ছয়টি মূলনীতির ব্যাখ্যা
-মূল : শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনু আব্দিল ওয়াহহাব
-ব্যাখ্যা : শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালেহ আল-উছাইমীন
-অনুবাদ : আব্দুর রাযযাক্ব বিন আব্দুল ক্বাদির*
বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম
গ্রন্থকার শাইখুল ইসলাম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, মহান বিজয়ী বাদশার ক্ষমতার প্রমাণ বহনকারী নিদর্শনসমূহের মধ্যে সর্বশেষ্ঠ এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের মধ্যে সর্বাধিক বিস্ময়কর প্রসঙ্গ হল ছয়টি মূলনীতি, যা আল্লাহ তা‘আলা সকল মানুষের জন্য ধারণাতীতভাবে সুন্দর ও স্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছেন। এরপরও অল্পসংখ্যক ব্যক্তি ছাড়া বিশ্বের মেধাবী ও জ্ঞানবান আদম সন্তানদের অধিকাংশই এ বিষয়গুলোতে ভুল করেছে।
ব্যাখ্যা : মূল লেখক তার কিতাবটি আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসরণে ‘বিসমিল্লাহ’ দ্বারা আরম্ভ করেছেন। কারণ কুরআন ‘বিসমিল্লাহ’ দ্বারা আরম্ভ হয়েছে। আর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর লিখনি ও পত্রগুলো ‘বিসমিল্লাহ’ দ্বারা আরম্ভ করতেন।
‘আল্লাহ’ একটি মহান শব্দ, যা একমাত্র তাঁকেই বুঝায়। তাঁর গুণবাচক নামসমূহ সেই ‘আল্লাহ’ নামের অনুগামী। যেমন নিম্নোক্ত আয়াতে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়।
کِتٰبٌ اَنۡزَلۡنٰہُ اِلَیۡکَ لِتُخۡرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوۡرِ ۬ۙ بِاِذۡنِ رَبِّہِمۡ اِلٰی صِرَاطِ الۡعَزِیۡزِ الۡحَمِیۡدِ ۙ – اللّٰہِ الَّذِیۡ لَہٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ
‘এই কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে আপনি মানুষকে তাদের রবের অনুমতিক্রমে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে নিয়ে আসতে পারেন, পরাক্রমশালী প্রশংসিত রবের পথের দিকে। আল্লাহর (পথ), আসমানসমূহ ও যমীনের সব কিছুই যার মালিকানায়’ (সূরা ইবরাহীম : ১-২)।
‘আর-রহমান’ নামটি আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ নামের অন্তর্ভুক্ত, যা অন্য কারো ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য নয়। যার অর্থ হল- এমন সত্তা, যিনি প্রশস্ত দয়ার অধিকারী।
‘আর-রাহীম’ এমন একটি নাম, যা আল্লাহর জন্য ব্যবহার হয় এবং তা অন্যের জন্যও ব্যবহার হতে পারে। যার অর্থ হল- বিশেষ বান্দার প্রতি পৌঁছায় এমন রহমতের অধিকারী।
অতএব দু’টি নাম একসঙ্গে উল্লেখ করলে ‘রহীম’ দ্বারা উদ্দেশ্য হবে বান্দাদের মধ্য থেকে যার প্রতি ইচ্ছা তিনি তার প্রতি রহমত দান করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يُعَذِّبُ مَن يَشَاء وَيَرْحَمُ مَن يَشَاء وَإِلَيْهِ تُقْلَبُونَ
‘তিনি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন এবং যার প্রতি ইচ্ছা রহমত করেন। তাঁরই দিকে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (সূরা আনকাবূত : ২১)।
আর ‘রহমান’ নাম দ্বারা উদ্দেশ্য প্রশস্ত দয়ার অধিকারী।
শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব (রাহিমাহুল্লাহ) এর সংক্ষিপ্ত পুস্তকসমূহের প্রতি পর্যবেক্ষণ ছিল, যাতে সাধারণ মানুষ ও ছাত্র সকলেই বুঝতে পারে।
‘ছয়টি বড় মূলনীতি’ নামক এই সংক্ষিপ্ত পুস্তকটিও ঐ শ্রেণীর পুস্তকেরই অন্তর্ভুক্ত। ছয়টি মূলনীতি নিম্নরূপ :
(১) ইখলাছ ও তার বিরোধী শিরকের বর্ণনা।
(২) দ্বীনের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং তার মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি থেকে বিরত থাকা।
(৩) শাসকণের কথা শ্রবণ করা ও তা মান্য করা।
(৪) ইলম ও উলামা এবং ফিক্বহ ও ফক্বীহগণের বর্ণনা। সেই সাথে তার ব্যাপারে আলোচনা যে তাদের সাথে সাদৃশ্য রাখে, কিন্তু সে তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।
