সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৮ পূর্বাহ্ন

মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ 

-আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম* 


(২৩তম কিস্তি) 

তাক্বলীদের পরিচয়   

التَّقْلِيْدُ শব্দটি قلد থেকে উৎপত্তি। এটা قَلَّدَ -এর মাছদার।[১] অর্থ হল, হার পরানো, গলায় পরানো, গলায় ঝুলানো, অনুকরণ করা বা পশুকে চালানোর জন্য গলায় দড়ি বাঁধা। আবার قلد মূল অক্ষর থেকে নামবাচক বিশেষ্য হল قِلَادَةٌ। যা বহুবচনে قَلَائِدٌ।[২] অর্থ হল, গলার হার, কণ্ঠহার, মালা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَا الۡہَدۡیَ وَلَا الۡقَلَآئِدَ ‘হারামে কুরবানীর জন্য প্রেরিত পশু, কুরবানীর পশুগুলোর গলায় ব্যবহৃত চিহ্নগুলো’ (সূরা আল- মায়িদা : ২, ৯৭)। ‘ক্বালাইদ (القلائد) হল প্রত্যেক কুরবানী পশুর ঘাড়ে বা কুঁজে ঝুলানো এমন আংটা বা অন্যান্য ব্যবহৃত চিহ্ন, যাতে বুঝা যায়, ঐ পশুটি আল্লাহ তা‘আলার (কুরবানীর) জন্য’।[৩]

আবার ক্বালাইদ অর্থ শুধুমাত্র পশুর গলায় মালা ঝুলানোই বুঝায় না। বরং তা মানুষের গলাতেও মালা ঝুলানো বুঝায়। সুদ্দী (রাহিমাহুল্লাহ) (وَ لَا الۡہَدۡیَ وَ لَا الۡقَلَآئِدَ)-এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘আরবগণ মক্কার গাছের ছাল তাদের গলায় ঝুলাতো। মানুষেরা মাশহারে হারামের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের স্থানে অবস্থান করত। তারপর যে তার আহলের (পরিবার) নিকট ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করত। তখন সে নিজের এবং তার উটের গলায় গাছের ছাল ঝুলাতো, যাতে করে সে নিরাপদে তার আহলের নিকট প্রত্যাবর্তন করতে পারে’।[৪]

আর তাক্বলীদ (التقليد) হল,جَعَل الشَّيْءَ فِي عُنُقِ غَيْرِهِ مَعَ الْإِحَاطَةِ بِهِ ‘কোন জিনিষকে অন্যের গলায় বেষ্টন করার মাধ্যমে নির্ধারণ বা স্থাপন করা’।[৫] যেমন বলা হয়, আমি মেয়ে বা দাসীর গলায় ঝুলিয়ে দিলাম। এটা তখনই বলা হয়, যখন মেয়ে বা দাসীর গলাায় হার, কণ্ঠহার বা মালা স্থাপন করা হয়। আমি কোন পুরুষের গলায় তরবারী ঝুলিয়ে দিলাম। ফলে সে গলায় ঝুলিয়ে নিল। এটা তখনই বলা হবে, যখন সে পুরুষ তার গলায় তা বহন করবে।

‘লিসানুল ‘আরব’-এর পরিভাষায়, لَيُّ الشَّيْءِ عَلَى الشَّيْءِ ‘কোন জিনিষকে কোন জিনিষের উপর পাক, মোচড় বা পেঁচ দেয়া’।[৬] যেমন লোহার কণাকে আরেক লোহার উপর পেঁচ দেয়া। আর এ অর্থে ঝুলানো বালা বা চুড়ি, যা হাতে ঝুলানো হয়।

দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তাক্বলীদ হল, আমলের ব্যাপারে কোন ব্যক্তির অন্ধ অনুসরণ করা। ফিক্বহ বিষয়ের অন্যতম বিশ্বকোষ ‘আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ’-তে বলা হয়েছে,وَقَلَّدَ فُلاَنًا الأمْرَ إِيَّاهُ وَمِنْهُ تَقْلِيدُ الْوُلَاةِ الأعْمَال ‘গুরুতর কাজে খাছ করে কোন ব্যক্তির তাক্বলীদ (অনুসরণ) করা। আর এখান থেকেই কোন আমলের ক্ষেত্রে কোন আলেম বা নেতার অন্ধ অনুকরণ করাই তাক্বলীদ’।[৭]

শারঈ মানদন্ডে তাক্বলীদ হল দলীলবিহীন কার কোন কথা গ্রহণ করা এবং আমল করা, যে ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (ﷺ) নির্দেশ প্রদান করেননি। ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ৭২৮ হি.) বলেছেন,التقليد قبول القول بغير دليل  ‘দলীলবিহীন কার কোন কথা গ্রহণ করাকে তাক্বলীদ বলে’।[৮]

আলী ইবনু আহমাদ ইবনু হাযম আন্দালুসী (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ৪৫৬ হি.) বলেছেন, والتقليد إنما هو اتباع من لم يأمرنا عز و جل باتباعه ‘তাক্বলীদ হল ঐ ব্যক্তির অনুসরণ, যার অনুসরণ করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে নির্দেশ প্রদান করেনি’।[৯] তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা যে তাক্বলীদের বিরোধিতা করি সেটা হল, নবী করীম (ﷺ)-এর কথা ব্যতীত দলীল বিহীন কোন ব্যক্তির কথা গ্রহণ করা। যে ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে নির্দেশ প্রদান করেনি’।[১০]

মুহাম্মাদ ইবনু আলী ইবনু মুহাম্মাদ আশ-শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ১২৫০ হি.) বলেছেন, هو العمل بقول الغير من غير حجة ‘দলীলবিহীন কার কোন কথার প্রতি আমল করা’।[১১]

