বিদ‘আত পরিচিতি
-ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*
(১৬তম কিস্তি)
৩. তাদেরকে সম্মান না করা, বরং কষ্ট দেয়া ও লাঞ্ছিত করা
বিদ‘আতীদেরকে কষ্ট দেয়া ও লাঞ্ছিত করা এবং তাদেরকে সম্মান-মর্যাদা প্রদান করা থেকে বিরত থাকার মৌলিক উদ্দেশ্য হল- তারা যেন বিদ‘আত থেকে বেরিয়ে এসে আল-কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে নিজেদের সার্বিক জীবন পরিচালনা করে। এ ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারী সালাফগণ অত্যন্ত কঠিন ভূমিকা পালন করেছেন। যেমন, ফুযাইল ইবনু ঈয়ায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
مَنْ عَظَمَ صَاحب بدعة فقد أعان على هدم الإسلام ومن تبسم في وجه مبتدع فقد استخف بما أنزل الله عز و جل على محمد ﷺ
‘যে ব্যক্তি বিদ‘আতীকে সম্মান করল সে যেন ইসলামকে ধ্বংস করতে সহযোগিতা করল। আর যে ব্যক্তি বিদ‘আতীর সম্মুখে মুচকি হাসল সে যেন আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (ﷺ) -এর উপর যা অবতীর্ণ করেছেন তা অবজ্ঞা করল’।[১] আসাদ ইবনু মূসা (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক আসাদ ইবনু ফুরাত (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নিকট প্রেরিত একটি পত্রে বলেন,
وقد وقعت اللعنة من رسول الله ﷺ على أهل البدع ... فأرفض مجالسهم وأذلهم وأبعدهم كما أبعدهم الله وأذلهم رسول الله ﷺ وأئمة الهدى
‘বিদ‘আতীর উপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পক্ষ থেকে অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে। সুতরাং তাদের আসরগুলো ভেঙ্গে দাও, তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে পরিত্যাগ ও লাঞ্ছিত করেছেন সেভাবে পরিত্যাগ ও লাঞ্ছিত কর এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও হেদায়াতপ্রাপ্ত ওলামায়ে কেরাম তাদেরকে যেরূপ লাঞ্ছিত করেছেন, তাদেরকেও অনুরূপ লাঞ্ছিত কর’।[২]
আবূ ক্বিলাবা (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত, ‘একদা তিনি আহলে সুন্নাতের এক ব্যক্তিকে এক বিদ‘আতী লোকের সাথে দেখে তাকে বলেন, তোমার কী হল, এটাতো ঠাট্টা-বিদ্রুপ’।[৩]
৪. ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত না হওয়া
বিদ‘আতীদের সাথে দ্বীনের কোন বিষয়ে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া যাবে না। কেননা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ স্পষ্টরূপে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তারা অহংকারের বশবর্তী হয়ে এবং বাপ-দাদার আমলকে আঁকড়ে ধরার অজুহাতে ছহীহ আক্বীদার ওলামায়ে কেরামের সাথে অযথা ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়। অথচ আল্লাহর কিতাব নিয়ে ঝগড়া করার কারণে পূর্বের উম্মতগণ ধ্বংস হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের নি¤েœাক্ত আয়াতগুলো প্রণিধানযোগ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
مَا یُجَادِلُ فِیۡۤ اٰیٰتِ اللّٰہِ اِلَّا الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا فَلَا یَغۡرُرۡکَ تَقَلُّبُہُمۡ فِی الۡبِلَادِ
‘শুধু কাফিররাই আল্লাহর নিদর্শন সম্বন্ধে ঝগড়া করে; সুতরাং শহরগুলোতে তাদের অবাধ বিচরণ যেন তোমাকে ধোঁকায় না ফেলে’ (সূরা আল-মুমিন : ৪)। অন্যত্র তিনি বলেন,
الَّذِیۡنَ یُجَادِلُوۡنَ فِیۡۤ اٰیٰتِ اللّٰہِ بِغَیۡرِ سُلۡطٰنٍ اَتٰہُمۡ ؕ کَبُرَ مَقۡتًا عِنۡدَ اللّٰہِ وَ عِنۡدَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ؕ کَذٰلِکَ یَطۡبَعُ اللّٰہُ عَلٰی کُلِّ قَلۡبِ مُتَکَبِّرٍ جَبَّارٍ
