তাওহীদ প্রতিষ্ঠার উপায়
-আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
(২য় কিস্তি)
(গ) الإخلاص আল-ইখলাছ (একনিষ্ঠতা বা আন্তরিকতা) : ইখলাছ (الإخلاص) শব্দটি আরবী। এটি خلص শব্দ হতে নির্গত। অর্থ হল আন্তরিক হওয়া, বিশ্বস্ত হওয়া, নিবেদিত হওয়া ইত্যাদি। কোন বস্তু নির্ভেজাল ও খাঁটি হওয়া এবং তার সাথে কোন কিছুর সংমিশ্রণ না থাকা। ইখলাছের আভিধানিক অর্থ আনুগত্যে রিয়া প্রদর্শন পরিহার করা’।[১] মানবাত্মার পরিচ্ছন্নতায় বিঘ্ন ঘটায় এ ধরনের যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা থেকে অন্তর খালি করাকে ইখলাছ বলে। অতএব ইখলাছ হল আমলগুলো যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা মুক্ত করা ও নির্ভেজাল করা।[২] আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে স্বীয় আমলের প্রত্যয়নকারী হিসাবে তালাশ না করা।[৩] আল্লাহর আনুগত্যের ক্ষেত্রে নিয়তকে পরিষ্কার করা।[৪] আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর নির্দেশিত বস্তু পালন করা এবং নিষেধাজ্ঞা বস্তু বর্জন বা পরিত্যাগ করা।[৫]
‘ইখলাছ’ শিরক এবং রিয়া তথা লোক দেখানো ইবাদতের বিপরীত। এটা হল আমলের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি, ভেজাল ও কলঙ্ক হতে পরিষ্কার এবং নির্মলকরণ। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা সকল কাজের ক্ষেত্রে ইখলাছ অবলম্বনের নির্দেশ প্রদান করেছেন। বান্দা তার যাবতীয় ইবাদত নির্ভেজালভাবে তার পালনকর্তা আল্লাহর জন্যই সম্পন্ন করবে। সে যদি ইবাদতের কোন কিছু আল্লাহ ব্যতীত কারো উদ্দেশ্যে করে বা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে, তবে সে আল্লাহর সাথে শিরক করল এবং ইখলাছের শর্তকে নষ্ট করে ফেলল। যে ব্যক্তি এ কাজ করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে এবং তার কাজকে প্রত্যাখ্যান করবেন। হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাযিআল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, মহান আল্লাহ বলেন,
.أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيْهِ مَعِىْ غَيْرِى تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ
‘আমি শরীকদের শিরক হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। যদি কোন লোক কোন কাজ করে এবং এতে আমি ছাড়া অপর কাউকে শরীক করে, তবে আমি তাকে ও তার শিরকী কাজকে প্রত্যাখ্যান করি’।[৬]
আর এ কারণেই ইবাদতকে বিশুদ্ধ করতে হবে এবং আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اَلَا لِلّٰہِ الدِّیۡنُ الۡخَالِصُ ‘জেনে রেখ, আল্লাহর জন্যই বিশুদ্ধ ইবাদত-আনুগত্য’ (সূরা আয-যুমার : ৩)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَاعۡبُدِ اللّٰہَ مُخۡلِصًا لَّہُ الدِّیۡنَ ‘অতএব আল্লাহর ইবাদত কর তাঁরই আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে’ (সূরা আয-যুমার : ২)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَاۤ اُمِرُوۡۤا اِلَّا لِیَعۡبُدُوا اللّٰہَ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ الدِّیۡنَ حُنَفَآءَ ‘আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে তাঁরই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে’ (সূরা আল-বাইয়িনাহ : ৫)।
হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাযিআল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِيْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ أَوْنَفْسِهِ ‘আমার শাফা‘আত লাভের ব্যাপারে ক্বিয়ামতের দিন সে ব্যক্তিই সর্বাপেক্ষা সৌভাগ্যবান হবে, যে তার অন্তর হতে একনিষ্ঠচিত্তে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলে।
৪. الصدق আছ-ছিদক্ব (সত্যায়ন) : আছ-ছিদক্ব (الصدق) হল মিথ্যার বিপরীত। এ কারণে বান্দা তার অন্তর থেকে এই কালেমা বলবে। কেননা الصدق হল অন্তরের বিশ্বাস মুখের সাথে একমত হওয়া।[৮] কালিমা ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ (لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ) এমনভাবে বলবে যে, সে তাতে সত্যবাদী থাকবে। তার অন্তর হবে মুখের কথার মোতাবেক। মুখের কথা হবে অন্তরের মোতাবেক। শুধু যদি মুখে উচ্চারণ করে, আর তার অন্তর কালিমার অর্থ ও তাৎপর্য বিশ্বাস না করে, তাহলে কোন লাভ হবে না। ফলে অন্যান্য মুনাফিক্বদের মত সেও কাফিরে পরিণত হবে। আর মৌখিক স্বীকৃতি ও আন্তরিক বিশ্বাস সঠিক কি না তা আমল দ্বারা সত্যায়িত হবে।[৯] আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিক্বদের নিন্দা ও দোষারোপ করে বলেন,