শায়খ ছালেহ আল-উছায়মীন (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ১৪২১ হি.) বলেছেন, وضع الشيء في العنق محيطاً به كالقلادة ‘কন্ঠহার বা মালার ন্যায় কোন জিনিষকে ঘাড়ে বেষ্টন করাকে তাক্বলীদ বলে’।[১২] তিনি আরও বলেছেন, اتباع من ليس قوله حجة ‘(তাক্বলীদ হল) দলীলবিহীন কার কোন কথার অনুসরণ করা’।[১৩]

আল্লামা আলবানী (১৩৩২-১৪২০ হি./১৯১৪-১৯৯৯ খ্রি.) (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, هُوَ الْعَمَلُ بِقَوْلِ الْغَيْرِ مِنْ غَيْرِ حُجَّةٍ ‘দলীল ব্যতীত অন্যের কথা অনুযায়ী আমল করা’।[১৪]

হানাফীদের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ‘মুসাল্লামুছ ছুবূত’ (مُسَلَّمُ الثُّبُوْت)-এ তাক্বলীদের পরিচয় প্রদান করে বলা হয়েছে, ‘তাক্বলীদ হল অন্য কারো কথার উপর দলীল-প্রমাণ ছাড়া আমল করা। যেমন সাধারণ মানুষ তার মত আরেকজনের এবং মুজতাহিদের তার মত আরেকজন মুজতাহিদের কথাকে গ্রহণ করা। তবে নবী করীম (ﷺ) বা ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা এই (তাক্বলীদের) অন্তর্ভুক্ত নয়।[১৫]

হানাফীদের গ্রহণযোগ্য কিতাব ‘ফাওয়াতিহুর রাহমূত’-এ বলা হয়েছে, ‘(অনুচ্ছেদ : নবী করীম (ﷺ) ব্যতীত অন্য কারো কথার উপর দলীল ছাড়া আমল করাকে তাক্বলীদ বলে)। এটি আমলের সাথে সম্পৃক্ত। আর হুজ্জাত দ্বারা উদ্দেশ্য হল চারটি দলীলের একটি। নতুবা মুজতাহিদের বক্তব্য তার (সাধারণ মানুষ) জন্য দলীল ও হুজ্জাত। যেমন সাধারণ মানুষের মুজতাহিদের নিকট থেকে গ্রহণ করা এবং মুজতাহিদের তার মত অন্য আরেকজন মুজতাহিদের নিকট থেকে গ্রহণ করা। আর নবী করীম (ﷺ) এবং ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা তাক্বলীদের অন্তর্ভুক্ত নয়। কেননা এটি দলীলের দিকে প্রত্যাবর্তন।[১৬]

গোলাম রাসূল সাঈদ বেরীলভী লিখেছেন, ‘তাক্বলীদের অর্থ হল দলীলসমূহ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে কোন ইমামের কথার উপর আমল করা। আর ইত্তেবা দ্বারা এটা উদ্দেশ্য যে, কোন ইমামের কথাকে কিতাব ও সুন্নাতের অনুকূলে পেয়ে এবং শারঈ দলীলসমূহ দ্বারা প্রমাণিত জেনে সেই কথাকে অগ্রাধিকার দেয়া।[১৭]

তাক্বলীদের প্রকার : তাক্বলীদ দু’ প্রকার। ১. তাক্বলীদে গায়রে শাখছী ২. তাক্বলীদে শাখছী

১. তাক্বলীদে গায়রে শাখছী : কোনরূপ খাছ করা ছাড়াই নবী করীম (ﷺ) ব্যতীত অন্যের দলীলবিহীন কথাকে চোখ বন্ধ করে, চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই মান্য করা।[১৮] যেমন অজ্ঞ ব্যক্তির আলেমের নিকট থেকে মাসআলা জিজ্ঞেস করা। একে তাক্বলীদ বলা হয় না।

২. তাক্বলীদে শাখছী : নবী করীম (ﷺ) ব্যতীত নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির দলীলবিহীন প্রতিটি কথা ও কাজকে চোখ বন্ধ করে, চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই অন্ধের মত মান্য করা।[১৯] তাক্বলীদে শাখছী আবার দু’ প্রকার। ১. ইমাম চতুষ্টয় ব্যতীত কোন জীবিত বা মৃত নির্দিষ্ট ব্যক্তির তাক্বলীদে শাখছী করা ২. ইমাম চতুষ্টয় (ইমাম আবূ হানীফা, মালেক, শাফেঈ ও আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুমুল্লাহ))-এর মধ্য থেকে স্রেফ একজন ইমামের তাক্বলীদে শাখছী। অর্থাৎ চিন্তা-ভাবনা ছাড়া অন্ধের মত চোখ বন্ধ করে প্রত্যেকটি কথা ও কাজের তাক্বলীদ করা।[২০]

তাক্বলীদ বাতিল হওয়ার দলীল

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

مَثَلُ الَّذِیۡنَ اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اَوۡلِیَآءَ کَمَثَلِ الۡعَنۡکَبُوۡتِ ۖۚ اِتَّخَذَتۡ بَیۡتًا ؕ وَ اِنَّ  اَوۡہَنَ الۡبُیُوۡتِ لَبَیۡتُ الۡعَنۡکَبُوۡتِ ۘ  لَوۡ  کَانُوۡا  یَعۡلَمُوۡنَ . اِنَّ اللّٰہَ یَعۡلَمُ مَا یَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِہٖ مِنۡ شَیۡءٍ ؕ وَ  ہُوَ  الۡعَزِیۡزُ  الۡحَکِیۡمُ  . وَ تِلۡکَ الۡاَمۡثَالُ نَضۡرِبُہَا لِلنَّاسِ ۚ وَ مَا یَعۡقِلُہَاۤ  اِلَّا  الۡعٰلِمُوۡنَ

