মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ১১:৪৫ অপরাহ্ন

ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩টি উপায়

-মূল : মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ
-অনুবাদক : আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীয*


(শেষ কিস্তি)

২৮). ছালাতে আকাশের দিকে তাকানো থেকে বিরত থাকা।

হাদীছে ছালাতরত অবস্থায় আকাশের দিকে তাকানো হতে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে এবং যারা ছালাতে আকাশের দিকে তাকায় তাদের জন্য কঠিন ধমক দেয়া হয়েছে। যেমন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, إِذَا كَانَ أَحَدُكُمْ فِى الصَّلَاةِ فَلَا يَرْفَعْ بَصَرَهُ إِلَى السَّمَاءِ أَنْ يُلْتَمَعَ بَصَرُهُ ‘যখন তোমাদের কেউ ছালাতে থাকে সে যেন তার দৃষ্টিকে আকাশের দিকে না ফেরায়, যাতে করে তার চোখের আলো ছিনিয়ে নেয়া হয়’।[১] অপর এক বর্ণনায় নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, مَا بَالُ أَقْوَامٍ يَرْفَعُونَ أَبْصَارَهُمْ إِلَى السَّمَاءِ فِىْ صَلَاتِهِمْ ‘তোদের কী হয়েছে যারা ছালাতে তাদের দৃষ্টিকে আকাশের দিকে উঠায়’?[২] অপর এক বর্ণনায় আছে, عَنْ رَفْعِهِمْ أَبْصَارَهُمْ عِنْدَ الدُّعَاءِ فِى الصَّلَاةِ ‘ছালাতে দু‘আ করার সময় তাদের দৃষ্টিকে আকাশের দিকে উঠায়’। নবী  করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছালাতে দৃষ্টিকে আসমানের দিকে নিক্ষেপকারীকে অত্যন্ত কঠিনভাবে ধমক দিয়েছেন এবং তিনি বলেছেন, لَيَنْتَهُنَّ عَنْ ذَلِكَ أَوْ لَتُخْطَفَنَّ أَبْصَارُهُمْ ‘তারা হয় আকাশের দিকে তাকানো হতে বিরত থাকবে নতুবা তাদের দৃষ্টিকে ছিনিয়ে নেয়া হবে’।[৩]

২৯). ছালাতে মুছল্লী কর্তৃক তার সামনে থুথু না ফেলা।

ছালাতে মুছল্লী কর্তৃক তার সামনে থুথু ফেলা ছালাতের খুশূ‘-একাগ্রতা এবং আল্লাহ তা‘আলার আদবের পরিপন্থী বিষয়। যেমন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, إِذَا كَانَ أَحَدُكُمْ يُصَلِّى فَلَا يَبْصُقْ قِبَلَ وَجْهِهِ فَإِنَّ اللهَ قِبَلَ وَجْهِهِ إِذَا صَلَّى ‘যখন তোমাদের কেউ ছালাত আদায় করে সে যেন তার সামনে থুথু না ফেলে। কেননা যখন সে ছালাত আদায় করে তখন আল্লাহ তা‘আলা তার সামনে থাকেন’।[৪] নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেন,

إِذَا قَامَ أَحَدُكُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَلَا يَبْصُقْ أَمَامَهُ فَإِنَّمَا يُنَاجِى اللهَ تَبَارَكَ وَ تَعَالٰى مَا دَامَ فِىْ مُصَلَّاهُ وَلَا عَنْ يَمِيْنِهِ فَإِنَّ عَنْ يَمِيْنِهِ مَلَكًا وَلْيَبْصُقْ عَنْ يَسَارِهِ أَوْ تَحْتَ قَدَمِهِ فَيَدْفِنُهَا.

‘তোমাদের কেউ ছালাতে দ-ায়মান হলে সে তার সামনের দিকে থুথু ফেলবে না। কেননা সে যতক্ষণ তার মুছল্লায় থাকে, ততক্ষণ সে মহান আল্লাহর সাথে চুপে চুপে কথা বলে। আর সে ডান দিকেও ফেলবে না। কেননা তার ডানে ফেরেশতা থাকে। বরং সে যেন তার বাম দিকে অথবা তার পায়ের নীচে থুথু ফেলে এবং পরে তা মিটিয়ে দেয়’।[৫] নবী করীম  (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেন,

إِنَّ أَحَدَكُمْ إِذَا قَامَ فِىْ صَلَاتِهِ فَإِنَّمَا يُنَاجِىْ رَبَّهُ وإن رَبّهُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ قِبْلَتِهِ فَلَا يَبْزُقَنَّ أَحَدَكُمْ فِىْ قِبْلَتِهِ وَلَكِنْ عَنْ يَسَارِهِ أَوْ تَحْتَ قَدَمِهِ.

