সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০১:৫৩ অপরাহ্ন

নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে ধর্মের ভূমিকা

-ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ *


অবতরণিকা

নৈতিক মূল্যবোধ সমাজকে সকল প্রকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংঘাত, দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ থেকে দূরে রাখে। ফলে মানুষ সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে বেঁচে থাকে। একটি সমাজকে চেনা যায় সে সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের গভীরতা দিয়ে। ধর্মীয় অনুশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় উপাদান নৈতিক মূল্যবোধে সঞ্জিবনী শক্তি হিসাবে কাজ করে। শুধু সামাজিক অবক্ষয় রোধের জন্যই নয় বরং জীবন সৌন্দর্যের জন্য নৈতিক মূল্যবোধ প্রয়োজন। নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি তার নীতিতে অটল থাকে, মূল্যবোধের উপর আস্থা রাখে। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ ব্যক্তি পর্যায় একজন মানুষকে সঠিক ও শুদ্ধ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলে। নৈতিক মূল্যবোধ থাকার কারণেই মানুষ তার নিজের, পরিবারের, সমাজের ও রাষ্ট্রের প্রতি সকল দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে। নৈতিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ শিক্ষিত একজন মানুষ অন্যকে উৎসাহিত করে নীতিবান হতে, মূল্যবোধের প্রতি সম্মান দেখাতে। যার মধ্যে নৈতিক শিক্ষা থাকে পারিপার্শ্বিকতার দোহাই দিয়ে সে অন্যায় অপরাধ করে না। বরং সে নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করে। মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী ইন্ডিকেটর বা সূচকের মধ্যে ধর্ম শীর্ষস্থানে রয়েছে। দৈনন্দিন জীবন-যাপনে ধর্মীয় চেতনা-বিশ্বাস মানুষের কর্মপ্রবাহ বদলে দেয়। ধর্মসমূহের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা মানুষের জীবনকে উৎকর্ষিত করতে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে ধর্মের রয়েছে বহুমাত্রিক প্রভাব। নিম্নে নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে ধর্মের ভূমিকা আলোচনা করা হলো-

নৈতিকতা

যে মৌলিক ধারণা, চিন্তা, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নীতি প্রনয়ণ করা হয়, সহজ অর্থে তাকেই নৈতিকতা বলা হয়। প্রচলিত ইংরেজিতে Morality (নৈতিকতা), Righteousness (ন্যায়পরায়ণতা), Goodness (উৎকৃষ্টতা), Riligiousity (ধার্মিকতা), Obedience (কর্তব্যপরায়ণতা) ইত্যাদি বুঝায়। অর্থাৎ যে উৎকৃষ্ট ও কল্যাণকর চিন্তা-চেতনা, নীতি প্রনয়ণে ভূমিকা পালন করে তাকেই নৈতিকতা বলা যেতে পারে। নৈতিকতা হলো নীতি সম্পর্কিত বোধ, এটি একটি মানবিক গুণাবলী, যা অন্য আরো অনেক গুণের সমন্বয়ে তৈরি হয়। মানুষ তার পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্মের উপর ভিত্তি করে সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মনীতি খুব সচেতনভাবে মেনে চলে। সমাজ বা রাষ্ট্র আরোপিত এই সব নিয়ম-নীতি ও আচরণবিধি মানুষের জীবন-যাপনকে প্রভাবিত করে। এই নিয়মগুলো মেনে চলার প্রবণতা, মানসিকতা, নীতির চর্চাই হলো নৈতিকতা। নৈতিকতা হলো কোনো মানদ- বা নীতিমালা; যা নির্দিষ্ট কোন আদর্শ, ধর্ম বা সংস্কৃতি থেকে আসতে পারে। নৈতিকতাকে ‘সঠিকতা’ বা ‘ন্যায্যতা’ও বলা যায়।

মূল্যবোধ

দীর্ঘদিন একই সমাজে একসাথে বাস করার ফলে অর্জিত মানবীয় অভিজ্ঞতা থেকে মূল্যবোধ গড়ে উঠে। মূল্যবোধের ভিত্তি হলো ধর্ম, দর্শন, দীর্ঘ দিনের লালিত আচরণ-বিশ্বাস, সমাজের নিজস্ব আদর্শ ও নিয়ম-নীতি। সমাজে বিদ্যমান রীতি-নীতি ও প্রথার প্রেক্ষিতে ভাল-মন্দ, ভুল-সঠিক, প্রত্যাশিত-অপ্রত্যাশিত বিষয় সম্পর্কে সমাজের মানুষের যে ধারণা সেগুলোই হলো মূল্যবোধ। 