‘যারা নিজেদের নিকট কোন দলীল প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর নিদর্শন সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয় (তাদের এ কর্ম) আল্লাহ এবং মুমিনদের নিকট অতিশয় ঘৃণার। এভাবে আল্লাহ প্রত্যেক অহংকারী ও স্বৈরাচারী ব্যক্তির হৃদয়কে মোহর করে দেন’ (সূরা আল-মুমিন : ৩৫)। তিনি আরো বলেন,
اِنَّ الَّذِیۡنَ یُجَادِلُوۡنَ فِیۡۤ اٰیٰتِ اللّٰہِ بِغَیۡرِ سُلۡطٰنٍ اَتٰہُمۡ ۙ اِنۡ فِیۡ صُدُوۡرِہِمۡ اِلَّا کِبۡرٌ مَّا ہُمۡ بِبَالِغِیۡہِ ۚ فَاسۡتَعِذۡ بِاللّٰہِ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ
‘যারা নিজেদের নিকট কোন দলীল না থাকলেও আল্লাহর নিদর্শন সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয়, তাদের অন্তরে আছে শুধু অহংকার, যা সফল হবার নয়। অতএব আল্লাহর শরাণাপন্ন হও, তিনি তো সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা’ (সূরা আল-মুমিন : ৫৬)। ধমক স্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَّ یَعۡلَمَ الَّذِیۡنَ یُجَادِلُوۡنَ فِیۡۤ اٰیٰتِنَا مَا لَہُمۡ مِّنۡ مَّحِیۡصٍ
‘আর আমার নিদর্শনাবলী সম্পর্কে যারা তর্কে লিপ্ত হয়। তারা যেন অবহিত থাকে যে, তাদের (আযাব হতে) কোন মুক্তি নেই’ (সূরা আশ-শূরা : ৩৫)।
এ মর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, إِنَّ أَبْغَضَ الرِّجَالِ إِلَى اللهِ الْأَلَدُّ الْخَصِمُ ‘আল্লাহর নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি হল, অতিমাত্রায় ঝগড়াটে লোক’।[৪] আবূ উমামা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
مَا ضَلَّ قَوْمٌ بَعْدَ هُدًى كَانُوْا عَلَيْهِ إِلَّا أُوْتُوْا الْجَدَلَ ثُمَّ قَرَأَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ هَذِهِ الْآيَةَ (مَا ضَرَبُوۡہُ لَکَ اِلَّا جَدَلًا بَلۡ ہُمۡ قَوۡمٌ خَصِمُوۡنَ)
‘হেদায়াত প্রাপ্তির পর কোন জাতির মধ্যে দ্বীনী বিতর্কে জড়িয়ে পড়া ব্যতীত কোন বিভেদ সৃষ্টি হয় না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পাঠ করেন, ‘তারা ঝগড়ার উদ্দেশ্য ব্যতীত আপনার নিকট তা উত্থাপন করেনি। বস্তুত তারা হল ঝগড়াপ্রিয় লোক’ (সূরা আয-যুখরুফ : ৫৮)।[৫]
আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, একদিন দ্বিপ্রহরে আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকটে পৌঁছলাম। রাবী বলেন, এমন সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দু’জন লোকের আওয়ায শুনলেন, যারা একটি আয়াত নিয়ে বাদানুবাদ করছিল। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিকট বেরিয়ে এলেন, এমতাবস্থায় তাঁর চেহারায় ক্রোধ প্রকাশ পাচ্ছিল। অতঃপর তিনি বললেন,
إِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِاِخْتِلَافِهِمْ فِىْ الْكِتَابِ
‘আল্লাহর কিতাবকে নিয়ে বাদানুবাদ করার কারণেই তোমাদের পূর্বের উম্মত ধ্বংস হয়েছে’।[৬]
সালাফগণ এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন। তারা তাদের রচিত কিতাবপত্রে বিদ‘আতীদের সাথে ঝগড়া-বিবাদ ও তর্ক-বিতর্ক করার ব্যাপারে হুঁশিয়ার করার জন্য বিভিন্ন অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন। যেমন, আল-আর্জুরী (রাহিমাহুল্লাহ) প্রণীত ‘আশ-শরী‘আহ’ গ্রন্থে ‘দ্বীনের ব্যাপারে ঝগড়া-বিবাদ করা দোষণীয়’[৭], ইবনু বাত্তাহ (রাহিমাহুল্লাহ) প্রণীত ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থে ‘কুরআন নিয়ে ঝগড়া করা নিষিদ্ধ’[৮], ইবনু আব্দুল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) প্রণীত ‘জা-মিঊ বায়ানিল ‘ইলমি ওয়া ফাযলিহ’ গ্রন্থে ‘তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি অপসন্দনীয়’ অনুচ্ছেদ[৯] এবং হাফেয ইসমাঈল আল-ইছপাহানী (রাহিমাহুল্লাহ) প্রণীত ‘আল-হুজ্জাহ ফী বায়ানিল মুহাব্বাহ’ গ্রন্থে ‘বিদ‘আতীদের সাথে ঝগড়া করা, তর্ক-বিতর্ক করা ও তাদের বক্তব্য শ্রবণ করা নিষিদ্ধ’ অনুচ্ছেদ ইত্যাদি।[১০] তাঁরা উক্ত অনুচ্ছেদগুলোর অধীনে বহু আছার উল্লেখ করে বিদ‘আতীদের সাথে ঝগড়া-বিবাদের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। তন্মধ্যে নি¤েœ কয়েকটি আছার উল্লেখ করা হল- ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
