ফাযায়েলে কুরআন
-আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম*
(৩য় কিস্তি)
আল-কুরআনের নাম ও ছিফাতসমূহ
অনেক ‘আলিম আল-কুরআনের অসংখ্য নামের কথা উল্লেখ করেছেন। কেউ ৫৫টি, আবার কেউ ৯০-এর অধিক। তবে ঐ সকল ‘আলিম কুরআনের ছিফাত (গুণবাচক নাম) কেও তার নাম হিসাবে গণনা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে আল-কুরআনের নাম ৪টি। সালাফে ছালেহীন কুরআনের চারটি নাম উল্লেখ করেছেন।[১]
১). (اَلْقُرَانُ) আল-কুরআন : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قٓ وَ الۡقُرۡاٰنِ الۡمَجِیۡدِ ‘ক্বা’ফ, শপথ কুরআন মাজীদের’ (সূরা ক্বা’ফ : ১)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اَفَلَا یَتَدَبَّرُوۡنَ الۡقُرۡاٰنَ وَ لَوۡ کَانَ مِنۡ عِنۡدِ غَیۡرِ اللّٰہِ لَوَجَدُوۡا فِیۡہِ اخۡتِلَافًا کَثِیۡرًا ‘তারা কেন কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না? আর যদি ওটা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও নিকট হতে হত তবে তারা ওতে বহু গরমিল পেত’ (সূরা আন- নিসা : ৮২)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّ ہٰذَا الۡقُرۡاٰنَ یَہۡدِیۡ لِلَّتِیۡ ہِیَ اَقۡوَمُ وَ یُبَشِّرُ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ الَّذِیۡنَ یَعۡمَلُوۡنَ الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَہُمۡ اَجۡرًا کَبِیۡرًا
‘এ কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ পথ নির্দেশ করে এবং সৎকর্মপরায়ণ বিশ্বাসীদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৯)। এছাড়াও সূরা আল-মায়েদা : ১০১; আল-আ‘রাফ : ২০৪; ইউসুফ : ৩; আল-হিজর : ৮৭; আন-নাহল : ৯৮; আন-নামল : ৭৬ এ আল্লাহ তা‘আলা কুরআনকে ‘কুরআন’ নামে নামকরণ করেছেন।
২). (اَلْفُرْقَانُ) আল-ফুরক্বান : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, تَبٰرَکَ الَّذِیۡ نَزَّلَ الۡفُرۡقَانَ عَلٰی عَبۡدِہٖ لِیَکُوۡنَ لِلۡعٰلَمِیۡنَ نَذِیۡرَا ‘কত মহান তিনি যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ‘ফুরক্বান’ অবতীর্ণ করেছেন যাতে তিনি বিশ্বজগতের জন্য সতর্ককারী হতে পারেন’ (সূরা আল-ফুরক্বান : ১)।
৩). (اَلْكِتَابُ) আল-কিতাব : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ذٰلِکَ الۡکِتٰبُ لَا رَیۡبَ فِیۡہِ ہُدًی لِّلۡمُتَّقِیۡنَ ‘এটা (কুরআন) সেই কিতাব, যাতে কোন সন্দেহ নেই। এটা মুত্তাকীদের জন্য পথ প্রদর্শক’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَقَدۡ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکُمۡ کِتٰبًا فِیۡہِ ذِکۡرُکُمۡ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ ‘আমরা তো তোমাদের নিকট অবতীর্ণ করেছি কিতাব যাতে আছে তোমাদের জন্য উপদেশ, তবুও কি তোমরা বুঝবে না?’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ১০)।
৪). (اَلْذِّكْرُ) আয-যিকর : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا الذِّکۡرَ وَ اِنَّا لَہٗ لَحٰفِظُوۡنَ ‘আমরাই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমরাই এর সংরক্ষণকারী’ (সূরা আল-হিজর : ৯)।
আল-কুরআনের ছিফাতসমূহ
১). (اَلْحَقُّ) আল-হাক্ব : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ اِذَا قِیۡلَ لَہُمۡ اٰمِنُوۡا بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ قَالُوۡا نُؤۡمِنُ بِمَاۤ اُنۡزِلَ عَلَیۡنَا وَ یَکۡفُرُوۡنَ بِمَا وَرَآءَہٗ وَ ہُوَ الۡحَقُّ مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَہُمۡ
‘এবং যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা বিশ্বাস কর, তখন তারা বলে, যা আমাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে আমরা তার প্রতি বিশ্বাস করি এবং তাছাড়া যা রয়েছে তা তারা অবিশ্বাস করে; অথচ এটা সত্য, তাদের সাথে যা আছে এটা তারই সত্যায়ণকারী’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৯১)।
২). (اَلْبُشْرَى) আল-বুশরা : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُلۡ مَنۡ کَانَ عَدُوًّا لِّجِبۡرِیۡلَ فَاِنَّہٗ نَزَّلَہٗ عَلٰی قَلۡبِکَ بِاِذۡنِ اللّٰہِ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡہِ وَ ہُدًی وَّ بُشۡرٰی لِلۡمُؤۡمِنِیۡنَ
‘আপনি বলুন! যে ব্যক্তি জিবরীলের সাথে শত্রুতা রাখে তিনিই তো সে আল্লাহর হুকুমে এ কুরআনকে তোমার অন্তঃকরণ পর্যন্ত পৌঁছিয়েছেন, যে অবস্থায় তা স্বীয় পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যতা প্রমাণ করছে, পথ দেখাচ্ছে মুমিনদের ও সুসংবাদ দিচ্ছে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৯৭)।
৩). (اَلْبُرْهَانُ) আল-বুরহান, ৪). (اَلْنُّوْرُ) আন-নূর, ৫). (اَلْمُبِيْنُ) আল-মুবীন : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ قَدۡ جَآءَکُمۡ بُرۡہَانٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکُمۡ نُوۡرًا مُّبِیۡنًا ‘হে লোক সকল! তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট প্রত্যক্ষ প্রমাণ এসেছে এবং আমরা তোমাদের প্রতি সমুজ্জ্বল জ্যোতি অবতীর্ণ করেছি’ (সূরা আন-নিসা : ১৭৪)।
৬). (اَلْمُصَدِّقُ) আল-মুছাদ্দিক, ৭). (اَلْمُهَيْمِنُ) আল-মুহাইমিন : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡہِ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ مُہَیۡمِنًا عَلَیۡہِ ‘আর আমরা এ কিতাব (কুরআন)-কে আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি যা হক্বের সাথে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যতা প্রমাণকারী এবং ঐসব কিতাবের সংরক্ষকও’ (সূরা আল-মায়িদা : ৪৮)।
৮). (اَلْمَوْعِظَةُ) আল-মাও‘ইযাহ, ৯). (اَلْشِّفَاءُ) আশ-শিফাঊ, ১০). (اَلْهُدَى) আল-হুদা, ১১). (اَلْرَّحْمَةُ) আর-রহমাহ : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ قَدۡ جَآءَتۡکُمۡ مَّوۡعِظَۃٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ شِفَآءٌ لِّمَا فِی الصُّدُوۡرِ وَ ہُدًی وَّ رَحۡمَۃٌ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ
‘হে মানব জাতি! তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সমাগত হয়েছে এক নসীহত এবং অন্তরসমূহের সকল রোগের আরোগ্যকারী, আর মুমিনদের জন্য পথ প্রদর্শক ও রহমত’ (সূরা ইউনুস : ৫৭)।
১২). (اَلْعَظِيْمُ) আল-‘আযীম : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَقَدۡ اٰتَیۡنٰکَ سَبۡعًا مِّنَ الۡمَثَانِیۡ وَ الۡقُرۡاٰنَ الۡعَظِیۡمَ ‘আমরা আপনাকে দিয়েছি সাত আয়াত (সূরা আল-ফাতিহা), যা পুনঃপুনঃ আবৃত হয় এবং দিয়েছি মহান কুরআন’ (সূরা আল-হিজর : ৮৭)।
১৩). (اَلْحَكِيْمُ) আল-হাকীম : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, یٰسٓ – وَ الۡقُرۡاٰنِ الۡحَکِیۡمِ ‘ইয়াসীন! (শপথ) প্রজ্ঞাময় কুরআনের’ (সূরা ইয়াসীন : ১-২)।