‘যারা আল্লাহর পরিবর্তে অপরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তাদের দৃষ্টান্ত মাকড়াসা, যে নিজের জন্যে ঘর বানায় এবং ঘরের মধ্যে মাকড়াসার ঘরই তো দুর্বলতম, যদি তারা জানতো! তারা আল্লাহর পরিবর্তে যা কিছুকেই আহবান করে আল্লাহ তা জানেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আমরা মানুষের জন্য এসব দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে থাকি; কিন্তু শুধু জ্ঞানী ব্যক্তিরাই এসব বুঝে থাকে’ (সূরা আল-‘আনকাবূত : ৪১-৪৩)।

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু হাযম আন্দালুসী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘কোন ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে ইমাম হিসাবে গ্রহণ করে। তারপর সে আল্লাহ তা‘আলা এবং নবী করীম (ﷺ)-এর কথাকে তার ইমামের উপর পেশ করে। ব্যক্তির কথা ইমামের মতের সাথে যা মিলে যায়, তা গ্রহণ করে এবং যা বিপরীত হয়, তখন আল্লাহ তা‘আলা এবং নবী করীম (ﷺ)-এর কথা ছেড়ে দেয়। সে আল্লাহ তা‘আলা এবং নবী করীম (ﷺ)-এর কথাকে সমর্থন করে বা মেনে নেয়। কিন্তু সে তার ইমামের কথাকে বাধ্যতামূলক হিসাবে গ্রহণ করে। আর এটাই হল আল্লাহ তা‘আলা ব্যতিত অন্য কাউকে অবিভাবক হিসাবে গ্রহণ করা।[২১] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَمۡ حَسِبۡتُمۡ  اَنۡ تُتۡرَکُوۡا وَ لَمَّا یَعۡلَمِ اللّٰہُ الَّذِیۡنَ جٰہَدُوۡا مِنۡکُمۡ وَ لَمۡ یَتَّخِذُوۡا مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ وَ لَا رَسُوۡلِہٖ وَ لَا الۡمُؤۡمِنِیۡنَ  وَلِیۡجَۃً ؕ وَ اللّٰہُ  خَبِیۡرٌۢ  بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ

‘তোমরা কি ধারণা করেছো যে, তোমাদেরকে এভাবেই ছেড়ে দেয়া হবে? অথচ আল্লাহ তো এখনও সেই সব লোককে প্রকাশ করেননি, যারা তোমাদের মধ্য হতে জিহাদ করেছে এবং আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণ ছাড়া অন্য কাউকেও অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করেনি; আর আল্লাহ তোমাদের সমস্ত কর্মের পূর্ণ খবর রাখেন’ (সূরা আত-তাওবা : ১৬)।

উপরিউক্ত আয়াতে ‘অন্তরঙ্গ বন্ধু’ বলতে আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর রাসূল (ﷺ) এবং উম্মাতের সমস্ত আলেমের কথার পরিবর্তে কোন ব্যক্তিকে মানদণ্ড হিসাবে গ্রহণ করা।[২২] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یَوۡمَ تُقَلَّبُ وُجُوۡہُہُمۡ فِی النَّارِ یَقُوۡلُوۡنَ یٰلَیۡتَنَاۤ  اَطَعۡنَا اللّٰہَ  وَ اَطَعۡنَا الرَّسُوۡلَا . وَ قَالُوۡا رَبَّنَاۤ  اِنَّاۤ  اَطَعۡنَا سَادَتَنَا وَ کُبَرَآءَنَا  فَاَضَلُّوۡنَا السَّبِیۡلَا

‘যেদিন তাদের মুখমন্ডল অগ্নিতে উলট-পালট করা হবে সেদিন তারা বলবে; হায়! আমরা যদি আল্লাহকে মানতাম এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে মানতাম! তারা আরো বলবে; হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল’ (সূরা আল-আহ্যাব : ৬৬-৬৭)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ  یَوۡمَ یَعَضُّ الظَّالِمُ عَلٰی  یَدَیۡہِ یَقُوۡلُ یٰلَیۡتَنِی اتَّخَذۡتُ مَعَ الرَّسُوۡلِ سَبِیۡلًا  . یٰوَیۡلَتٰی لَیۡتَنِیۡ لَمۡ اَتَّخِذۡ فُلَانًا خَلِیۡلًا .  لَقَدۡ اَضَلَّنِیۡ عَنِ الذِّکۡرِ  بَعۡدَ  اِذۡ جَآءَنِیۡ ؕ وَ کَانَ الشَّیۡطٰنُ لِلۡاِنۡسَانِ خَذُوۡلًا  . وَ قَالَ الرَّسُوۡلُ یٰرَبِّ اِنَّ قَوۡمِی اتَّخَذُوۡا ہٰذَا  الۡقُرۡاٰنَ  مَہۡجُوۡرًا

‘যালিম ব্যক্তি সেদিন নিজ হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, হায়! আমি যদি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম। হায়! দুর্ভোগ আমার, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। আমাকে তো সে বিভ্রান্ত করেছিল আমার নিকট উপদেশ পৌঁছার পর; শয়তান মানুষের জন্যে মহাপ্রতারক’ (সূরা আল-ফুরক্বান :২৭-২৯)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِذۡ  تَبَرَّاَ الَّذِیۡنَ اتُّبِعُوۡا مِنَ الَّذِیۡنَ اتَّبَعُوۡا  وَ رَاَوُا  الۡعَذَابَ وَ تَقَطَّعَتۡ بِہِمُ الۡاَسۡبَابُ  . وَ قَالَ الَّذِیۡنَ اتَّبَعُوۡا لَوۡ  اَنَّ لَنَا کَرَّۃً فَنَتَبَرَّاَ مِنۡہُمۡ کَمَا تَبَرَّءُوۡا مِنَّا ؕ کَذٰلِکَ یُرِیۡہِمُ اللّٰہُ  اَعۡمَالَہُمۡ حَسَرٰتٍ عَلَیۡہِمۡ ؕ وَ مَا ہُمۡ  بِخٰرِجِیۡنَ مِنَ النَّارِ

