রামাযান : কুরআন নাযিলের মাস
-ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন বিশ্ব মানবতার চিরন্তন সংবিধান। মানব জাতির সার্বিক কল্যাণের সর্বশ্রেষ্ঠ পথনির্দেশিকা। অভ্রান্ত সত্যের চুড়ান্ত মাপকাঠি। পৃথিবীর ইতিহাসে আল-কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ, যেখানে সন্দেহের লেশমাত্র নেই। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এটা ঐ গ্রন্থ যার মধ্যে কোনরূপ সন্দেহ নেই’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২)। সামনে-পিছনে, ডানে-বামে তথা কোনদিক থেকে তাতে মিথ্যা প্রবেশের কোনই সুযোগ নেই। এরশাদ হচ্ছে, ‘মিথ্যা এর নিকটে সামনে না পিছনে কোন দিক দিয়ে আসতে পারে না। ইহা অবতীর্ণ হয়েছে মহাজ্ঞানী, সকল প্রশংসার যোগ্য আল্লাহ্র পক্ষ থেকে’ (আল-ফুছছিলাত : ৪২)। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, ‘সততা ও ইনসাফের দিক দিয়ে আপনার প্রতিপালকের বাণী (আল-কুরআন) পরিপূর্ণ। তাঁর বাণী পরিবর্তন করার সাধ্য কারোর নেই। আর তিনি হলেন সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (সূরা আল-আন‘আম : ১১৫)। *
কুরআন মাজীদ সরাসরি আল্লাহ্র কালাম বা বাণী। এটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মু‘জেযাও বটে। ইহা নিয়মিত তেলাওয়াত করে অফুরন্ত প্রতিদানের অধিকারী হওয়া সম্ভব। ইহা তেলাওয়াত, শ্রবণ, শিক্ষা করা, অপরকে শিক্ষা দেয়া, আমল করা এমনকি এর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করলেও নেকী পাওয়া যায়। যা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কুরআনের শিক্ষা সমাজ জীবনে প্রয়োগ করলে ঐ সমাজ শান্তি-শৃঙ্খলার মডেল হতে বাধ্য। এই মহিমান্বিত গ্রন্থ কুরআন মাজীদ অবতীর্ণ হয়েছে রামাযান মাসে। ছিয়াম পালন ও কুরআন নাযিলের মাস হিসাবে রামাযান এক মহিমান্বিত মর্যাদাপূর্ণ মাস।
কুরআনের অর্থ
আভিধানিক অর্থে- কুরআন (القرأن) শব্দটি আরবী, যা ক্বরয়ুন (قَرْءٌ) মূলধাতু থেকে উদ্ভূত। তখন ইসমে মাফঊল (إسم مفعول) হিসাবে এর অর্থ দাঁড়ায় পঠিত, যা পড়া হয়। আর কুরআন (قُرْأنٌ) শব্দটি (فَعْلٌ) ফা‘লুন এর ওযনে (قَرْنٌ) ক্বারনুন মূলধাতু থেকে উৎকলিত হলে অর্থ হয় সন্নিবেশিত, মিলিত।[১] আর পারিভাষিক অর্থে-
هو كلام اللّه المعجز المنزّل على النّبي محمد ﷺ باللفظ العربي المكتوب في المصاحف المتعبّد بتلاوته المنقول بالتواتر المبدوء بسورة الفاتحة المختوم بسورة الناس
‘কুরআন আল্লাহ্র চিরন্তন বাণী, যা নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর আরবী ভাষায় নাযিল করা হয়েছে, মাছহাফে যা লিপিবদ্ধ, যার তেলাওয়াত ইবাদত এবং বর্ণনা মুতাওয়াতির পর্যায়ের, যা বর্ণনাকৃত এবং যার শুরু সূরা আল-ফাতিহা ও শেষ সূরা আন-নাস দ্বারা’।[২]
রামাযান কুরআন নাযিলের মাস
মহান আল্লাহ পবিত্র রামাযান মাসে কুরআনুল কারীম নাযিল করেন। বিধায় এমাসে কুরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব-মর্যাদাও অনেক বেশী। এমর্মে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ
