকাত, হা/২৫০, সনদ হাসান।
[৬]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৫৩৬৭; মিশকাত, হা/২৫৫।
[৭]. ইবনে মাজাহ, পৃ. ৬০, হা/২৪২; মিশকাত, হা/২৫৪।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৩১।
[৯]. বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা, ৫ম খণ্ড, হা/৯৭৯৬, সনদ ছহীহ।
[১০]. ছহীহ বুখারী, পৃ. ২৩৬, হা/১৯০৩।
[১১]. ছহীহ মুসলিম হা/১৭১৮, ‘বিচার’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৯।
[১২]. ছহীহ মুসলিম, পৃ. ৪২, হা/১০২, ‘ঈমান’ অধ্যায়।
[১৩]. ছহীহ মুসলিম, পৃ. ২৮৪, হা/১০১৫, ‘যাকাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২০; মিশকাত, হা/২৭৬০, ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়।
[১৪]. তিরমিযী, হা/১৩৩৬; সনদ ছহীহ, মিশকাত, হা/৩৭৫৩; ছহীহ মুসলিম, পৃ. ৪২, হা/১০১, ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৫।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৭১৩৮।
[১৬]. আবূ দাঊদ, হা/৩৫৭৩; মিশকাত, হা/৩৭৩৫, ‘বিচার ও প্রশাসন’ অধ্যায়।
[১৭]. ছহীহ বুখারী, পৃ. ৩৬৪-৩৬৫, হা/২৮৯২।
[১৮]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, ১৮তম খণ্ড, পৃ. ১৭০; সনদ ছহীহ, মিশকাত, হা/৩৬৯৬ ‘নেতৃত্ব’ অধ্যায়।
[১৯]. ছহীহ বুখারী, পৃ. ১৮৯, হা/১৪৯৬।
প্রসঙ্গসমূহ »:
নীতি-নৈতিকতা