‘যখন তোমাদের কেউ ছালাতে দ-ায়মান হয়, তখন সে তার প্রতিপালকের সাথে চুপে চুপে কথা বলে। অথবা (তিনি বলেছেন) তখন তার প্রতিপালক, ক্বিবলা ও তার মাঝখানে থাকেন। কাজেই সে যেন ক্বিবলার দিকে থুথু না ফেলে বরং (প্রয়োজনে) তার বাম দিকে বা পায়ের নীচে ফেলবে’।[৬] আর যদি আমাদের বর্তমান সময়ের মসজিদ হয় যেগুলোতে জায়নামায বা এধরনের কিছু বিছানো থাকে, সেখানে যদি থুথু ফেলার প্রয়োজন হয় তাহলে সে রুমাল বের করে তাতে থুথু ফেলে তা আবার রেখে দিবে।

৩০). ছালাতে ‘হাই’-কে সাধ্যানুযায়ী প্রতিহত করা বা দমানো।

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, إذَا تَثَاءَبَ أَحَدُكُمْ فِي الصَّلَاة فَلْيَكْظِمْ مَا اسْتَطَاعَ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ يَدْخُلُ ‘যখন তোমাদের কারও ছালাতে ‘হাই’ আসে, তখন সে যেন তা সাধ্যানুযায়ী প্রতিহত করে। কেননা শয়তান তাতে প্রবেশ করে’।[৭] আর যখন শয়তান সেখানে প্রবেশ করে তখন সে আরও বেশী বিশৃঙ্খলা-গোলযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। এমনকি মুছল্লী যখন হাই দেয় তখন শয়তান হাসাহাসি করে।

৩১). ছালাতে কোমরে হাত রাখা থেকে বিরত থাকা।

আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, نَهَى رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ الْاِخْتِصَارِ فِى الصَّلَاةِ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছালাতে কোমরে হাত রাখতে নিষেধ করেছেন’।[৮] যিয়াদ ইবনু ছুবাইহ আল-হানাফী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

صَلَّيْتُ إِلَى جَنْبِ ابْنِ عُمَرَ فَوَضَعْتُ يَدَىَّ عَلَى خَاصِرَتَىَّ فضرب يدي فَلَمَّا صَلَّى قَالَ هَذَا الصَّلْبُ فِى الصَّلَاةِ وَكَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَنْهَى عَنْهُ.

‘আমি ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর পাশে ছালাত আদায় করছিলাম। ছালাতে আমি আমার দু’হাত কোমরে রাখলে তিনি আমাকে মারলেন। ছালাত  শেষ হলে তিনি বললেন, এটা ছালাতের মাঝে একধরনের শূলী। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এটা করতে নিষেধ করেছেন’।[৯] অপর একটি মারফূ‘ হাদীছে বর্ণিত আছে, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, أَنَّ التَّخَصُّرَ رَاحَةُ أَهْلِ النَّارِ وَالْعِيَاذُ بِاللهِ ‘ছালাতে কোমরে হাত রাখা জাহান্নামীদের জন্য প্রশান্তি। মহান আল্লাহর কাছে এর থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি’। হাদীছটি ইমাম বায়হাক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেছেন।[১০] ইমাম ইরাক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাদীছটির সনদ ছহীহ।

৩২). ছালাতে কাপড় ঝুলিয়ে দেয়া পরিহার করা।

ছালাত অবস্থায় কাপড় ঝুলিয়ে দেয়া পরিহার করতে হবে। কেননা نَهَى عَنِ السَّدْلِ فِى الصَّلَاةِ وَأَنْ يُغَطِّىَ الرَّجُلُ فَاهُ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছালাতের সময় কাপড় উপর থেকে নীচের দিকে ঝুলিয়ে দিতে ও মুখ ঢেকে রাখতে নিষেধ করেছেন’।[১১] ‘আউনুল মা‘বূদ’ গ্রন্থকার ইমাম খাত্ত্বাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, اَلسَّدْلُ إِرْسَالُ الثَّوْبِ حَتَّى يُصِيْبُ الْأَرْضُ ‘সাদল হল- কাপড় যমীন পর্যন্ত ঝুলিয়ে পড়া, যাতে করে তা যমীনের সাথে জড়িয়ে যায়।[১২]

মিরক্বাতুল মাফাতীহ-তে বর্ণিত হয়েছে যে, সাদল নিষিদ্ধ। কেননা তা অহংকারের অন্তর্ভুক্ত। আর ছালাতে সাদল করা আরও বেশী মারাত্মক ও নিন্দনীয় গর্হিত কাজ।[১৩]