.اِذَا جَآءَکَ الۡمُنٰفِقُوۡنَ قَالُوۡا نَشۡہَدُ اِنَّکَ لَرَسُوۡلُ اللّٰہِ وَ اللّٰہُ یَعۡلَمُ اِنَّکَ لَرَسُوۡلُہٗ وَ اللّٰہُ یَشۡہَدُ اِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ لَکٰذِبُوۡنَ
‘যখন আপনার কাছে মুনাফিক্বরা আসে, তখন বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং আল্লাহ জানেন যে, অবশ্যই আপনি তাঁর রাসূল। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, অবশ্যই মুনাফিক্বরা মিথ্যাবাদী’ (সূরা আল-মুনাফিকুন : ১)।
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিক্বদের মিথ্যুকের গুণে বিশেষিত করেছেন। কেননা তারা মুখে যা বলে, তাদের অন্তর তার বিপরীত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّقُوۡلُ اٰمَنَّا بِاللّٰہِ وَ بِالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَ مَا ہُمۡ بِمُؤۡمِنِیۡنَ ‘আর মানুষের মধ্যে এমন লোক আছে, যারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিবসের প্রতি, অথচ তারা মুমিন নয়’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৮)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
.اَحَسِبَ النَّاسُ اَنۡ یُّتۡرَکُوۡۤا اَنۡ یَّقُوۡلُوۡۤا اٰمَنَّا وَ ہُمۡ لَا یُفۡتَنُوۡنَ .وَ لَقَدۡ فَتَنَّا الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ فَلَیَعۡلَمَنَّ اللّٰہُ الَّذِیۡنَ صَدَقُوۡا وَ لَیَعۡلَمَنَّ الۡکٰذِبِیۡنَ
‘মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? আর আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি। ফলে আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা সত্য বলে এবং অবশ্যই তিনি জেনে নেবেন, কারা মিথ্যাবাদী’ (সূরা আল-আনকাবূত : ২-৩)।
হাদীছে এসেছে, আনাস (রাযিআল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
.مَا مِنْ أَحَدٍ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ صِدْقًا مِنْ قَلْبِهِ إِلَّا حَرَّمَهُ اللهُ عَلَى النَّارِ
‘এমন কেউ কি নেই, যে ব্যক্তি অন্তরের সাথে সত্য জেনে একথা ঘোষণা করবে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামকে হারাম করে দিবেন’।[১০] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন,
.مَنْ مَاتَ وَهُوَ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ صَادِقًا مِنْ قَلْبِهِ دَخَلَ الْجَنَّةَ
‘যে ব্যক্তি অন্তরের সত্যবাদিতার সাথে ‘আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এ কথার সাক্ষ্য দিবে, এমতাবস্থায় মারা গেলে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[১১]
৫. المحبةআল-মাহাব্বা (ভালবাসা) : আছ-মাহাব্বা (المحبة) হলো ঘৃণা, অবজ্ঞা ও অপসন্দের বিপরীত।[১৩] এ কালেমা পাঠকারী আল্লাহ, তাঁর রাসূল, দ্বীন-ইসলাম এবং ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত অনুগত মুসলিমদেরকে ভালবাসবে এবং যে ব্যক্তি কালিমা ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ (لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ)-এর বিপরীত (যেমন শিরক, কুফর ইত্যাদি) করবে, তার প্রতি ঘৃণা ও বিরাগ পোষণ করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قَدۡ کَانَتۡ لَکُمۡ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ فِیۡۤ اِبۡرٰہِیۡمَ وَ الَّذِیۡنَ مَعَہٗ اِذۡ قَالُوۡا لِقَوۡمِہِمۡ اِنَّا بُرَءٰٓؤُا مِنۡکُمۡ وَ مِمَّا تَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ کَفَرۡنَا بِکُمۡ وَ بَدَا بَیۡنَنَا وَ بَیۡنَکُمُ الۡعَدَاوَۃُ وَ الۡبَغۡضَآءُ اَبَدًا حَتّٰی تُؤۡمِنُوۡا بِاللّٰہِ وَحۡدَہ