সমাজবিজ্ঞানী R.T. Schaefer তার ‘Sociology’ গ্রন্থে বলেন ‘Values are collective what is considered good desirable and proper (or bad, Undesirable, and improper) in a culture’. অর্থাৎ ‘অন্য কথায় ভাল বা মন্দ, কাঙ্ক্ষিত বা অনাকাঙ্ক্ষি এবং ঠিক বা বেঠিক সম্পর্কে সমাজে বিদ্যমান ধারণার নামই মূল্যবোধ’।

সমাজবিজ্ঞানী David Popenoe তাঁর ‘Sociology’ গ্রন্থে বলেন যে, মূল্যবোধ হলো ‘Idea Shared by members of a Society about what is good and bad, right & wrong, desirable and Undesirable’. অর্থাৎ ‘ভাল-মন্দ, ঠিক-বেঠিক, কাঙ্ক্ষি-অনাকাঙ্ক্ষি বিষয় সম্পর্কে সমাজের সদস্যদের যে ধারণা তার নামই মূল্যবোধ। উপরিউক্ত সংজ্ঞার আলোকে বলা যায় যে-

১.  মূল্যবোধ হলো ভাল বা মন্দ সম্পর্কে সামাজিক ধারণা।

২.  কাঙ্ক্ষি বা অনাকাঙ্ক্ষি সম্পর্কে সমাজে বিচার বিশ্লেষণমূলক রায়, ঠিক বা বেঠিক, তথা উচিত বা অনুচিত সম্পর্কে সামাজিক ধ্যান-ধারণা। মূল্যবোধের মধ্যে একটি আবেগীয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। কেননা এটি কোন কাজ বা বিষয়কে মূল্যায়ন করে এবং কোনটি ঠিক বা কোনটি বেঠিক সে সম্পর্কে রায় প্রদান করে।

অতএব, কোন ব্যক্তি সমাজের মূল্যবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যখন কোন কিছুকে ভাল অথবা মন্দ জ্ঞান করে তখন সে দৃঢ়চিত্তেই করে এবং সে মনে করে এটি সমাজের মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আর তাই এ ব্যাপারে সে অনেকটা অনমনীয়ভাবে দৃঢ়চিত্তে আবেগীয় মানসিকতায় কোনো কিছুকে মূল্যায়ন করে।

নৈতিক মূল্যবোধ

নৈতিক মূল্যবোধ হচ্ছে শৃঙ্খল ও ন্যায়পূর্ণ সমাজ গঠনের প্রথম শর্ত। নৈতিক মূল্যবোধ বলতে কতগুলো মনোভাবের সমন্বয়ে গঠিত অপেক্ষাকৃত স্থায়ী বিশ্বাসকে বুঝায়। যে চিন্তা-ভাবনা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মানুষের মানবিক আচরণ, ব্যবহার ও কর্মকা-কে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তাই নৈতিক মূল্যবোধ। ন্যায়পরায়ণতা, সততা ও শিষ্টাচার মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। বড়দের সম্মান করা, আর্তের সেবা করা, উত্তম ব্যবহার, সহনশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, সততা প্রভৃতি নৈতিক মূল্যবোধের উদাহরণ। নৈতিক মূল্যবোধ ব্যক্তির মানসিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করে। আর এভাবে ব্যক্তিসত্তা বিকাশ করে; এটি সুশাসনের পথকে প্রশস্ত করে এবং সামাজিক অবক্ষয়ের অবসান ঘটায়। পরিবার, বিদ্যালয়, সম্প্রদায়, খেলার সাথী, সমাজ ও প্রথা থেকে একজন শিশু মূল্যবোধ লাভ করে। আবেগি ও আদর্শগত ঐক্যের ধারণার মাধ্যমে মনস্তাত্তিকভাবে একজন মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে উঠে, যা রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারকে সুশৃঙ্খল ও উন্নত করে। এই নৈতিক মূল্যবোধ নির্মাণের যাবতীয় প্রক্রিয়ায় ধর্ম অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে কাজ করে।

নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে ধর্মের ভূমিকা

ধর্ম ও ধর্মীয় অনুশাসনের সঠিক অনুশীলন ব্যক্তির পারিবারিক, সামাজিক, ব্যবসায়িক ও সামগ্রিক জীবনে পরিশুদ্ধতা নিশ্চিত করে। এই ধর্মীয় অনুশাসন মানুষের আত্মিক ও মনোজাগতিক উৎকর্ষ সাধন করে ব্যক্তিগত সুবিধা লাভের দৃষ্টিভঙ্গীর গণ্ডির বাহিরে এক পবিত্র চেতনার উম্মেষ ঘটায়। যা শুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন জীবন-যাপনে উৎসাহিত করে। নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে ধর্মীয় নির্দেশনা ব্যক্তি চরিত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন ও তার মৌলিক বৈশিষ্ট্য ধারণ ও প্রতিপালনে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। এই গুণরাজি এক একটি কর্তব্য পালন এবং এক একটি মর্যাদা লাভের জন্য মানুষের ভিতর থেকে ক্রমাগত তাকীদ ও দাবী জানাতে থাকে। এর ফলে প্রতি পদক্ষেপেই ব্যক্তি সদুপদেশ ও সতর্কবাণীর চাদরে বেষ্টিত থাকে। ধর্মীয় এ নির্দেশনা ও পন্থাসমূহ নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে ভূমিকা পালন করে। এ জন্যই চারিত্রিক বৈশিষ্টাবলী অর্জনের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে মহান প্রভুর গুণে গুণান্বিত হতে ‘আল-কুরআনে’ নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।[১] হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ ‘বেদে’ বলা হয়েছে, ‘হে নেতা! হে পুরোধা! ঈশ্বরের গুণাবলীতে গুণান্বিত হও’।[২] স্রষ্টার গুণে নিজেকে এবং জগৎকে রাঙ্গানোর মাধ্যমে মানুষের মৌলিক মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ ঘটে, শুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন মনন গড়ে উঠে। নৈতিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ হয়। ধর্মের বাণীসমূহ এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। নিম্মে নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশের জন্য ধর্মীয় নির্দেশনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ আলোচনা করা হল-

এক. নৈতিক চরিত্র গঠন

১. কল্যাণ কামনা

হাদীছে কল্যাণ কামনার জন্য নসিহাহ (উপদেশ বা কল্যাণ কামনা) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থপূর্ণ। এ কারণে নবী (ﷺ) এ পর্যন্ত বলেছেন, اَلدِّيْنُ النَّصِيْحَةُ ‘দ্বীন হচ্ছে নিছক কল্যাণ কামনা’। এ বাক্যটি তিনি এক সঙ্গে তিনবার উচ্চারণ করেছেন।[৩] বিশ্বাসীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে অপরের পসন্দ-অপসন্দের সাথে যুক্ত করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, وَالَّذِىْ نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيْهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ مِنَ الْخَيْرِ ‘যে মহান সত্তার হাতে আমার জীবন, তার কসম! কোন মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা পসদ করবে, তার ভাইয়ের জন্যও তাই পসন্দ করবে’।[৪] ‘বাইবেলে’ বলা হয়েছে, ‘যারা অন্যায়ের বীজ বপন করে এবং অনিষ্টের চারা রোপন করে তারা অন্যায়-অনিষ্টের ফসলই ঘরে তোলে’।[৫]

২. আত্মত্যাগ

অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়া চরিত্রের অন্যতম মৌলিক গুণ। নিজের প্রয়োজনকে মুলতবী রেখে অন্যের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয়া, অন্যের প্রয়োজন মেটানোÑ এটিই আত্মত্যাগ। নিজে কষ্ট স্বীকার করে অন্যকে আরাম দেবে। নিজের জন্য দরকার হলে স্বভাব-প্রকৃতির প্রতিকূল জিনিস মেনে নেবে, কিন্তু স্বীয় ভাইয়ের দিলকে যথাসম্ভব অপ্রীতিকর অবস্থা থেকে রক্ষা করবে। আল কুরআনে এ গুণটির প্রশংসায় আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَ یُؤۡثِرُوۡنَ  عَلٰۤی  اَنۡفُسِہِمۡ وَ لَوۡ کَانَ بِہِمۡ خَصَاصَۃٌ ؕ۟ وَ مَنۡ یُّوۡقَ شُحَّ نَفۡسِہٖ  فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ  الۡمُفۡلِحُوۡنَ ‘এবং আর তারা তাদেরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও; যারা কার্পণ্য হতে নিজেদেরকে মুক্ত করেছে তারাই সফলকাম’ (সূরা আল-হাশর : ৯)। ‘বেদে’ বলা হয়েছে, ‘যে ক্ষুধার্ত সঙ্গীকে অভুক্ত রেখে একাই ভূরিভোজ করে এবং যে স্বার্থপর তার সাথে কখনো বন্ধুত্ব করো না’।[৬]