‘নিহায়াহ’ গ্রন্থাকার বলেন, দুই কাপড় দিয়ে নিজেকে আবৃত করে তাতে দুই হাত প্রবেশ করিয়ে রুকূ‘ ও সিজদা করাকে সাদল বলে। কেউ কেউ বলেন, সাদল হল ইহুদীদের কাজ। তারা এ কাজটি করে। আবার কেউ বলেন, কাপড় মাথা বা কাঁধের উপর রেখে তা সামনের দিকে অথবা দুই বাহুর উপর দিয়ে ছেড়ে দেয়া। ফলে মুছল্লী ছালাতে কাপড় নিয়ে ব্যস্ত থাকে যাতে করে কাপড় না পড়ে। এর ফলে মুছল্লির ছালাতে একাগ্রতা অর্জনে বিঘœতা সৃষ্টি হয়। তবে যদি কাপড় বাঁধা থাকে কিংবা বোতাম লাগানো থাকে, কাপড় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা না থাকে, মুছল্লীকে ছালাতে ব্যস্ত না রাখে এবং খুশূ‘-একাগ্রতা ও বিনয়ী অর্জনের পরিপন্থী না হয় তাহলে সমস্যা নেই।

আর বর্তমানে আমরা আফ্রিকা বা তার আশেপাশের মানুষদেরকে এমন ধরনের পোশাক পরিধান করতে দেখি, যার কারণে তারা ছালাতে তাদের  কাপড়কে ঠিক করাতেই অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকে। যদি তাদের কাপড় শরীর থেকে পড়ে যায়, তাহলে তা উঠিয়ে নেয় আবার কাপড় ছুটে গেলে তা মিলিয়ে নেয়, যার কারণে তাদের ছালাতে মনোযোগ অবশিষ্ট থাকে না। তাই আমাদেরকে এর থেকে সতর্ক ও সাবধান থাকা একান্ত উচিত। আর ছালাতে মুখ ঢেকে রাখতে নিষেধ করার কারণ সম্পর্কে আলেমগণ বলেন, ‘ছালাতরত অবস্থায় মুখ ঢেকে রাখলে তা সুন্দরভাবে কুরআন তিলাওয়াত এবং পরিপূর্ণরূপে সিজদা করা হতে বাধা প্রদান করে’।

৩৩). চতুষ্পদ জন্তুর সাথে সাদৃশ্যতা অবলম্বন করা হতে বিরত থাকা।

আল্লাহ তা‘আলা আদম সন্তানকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেছেন এবং তাকে উত্তম আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং একজন ব্যক্তির জন্য তার নিজের আকৃতি ছেড়ে দিয়ে কোন জন্তুর আকৃতি ধারণ করা খুবই অন্যায় এবং দোষনীয় কাজ। আমাদেরকে ছালাতে চতুষ্পদ জন্তুর আকৃতির সাদৃশ্য গ্রহণ করতে এবং ছালাতে তাদের ন্যায় নড়াচড়া ও ওঠাবসা করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা ইহা ছালাতে একাগ্রতা ও খুশূ‘-খুযূ‘ আনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। আর একজন মুছল্লির জন্য খারাপ ও বিকৃত আকৃতি ধারণ করা বেমানান, যা মুছল্লির জন্য সমীচীন নয়। এ ব্যাপারে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে,

نَهَى رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الصَّلَاةِ عَنْ ثَلَاثٍ عَنْ نَقْرِ الْغُرَابِ وَافْتِرَاشِ السَّبُعِ وَأَنْ يُوَطِّنَ الرَّجُلُ الْمَقَام الْوَاحِد كَإِيْطَانِ الْبَعِيْرِ.

‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছালাতে তিনটি জিনিস করতে নিষেধ করেছেন। যথা : কাকের ন্যায় ঠোকরানো, হিং¯্র জন্তুর ন্যায় বিস্তৃত হয়ে বসা এবং উটের ন্যায় কোন একটি স্থানকে ছালাত আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট করে নেয়া’।[১৪] অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, نَهَانِيْ عَنْ نَقْرَةٍ كَنَقْرَةِ الدِّيْكِ وَإِقْعَاءٍ كَإِقْعَاءِ الْكَلْبِ وَالْتِفَاتٍ كَاِلْتِفَاتِ الثَّعْلَبِ ‘নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে মোরগের ঠোকরের ন্যায় ঠোকর দেয়া হতে, কুকুরের বসার ন্যায় পা তুলে বসা হতে এবং শিয়ালের ন্যায় এদিক সেদিক তাকানো হতে নিষেধ করেছেন’।[১৫]

উপরে যে বিষয়গুলো এতক্ষণ পর্যন্ত আলোচনা করা হল সেগুলো ছালাতে খুশূ‘-একাগ্রতা ও মনোযোগ আনার উপায়-মাধ্যম। যেগুলোর দ্বারা ছালাতে খুশূ‘-একাগ্রতা ও মনোযোগ আনয়ন সহজ হয়। সাথে সাথে যে বিষয়গুলো ছালাতে খুশূ‘-একাগ্রতা ও মনোযোগ বিনষ্ট করে সেগুলো থেকে বেঁচে থাকাও সম্ভবপর হয়।

আলেমদের নিকটে ছালাতে একাগ্রতা, খুশূ‘-খুযূ‘ এর বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাপূর্ণ হওয়ার কারণে তারা নিম্নোল্লিখিত বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ও মতামত ব্যক্ত করেছেন।

মাসআলা : কোন মুছল্লির ছালাতে ওয়াসওয়াসার পরিমাণ বেশী হলে তার ছালাত ছহীহ হবে, না-কি তাকে পুনরায় ছালাত ফিরিয়ে পড়তে হবে?

ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যদি জিজ্ঞেস করা হয়, যে মুছল্লীর ছালাতে খুশূ‘-একাগ্রতা থাকে না, তার ছালাত সম্পর্কে তোমাদের মতামত কী? তার ছালাত সঠিক বলে গণ্য হবে, না-কি হবে না?

তাহলে উত্তরে বলা হবে, প্রতিদানের দিক দিয়ে তার ছালাত গণ্য করা হবে না, তবে ততটুকু গণ্য করা হবে যতটুকু সে বুঝে বুঝে আদায় করেছে এবং ছালাতে আল্লাহকে ভয় করে এবং তাকে স্মরণ করে ছালাত আদায় করেছে। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, لَيْسَ لَك مِنْ صَلَاتِك إلَّا مَا عَقَلْت مِنْهَا ‘তুমি তোমার আদায়কৃত ছালাতের ততটুকুরই অধিকারী হবে, যতটুকু তুমি বুঝে-বুঝে মনোযোগ দিয়ে আদায় করবে’।[১৬] মুসনাদে একটি মারফূ’ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

إِنَّ الْعَبْدَ لَيُصَلِّي الصَّلَاةَ وَلَمْ يُكْتَبْ لَهُ إِلَّا نِصْفُهَا أَوْ ثُلْثُهَا أَوْ رُبْعُهَا حَتَّى بَلَغَ عُشْرَهَا.

‘নিশ্চয় একজন বান্দা যখন ছালাত আদায় করে, তখন সে তার ছালাতের পূর্ণ ছওয়াব পায় না বরং সে অর্ধেক, এক তৃতীয়াংশ, এক চতুর্থাংশ, এমনকি এক দশমাংশ পর্যন্ত কম ছওয়াব পায়’।[১৭]

মহান আল্লাহ তা‘আলা ছালাতে মুছল্লিদের সফলতাকে ছালাতের মধ্যকার একাগ্রতা, খুশূ‘-খুযূ‘-এর সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তির ছালাতে একাগ্রতা, খুশূ‘-খুযূ‘ থাকে না সে ব্যক্তি সফলতা অর্জন করতে পারে না এবং সে সফল ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত নয়। কেননা যদি ছালাতে একাগ্রতা, খুশূ‘-খুযূ‘ না থাকাতেই ছওয়াব গণ্য করা হত, তাহলে তারা সফল ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত হত।

আর দুনিয়াবী আহকাম অনুযায়ী যদি ছালাতে অধিকাংশ সময়েই একাগ্রতা, খুশু’-খুযূ’ থাকে এবং মুছল্লী বুঝে-বুঝে ছালাত আদায় করে, তাহলে ঐকমত্যে তার ছালাত সঠিক বলে গণ্য হবে। আর ছালাতের পরে হাদীছে বর্ণিত যিকর ও দু‘আ সমূহ পড়া, যাতে করে ছালাতের মধ্যকার দুর্বল বিষয়গুলো এগুলো পড়ার দ্বারা পরিপূর্ণ হয় এবং সেগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ হয়ে যায়।

আর যদি ছালাতে অধিকাংশ সময়ই একাগ্রতা, খুশূ‘-খুযূ‘ না থাকে এবং ছালাত বুঝে-বুঝে, মনোযোগ সহকারে আদায় না করে, তাহলে তার ছালাত পুনরায় আদায় করা আবশ্যক হওয়া নিয়ে ফক্বীহদের মাঝে মতবিরোধ বিদ্যমান। ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর একজন সাথী ইবনু হামিদ এর মতে পুনরায় ছালাত আদায় করা আবশ্যক হবে। এছাড়াও ছালাতে একাগ্রতা, খুশূ‘-খুযূ‘-এর বিধান সম্পর্কেও ফক্বীহদের মাঝে মতবিরোধ বিদ্যমান। এ ক্ষেত্রে দু’টি মতই ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) এবং তার অনুসারীদর থেকে পাওয়া যায়।