১৪). (اَلْمَجِيْدُ) আল-মাজীদ : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قٓ وَ الۡقُرۡاٰنِ الۡمَجِیۡدِ ‘ক্ব’ফ, শপথ কুরআন মাজীদের’ (সূরা ক্বা’ফ : ১)।
১৫). (اَلْكَرِيْمُ) আল-কারীম, ১৬). (اَلْمَكْنُوْنُ) আল-মাকনূন : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّہٗ لَقُرۡاٰنٌ کَرِیۡمٌ – فِیۡ کِتٰبٍ مَّکۡنُوۡنٍ – لَّا یَمَسُّہٗۤ اِلَّا الۡمُطَہَّرُوۡنَ
‘নিশ্চয় এটা সম্মানিত কুরআন, যা আছে সুরক্ষিত কিতাবে, পুত-পবিত্ররা ব্যতীত অন্য কেউ তা স্পর্শ করে না’ (সূরা আল-ওয়াক্বি‘আহ : ৭৭-৭৯)।
১৭). (اَلْبَيَانُ) আল-বায়ান : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَ نَزَّلۡنَا عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ تِبۡیَانًا لِّکُلِّ شَیۡءٍ وَّ ہُدًی وَّ رَحۡمَۃً وَّ بُشۡرٰی لِلۡمُسۡلِمِیۡنَ ‘আমরা মুসলিমের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা স্বরূপ, পথ নির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদ স্বরূপ আপনার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি’ (সূরা আন-নাহল : ৮৯)।
১৮). (اَلْمُبَارَكُ) আল-মুবারাক : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ ہٰذَا کِتٰبٌ اَنۡزَلۡنٰہُ مُبٰرَکٌ مُّصَدِّقُ الَّذِیۡ بَیۡنَ یَدَیۡہِ وَ لِتُنۡذِرَ اُمَّ الۡقُرٰی وَ مَنۡ حَوۡلَہَا وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡاٰخِرَۃِ یُؤۡمِنُوۡنَ بِہٖ وَ ہُمۡ عَلٰی صَلَاتِہِمۡ یُحَافِظُوۡنَ
‘আর এ কিতাবও আমরাই অবতীর্ণ করেছি; যা খুব বরকতময় কিতাব এবং পূর্বের সকল কিতাবকে সত্যায়িত করে থাকে, যেন আপনি উম্মুল কুরা এবং ওর চতুষ্পার্শ্বস্থ সমস্ত জনপদের লোকদেরকে এর দ্বারা ভীতি প্রদর্শন করেন। যারা আখেরাতে বিশ্বাস করবে তারা এর প্রতি ঈমান আনবে, আর তারা নিয়মিতভাবে স্বীয় ছালাতের সংরক্ষণ করে থাকে’ (সূরা আল-আন‘আম : ৯২)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ ہٰذَا کِتٰبٌ اَنۡزَلۡنٰہُ مُبٰرَکٌ فَاتَّبِعُوۡہُ وَ اتَّقُوۡا لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ ‘আর আমরা এই কিতাব অবতীর্ণ করেছি যা বরকতময়! সুতরাং তোমরা এটার অনুসরণ করে চল এবং ভয় কর, যেন তোমাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করা হয়’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৫৫)।
১৯). (اَلْمُفَرَّقُ) আল-মুফাররাক্ব : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ قُرۡاٰنًا فَرَقۡنٰہُ لِتَقۡرَاَہٗ عَلَی النَّاسِ عَلٰی مُکۡثٍ وَّ نَزَّلۡنٰہُ تَنۡزِیۡلًا ‘আমরা কুরআন অবতীর্ণ করেছি খণ্ড খণ্ড ভাবে, যাতে আপনি তা মানুষের কাছে পাঠ করতে পারেন ক্রমে ক্রমে এবং আমরা তা যথাযথভাবে অবতীর্ণ করেছি’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ১০৬)।
২০). (اَلْمَحْفُوْظُ) আল-মাহফূয : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, بَلۡ ہُوَ قُرۡاٰنٌ مَّجِیۡدٌ – فِیۡ لَوۡحٍ مَّحۡفُوۡظٍ ‘বরং এটা অতি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন কুরআন। সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ’ (সূরা আল-বুরূজ : ২২)।
(ইনশা-আল্লাহ চলবে)
* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র :
[১]. জামি‘ঊল বায়ান ফী তা‘বীলিল কুরআন, , ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৪।