৩. সুবিচার

ইসলাম ধর্মে ন্যায়বিচারকে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আল কুরআনে বলা হয়েছে, وَ اَنۡزَلۡنَا مَعَہُمُ  الۡکِتٰبَ وَ الۡمِیۡزَانَ لِیَقُوۡمَ النَّاسُ بِالۡقِسۡطِ ‘এবং আমরা তাদের (রাসূলদের) সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও মানদ-, ন্যায়নীতি- যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারে’ (সূরা আল-হাদীদ : ২৫)। কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাওয়া ৭ ব্যক্তির প্রথম ব্যক্তি হবেন- ন্যায় বিচারক।[৭]

৪. সদাচরণ

পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সদাচরণের গুরুত্ব অনেক বেশি। কেউ অন্যায় করলেও তার জবাব ন্যায়ের দ্বারা দিতে ধর্মে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ یَدۡرَءُوۡنَ بِالۡحَسَنَۃِ  السَّیِّئَۃَ ‘তারা অন্যায় ও পাপকে ন্যায় ও পুণ্যের দ্বারা নিরসন করে থাকে’ (সূরা আল-ক্বাছাছ : ৫৪)। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হবে, আমি তার সঙ্গে যুক্ত হব; যে আমাকে (অধিকার থেকে) বঞ্চিত করবে, আমি তাকে (তার অধিকার) বুঝিয়ে দেব এবং যে আমার উপর যুলুম করবে, আমি তাকে মার্জনা করে দেবো’। ‘ধম্মপদে’ বলা হয়েছে, ‘ভাল কাজ সবসময় কর। বারবার কর। মনকে সব সময় ভাল কাজে নিমগ্ন রাখো। সদাচরণই স্বর্গসুখের পথ’।[৮] রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘সদাচরণই ধর্ম’।[৯] ‘বেদে’ বলা হয়েছে, ‘সত্যিকারের ধার্মিক সব সময়ে মিষ্টভাষী ও অন্যের প্রতি সহমর্মী’।[১০]

৫. নম্র ও ভালোবাসাময় ব্যবহার

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَبِمَا رَحۡمَۃٍ مِّنَ اللّٰہِ لِنۡتَ لَہُمۡ ۚ وَ لَوۡ کُنۡتَ فَظًّا غَلِیۡظَ الۡقَلۡبِ لَانۡفَضُّوۡا مِنۡ حَوۡلِکَ ‘আল্লাহর রহমতে আপনি তাদের উপর নরম দিল ও সদয় হয়েছেন। যদি তাদের সাথে বদমেজাজী ও কঠিন মনের হতেন, তাহলে লোকেরা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যেত’ (সূরা আলে ইমরান : ১৫৯)। রাসূল (ﷺ) বলেছেন,

مَنْ أُعْطِىَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ أُعْطِىَ حَظَّهُ مِنْ خَيْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَمَنْ حُرِمَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ حُرِمَ حَظَّهُ مِنْ خَيْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ

‘যাকে নম্রতার কিছু অংশ প্রদান করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের বিরাট কল্যাণের অংশ প্রদান করা হয়েছে। আর যাকে সেই নম্রতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের বিরাট কল্যাণ হতে বঞ্চিত করা হয়েছে’।[১১] রাসূল (ﷺ) আরো বলেছেন, مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيْرَنَا وَيَعْرِفْ حَقَّ كَبِيْرِنَا فَلَيْسَ مِنَّا ‘যে ব্যক্তি ছোটদের প্রতি স্নেহ এবং বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[১২]

৬. মার্জনা

ইসলাম ধর্মে ক্ষমা ও মার্জনার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, خُذِ الۡعَفۡوَ وَ اۡمُرۡ بِالۡعُرۡفِ ‘নম্রতা ও ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন করো’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৯৯)। তিনি আরো বলেন, فَاعۡفُ عَنۡہُمۡ وَ اسۡتَغۡفِرۡ لَہُمۡ  ‘আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন, তাদের জন্য ক্ষমার প্রার্থনা করুন’ (সূরা আলে ইমরান : ১৫৯)। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, اَلْغَضَبُ يَفْسُدُ الْإِيْمَانِ كَمَا يَفْسُدُ الّخَلِّ الَعَسَلِ ‘নিশ্চয় ক্রোধ ঈমানকে এমনিভাবে নষ্ট করে দেয়, যেমন বিষাক্ত ঔষুধ মধুকে নষ্ট করে’।[১৩]

