মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ১১:২৭ অপরাহ্ন
সালাফী মানহাজ অনুসরণের মর্যাদা
-আবূ মুশফিক*

সালাফী মানহাজের সত্যিকার ও সত্যনিষ্ঠ অনুসারীদের জন্য রয়েছে কল্যাণ, ছওয়াব ও মহা পুরস্কার। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর উপর অবতীর্ণ অহী ছাহাবায়ে কেরামগণের মাধ্যমই বাস্তবায়ন করেছেন, তাদেরকে শরী‘আতের সঠিক বুঝ ও ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছেন এবং দ্বীনের সামগ্রিক ব্যাপারে সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তৎপরবর্তীতে ছাহাবীগণ তাবেঈগণকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং তাঁরা তাঁদের অনুসারী তাবে‘ তাবেঈদের শিক্ষা দিয়েছেন। এছাড়া উক্ত তিন যুগকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘উত্তম যুগ’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। সুতরাং শরী‘আতের নছ বা বিধান বুঝার ক্ষেত্রে তাদেরকে মডেল হিসাবে গ্রহণ করা একদিকে যেমন আবশ্যক, তেমনি তাদের যথাযথ অনুসারীদের জন্য রয়েছে কল্যাণ ও মহা পুরস্কারের ঘোষণা।

১- আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি অর্জন

সালাফী মানহাজ অনুসরণ করা ওয়াজিব। আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে অনেক আয়াতে নির্দেশনা প্রদান করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি এ মানহাজের অনুসরণ করবে, সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর নির্দেশের অনুসারী হবে। আর যে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশের অনুসারী হবে, আল্লাহ তাকে ভালোবাসবেন। এছাড়া তিনি ছাহাবী ও তাঁদের অনুসারীদের যেমন প্রশংসা করেছেন, তেমনি জান্নাতের সুসংবাদও প্রদান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ السّٰبِقُوۡنَ الۡاَوَّلُوۡنَ مِنَ الۡمُہٰجِرِیۡنَ وَ الۡاَنۡصَارِ وَ الَّذِیۡنَ اتَّبَعُوۡہُمۡ بِاِحۡسَانٍ ۙ رَّضِیَ اللّٰہُ عَنۡہُمۡ وَ رَضُوۡا عَنۡہُ وَ اَعَدَّ لَہُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ تَحۡتَہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَاۤ  اَبَدًا ؕ ذٰلِکَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ.

‘আর যেসব মুহাজির ও আনছার (ঈমান আনয়নে) অগ্রবর্তী এবং প্রথম, আর যেসব লোক একান্ত নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুগামী, আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাঁরাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে, আর আল্লাহ তাদের জন্য এমন উদ্যানসমূহ প্রস্তুত করে রেখেছেন যার তলদেশে নহরসমূহ বইতে থাকবে, যার মধ্যে তারা চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে, তা হচ্ছে বিরাট সফলতা’ (সূরা আত-তাওবাহ : ১০০)।

২- হেদায়াত লাভ ও ভ্রষ্টতা থেকে নিরাপত্তা লাভ

সালাফী মানহাজ অবলম্বনের মাধ্যমে হেদায়াত লাভ হবে এবং ভ্রষ্টতা ও বক্রতা থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে। বিদায় হজ্জে নবী করীম (ﷺ) বলেছেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّيْ قَدْ تَرَكْتُ فِيْكُمْ مَا إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ فَلَنْ تَضِلُّوْا أَبَدًا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ ﷺ.

‘হে লোকসকল! নিশ্চয় আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস ছেড়ে যাচ্ছি, তোমরা যদি তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাক, তাহলে কখনই তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হল আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবী (ﷺ)-এর সুন্নাত’।[১] আর আল্লাহর কিতাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সালাফে ছালিহীনের অনুসরণের আদেশ বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ  فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰہِ  اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ  لِّمَنۡ کَانَ یَرۡجُوا اللّٰہَ وَ الۡیَوۡمَ  الۡاٰخِرَ  وَ ذَکَرَ  اللّٰہَ  کَثِیۡرًا.

‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে’ (সূরা আল-আহযাব : ২১)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা, কর্ম ও অবস্থাসমূহে তাঁকে নিজের আদর্শ মানার ব্যাপারে এই আয়াত একটি বড় মৌলনীতি। এজন্য খন্দক যুদ্ধের দিন নবী (ﷺ)-কে তার ধৈর্যধারণে, ধৈর্যধারণের প্রতিযোগিতায় (শত্রুর বিরুদ্ধে) সদা প্রস্তুত থাকাতে, তার জিহাদ ও সংগ্রামে এবং নিজ প্রতিপালকের নিকট থেকে বিপদমুক্তির অপেক্ষায় নিজেদের আদর্শ বানায় (এবং তার অনুসরণ করতে) মহান আল্লাহ মানুষকে আদেশ করেছেন’।[২]

৩- মতানৈক্য ও বিচ্ছিন্নতা থেকে সুরক্ষা

সালাফী মানহাজ অনুসরণ করলে অনুসারীকে নিন্দিত মতানৈক্য ও বিচ্ছিন্নতায় পতিত হওয়া থেকে সুরক্ষিত রাখে। যেহেতু শরী‘আত মুসলিমদেরকে হকের উপর, হকের সাথে ও হকের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। মহান আল্লাহ বলেছেন,
 وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰہِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا ‘তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুক শক্ত করে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

مُنِیۡبِیۡنَ اِلَیۡہِ وَ اتَّقُوۡہُ  وَ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ  وَ لَا تَکُوۡنُوۡا مِنَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ- مِنَ الَّذِیۡنَ فَرَّقُوۡا دِیۡنَہُمۡ  وَ کَانُوۡا شِیَعًا ؕ کُلُّ  حِزۡبٍۭ بِمَا لَدَیۡہِمۡ فَرِحُوۡنَ

‘বিশুদ্ধচিত্তে তাঁর অভিমুখী হয়ে তাঁকে ভয় কর, তোমরা ছালাত কায়েম কর এবং অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না; যারা দ্বীনের মধ্যে নানা মত সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে, প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে আনন্দিত’ (সূরা আর-রূম : ৩১-৩২)। আর হাদীছে এসেছে, ইরবায ইবনু সারিয়্যাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

إِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِى فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيْرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِىْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّيْنَ الرَّاشِدِيْنَ تَمَسَّكُوْا بِهَا وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ.

‘তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে জীবিত থাকবে তারা অচিরেই প্রচুর মতবিরোধ দেখবে। তখন তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাত এবং আমার হিদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নাত অনুসরণ করবে, তা দাঁত দিয়ে কামড়ে আঁকড়ে থাকবে। সাবধান! প্রতিটি নবাবিষ্কার সম্পর্কে! কারণ প্রতিটি নবাবিষ্কার হল বিদ‘আত এবং প্রতিটি বিদ‘আত হল ভ্রষ্টতা’।[৩] ইমাম বাগাবী (রাহিমাহুল্লাহ) উক্ত হাদীছের টীকায় বলেছেন, ‘এতে বিদ‘আত ও খেয়ালখুশির বহিঃপ্রকাশ ঘটার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত। তাই রাসূল (ﷺ) তাঁর সুন্নাত ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অবলম্বন করতে, ঐকান্তিকভাবে সর্বাত্মক প্রচেষ্টার সাথে তা আঁকড়ে ধরতে এবং তার পরিপন্থী নব উদ্ভাবিত কর্মসমূহ থেকে দূরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন’।[৪] সুতরাং সালাফদের অনুসরণ করলে যেমন পরস্পর বিচ্ছিন্নতা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, তেমনি তাদের অনুসরণ না করলে বিচ্ছিন্নতা ও মতানৈক্য অবশ্যম্ভাবী।

৪- শয়তানের পথসমূহ থেকে নিষ্কৃতি

মহান আল্লাহ বলেন,

وَ  اَنَّ  ہٰذَا صِرَاطِیۡ مُسۡتَقِیۡمًا فَاتَّبِعُوۡہُ ۚ وَ لَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ  فَتَفَرَّقَ  بِکُمۡ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ ؕ ذٰلِکُمۡ  وَصّٰکُمۡ بِہٖ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ

‘নিশ্চয়ই এটি আমার সরল পথ। সুতরাং এরই অনুসরণ কর এবং ভিন্ন পথ অনুসরণ করো না, করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন করতে পার’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৫৩)। উক্ত আয়াতের ব্যাপারে ইমাম মুহাম্মাদ নাছির আল-মিরওয়াযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘সুতরাং আল্লাহ আমাদেরকে অবহিত করেছেন যে, তার পথ হল একক ও সরল। আরও অনেক পথ আছে। যে ব্যক্তি সে পথসমূহের অনুসরণ করবে, তা তাকে তার সরল পথ থেকে বাধা দিবে’। এর পর তিনি আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর হাদীছ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,

خَطَّ لَنَا رَسُوْلُ اللهِ ﷺ خَطًّا ثُمَّ قَالَ هَذَا سَبِيْلُ اللهِ ثُمَّ خَطَّ خُطُوْطًا عَنْ يَمِيْنِهِ وَعَنْ شِمَالِهِ وَقَالَ هَذِهِ سُبُلٌ عَلَى كُلِّ سَبِيْلٍ مِنْهَا شَيْطَانٌ يَدْعُوْ إِلَيْهِ وَقَرَأَ : وَ  اَنَّ  ہٰذَا صِرَاطِیۡ مُسۡتَقِیۡمًا فَاتَّبِعُوۡہُ ۚ وَ لَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ  فَتَفَرَّقَ  بِکُمۡ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ.

‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিকট একটি রেখা টানলেন। অতঃপর তিনি বললেন, ‘এটি আল্লাহর সরল পথ’। অতঃপর ঐ রেখার ডানে ও বামে অনেকগুলো রেখা টেনে বললেন, ‘এগুলো বিভিন্ন পথ। এই পথগুলোর প্রত্যেটির উপর একটি করে শয়তান আছে, যে ঐ পথের প্রতি মানুষকে আহ্বান করে’। অতঃপর তিনি আল্লাহ তা‘আলার এই বাণী পাঠ করলেন, وَ  اَنَّ  ہٰذَا صِرَاطِیۡ مُسۡتَقِیۡمًا فَاتَّبِعُوۡہُ ۚ وَ لَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ  فَتَفَرَّقَ  بِکُمۡ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ ‘নিশ্চয় এটি আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ কর এবং বিভিন্ন পথের অনুসরণ করো না। করলে তা তোমাদেরকে তার পথ হতে বিচ্ছিন্ন করবে’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৫৩)।[৫] অতঃপর আল-মাওয়ারযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘সুতরাং আল্লাহ অতঃপর তাঁর রাসূল (ﷺ) আমাদেরকে নব রচিত কর্মাবলী এবং মনের খেয়ালখুশির অনুসরণ থেকে সতর্ক করেছেন, যা আল্লাহর নির্দেশ ও তাঁর নবীর তরীকা অনুসরণ করা থেকে বাধাগ্রস্ত করে’।[৬] অতএব যে ব্যক্তি নবুঅতের আদর্শের অনুবর্তী হবে, সে ব্যক্তি শয়তানের পথসমূহের এবং তার ভ্রষ্টকারী রাস্তাসমূহের ফাঁদে ফেঁসে যাওয়া হতে নিরাপত্তা লাভ করবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মুমিনদের পথ তথা সালাফদের পথ এড়িয়ে চলবে, সে ব্যক্তি শয়তানের রশিতে আবদ্ধ হয়ে যাবে।

ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘যখন লোকেরা কিতাব ও সুন্নাহকে জীবন-বিধান বানানো হতে এবং উভয়ের কাছে বিচার-ফায়সালা নিতে বিমুখ হল, বরং তা যথেষ্ট নয় বলে ধারণা করল এবং রায়, কিয়াস, ইসতিহসান তথা ভালো মনে করে কোন কাজ করল ও বুযুর্গদের উক্তির দিকে ফিরে গেল, তখন এর ফলে তাদের প্রকৃতিতে বিকৃতি, তাদের হৃদয়ে অন্ধকার, তাদের বুঝে আবিলতা এবং তাদের বিবেক-বুদ্ধিতে বিলুপ্তি প্রকাশ পেল। তাদের মাঝে এ সকল বিপত্তি ব্যাপক আকার ধারণ করল। তাদের ওপর এমন আধিপত্য লাভ করল যে, তারই মাঝে ছোটরা বড় হল এবং বড়রা বুড়ো হল। যার ফলে তারা সেগুলোকে আপত্তিকর মনেই করল না। অতঃপর তাদের ওপর এল অন্য এক সা¤্রাজ্য। যাতে সুন্নাহর জায়গায় বিদ‘আত, বিবেক-বুদ্ধির জায়গায় আবেগ, বুদ্ধিমত্তার জায়গায় খেয়ালখুশি, হেদায়াতের জায়গায় ভ্রষ্টতা, সৎকর্মের জায়গায় অসৎকর্ম, জ্ঞানের জায়গায় অজ্ঞতা, ইখলাছের জায়গায় রিয়া বা লোকপ্রদর্শন, হকের জায়গায় বাতিল, সত্যের জায়গায় মিথ্যা, উপদেশের জায়গায় চাটুকারিতা এবং ন্যায়ের জায়গায় অন্যায় দখল গ্রহণ করল। অনিবার্যরূপে এ সকল বিষয়ের জন্য সা¤্রাজ্য ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠালাভ করল এবং তার অধিবাসীরাই হল বিখ্যাত। অথচ ইতিপূর্বে উক্ত সকল বিষয় ছিল তার বিপরীতের জায়গায়। আর তার অধিবাসীরাই ছিল বিখ্যাত। সুতরাং তুমি যখন দেখবে যে, উক্ত সকল বিষয়ের সা¤্রাজ্য আগত হয়েছে, তার পতাকা স্থাপিত হয়েছে এবং তার সৈন্যদল সওয়ারী গ্রহণ করেছে, তখন তোমার জন্য আল্লাহর কসম! মাটির উপরের অংশের চেয়ে ভিতরের অংশই শ্রেষ্ঠ তথা বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো, সমভূমির চেয়ে পর্বত-চূড়াই শ্রেষ্ঠ এবং মানুষের সংসর্গে থাকার চেয়ে হিং¯্র প্রাণীদের সংসর্গে থাকাটাই বেশি নিরাপদ’।[৭]

৫- অনুগামীর প্রাপ্ত নেকীর অংশ লাভ

যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদর্শ ও তাঁর সাহাবীগণের আদর্শ তথা সালাফে ছালিহীনের আদর্শকে জীবিত করবে, লোকেদের মাঝে তা প্রচার করবে এবং অন্যরা যত তার অনুসরণ করবে। সে তার ছওয়াব পাবে কিন্তু আমলকারীর ছাওয়াবের কিছু পরিমাণও কম করা হবে না। সালাফী মানহাজের অনুসরণ ব্যতীত এরূপ সম্ভব নয়। জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

مَنْ سَنَّ فِى الإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَهُ أَجْرُهَا وَأَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا بَعْدَهُ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَىْءٌ.

‘যে ব্যক্তি ইসলামে ভাল রীতি চালু করবে, সে তার নিজের এবং ঐ সমস্ত লোকের ছওয়াব পাবে, যারা তার (মৃত্যুর) পর তার উপর আমল করবে। তাদের ছওয়াবের কিছু পরিমাণও কম করা হবে না’।[৮]

৬- ইহ ও পরকালে সুখ ও সম্মৃদ্ধি লাভ

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশের অনুসরণকারীরাই মূলত প্রকৃত সুখ ও সম্মৃদ্ধি লাভে ধন্য। আর প্রকৃত সালাফী মানহাজের অনুসারীরাই মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশ পালনকারী। পক্ষান্তরে নির্দেশ থেকে বিমুখ ব্যক্তি সুখী নয়। তার ব্যাপারে ধমক দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَنۡ اَعۡرَضَ عَنۡ ذِکۡرِیۡ فَاِنَّ لَہٗ مَعِیۡشَۃً ضَنۡکًا وَّ نَحۡشُرُہٗ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ  اَعۡمٰی  ‘যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হবে, অবশ্যই তার হবে সংকীর্ণময় জীবন এবং আমরা তাকে কিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব’ (সূরা ত্বো-হা : ১২৪)।

প্রশ্ন হতে পারে- সালাফী মানহাজের অবলম্বনকারী কি বিমুখ, না-কি অনুসারী? উত্তর হল- অবশ্যই সালাফী মানহাজের অবলম্বনকারী অনুসারী, বিমুখ নয়। যেহেতু সে নিজ প্রতিপালককে স্মরণকারী ও তাঁর নবী (ﷺ)-কে অনুসরণকারী। আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তার জন্যই তো স্থায়ী নে‘মত ও ব্যাপক ছাওয়াবের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেন,

تِلۡکَ حُدُوۡدُ اللّٰہِ ؕ وَ مَنۡ یُّطِعِ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ یُدۡخِلۡہُ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا ؕ وَ ذٰلِکَ الۡفَوۡزُ  الۡعَظِیۡمُ .