দু’টি মতামত অনুযায়ী সারকথা হল- যদি ছালাতে মুছল্লির একাগ্রতা, খুশূ‘-খুযূ‘ এর পরিবর্তে ওয়াওয়াসার পরিমাণ বেশী হয়, তাহলে তার ছালাত পুনরায় পড়তে হবে কি-না এ ব্যাপারে ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর অনুসারী ইবনু হামিদ বলেছেন, তাকে ছালাত পুনরায় পড়া আবশ্যক। কিন্তু অধিকাংশ ফক্বীহর মতানুযায়ী পড়তে হবে না। তারা এ ক্ষেত্রে দলীল হিসাবে উল্লেখ করেছেন যে, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছালাতে ভুলকারীকে দু’টি সাহু সিজদা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন কিন্তু তাকে পুনরায় ছালাত আদায় করার নির্দেশ দেননি। যেমন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

إِنَّ الشَّيْطَانَ يَأْتِي أَحَدَكُمْ فِيْ صَلَاتِهِ فَيَقُوْلُ اذْكُرْ كَذَا اذْكُرْ كَذَا لِمَا لَمْ يَكُنْ يَذْكُرُ حَتَّى يَضِلَّ الرَّجُلُ أَنْ يَدْرِيَ كَمْ صَلَّى.

‘নিশ্চয় শয়তান ছালাতরত অবস্থায় তোমাদের কাছে আসে এবং বলে তুমি এ কথা স্মরণ কর, তুমি এ কথা স্মরণ কর, মুছল্লির ভুলে যাওয়া বিষয়গুলো সে স্মরণ করিয়ে দেয়। ফলে মুছল্লী ছালাতে বিভ্রান্তিতে পতিত হয় এবং সে কত রাক‘আত ছালাত আদায় করেছে সে ভুলে যায়’।[১৮] তবে এভাবে ছালাত আদায় করাতে কোন ছওয়াব নেই বরং তার যতটুকু একাগ্রতা, খুশূ‘-খুযূ‘ এবং মনোযোগ থাকবে সে ততটুকুই ছওয়াব পাবে। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

إِنَّ الْعَبْدَ لِيَنْصَرِفُ مِنَ الصَّلَاةِ وَلَمْ يُكْتَبْ لَهُ إِلَّا نِصْفُهَا ثُلْثُهَا رُبْعُهَا حَتَّى بَلَغَ عُشْرَهَا.

‘নিশ্চয় একজন বান্দা যখন ছালাত আদায় করে ফিরে, তখন সে তার ছালাতের পূর্ণ ছওয়াব পায় না বরং সে অর্ধেক, এক তৃতীয়াংশ, এক চতুর্থাংশ, এমনকি এক দশমাংশ পর্যন্ত কম ছওয়াব নিয়ে ফিরে যায়’।[১৯] আর ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, لَيْسَ لَكَ مِنْ صَلَاتِكَ إلَّا مَا عَقَلْتَ مِنْهَا ‘তুমি তোমার আদায়কৃত ছালাতের ততটুকুরই অধিকারী হবে যতটুকু তুমি বুঝে-বুঝে মনোযোগ দিয়ে আদায় করবে’।[২০] যদিও এ ধরনের ছালাতকে এ দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক বলা যায় যে, শরী‘আত এ ধরনের ছালাতকে পুনরায় ফিরিয়ে পড়তে বলেনি। তবে ছালাতের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের দিক পর্যালোচনা করলে ছালাতকে সঠিক বলা যায় না। আর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

إِذَا أَذَّنَ الْمُؤَذِّنُ بِالصَّلَاةِ أَدْبَرَ الشَّيْطَانُ وَلَهُ ضُرَاطٌ حَتَّى لَا يَسْمَعَ التَّأْذِيْنَ فَإِذَا قَضَى التَّأْذِيْنَ أَقْبَلَ فَإِذَا ثُوِّبَ بِالصَّلَاةِ أَدْبَرَ فَإِذَا قَضَى التَّثْوِيْبَ أَقْبَلَ حَتَّى يَخْطُرَ بَيْنَ الْمَرْءِ وَنَفْسِهِ يَقُولُ اذْكُرْ كَذَا اذْكُرْ كَذَا مَا لَمْ يَكُنْ يَذْكُرُ حَتَّى يَظَلَّ لَا يَدْرِىْ كَمْ صَلَّى فَإِذَا وَجَدَ أَحَدُكُمْ ذَلِكَ فَلْيَسْجُدْ سَجْدَتَيْنِ وَهُوَ جَالِسٌ.