৭. ক্রোধ নিবারণ

রাগ বা ক্রোধ নিবারণের ব্যাপারে ইসলামে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘অলা বলেন,

الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ فِی السَّرَّآءِ وَ الضَّرَّآءِ وَ الۡکٰظِمِیۡنَ الۡغَیۡظَ وَ الۡعَافِیۡنَ عَنِ النَّاسِ ؕ وَ اللّٰہُ یُحِبُّ الۡمُحۡسِنِیۡنَ 

‘যারা স্বচ্ছলতায়ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে, আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুতঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদিগকেই ভালোবাসেন’ (সূরা আলে ইমরান: ১৩৪)।’ ‘বেদে’ বলা হয়েছে, ‘জীবনের প্রতিটি স্তরে অনিয়ন্ত্রিত রাগ ক্রোধ থেকে দূরে থাকো’।[১৪] ‘বেদে’ আরো বলা হয়েছে, ‘ধনুকের তীর নিক্ষেপের ন্যায় মন থেকে ক্রোধকে দূরে নিক্ষেপ করো। তাহলেই তোমরা পরস্পরের বন্ধু হতে ও শান্তিতে বসবাস করতে পারবে’।[১৫] হাদীছে এসেছে, لَيْسَ الشَّدِيْدُ بِالصُّرَعَةِ إِنَّمَا الشَّدِيْدُ الَّذِىْ يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ ‘সেই ব্যক্তি প্রকৃত বীর নয়, যে কুস্তিতে বিজয়ী হয়। বরং প্রকৃত বীর সেই, যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে’।[১৬] ‘ধম্মপদে’ বলা হয়েছে, ‘রণক্ষেত্রে সহ¯্রযোদ্ধার উপর বিজয়ীর চেয়ে রাগ-ক্রোধ বিজয়ী বা আত্মজয়ী বীরই বীরশ্রেষ্ঠ’।[১৭]

‘ভগবদ্গীতায়’ বলা হয়েছে, ‘কাম-ক্রোধ-লোভ- এই তিনটি নরকের প্রবেশদ্বার। এই তিনটি বিষবৎ পরিত্যাজ্য’।[১৮]

পরিশ্রমপ্রিয়তা

মানব সভ্যতার উন্নতি ও বিকাশ কিছু পরিশ্রমী মানুষের অর্জন। পরিশ্রম ছাড়া কোন সফলতা অর্জিত হয় না, কল্যাণ হাতছানি দিয়ে কাউকে ডাকে না। এই জন্যই দয়াময় আল্লাহ বলেন, لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ فِیۡ  کَبَدٍ ‘আমি তোমাদের পরিশ্রম প্রিয় করে তৈরি করেছি’ (সূরা আল-বালাদ : ৪)। ‘বেদে’ বলা হয়েছে, ‘অলস মস্তিষ্ক কুচিন্তার সহজ শিকার’।[১৯] ‘বেদে’ আরো বলা হয়েছে, ‘হে নেতা! হে পুরোধা! পাহাড়ের মত দৃঢ় ও অজেও হও। কর্তব্য পালনে সবসময় অবিচল থাকো’।[২০] ‘বেদে’ আরো বলা হয়েছে, ‘হে মানুষ! স্বনির্ভর হও, বাহিরের সাহায্যের দাসে পরিণত হয়ো না’।[২১] আরো বলা হয়েছে, ‘হে মানুষ! উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে আন্তরিকতার সাথে পরিশ্রম করো। দারিদ্র্য ও সুস্থতা তোমার কাছ থেকে পালিয়ে যাবে।’[২২] ‘ধম্মপদে’ বলা হয়েছে, ‘গন্ধহীন পুষ্পের ন্যায় কর্মবর্জিত সুন্দর বাক্যমালাও নিষ্ফল’।[২৩] ‘বাইবেলে’ বলা হয়েছে, ‘তুমি চাও, তোমাকে দেয়া হবে। খোঁজ কর, পাবে। দরজা খটখট কর, দরজা খুলে যাবে’।[২৪] বাইবেলে আরো বলা হয়েছে, ‘পরিশ্রমী হাত সবসময় কর্তৃত্ব করে আর অলস পরিণত হয় পরাধীন দাসে’।[২৫]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* সহকারী অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা), সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা।