‘রামাযান মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন। যা মানুষের হেদায়াত এবং সৎপথের সুস্পষ্ট নির্দেশ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। সুতরাং যে ব্যক্তি রামাযান মাস পায় সে যেন ছিয়াম পালন করে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৫)। আর অন্যত্র তিনি বলেন, إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِيْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ ‘আমি তা নাযিল করেছি ক্বদরের রাতে’ (সূরা আল-ক্বদর : ১)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ‘নিশ্চয় আমি ইহা নাযিল করেছি এক বরকতময় রাত্রিতে; নিশ্চয় আমরা সতর্ককারী’ (সূরা আদ-দুখান : ৪)। আর বরকতময় রাত্রি হচ্ছে কদরের রাত্রি। যা রামাযান মাসেই সংঘটিত হয়ে থাকে। যেমন কদরের রাত সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘কদরের রাত্রি হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ’ (সূরা আল-ক্বদর : ৩)। আর দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, লায়লাতুল ক্বদর কেবলমাত্র রামাযান মাসেই হয়েই থাকে। এ কারণেই রামাযান সর্বাধিক মহিমান্বিত মাস।
নুযূলে কুরআন শুরু হয় হেরা গুহায় ২১ রামাযান সোমবার ক্বদরের রাত্রিতে। প্রথম পাঁচটি আয়াত (সূরা আল-‘আলাক্ব : ১-৫) নাযিল করে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) চলে যান। খৃষ্টীয় হিসাবে এ দিনটি ছিল ৬১০ খৃষ্টাব্দের ১০ই আগষ্ট। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বয়স ছিল চান্দ্রবর্ষ হিসাবে ৪০ বছর ৬ মাস ১২ দিন এবং সৌরবর্ষ হিসাবে ৩৯ বছর ৩ মাস ২২ দিন।[৩]
কুরআনুল কারীমকে একই সাথে প্রথম আকাশের উপরে রামাযান মাসের ক্বদরের রাতে অবতীর্ণ করা হয় এবং ঐ রাতকে বরকতময় রাতও বলা হয়।[৪] ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘আল্লাহ কুরআনকে ক্বদরের রাতে দুনিয়ার আসমানে একসাথে নাযিল করেন। অতঃপর তাঁর রাসূলের নিকট একের পর এক নাযিল করেন’।[৫] জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (মৃ. ৯১১ হি.) বলেন, ‘আল্লাহ কুরআনকে একসাথে ক্বদরের রাতে দুনিয়ার আসমানে নাযিল করেন। অতঃপর পর্যায়ক্রমে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নবুঅত প্রাপ্তির পরে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট অনুপাতে তা দুনিয়ায় নাযিল করেন’।[৬]
কুরআন নাযিলের পটভুমি
কুরআন নাযিলের বছরে রবীউল আউয়াল মাস থেকে রাসূল (ﷺ) সত্যস্বপ্ন দেখতে থাকেন। ছ’মাস পর রামাযান মাসে তিনি হেরা গুহাতে ই‘তিকাফ করেন। অতঃপর শেষ দশকে ক্বদর রাতে কুরআন নাযিলের সূচনা হয়। যা তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ২৩ বছরে শেষ হয়। এজন্য তাঁর সত্য স্বপ্নকে নবুঅতের ৪৬ ভাগের একভাগ বলা হয়’।[৭]
হাদীছে এসেছে, প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ঘুমন্ত অবস্থায় সত্যস্বপ্নের মাধ্যমে ‘অহী’ নাযিলের সূচনা হয়। স্বপ্নে তিনি যা দেখতেন, প্রভাত সূর্যের মত তা সত্য হয়ে দেখা দিত। এরপর তাঁর মধ্যে নিঃসঙ্গপ্রিয়তা দেখা দেয়। তখন তিনি হেরা গুহায় গিয়ে রাত কাটাতে থাকেন। তিনি একত্রে কয়েকদিনের খাদ্য সাথে নিয়ে যেতেন। ফুরিয়ে গেলে খাদীজার কাছে ফিরে এসে আবার খাদ্য নিয়ে যেতেন। এইভাবে একরাতে তাঁর নিকটে হেরা গুহাতে সত্য এসে হাযির হল। ফেরেশতা তাঁকে বলল, তুমি পড়। রাসূল (ﷺ) বললেন,مَا أَنَا بِقَارِئٍ ‘আমি পড়তে জানি না’। রাসূল (ﷺ) বলেন, তখন ফেরেশতা আমাকে বুকে ধরে জোরে চাপ দিল। তাতে আমি হাঁপিয়ে উঠলাম। তখন বলল, ‘পড়’। বললাম, ‘পড়তে জানি না’। এবার দ্বিতীয়বার চাপ দিয়ে বলল ‘পড়’। বললাম, পড়তে জানি না। অতঃপর তৃতীয়বার চাপ দিয়ে বলল, اِقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ الَّذِیۡ خَلَقَ ‘পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’- এখান