‘যখন অনুসরণীয় নেতারা অনুসারীদেরকে প্রত্যাখ্যান করবে এবং তারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে ও তাদের সমস্ত সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। অনুসরণকারীরা বলবে, যদি আমরা ফিরে যেতে পারতাম তবে তারা যেরূপ আমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছে আমরাও তদ্রুপ তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করতাম; এভাবে আল্লাহ তাদের কৃতকর্মসমূহ তৎপ্রতি দুঃখজনকভাবে প্রদর্শন করাবেন এবং তারা জাহান্নাম হতে উদ্ধার পাবে না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৬৬-১৬৭)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اِذَا قِیۡلَ لَہُمُ  اتَّبِعُوۡا مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ قَالُوۡا بَلۡ نَتَّبِعُ مَاۤ اَلۡفَیۡنَا عَلَیۡہِ اٰبَآءَنَا ؕ اَوَ لَوۡ کَانَ اٰبَآؤُہُمۡ لَا یَعۡقِلُوۡنَ شَیۡئًا وَّ لَا  یَہۡتَدُوۡنَ

‘এবং যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার অনুসরণ কর; তখন তারা বলে- বরং আমরা তারই অনুসরণ করব যার উপর আমাদের পিতৃপুরুষগণকে পেয়েছি; যদিও তাদের পিতৃপুরুষদের কোনই জ্ঞান ছিল না এবং তারা সুপথগামী ছিল না তবুও?’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৭০)।

উপরিউক্ত আয়াতে ঐ দিকটাই পরিস্ফুটিত হয়েছে, যারা কোন রকম তা’বীল, চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা ছাড়াই এই কাজটি করে। অর্থাৎ পিতৃপুরুষগণকে অনুসরণ করে। তবে যাদের উপর কুরআনের দলীল এবং ছহীহ হাদীছ পেশ করা হয় এবং তারাও কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সত্যতার ব্যাপারে স¦ীকৃতি প্রদান করে। কিন্তু যখন সেই দলীল তাদের মাযহাবের বিরোধী বা বিপরীত হয়, তখন সেই দলীল তাদের নিকট বাতিল বা ভ্রান্ত মনে হয়। ফলে তারা সেই দলীলটা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। পিতৃপুরুষগণের অন্ধ অনুকরণ এবং মাযহাব বা ব্যক্তির অন্ধ অনুকরণের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। মূলত তারা প্রবৃত্তির অনুসারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَاِنۡ لَّمۡ یَسۡتَجِیۡبُوۡا لَکَ فَاعۡلَمۡ  اَنَّمَا یَتَّبِعُوۡنَ  اَہۡوَآءَہُمۡ ؕ وَ مَنۡ اَضَلُّ  مِمَّنِ اتَّبَعَ ہَوٰىہُ بِغَیۡرِ ہُدًی مِّنَ اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ  لَا  یَہۡدِی الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ

‘অতঃপর যদি তারা তোমার আহ্বানে সাড়া না দেয়, তাহলে জানবে যে, তারা তো শুধু নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে। আল্লাহর পথ-নির্দেশ অগ্রাহ্য করে যে ব্যক্তি নিজ খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে সে ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত আর কে? আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়ের পথ-নির্দেশ করেন না’ (সূরা আল-ক্বাছাছ : ৫০)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَفَرَءَیۡتَ مَنِ اتَّخَذَ  اِلٰـہَہٗ  ہَوٰىہُ وَ اَضَلَّہُ  اللّٰہُ  عَلٰی  عِلۡمٍ  وَّ خَتَمَ عَلٰی سَمۡعِہٖ وَ قَلۡبِہٖ وَ جَعَلَ عَلٰی بَصَرِہٖ  غِشٰوَۃً ؕ فَمَنۡ یَّہۡدِیۡہِ  مِنۡۢ  بَعۡدِ اللّٰہِ ؕ اَفَلَا  تَذَکَّرُوۡنَ

‘আপনি কি লক্ষ্য করেছেন তাকে, যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের মা‘বূদ বানিয়ে নিয়েছে? আল্লাহ জেনে শুনেই তাকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং তার কর্ণ ও হৃদয়ে মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তার চক্ষুর উপর রেখেছেন আবরণ। অতএব, আল্লাহর পর কে তাকে হেদায়ত করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না’ (সূরা আল-জাসিয়া : ২৩)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَرَءَیۡتَ مَنِ اتَّخَذَ اِلٰـہَہٗ ہَوٰىہُ ؕ اَفَاَنۡتَ تَکُوۡنُ  عَلَیۡہِ   وَکِیۡلًا  . اَمۡ  تَحۡسَبُ اَنَّ  اَکۡثَرَہُمۡ  یَسۡمَعُوۡنَ  اَوۡ یَعۡقِلُوۡنَ ؕ اِنۡ  ہُمۡ   اِلَّا  کَالۡاَنۡعَامِ  بَلۡ ہُمۡ اَضَلُّ  سَبِیۡلًا

‘আপনি কি দেখেন না তাকে, যে তার প্রবৃত্তিকে মা‘বূদ রূপে গ্রহণ করে? তবুও কি আপনি তার জিম্মাদার হবেন? আপনি কি মনে করেন যে, তাদের অধিকাংশ শুনে ও বুঝে? তারা পশুর মত। বরং তারা আরো পথ ভ্রষ্ট’ (সূরা আল-ফুরক্বান : ৪২-৪৩)।