اصول السنة عندنا التمسك بما كان عليه أصحاب رسول الله ﷺ والاقتداء بهم وترك البدع وكل بدعة فهي ضلالة وترك الخصومات والجلوس مع أصحاب الأهواء وترك المراء والجدال والخصومات في الدين
‘আমাদের নিকট সুন্নাতের মূলনীতি হল- রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ছাহাবীদেরকে আঁকড়ে ধরা ও তাদের অনুসরণ করা এবং বিদ‘আতকে পরিত্যাগ করা। কেননা প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্ট। এছাড়া দ্বীনের ব্যাপারে প্রবৃত্তি পূজারী বিদ‘আতীদের সাথে ঝগড়া করা, তাদের সাথে বসা, তর্ক-বিতর্ক পরিত্যাগ করা’।[১১]
ফুযাইল ইবনু ঈয়ায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, لا تجادلوا أهل الخصومات فإنهم يخوضون في آيات الله ‘তোমরা ঝগড়া-বিবাদকারী তথা বিদ‘আতীদের সাথে ঝগড়া কর না। কেননা তারা আল্লাহর আয়াতের ব্যাপারে নিরর্থক কথা বলে থাকে’।[১২]
৫. তাদের বিরুদ্ধে বদ দু‘আ করা
দ্বীন ইসলামের সংরক্ষণ, মুসলিমদের মধ্যকার সংশোধন এবং বিদ‘আতীদের অনিষ্ট থেকে মুক্তির জন্য তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করা বৈধ। কেননা বিদ‘আতীরা সালাফদের মানহাজের বিরোধিতা করে এবং আহলেহাদীছগণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে ষড়যন্ত্র করে থাকে। বিভিন্ন সীমালঙ্ঘন, মিথ্যাচার ও শরী‘আতের মনগড়া ব্যাখ্যার মাধ্যমে ইসলামের ধ্বংস সাধনে প্রচেষ্টা করে থাকে। এজন্য বিদ‘আতীদের ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক থাকা যেমন আহলেহাদীছগণের উপর অপরিহার্য, তেমনি তাদের হেদায়াতের জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করাও বাঞ্ছনীয়। এতদ্ব্যতীত তাদের দৌরাত্ম্য ও ভ্রষ্টতা থেকে তারা যদি বিরত না হয়, তাহলে তাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে ভেঙ্গে দেয়া এবং তাদের অনিষ্ট থেকে সাধারণ মুসলিমদেরকে মুক্তির জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাদের বিরুদ্ধে বদ দু‘আ করা যায়। অন্যথা তারা বিভিন্ন বিকৃতি, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে শরী‘আতকে ধ্বংস করে ফেলবে। ঐক্যবদ্ধ ও অখ- মুসলিম উম্মাহকে পথহারা করে দিবে। যেমনটি ইহুদী-খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্মকে বিকৃত করেছে এবং নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়েছে। বিদ‘আতীদের বিরুদ্ধে বদদু‘আ করা প্রসঙ্গে আল-কুরআন, ছহীহ হাদীছের অনেক দলীল এবং সালাফে ছালিহীনের অসংখ্য আমল বিদ্যমান রয়েছে। যা নি¤œরূপ:
আল-কুরআনে কতিপয় নবী তাঁদের ক্বওমের বিরুদ্ধে তাদের কুফরী, পাপাচার ও সীমালঙ্ঘনের কারণে যে বদদু‘আ করেছিলেন তার অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। যেমন নূহ (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ قَالَ نُوۡحٌ رَّبِّ لَا تَذَرۡ عَلَی الۡاَرۡضِ مِنَ الۡکٰفِرِیۡنَ دَیَّارًا ‘নূহ (আলাইহিস সালাম) আরো বলেছিলেন, হে আমার প্রতিপালক! পৃথিবীতে কাফিরদের মধ্য হতে কোন গৃহবাসীকে ছেড়ে দিবেন না’ (সূরা আন-নূহ : ২৬)। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর ব্যাপারে আরো সংবাদ দিয়েছেন যে,
فَدَعَا رَبَّہٗۤ اَنِّیۡ مَغۡلُوۡبٌ فَانۡتَصِرۡ- فَفَتَحۡنَاۤ اَبۡوَابَ السَّمَآءِ بِمَآءٍ مُّنۡہَمِرٍ