থেকে পরপর পাঁচটি আয়াত। রাসূল (ﷺ) পাঠ করলেন। তারপর ফেরেশতা চলে গেল এবং রাসূল (ﷺ) বাড়ীতে ফিরে এলেন। এ সময় ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তিনি খাদীজাকে বললেন, زَمِّلُوْنِىْ زَمِّلُوْنِىْ ‘আমাকে চাদর মুড়ি দাও! আমাকে চাদর মুড়ি দাও’। অতঃপর চাদর মুড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ থাকার পর তিনি বললেন, يَا خَدِيْجَةُ مَا لِىْ ‘খাদীজা আমার কি হ’ল’? তারপর তিনি সব খুলে বললেন এবং শেষে বললেন, قَدْ خَشِيْتُ عَلَىَّ ‘আমি মৃত্যুর আশংকা করছি’। তখন খাদীজা দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
كَلَّا أَبْشِرْ فَوَاللهِ لا يُخْزِيْكَ اللهُ أَبَدًا، فَوَاللهِ إِنَّكَ لَتَصِلُ الرَّحِمَ وَتَصْدُقُ الْحَدِيْثَ وَتَحْمِلُ الْكَلَّ وَتَكْسِبُ الْمَعْدُوْمَ وَتَقْرِى الضَّيْفَ وَتُعِيْنُ عَلَى نَوَائِبِ الْحَقِّ
‘কখনোই না। সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহর কসম! আল্লাহ কখনোই আপনাকে লজ্জিত করবেন না। নিশ্চয়ই আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেন, সত্য কথা বলেন, গরীবের বোঝা বহন করেন, নিঃস্বদের কর্মসংস্থান করেন, অতিথি সেবা করেন এবং বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করেন’। অতঃপর খাদীজা তাঁকে নিয়ে চাচাতো ভাই ওয়ারাক্বা বিন নওফেলের কাছে গেলেন। যিনি জাহেলী যুগে ‘নাছারা’ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আরবী লিখতে পারতেন এবং ইনজীল থেকে আরবী করতেন। তিনি অতি বার্ধক্যে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদীজা তাকে বললেন, ভাই দেখুন আপনার ভাতিজা কি বলছেন। ওয়ারাক্বা বললেন, বল ভাতিজা, কি দেখেছ? তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে সব খুলে বললেন, যা তিনি দেখেছেন। জওয়াবে ওয়ারাক্বা বললেন,
هَذَا النَّامُوْسُ الَّذِىْ أُنْزِلَ عَلَى مُوْسَى، يَا لَيْتَنِىْ فِيْهَا جَذَعًا يَا لَيْتَنِىْ أَكُوْنُ حَيًّا حِيْنَ يُخْرِجُكَ قَوْمُكَ
‘এতো সেই ফেরেশতা যিনি মূসার উপর অবতীর্ণ হয়েছিলেন। হায়! যদি আমি সেদিন যুবক থাকতাম। হায়! যদি আমি সেদিন জীবিত থাকতাম। যেদিন তোমার সম্প্রদায় তোমাকে বহিষ্কার করবে’। একথা শুনে রাসূল (ﷺ) বলে উঠলেন أَوَمُخْرِجِىَّ هُمْ ؟ ‘ওরা কি আমাকে বের করে দেবে?’ ওয়ারাক্বা বললেন, نَعم، لَمْ يَأْتِ رَجُلٌ قَطُّ بِمِثْلِ مَا جِئْتَ بِهِ إِلَّا عُوْدِىَ ‘হ্যাঁ! তুমি যা নিয়ে আগমন করেছ, তা নিয়ে ইতিপূর্বে এমন কেউ আগমন করেননি, যার সাথে শত্রুতা করা হয়নি’। ছহীহ বুখারীর একটি বর্ণনায় إِلَّا أُوْذِىَ ‘যিনি নির্যাতিত হননি’ এসেছে।[৮] অতঃপর তিনি বললেন, إِنْ يُدْرِكْنِىْ يَوْمُكَ أَنْصُرْكَ نَصْرًا مُؤَزَّرًا ‘যদি তোমার সেই দিন আমি পাই, তবে আমি তোমাকে যথাযোগ্য সাহায্য করব’।
এর কিছু দিনের মধ্যেই ওয়ারাক্বা মৃত্যুবরণ করেন। এ সময় ‘অহী’ নাযিল বন্ধ হয়ে যায়। যাতে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি বারবার পাহাড়ের চূড়ার দিকে তাকাতে থাকেন ফেরেশতাকে দেখার আশায়। হঠাৎ একদিন জিবরীল তাঁর সামনে স্বরূপে প্রকাশিত হলেন এবং বললেন, يَا مُحَمَّدُ إِنَّكَ رَسُوْلُ اللهِ حَقَّا ‘হে মুহাম্মাদ (ﷺ)! অবশ্যই আপনি নিশ্চিতভাবে আল্লাহর রাসূল’। একথা শোনার পরে তাঁর অস্থিরতা দূর হয়ে গেল এবং হৃদয় ঠা-া হয়ে গেল। তিনি ফিরে এলেন এবং এরপর থেকে কিছু দিন অহীর আগমন বন্ধ রইল। একদিন তিনি রাস্তায় চলা অবস্থায় একটি আওয়ায শুনে উপরদিকে তাকিয়ে জিবরীলকে আবির্ভূত হতে দেখেন, যেভাবে তিনি তাকে হেরা গুহায় দেখেছিলেন। এদিন তিনি তাকে আকাশ ও পৃথিবীব্যাপী চেয়ারের উপর বসা অবস্থায় দেখে ভীত হয়ে পড়েন এবং বাড়ীতে এসে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন। তখন সূরা মুদ্দাছছির নাযিল হয়। এরপর থেকে অহী নাযিল চলতে থাকে (তাফসীর ইবনু কাছীর)।[৯]