(৫) কারা আল্লাহর ওলী? তাদের বর্ণনা।
(৬) কুরআন এবং সুন্নাহকে পরিহার করার ব্যাপারে শয়তানের উদ্ভাবিত সন্দেহ নিরসন করা।
এই মূলনীতিগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা বিশেষভাবে উপলব্ধির যোগ্য। আমরা এগুলোর ব্যাখ্যা ও টীকা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্য কামনা করছি, তিনি যেন তা সহজ করে দেন।
মূলনীতি-১
অংশীদারহীন একক আল্লাহ তা‘আলার জন্য দ্বীনকে খাঁটি করা এবং তার বিপরীত আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপনের বর্ণনা। এই মূলনীতিকে কুরআন বহু ভঙ্গিতে এত বিশদভাবে বর্ণনা করেছে যে, নির্বোধ শ্রেণীর মানুষও তা বুঝতে সক্ষম। অতঃপর বিভিন্ন জাতীর উপর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলে শয়তান সৎলোক ও তাদের অনুসারীদের প্রতি ভালোবাসার নামে তাদের সামনে আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপনকে সুশোভিত করে তুলে।
ব্যাখ্যা : ‘আল-ইখলাছ লিল্লাহ’-এর অর্থ হল- ব্যক্তি তার ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভ করা এবং আল্লাহর সম্মানজনক জায়গা জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছার ইচ্ছা পোষণ করা। অর্থাৎ বান্দা তার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল অবস্থায় আল্লাহর ইচ্ছা পোষণ করতে, তাঁকে ভালবাসতে ও সম্মান প্রদর্শন করতে আল্লাহ তা‘আলার জন্য আন্তরিক ও মনোনশীল হবে। আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি এবং তার সম্মানের জায়গা জান্নাত লাভ করা ব্যতীত অন্য কিছুই তালাশ করবে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُلۡ اِنَّ صَلَاتِیۡ وَ نُسُکِیۡ وَ مَحۡیَایَ وَ مَمَاتِیۡ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ- لَا شَرِیۡکَ لَہٗ وَ بِذٰلِکَ اُمِرۡتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الۡمُسۡلِمِیۡنَ
‘(হে নবী!) আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক। তাঁর কোন অংশীদার নেই এবং আমাকে এই নির্দেশই প্রদান করা হয়েছে। আর আমিই মুসলিমদের মধ্যে সর্বপ্রথম’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৬২-১৬৩)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَ اَنِیۡبُوۡۤا اِلٰی رَبِّکُمۡ وَ اَسۡلِمُوۡا لَہٗ ‘তোমরা তোমাদের রবের অভিমুখী হও এবং তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ কর’ (সূরা আয-যুমার-৫৪)। তিনি আরো বলেন,
وَ اِلٰـہُکُمۡ اِلٰہٌ وَّاحِدٌ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ الرَّحۡمٰنُ الرَّحِیۡمُ
‘আর তোমাদের ইলাহ এক। তিনি ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই। তিনি পরম করুণাময় দয়ালু’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৬৩)। আল্লাহর বাণী, فَاِلٰـہُکُمۡ اِلٰہٌ وَّاحِدٌ فَلَہٗۤ اَسۡلِمُوۡا وَ بَشِّرِ الۡمُخۡبِتِیۡنَ ‘তোমাদের ইলাহ তো এক ইলাহ। অতএব তারই কাছে আত্মসমর্পণ কর। আর অনুগতদেরকে সুসংবাদ দাও’ (সূরা আল-হাজ্জ : ৩৪)।
মূল কথা হল যে, ইবাদতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ভেজাল ও শিরকমুক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ مِنۡ رَّسُوۡلٍ اِلَّا نُوۡحِیۡۤ اِلَیۡہِ اَنَّہٗ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّاۤ اَنَا فَاعۡبُدُوۡنِ ‘আর আমরা আপনার পূর্বে এমন কোন রাসূল পাঠাইনি, যার প্রতি এই ওহী নাযিল করিনি যে, আমি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই, সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত কর’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ২৫)। শায়খুল ইসলামও এ বিষয়েই গুরুত্বারোপ করেছেন।