উপরিউক্ত আয়াতে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলো হল একজন মুকাল্লিদ বা অন্ধ অনুসরণকারীর। কেননা সে প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। সে ইলম ছাড়াই অন্ধ অনুকরণ করে। অথচ সে যার বা যে জিনিষের অনুসরণ করছে, তা তার কোন কাজে আসবে না। সে আল্লাহর হেদায়ত তথা আল্লাহর কিতাব এবং নবী করীম (ﷺ)-এর হেদায়ত ছেড়ে দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর হেদায়ত ব্যতিত ভ্রান্ত হেদায়ত অনুসন্ধান করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلۡ  اَنَدۡعُوۡا  مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ مَا لَا یَنۡفَعُنَا وَ لَا یَضُرُّنَا وَ نُرَدُّ عَلٰۤی اَعۡقَابِنَا بَعۡدَ اِذۡ ہَدٰىنَا اللّٰہُ کَالَّذِی اسۡتَہۡوَتۡہُ الشَّیٰطِیۡنُ فِی الۡاَرۡضِ حَیۡرَانَ ۪ لَہٗۤ  اَصۡحٰبٌ یَّدۡعُوۡنَہٗۤ  اِلَی الۡہُدَی ائۡتِنَا ؕ قُلۡ  اِنَّ ہُدَی اللّٰہِ ہُوَ الۡہُدٰی ؕ وَ اُمِرۡنَا لِنُسۡلِمَ لِرَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ

‘হে মুহাম্মাদ (ﷺ)! আপনি বলে দিন; আমরা কি আল্লাহ ছাড়া এমন বস্তুকে আহ্বান করব ও তার ইবাদত করব, যারা আমাদের কোন উপকার করতে পারবে না এবং আমাদের কোন ক্ষতিও করতে পারবে না? আর আল্লাহ আমাদেরকে সুপথ প্রদর্শনের পর আমরা কি পশ্চাৎপদে ফিরে যাবো? আমরা কি ঐ ব্যক্তির ন্যায় হবো যাকে শয়তান মরুভূমির মধ্যে বিভ্রান্ত করে ফেলেছে এবং যে দিশাহারা; লক্ষ্যহারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে? তার সঙ্গীগণ তাকে হেদায়তের দিকে ডেকে বলছে-তুমি আমাদের সঙ্গে এসো, তুমি বল, আল্লাহর হেদায়তই হচ্ছে সত্যিকারের সঠিক হেদায়ত, আর আমাদেরকে সারা জাহানের প্রতিপালকের সামনে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে’ (সূরা আল-আন‘আম : ৭১)।

উপরিউক্ত আয়াতে মুকাল্লিদ ব্যক্তির কার্যক্রম পরিস্ফুটিত হয়েছে। কেননা সে এমন বিষয়ের অনুসরণ করাকে অপরিহার্য মনে করে, যা তার কোন উপকার ও ক্ষতি করতে পারবে না এবং ক্বিয়ামতের ময়দানে তার জন্য কোন শাফা‘আত করবে না। তার কোন নেকি নষ্ট বা ক্ষতি করতে পারবে না এবং কোন পাপ হ্রাস করতে পারবে না। অথচ তারা তাদের ধারনা অনুযায়ী এই ভ্রান্ত অনুসরণকে সঠিক মনে করে মানুষকে সে দিকেই আহবান করে। আল্লাহ তা‘আলা তাদের এই ধারনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে বলেন,

وَ لَنۡ تَرۡضٰی عَنۡکَ الۡیَہُوۡدُ وَ لَا النَّصٰرٰی حَتّٰی تَتَّبِعَ مِلَّتَہُمۡ ؕ قُلۡ اِنَّ ہُدَی اللّٰہِ ہُوَ  الۡہُدٰی ؕ وَ لَئِنِ اتَّبَعۡتَ اَہۡوَآءَہُمۡ بَعۡدَ الَّذِیۡ جَآءَکَ مِنَ الۡعِلۡمِ ۙ مَا لَکَ مِنَ اللّٰہِ مِنۡ وَّلِیٍّ وَّ لَا نَصِیۡرٍ

‘এবং ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানগণ আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষন পর্যন্ত আপনি তাদের ধর্ম অনুসরণ না করবেন; আপনি বলুন, আল্লাহর প্রদর্শিত পথই সুপথ; এবং আপনার নিকট যে জ্ঞান এসেছে তৎপর যদি আপনি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করেন, তবে আল্লাহর নিকট হতে আপনার জন্য কোনই অভিভাবক ও সাহায্যকারী নেই’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১২০)।

এ জন্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে যা এসেছে সেটাই হেদায়ত। এর বাহিরে কোন হেদায়ত নেই। কোন পথ নেই। অভ্রান্ত সত্যের চুড়ান্ত উৎস একমাত্র আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اِذَا فَعَلُوۡا فَاحِشَۃً  قَالُوۡا وَجَدۡنَا عَلَیۡہَاۤ  اٰبَآءَنَا وَ اللّٰہُ اَمَرَنَا بِہَا ؕ قُلۡ اِنَّ اللّٰہَ  لَا  یَاۡمُرُ  بِالۡفَحۡشَآءِ ؕ اَتَقُوۡلُوۡنَ عَلَی اللّٰہِ  مَا  لَا  تَعۡلَمُوۡنَ

‘যখন তারা কোন নিকৃষ্ট ও অশ্লীল কর্ম করে, তখন তারা বলে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এসব কাজ করতে পেয়েছি এবং আল্লাহও আমাদেরকে এটা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। হে মুহাম্মাদ (ﷺ)! আপনি ঘোষণা করে দিন যে, আল্লাহ অশ্লীল ও নিকৃষ্ট কর্মের নির্দেশ দেন না, তোমরা কি আল্লাহ সম্পর্কে এমন সব কথা বলছো যে বিষয়ে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই?’ (সূরা আল-‘আরাফ : ২৮)।