অধিক কুরআন তেলাওয়াতের মাস রামাযান
সর্বাধিক কুরআন তেলাওয়াতের মাস রামাযান। প্রত্যেক রামাযানে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে কুরআন মাজীদ শুনাতেন। তাই তিনিও এ মাসে অধিক হারে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। এমর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ كَانَ النَّبِىُّ ﷺ أَجْوَدَ النَّاسِ بِالْخَيْرِ وَأَجْوَدُ مَا يَكُوْنُ فِىْ شَهْرِ رَمَضَانَ لِأَنَّ جِبْرِيْلَ كَانَ يَلْقَاهُ فِىْ كُلِّ لَيْلَةٍ فِىْ شَهْرِ رَمَضَانَ حَتَّى يَنْسَلِخَ يَعْرِضُ عَلَيْهِ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ الْقُرْآنَ فَإِذَا لَقِيَهُ جِبْرِيْلُ كَانَ أَجْوَدَ بِالْخَيْرِ مِنَ الرِّيْحِ الْمُرْسَلَةِ
ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অধিক দানশীল ছিলেন। যখন জিবরীল (আলাইহিস সালাম) রামাযানে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন, তখন তিনি আরও বেশি দান করতেন। কারণ রামাযানের প্রতি রাতে তিনি জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-এর নিকট কুরআন তেলাওয়াত করতেন এবং প্রবাহিত বাতাসের ন্যায় অধিকহারে দান করতেন।[১০]
আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ) রহমতের বায়ু অপেক্ষাও অধিক দানশীল ছিলেন। অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
أَنَّ جِبْرِيْلَ كَانَ يُعَارِضُهُ بِالْقُرْآنِ كُلَّ سَنَةٍ مَرَّةً وَإِنَّهُ قَدْ عَارَضَنِىْ بِهِ الْعَامَ مَرَّتَيْنِ
‘নিশ্চয় জিবরীল (আলাইহিস সালাম) প্রত্যেক বছর রামাযানের রাত্রিতে আমার কাছে পুনরাবৃত্তি করতেন। আর এই বছর তিনি দু’বার কুরআন পুনরাবৃত্তি করেছেন’।[১১] অপর হাদীছে ্এসেছে,
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ ﷺ قَالَ كَانَ يَعْرِضُ عَلَى النَّبِىِّ ﷺ الْقُرْآنَ كُلَّ عَامٍ مَرَّةً فَعَرَضَ عَلَيْهِ مَرَّتَيْنِ فِى الْعَامِ الَّذِىْ قُبِضَ
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘প্রতি বছর জিবরীল নবী করীম (ﷺ)-এর সঙ্গে একবার কুরআন মাজীদ শোনতেন ও শোনাতেন। কিন্তু যে বছর তার ওফাত হয়, সে বছর তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দু’বার শুনিয়েছেন’।[১২]
রামাযান মাসে কুরআন নাযিল হয়। আর এই রামাযানেই পুরো কুরআন মাজীদ জিবরীল নবী করীম (ﷺ)-কে শোনতেন ও শোনাতেন। ফলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও ছাহাবীগণ এ মাসে অধিকহারে কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করতেন। তাই আমাদের প্রত্যেক রামাযান মাসে বেশি বেশি কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করা উচিত।
ছিয়াম ও কুরআনের নিবীড় সম্পর্ক