‘তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ; তাঁরা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত কর তার সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই; আমরা তোমাদের সাথে কুফরী করি। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হল শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য, যখন পর্যন্ত তোমরা এক আল্লাহয় ঈমান না আন’ (সূরা আল-মুমতাহিনাহ : ৪)।
এ জন্য আল্লাহর প্রতি ভালবাসা রেখে এ কালিমা উচ্চারণ করবে। কিন্তু আল্লাহর প্রতি ভালবাসা না রেখে যদি এ কালিমা পাঠ করে, তবে কাফিরই থেকে যাবে। ইসলামে প্রবেশ করবে না। তবে তার বিধান হবে অন্যান্য মুনাফিক্বদের ন্যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
.قُلۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُحِبُّوۡنَ اللّٰہَ فَاتَّبِعُوۡنِیۡ یُحۡبِبۡکُمُ اللّٰہُ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ وَ اللّٰہُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ
‘বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ৩১)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
.وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّتَّخِذُ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اَنۡدَادًا یُّحِبُّوۡنَہُمۡ کَحُبِّ اللّٰہِ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَشَدُّ حُبًّا لِّلّٰہِ
‘আর মানুষের মধ্যে এমনও লোক আছে, যারা আল্লাহ ব্যতীত অপরকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহকে ভালবাসার ন্যায় ভালবাসে। অথচ যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহর জন্য ভালবাসায় দৃঢ়তর’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৬৫)।
হাদীছে এসেছে, আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
لَا يَجِدُ أَحَدٌ حَلَاوَةَ الْإِيْمَانِ حَتَّى يُحِبَّ الْمَرْءَ لَا يُحِبُّهُ إِلَّا لِلهِ وَحَتَّى أَنْ يُقْذَفَ فِى النَّارِ أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنْ أَنْ يَرْجِعَ إِلَى الْكُفْرِ بَعْدَ إِذْ أَنْقَذَهُ اللهُ وَحَتَّى يَكُوْنَ اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا
‘কোন ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ পাবে না, যতক্ষণ না সে মানুষকে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবাসবে, আর ততক্ষণ না সে যে কুফরী থেকে আল্লাহ তাকে উদ্ধার করেছেন, তার দিকে ফিরে যাবার চেয়ে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অধিক প্রিয় মনে না করবে এবং যতক্ষণ না আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তার কাছে অন্য সব কিছুর চেয়ে অধিক প্রিয় না হবেন’।[১৪]
৬. القبولআল-ক্ববূল (গ্রহণ করা) : আল-ক্ববূল (القبول) হল প্রত্যাখ্যান ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করার বিপরীত।[১৫] আমাদের উপর আবশ্যিক হল কালিমা ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ (لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ)-কে যথাযথভাবে ও সত্য সহকারে অন্তর এবং মুখের মাধ্যমে গ্রহণ করা। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে অসংখ্য খবরের বর্ণনা পেশ করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই এ কালিমা গ্রহণ করার কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন এবং রক্ষা করেছেন। আবার যারা এ কালিমাকে প্রত্যাখ্যান ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছেন, তাদেরকে শাস্তি প্রদান ও ধ্বংস করেছেন এবং তাদের নিকট হতে কোন কিছুই গ্রহণ করেননি।[১৬] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ثُمَّ نُنَجِّیۡ رُسُلَنَا وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کَذٰلِکَ حَقًّا عَلَیۡنَا نُنۡجِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ‘তারপর আমি মুক্তি দেই আমার রাসূলদেরকে এবং তাদেরকেও যারা ঈমান এনেছে। এটা আমাদের দায়িত্ব যে, মুমিনদের মুক্তি দেই’ (সূরা ইউনুস : ১০৩)। আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের ব্যাপারে বলেন,