‘তখন তিনি তাঁর প্রতিপালককে আহ্বান করে বলেছিলেন, আমি তো অসহায়, অতএব আপনি আমার প্রতিবিধান করুন। ফলে আমরা উন্মুক্ত করে দিলাম আকাশের দ্বার প্রবল বারি বর্ষণে’ (সূরা আল-ক্বামার : ১০-১১)। অনুরূপভাবে মূসা (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَدَعَا رَبَّہٗۤ اَنَّ ہٰۤؤُلَآءِ قَوۡمٌ مُّجۡرِمُوۡنَ ‘অতঃপর মূসা (আলাইহিস সালাম) তাঁর প্রতিপালকের নিকট দু‘আ করলেন, এরা তো এক অপরাধী সম্প্রদায়’ (সূরা আদ-দুখান : ২২)।
আবার সম্প্রদায়ের মধ্যে নির্দিষ্ট করে কারো বিরুদ্ধেও নবীগণ দু‘আ করেছিলেন। যেমন ফিরআঊন ও তার সদলবলের বিরুদ্ধে মূসা ও হারূণ (আলাইহিমাস সালাম) -এর বদদু‘আ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ قَالَ مُوۡسٰی رَبَّنَاۤ اِنَّکَ اٰتَیۡتَ فِرۡعَوۡنَ وَ مَلَاَہٗ زِیۡنَۃً وَّ اَمۡوَالًا فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۙ رَبَّنَا لِیُضِلُّوۡا عَنۡ سَبِیۡلِکَ ۚ رَبَّنَا اطۡمِسۡ عَلٰۤی اَمۡوَالِہِمۡ وَ اشۡدُدۡ عَلٰی قُلُوۡبِہِمۡ فَلَا یُؤۡمِنُوۡا حَتّٰی یَرَوُا الۡعَذَابَ الۡاَلِیۡمَ- قَالَ قَدۡ اُجِیۡبَتۡ دَّعۡوَتُکُمَا
‘আর মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি ফিরাঊন ও তার পরিষদবর্গকে দান করেছেন জাঁকজমকের সামগ্রী এবং পার্থিব জীবনে বিভিন্ন রকমের সম্পদ, হে আমাদের রব! যার কারণে তারা আপনার পথ হতে (মানবম-লীকে) বিভ্রান্ত করে, হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের সম্পদগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিন এবং তাদের অন্তরসমূহকে কঠিন করুন, যাতে তারা ঈমান না আনতে পারে যতক্ষণ, তারা যন্ত্রণাময় আযাবকে দেখে নেয়। তিনি (আল্লাহ) বললেন, তোমাদের উভয়ের দু‘আ কবুল করা হল’ (সূরা ইউনুস : ৮৮-৮৯)।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কাফির-মুশরিকদের বিরুদ্ধে অনেকবার বদদু‘আ করেছেন। যেমন আহযাবের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুশরিকদের বিরুদ্ধে বদদু‘আ করেছিলেন। আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আহযাব যুদ্ধের দিন আল্লাহর রাসূল (ﷺ) দু‘আ করেন,
مَلَأ اللهُ بُيُوْتَهُمْ وَقُبُوْرَهُمْ نَارًا شَغَلُوْنَا عَنِ الصَّلَاةِ الْوُسْطَى حِيْنَ غَابَتِ الشَّمْسُ
‘আল্লাহ তাদের (মুশরিকদের) ঘর ও কবর আগুনে পূর্ণ করুন। কেননা তারা মধ্যম ছালাত তথা আছরের ছালাত থেকে আমাদেরকে ব্যস্ত করে রেখেছে, এমনকি সূর্য অস্তমিত হয়ে যায়’।[১৩] অন্যত্র কুরাইশ বংশের পরিচিত মুযার গোত্রের বিরুদ্ধে তিনি বদদু‘আ করেছিলেন। যেমন,
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كَانَ النَّبِىُّ ﷺ يَدْعُوْ فِى الْقُنُوْتِ ... اللَّهُمَّ اشْدُدْ وَطْأَتَكَ عَلَى مُضَرَ اللَّهُمَّ سِنِيْنَ كَسِنِىْ يُوْسُفَ
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী করীম (ﷺ) কুনূতে নাযিলায় দু‘আ করতেন যে, ... হে আল্লাহ! মুযার গোত্রকে সমূলে উৎপাটিত করুন। হে আল্লাহ! কাফিরদের উপর ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)-এর সময়ের দুর্ভিক্ষের মত দুর্ভিক্ষ নাযিল করুন’।[১৪]
عَنْ عَائِشَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ اللهم مَنْ وَلِيَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِيْ شَيْئًا فَشَقَّ عَلَيْهِمْ فَاشْقُقْ عَلَيْهِ وَمَنْ وَلِيَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِيْ شَيْئًا فَرَفَقَ بِهِمْ فَارْفُقْ بِهِ
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, হে আল্লাহ! কোন ব্যক্তি যদি আমার উম্মতের সামান্য কাজের দায়িত্বশীল হয়, তারপর সে অধীনস্থ লোকের প্রতি কঠোরতা করে, তাহলে আপনি তার ওপর কঠোর হন। আর যে ব্যক্তি আমার উম্মতের সামান্য কাজের দায়িত্বশীল হয়ে তাদের ওপর নরম হয়, আপনি তার ওপর নরম হন।[১৫] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শরী‘আতের বিপরীত কাজ করলে তা‘যীর হিসাবে বিপরীতমুখী দু‘আ করেছেন মর্মে বর্ণিত হয়েছে। যেমন,