রামাযানের ছিয়াম ও কুরআন মাজীদের মধ্যে নিবীড় সম্পর্ক। এ দু‘টির কারণেই রামাযান এতো অধিক ফযীলতপূর্ণ মাস। ক্বিয়ামতের দিন সুপারিশের ব্যাপারেও তারা একে অপরের পরিপূরক। কারণ রামাযানের ছিয়াম ক্বিয়ামতের ভয়াবহ মুহূর্তে ছিয়াম পালনকারী বান্দার জন্য যেমন সুপারিশ করবে, তেমনি কুরআনও তার পাঠকের জন্য সুপারিশ করবে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ الصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَقُوْلُ الصِّيَامُ أَيْ رَبِّ إِنِّيْ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِيْ فِيْهِ وَيَقُوْلُ الْقُرْآنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِيْ فِيْهِ فَيُشَفَّعَانِ
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ছিয়াম এবং ক্রুআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। ছিয়াম বলবে, হে প্রভু! আমি আপনার বান্দাকে দিনের বেলায় যাবতীয় পানাহার ও প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতে ঘুম হতে বিরত রেখেছি, তাই তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। অতঃপর দু’জনের সুপারিশ কবুল করা হবে।[১৩]
عَنْ جَابِرٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ الْقُرْآنُ شَافِعٌ مُشَفَّعٌ ومَاحِلٌ مُصَدَّقٌ فَمَنْ جَعَلَهُ إِمَامًا قَادَهُ إِلَى الْجَنَّةِ وَمَنْ جَعَلَهُ خَلْفَهُ سَاقُهُ إِلَى النَّارِ
জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কর্তৃক বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘এই কুরআন (ক্বিয়ামতে) সুপারিশকারী; তার সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হবে। (কুরআন) সত্যায়িত প্রতিবাদী। যে ব্যক্তি তাকে নিজের সামনে রাখবে, সে ব্যক্তিকে সে জান্নাতের প্রতি পথ প্রদর্শন করে নিয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি তাকে পিছনে রাখবে, সে ব্যক্তিকে সে জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করবে’।[১৪]
সুধী পাঠক! এ কথা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত যে, রামাযান মাসের বরকতপূর্ণ মহিমান্বিত লায়লাতুল কদরে কুরআন মাজীদ অবতীর্ণ হয়েছে। তাই রামাযান মাসেই অধিকহারে কুরআন তেলাওয়াত করতে হয়। আর রামাযান মাসের ক্বদরের রাতে নাযিল হওয়ার কারণে এ রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদতে মশগুল থাকতে হয়। প্রথমত : কুরআন নাযিলের মাস হিসাবেই রামাযান অধিক ফযীলতপূর্ণ মাস। দ্বিতীয়ত : লায়লাতুল ক্বদরে কুরআন নাযিল হওয়ার কারণেই এ রাতগুলো সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ রজনী।
পরিশেষে বলা যায় কুরআন মাজীদ বান্দার জন্য নে‘মত স্বরূপ। যা মহিমান্বিত রামাযান মাসে নাযিল করা হয়েছে। আর তা তেলাওয়াত করা, শ্রবণ করা, ভালোবাসা ও আমল করার মধ্যে বহুবিধ কল্যাণ ও ছওয়াব রয়েছে। ইহকালে সমৃদ্ধি ও পরকালে সুখি জীবন-যাপনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এমর্মে হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ شُرَيْحٍ الْخُزَاعِيِّ قَالَ خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُوْلُ اللهِ ﷺ فَقَالَ أَبْشِرُوْا أَبْشِرُوْا أَلَيْسَ تَشْهَدُوْنَ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَإِنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ قَالُوْا نَعَمْ قَالَ فَإِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ سَبَبُ طَرْفِهِ بِيَدِ اللهِ وَطَرْفُهُ بِأَيْدِيْكُمْ فَتَمَسَّكُوْا بِهِ فَإِنَّكُمْ لَنْ تَضِلُّوا وَلَنْ تَهْلِكُوْا بَعْدَهُ أَبَدًا