اِنَّہُمۡ کَانُوۡۤا اِذَا قِیۡلَ لَہُمۡ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا اللّٰہُ یَسۡتَکۡبِرُوۡنَ . وَ یَقُوۡلُوۡنَ اَئِنَّا لَتَارِکُوۡۤا اٰلِہَتِنَا لِشَاعِرٍ مَّجۡنُوۡنٍ
‘তাদেরকে যখন বলা হত, ‘আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মা‘বূদ নেই’, তখন নিশ্চয় তারা অহঙ্কার করত। আর বলত, ‘আমরা কি এক পাগল কবির জন্য আমাদের উপাস্যদের ছেড়ে দেব?’ (সূরা আছ-ছাফফাত : ৩৫-৩৬)।
৭. الانقياد আল-ইনক্বিয়াদ (বশ্যতা স্বীকার করা বা মেনে নেয়া) : আল-ইনক্বিয়াদ (الانقياد) হল পরিত্যাগ ও উপেক্ষা করার বিপরীত।[১৭] কালিমা ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ (لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ) পাঠকারীর উপর আবশ্যিক হল আল্লাহর শরী‘আতের নিকট আত্মসমর্পণ করা, তাঁর নির্দেশের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করা এবং নিজেকে আল্লাহর জন্য অনুগত করা। যাতে করে সে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ (لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ)-কে আঁকড়ে ধরতে পারে। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اَنِیۡبُوۡۤا اِلٰی رَبِّکُمۡ وَ اَسۡلِمُوۡا لَہٗ ‘আর তোমরা তোমাদের রবের অভিমুখী হও এবং তার কাছে আত্মসমর্পণ কর’ (সূরা আয-যুমার : ৫৪)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَنۡ اَحۡسَنُ دِیۡنًا مِّمَّنۡ اَسۡلَمَ وَجۡہَہٗ لِلّٰہِ وَ ہُوَ مُحۡسِنٌ ‘আর দ্বীনের ব্যাপারে তার তুলনায় কে উত্তম, যে সৎকর্মপরায়ণ অবস্থায় আল্লাহর নিকট নিজেকে পূর্ণ সমর্পণ করল’ (সূরা আন-নিসা : ১২৫)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَنۡ یُّسۡلِمۡ وَجۡہَہٗۤ اِلَی اللّٰہِ وَ ہُوَ مُحۡسِنٌ فَقَدِ اسۡتَمۡسَکَ بِالۡعُرۡوَۃِ الۡوُثۡقٰی ‘আর যে ব্যক্তি একনিষ্ঠ ও বিশুদ্ধচিত্তে আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে, সে তো শক্ত রশি আঁকড়ে ধরে’ (সূরা লুক্বমান : ২২)। অর্থাৎ সে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ (لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ)-কে আঁকড়ে ধরল।[১৮]
৮. الكفر আল-কুফরু (অস্বীকার করা) : আল-কুফরু (الكفر) হল আল্লাহ ব্যতীত যা কিছুর ইবাদত করা হয় তা অস্বীকার করা। অর্থাৎ গাইরুল্লাহর (আল্লাহ ব্যতীত অন্যের) ইবাদত থেকে নিজেকে মুক্ত করা এবং তা যে বাতিল তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা।[১৯] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
.فَمَنۡ یَّکۡفُرۡ بِالطَّاغُوۡتِ وَ یُؤۡمِنۡۢ بِاللّٰہِ فَقَدِ اسۡتَمۡسَکَ بِالۡعُرۡوَۃِ الۡوُثۡقٰی لَا انۡفِصَامَ لَہَا وَ اللّٰہُ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ
‘অতএব যে ব্যক্তি ত্বাগূতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মযবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৫৬)।
শাহাদাতের দ্বিতীয় অংশের শর্তসমূহ [২০]
(ক) ‘মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল’-এ কথার স্বীকৃতি প্রদান করা এবং অন্তরে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা।
(খ) ‘মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল’-এ কথা বলা এবং প্রকাশ্যে মৌখিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা : উপরিউক্ত শর্ত দু’টির দলীল হল আল্লাহ তা‘আলার বাণী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
.اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِاللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ ثُمَّ لَمۡ یَرۡتَابُوۡا
‘মুমিন কেবল তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ঈমান এনেছে তারপর সন্দেহ পোষণ করেনি’ (সূরা আল-হুজুরাত : ১৫)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, تِلۡکَ اٰیٰتُ اللّٰہِ نَتۡلُوۡہَا عَلَیۡکَ بِالۡحَقِّ وَ اِنَّکَ لَمِنَ الۡمُرۡسَلِیۡنَ ‘এগুলো আল্লাহর নিদর্শন-আপনার নিকট এগুলো সত্যরূপে পাঠ করছি এবং নিশ্চয় আপনি রাসূলগণের অন্তর্গত’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৫২)।