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ يَقُوْلُ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ مَنْ سَمِعَ رَجُلًا يَنْشُدُ ضَالَّةً فِى الْمَسْجِدِ فَلْيَقُلْ لَا رَدَّهَا اللهُ عَلَيْكَ فَإِنَّ الْمَسَاجِدَ لَمْ تُبْنَ لِهَذَا
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি কাউকে মসজিদে এসে কোন হারানো বস্তু তালাশ করতে শুনে, সে যেন বলে, আল্লাহ তোমাকে তা ফিরিয়ে না দিন। কেননা মসজিদসমূহ এই জন্য নির্মিত হয়নি।[১৬]
সুধী পাঠক! উক্ত হাদীছগুলোতে কুফরী ও সীমালঙ্ঘনমূলক কাজের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদেরকে বদ দু‘আ করেছেন। যা ছিল কিছু পাপী ব্যক্তি এবং কতিপয় গোত্র ও সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। উল্লেখ্য, এখানে কাফের ও পাপাচারী মুসলিম বদদু‘আর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এতদ্ভিন্ন নির্দিষ্ট করে কতিপয় কাফির ও মুসলিমদের মধ্যে কতিপয় পাপাচারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বদ দু‘আ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,
اسْتَقْبَلَ النَّبِىُّ ﷺ الْكَعْبَةَ فَدَعَا عَلَى نَفَرٍ مِنْ قُرَيْشٍ عَلَى شَيْبَةَ بْنِ رَبِيْعَةَ وَعُتْبَةَ بْنِ رَبِيْعَةَ وَالْوَلِيْدِ بْنِ عُتْبَةَ وَأَبِىْ جَهْلِ بْنِ هِشَامٍ فَأَشْهَدُ بِاللهِ لَقَدْ رَأَيْتُهُمْ صَرْعَى قَدْ غَيَّرَتْهُمُ الشَّمْسُ وَكَانَ يَوْمًا حَارًّا
‘নবী করীম (ﷺ) কা‘বার দিকে মুখ করে কুরাইশদের কতিপয় লোকের তথা- শায়বাহ ইবনু রাবী‘আ, উতবাহ ইবনু রাবী‘আ, ওয়ালীদ ইবনু উতবাহ এবং আবূ জাহল ইবনু হিশামের বিরুদ্ধে দু‘আ করেন। আমি আল্লাহর নামে সাক্ষ্য দিচ্ছি, অবশ্যই আমি এ সমস্ত লোকদেরকে (বদরের ময়দানে) নিহত হয়ে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকতে দেখেছি। প্রচণ্ড রোদ তাদের দেহগুলোকে বিকৃত করে দিয়েছিল। দিনটি ছিল প্রচণ্ড গরম’।[১৭]
আবার কিছু সীমালঙ্ঘান, মুসলিমদের মধ্যে কারো দ্বারা শরী‘আত বিরোধী কাজ সংঘটিত হলে তার জন্যও বদ দু‘আর বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন, সালামা ইবনুল আকওয়া‘ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত,
أَنَّ رَجُلًا أَكَلَ عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ بِشَمَالِهِ فَقَالَ كُلْ بِيَمِيْنِكَ قَالَ لَا أَسْتَطِيْعُ قَالَ لَا اسْتَطَعْتَ مَا مَنَعَهُ إِلَّا الْكِبْرُ قَالَ فَمَا رَفَعَهَا إِلَى فِيْهِ
‘এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে বাম হাতে খাচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, তুমি তোমার ডান হাতে খাও। সে বলল, আমি ডান হাতে খেতে পারি না। তিনি বললেন, ডান হাতে খাওয়ার সাধ্য তোমার না হোক। আসলে সে অহংকারবশত ডান হাতে খাওয়া হতে বিরত ছিল। (বর্ণনাকারী বলেন) সে আর কোনদিই তার ডান হাত নিজের মুখের কাছে নিতে পারেনি।[১৮] ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এই হাদীছ প্রমাণ করে যে, বিনা ওযরে শরী‘আতের বিধান লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে বদ দু‘আ করা যায়’।[১৯] নিম্নের হাদীছটি মনোযোগ দিয়ে পাঠ করুন-
আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মা উম্মু সুলায়মা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট এক ইয়াতীম মেয়ে ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে দেখে বললেন, এ তুমি সে মেয়ে? তুমি তো অনেক বড় হয়েছ; কিন্তু তুমি দীর্ঘায়ু হবে না। তখন ইয়াতীম মেয়েটি উম্মু সুলায়মের নিকট এসে কাঁদতে লাগল। তখন উম্মু সুলায়ম (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন, তোমার কী হয়েছে? হে আমার স্নেহের মেয়ে! মেয়েটি বলল, নবী (ﷺ) আমাকে বদদু‘আ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমি দীর্ঘায়ু হব না। সুতরাং এখন থেকে আমি বয়সে আর বড় হব না। অথবা সে سِنِّى- এর স্থলে قَرْنِى (আমার সমবয়সী) বলেছিল। এ কথা শুনে উম্মু সুলায়ম (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাড়াতাড়ি গায়ে চাদর দিয়ে বেরিয়ে পড়েন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে দেখা করেন। তখন তাঁর উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, কী ব্যাপার, হে উম্মু সুলায়ম! তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি কি আমার ইয়াতীম মেয়েটিকে বদদু‘আ করেছেন? তিনি বললেন, হে উম্মু সুলায়ম! এটা কেমন কথা! বদদু‘আ করব কেন? উম্মু সুলায়ম বললেন, সে তো মনে করেছে যে, আপনি তাকে বদদু‘আ করেছেন যেন তার বয়স না বাড়ে কিংবা তার সমবয়সীর বয়স বৃদ্ধি না পায়।
রাবী বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুচকি হেসে বললেন, হে উম্মু সুলায়ম! তুমি বোধহয় জান না যে, আমার রবের সাথে এ মর্মে আমি শর্ত করেছি এবং আমি বলেছি যে, আমি একজন মানুষ মাত্র। মানুষ যাতে সন্তুষ্ট থাকে আমিও তাতে সন্তুষ্ট হই। আমিও রাগান্বিত হই যেভাবে মানুষ রাগান্বিত হয়ে থাকে। সুতরাং আমি আমার উম্মতের কোন লোকের বিরুদ্ধে বদদু‘আ করলে সে যদি তার যোগ্য না হয় তাহলে তা তার জন্য পবিত্রতা, আত্মশুদ্ধি ও নৈকট্যর সোপান বানিয়ে দাও, যার দ্বারা ক্বিয়ামতের দিনে সে তোমার নৈকট্য অর্জন করতে পারে।[২০] অতএব শারঈ দৃষ্টিতে বদদু‘আ পাওয়ার যে যোগ্য তার কর্মের জন্য তাকে বদদু‘আ করা যাবে।
জাবির ইবনু সামুরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, কূফাবাসীরা (তাদের জন্য নিযুক্ত আমীর) সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বিরুদ্ধে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট অভিযোগ করলে তিনি তাঁকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন এবং আম্মার (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে তাদের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। কূফার লোকেরা সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে গিয়ে এ-ও বলে যে, তিনি ভালরূপে ছালাত আদায় করতে পারেন না। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, হে আবূ ইসহাক! তারা আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে যে, আপনি নাকি ভালরূপে ছালাত আদায় করতে পারেন না। সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ছালাতের অনুরূপই ছালাত আদায় করে থাকি। তাতে কোন ত্রুটি করি না। আমি এশার ছালাত আদায় করতে প্রথমে দু’রাক‘আত একটু দীর্ঘ ও শেষের দু’রাক‘আত সংক্ষেপ করতাম। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, হে আবূ ইসহাক! আপনার সম্পর্কে আমার এ-ই ধারণা। অতঃপর ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কূফার অধিবাসীদের এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এক বা একাধিক ব্যক্তিকে সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সঙ্গে কূফায় পাঠান।