অনুরূপ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও বিষয়টি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি তাওহীদকে বাস্তবায়ন করা এবং তাওহীদকে সকল প্রকার কলঙ্ক থেকে খাঁটি ও মুক্ত করার জন্যই আগমন করেছিলেন। যেমন ‘কোন এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বললেন, আল্লাহ এবং আপনার ইচ্ছায় যা হওয়ার হয়েছে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার প্রতিবাদ করে বললেন, তুমি আমাকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে দিলে? বরং শুধু আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটেছে’।[১]
লোকটি তার ভাষার মাঝে আরবী অক্ষর (و), যার অর্থ ‘এবং’ ব্যবহার করার কারণে আল্লাহর ইচ্ছা ও রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইচ্ছার মাঝে কোন ফাঁক নেই। বরং উভয়ের ইচ্ছাকেই সমান বুঝিয়েছেন। তাই বাক্যটির মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহর সমকক্ষ বানানোর গন্ধ পাওয়া যায়। সে কারণেই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কঠোর ভাষায় লোকটির কথার প্রতিবাদ করেছেন। আরেকটি উদাহরণ যেমন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গাইরুল্লাহর নামের শপথ করাকে হারাম করেছেন এবং সেটাকে আল্লাহর সাথে শিরক করা বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللهِ فَقَدْ كَفَرَ اَوْ أَشْرَكَ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর নামে শপথ করল সে নিশ্চিত কুফর বা শিরক করল’।[২] তার কারণ হল- গাইরুল্লাহর নামে শপথ করা প্রকৃতপক্ষে শপথকৃত বস্তুর প্রতি এমন সম্মান প্রদর্শন বুঝায়, যে সম্মান একমাত্র আল্লাহই পাওয়ার যোগ্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, যখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট একটি প্রতিনিধি দল আগমন করে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বন্ধ করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! হে আমাদের শ্রেষ্ঠজন, শ্রেষ্ঠজনের সন্তান, আমাদের নেতা, আমাদের নেতার সন্তান। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমরা তোমাদের কথা বল, তবে সাবধান! শয়তান যেন তোমাদেরকে কোনভাবেই আকৃষ্ট না করে। আমার পরিচয় হল, আমি মুহাম্মাদ, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল, আল্লাহ আমাকে যে মর্যাদায় আসীন করেছেন তোমরা আমাকে তার চেয়ে বেশি মর্যাদায় তুলে দিবে এটা আমি মোটেও পসন্দ করি না।[৩]
শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব (রাহিমাহুল্লাহ) তার রচিত ‘কিতাবুত তাওহীদ’-এর মাঝে এই বিষয়ে একটি অধ্যায় রচনা করে বলেন যে, ‘এই অধ্যায়টি হল মুছত্বফা মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক ‘তাওহীদ’-এর পরিধি সংরক্ষণ ও ‘শিরক’-এর সকল পথ রুদ্ধকরণ সম্পর্কে। সার কথা হল- আল্লাহ তা‘আলা ইখলাছ তথা ইবাদতকে একমাত্র তাঁর জন্য খাঁটি ও নির্ভেজালভাবে সম্পাদনের বিষয়টি যেমন পরিষ্কার করে বর্ণনা করেছেন, তেমনি ইখলাছের বিপরীত বিষয় শিরকের বর্ণনাও পরিস্কারভাবে পেশ করেছেন। তাইতো আল্লাহ বলেন,
اِنَّ اللّٰہَ لَا یَغۡفِرُ اَنۡ یُّشۡرَکَ بِہٖ وَ یَغۡفِرُ مَا دُوۡنَ ذٰلِکَ لِمَنۡ یَّشَآءُ وَ مَنۡ یُّشۡرِکۡ بِاللّٰہِ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلًۢا بَعِیۡدًا
‘নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে। এছাড়া যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে সুদূর ভ্রান্তিতে পতিত হয়’ (সূরা আন-নিসা : ১১৬)। তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক কর না’ (সূরা আন-নিসা : ৩৬)। তিনি আরও বলেন, وَ لَقَدۡ بَعَثۡنَا فِیۡ کُلِّ اُمَّۃٍ رَّسُوۡلًا اَنِ اعۡبُدُوا اللّٰہَ وَ اجۡتَنِبُواالطَّاغُوۡتَ ‘আর আমরা অবশ্যই প্রত্যেক জাতির মাঝে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে নির্দেশ প্রদান করার জন্য যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূতকে বর্জন কর’ (সূরা আন-নাহল : ৩৬)। এই বিষয়ে আরও অনেক আয়াত রয়েছে। এছাড়া নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, مَنْ لَقِىَ اللَّهَ لَا يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ لَقِيَهُ يُشْرِكُ بِهِ دَخَلَ النَّارِ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক না করে সাক্ষাৎ করবে, সে জান্নাতে যাবে। পক্ষান্তরে যে আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করে সাক্ষাৎ করবে, সে জাহান্নামে যাবে’।[৪]