এই কাজটি মূলত মুকাল্লিদগণ করে থাকে। তারা তাদের পিতৃপুরুষগণের বা মাযহাব বা অনুসরণীয় নেতার দলিলবিহীন কথাকে আল্লাহ এবং রাসূল (ﷺ)-এর সাথে সম্পৃক্ত করে থাকে। তারা তাদের পূর্বপুরুষদেরকে যে অবস্থায় পেয়েছে, তারা সেটাকেই শরী‘আত মনে করে। যা পূর্বের মানুষরা করত। যা উপরিউক্ত আয়াতে আলোচিত হয়েছে। যেমন : কাবা ঘর তাওয়াফ করা প্রসঙ্গ। পূর্বের মানুষরা কাবাকে উলঙ্গ অবস্থায় তাওয়াফ করত। মুজাহিদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘তারা মূলত কাবা ঘরকে উলঙ্গ অবস্থায় তাওয়াফ করত। তারা বলত, نطوف كما ولدتنا أمهاتنا ‘আমরা কাবাকে ঐভাবেই তাওয়াফ করব যেভাবে আমাদের মাতা আমাদেরকে প্রসব (জন্ম) করেছেন’। অর্থাৎ উলঙ্গ অবস্থায়।[২৩] আর এই কাজ (উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ করা) তারা নিজেরাই বিধান হিসাবে সাব্যস্ত করেছিল। আর এই ব্যাপারে তারা তাদের পিতৃপুরুষগণকে অনুসরণ করত এবং তারা বিশ্বাস করত যে, তাদের পিতৃপুরুষগণের কাজ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত এবং আল্লাহ তা‘আলা তা শরী‘আত হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের এই কাজকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং তাদের এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের ব্যাপারে উপরিউক্ত আয়াতে তার জবাব প্রদান করেছেন।[২৪] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلۡ اَمَرَ رَبِّیۡ  بِالۡقِسۡطِ ۟ وَ اَقِیۡمُوۡا وُجُوۡہَکُمۡ عِنۡدَ کُلِّ مَسۡجِدٍ  وَّ ادۡعُوۡہُ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ  الدِّیۡنَ ۬ؕ کَمَا بَدَاَکُمۡ تَعُوۡدُوۡنَ  . فَرِیۡقًا ہَدٰی وَ فَرِیۡقًا حَقَّ عَلَیۡہِمُ الضَّلٰلَۃُ ؕ اِنَّہُمُ اتَّخَذُوا الشَّیٰطِیۡنَ اَوۡلِیَآءَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ وَ یَحۡسَبُوۡنَ  اَنَّہُمۡ مُّہۡتَدُوۡنَ

‘আপনি ঘোষণা করে দিন, আমার প্রতিপালক ন্যায়ের নির্দেশ দিয়েছেন এবং (আরও নির্দেশ  দিয়েছেন যে,) তোমরা প্রত্যেক ছালাতের সময় তোমাদের মুখমন্ডলকে (ক্বিবলার দিকে) স্থির রাখ ও তাঁরই আনুগত্যে বিশুদ্ধ মনে একনিষ্ঠভাবে তাঁকেই ডাক, তোমাদেরকে প্রথমে যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে, তোমরা তেমনিভাবে ফিরে আসবে। এক দলকে আল্লাহ হেদায়ত দান করেছেন এবং অপর দলের জন্যে ভ্রান্তি স্থির হয়েছে, কারণ তারা আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে অভিভাবক ও বন্ধু বানিয়েছিল এবং নিজেদেরকে হেদায়েতপ্রাপ্ত মতে করত’ (সূরা আল-‘আরাফ : ২৯)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

بَلۡ قَالُوۡۤا  اِنَّا وَجَدۡنَاۤ  اٰبَآءَنَا عَلٰۤی اُمَّۃٍ وَّ  اِنَّا عَلٰۤی  اٰثٰرِہِمۡ  مُّہۡتَدُوۡنَ  . وَ کَذٰلِکَ مَاۤ  اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ فِیۡ قَرۡیَۃٍ مِّنۡ نَّذِیۡرٍ  اِلَّا قَالَ مُتۡرَفُوۡہَاۤ  ۙ اِنَّا وَجَدۡنَاۤ  اٰبَآءَنَا عَلٰۤی  اُمَّۃٍ  وَّ اِنَّا عَلٰۤی اٰثٰرِہِمۡ  مُّقۡتَدُوۡنَ  . قٰلَ   اَوَ لَوۡ جِئۡتُکُمۡ  بِاَہۡدٰی مِمَّا وَجَدۡتُّمۡ عَلَیۡہِ  اٰبَآءَکُمۡ ؕ قَالُوۡۤا  اِنَّا بِمَاۤ  اُرۡسِلۡتُمۡ  بِہٖ  کٰفِرُوۡنَ

‘বরং তারা বলে, আমরা নিশ্চয় আমাদের পিতৃ-পুরুষদেরকে এক মতাদর্শের উপর পেয়েছি, আর নিশ্চয় আমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণে হেদায়তপ্রাপ্ত হব। আর এভাবেই তোমাদের পূর্বে যখনই আমরা কোন জনপদে সতর্ককারী পাঠিয়েছি, তখনই সেখানকার বিলাসপ্রিয়রা বলেছে, নিশ্চয় আমরা আমাদের পিতৃ-পুরুষদেরকে এক মতাদর্শের উপর পেয়েছি এবং নিশ্চয় আমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করব। তখন সে (সতর্ককারী) বলেছে, তোমরা তোমাদের পিতৃ-পৃরুষদেরকে যে মতাদর্শে পেয়েছ, আমি যদি তোমাদের কাছে তার চেয়ে উৎকৃষ্ট পথে নিয়ে আসি তবুও কি? (তোমরা তাদের অনুসরণ করবে?) তারা বলেছে, নিশ্চয় তোমাদেরকে যা দিয়ে পাঠানো হয়েছে আমরা তার অস্বীকারকারী’ (সূরা আয-যুখরুফ : ২২-২৪)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اِذَا قِیۡلَ لَہُمۡ تَعَالَوۡا  اِلٰی  مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ وَ اِلَی الرَّسُوۡلِ قَالُوۡا حَسۡبُنَا مَا وَجَدۡنَا عَلَیۡہِ اٰبَآءَنَا ؕ اَوَ  لَوۡ کَانَ اٰبَآؤُہُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ شَیۡئًا وَّ لَا یَہۡتَدُوۡنَ 