‘এসব আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। আর যে আল্লাহ ও রাসূলের অনুগত হয়ে চলবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে স্থান দান করবেন; যার নিচে নদীসমূহ প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে এবং এটা মহা সাফল্য’ (সূরা আন-নিসা : ১৩)। তিনি আরো বলেছেন,

فَاِنۡ تَنَازَعۡتُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ فَرُدُّوۡہُ اِلَی اللّٰہِ وَ الرَّسُوۡلِ  اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ ذٰلِکَ خَیۡرٌ  وَّ  اَحۡسَنُ  تَاۡوِیۡلًا.

‘যদি তোমরা আল্লাহ তা‘আলা ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান আনয়ন কর, তাহলে কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে, সে বিষয়কে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। এটিই হল উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর’ (সূরা আন-নিসা : ৫৯)। উক্ত আয়াতের পাদটীকায় ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘এ আয়াত এই কথার দলীল যে, আল্লাহর আনুগত্য করা, তার রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্য করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে বিচারক মান্য করা, চাই তা বিলম্বে হোক কিংবা অবিলম্বের হোক; তার ফলাফল হল সুখ ও সমৃদ্ধি লাভ। আর যে ব্যক্তি বিশ্বসংসার ও তার মাঝে সংঘটিত মন্দসমূহ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে, সে জানতে পারবে যে, প্রত্যেক মন্দের কারণ হল, রাসূল (ﷺ)-এর বিরুদ্ধাচরণ করা এবং তাঁর আনুগত্য থেকে বের হয়ে যাওয়া। পক্ষান্তরে ইহকালের প্রত্যেক কল্যাণের কারণ হল, নবী করীম (ﷺ)-এর আনুগত্য। অনুরূপভাবে পরকালের অকল্যাণসমূহ, তার কষ্টরাজি ও শাস্তিসমূহের মৌলিক কারণ হল নবী করীম (ﷺ)-এর বিরুদ্ধাচরণ’।[৯]

উল্লেখ্য, আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর অনুসরণের ক্ষেত্রে সালাফী মানহাজের অনুসারীরাই অগ্রগণ। ফলে দুনিয়াতে তারা যেমন আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত নে‘মত ও সার্বিক কল্যাণ ও নিরাপত্তা বলয়ে জীবন-যাপন করে, তেমনি পরকালে চিরস্তায়ী সুখ ও শান্তির স্থান জান্নাত লাভে ধন্য হবে।

আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মুসলিমকে সালাফী মানহাজ সম্পর্কে সঠিকটা বুঝা ও তা পূর্ণাঙ্গরূপে অনুসরণের তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!


* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আল-ইসলামিয়্যাহ, খড়খড়ি, রাজশাহী।

[১]. আল-মুসতাদরাক আলাছ ছহীহাইন, হা/৩১৮, সনদ হাসান।

[২]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৩৯১।

[৩]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭, সনদ ছহীহ।

[৪]. শারহুস সুন্নাহ, ১ম খ-, পৃ. ২০৬।

[৫]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৪১৪২; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৬; মিশকাত, হা/১৬৬, সনদ হাসান।

[৬]. আস-সুন্নাহ, পৃ. ৯৯।

[৭]. আল-ফাওয়াইদ, পৃ. ৪৭।

[৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০১৭।

[৯]. আর-রিসালাতুত তাবুকিয়্যাহ, পৃ. ৭৫-৭৬।




প্রসঙ্গসমূহ »: সালাফে ছালেহীন
ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল ক্বাদির
তওবার গুরুত্ব ও ফযীলত - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
হজ্জ ও ওমরার সঠিক পদ্ধতি - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতিবন্ধকতা ও তার সমাধান - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ছালাতের সঠিক সময় ও বিভ্রান্তি নিরসন (২য় কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (২১তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামী জামা‘আতের মূল স্তম্ভ (৫ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায় (৮ম কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
মাহে রামাযানে শিশু-কিশোর প্রতিপালন - আব্দুর রশীদ
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১৯তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
যুলমের পরিচয় ও পরিণাম - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর আগমন সংশয় নিরসন (৮ম কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী

ফেসবুক পেজ