শিরক দুই প্রকার
প্রথম প্রকার : বড় শিরক, যা ইসলাম থেকে বের করে দেয়। এটা এমন শিরক, যাকে শরী‘আত প্রণেতা সাধারণভাবে উল্লেখ করেছেন এবং যা সার্বিক দিক দিয়ে তাওহীদ বিরোধী। যেমন বহু প্রকার ইবাদতের মধ্য হতে কোন এক প্রকার ইবাদত গাইরুল্লাহর জন্য সম্পাদন করা। অর্থাৎ গাইরুল্লাহর জন্য ছালাত আদায় করা, কুরবানী করা, মানত করা বা গাইরুল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা। যেমন কবরবাসী ও অনুপস্থিত ব্যক্তির নিকট কোন বিপদ থেকে মুক্তি কামনা করা, যা উপস্থিত ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব হলেও তার পক্ষে সম্ভব নয়। এছাড়াও বিদ্বানদের রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে এধরণের অসংখ্য শিরকের বর্ণনা পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় প্রকার : ছোট শিরক, এটা ঐ প্রত্যেক কথা ও কাজ, যেগুলোর ক্ষেত্রে শরী‘আত প্রণেতা শিরক হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন। তবে যা সার্বিকভাবে তাওহীদের পরিপন্থী নয়। যেমন আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন কিছুর নামে শপথ করা। সুতরাং গাইরুল্লাহর নামে শপথকারী ব্যক্তি যদি শপথকৃত বস্তুর সম্মানকে আল্লাহর সম্মানের সমকক্ষ বিশ্বাস না করে, তাহলে সে ছোট শিরককারী বলে গণ্য হবে। ইবাদতের ক্ষেত্রে লোক দেখানো বা সুনাম অর্জন উদ্দেশ্য করাও ছোট শিরকের উদাহরণ। আর এটা অনেক গুরুতর বিষয়। যার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَا الشِّرْكُ الأَصْغَرُ قَالَ الرِّيَاءُ ‘আমি তোমাদের প্রতি যে বিষয়ে সবচাইতে বেশি ভয় পাচ্ছি তা হলো ছোট শিরক। তাঁরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! ছোট শিরক কী? তিনি বললেন, ‘রিয়া’ তথা লোক দেখানো ইবাদত করা’।[৫]
রিয়া তথা ‘লোক দেখানো ইবাদত’ কোন কোন ক্ষেত্রে বড় শিরকের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। অবশ্য ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) টুকিটাকি সামান্য রিয়ার ভাবকে ছোট শিরক এর উদাহরণ হিসাবে পেশ করেছেন। তাতে বুঝা যায় যে, রিয়ার ভাব বেশি হলে তা বড় শিরক এর পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। আবার কোনো বিদ্বান বলেছেন, আল্লাহর বাণী- ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করার অপরাধকে ক্ষমা করেন না’। এই বাণী সকল প্রকার শিরককে অন্তর্ভুক্ত করে। সুতরাং সাধারণভাবে শিরক থেকে সাবধান থাকা আবশ্যক। কেননা শিরকের পরিণতি অতীব ভয়াবহ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّہٗ مَنۡ یُّشۡرِکۡ بِاللّٰہِ فَقَدۡ حَرَّمَ اللّٰہُ عَلَیۡہِ الۡجَنَّۃَ وَ مَاۡوٰىہُ النَّارُ وَ مَا لِلظّٰلِمِیۡنَ مِنۡ اَنۡصَارٍ
‘নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করবে তার উপর আল্লাহ জান্নাতকে হারাম করেছেন। তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম। আর যালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৭২)।
মুশরিকের প্রতি জান্নাত হারাম হওয়া তার জাহান্নামে স্থায়ীভাবে অবস্থান করাকে আবশ্যক প্রমাণ করে। অতএব শিরককারী স্থায়ী জাহান্নামী হওয়ার কারণে পরকালে নিশ্চিত ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তার নিকট অকাট্য প্রমাণসহ সতর্ককারী আসার পরও পার্থিব জীবনকে কাজে লাগাতে না পারাই দুনিয়াতেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُلۡ اِنَّ الۡخٰسِرِیۡنَ الَّذِیۡنَ خَسِرُوۡۤا اَنۡفُسَہُمۡ وَ اَہۡلِیۡہِمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ اَلَا ذٰلِکَ ہُوَ الۡخُسۡرَانُ الۡمُبِیۡنُ