তথ্যসূত্র :
[১]. আল্লাহ তা‘আলা বলেন, صِبۡغَۃَ اللّٰہِ ۚ وَ مَنۡ اَحۡسَنُ مِنَ اللّٰہِ صِبۡغَۃً  ۫ وَّ نَحۡنُ لَہٗ عٰبِدُوۡنَ ‘আল্লাহর রং, আল্লাহর রংয়ের চাইতে উত্তম রং আর কার হতে পারে? আমরা তাঁরই ইবাদত করি’। দ্র. : সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৩৮।
[২]. যজুর্বেদ: ১.১৮, ‘স্বামী সত্য প্রকাশ সরস্বতীর ভূমিকা সম্বলিত প-িত সত্যকাম বিদ্যালঙ্কার’- এর ঈংরেজী অনুবাদ ঞযব ঐড়ষু ঠবফধং থেকে কিছু বাণীর সরল বাংলা মর্মার্থ থেকে উৎকলিত।
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৫; আবূ দাঊদ, হা/৪৯৪৪; মিশকাত, হা/৪৯৬৬।
[৪]. নাসাঈ, হা/৫০১৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩১৬৯, সনদ ছহীহ।
[৫]. ইয়োব, ৪:৮, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টরন্যাশনাল সোসাইটির ইংরেজী অনুবাদ থেকে সরল বাংলা মর্মার্থ থেকে উৎকলিত।
[৬]. ঋগবেদ: ১০.১১৭.৪, তদেব।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৬০; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৩১; মিশকাত, হা/৭০১।
[৮]. পাপবগগো: ১১৮, অনন্ত প্রশান্তিলোকে পৌঁছার পথ ত্রিপিটকের ধম্মপদ। প্রখ্যাত দার্শনিক এস রাধাকৃঞ্চ-এর ইংরেজী অনুবাদ ঞযব উযধসসধঢ়ধফধ থেকে কিছু গাথার সরল বাংলা মর্মার্থ থেকে উৎকলিত।
[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৫; আবূ দাঊদ, হা/৪৯৪৪; মিশকাত, হা/৪৯৬৬।
[১০]. সামবেদ:২.৫১, তদেব।
[১১]. তিরমিযী, হা/২০১৩; মিশকাত, হা/৫০৭৬; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৫১৯।
[১২]. আবূ দাঊদ, হা/৪৯৪৩, সনদ ছহীহ।
[১৩]. মুহাম্মাদ তাক্বীউল মাজলীসি, রওযাতুল মুত্তাক্বীন ফী শারহি মান লা ইয়াহযুরুহল ফাক্বীহ, ১২/৮৮ পৃ.।
[১৪]. গামবেদ: ৩০.৭, তদেব।
[১৫]. অথর্ববেদ: ৬.৪২.১, তদেব।
[১৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১১৪; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬০৯; মিশকাত, হা/৫১০৫।
[১৭]. সহস্সবগ্গো, ১০৩, তদেব।
[১৮]. দবাসুর সম্পদ্বি ভাগযোগ: ২১।
[১৯]. ঋগবেদ:১০.২২.৮, তদেব।
[২০]. যজুর্বেদ:১২.১৭, তদেব।
[২১]. যজুর্বেদ: ৬.১২, তদেব।
[২২]. অথর্ববেদ: ৬.৮১.১, তদেব।
[২৩]. পুপ্কবগগো: ৫১, তদেব।
[২৪]. মথি, ৭:১২।
[২৫]. হিতোপদেশ, ১২:২৪।




প্রসঙ্গসমূহ »: নীতি-নৈতিকতা
সচ্চরিত্রই মানব উন্নতির চাবিকাঠি - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
তারুণ্যের উপর সন্ত্রাসবাদের হিংস্র ছোবল : প্রতিকারের উপায় - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
রামাযানে দাওয়াতী কাজের গুরুত্ব ও প্রভাব - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন
পরনিন্দা চর্চা ও তার পরিণাম - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ইসলামী শিষ্টাচার (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
ইসলামে পর্দার বিধান (২য় কিস্তি) - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
মাযহাবী গোঁড়ামি ও তার কুপ্রভাব (৩য় কিস্তি) - অনুবাদ : রিদওয়ান ওবাইদ
মাতুরীদী মতবাদ ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহ (১৩তম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
তারুণ্যের উপর সন্ত্রাসবাদের হিংস্র ছোবল : প্রতিকারের উপায় (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
সালাফী মানহাজের বৈশিষ্ট্য (শেষ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
মুসলিম বিভক্তির কারণ ও প্রতিকার (২য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
শবেবরাত - আল-ইখলাছ ডেস্ক

ফেসবুক পেজ