‘আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে ও রাসূলের দিকে আস। তারা বলে, আমরা আমাদের পিতৃ-পুরুষদের যার উপর পেয়েছি তাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। যদিও তাদের পিতৃ-পুরুষরা কিছুই জানত না এবং হেদায়াতপ্রাপ্ত ছিল না তবুও’? (সূরা আল-মায়েদাহ : ১০৪)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اِذَا قِیۡلَ لَہُمُ  اتَّبِعُوۡا مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ قَالُوۡا بَلۡ نَتَّبِعُ مَاۤ اَلۡفَیۡنَا عَلَیۡہِ اٰبَآءَنَا ؕ اَوَ لَوۡ کَانَ اٰبَآؤُہُمۡ لَا یَعۡقِلُوۡنَ شَیۡئًا وَّ لَا  یَہۡتَدُوۡنَ

‘আর যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা অনুসরণ কর যা আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন। তারা বলে, বরং আমরা অনুসরণ করব আমাদের পিতৃ-পুরুষদেরকে যার উপর পেয়েছি। যদি তাদের পিতৃ-পুরুষরা কিছু না বুঝে এবং হেদায়াতপ্রাপ্ত না হয়, তাহলেও কি’? (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৭০)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اِذَا قِیۡلَ لَہُمُ اتَّبِعُوۡا مَاۤ  اَنۡزَلَ اللّٰہُ قَالُوۡا بَلۡ نَتَّبِعُ مَا وَجَدۡنَا عَلَیۡہِ اٰبَآءَنَا ؕ اَوَ لَوۡ  کَانَ الشَّیۡطٰنُ یَدۡعُوۡہُمۡ  اِلٰی  عَذَابِ  السَّعِیۡرِ .