‘যখন ছালাতের জন্য আযান দেয়া হয়, তখন শয়তান পিঠ ফিরিয়ে পালায় যাতে করে আযান শুনতে না পায় আর তার পশ্চাদ-বায়ূ সশব্দে নির্গত হতে থাকে। আযান শেষ হয়ে গেলে এগিয়ে আসে। আবার ছালাতের জন্য ইক্বামত দেয়া হলে সে পিঠ ফিরিয়ে পালায়। ইক্বামত শেষ হয়ে গেলে আবার ফিরে আসে। এমনকি সে ছালাত আদায়রত ব্যক্তির মনে ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি করে এবং বলতে থাকে, অমুক অমুক বিষয় স্মরণ কর, যা তার স্মরণে ছিল না। এভাবে সে ব্যক্তি কত রাক‘আত ছালাত আদায় করেছে তা স্মরণ করতে পারে না। তাই তোমাদের কেউ এরূপ অবস্থায় পড়লে (শেষ বৈঠকে) বসা অবস্থায় সে যেন দু’টি সিজদা করে’।[২১]

ফক্বীহগণ বলেন, উপরে যে ব্যক্তির ছালাত আদায়ের ধরন বর্ণনা করা হল তার ছালাত এমন ধরনের ছালাত, যাতে শয়তান তাকে অমনোযোগী করে ফেলেছে, এমনকি সে জানে না সে কত রাক‘আত ছালাত আদায় করেছে। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে দু’টি সাহু সিজদা দিতে বলেছেন, তাকে পুনরায় ছালাত ফিরিয়ে আদায় করতে বলেননি। আর যদি তার ছালাত বাতিলই হয়ে যেত, যেমনটি তোমরা ধারণা করছ এবং বলছ তাহলে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে পুনরায় ছালাত ফিরিয়ে আদায় করতে বলতেন।

ফক্বীহগণ আরও বলেছেন যে, এটাই সাহু সিজদার আসল রহস্য ও উদ্দেশ্য। বান্দাকে ছালাতে শয়তান কর্তৃক ওয়াসওয়াসা দেয়া এবং বান্দা ও ছালাতের মাঝে মনোযোগী হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা প্রদানের জন্য এটা শয়তানের জন্য লাঞ্ছনা অপমানজনক বিষয়। এজন্যই নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহু সিজদাকে ‘মুরগামাতায়ন’ তথা নাক মাটির সাথে মেশানো অপসন্দনীয় কাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

আর যদি তোমরা ছালাতকে পুনরায় ফিরিয়ে পড়তেই চাও এবং ছালাতের প্রকৃত ফলাফল, উপকার ও প্রতিদান নিতেই চাও, তাহলে এটা জেনে রাখা দরকার যে, এগুলো বিষয় বান্দার জন্য ইচ্ছাধীন। সে ইচ্ছা করলে তার পূর্ণ প্রতিদান অর্জন করতে পারে কিংবা সে চাইলে ছেড়েও দিতে পারে। আর যদি পুনরায় ছালাত আদায়ের দ্বারা তোমরা এমন উদ্দেশ্য গ্রহণ কর যে, তোমরা এ ধরনের ছালাত আদায়কারীকে পুনরায় ছালাত আদায় করাতে বাধ্য করবে, কিংবা ছালাতে একাগ্রতা, খুশূ‘-খুযূ‘ না থাকার কারণে তাকে শাস্তি দিবে এবং তাদের উপর ছালাত পরিত্যাগকারীর বিধান আরোপ করবে, তাহলে আমরা তোমাদের সাথে একমত নই। আর এটাই সর্বজন গ্রাহ্য ও সর্বাধিক গ্রহণীয় মতামত। আল্লাহ তা‘আলা অধিক অবগত।

শেষ কথা

ছালাতে একাগ্রতা, খুশূ‘-খুযূ‘ এর বিষয়টি খুবই বড়, মর্যাদাময় এবং গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। এটা ঐ মুছল্লির পক্ষেই সম্ভব হয় যাকে আল্লাহ তা‘আলা তাওফীক্ব দান করেন। ছালাতে খুশূ‘-খুযূ‘ ও একাগ্রতা না থাকা খুবই মারাত্মক ও বিপজ্জনক বিষয়। এজন্যই নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু‘আ পড়ার সময় বলতেন,

اَللّٰهُمَّ إِنِّىْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ قَلْبٍ لَا يَخْشَعُ وَدُعَاءٍ لَا يُسْمَعُ وَمِنْ نَفْسٍ لَا تَشْبَعُ وَمِنْ عِلْمٍ لَا يَنْفَعُ

‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি এমন মন হতে, যা আপনার ভয়ে ভীত হয় না। এমন দু‘আ হতে, যা শুনা হয় না (প্রত্যাখ্যান করা হয়), এমন আত্মা হতে, যা পরিতৃপ্ত হয় না এবং এমন জ্ঞান হতে, যা উপকারে আসে না’।[২২]

ছালাতে খুশূ‘-খুযূ‘ আনয়নকারীদের অনেক স্তর রয়েছে। মূলত খুশূ‘-খুযূ‘-এর বিষয়টি মানুষের অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত কাজ। তা কখনও বৃদ্ধি পায় আবার কখনও কমে যায়। এমনকি কারও কারও খুশূ‘-খুযূ‘ আসমান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আবার এমন অনেক ব্যক্তি আছে যারা ছালাত শেষ করে বের হয়ে আসে কিন্তু ছালাতের কোন কিছুই তাদের বোধগম্য হয় না অর্থাৎ, ছালাতে মনোযোগ না থাকার কারণে ছালাত সম্পর্কে কিছুই বলতে পারে না।