সে ব্যক্তি প্রতিটি মসজিদে গিয়ে সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল এবং তাঁরা সকলেই তাঁর ভূঁয়সী প্রশংসা করলেন। অবশেষে সে ব্যক্তি বনূ আব্স গোত্রের মসজিদে উপস্থিত হয়। এখানে উসামা উবনু কাতাদা নামে এক ব্যক্তি যাকে আবূ সা‘দাহ ডাকা হত দাঁড়িয়ে বলল, যেহেতু তুমি আল্লাহর নামে শপথ দিয়ে জিজ্ঞেস করেছ, সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কখনো সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে যান না, গনীমতের মাল সমভাবে বণ্টন করেন না এবং বিচারে ইনছাফ করেন না। তখন সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, মনে রেখো, আল্লাহর কসম! আমি তিনটি দু‘আ করছি, হে আল্লাহ! যদি তোমার এ বান্দা মিথ্যাবাদী হয়, লোক দেখানো এবং অপপ্রচারের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে (১) তার হায়াত বাড়িয়ে দিন, (২) তার অভাব বাড়িয়ে দিন এবং (৩) তাঁকে ফিতনার সম্মুখীন করুন। পরবর্তীকালে লোকটিকে (তার অবস্থা সম্পর্কে) জিজ্ঞেস করা হলে সে বলত, আমি বয়সে বৃদ্ধ, ফিতনায় লিপ্ত। সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বদদু‘আ আমার উপর লেগে আছে। বর্ণনাকারী আব্দুল মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, পরে আমি সে লোকটিকে দেখেছি, অতি বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে তার ভ্রু চোখের উপর ঝুলে গেছে এবং সে পথে মেয়েদের বিরক্ত করত এবং তাদের চিমটি দিত।[২১]
উরওয়া ইবনু যুবায়র (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, আরওয়া বিনতু উওয়াইস খলীফা মারওয়ান ইবনু হাকামের কাছে সাঈদ ইবনু যায়দ ইবনু ‘আমর ইবনু নুফায়লের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে এবং সে দাবী করে যে, তিনি তার কিছু জমি দখল করে নিয়েছে। সাঈদ বললেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হতে এ সম্পর্কে একটি হাদীছ শুনার পরও কি আমি তার জমির কিছু অংশ দখল করতে পারি? তখন তিনি বললেন, সে হাদীছটি আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি কারও এক বিঘত পরিমাণ জমি অন্যায়ভাবে কেড়ে নিবে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তাকে সাত স্তর পর্যন্ত বেড়ী বানিয়ে তার গলায় ঝুলে দিবেন। একথা শুনে মারওয়ান তাকে বললেন, এই হাদীছ শোনার পর আমি আর কোন প্রমাণ আপনার নিকট হতে চাব না।
অতঃপর সাঈদ এই দু‘আ করলেন, ‘হে আল্লাহ! এই মহিলাটি যদি মিথ্যাবাদী হয়; তাহলে আপনি তার চক্ষু অন্ধ করে দিন এবং উক্ত জমিতেই তাকে ধ্বংস করুন। বর্ণনাকারী ঊরওয়া বলেন, মৃত্যুর পূর্বেই সে মহিলাটি অন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং একদা সে তার উক্ত জমিতে হাঁটছিল, হঠাৎ সে সেখানে একটি গর্তে পড়ে মৃত্যুবরণ করল। ছহীহ মুসলিমের বর্ণনায় আছে, মুহাম্মদ ইবনু যায়দ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে উক্ত হাদীছের মর্মার্থে বর্ণিত, তাতে এ কথাটি উল্লেখ আছে যে, তিনি (মুহাম্মদ ইবনু যায়দ) উক্ত মহিলাটিকে অন্ধ অবস্থায় দেখেছেন। সে দেওয়াল ধরে চলত এবং বলত, আমার উপর সাঈদের বদ দু‘আ লেগেছে। অতঃপর একদা উক্ত মহিলাটি তার ঘরের সে বিবাদময় জমির একটি কূপের নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় তাতে পড়ে গেল এবং সেখানেই তার কবর হল।[২২]
সুধী পাঠক! উক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হয় যে, শরী‘আত সীমালঙ্ঘনকারীদের উপর বদবদু‘আ করাকে বৈধ করেছে। যাতে করে তারা সঠিক পথে ফিরে আসতে পারে। অনুরূপভাবে বিদ‘আতীদের বিরুদ্ধে বদদু‘আ করার প্রমাণ হিসাবে উপরিউক্ত দলীলগুলোও প্রমাণ বহন করে। কেননা বিদ‘আত অন্যান্য পাপকর্মের চেয়ে আরো বেশি ভয়ংকর, মারাত্মক ও ক্ষতিকর। বরং পাপী ব্যক্তির চেয়ে বিদ‘আতী ব্যক্তির বদদু‘আ প্রাপ্তির অধিকার বেশি। কেননা বিদ‘আত মুসলিমের কষ্টার্জিত ইবাদত নষ্ট করে দেয়, পরকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শাফা‘আত থেকে বঞ্ছিত করে এবং চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামের ইন্ধনে পরিণত করে। অতএব বিদ‘আতটি কুফরী হোক কিংবা না হোক, তার বিরুদ্ধে বদদু‘আ করা যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বিদ‘আত ও বিদ‘আতীদের অনিষ্ট থেকে সকল মুসলিম উম্মাহকে হেফাযত করুন। আমীন!!