‘(হে নবী!) আপনি বলুন, নিশ্চয় তারা ক্ষতিগ্রস্ত যারা নিজেদেরকে ও তাদের পরিবারবর্গকে ক্বিয়ামতের দিবসে ক্ষতিগ্রস্ত পাবে। জেনে রাখ এটাই স্পষ্ট ক্ষতি’ (সূরা আয-যুমার : ১৫)। সে নিজের আত্মাকে কাজে না লাগিয়ে নিকৃষ্ট স্থান জাহান্নামের অধিবাসী বানানোর কারণে নিজেই নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। পাশাপাশি তার পরিবারবর্গ জান্নাতী হোক বা জাহান্নামী হোক তাদের মাধ্যমে উপকৃত হতে না পারার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থাৎ সে একুল-ওকুল সব হারিয়ে প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জেনে রাখুন! শিরক খুবই সূক্ষ্ম একটি বিষয়। তাইতো আল্লাহর খলীল, একনিষ্ঠ ব্যক্তিদের নেতা ইবরাহীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর নিকট দু‘আ করেছিলেন যে, وَّ اجۡنُبۡنِیۡ وَ بَنِیَّ اَنۡ نَّعۡبُدَ الۡاَصۡنَامَ ‘আর হে আমার রব! আপনি আমাকে ও আমার পুত্রদেরকে মূর্তিপূজা হতে দূরে রাখুন’ (সূরা ইবরাহীম : ৩৫)। তিনি দু‘আর মাঝে ভাষা ব্যবহার করেছেন, দূরে রাখূন, ফাঁকে রাখুন। তিনি বিরত রাখুন বলেননি। এর দ্বারা বুঝিয়েছেন যে, মূর্তির ধারে কাছেও যেন না যায়। ইবনু আবি মুলাইকা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ৩০ জন ছাহাবীকে পেয়েছি, যারা প্রত্যেকেই নিজের উপর নিফাক্বকে ভয় করতেন’।[৬]
আমীরুল মুমিনীন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হুযাইফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বলেছিলেন, আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জানতে চাই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমার নিকট মুনাফিকদের নামের তালিকা পেশ করার সময় তাদের সাথে আমার নাম উল্লেখ করেছেন কি?[৭] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া সত্ত্বেও তিনি নিফাক্বের আশংকা করেছেন। কারণ হতে পারে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট তার জীবনের কোন কাজের ত্রুটি প্রকাশ পেয়েছে। সুতরাং মুনাফিক ছাড়া নিফাক্বকে কেউ আশ্রয় দেয় না এবং মুমিন ছাড়া কেউ নিফাক্বকে ভয় পায় না। অতএব আল্লাহর বান্দার জন্য যরূরী হল, ইখলাছের প্রতি তার অধীর আগ্রহ থাকবে এবং নিজেকে ইখলাছের উপর রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করবে। তাই কতক সালাফ বলেছেন, ‘আমি নিজেকে ইখলাছের উপর রাখতে যতটা চেষ্টা করেছি, অন্য কিছুর উপর নিজেকে অবিচল রাখতে এতটা চেষ্টা করিনি’।
মোট কথা হল, শিরক বিষয়টি বড়ই জটিল ও কঠিন। তা মোটেই সহজ নয়। তবে আল্লাহ তা‘আলা বান্দার উপর ইখলাছকে সহজ করে দেন। আর তা এইভাবে যে, বান্দা আল্লাহ তা‘আলাকে তার চোখের সামনে উপস্থিত মনে করে। অতঃপর নিজ আমল দ্বারা একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনকে উদ্দেশ্য করে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
* মুহাদ্দিছ, দারুল হুদা ইসলামী কমপ্লেক্স, বাউসা হেদাতীপাড়া, বাঘা, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র:
[১]. ত্বাবারাণী কাবীর, হা/১৩০০৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৪২, ছহীহ; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১০৯৩।
[২]. মুসতাদরাকু আলাছ ছহীহাইন, হা/৭৮১৪, সনদ ছহীহ; আবূ দাঊদ, হা/৩২৫১; ইরওয়া, হা/২৫৬১।
[৩]. নাসাঈ কুবরা, হা/১০০৭৭; আহমাদ, হা/১২৫৭৩; আবূ দাউদ, হা/৪৮০৬, সনদ ছহীহ; ইরওয়া, হা/২৫৬১।
[৪]. ছহীহ মুসলিম, হা/৯৩।
[৫]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৬৮৬; মিশকাত, হা/৫৩৩৪; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৯৫১।
[৬]. তিরমিযী, হা/১১৫০, সনদ ছহীহ; ছহীহ বুখারী হা/৪৮-এর অনুচ্ছেদ।
[৭]. ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়াহ, ত্বরীকুল হিজরাতাইন, পৃ : ৪৩৩ ।