ছালাতে মুছল্লী পাঁচ স্তরে বিভক্ত। যথা:

এক : ঐ মুছল্লী, যে তার নিজের আত্মার উপর মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচার করেছে। সে ছালাতের জন্য উত্তমরূপে ওযূ করেনি। নির্ধারিত সময়ে ছালাত আদায় করেনি এবং ছালাতের ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত ও আরকানগুলো ঠিকমত আদায় করেনি।

দুই : ঐ মুছল্লী, যে নির্ধারিত সময়ে ছালাত আদায় করেছে। ছালাতের ফরয, ওয়াজিব এবং বাহ্যিক আরকানগুলো ঠিকঠাক আদায় করেছে এবং উত্তমরূপে ওযূ করেছে। কিন্তু সে শয়তানের ওয়াসওয়াসার কবলে পড়ে তার আত্মিক প্রচেষ্টাকে নষ্ট করে ফেলেছে। যার ফলে শয়তানী ওয়াসওয়াসা এবং চিন্তাভবনা করার সাথে সাথে তার সব কিছু হারিয়ে গেছে।

তিন : ঐ মুছল্লী, যে ছালাতের ফরয, ওয়াজিব এবং বাহ্যিক আরকানগুলো ঠিকঠাক আদায় করেছে। শয়তানের ওয়াসওয়াসা ও তার চিন্তাভাবনাকে প্রতিহত করার জন্য আত্মিক প্রচেষ্টাও করেছে। এ মুছল্লী তার ছালাতে সার্বক্ষণিক তার শত্রু শয়তানের সাথে মোকাবেলায় ব্যস্ত; যাতে করে শয়তান তার ছালাত থেকে কোন কিছু চুরি করতে (ছিনিয়ে নিতে) না পারে। এই মুছল্লী একই সাথে ছালাতেও রয়েছে এবং শয়তানের মোকাবেলায় জিহাদে নিয়োজিত রয়েছে।

চার : ঐ মুছল্লী, যখন সে ছালাতে দ-ায়মান হয়, তখন ছালাতের হক্ব, আরকান এবং ফরয-ওয়াজিবসমূহ পরিপূর্ণভাবে আদায় করে। ছালাতের ফরয-ওয়াজিব বিষয়াবলী ও হক্বসমূহ আদায়ে তার অন্তর নিমগ্ন থাকে। যাতে করে তার ছালাতের কিছু অংশ ছুটে না যায় এবং নষ্ট না হয়। বরং তার উদ্দেশ্য এরূপ থাকে যে, সে সর্বদা তার ছালাতকে সাধ্যানুযায়ী পূর্ণ করবে এবং সুন্দরভাবে ছালাত আদায় করবে। মূলত আল্লাহর ইবাদতের গুরুত্ব ও ছালাতের মাহাত্ম্য তার অন্তরকে ছালাতের মধ্যে নিমজ্জিত করেছে।

পাঁচ : ঐ মুছল্লী, যে পূর্বোল্লিখিত মুছল্লির ন্যায় ছালাতে দ-ায়মান হয়; কিন্তু এর সাথে সাথে তার অন্তরের অবস্থা এবং তার মহান প্রভু আল্লাহর সামনে তার দণ্ডায়মান হওয়ার অবস্থা এরূপ যে, যেন সে তার অন্তর দ্বারা আল্লাহকে দেখছে এবং মহান আল্লাহ তা‘আলাও তাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। আল্লাহর ভালবাসা, বড়ত্ব ও মহত্ব দ্বারা তার অন্তর পূর্ণ থাকে এবং সে মনে করতে থাকে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে দেখছেন ও প্রত্যক্ষ করছেন। তার নিকট থেকে শয়তানী ওয়াসওয়াসা ও বিপদ-আশঙ্কা সবকিছু উধাও ও অদৃশ্য হয়ে যায়। তার মাঝে এবং তার প্রতিপালক মহান আল্লাহর মাঝে কোন প্রতিবন্ধক পর্দা অবশিষ্ট থাকে বরং সব দূর হয়ে যায়। এভাবে ছালাত আদায়কারী মুছল্লী এবং সাধারণভাবে ছালাত আদায়কারী মুছল্লির মাঝে আসমান ও যমীনের মাঝে যে ব্যবধান-দূরত্ব রয়েছে তার চেয়েও অনেক বেশী ব্যবধান রয়েছে। এই মুছল্লী ছালাতে তার মহান প্রতিপালকের সাথে ব্যস্ত এবং মহান আল্লাহর সান্নিধ্য ও দর্শনে সে পরিতৃপ্ত ও সন্তুষ্ট।