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আল-ইসলামিয়্যাহ, খড়খড়ি, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র :
[১]. কিতাবু শারহিস সুন্নাহ, পৃ. ৬০, আছার নং-১৩০।
[২]. মুহাম্মাদ ইবনু ওয়াযযাহ আল-কুরতুবী, আল-বিদা‘ঊ ওয়ান নাহিউ ‘আনহা (কায়রো : দারুছ ছাফা, ১ম সংস্করণ, ১৪১১ হি./১৯৯০ খ্রি.), পৃ. ১৪।
[৩]. আল-ইবানাতু আন শার‘আতিল ফিরক্বাতিন নাজিয়াতি ওয়া মুজানিবাতিল ফিরাক্বিল মাযমূমাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮৯১।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/২৪৫৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৬৮; মিশকাত, হা/৩৭৬২।
[৫]. ইবনু মাজাহ, হা/৪৮; তিরমিযী, হা/৩২৫৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২২১৮; মিশকাত, হা/১৮০, সনদ ছহীহ।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৬৬; মিশকাত, হা/১৫২।
[৭]. আবূ বকর মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন আল-আজুররী, কিতাবুশ শারী‘আহ (রিয়াদ : দারুল ওয়াত্বান, ১ম সংস্করণ, ১৪১৮ হি./১৯৯৭ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪২৯।
[৮]. আল-ইবানাতু আন শার‘আতিল ফিরক্বাতিন নাজিয়াতি ওয়া মুজানিবাতিল ফিরাক্বিল মাযমূমাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬১১।
[৯]. ইবনু আব্দিল বার্র, জামিঊ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহ (মুওয়াসসাসাতুর রাইয়ান, ১ম সংস্করণ, ১৪২৪ হি./২০০৩ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮৫।
[১০]. হাফেয ইসমাঈল আল-ইছপাহানী, আল-হুজ্জাহ ফী বায়ানিল মুহাব্বাহ (রিয়াদ : দারুল রায়াহ, ১৪১৯ হি./১৯৯৯ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৮।
[১১]. শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদ আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত মিনাল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ ওয়া ইজমাঈছ ছাহাবাহ, পৃ. ১৫৬, আছার নং-৩১৭।
[১২]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৯, আছার নং-২২৩।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/২৯৩১, ৪১১১; ছহীহ মুসলিম, হা/৬২৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১২২০।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/২৯৩২; ছহীহ মুসলিম, হা/৬৭৫; মিশকাত, হা/১২৮৮।
[১৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৮২৮; মিশকাত, হা/৩৬৮৯।
[১৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৬৮; মিশকাত, হা/৭০৬।
[১৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৯৬০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৯৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৭৭৫।
[১৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০২১; মিশকাত, হা/৫৯০৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৫৪০।
[১৯]. ইমাম নববী, আল-মিনহাজু শারহু ছহীহ মুসলিম (বৈরূত : দারু ইহইয়াইত তুরাছিল ‘আরাবী, ২য় সংস্করণ, ১৩৯২ হি.), ১৩তম খণ্ড, পৃ. ১৯২।
[২০]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬০৩; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৬৫১৪।
[২১]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৫৫।
[২২]. ছহীহ বুখারী, হা/৩১৯৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬১০।
প্রসঙ্গসমূহ »:
শিরক, বিদ‘আত ও কুসংস্কার