আবূ শুরায়হ আল-খুযাঈ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বের হলেন এবং বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর, সুসংবাদ গ্রহণ কর, আচ্ছা তোমরা কি একথার সাক্ষী দাও না যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন সত্য মা‘বূদ নেই এবং আমি আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ)? ছাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই। অতঃপর বললেন, নিশ্চয় এই কুরআন এমন একটি রজ্জু, যার এক দিক আল্লাহ্র হাতে আর অন্য দিক তোমাদের হাতে। অতএব তোমরা এটা শক্তভাবে ধর। কেননা কুরআনকে আঁকড়ে ধরার পর তোমরা কখনো গোমরাহ হবে না, ধ্বংসও হবে না।[১৫]
* পরিচালক, ইয়াসিন আলী সালাফী মাদরাসা, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র :
[১]. ফাতাওয়া শাবাকাতুল ইসলামিয়া, প্রশ্ন নং-১৪৬৫১; মা‘আনাল কুরআন লুগাহ, ৩য় খ-, পৃ. ২৫৫২।
[২]. ড. ওয়াবাহ ইবনু মুছত্বফা আয-যুহাইলী, তাফসীরুল মুনীর ফিল আক্বীদাতি ওয়াশ শারী‘আতি ওয়াল মানহাজ (দারুল ফিকর মা‘আছির, দ্বিতীয় মুদ্রণ ১৪১৮ হি.), ১ম খ-, পৃ. ১৩।
[৩]. ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ৬৬-৬৭, টীকাসহ আলোচনা দ্রষ্টব্য; তাফসীরুল কুরআন, ৩০তম পারা, পৃ. ৩৬৮।
[৪]. তাফসীর ইবনু কাছীর, ১ম খ-, সূরা বাক্বারাহ-এর ১৮৫-নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[৫]. মুসতাদরাক আলাছ ছহীহাঈন লিল হাকিম মা‘আ তালিকাতিয যাহাবী, ২য় খ-, পৃ. ৫৭৮।
[৬]. জালালুদ্দীন আবুবাকর আস-সুয়ূত্বী, আল-ইতক্বান, ১ম খ-, পৃ. ৮৯।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৯৮৯; ছহীহ মুসলিম, হা/২২৬৩।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৫৩।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৪; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬১; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬০০১; মিশকাত, হা/৫৮৪১-৪৩ ‘অহীর সূচনা’ অনুচ্ছেদ।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯০২; নাসাঈ, হা/২০৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৪২৫; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৩৪৪০; মিশকাত, হা/২০৯৮।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৬২৮৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬৪৫৬; কানযুল উম্মাল, হা/৩৭৭৩২; ছহীহুল জামে‘, হা/১৭২৬৩; মিশকাত, হা/৬১২৯।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৯৮; ইবনু মাজাহ, হা/১৭৬৯; মিশকাত, হা/২০৯৯।
[১৩]. বায়হাক্বী-শু‘আবুল ঈমান, হা/১৮৩৯; হাকেম, হা/২০৩৬; মিশকাত, হা/১৯৬৩; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৪২৯, সনদ ছহীহ।
[১৪]. ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/১২৪; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/১৮৫৫; ত্বাবারাণী কাবীর, হা/৮৬৫৫; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, হা/৩০৬৭৭; কানযুল উম্মাল, হা/২৩০৬; ছহীহ আত-তারগীব, হা/১৪২৩; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২০১৯, সনদ ছহীহ।
[১৫]. ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/১২২; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/২০১৩; মুছান্নাফে ইবনু আবী শায়বা, হা/৩০৬২৮; আল-মুসনাদুল জামে‘, হা/১২৪৭২; ছহীহুল জামে‘, হা/৩৪; ছহীহ আত-তারগীব, হা/৩৮; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৭১৩, সনদ ছহীহ।
প্রসঙ্গসমূহ »:
কুরআনুল কারীম