উল্লিখিত ছালাত আদায়কারীদের স্তর হতে প্রথম স্তরের মুছল্লীগণ পাপী। তাই তারা শাস্তির আওতাভুক্ত হবে। দ্বিতীয় স্তরের মুছল্লীগণ তার ছালাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হবে। তৃতীয় স্তরের মুছল্লীগণকে তাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। চতুর্থ স্তরের মুছল্লীগণ সুন্দরভাবে ছালাত আদায়ের জন্য ছওয়াব পাবে। পঞ্চম স্তরের মুছল্লীগণ তাদের মহান প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্যপ্রাপ্ত এবং মহান আল্লাহর সবচেয়ে কাছের বান্দা। কেননা তার জন্য ছালাতে চক্ষু সিক্ততা পরিতৃপ্তির একটি অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। সুতরাং যে মুছল্লির দুনিয়াতে ছালাতের দ্বারা চক্ষু সিক্ত হবে এবং আখেরাতে মহান প্রভুর নৈকট্য লাভের মাধ্যমে তার চক্ষু সিক্ত হবে, সে সফলকাম হবে। আবার সে দুনিয়াতেও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যমে পরিতৃপ্ত ও সন্তুষ্ট হবে। আর যার চক্ষু মহান প্রভুর নৈকট্য দ্বারা সিক্ত হবে তার সমস্ত চক্ষুই প্রশান্তি লাভ করবে। আর যার চক্ষু মহান প্রভুর নৈকট্য অর্জন করতে অপারগ হবে, তার মন দুনিয়াতেই বিষণœতায় পূর্ণ হবে এবং ফলস্বরূপ সে আফসোস ও পরিতাপে ভেঙ্গে পড়বে।[২৩]

পরিশেষে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে ছালাতে খুশূ‘-খুযূ‘ ও একাগ্রতা অবলম্বনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং আমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দেন। এই বইটি লিখতে যিনি অবদান রেখেছেন তাকে যেন আল্লাহ তা‘আলা উত্তম প্রতিদান দান করেন । যারা বইটি পড়বে তাদেরকে যেন তিনি বইটি পড়ার দ্বারা উপকৃত করেন। আমীন! সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য।



* অধ্যয়নরত, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।

তথ্যসূত্র : 
[১]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৫৬৯; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘, হা/৭৬২।
[২]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪২৯।
[৩]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১২০৮৪; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘, হা/৫৫৭৪।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৯৭।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৪১৬, ফাৎহুল বারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫১২।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৪১৭, ফাৎহুল বারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫১৩।
[৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৯৫।
[৮]. আবূ  দাঊদ, হা/৯৪৭।
[৯]. আবূ দাঊদ, হা/৯০৩; মুসানদে আহমাদ, ২/১০৬।
[১০]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/৩৩৮০।
[১১]. আবূ দাঊদ, হা/৬৪৩; ছহীহুল জামে‘, হা/৬৮৮৩।
[১২]. ‘আউনুল মা‘বূদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৭।
[১৩]. মিরক্বাতুল মাফাতীহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩৬।
[১৪]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫৫৭২।
[১৫]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৮০৯১; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৫৫৫।
[১৬]. শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৩১।
[১৭]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৯১৪, সনদ ছহীহ।
[১৮]. আবূ দাঊদ, হা/৫১৬, সনদ ছহীহ।
[১৯]. তাফসীরুল ইবনিল ক্বাইয়িম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৬।
[২০]. শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৩১।
[২১]. ছহীহ বুখারী, হা/১২২২, ১২৩১।
[২২]. তিরমিযী, হা/৩৪৮২; ছহীহ সুনান তিরমিযী, হা/২৭৬৯।
[২৩]. আল ওয়াবিলুছ ছায়্যিব, পৃ. ৪০।




প্রসঙ্গসমূহ »: ছালাত
কুরবানীর মাসায়েল - আল-ইখলাছ ডেস্ক
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম (৫ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
মুসলিম বিভক্তির কারণ ও প্রতিকার (২য় কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলনীতি (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
সন্ত্রাসবাদ : ইসলামের দিকে শ্যেনদৃষ্টি - অধ্যাপক মো. আকবার হোসেন
ফাযায়েলে কুরআন (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
সুন্নাতের রূপরেখা (শেষ কিস্তি) - মাইনুল ইসলাম মঈন
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
আল-কুরআনের আলোকে দাওয়াতের মাধ্যম - আব্দুল গাফফার মাদানী
দু‘আ ও যিকর : আল্লাহর অনুগ্রহ ও প্রশান্তি লাভের মাধ্যম (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩টি উপায় (শেষ কিস্তি) - আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ
অহংকার করা ও তার পরিণাম - ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর

ফেসবুক পেজ