‘আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তোমরা তার অনুসরণ কর। তখন তারা বলে, বরং আমরা তার অনুসরণ করব, যার উপর আমাদের পিতৃ-পুরুষদেরকে পেয়েছি। শয়তান যদি তাদেরকে জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তির দিকে আহ্বান করে, তবুও কি?’ (সূরা লুক্বমান : ২১)। উপরিউক্ত দলীলগুলো সকল ক্ষেত্রে পুরুষ-মহিলার তাক্বলীদকে বাতিল সাব্যস্ত করে। পিতৃপুরুষগণ এবং নেতাদের দলীলবিহীন অন্ধ অনুসরণ করাকে একেবারেই হারাম ঘোষনা করে।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র :
[১]­. আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ, (কুয়েত : ওয়াযারাতুল আওক্বাফ ওয়াশশুয়ূনিল ইসলামিয়্যাহ, ১৪০৪-১৪২৭ হি.), ১৩তম খণ্ড, পৃ. ১৫৪।    
[২]­. আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনু আবু বকর শামসুদ্দীন আল-কুরতুবী, আল-জামেঊ‘ লি আহকামিল কুরআন (রিয়াদ : দারু ‘আলিমিল কুতুব, সঊদীআরব, ১৪২৩ হি./২০০৩ খ্রি.), ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৩৯; আবুল হাসান আলী ইবনু ইসমাঈল আন-নাহবী আল-আন্দালুসী, আল-মিখাছ্ছাছু লি ইবনু সীদাহ; তাহক্বীক : খলীল ইবরাহীম (বৈরূত : দারু ইহইয়ায়িল তুরাছ আল-আরাবী, ১৪১৭ হি./১৯৯৬ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৬৯।
[৩]­. আল-জামেঊ‘ লি আহকামিল কুরআন, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৪০; আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ, (কুয়েত : ওয়াযারাতুল আওক্বাফ ওয়াশশুয়ূনিল ইসলামিয়্যাহ, ১৪০৪-১৪২৭ হি.) ১৩তম খণ্ড, পৃ. ১৫৫; আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম; তাহক্বীক : সামী ইবনু মুহাম্মাদ সালামাহ (দারুত তায়্যেবা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ১০; আব্দুর রহমান ইবনু নাছের আস-সা‘আদী, তায়সীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান (বৈরূত : মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ১৪২০ হি./২০০০ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ২১৮; জাবির ইবনু মূসা ইবনু আব্দুল ক্বাদির ইবনু জাবির আবূ বকর আল-জাযাইরী, আইসারুত তাফাসীর লিকালামিল উলয়িল কাবীর (আল-মাদীনাতুল মুনুয়্যারা : মাকতাবাতুল উলূমে ওয়াল হুকমে, ৫ম সংস্করণ, ১৪২৪ হি./ ২০০৩ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৮৬-৫৮৭। 
[৪]­.إن العرب كانوا يتقلدون من لحاء شجر مكة فيقيم الرجل بمكانه حتى إذا انقضت الأشهر الحرم فأراد أن يرجع إلى أهله قلَّد نفسه وناقته من لحاء الشجرفيأمن حتى يأتي أهله -মুহাম্মাদ ইবনু জারীর ইবনু ইয়াযীদ ইবনু কাছীর আবূ জাফর আত-ত্বাবারী, জামেউল বায়ান ফী তাবীলিল কুরআন, তাহক্বীক : আহমাদ মুহাম্মাদ শাকীর (মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ১৪২০ হি./ ২০০০ খ্রি.), ৯ম খণ্ড, পৃ. ৪৬৮।
[৫]­. আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ১৫৪; আলী ইবনু নায়িফ আশ-শুহুদ, মাওসূ‘আতুর রাদ্দে ‘আলাল মাযাহিবিল ফিকরিয়াতিল মা‘আছিরাহ, ৬৪তম খণ্ড, পৃ. ৩৬। 
[৬]­. আবু মানছূর মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ আল-আযহারী, তাহযীবুল লুগাত (বৈরূত : দারু ইহইয়ায়ুত তুরাছুল ‘আরাবী, ২০০১ খ্রি.), ৯ম খণ্ড, পৃ. ৪৮।
[৭]­. আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ১৫৪। 
[৮]­. আব্দুস সালাম ইবনু তাইমিয়াহ, আব্দুল হালীম ইবনু তাইমিয়াহ, আহমাদ ইবনু তাইমিয়াহ, মুসাওয়্যাদাতু ফী উছূলিল ফিকহ; তাহক্বীক : মুহাম্মাদ মুহীউদ্দীন আব্দুল হামীদ (দারুল কিতাবিল ‘আরাবী, তাবি), ১ম খণ্ড, পৃঃ ৪৬২।
[৯]­. আলী ইবনু আহমাদ ইবনু হাযম আন্দালুসী আবূ মুহাম্মাদ, আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম (কায়রো : দারুল হাদীছ, ১৪০৪ হি.), ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৩৪।
[১০]­. وإنما التقليد الذي نخالفهم فيه أخذ قول رجل ممن دون النبي صلى الله عليه و سلم لم يأمرنا ربنا  باتباعه بلا دليل ; আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৩৪।
[১১]­. মুহাম্মাদ ইবনু আলী ইবনু মুহাম্মাদ আশ-শাওকানী, ইরশাদুল ফুহুল ইলা তাহক্বীকিল হাক্কি মিন ইলমিল উছূল; তাহক্বীক : শাইখ আহমাদ আয্যা ঈনায়াহ (দারুল কিতাবিল ‘আরাবী, ১৪১৯ হি./১৯৯৯ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩৯।
[১২]­. মুহাম্মাদ ইবনু ছালেহ আল-উছায়মীন, আল-উছূল মিন ইলমিল উছূল (দারু ইবনু জাওযী, ১৪২৬ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৮৭।
[১৩]­. আল-উছূল মিন ইলমিল উছূল, ১ম খণ্ড, পৃ. ৮৭।
[১৪]­. আলবানী, আল-হাদীছ হুজ্জাতুন বিনাফসিহী ফিল আক্বাইদ ওয়াল আহকাম, পৃ. ৭১।
[১৫]­. যুবায়ের আলী যাঈ, ইসলামে তাক্বলীদের বিধান; অনুবাদ : আহমাদুল্লাহ (রাজশাহী : হাদীছ ফাউণ্ডেশণ বাংলাদেশ, ২০১৭ খ্রি.), পৃ. ৯; মুসাল্লামুছ ছুবূত (ছাপা : ১৩১৬ হি.), পৃ. ২৮৯, ফাওয়াতিহূর রাহমূত, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪০০।
[১৬]­. ইসলামে তাক্বলীদের বিধান, পৃ. ১০; ফাওয়াতিহুর রাহমূত বি-শারহি মুসাল্লামিছ ছুবূত ফী উছূলিল ফিক্বহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪০০।
[১৭]­. ইসলামে তাক্বলীদের বিধান, পৃ. ১৫।
[১৮]­. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪।
[১৯]­. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫।
[২০]­. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫।
[২১]­. قال أبو محمد فمن اتخذ رجلا إماما يعرض عليه قول ربه وقول نبيه صلى الله عليه و سلم فما وافق فيه قول ذلك الرجل قبله وما خالفه ترك قول ربه تعالى وقول نبيه صلى الله عليه و سلم وهو يقر أن هذا قول الله عز و جل وقول رسوله صلى الله عليه و سلم والتزم قول إمامه فقد اتخذ دون الله تعالى وليا ; আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৭৪-২৭৫।
[২২]­. আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৭৫।
[২৩]­. মুহাম্মাদ ইবনু জারীর ইবনু ইয়াযীদ ইবনু কাছীর আবূ জা‘ফর আত-ত্বাবারী, জামেঊল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন; তাহক্বীক : আহমাদ মুহাম্মাদ শাকির (মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১৪২০ হি./ ২০০০ খ্রি.), ১২তম খণ্ড, পৃ. ৩৭৭।
[২৪]­. وكان هذا شيئًا قد ابتدعوه من تلقاء أنفسهم واتبعوا فيه آباءهم ويعتقدون أن فعل آبائهم مستند إلى أمر من الله وشرع فأنكر الله تعالى عليهم ذلك فقال ; আবূল ফিদা ইসমাঈল ইবনু ওমর ইবনু কাছীর আদ-দিমাশক্বী, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম; তাহক্বীক : সামী ইবনু মুহাম্মাদ সালামা (দারুত ত্বায়েবা, ২য় সংস্করণ, ১৪২০ হি./ ১৯৯৯ খ্রি.), ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪০২।




আল-কুরআন এক জীবন্ত মু‘জিযা - আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইউনুস
বিদায় হজ্জের ভাষণ : তাৎপর্য ও মূল্যায়ন (শেষ কিস্তি) - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
ক্রোধের ভয়াবহতা ও তার শারঈ চিকিৎসা (শেষ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
সালাফী মানহাজের বৈশিষ্ট্য (শেষ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইখলাছই পরকালের জীবনতরী (৩য় কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
আল-উরওয়াতুল উছক্বা - অনুবাদ : ইউনুস বিন আহসান
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
অল্পে তুষ্ট (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
প্রচলিত তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের অবস্থান (৮ম কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
ফাযায়েলে কুরআন (৭ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
দুর্নীতি হ্রাসে শিক্ষার ভূমিকা - মোঃ শফিকুল ইসলাম

ফেসবুক পেজ