(গ) মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পক্ষ থেকে যা এসেছে, তার অনুসরণ করা এবং যা হতে নিষেধ করেছে তা বর্জন করা : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُحِبُّوۡنَ اللّٰہَ فَاتَّبِعُوۡنِیۡ یُحۡبِبۡکُمُ اللّٰہُ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ وَ اللّٰہُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ‘[হে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)]! আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ৩১)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
…وَ رَحۡمَتِیۡ وَسِعَتۡ کُلَّ شَیۡءٍ فَسَاَکۡتُبُہَا لِلَّذِیۡنَ یَتَّقُوۡنَ وَ یُؤۡتُوۡنَ الزَّکٰوۃَ وَ الَّذِیۡنَ ہُمۡ بِاٰیٰتِنَا یُؤۡمِنُوۡنَ . اَلَّذِیۡنَ یَتَّبِعُوۡنَ الرَّسُوۡلَ النَّبِیَّ الۡاُمِّیَّ
‘আর আমার করুণা ও দয়া প্রতিটি জিনিসকেই পরিব্যপ্ত করে রয়েছে, সুতরাং কল্যাণ আমি তাদের জন্যই লিখব যারা পাপাচার হতে বিরত থাকে, যাকাত দেয় এবং আমার নিদর্শনসমূহের প্রতি ঈমান আনয়ন করে। যারা সেই নিরক্ষর রাসূল নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসরণ করে চলে..’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৫৬-১৫৭)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
.فَاٰمِنُوۡا بِاللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہِ النَّبِیِّ الۡاُمِّیِّ الَّذِیۡ یُؤۡمِنُ بِاللّٰہِ وَ کَلِمٰتِہٖ وَ اتَّبِعُوۡہُ لَعَلَّکُمۡ تَہۡتَدُوۡنَ
‘সুতরাং তোমরা আল্লাহর প্রতি এবং তাঁর সেই বার্তাবাহক নিরক্ষর নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ঈমান আনয়ন কর, যে আল্লাহতে ও তাঁর কালামে বিশ্বাস স্থাপন করে থাকে, তোমরা তারই অনুসরণ কর, আশা করা যায় তোমরা সরল সঠিক পথের সন্ধান পাবে’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৫৮)।
[ইনশাআল্লাহ চলবে]
* আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম, এম. ফিল গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
১. আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আলী আল-জুরজানী, কিতাবুত তা‘রীফাত (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪০৩ হি.), পৃ. ১৩।
২. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫, শব্দ নং-৬৭।
৩. তদেব।
৪. আবুল মুযাফফর আস-সুম‘আনী আশ-শাফিঈ, তাফসীরুল কুরআন (রিয়ায : দারুল ওয়াত্বান, ১ম সংস্করণ, ১৪১৮ হি.), ৪র্থ খন্ড, পৃ. ৪৫৭।
৫. মুহাম্মাদ আত-তাহির ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু ‘আশূর, আত-তাহরীর ওয়াত তানবীর (দারুত তিউনিশিয়া, ১৯৮৪ হি.), ২৩তম খন্ড, পৃ. ৩৮।
৬. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৮৫।
৭. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪।
৮. আব্দুর রাযযাক্ব ইবনু আব্দুল মুহসিন আল-বদর, কালিমাতুত তাওহীদ লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ, পৃ. ৩১।
৯. আব্দুল আযীয ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু বায, কালিমাতুত তাওহীদ লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ, পৃ. ৯।
১০. ছহীহ বুখারী, হা/১২৮; ছহীহ মুসলিম, হা/৩২।
১১. মুসনাদে আহমাদ, হা/২২০৫৬, সনদ ছহীহ।
১২. কালিমাতুত তাওহীদ লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ, পৃ. ৩২।
১৩. আব্দুল আযীয ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু বায, কালিমাতুত তাওহীদ লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ, পৃ. ৯।
১৪. ছহীহ বুখারী, হা/৬০৪১।
১৫. কালিমাতুত তাওহীদ লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ, পৃ. ৩৩।
১৬. কালিমাতুত তাওহীদ লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ, পৃ. ৩৩।
১৭. প্রাগুক্ত।
১৮. জা‘মিঊল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন, ১৮তম খন্ড, পৃ. ৫৬৯; আল-জামিঊ লি আহকামিল কুরআন, ১৪তম খন্ড, পৃ. ৭৪।
১৯. আব্দুল আযীয ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু বায, কালিমাতুত তাওহীদ লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ, পৃ. ১১।
২০. আল-ক্বাওলুল মুফীদ ফী আদিল্লাতিত তাওহীদ, পৃ. ৩৬-৩৮।